শাহনাজ মুন্নী'র গল্প : উনার নাম আলাউদ্দিন

আলাউদ্দিন জীবিত না মৃত সেটাই এখন নগরবাসীর সামনে সবচে বড় প্রশ্ন। শুধু বড় নয় বরং ঝুলন্ত ও জ্বলন্ত একটি প্রশ্ন। একেবারে গ্যাস, ডিজেল বা পেট্রোলের আগুনের মতো দাউ দাউ করা জ্বলে উঠে, বাঁকা হয়ে ঝুলে থাকা বিরাট প্রশ্ন এটি। দগদগে ঘা-এর মতো প্রশ্নটা একটু একটু করে নগরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছিল, আর পুরো নগর জুড়ে সংক্রমণ, যন্ত্রণা ও বেদনা বাড়াচ্ছিল।

প্রশ্নটি ধীরে ধীরে আরো প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছিলো, যেমন- ‘আলাউদ্দিন কি আছে? নাকি, নাই? নাই? নাকি, আছে? থাকলে কোথায় আছে? কেমন আছে? না থাকলে কেন নাই? কিভাবে নাই? সর্বশেষ তাকে কোথায় দেখা গিয়েছিল? কে তাকে দেখেছিল? কোথায় দেখেছিল? কিভাবে দেখেছিল? 

বাতাসে নানা রকম উত্তর ভেসে বেড়ায়। কেউ কেউ বলে, আলাউদ্দিনকে নাকি সব শেষ দেখা গিয়েছিল টঙ্গীর চেরাগ আলী মার্কেটে একটা অভিজাত জুতার দোকানে। তার সঙ্গে ছিল, অতীব সুন্দরী অল্পবয়সী একটা মেয়ে। মেয়েটা সিন্ডারেলার মতো একটা স্ফটিক স্বচ্ছ উচ্চ হীলের জুতা খুঁজছিলো। তাক থেকে দোকানী একের পর এক জুতা নামিয়ে দিচ্ছিলো, আর মেয়েটা বার বারই মাথা নাড়ছিল। 

কেউ বলে, আলাউদ্দিনকে সব শেষ দেখা গিয়েছিল. চকবাজারে। আমদানি করা খেলনা বেচার পাইকারি দোকানে। আলাউদ্দিন সেখানে একটা খেলনা পিস্তল কিনতে চাইছিল, এমন পিস্তল যা দেখতে হবে অবিকল সত্যিকারের পিস্তলের মতো, কিন্তু যা দিয়ে সত্যিকারের গুলি বের হয় না।

আসলে, আলাউদ্দিন শেষ বার কোথায় ছিল তা একটা ধাঁধা বটে। একজন লোক তো একই সঙ্গে চকবাজার ও টঙ্গীতে থাকতে পারে না, নগরবাসীর মনে এখন প্রশ্ন, প্রকৃত পক্ষে সে কোথায় ছিল? 

আলাউদ্দিন শেষ কথা-ই বা বলেছিল কার সাথে? আলাউদ্দিনের স্ত্রী রুবিনা দাবি করে, আলাউদ্দিনের সাথে শেষ কথা হয়েছিল তারই। রুবিনা জানায়, আলাউদ্দিন টেলিফোনে তাকে বলেছিল, আজ রাতে সে বাড়িতে ডিনার করবে। রুবিনাকে সে বলেছিল, ‘বাঁশমতি চালের ভাত রাধো, সঙ্গে টাকি মাছের ভর্তা, চিংড়ি চচ্চড়ি, কাঁচকি মাছ আর চিকেন ঝাল ফ্রাই।’ রুবিনা সেসব তো রেঁধেছিলোই সঙ্গে কাঁচা আম দিয়ে মুসুরীর ডাল ও রেঁধেছিলো, আলাউদ্দিনকে চমকে দেবে বলে। কিন্তু হায়, সেসব খাবার টেবিলেই পড়ে রয়েছে। আলাউদ্দিন আসে নাই। 

আবার আলাউদ্দিনের বোন সুরাইয়া জানায় নিখোঁজ হওয়ার আগ্ মুহুর্তে নাকি তার সাথেই টেলিফোনে কথা বলছিলো আলাউদ্দিন। ফোনটি করেছিলো সুরাইয়া, নিজেই, মুন্সীগঞ্জ থেকে। সে তার বড় ভাই আলাউদ্দিনের সঙ্গে নিজের মেজ ছেলে অর্থাৎ আলাউদ্দিনের মেজ ভাগিনা সাবেরের বিষয়ে আলাপ করছিলো। সাবের সম্প্রতি এলাকার চেয়ারম্যানের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বড় কন্যার সাথে প্রেম-ভালবাসায় জড়িয়ে পড়েছিল। সুরাইয়া ভাইয়ের কাছে পরামর্শ চাইছিল কিভাবে সাবেরের সাম্প্রতিক প্রেম-ভালবাসাজনিত কেলেংকারি সামাল দেওয়া যায়, সে বিষয়ে। 

আলাউদ্দিন বোনকে বলছিলো, ‘আরে, আমি নিজেই আছি নানা ঝামেলার মধ্যে, এর মধ্যে তুই শুরু করলি তোর পোলার প্যাঁচাল।’ 

‘কি করুম ভাইজান, তুমি ছাড়া আমার আর বুদ্ধি পরামর্শ নেওয়ার মতো কে আছে, কও।’ 

বোনের এই কথায় একটু নরম হয়েছিল আলাউদ্দিন। সে বলেছিল, ‘আইচ্ছা, দাঁড়া, আমারে একটু চিন্তা করতে দে ..’

সেই সময়ই, ঠিক সেই সময়টাতে ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে সুরাইয়া শুনেছিল কলিং বেলের আওয়াজ। আলাউদ্দিনও শুনেছিল সেই শব্দ। সে তার বোনকে ‘একটু ধর’ বলে হয়তো দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, অন্তত পায়ের শব্দ শুনে তেমনটাই আন্দাজ করেছিল সুরাইয়া। দরজা খোলার একটা ক্যাঁচম্যাঁচ আওয়াজ’ও পেয়েছিল সে। তারপর ফোনের ভেতর দিয়েই অস্পষ্টভাবে তার কানে এসেছিল আলাউদ্দিনের কন্ঠস্বর, ‘কারা আপনারা?’ 

আগন্তকদের কাছ থেকে কি উত্তর এসেছিল শুনতে পায়নি সুরাইয়া। শুধু আলাউদ্দিন ওই পাশ থেকে ফোনটা কানে উঠিয়ে বলেছিল, ‘তোর সাথে পরে কথা বলবো’রে সুরি। এখন রাখ।’

ফোনটা এর পর পরই কেটে যায়। সুরি আর তার ভাইয়ের কন্ঠস্বর শুনতে পায় নাই। 

তাহলে, কেউ কি আলাউদ্দিন’কে ধরে নিয়ে গেছে? নাকি সে কোথাও পালিয়ে গেছে? নাকি হারিয়ে গেছে? আসলে, কি হয়েছে আলাউদ্দিনের? 

এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে সব ধরনের চেষ্টাই চলে। কিন্তু সত্যি বলতে কি কোন উত্তর মেলে না। রুবিনা যাদের কাছে গেছে, তারা মুখ বিকৃত করে বলেছে ‘এত সব প্রশ্নের উত্তর জানা নাই। এ বিষয়ে কোন তথ্য’ও নাই আমাদের কাছে। দয়া করে অবান্তর প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না।’ 

শেষ পর্যন্ত আত্মীয় স্বজন সবাই মিলে গেছে পীর-ফকিরের কাছে। গিয়ে বলেছে, ‘হুজুর, আলাউদ্দিনের খবর চাই। অনুগ্রহ করে বলেন, সে কোথায় আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে?’

পীর ফকিরদের কেউ বলে, ‘বেঁচে আছে, আগামী বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে সে ঠিক ফিরে আসবে।’

কেউ বলে, ‘নাই, আলাউদ্দিন জীবিত নাই। ওকে মেরে সন্ধ্যা নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে, তার মৃতদেহ ভেসে গেছে সমুদ্রে। সামুদ্রিক প্রাণীর খাদ্য হয়েছে সে। ওর আশা ছেড়ে দে।’ 

কেউ আবার দেয় তাবিজ, কবচ, পানি পড়া। বলে, তিন পথের মাথায় যে বটগাছ, অমাবস্যার রাতে সেই বটগাছের ডালে রুবিনাকে একা গিয়ে তাবিজ বেঁধে আসতে হবে। বাতাসে তাবিজ নড়বে আর আলাউদ্দিনের মনে পড়বে তার স্ত্রীর কথা, তার বোনের কথা, দেশের কথা, পরিবারের কথা, মনে পড়বে ফিরে আসার কথা ...’

‘কেন হুজুর? এখন কি তার আমাদের কথা মনে নাই?’

হুজুর বলে, ‘না, সে স্মৃতি ভ্রষ্ট হইছে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সব ভুলে গেছে। বাপ-মার নাম ভুলছে, এমনকি বউ বাচ্চা, ভাই-বোন কারো কথা তার মনে নাই।’

হুজুরের কথা শুনে সবাই যখন ‘হায়’ ‘হায়’ করছে, তখন রুবিনার এক চাচা শশ্বুর পাগলা বাবার খবর নিয়ে এলো। পাগলা বাবা খুবই কামেল ব্যক্তি। তার পোষা জ্বিন আছে। যখন তখন তিনি সেই জ্বিন নামাতে পারেন। জ্বিন সবরকম গায়েবানা-অগায়েবানা প্রশ্নের জবাব দিতে পারে। জ্বিন অবশ্যই খোঁজ দিতে পারবে নিখোঁজ আলাউদ্দিনের। 

আবার সবাই মিলে ছুটলো ঝাঁলকুড়ি বাজারে পাগলা বাবার দরবারে।

বাবা নিজের উপরেই জ্বিন নামালেন, অর্থাৎ জ্বিন এসে ভর করলো বাবার দেহে।

‘জ্বিন বাবা, বলেন আলাউদ্দিন কই? সে কি আছে? নাকি নাই?’ 

পাগলা বাবার গলায় ইঁদুরের কিচমিচ শব্দ শোনা যায়। কিচ্ মিচ্ করেই জ্বিন বাবা জানান দেয়, 

‘আলাউদ্দিন আছে। বাঁইচ্যাই আছে। তবে পায়ে গুলি লাগছে তার। এখন পায়ের এলোপ্যাথি চিকিৎসা চলতেছে। ক্ষত ভাল হইলেই আলাউদ্দিনকে ওরা ফিরায়া দিয়া যাবে। চিন্তার কিছু নাই।’ 

আলাউদ্দিনের বউ পড়লো মহা সমস্যায়, অপেক্ষা আর প্রতীক্ষায় তার দিন কাটে। 

মাঝে হঠাৎ খবর আসে কুড়িগ্রামের রৌমারির চর এলাকা চাতলকান্দিতে নাকি আলাউদ্দিনকে অথবা তার মতো একই চেহারার একজন আগন্তককে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে। এই খবরে চারপাশে তোলপাড় পড়ে যায়। রুবিনাও উদগ্রীব হয়ে স্বামীর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করে। কিন্তু কোথায় কি? রাত পেরিয়ে সকাল হলে জানা যায় ওটি ছিল ভূয়া খবর। হায়, কে এসব ভূয়া খবর ছড়ায়? তারা কি জানে না এসব খবর হারানো মানুষটার, কাছের মানুষের মনের ভেতর কেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে ! 

একদিন আলাউদ্দিনের বউ রুবিনার সঙ্গে দেখা করতে আসে আরেক না-বিধবা, না-সধবা সাজেদা বেগম। তার স্বামী আবদুর রশিদ, আলাউদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার দশ মাস আগে থেকেই নিখোঁজ। কদিন আগে আবদুর রশিদের নিখোঁজ হওয়ার এক বছর পূর্তি হয়েছে। বুকে কান্না চেপে রুবিনার সামনে এসে বসে থাকে সাজেদা। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? আসে সানাউল্লাহ’র না-বিধবা, না-সধবা বউ বিথি। রুবিনা আর সাজেদার পাশে এসে চুপ-চাপ বসে থাকে সে-ও।

‘তোমাদের স্বামীরা নিশ্চয়ই আত্মগোপনে আছে। সময় হলে ঠিকই আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে আসবে।’

পাড়া-পড়শিরা তাদের বলে যায়।

অনেকে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, কেউ কি মুক্তি পণ চেয়ে ফোন টোন করেছিল? অনেক সময় এমন তো হয়, কিডন্যাপার-রা টাকা পয়সার জন্য অপহরণ করে, আবার টাকা পয়সা পেলে ছেড়েও দেয়।’ 

আলাউদ্দিনের আত্মীয়স্বজনরা শুকনো মুখে মাথা নাড়ে। ‘না, এমন কোন ফোন তো আমরা পাইনি।’ 

‘তাহলে অপহরণ হয় নাই। অন্য কোন ব্যাপার আছে।’

‘কি ব্যাপার?’ 

মন্তব্যকারী সেটা আর খোলাসা না করে চলে যায়।

শুভাকাঙ্খিরা পরামর্শ দেয় প্রেস কনফারেন্স করো, বাংলাদেশের মিডিয়া বড়ই ভাইব্র্যান্ট, তারাই আলাউদ্দিনের হদিশ বের করে ফেলবে। একজন একটি দীর্ঘ বক্তব্য লিখে দেয়। আলাউদ্দিনের স্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে তা পাঠ করে। 

সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে, ‘আপনারা কি কাউকে সন্দেহ করেন? তার কি কোন শত্রু ছিল? কেউ কি টাকার লোভে তাকে কিডন্যাপ করেছে? তিনি কি শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছে? 

এসব প্রশ্নের উত্তরে রুবিনা তোতা পাখির মতো বার বার বলেছে, ‘আমরা কিছুই জানিনা শুধু তাকে অক্ষত অবস্থায় জীবিত ফেরত চাই। আপনারা সাহায্য করেন। একটা জলজ্যান্ত মানুষ তো রাতারাতি হাওয়ার মধ্যে মিশে যেতে পারে না। আমরা তার সন্ধান চাই।’ 

পরদিন বিভিন্ন রকমের বিশ্লেষণ, অনুমান ও অনুসন্ধানমূলক খবর ছাপা হয়। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হয়। কিন্তু আলাউদ্দিনের খোঁজ পাওয়া যায় না।

রুবিনার কাছে নানা রকম উড়ো খবর আসে। কেউ বলে, দার্জিলিংয়ের ঘুম ষ্টেশনে তার মতো লম্বা-চওড়া একজন মানুষকে ঘুম ঘুম চোখে ঘুরতে দেখা গেছে। কেউ বলে, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির মাজারে আউলা ঝাউলা ফকিরের বেশে এলোমেলো পদক্ষেপে হাঁটতে দেখা গেছে আলাউদ্দিনকে।

কিন্তু কোন খবরেরই সত্যতা পাওয়া যায় না, শুধু রহস্য ঘণীভূত হয়।

বুড়িগঙ্গায় এরি মধ্যে হঠাৎ ভেসে উঠে কারো গলা কাটা লাশ---- নগরবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে, কার লাশ এটা? 

মুখ নেই, মাথা নেই, অনেক দিন ধরে পানিতে ভিজে, পচে, ফুলে উঠা বেঢপ একটা শরীর, স্বাভাবিকভাবে চেনার কোন উপায় নেই। এটা আলাউদ্দিন নয় তো? রুবিনা মন শক্ত করে, নাকে কাপড় চেপে নদীর পারে ছুটে যায়, উদ্ধারকারীরা উল্টেপাল্টে লাশটা দেখায়, এই বীভৎস দৃশ্য দেখে অসুস্থ বোধ করে রুবিনা। তার নাঁড়িভুঁড়ি উল্টে আসে, সে হড় হড় করে বমি করে দেয় কিন্তু এটি নিশ্চিতভাবেই আলাউদ্দিনের মৃতদেহ বলে সনাক্ত করতে পারে না।

দুই মাস, চার মাস, আট মাস পেরিয়ে যায়, আলাউদ্দিন ফেরে না, তার কোন সন্ধানও পাওয়া যায় না। যেন সত্যিই কোন যাদুকরের যাদু মন্ত্র বলে আলাউদ্দিন অদৃশ্য হয়ে গেছে। মসজিদে মিলাদ পড়ানো হয়। মুরুব্বী গোছের কয়েকজন গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু গায়েবানা জানাজার প্রস্তাবে রাজি হয় না রুবিনা। 

সে দৃঢ়ভাবে বলে, ‘আমি তো উনার লাশ পাই নাই। মারা গেছেন এমন কোন আলামতও পাই নাই। উনি মারা গেছেন, না বেঁচে আছেন তা নিশ্চিত না হয়ে জানাজা পড়া ঠিক হবে না।’

তার কথায় যুক্তি থাকায় মুরুব্বিরা আর জোর না করে জানাজার পরিকল্পনা বাতিল করে। 

এই ভাবে আলাউদ্দিনকে খুঁজে পাওয়ার সব আশা যখন স্তিমিত হয়ে আসে। রুবিনার চোখের জলও যখন প্রায় শুকিয়ে যায়, আলাউদ্দিন বলে কখনো কারো অস্তিত্ব ছিল কিনা, তা নিয়েও যখন মানুষেরা সন্দিহান হয়ে পড়ে --- তখন হঠাৎ করেই একজন অপরিচিত লোক আলাউদ্দিনের খবর নিয়ে আসে। 

লোকটার বেশভূষা উদ্ভট। গায়ে একটা আধময়লা শার্ট, পরনে একটা কুঁচকানো প্যান্ট, হাতে একটা পোটলা। মুখে খোঁচা খোঁচা কাচা পাকা দাড়ি। দাঁতগুলো পান খাওয়া মানুষের মতো খয়েরি। ডান চোখটা বাম চেখের চেয়ে ছোট। কপালে একটা গভীর কাটা দাগ। লোকটা বলে, ‘আলাউদ্দিন সাহেবকে আমি দেখছি। তিনি কোথায় আছেন, তা আমি জানি, যদি কিছু টাকা দেন, তাহলে আমি তার খোঁজ দিতে পারি।’

আলাউদ্দিনের ছোট ভাই মিল্লাত কপাল কুঁচকে বলে, ‘তুমি যে সত্যি খবর দিবা, তার গ্যারান্টি কি? টাকা দিয়া পরে যদি ঠকে যাই ...’ 

‘একেবারে পাক্কা খবর। আমারে বিশ্বাস করতে পারেন।’ লোকটা ছোট্ট করে বলে। তার কন্ঠে আত্মবিশ্বাস। 

মিল্লাত ছুটে যায় রুবিনার কাছে। ‘কি করবো ভাবি? লোকটাকে কি বিশ্বাস করা যায়? টাকা দিবো? .. আমার কিন্তু ওকে বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছে না, ফ্রড হতে পারে..।’

রুবিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাথায় ঘোমটা টেনে বলে, ‘সব চেষ্টাই তো করলে ভাই, কত দিকে কত টাকা ফেললে, কিছুতেই তো কিছু হলো না, দেখো এবার শেষ বারের মতো চেষ্টা করে, না হয় কিছু টাকা যাবে.. যাক্ ...’ 

পুরো এক লাখ টাকা দাবি করে লোকটা। তার চে এক পয়সা কম’ও না বেশিও না। মিল্লাত একটু দর কষাকষির চেষ্টা করে। কিন্তু লোকটা তার দাবিতে অনড়। শেষ পর্যন্ত খবরটার জন্য পঞ্চাশ হাজার অগ্রিম আর খবর সত্যি হলে বাকি পঞ্চাশ হাজার দেয়ার প্রস্তাবে রফা হয়। 

লোকটা জানায়, ‘আলাউদ্দিন সাহেবকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। উনি বর্তমানে পাবনার হেমায়েতপুরের মানসিক হাসপাতালে, ৫ নম্বর বিল্ডিং, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১১৬ নম্বর বেডে ডাক্তার ওয়ালিদুর রহমানের আন্ডারে চিকিৎসাধীন আছেন।’

এত সহজ? এত কাছে? বিশ্বাস হতে চায় না। তবু উদ্ভট লোকটাকে সাথে নিয়ে পাবনা ছুটে যায় মিল্লাত আর রুবিনা। কি জানি কাকে দেখবে? আদৌ সে আলাউদ্দিন কি-না। ৫ নম্বর বিল্ডিং-এ ঢুকতে গিয়ে দুরু দুরু বুক কাঁপতে থাকে রুবিনার। 

১১৬ নম্বর বেডের সামনে গিয়ে উত্তেজনায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় তার। সারা গা মাথা একটা চাদরে মুড়ি দিয়ে কেউ একজন ঘুমিয়ে আছে সেখানে। উদ্ভট লোকটা চাদরে আবৃত মানুষটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। বলে ‘ইনিই আলাউদ্দিন। আমার টাকা দেন, আমি চলে যাবো।’ 

মিল্লাত বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার পিঠে হাত রাখে। আস্তে করে ডাকে, ‘ভাইজান, ভাইজান।’ 

বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটা একটু নড়ে উঠে। মিল্লাত আবার ডাকে, ‘ভাইজান, এইদিকে দেখেন।’ 

এবার শুয়ে থাকা লোকটা মুখ থেকে চাদর সরায়। তারপর সটান উঠে বসে। তার গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। 

হ্যাঁ। এটা অবশ্যই আলাউদ্দিন। আলাউদ্দিন-ই। সেই চওড়া কপাল। খাড়া নাক। নাকের নিচে চিকন গোঁফ। লম্বাটে চেহারা। প্রশ্বস্ত বুক। রুবিনা নিজের বুকের মাঝখানটায় কেমন একটা ব্যাথা অনুভব করে, তার চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। মিল্লাত ‘ভাইজান’ বলে আলাউদ্দিনকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু আলাউদ্দিনের মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না। সে শূন্য চোখে ফ্যালফ্যাল করে মিল্লাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সন্ধানকারীকে দ্রুত টাকা দিয়ে বিদায় করে রুবিনা।

‘ভাইজান, আমি মিল্লাত। আমাকে চিনতে পারছেন না? ... এই যে ভাবি, ভাবিকে চিনতে পারছেন তো?’

আলাউদ্দিন একবার রুবিনার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। বিড়্ বিড়্ করে কি বলে বোঝা যায় না। 

রুবিনা এবার চিৎকার করে কেঁদে ফেলে। 

‘কিগো? কথা বলছো না কেন? কই ছিলে তুমি এত দিন? আমরা তোমাকে খুঁজে খুজে হয়রান আর তুমি এখানে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে ছিলে ... !’ 

রুবিনার এমন চিৎকারেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না আলাউদ্দিনের মধ্যে। সে ভাবলেশহীন চোখে এদিক ওদিক তাকায়, যেন রুবিনা বিদেশী কোন ভাষায় কথা বলছে, যার এক বর্ণ’ও আলাউদ্দিন বুঝতে পারছে না। সম্ভবত রুবিনার কান্না শুনেই, ওয়ার্ডের অন্যান্য অপ্রকৃতস্ত রুগীরা এসে আলাউদ্দিনের বেডের পাশে ভীড় জমায়। এবার একজন কঠিন চেহারার নার্স এগিয়ে এসে রোগীদের ধমক দেয় জটলা করার জন্য। 

তার ধমকে কাজ হয়, সবাই নিজ নিজ বেড ফিরে যায় তারপর জ্বলজ্বলে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আলাউদ্দিনের বিছানার দিকে। যেন খুব মজার কোন তামাশা চলছে সেখানে। 

নার্স এবার মিল্লাত আর রুবিনাকে জিজ্ঞেস করে, 

‘উনি কি আপনাদের আত্মীয় হয়?’ 

‘হ্যাঁ, আমার ভাই।’ মিল্লাত বলে। ‘আচ্ছা, উনি কবে থেকে এখানে আছেন একটু বলবেন?’ 

নার্স বলে, ‘মনে হয় তিন চার দিন হবে। কাগজপত্র দেখে বলতে পারবো। কিন্তু আপনারা এখানে এই রকম চিল্লাচাটি কইরেন না। রুগীকে সুস্থ মনে করলে ডাক্তারের সাথে কথা বলেন। তারপর উনাকে রিলিজ করে নিয়ে যান। নাম কি আপনাদের রুগীর ... ’

‘উনার নাম, আলাউদ্দিন।’ 

মিল্লাত বলে। এবার আল্উাদ্দিন একটু নড়ে চড়ে উঠে। সে একবার মিল্লাত একবার রুবিনার দিকে তাকায়। তারপর স্পষ্ট কন্ঠে বলে, ‘আলাউদ্দিন না, তোমরা ভুল বলছো। আমার নাম জালাল উদ্দিন।’

‘ভাইজান, আপনার নাম আলাউদ্দিন।’

রুবিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, 

‘ওগো, তুমি নিজের নাম ভুল বলছো কেন?’


‘ভুল তো বলি নাই। ওরা বলে দিয়েছে, আমার নাম জালালউদ্দিন।



লেখক পরিচিতি
শাহনাজ মুন্নী
শাহনাজ মুন্নীর জন্ম ১৯৬৯-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি মূলত লেখক। এ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস গবেষণা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা আঠারোটি। তার স্বভাবে আছে এক ধরণের নির্মোহতা। শিল্পেও তার প্রভাব দেখা যায়। তার গল্পে সবসময়ই একটা গল্প থাকে। চরিত্রগুলো বিকশিত হয় সহজিয়া প্রেরণায়। জবরদস্তি নয়, সহজাত নির্দেশনা ধরেই যেন তার কথাশিল্পের চরিত্রগুলো নিজস্ব পথে পদচারণা করেন। তার কথাশিল্পের ভাষা রসবোধসম্পন্ন, কাব্যসংলগ্ন ও স্বতস্ফূর্ত। মুন্নীর কবিতাও তার ব্যক্তি স্বভাবের মতোই অউচ্চকিত। মৃদুভঙ্গীতে তিনি মোক্ষম বোধটি ব্যক্ত করে ফেলেন। যার অনুরণন থেকে যায় ঢেউ মিলিয়ে যাবার পরও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. পুরোটা সময় পাঠক কিভাবে ধরে রাখতে হয় লেখক তা জানেন।

    উত্তরমুছুন
  2. খবরের মতোই গল্পটি শেষ পর্যন্ত পাঠককে / আমাকে টেনে নিয়েছে।

    উত্তরমুছুন