আমার জন্য হুইস্কি, মধুশ্রী বলল ও জিন নেবে, আর অলীক আজ হঠাৎ রাম নিতে চাইল। পছন্দগুলো আজ সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল – মনে হল আমার মত সবাই একই কথা ভাবছে। আমি চিরকাল রামের ভক্ত, মধুশ্রী বিয়ার, অলীক তো গ্লাসে হুইস্কি ঢাললে নাকে যেই গন্ধ গেছে, অমনি ‘আঃ’ বলে উঠেছে। ওর নাকি আওয়াজটা অটোম্যাটিক বেরোয়।
কেন যে শব্দটা আমার মনে এল, কে জানে। মধুশ্রীকে আজ আমার অভিসারিকার মত মনে হচ্ছিল। অথচ বোধহয় আঙুলে গুণে বলা যাবে জীবনে আমি ক’বার শব্দটা পড়েছি বা ব্যবহার করেছি। ইদানীং বাংলা ক্রসওয়ার্ড করতে গিয়ে ক’দিন পেয়েছি। আর পড়ার ভেতর রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে বা কবিতায়। কিন্তু যে যাই বলুক, শব্দটার কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা মারাত্মক আবেশ তৈরি করার ক্ষমতা আছে। ‘অভিসারিকা’ শুনলেই মনে হয় গভীর রাতে মরাচাঁদের আলো, নীলশাড়ি – যা ওই ম্লান আলোয় প্রায় কালো, খোঁপায় বেলকুঁড়ির মালা, কাজলটানা চোখ, ফর্সা, লম্বাটাইপের একটা মেয়ের কথা। ‘অভিসারিকা’ শুনলে মেয়েটার ক্যারেকটার সম্পর্কে উৎসাহব্যঞ্জক এক রকম সন্দেহ জাগে। প্রেম বা ভালোবাসার কথা মনে পড়ে না। তার আগেই কাম, যুবতী, তাড়না, গোপন, ক্ষারগন্ধ – এসব শব্দ বর্ষার কইমাছের মত বুকের কাদাজলে খলবল করে ওঠে। অবশ্যই মনে হয় একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, পথ এখন সামান্য ভেজা, পেছলও।
কিন্তু নীলশাড়ি নয়, মধুশ্রী জিনস্ আর টপ পরে সিংগল্ সোফাটায় বসেছে। আমি জানালার পাশে দোলনাচেয়ারে, অলীক বসেছে আমার মুখোমুখি অন্য জানালার পাশে, ছোট একটা বেতের মোড়ায়। আমাদের মনে হয়েছিল আজ আমাদের এমন পোশাক পরা উচিত, যাতে দরকার পড়লে দৌড়তে অসুবিধা না হয়। যেমন নির্দেশ ছিল – কেউ কোনও জিনিস সঙ্গে রাখিনি। ব্যাগফ্যাগ তো দূরের কথা, আমি দেশলাই পর্যন্ত রাখিনি। আর সেলফোনের কথা তো স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়ে ছিল। একদম বারণ। আজ আমরা তিনজন এ শহর ছেড়ে পালাব। যেমন নির্দেশ ছিল, রাত দশটার ভেতর ট্যাক্সি নিয়ে সবাই এই ঠিকানায় পৌঁছে গেছি। এখন শুধু অপেক্ষা। বনোয়ারিলাল ওর লোক পাঠাবে। সে আমাদের নিয়ে কীভাবে হাজারও সতর্ক চোখের নজর এড়িয়ে সীমান্ত পার করে দেবে – সেটা ওদের ব্যাপার।
কয়েক শতকজুড়ে প্রাচীন পলিমাটির স্তরে শহরের নিকাশি ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে। শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা একেবারেই ধসে পড়েছে। শুধুমাত্র ইস্পাত কারখানাগুলোতে বিরামহীন শক্তি সরবরাহ করা হয়, বাদবাকি সর্বত্র আংশিক ভাবে। বহুদিন ধরে আকাশের নীল রং কেউ দেখতে পায় না। সারাদিন এক রকম ধূসর আলো শহরের পথঘাট ঘরবাড়ির ওপর ছড়িয়ে থাকে। যে অরণ্যানী প্রাচীন এই শহরকে ঘিরে ছিল, জনপদ বিস্তৃত করার লক্ষে সে সব কবেই উচ্ছেদ করা হয়ে গেছে। কোনও এক অজানা কীটের আক্রমণে শহরের সমস্ত গাছের পাতা প্রথমে হলুদ, পরে হলুদ হয়ে ঝরে পড়েছে। শহরের কোথাও কোনও সবুজ নেই। সত্যিকারের কোনও পাখির ডাক এ শহরের মানুষ এখন আর শুনতে পায় না। প্রধান সড়কে, মার্গ ও সরণিতে, অলিতে গলিতে পলি জমে আছে। বহুযুগের পলি। কালো, দুর্গন্ধময় সেই পলিমাটিতে প্রাচীন যুগের জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া গেছে। সকালসন্ধ্যায় এক ধরণের যান্ত্রিক পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যায়। নির্লিপ্ত মুখে শহরের বাসিন্দারা সেই ডাক শুনে বুঝতে পারে এখন বসন্ত, এখন সন্ধ্যাকালীন স্তোত্রপাঠের সময়, এখন প্রভাতের বন্দনাগীতি গাইতে হবে। প্রশাসনের সহস্র চোখ, সহস্র কান। কিন্তু যারা এ সব কথা আলোচনা করে, যে সব পানশালায় গোপনে ফিসফাস কথা হয় – সে সব পানশালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সে সব মানুষজন নিখোঁজ হয়ে গেছে।
সাদা, ধোপদুরস্ত পাজামাপাঞ্জাবি পরা একটা লোক এসে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল আমরা চা কিংবা কফি নেব কিনা। অবাক হয়েছিলাম আমরা সবাই। এ রকম আশাই করিনি। ভেবেছিলাম কোনও গুপ্তকক্ষ, পরিত্যক্ত কোনও বাগানবাড়ি, বন্দর এলাকার কোনও গুদামঘর বা ওই ধরণের কোথাও আমাদের লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছে বনোয়ারিলাল। তিনজন প্রায় এক সঙ্গেই এই ঠিকানায় পৌঁছে প্রথমে মনে হয়েছিল ভুল জায়গায় এসে পড়িনি তো। ফাঁদে পড়ে যাইনি তো। পরে বুঝেছি এটাই বনোয়ারির গোপন আস্তানা। একদম আধুনিক কেতাদুরস্ত লিভিংরুম। পরে জেনেছি একজন উঁচু দরের সেনানায়কের ঘর এটা। কে জানে, বনোয়ারিলাল কীভাবে ম্যানেজ করেছে। ব্যবসায়ী লোক, ওদের কত রকমের যে চতুরালি থাকে।
চা কিংবা কফির কথা শুনে আমরা একটু ইতস্তত করছিলাম। তখন সাদা পোশাকপরা লোকটা জানতে চেয়েছিল আমরা ইচ্ছে করলে যে কোনও রকম ড্রিংক্স নিতে পারি। আমাদের দিকে তাকিয়ে তার কথা বলার ভঙ্গির মধ্যেই অ্যালকোহলের গন্ধ ছিল। আমি হুইস্কি চেয়েছিলাম, মধুশ্রী বলল ও জিন নেবে, অলীক একটু থেমে, যেন দ্বিধা নিয়ে ওল্ড মঙ্কের কথা বলেছিল।
আপনার কী মনে হয়? বনোয়ারিলাল আমাদের ওপারে পৌঁছে দিতে পারবে ? অলীক চক্রবর্তী আমার কাছে জানতে চেয়েছিল। অলীকের ঘননীল জিনস্, সাদাকালো চেকের ফুলস্লিভ শার্ট। অলীকের চশমার ভেতর দিয়ে চোখে সংশয়, ভয় বোঝা যাচ্ছিল। আমি মধুশ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখে কোনো সংশয় নেই। খুব নিশ্চিত ভঙ্গিতে সে তার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল। তাকে দেখে মনে হয় সে জানে এই শহর ছেড়ে আমরা পালিয়ে যাবই।
বনোয়ারি অ্যাক্চুয়ালি এজেন্ট। কিন্তু অসম্ভব শক্তিশালী তার নেটওয়ার্ক। প্রশাসন বহু চেষ্টা করে তার একটা লোমও টাচ করতে পারেনি। দেশজুড়ে তার জাল ছড়ানো। এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য যাদের শরীর আর মন ছটফট করে ওঠে, বনোয়ারির নেটওয়ার্ক তাদের খুঁজে পায়। কেন্দ্রগত বনোয়ারি মুক্তিকামী মানুষের কাছে তার লোক গোপনে পাঠিয়ে দেয়। দরদস্তুর হয়। প্রশাসনের সহস্র সতর্ক চোখ এড়িয়ে অবিশ্বাস্য কায়দায় সে এই পুরনো শহর থেকে নতুন শহরে লোক পাচার করে দেয়।
আমার গ্লাসে টলটলে সোনালি তরল। এখনও আমি চুমুক দিইনি। হুইস্কি আমার পছন্দের পানীয় নয়। আমার গ্লাসে আমি রক্তের মত লালচে রাম দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু আজ আমরা তিনজনই অন্য রকম ড্রিংক্স নিয়েছি। জানি না কেন আজ আমাদের পছন্দ চিরকালের চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে এল। ধীরেসুস্থে একটা চুমুক দিয়ে অলীক চক্রবর্তীর দিকে তাকালাম।
আপনার মনে যদি বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস বা সংশয় থাকে, তবে চুক্তিপত্রে সই করলেন কেন ? সন্দেহ নিয়ে আপনি বনোয়ারিলালকে অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা দিয়েছেন – দিস ইজ আনবিলিভেবল্।
সে তো আপনিও দিয়েছেন ...
হ্যাঁ, আমি তো বনোয়ারির ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেছি। নতুন শহরের আকাশ নাকি সত্যিই নীল, গাছের পাতা ঘন সবুজ, নদীর জল স্বচ্ছ। সেখানে ছ’টি ঋতু স্পষ্ট বোঝা যায়। পূর্ণিমার রাতে আস্ত একটা গোলচাঁদ শালজঙ্গলের মাথায় থমকে দাঁড়ায়। কারা যেন জোছ্নায় ভেসেযাওয়া মাঠে খেলা করে। ভারি সুন্দর একটা নাম-না-জানা ফুলের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
জানি। আমিও শুনেছি।
বনোয়ারির গোপন চোখ আমাদের আগলে রেখেছে। জানিনা, কখন, কীভাবে সে আমাদের তীব্র বাসনার কথা বুঝতে পেরেছিল। জানি না, কখন, কীভাবে সে আমাদের ওপারে পৌঁছে দেবে। এই যে প্রাচীন শ্যাওলাপড়া শহর, সহস্র ফাটলধরা পাথুরে ঘরবাড়ি, হাজার অনুশাসনের সকালদুপুরসন্ধ্যা, সেই একঘেয়ে সুরের নামকীর্তন, এক ধূসর, বিষণ্ণ, গুমোট আকাশ – এ সব থেকে মুক্তি দেবে বনোয়ারি। মিথ্যে তো নয়। কত মানুষকে বনোয়ারি পার করে দিয়েছে। তা বলে পুরনো এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়া অত সহজ নয়। আপনি জানেন, গতমাসে সাতজন ধরা পড়েছে। সাতজনেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় সংশোধন কমিটি।
আচ্ছা বলুন তো, বনোয়ারিলাল কীভাবে মানুষের মনের কথা টের পায় ? মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কি কোনও অজানা তরঙ্গদৈর্ঘে বাতাসে ঢেউ তোলে ? দুঁদে স্বরাষ্ট্রদপ্তরের কোনও যন্ত্র সেই কম্পন ধরতে পারে না। অথচ বনোয়ারি ঠিক কেন্দ্রগত অষ্টপদীর মত টের পায়। ও কি আরও উন্নত কোনও টাওয়ার বসিয়েছে। প্রশাসনের সতর্ক নজর এড়িয়ে কীভাবে বনোয়ারি এই যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রেখেছে ... আশ্চর্য ব্যাপার!
সাদা পোশাকপরা লোকটা নিশ্চয় আমাদের ওপর নজর রাখছিল। আমাদের পান শেষ হতেই একটা ট্রের ওপর আবার তিনটে ভর্তি গ্লাস নিয়ে এল। আমি হুইস্কি, মধুশ্রী জিন, অলীক রামের গ্লাস তুলে নিলাম। স্পষ্টতই তিনটের রং আলাদা ছিল। লক্ষ করে দেখলাম প্রথম পেগ আমরা সবাই বেশ তাড়াতাড়ি শেষ করেছি। এর আগে অনেকবার আমরা তিনজন একসঙ্গে বসে পান করেছি। একই ইস্পাত কারখানায় আমরা চাকরি করি। আমাদের বিভাগ আলাদা, কিন্তু প্রত্যেকেই সেই বিভাগে উচ্চপদস্থ কর্মচারি হওয়ার সুবাদে এবং বিভাগগুলোর পারস্পরিক নির্ভরতার কারণে প্রতি সপ্তাহেই আমাদের তিনজনকে আলোচনায় বসতে হয়। কারখানার কোনও কর্মচারি নয়, অলীক চক্রবর্তী নয়, এমন কি উৎপাদন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পরিষদের কোনও অধিনায়কও জানে না মধুশ্রী আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া। জানলে যে কোনও একজনের চাকরি চলে যাবে। এ রকমই নিয়ম। আমাদের তিনজনের কাঁধেই উল্কির চিহ্ন আছে। ইস্পাত কারখানার কর্মীদের প্রত্যেকের কাঁধেই দেগে দেওয়া হয়। নিচুতলার কর্মীদের ক্ষেত্রে অসাবধানতা এবং অবহেলার কারণে কাঁধে প্রায়শই সংক্রমণ ঘটে যায়। ঘা সারতে চায় না। ওরা কাঁধের নিচে পূঁজরক্ত মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। সুগন্ধী মাখলেও এক রকম ছাই ছাই রং-এর মাছি সব সময় ওদের চারপাশে উড়ে বেড়ায়।
মধুশ্রী আমার অনেক দূরের লতায় পাতায় বোন। খুব পড়াশোনা করে। লুকিয়ে কবিতা পড়ে। এমন কী, আমার একটা কুটিল সন্দেহ হয় কবিতা লেখেও হয়তো। আমি আর মধুশ্রী পরস্পরকে জানতাম, বুঝতাম। দুজনের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতাম আমাদের দুজনেরই ভেতরের ডানা ছটফট করে উঠছে। আর পারছি না। অলীক চক্রবর্তী কি কিছু টের পেয়েছিল –বুঝতে পারিনি। কিন্তু একদিন সাপ্তাহিক মিটিং-এর শেষে আস্তে বলে উঠেছিল – আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে। আমি ওর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে চোখের ইশারায় বুঝিয়েছিলাম –পরে হবে। ও কি জানে না গোপন ক্যামেরার কথা, ইস্পাত কারখানার ভয়ংকর বাধানিষেধের কথা, নিয়মভঙ্গকারীদের নিষ্ঠুর নিয়তির কথা।
আমি জানালার পাশে বসেছিলাম। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম শহরজুড়ে অঝোরধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বহুদিন বাদে এমন বৃষ্টি এল। ঝপ করে অন্ধকার নামল আমাদের ঘরে। সমস্ত শহর অন্ধকারে ডুবে রইল। শুধু অনেকদূরের পশ্চিম আকাশে লাল আভা। ইস্পাত কারখানা চালু রয়েছে। গলিত পুঁজরক্তের মত থকথকে দুর্গন্ধময় কাদার স্রোত এখন এখন শহরের পথেঘাটে ছড়িয়ে পড়বে। বাতাস উঠল ঝড়ের মত। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে আমার চুল, মুখ, বুকের জামা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। ভয়ংকর একটা শোঁ শোঁ শব্দ শুরু হলে আমার মনে হল শতাব্দীপ্রাচীন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা আজ নিশ্চয় ভেঙে পড়বে। বনোয়ারি কি জানত এমন দুর্যোগের রাত হবে আজ। পাহারা শিথিল হবে। নজরদারির যান্ত্রিক ব্যবস্থায় গোলযোগ হতে পারে। মনে হল ভারি পিতলের তৈরি – একটা বাতিদানে তিনটে মোমবাতি জ্বালিয়ে লোকটা ঘরে রেখে গেল।
হাতে গ্লাস নিয়ে মধুশ্রী উঠে এল। জানালার পাশে আমার শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল। আত্মীয়তার সম্পর্ক খুঁজতে গেলে শেষ পর্যন্ত মধুশ্রীর সঙ্গে আমার ভাইবোনের সম্পর্ক দাঁড়ায়। মাই ফুট। আই কেয়ার এ ফিগ। মধুশ্রীর অসাধারণ ফিগার, অথচ কোথাও একটা পুরুষালি ব্যাপার আছে। সেটা ওর বাইরের কঠিন আবরণের জন্য হতে পারে, কারখানায় ওর বিভাগ পরিচালনার ক্ষেত্রে কঠোরতার জন্যও হতে পারে। কী লাবণ্যময় ওর মুখ, উদ্ধত বুক, সাধারণ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় বেশ ভালো হাইট। বৃদ্ধদের দীর্ঘশ্বাস, মধ্যবয়সিদের ফ্যান্টাসি, তরুণদের প্রেমিকা হওয়ার সব উপকরণ নিয়েও মধুশ্রী একা। ওর শরীরের নারীত্ব, নাকি ওর স্বভাবের পুরুষত্ব – কোনটা যে আমাকে বেশি আকর্ষণ করে, বুঝতে পারি না। বাট, ইয়েস ... ওকে নিয়ে আমারও বিছানায় ঘুমের আগে, এমন কী কখনও দিনের বেলাতেও ফ্যান্টাসি আছে। জানালার পাশে এসে দাঁড়ালে আমার হাঁটু ওর পায়ের সঙ্গে লেগে রইল। আমার শরীর শিরশির করতেই থাকল। অন্ধকারে ডুবেথাকা প্রাচীন এক নগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মধুশ্রী। ঘোলা জলে ভেসে যাচ্ছে সড়ক ও মহাসড়ক। জেগে আছে ইস্পাত কারখানার লালচুল্লি। অবিরত তৈরি হয়ে চলেছে সড়কি, যুদ্ধকুঠার, লৌহমুষল, বর্ম, মেশিনগান, মাস্কেট, সাঁজোয়াগাড়ি।
জানিস রন্টুদা, যদুবংশের কুলবধূরা ইচ্ছে করেই অনার্য দস্যুদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল।
আমি চমকে উঠলাম। এখন একটা দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছি। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে বনোয়ারিলালের লোক বোধহয় এল। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। কীভাবে সে আমাদের নতুন শহরে নিয়ে যাবে, সেই ভাবনা রয়েছে। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও কোনও কৌশল আছে কিনা, আমাদের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে কিনা – সেই চিন্তাও রয়েছে। সত্যিই কি বনোয়ারিলাল বলে কেউ আছে। আজ পর্যন্ত কেউ তাকে চোখে দেখেনি। কত গল্পগাথা তাকে নিয়ে। খাঁচার ভেতর পাখি ছটফট করে উঠলেও নাকি সে টের পায়। একটা চুক্তিপত্রে সই কর আর তার প্রাপ্য টাকা তাকে দাও, সে তোমাকে এই ক্রমাগত যুদ্ধে ক্লান্ত শহর থেকে বাইরে নিয়ে যাবে। প্রাচীন ঐতিহ্যের সমস্ত ইমারতগুলো ভগ্নস্তুপ হয়ে শহরের একদম উত্তরে পড়ে আছে। বিখ্যাত স্মৃতিসৌধগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক ছাঁচে ঢালা, এক রং-এর অসংখ্য বাড়ি তৈরি হয়েছে শুধু। আর সব কিছু পচনশীল, উৎসন্নে যাওয়ার মুখে। সন্ধ্যার পর শুধু শহর থেকে দূরে পশ্চিম প্রান্তরে কালাগ্নির মত ইস্পাত কারখানার আগুন জেগে থাকে। আজকের এই রাত এ শহরে আমাদের শেষ রাত। ঘরে মোমের আলো। বাইরে তুমুল বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। জিনের গ্লাস হাতে মধুশ্রী জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার হাঁটু ওর পুষ্ট পায়ের কাপের সঙ্গে লেগে রয়েছে। মোমের আলো পড়েছে ওর মুখে পাশ থেকে। ওর নাকে, কপালে জলের ফোঁটা সামান্য বোঝা যায়। মুখের একপাশ দেখতে পাচ্ছি, সিল্যুয়েট। সব রকম দুশ্চিন্তা উপেক্ষা করে আমার কামনা জাগছিল। মধুশ্রীর কথাগুলো যেন আমাকে ধাক্কা মেরে এক জগত থেকে অন্য এক জগতে ঠেলে দিল। নতুন জগতের ভাষা আমি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। মধুশ্রী ঘুরে আমার দিকে তাকাল।
তখন কী হয়েছিল জানিস ?
কবে ? কী হয়েছিল ? আমার বুকের ভেতর অজানা কোনও ভয় লাফিয়ে উঠল। হৃদস্পন্দন মনে হয় হঠাৎ খুব বেড়ে গেল। মধুশ্রী কোন অমঙ্গলের কথা শোনাবে। মধুশ্রীর কথায় কোনও ওঠাপড়া নেই। কেমন যেন নির্লিপ্ত ধাতব স্বরে কোনও দৈববাণী শোনাবে – এমন মনে হয়।
পাখিরা বামাবর্তে ঘুরতে শুরু করল। নদীগুলো উল্টোদিকে বইতে লাগল। গোরুর গর্ভে গর্দভ, গর্দভের গর্ভে হস্তিশাবক, কুক্কুরীর গর্ভে বেড়াল, বেজির গর্ভে ইঁদুর জন্ম নিল।
তুই কোন কথা, কবেকার কথা বলছিস ? কার লেখা ? গ্রিমভাইদের রূপকথা নাকি...
মুষলপর্বের সূচনা। পড়িস নি ? ইতিহাসের নিয়মেই কালচক্র পূর্ণ হবে। সব কালের অধীন। সব একদিন ধ্বংস হবে। অর্জুনের চোখের সামনে যাদবরমণীদের লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে অনার্য দস্যুরা। কেউ স্বেচ্ছায় ওদের সঙ্গে চলে যাচ্ছে। এই নারীরাই পান্ডবদের অস্ত্র বিকল করে রেখেছে। মহাতেজা অর্জুনের ধনুকের জ্যা কে যেন কেটে রেখে দিয়েছে। যুদ্ধ আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত কৃষ্ণ আর পান্ডব যোদ্ধারা। অতৃপ্ত কুলবধূরা স্বেচ্ছায় চলে গেল আভীর দস্যুদের সঙ্গে।
ঊর্দ্ধশ্বাস উৎসবে কাতর বিলাসী যাদব যুবাদল
অতীত অর্জিত সুখে এলোমেলো অলস ভোগের
স্বার্থপর আবিষ্কারে ক্লান্তিভারে নিদ্রান্ধ বিকল
একটু একটু করে বুঝতে পারছিলাম। মধুশ্রী বলতে চাইছে ভবিষ্যতের ধ্বংসের বীজ কেমন করে অতীতেই বপন করা হয়। কিন্তু আজ, এখন কেন মধুশ্রী এসব কথা বলছে। আজ তো আমাদের সেই ধ্বংস পার হয়ে নতুন সভ্যতার দিকে যাত্রা করার কথা। কোনও এক অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন বীরযোদ্ধা সমস্ত সংশয় ও প্রতিরোধ পার করে আমাদের নতুন দেশে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এসব কবিতা মধুশ্রী কোথায় পেল।
বিষ্ণু দের কবিতা। পদধ্বনি। শোন, অর্জুন কী বলছে।
যাদের সম্মান রক্ষা করবার মানসে আমি গান্ডীবে সেদিন
জ্যা-রোপণ করতে গিয়েছিলুম, যখন
তারাই অনেকে – অগ্নিকুন্ডের উদ্দেশ্যে ধাবমান
মূর্খ পতঙ্গের মত—
লাস্যভরে
লুঠেরার দলের দিকে চলে গেল,
তখন, স্বীকার করি, ঠিক সেই সেই মুহুর্তে আমার
শরসন্ধানের কোনও ইচ্ছাই ছিল না
এটা কার লেখা ? আমার কেমন যেন ঘোর লাগছিল। মধুশ্রী আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দীর্ঘচুমুকে তার গ্লাস শেষ করল। ওর সিংগল সোফাটার সামনে ছোট টেবিলে গ্লাস নামিয়ে সোফায় বসল। এখন মোমের আলোয় ওর মুখ আর সিল্যুয়েট নয়, সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছি। ওর টাইট টপের আড়াল থেকে উপচেওঠা বুকের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলাম। মোমবাতির শিখা কেঁপে উঠছিল। অলীক চক্রবর্তী উঠে গিয়ে দুটো জানালাই বন্ধ করে দিলে শিখা অনেক স্থির আলো দিল। অলীক আমার চোখের নড়াচড়া লক্ষ করছিল।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। অকালসন্ধ্যা। আরও শোন –
তারা অনেকেই
অর্জুনের হাত ধরে
নিরাপদ ভূমিতে উত্তীর্ণ হতে চায়নি, অনেকে
সেই ঘোর সংকটের মুহূর্তে সেদিন
অর্জুনকে নয় –
অরণ্যের একদল আভীর দস্যুকে
প্রাপনীয় প্রেমিক পুরুষ বলে সাগ্রহে বরণ করেছিল।
জেনে রাখো,
কোথায় আমার লজ্জা, কোথায় আমার পরাজয়।
এসব বই তুই কোথায় পেয়েছিস ? কোথায় লুকনো ছিল ?
নেই। কোথাও বই নেই। যখন বাবার কাছে ছিলাম, গভীর রাতে বাবা ফিসফিস করে মন্ত্রের মত উচ্চারণ করত। যে রাতে শান্তিবাহিনী এসে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেত সংশয়বাদীদের, যে রাতে আজকের মত এ রকম মহাপ্লাবনের রাত হত, মনে হত আজই এ শহর ভেসে যাবে, তলিয়ে যাবে কালের গর্ভে – আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে বাবা আবৃত্তি করত। বই ছিল না কোথাও। বেদের মত শ্রুতিতে রেখে দিয়েছি মুষলপর্বের কথা।
চলুন, সময় হয়ে গেছে। চমকে সামনে তাকিয়ে দেখলাম দরজায় সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এখন আর তার পরনে সাদা পাজামাপাঞ্জাবি নেই। রেলের গ্যাংম্যানদের মত ঘননীল জামাপ্যান্ট। তার হাতে একটা চারপাশে কাচপরানো চৌখুপি আলো। অনেকরাতে দুরন্ত গতিতে ছুটেযাওয়া ট্রেন যখন কোনও ছোট স্টেশন পেরিয়ে যায়, তখন কেবিন থেকে এ রকম আলো দোলে। সবুজ। এবার সত্যি তাহলে এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ঘুম থেকে উঠে আর রুগ্ন, বিষাদময় আলো দেখতে হবে না। সকালসন্ধ্যা সেই একঘেয়ে সুরের নামগান শুনতে হবে না। বুক ভরে বাতাস টানলে ফুসফুস ভরে যাবে না ধুলোবালি আর ধাতুর অণুকণায়। সেখানে কাজের শেষে সন্ধেবেলা পানশালায় বসে যতখুশি তর্ক করব, পান করব, মধুশ্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে দ্বিধাহীন উদ্যাপন করব গোপন বাসনার জয়ন্তী। কত লোককে বনোয়ারিলাল পার করে দিয়েছে। মানুষের শরীরে, মনে, চিন্তাভাবনায়, চলাফেরায়, কথাবলায় যখন শেকল ছেঁড়ার ইচ্ছে তীব্র হয়ে ওঠে, তখন সেই ইচ্ছে থেকে এক রকম তরঙ্গ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। বনোয়ারির জালে কাঁপন ওঠে। বনোয়ারি আড়কাঠি পাঠায়।
মধুশ্রীর চেয়ে সুন্দর কোনও নারী বা পুরুষ আমি আর দেখিনি। কোনও দিন হয়তো ওর সঙ্গে কারখানায় দেখা হয়ে যায়। টানটান করে পেছনে বাঁধা ওর পনিটেল, ওর কপালে ছোট ছোট ঘামের ফোঁটা, প্রচুর স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ লম্বা ওর চেহারার দিকে সবসময় সোজাসুজি তাকাতে পারি না। একটা অস্বস্তি হয়। ইচ্ছে করে ওকে বলি যেন ফার্নেসের বেশি সামনে না যায়। ভয় করে, যদি গলে যায়। আমাদের এই হতদরিদ্র পুরনো শহরে সূর্যের আলোর আর সে তেজ নেই। দুঃস্বপ্নের মত একটা গাঢ় ধূসর আবরণ কতদিন ধরে এ শহরের মাথার ওপর জমে আছে। ক্রমশ ঘন হয়েছে সেই আচ্ছাদন। এ শহরের মাটি, ঘরবাড়ি, পথঘাট রাত্রিবেলা তাপ হারিয়ে কিছুটা ঠান্ডা হয় বটে, কিন্তু সে তাপ ওপরের আকাশের ধুলো আর ঘন ধোঁয়ায় ধাক্কা খেয়ে আবার এই শহরে ফিরে আসে। একটা গুমোট আবহাওয়া দিনরাত, সারামাস, সারাবছর।
মধুশ্রী যখন আমাকে রন্টুদা বলে ডাকে, আমার কেন মনে হয় হাজারটা বাজ পড়ুক নিয়মের এই সংসারে। পুড়ে খাক হয়ে উড়ে যাক কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার, ঘুণেধরা পৌর-সংবিধান।শিকলেবাঁধা নিয়মের এই জীবন থেকে গোপন কোনও বাগানবাড়িতে মধুশ্রীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। অন্য কোনও পুরুষকে জড়িয়ে মধুশ্রী শুয়ে আছে, অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে মধুশ্রী সঙ্গমরত – এই ভাবনা আমার বেঁচে থাকাকে টালমাটাল করে দেয়। মধুশ্রীকে নিয়ে আমার চূড়ান্ত ফ্যান্টাসি ইদানীং এত স্পষ্ট হয়ে মাথার ভেতরে প্রায় স্থির ছবি হয়ে থাকে যে, মনে হয় এটাই ঘটনা। কোনও কল্পনা নয়। বাস্তবের কাছাকাছি মনে হয়।
সেই লোকটা আমাদের সামনে রয়েছে। ওর হাতে কালো ফ্রেমের চারকোনা বাক্সের মত লন্ঠন। রেলের পয়েন্টসম্যানদের হাতে আমি এ রকম লন্ঠন দেখেছি। সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে আমরা পাতালঘরের দিকে নামছি। অনেকবড় ব্যাসার্ধ নিয়ে একটা সুড়ঙ্গ নিচে নেমে গেছে। তার দেয়াল বেয়ে ঘোরানো সিঁড়ি। লোকটার পেছনে অলীক, তার পেছনে মধুশ্রী, সব শেষে আমি। সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিকের বাড়ি এটা। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এ বাড়ির নিচে এ রকম সুড়ঙ্গ-পথ আছে। এ শহর ছেড়ে চলে যাব – শুধু এ কথা ভেবে নয়, আমার উত্তেজনা হচ্ছিল বনোয়ারিলালের সঙ্গে দেখা হতে পারে – এ কথা ভেবে। সর্বশক্তিমান এক রাষ্ট্রের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে বারবার যে জিতে যাচ্ছে – সে কেমন মানুষ। নতুন শহর সম্পর্কে কোনও খবর যাতে আমাদের শহরে না পৌঁছয়, সে জন্য নিয়মের কত কড়াকড়ি রয়েছে। তবু কেমন করে যেন সে দেশের কথা এখানে পৌঁছে যায়। নদীর স্বচ্ছ জল, পরিষ্কার নীল আকাশ, গাছের সবুজ পাতা, রকমারি পাখির ডাক সে শহরে দেখা যায়, শোনা যায়। চারণকবিরা নতুন সুরে গান বেঁধে একতারা বাজিয়ে গেয়ে বেড়ায়। সেখানে কারও কাঁধে দাসত্বের প্রতীকচিহ্ন দেগে দেওয়া হয় না। পানশালায় বসে সবাই মুক্তচিন্তা, মুক্ত ভাবনার কথা বলে। অলীক চক্রবর্তী বলেছিল সেখানে নাকি কেউ ব্রহ্মহত্যা, ব্রাহ্মনের সুবর্ণচুরি, সুরাপান, গুরুভার্যাহরণ করে না। আত্মবিক্রয় সেখানে মহাপাপ।
লোকটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ভয়ে আমার বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠল। শেষমুহূর্তে সব ভেস্তে গেল নাকি। আমাদের এই যাত্রা কি ব্যর্থ হয়ে গেল। শেষমুহূর্তে যদি বনোয়ারিলাল কোনও কারণে আমাদের ফিরিয়ে দেয়। দেখলাম লোকটা একটা কালো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জানি না দরজার ওপাশে কী আছে।
আসুন। দরজার পাল্লা সামান্য ঠেলে দিল লোকটা। সম্মোহিতের মত আমরা তিনজন ঘরে ঢুকলাম। চৌখুপি আলোটা বাইরে রেখে লোকটাও ঘরে ঢুকল। ঘরের মাঝখানে একটা মাদুর পেতে দিল সে। আমরা বসলাম। মুখোমুখি আর একটা মাদুর পেতে লোকটাও বসল।
কী আশ্চর্য! এই লোকটাই বনোয়ারি নাকি। এই সাদামাটা লোক কী করে বনোয়ারি হয়। সে কি এক বিশাল লম্বাচওড়া শক্তিশালী পুরুষ নয়। এই গোপন সংগঠনের সেই হল কেন্দ্র। আকাশবাতাসজুড়ে তার জাল পাতা। সাংসারিক মানুষের কামনাবাসনার ঢেউ সে ঠিক টের পায়। কেন্দ্রে বসে কলকাঠি নাড়ে, আড়কাঠি পৌঁছে যায় দুখি মানুষের কাছে। আড়ালে বসে সে কলের কৌশল দেখায়। সে কি নিজেই একটা লন্ঠন হাতে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তার সংগঠনে অজস্র উঁচু উঁচু টাওয়ার রয়েছে।
আপনি... গলা থেকে কাল্পনিক শ্লেষ্মা ঝেড়ে আমিই প্রথম কথা বললাম। ঠকে যাইনি তো – আমার মনে হল।
আপনারা যা ভাবছেন, তা নয়। আমি বনোয়ারি নই।
মানে ? অলীক চক্রবর্তী প্রথমে আমাদের মতই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসেছিল। এখন হাঁটুদুটো ক্রস করে লোকনাথবাবার পশ্চারে বসে জিজ্ঞেস করল।
আসলে বনোয়ারি বলে পৃথিবীতে কেউ নেই। আমরাই বনোয়ারি, আমরা সবাই মিলে বনোয়ারিলাল বানাই। এটা একটা সমবায় প্রতিষ্ঠান।
আমাদের যাওয়ার ব্যাপার ... টাকা ...
অবশ্যই যাবেন। তার আগে আপনাদের ঘাড়ের জামা সরিয়ে উলকিছাপ দেখান।
আমি আর অলীক চক্রবর্তী ইতস্তত করছিলাম। আমাদের বুকের ভেতর সংশয় তৈরি হচ্ছিল। মধুশ্রী প্রথম ওর জামার একটা বোতাম খুলে গলা একটু পেছনে ঠেলে দিলে এই প্রথম আমি চিহ্নটা দেখতে পেলাম। মধুশ্রীর ঝকঝকে ফর্সা চামড়ার ওপর ঘননীল একটা শেকল অর্ধবৃত্তাকারে ওর ঘাড়ে ফুটে রয়েছে। এবার আমরাও জামা আলগা করে দেখালাম।
ঠিক আছে। এবার শুনুন, গতকাল থেকে আমাদের কোম্পানি একটা নতুন নিয়ম চালু করেছে। নিয়মের কড়াকড়ি হঠাৎ খুব বেড়ে গেছে। শান্তিবাহিনী একদল কুকুর আমদানি করেছে। যারা এ শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে চায়, তাদের শনাক্ত করতে পারছে কুকুরগুলো। তা ছাড়া মুক্তিকামী মানুষের সংখ্যাও খুব বেড়ে গেছে। ফলে স্থির হয়েছে প্রতি তিনজনের ভেতর একজন সুযোগ পাবে।
লাফ দিয়ে অলীক চক্রবর্তী উঠে দাঁড়াল। নিচু হয়ে মধুশ্রীর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকেও দাঁড় করাল। লোকটার দিকে তর্জনী তুলে হিসহিস করে উঠল।
একজন নয়, দুজনকে যেতে দিতে হবে। আমরা দুজন যাব।
আমি মধুশ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও হাসছে। কী অসম্ভব উজ্জ্বল ওর দাঁত। ও কেন হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে না। মধুশ্রীও কি নিজের ইচ্ছায় যেতে চাইছে। আমিও একটা ভয়ংকর লাফ দিলাম। দুহাতে অলীক চক্রবর্তীর গলা চেপে ধরে দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরলাম। দুচোখ বিস্ফারিত হল, জিভ বেরিয়ে এল অলীক চক্রবর্তীর। টের পাচ্ছিলাম বুকের ভেতর থেকে কে যেন খুব উৎসাহ দিচ্ছে। আর সুখ গড়িয়ে নামছিল সমস্ত শরীরজুড়ে। মধুশ্রী আর নীলজামাপরা লোকটা মাদুরের ওপর শুয়ে পরস্পরের পোশাক খুলে নিচ্ছিল। আমি তাকালে মধুশ্রী আবার সে রকম দাঁত বার করে হাসল। শ্বদন্ত দুটো সামান্য বড় মনে হল আমার। অলীক চক্রবর্তীর শরীর শিথিল হয়ে গেল। ছেড়ে দিলে মাটিতে পড়ল ওর নিষ্প্রাণ শরীর। আমি এবার মধুশ্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ওর নিরাবরণ দীর্ঘ শরীরকে পেছন থেকে জাপটে ধরে ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দিলাম। মধুশ্রী চেষ্টা করছিল মুখ ঘুরিয়ে ওর তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত আমার গলায় বসিয়ে দিতে। আমাকে ভেতর থেকে কেউ সাবধান করছিল। দুহাতে ওর চুলের মুঠি ধরে ওর কপালটা প্রচন্ড জোরে ঠুকে দিলাম শক্ত মেঝের ওপর। নিশ্চিত হওয়ার জন্য মধুশ্রীর মুখটা ঘুরিয়ে মাথার পেছনটাও জোরে জোরে বেশ ক’বার মেঝেতে ঠুকলাম। ঘিলুটিলু সব বেরিয়ে গেল। রক্তে ভেসে গেল ঘর।
তখন মেঝেটা দুলে উঠল। দেয়াল থেকে একটা ছোট্ট আয়না ছিটকে মাটিতে পড়ে অজস্র টুকরো হয়ে গেল। মেঝেতে আমি স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। এই ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে সাতের ওপরে হতে পারে। এখন নিশ্চয়ই নদীগুলো উলটো দিকে বইছে। অন্ধকার আকাশেই পাখিগুলো বাঁ দিকে ঘুরে উড়ছে। দুটো নিষ্প্রাণ শরীরের মাঝে একটা দীর্ঘ ফাটল তৈরি হল এবার।
আপনার জন্য নতুন শহরের দ্বার উন্মুক্ত। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল লোকটা। ফাটলের দিকে নির্দেশ করল।
0 মন্তব্যসমূহ