নান্দাইল চৌরাস্তা থেকে সদাই এসেছে অনেক। মেরেঙা বাজার গমগম করছে। আজ হাটবার। তীব্র রোদ, ধু ধু বাতাস আর ঘামভরা লোকজনের ভিড় ঠেলেঠুলে কুসুম আর ওর কাকা আবু মিয়া রতনের দোকানের দিকে যাচ্ছিল। পথেই কারো পায়ে চাপ লেগে কুসুমের এক পাটি স্যান্ডেল ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল, আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। সবুজ লাল ফুলপাতা ছাপ আর কালো ফিতার প্লাস্টিক স্যান্ডেল। বাসন্তী দুর্গাপূজার সময় বড়’বু কিনে দিয়েছিলেন। বড়’বু কুসুমের দাদী। মিয়া বাড়ির কর্তা। ঐ এক জোড়া স্যান্ডেলই ছিল কুসুমের, তাও বুবু না কিনে দিলে হয়ত সেটাও জুটত না। গত দশ বছরে এর আগে কখনও কোনদিন পায়ে কিছু জোটেনি। স্যান্ডেল হারিয়ে তাই কুসুম ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিল। কান্না সহ্য করতে না পেরে আবু কাকা তাকে এক ঝটকা টানে পানের দোকানের সামনে এনে দাঁড় করালো।
‘ওই ছেড়ি, অত রাও করস ক্যান? ডাঙ্গর অইসোস না! বিলওর মদ্যে চুবাইবাম কইলাম! মায়্যাগো মায়া, কি যালাইনডা যালাইতাসে! খালি ফাও আডন যায় না? বাড়িত গিয়া য্যারে গুসল কইরাললে ফরিষ্কার অইতোনা? অইব?’ রাগে গজ গজ করতে থাকে আবু মিয়া।
কুসুম কাঁদতে কাঁদতেই দুদিকে মাথা নেড়ে বলে, ‘মায়ে মাইরালবো’
‘মিসরি খাইবি?’
কুসুমের মুখ মুহূর্তেই চকচক করে ওঠে, বলে, ‘যিলাফি খাইবাম’।
‘অত ট্যাহা কইত্থন ফাইবাম? ট্যাহা নাই, ড্যাঙ্গা শাগ আর মাষকালাই ডাইল কিনচিনা অহনো। তর মা আড্ডি গুড়া কইরালতোনা এইত্যা না কিনল্যে!’
ধানক্ষেতের আইল ধরে আবুকাকা হন হন করে হাঁটছে; পেছন পেছন কুসুম । কাদায় প্যাচ প্যাচ করছে আইল। আবু মিয়ার পায়ে জুতা নাই…। নখ ভর্তি কাদা। কাদার ওপর জোঁকেরা হাঁটছে। লুকিয়ে আঙুলের ফাঁক গলে খেয়ে ফেলছে চামড়া। রক্ত ঝরে পড়ছে, আবু মিয়া টের পাচ্ছে না। ওদিকে খাল শুকিয়ে কাঠ…। ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে কতকাল ধানি জমিতে জল দেয়া যাবে কে জানে। ধানের চারাগুলো হড়হড় করে বড় হচ্ছে, সবুজ কচি পাতা…বাতাসে যেন হেলে দুলে গাইছে, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরে লাল দোপাট্টা মল মল, মেরে লাল দোপাট্টা মল মল…। আবু মিয়া কোমরের গামছাটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে দুই হাত দিয়ে টানছে আর বলছে, ‘ঐ ধুন্দা মগা, অত গান গাইনন্যাযে; বিলোর বাতাস খাওহাইন, আর অত গফ করুইন্যাযে, ম্যাগ আইলে দিশ্যা পাইত্যাই্ন্যা।’
ধান্দুয়া দুলতে দুলতে চুপ মেরে যায়। আকাশে তখন সাদা সাদা উদাস মেঘ হাওয়ায় উড়ে পশ্চিমে ফিরছে।
কুসুমের নাক দিয়ে তখনও অনবরত সর্দি ঝরছে, আর সে ঘ্যান ঘ্যান করেই চলছে। তাই দেখে আবু মিয়া আবার দিল এক ধমক,‘অত তড়োবড়ো করস ক্যান? কান্দন থামাই’ত্ কইসিনা? ব্যাশ্যায়া জিলাফি কিন্ন্যা দিসি। হ্যারফরও কান্দ্যইন থামে না! বাড়িত গ্যালে তর মায়ে লাড়কি দিয়া হুতায়া ফিডাইব।
কুসুম জামা তুলে নাক মোছে…কিন্তু চোখের পানি তেমনি থেকে যায়।
ধানি জমিটা পার হলেই ইসহাকদের বাড়ি। শিমগাছের ঝোপটা বেশ বড়সড় হয়েছে। ইসহাক মিয়ার স্ত্রী লতিফা শিম তুলছে শাড়ির কোঁচরে। ওর কালো ল্যাতপ্যাতে ন্যাংটো বাচ্চাটা মায়ের পায়ের সাথে লেপটে আছে। লতিফা ওরফে কুসুমের মা বছর বছর বাচ্চা পয়দা করে। এই নিয়ে গ্রামের লোকেরা নানা কুকথা বলে। খেতে পায় না আবার বাচ্চা পয়দার সখ! পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে কুসুমই বড়। বছর বছর নতুন মুখ দেখতে ভালই লাগে তার। কিন্তু সংসারে অভাব অনটন একেবারেই সহ্য হয় না।
কুসুমের বাবার নিজের ধানি জমি নেই। অন্যের জমিতে গতর খাটতেও সে দোনামনা করে। ভাঙাচোরা নৌকাটাই সময় অসময়ে ঘাটে লাগায় সে। কেউ দিলে দেয়, না দিলে খাতিরে পার করে দেয়। আষাঢ়, শ্রাবণ- দুইমাস মন্দ কাটে না। আশ্বিনের শেষ থেকেই টানাটানিটা শুরু হয়ে যায়। আর কার্তিক মাস শুরু হলেই বাঁশের সাঁকোটা লেগে গেলে গ্রামের লোকের আর খাল পারাবারে নৌকা লাগে না। কুসুম জানে, বাবা খেয়ালী মানুষ। তার খুব বেশি আয় করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু এরপরও ভয় হয়, বাবা যদি সংসার ফেলে চলে যায়? তবে কী হবে? অতগুলো ভাইবোনকে কে খাওয়াবে?
দাদিজান আজিবুন্নেসা বলেছিলেন, এই বংশের লোকেদের নাকি সংসারে মন নেই। যখন তখন চাইলেই দূর দূরান্তে চলে যায়, আর ফিরে আসে না। এসব কথা ভাবলেই কুসুমের মন খারাপ হয়। বড়’বুর ঘরে গেলে প্রতিদিনই সে একই প্রশ্ন করে- ‘কিরে কুসুইম্যা, ‘তোর বাফ বাড়িত ফিরস্যানি? ট্যাহাপয়স্যা ফাই্সে কিসতা? তরে কইসিলামনা যে বাজারর ব্যাগডা আগুইয়া দিত্যা, দিসিলি? তর মায়ে তো আবুদুবই সামলাইতারেনা। কফাল আমরার!’
কুসুম মাথা নেড়ে বলে, ‘না’।
দাদিজান কিনকিন গলায় রেগে উঠে বলে, ‘দড়িত বাইন্দ্যা মাছ লয়্যা গেরামের রাস্তা দিয়া আইট্টা আইলে ওই মাছ কি আর বাড়িত আইবো? চ্যাঁফা, আলুগুডা বত্তা, আর লাউ ডগা ছাড়া তুমরার কফালো আর কিসু যুটতনা। এইত্যা বাউইর্যা বংশের দুষ!’
কুসুমের দাদাজান ছফরুদ্দিন মিয়ার জন্ম হয়েছিল ১৮৯৯ সালে। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চণ্ডীপাশা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াকালে ষোল বছর বয়স থেকেই তিনি জায়গীর থেকে পড়াশুনা শুরু করেন। তার এই কঠিন তপস্যার কারণেই ধীরে ধীরে মিয়া বাড়ির বেশ নামডাক হতে শুরু করে। ছফর মিয়া বিয়ে করেছিলেন কালীগঞ্জ গ্রামের আজিবুন্নেসাকে। চার সন্তান নিয়ে তাদের ভালোই দিন কাটছিল।
ঐ সময়ে মুহম্মদ ওয়াজিদ ছিলেন বরিশাল আদালতের ফৌজদারি উকিল। ওয়াজিদ পরিবারের সাথে মিয়া বাড়ির বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। সময়ে অসময়ে তিনি ছফরুদ্দিন মাস্টরকে ডেকে পাঠাতেন। মামলার নথিপত্র যোগাড় আর যুক্তিতর্কের কাজে ছফরুদ্দিনের তুলনা ছিল না। পরবর্তীতে ওয়াজিদ পরিবারের নাম ডাক বেড়ে গেলে সম্পর্কটা ঢিলেঢালা হতে শুরু করে। মাস্টরের ডাক কমে যেতে থাকে। তবে ভাগ্য ভাল যে মুসুল্লি ইস্কুলের মাস্টারিটা তার বহাল ছিল। নইলে পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে টিকে থাকাটাই মুশকিল ছিল।
ছফরুদ্দিন মিয়ার প্রথম সন্তান কাদের মিয়ার পড়াশুনার প্রতি বিশেষ ঝোঁক থাকায় সে মফসঃলে পড়া শেষ করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকায় চলে যায়। দ্বিতীয় পুত্র আবু মিয়া গান বাজনার শখের কারণে যাত্রা-দলে যোগ দেয় আর দূর দূরান্তে ঘুরতে থাকে। নিয়মের মধ্যে তাকে আর সংসারে পাওয়া যায় না। তিন নম্বর, গুনু মিয়ার পাখির সখ ছিল। সে বাড়িতে নানান জাতের পাখি পালতে পালতে নিজেই ঘরছাড়া হয়ে উড়ে যায়। লোকে বলে পাখির বিষ শরীরে ঢুকে মরে গেছে মানুষটা। চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট জন ইসহাক মিয়া হাল চাষ ছাড়া আর কিছু শেখেনি জীবনে। আর সবচেয়ে ছোটবোন রিজিয়ার বিয়ে হয়েছিল রসুলপুর গ্রামের ইন্সুরেন্স কোম্পানির চাকুরে কাসেমুল হকের সাথে। চার সন্তান জন্মের পর কাসেম হাঁপানি রোগে মারা যান আর সেই থেকে রিজিয়ার কঠিন বিধবা জীবন গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে থাকে। গ্রামের মানুষ বলাবলি করে-- ছফর মাস্টরের অল্প বয়সে মৃত্যু না হলে ছেলেপুলের এই দুর্গতি হতো না।
কুসুমের বাবার ইসহাক মিয়ার মেজো ভাই আবু মিয়া বয়সে তার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। ফুর্তিবাজ বলে সকলের বাড়িতেই তার ডাক পড়ে। জমিজমা যা ছিল কিছুই ধরে রাখতে পারেনি সে। সব বেচে খেয়ে খুয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যায় সে। সেখানেই তার স্ত্রী অসুস্থ অবস্থায় মারা যায়। উপায়ন্তর না থাকায় নিঃসন্তান আবু মিয়া ফিরে আসেন নিজ ভিটায়। যদিও তার ভাষ্যে সে শুধু মাটির টানেই ফিরে এসেছে। ভিটে না থাকলে কি হয়, ভিটের ঘ্রাণতো আছে। তাই বুকে নিয়ে থেকে যান তিনি কালিগঞ্জ গ্রামে।
আবু মিয়া যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে আসে তখন কুসুমের বাবা ইসহাক মিয়ার বেপাত্তা হয়েছে। তারপর থেকেই তিনি এ বাড়ির সব কিছু দেখাশুনা করেন।
আবু মিয়া কুসুমের মা লতিফার সামনে বাজারের থলেটা থপ করে রেখে দিয়ে বলে,‘এই ঘ্যানঘ্যানিডারে রোইদের মদ্যে লগে লয়া এক্কবারে ঠাট মাইরালচি। ব্যাবাক বেইট্টানের এক স্বভাব। নাহো ফুল, হাতো চুড়ি, বায়নার শ্যাষ নাই। ট্যাহা আসে আমরার? অত করতাম ফারি?’
কুসুম অবাক হয়ে আবুকাকার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেকি জানতো যে সে একটা ঘ্যানঘ্যানি মেয়ে? আর সে একবারের জন্যেও তো নাকফুল বা চুড়ি চায়নি! মিথ্যে কথা বলছে কাকা। লোকটাকে বড় অপরিচিত লাগে তখন তার। বড়পাড়ার ইস্কুলের পিছনে ডোবার ধার ঘেঁষে ম্যালা লেবু বাগান। তাতে বড় বড় এলাচি লেবু ধরে ছিল। পাহারাদার এদিক সেদিক গেলেই লেবু চুরি যায়। সেই চুরির সময়ই আবুকাকার সাথে তার প্রথম দেখা। এর আগে লোকটাকে কখনও দেখেনি সে। পরে না জানলো, এটা তারই বাবার ভাই। কাছের মানুষ এত বেইমান কি করে হয়?
একদিন ঝকঝকে দুপুর। দাদিজানচুল মেলে দিয়ে রোদ পোহাচ্ছিল উঠোনে। গরম বাতাসে জ্বালা করছিল তার শরীর। আবুকাকা এলো হৈ হৈ করতে করতে। ্দাদিজানকে বলল, রেডু শুনবা, মা? দাদিজান উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,'রেডু কি’রে বাজান? আবুকাকা ্তার কানে রেডিওটা ধরে বললো- ‘গান হুনতাম ফারবা’। বুড়ো মানুষ, কানে কম শোনে, কিন্তু ফোকলা দাঁতগুলো বের করে বলে, ‘হনতাম ফারিগো বাপ’ আমরার দ্যাশর কলের গান। এইতা কইরা কি দিন যাইব ? ট্যাহা ফয়সা লাগতোনা? রেডু হুইন্যা বাত খাইতাম ফারবি?
রেডিওতে খর খর শব্দ হয়। দাদিজান আরো কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘এই ব্যাডা ক্যাডা? শ্যাখ শাব কি মইরা গ্যাসে'? মায়ের কোন কথা আবুর কানে যায় না। সে মহা আনন্দে লাফাতে লাফাতে রেডিওটা বগলদাবা করে পুকুরঘাটে গিয়ে বসে। পেছন পেছন তাকে অনুসরণ করে গাদা গাদা পোলাপান। এদের মধ্যে একদল হুড়মুড় করে জলে লাফিয়ে পড়ে। কুসুমের গায়ে কোন জামা নেই। দড়ির মতন লম্বা চুল। তেলহীন খরখরা। সেও ঝাঁপ দেয় জলে। ঘোলা জল। ডুব দিলে কাদা ধরা যায়। হাতের মুঠোয় উঠে আসে শুকনো ডালপালা, কাচের শিশি। কলাগাছের একটা ভেলা ভাসছে। তাতেই চড়ে বসে কুসুম । শুনতে পায় আবুকাকা কানে রেডিও ধরে হাসি হাসি মুখ করে ওদের সাঁতার কাটা দেখছে।
পুকুর থেকে উঠে এলে আবুকাকা প্রশ্ন করে- ‘কিরে, ঠাণ্ডা লাগতো না? ফিরান কুই? এক্কানই ঘডিপ্যান্ট’? কুসুম কোন জবাব দেয় না। গা বেয়ে টপ টপ জল ঝরে। লতিফা ডাকে...’কু......সুম’, শব্দটা যেন সারা পুকুরঘাট এলোমেলো করে ঘুরে ঘুরে এসে ছড়িয়ে পড়ে। বাবা ডাকে, কুস্যুম্যা-----পাড়াতো বোনেরা ডাকে, কুইশ্যা, শুধু আবুকাকা ডাকে কুসুম। নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কোন নামটি ওর জন্যে মানানসই।
পুকুর-ঘাটে সারি সারি সুপারীগাছ। একটার সংগে আরেকটার সামান্য দূরত্ব। বা দিকটায় বড় বড় দুটো নারকেল গাছ। বাঁকা হয়ে জলের ওপর পাতাগুলো মেলে দিয়েছে। ডাব কাটলেই সেগুলো সরাসরি জলে পড়ে আর ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ হয়। বাড়ির ভেতর থেকে বড়বু টের পান,ডাব চুরি যাচ্ছে। গভীর রাতে সে তার চিনচিনে গলায় চিৎকার করে ওঠেন; ‘কুন ছ্যাড়া ডাব পারেরে...? শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে...... ডাব পারেরে...ডাব পারেরে...ডাব..পারেরে....আমরার সব গ্যালো...সব গ্যালো...।‘ কুসুম ভয় পায়। মনে মনে ভাবে, তাকে কেন এই বুড়ির পাশে শুতে হয়?
অতগুলো ছেলেপুলে নিয়ে ইসহাক আর লতিফা নিজেদের ছোট্ট ঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকে। তাই কুসুমকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে দাদিজানের ঘরে। প্রায় রাতেই কারণে অকারণে ঘুমের ঘোরে তিনি চিৎকার করে উঠেন। কুসুমের ঠিকমত ঘুম হয় না। আবুকাকার আলাদা ঘর নাই। তিনি দাদিজানের ঘরের বারান্দাতেই শক্ত খাটিয়ায় ঘুমান। রাত বাড়লে যখন দাদিজানের কাশিটা বাড়ে, কুসুম বুঝতে পারে আবুকাকা শান্ত গলায় বলছে; ‘গুমা, মা; আমরার বাড়িত ভূত নাই, ডরাস ক্যান?’ কিন্তু তারপরও কুসুমের ভয় পায়।
বাড়ির পিছনে একা যেতেও তার ভয় হয়। বাঁশঝাড় আর জংলী গাছে ভরে আছে জায়গাটা। কুসুমের বড় কাকা কাদের মিয়া গেলবছর এই জমি বেঁচতে এসেছিলেন। যুতসই দামে বনেনি বলে ফেলে গেছে। তার মা আজিবুন্নেসা যুদ্ধের সময়ও স্বামীর ভিটা ত্যাগ করেননি। মিলিটারিরা খাবার দাবার যা পেয়েছে সব নিয়ে গেছে। তবে বুবুর কোন ক্ষতি করেনি। জীবন দিয়ে ভিটামাটি আঁকড়ে পড়েছিল সে। আর এখন স্বয়ং গর্ভের সন্তানই ভিটেসহ যা কিছু ধানী জমি আছে সব বিক্রি করে দিতে চায়। বাড়ির পেছনের জঙ্গলের কুয়াশা, প্রতিটা পাতা, প্রতিটা শিকড় আকঁড়ে ধরে বেঁচে আছে যে বুড়ো মা’টা, তার এখন হারাবার ভয়। বাড়ির পেছনটা আড়ালের জন্য আর কিছু যখন অবশিষ্ট থাকে না, তখন দাদিজান কুসুমকে নিয়ে দিনরাত পাথর জড় করে, পাঠখড়িগুলো গুনে গুনে বেঁধে রাখেন। কুয়াশাগুলো জাপটে ধরে পাথরের দেয়ালে পুতে দেন। বাশঁঝাড়ের ঠিক পরেই রসভরা ধানী জমিটা বর্গা দেয়া। ওটাকে টপকে শুধুমাত্র এই জঙ্গলটা কেউ কিনতে চায় না, তাই বোধহয় এখনো মাটিটা মিয়া বাড়ির ঠিকানা হয়ে আছে।
সেদিনকার সন্ধ্যেটা অন্যরকম ছিল। ইসহাক জাল ফেলেছিল খালে। কাঁচকি, চাপিলা, ট্যাংরা, পুঁটি সহ নানা রকম পাঁচ মিশালী মাছ উঠেছে । এত্ত এত্ত ছোটমাছ দেখে বড়’বুর সখ হলো তিনি রান্না করবেন। দুটো মাটির চুলায় গনগন করে আগুন জ্বলছে। উঠোনের এক কোণায় বাঁশের বেঞ্চিতে বসে আবুকাকা রেডিওর এন্টিনা ঘোরাচ্ছে। হঠাৎই একটা ভারি কণ্ঠ কথা বলতে শুরু করলো; ‘রাখী...ও রাখী, ও আমার লক্ষ্মীসোনা রাখী, তুই আমার অবুঝ মনের সবুজ টিয়াপাখি...এই গানটার জন্য অনুরোধ পাঠিয়েছেন- ঢাকা থেকে টুটুল, পুতুল,নাজ,সাজ; মৌলভিবাজার থেকে তরিক, হাসান, হোসেন এবং আরো অনেকে। আর তখনই পাশের উঠোন থেকে ধূলোবালিমাখা নোংরা পোলামান হৈ হৈ করতে করতে আবুকাকা’কে এসে ঘিরে ধরলো রেডিও শোনার জন্য। কুসুমেরও ইচ্ছে হলো, ছুটে যায়। কিন্তু বড়’বু তার সত্তর বছরের লিকলিকে হাত দিয়ে জোরে কুসুমের জামা টেনে ধরে রাখলেন। কুসুম গাট হয়ে বসে মাটির চুলোয় ভুষি ঢালতে থাকলো আর দাউ দাউ করে আগুনের তাপ ওর চোখে মুখে এসে লাগলো। লতিফা তখন চাপকল থেকে এক কলস জল এনে বুবু’র পাশে রাখছিল। তারপর সেও মাছ কুটতে বসে গেল। কুপি বাতিদুটো জ্বালিয়ে দিয়েছে কুসুম। সলতেগুলো জ্বলছে দাউ দাউ। উঠোন অন্ধকার হতে হতে রান্নাও শেষ হয়ে যায়। বাড়ির সকলে মিলে সেদিন অনেক আনন্দ করে মাষকলাইয়ের ডাল আর ছোটমাছের চচ্চরি দিয়ে গরম ভাত খায়।
ঘুমোবার আগে পুরনো কারুকাজ করা কাঠের খাটে শুয়ে বড়কাকার গল্প করছিলেন দাদিজান। টিনের চালের ছায়া ওর শরীরে অন্ধকার ডেকে আনছিল। কুসুমের সাথে বকবক করতে করতে ঘুমাতে যাবার অভ্যাস তার। কুসুম হাঁটুর উপর কাঁথাটা টেনে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- ‘ডাকায় কি আমরার দ্যাশর লাহান বড় বড় বাতাসা ফাওন যায়, দাদিজান? একটা দ্বীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রেখে আজিবুন্নেসা বলেছিল; ‘কিসতা ফাওন যায়না, তুই গুমা।‘
কুসুমের অনেক সখ ছিল ঢাকায় বড়কাকার বাড়ি দেখবে। কিন্তু দাদিজান বলতেন, উনি কখনও কুসুমকে শহরে যেতে দেবেন না। মেরেঙা গ্রামের প্রতিটা খোলা জমি আর পোকাদের গুনগুন করা বাতাস নাকি উত্তাপ ছড়ায়, গ্রামদেশ ছাড়া আর নাকি কোন দেশই নাই।
সেই রাতে পুকুরপাড়ে কোন শব্দ হয় না, ডাবও চুরি যায় না। ঝিলমিল বয়ে চলা মেরেঙা খাল ঝিম মেরে পড়ে থাকে। দাদিজান কোন নড়াচড়া করে না। ভোররাতে মসজিদে আযান পড়লে বারান্দায় বদনার পানিটা তেমনিই পড়ে থাকে। দরজার ফাঁক গলে রোদের ছটা ঘরে ঢুকলে কুসুম দেখতে পায় তার পাশে কাঠ হয়ে শুয়ে আছে আজিবুন্নেসা। ভয়ে ভয়ে ছুঁয়ে দেখে শরীরটা ঠাণ্ডা বরফশীতল। চোখ দুটো আকাশমুখো তাকানো, পাথর স্থির। টিনের চালের ফুটো গলে দাদিজান কি তারা খুঁজছিল? কর্কশ স্বরে কা কা করতে করতে একটা কাক মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়।
কুসুম তীব্র স্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠে......দা-দি-জা-ন......................।
আবু মিয়ার মুখটা কিচ্ছুক্ষণ উদাস থেকেই সব বেদনা মুহূর্তে উবে যায়। শুয়ে শুয়ে সে ভাবতে থাকে, যাক বাবা বাঁচা গেল, বুড়িটা মরলো। পুরো ঘরটা দখল করে বাকি জীবন কি আরামেই না কাটানো যাবে। খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে মাজায় ব্যাথা ধরে যাচ্ছিল। পকেট হাতড়ে বিড়িটা খুঁজে পায় সে। নিভু নিভু হারিকেনের আগুন থেকে বিড়িটা ধরায়।
তারপর, একটা লম্বা সুখটান। আহ!
১/৬/২০১৬
টরন্টো, কানাডা
0 মন্তব্যসমূহ