সিডনীতে আসার আগেই অবিনাশ আলেস্টার ক্রাউলির কথা জানত। সে নাকি পৃথিবীর সবচাইতে শয়তান লোক। আক্ষরিকভাবে। লোকটা শয়তান নামাত। হেন স্যাটানিক কাল্ট ছিল না যা সে জানত না। সময়টা বিশ শতকের প্রথমার্দ্ধের ইংল্যান্ড। ভারত তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ। লোকটা অকাল্ট থেকে কবিতা, পাহাড় থেকে পর্বত ঘোরাফেরা করত। নিজে ‘থেলেমা’ নামে ধর্ম-দর্শন প্রবর্তন করেছিল। সে ছিল তার নিজের ধর্মের স্বঘোষিত প্রফেট। শোনা যায় মাউনটেনিয়ার ক্রাউলি হিমালয়ে এসেও কাঞ্চনজঙ্ঘায় উঠতে না পেরে ব্রিটেন ফিরে যায়।
পাহাড়ী সান্যালের দর্শন নসীব হয়নি তার। লোকটা নাকি হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মে আগ্রহী ছিল। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ক্রাউলি কলকাতায় চিকিৎসাধীন ছিল বিশ শতকের শুরুর ব্রিটিশ ভারতে। তখনও K2 জয় করার কোন ইতিহাস ছিল না আর ক্রাউলির সাহেব রক্তও বিশ হাজার ফিটের বেশি সুবিধা করতে পারেনি। অবিনাশ এসব মার্টিন বুথের ক্রাউলি-জীবনী থেকে জেনেছিল। লোকটা ভারতে বসে কবিতাও লিখেছিল আবার খুনও করেছিল। একজন ভারতীয়কে খুন করার পর তাকে দেশ ছাড়তে হয়। ক্রাউলি কি পৃথিবীর ধবংস চাইত? প্রাণের ধ্বংস? আর অবিনাশ, সে কি চায়? ক্রাউলিকে তার জীবদ্দশাতেই ‘the wickedest man of the world’ বলা হত। ভাগ্যিস। অবিনাশের তো ধারণা ছিল এ মুকুট একান্তই তার! কিন্তু নাহ, পৃথিবী অনেক বড়, অনেক ভাষা, অনেক দেশ, অনেক মন্দভালো লোক। নাহ, কতটাই বা আর খারাপ হওয়া গেল শেষমেষ?
তা এই আলেস্টার ক্রাউলির এক প্রেমিকা ছিল যার নাম লীলা ওয়াডেল। অবিনাশের তো লীলা বললেই মজুমদার মনে পড়ে। কিন্তু নাহ, পৃথিবীতে কি আর লীলার অভাব আছে? লীলা ছিল ডাকসাইটে সুন্দরী, অস্ট্রেলিয়ান, শিকড়ে তার আয়ারল্যান্ড। সে ভায়োলিন বাজাতো। শোনা যায় ক্রাউলির স্যাটানিক কাল্টে সঙ্গীত-সঙ্গ দিতে দিতেই তাদের সম্পর্ক। বিয়ে অবিশ্যি হয়নি। ক্রাউলির বেলেল্লাপনাই কাল হয়! থেলেমার জাদু-দুনিয়ায় লীলা শুধু ভায়োলিনিস্ট ছিল না, সে ছিল 'বাবালন' অর্থাত পৃথিবীমাতা--নারীর মুক্ত যৌনতার প্রতীক। বিশ্বাসমতে তার মাংস মানুষের ন্যাংটো আত্মার কাপড়। পৃথিবীর কাপড়। ক্রাউলির কাছে লীলা ছিল সেই প্রেতযোনি যার ভেতর দিয়ে সারা পৃথিবীর রক্ত বয়ে চলেছে। ব্যাবিলন থেকে বাবালন আর মা থেকে বেশ্যা, প্রেতের মা আর বাবা! কতটাই বা জানা গেল?
আসলে অবিনাশের এই ক্রাউলি-লীলাখেলা শুরু হয়েছিল একটা গোয়েন্দা গল্প থেকে। বিদঘুটে গল্পখানা কে লিখেছিল মনে নেই। বন্ধুর বাড়ির টেবিলে রাখা লিট-ম্যাগ থেকে রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলেছিল, আর গল্পটাও তাকে...নাগাড়ে, অনায়াস। গোয়েন্দা কিন্তু গোয়েন্দা নয় সে গল্প। একটা লোক নিজেকে ক্রাউলি, আরো সব কাদের যেন, উত্তরসূরী ভেবে নিয়েছিল। সেই তার অপরাধ-জীবনের শুরু। গোয়েন্দা দিয়ে শুরু হয়ে গল্প শেষ হয়েছিল ক্রিমিনালের ডায়েরীর ভেতরে। নিজেকে একুশ শতকের ক্রাউলি ভেবে নেওয়া সেই অসুস্থ লোকটার বিকৃত যৌনযাপনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল, যেন পৃথিবীটা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। অবিনাশ তখন স্বদেশে। বাড়ির লোকজনকে গল্পটা একটু-আধটু বলতে শুরু করামাত্র তারা তার মানসিক ও নৈতিক ভারসাম্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। গল্পটা কোথায় যেন খপ করে ধরেছিল। হরর ফিল্মের পোকা অবিনাশ তারপর থেকেই ক্রাউলি-কাতর। এখন কি আর পাওয়া যাবে গল্পটা? হয়ত না, তবে ক্রাউলি-লীলা রয়ে গ্যাছে।
আশেপাশে মিল না থাকলে কতকিছুই চোখে পড়ে না। ক্রাউলির জীবন নিয়ে মাঝে মধ্যে অনলাইন পড়াশোনা (দেখাশোনা) করা স্বত্ত্বেও আগে খেয়ালই হয়নি যে লীলা আদতে সিডনীর লোক। ১৯২৩ এ ক্রাউলি-পর্ব শেষ করে সে সিডনী ফেরে বৃদ্ধ বাবা-মার দেখাশোনা করতে, বাজনা কিন্তু চলতে থাকে। শয়তানের প্রেমিকা ইস্কুল শিক্ষিকা হয়। ন'বছর পর ক্যান্সারে অবিবাহিত লীলার মৃত্যু হয়। ১৯৩২র ১৪ই সেপ্টেম্বরের সিডনী মর্নিং হেরাল্ডে যে অবিচুয়ারী বেরিয়েছিল, মজার ব্যপার হলো তাতে কোথাও ক্রাউলির উল্লেখ নেই। হয়ত লীলা ও তার পরিবার দুঃস্বপ্নের মতই ভুলে যেতে চেয়েছিল তাকে। অবিচুয়ারী জুড়ে ছিল লীলার সাঙ্গীতিক প্রতিভার কথা। আর যেটা ছিল না, তা হল তাকে কোন কবরখানায় সমাধিস্থ করা হয়েছে সেই ডিটেইল। কর্মসূত্রে অবিনাশ এখন সিডনীতেই! আর কে পায়? মানুষ মরে গেলে সে যতই শয়তান হোক, তাকে ভালো বলে চালাবার একটা মনুষ্য প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অবিনাশকে অবশ্য বেশির ভাগ লোক খারাপ বলেই জানে। অবিনাশ নিজেও খানিক তেমনই মানে। বাকিটা ব্যক্তিগত...এমন গ্রেভ-হান্টিং এর হন্টিং সুযোগ কি আর ছেড়ে দিতে পারে? অতএব গোরস্থানে সাবধান!
সিডনীতে নয় নয় করে কবরখানার সংখ্যা নেহাত কম নয়। শহরের একটু বাইরে লিডকম্বে সুবিশাল রুকউড সেমেটারী রয়েছে। সেখান দিয়েই শুরু করেছিল অবিনাশ। হাতে ক্লু বলতে একটাই। কোন এক অনলাইন ক্রাউলি-নার্ড কলিন ম্যাকলীয়ডের তোলা সন্দেহজনক ছবি যেখানে লোকটা কবরখানার কোণে ফাঁকা এক জায়গায় একটা ব্যাগ বসিয়ে বলেছে, ওটাই নাকি লীলার আনমার্কড গ্রেভ। যত্তসব! লীলা বেশ বিখ্যাত ভায়োলিনিস্ট ছিল, ইউটিউবে তার ভায়োলিনও শুনেছে অবিনাশ। সে এক সম্মোহক সঙ্গীত। যেন অন্ধকারে দূরপথে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু অডিওর নীচে কমেন্ট সেকশন পড়ে দেখেছে সেখানে একজন জানিয়েছেন কম্পোজিশন লীলার হলেও রেকর্ডিং অন্য কারুর করা। তাতে কি সম্মোহন ভেঙে গেছে? ঠিক তা নয়। ইন্টারনেট তো এমনই! সেও কি রহস্য কম জানে? লীলা এমন কিছু প্রাগৈতিহাসিক যুগে মারা যায়নি অথচ তার কবর চিহ্নহীন কেন এটা একটা প্রশ্ন। কলিন লোকটা ভাঁওতা মারুক আর নাই মারুক, কোথাও থেকে কোন তথ্য না পেয়ে অবিনাশের মনে এই রহস্য থেকেই গেছিল । মাটির মাংস কি মাটিতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল?
ক্রাউলি লীলাকে লায়লা বলে ডাকত। একসাথে বসে তারা অকাল্ট পড়ত আর হ্যালুসিনোজেনিক নিত। সে ক্রাউলির ছাত্রী ছিল আবার মিউসও। ক্রাউলির বহু কবিতা ও গল্প লায়লাকে নিয়ে লেখা। লায়লার শেষ চিহ্নের খোঁজে অবিনাশ সিডনীর কবরখানাগুলোয় উইকএন্ড কাটাতে লাগলো। হাতে কলিন ম্যাকলীয়ডের সেই জালি মার্কা ছবি। রুকউডে লায়লার লীলা না মিললেও সারাদিনের হাঁটায় নানা অনুভব শিহরণ গজিয়ে উঠলো। কবরখানার একদিক থেকে অন্যদিকে নতুন থেকে ক্রমে পুরনো হতে থাকা কবরে টাটকা ফুলের তোড়া থেকে মাটি ফুঁড়ে, ভেঙ্গে গাছ হয়ে ওঠা টুম্বস্টোন--সময়ের বহতা রং বেরং দেখে অবিনাশের একটু উদাস লাগতে লাগলো। মৃতের পরের প্রজন্ম আর তারপর বড়জোড় আরেকটা। দুই প্রজন্ম পেরিয়ে গেলে কবর ভূতে পায়। আর কারো মনে থাকে না। 'In loving memory' তখন বিস্মরণে চুরমার। মাটির নিচে বহুযুগের রক্তমাংসের ধুলো। নিথর শরীরগুলোর আনুভূমিক অতীতের ওপর উল্লম্ব বর্তমান বলতে অবিনাশ। বিদেশের কবরখানায় বৈচিত্র বেশি। খ্রিষ্টধর্মের আলাদা আলাদা সেক্ট থেকে পেগান গ্রেভস, বিশ্বযুদ্ধের নানা কবর--কত কি! আর তার জন্য অপেক্ষমান লেলিহান শিখা। রবিবারগুলো মৃতদের সাথেই কাটাতে লাগলো অবিনাশ। সন্ধেবেলা কবরখানায় হাঁটা বারণ হলে শহরে ফিরে পানশালায় ঢুঁ মারত। রক্তের আগুন দেখেছ কখনো?
রুকউডের পর কয়েকটা ছোটখাটো কবরখানা সেরে ব্রন্টি বীচের পাশের ওয়েভরলি সেমেটারীতে এসে পৌঁছলো অবিনাশ। সমুদ্রসৈকতের জীবনস্রোতের পাশেই মৃতদের নিরবতা। আকাশে একফোঁটা মেঘ ছিল না। দিনের নীল যে কখন সন্ধ্যের ডুরে হয়ে গেল টেরই পেল না। ফটোগ্রাফে কলিন যে জায়গায়টায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখান থেকে ছবির বাঁদিক ধরে দিগন্তে তাকালে টুম্বস্টোনগুলো ছাড়িয়ে বিশাল ফাঁকা বিস্তার চোখে পড়ছে। সেখানে স্কাইলাইনে কোনো হাইরাইজ নেই। যেন একরাশ জল লুকিয়ে রয়েছে ছবির ঐখানে। আর সিডনীতে বীচের পাশে বড়সড় কবরখানা যা কিনা আবার ১৯৩২ সালে ছিল এরকম কন্টেনডার বলতে ওয়েভরলিই। কিন্তু এ খোঁজ যে এমনিতেই বৃথা। ছবিতে যে ফাঁকা সবুজ ঘাসে ভরা জায়গাটাকে লায়লা তথা লীলার কবর বলা হয়েছে সেখানে তো কিছুই নেই। সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে অবিনাশের মনে হল সে ঐ নেইটাকেই যেন খুঁজতে এসেছে। বিশাল কবরখানার কত যে অমন কোণ আছে কে জানে। এদেশে কবরখানায় প্রেম করার চল নেই বলে বাঁচোয়া নাহলে এই আসন্ন সন্ধ্যায় ভয়ারবাজি হয়ে যেত। এখানে কিছুক্ষণ পরপর ফিটনেস ফ্রিক ছুটন্ত মানুষ নামের একেকটা ঘটনা, তারপর আবার কবরের শান্তি। পড়ন্ত আলোয় তার মত দুএকটা লোক ইতি-উতি কবর খুঁজে ফিরছে। অবিনাশ একটা বেঞ্চ দেখে বসে পড়ল। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। স্মার্টফোনে ইউটিউব ধরে আলতো করে লীলার কম্পোজিশন 'A Tone Testament' চালিয়ে দিল। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিতেই আকাশে চাঁদ দেখা গেল। লীলার ইউটেরাসে ক্যান্সার হয়েছিল। মারক রোগই তার জন্মহীন শিশু। তাকে আকাশ জোড়া মৃত্যুর মা মনে হলো অবিনাশের, সঙ্গীত শুনতে শুনতে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো। ভায়োলিনের বাজনা থেমে যেতে না যেতেই অর্দ্ধঘুমন্ত অবিনাশ আকাশের ঘোরের ভেতর শুনতে পেল নারীকন্ঠে কে যেন মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গীতে বলছে:
"Dirt is matter in the wrong place.
Thought is mind in the wrong place.
Matter is mind; so thought is dirt."
অবিনাশ চোখ খোলার চেষ্টা করেও পারেনি যতক্ষণ না কানে গুনগুনানো অক্ষরগুলোর গর্তের ভেতর একটু একটু করে ঢুকে পড়েছিল তার শরীর। ধুলো হয়ে গেছিল রক্তমাংস। শয়তানের আকাশে তখন ফেরারী মেঘের পানসি। 'ডার্ট' শব্দটা প্রথম লাইন থেকে তৃতীয় লাইনে ফেরত আসার আগেই অবিনাশের শরীরের ওপরদিকটা, কোমরপর্যন্ত গলে রক্ত হয়ে গেছিল। এরপর সেই রক্তের পুকুর শুনেছিল বাকি লাইনগুলো:
"And worship Him that swore by His holy T that One
Should not be One except in so far as it is Two.
I am glad that LAYLAH is afar; no doubt clouds love."
এই লাইনগুলো বেঞ্চের ওপর পড়ন্ত রক্তের পুকুরের মধ্যে রাখা ইয়ারফোন থেকে আলতো স্বরে বেরিয়ে এসেছিল। ওয়েভরলিতে তখন ফিটনেসের ছোটাছুটির শেষে অন্ধকার নেমেছিল। অন্ধকারে রক্ত আরো নিকষ কালো হয়ে উঠেছিল। আর সমুদ্রের হাওয়ায় বালির শরীরে ধুলো এসে মিশছিল।
সেদিন ছিল ২০১৪র ১৬ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানের পেশাওয়ারের এক আর্মি পাবলিক স্কুলে ঢুকে সাতজন সন্ত্রাসবাদী ১৩২টি বাচ্চাকে হত্যা করে। জঙ্গী সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান ঘটনার দায় নিয়ে জানায় ওয়াজিরিস্থানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মিলিটারী ফোর্সের আগ্রাসনের বদলা এই আক্রমণ। বাবার অস্ত্রের খেসারত দিতে হয়েছিল ছেলেদের। দুদিকেই রক্তপাত। ক্লাসরুমের বেঞ্চে বেঞ্চে রক্তের পুকুর জমাট বেঁধে ছিল। অবিনাশকে খবরের কাগজে বা অনলাইন সেসব আর দেখতে হয়নি। সে রক্তপাত থেকে ধর্মপাতের শয় তানে গলে গিয়ে মহাকাশের ভায়োলিন হয়ে উঠেছিল। লায়লার প্রেতযোনির ভেতর ক্রাউলি তখন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন উপনিবেশের হালহকিকত দেখে মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। সে নির্দয় হাসি যেন বলছে, কতই বা আর খারাপ হতে পারে শেষমেষ? কতটা?
পাহাড়ী সান্যালের দর্শন নসীব হয়নি তার। লোকটা নাকি হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মে আগ্রহী ছিল। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ক্রাউলি কলকাতায় চিকিৎসাধীন ছিল বিশ শতকের শুরুর ব্রিটিশ ভারতে। তখনও K2 জয় করার কোন ইতিহাস ছিল না আর ক্রাউলির সাহেব রক্তও বিশ হাজার ফিটের বেশি সুবিধা করতে পারেনি। অবিনাশ এসব মার্টিন বুথের ক্রাউলি-জীবনী থেকে জেনেছিল। লোকটা ভারতে বসে কবিতাও লিখেছিল আবার খুনও করেছিল। একজন ভারতীয়কে খুন করার পর তাকে দেশ ছাড়তে হয়। ক্রাউলি কি পৃথিবীর ধবংস চাইত? প্রাণের ধ্বংস? আর অবিনাশ, সে কি চায়? ক্রাউলিকে তার জীবদ্দশাতেই ‘the wickedest man of the world’ বলা হত। ভাগ্যিস। অবিনাশের তো ধারণা ছিল এ মুকুট একান্তই তার! কিন্তু নাহ, পৃথিবী অনেক বড়, অনেক ভাষা, অনেক দেশ, অনেক মন্দভালো লোক। নাহ, কতটাই বা আর খারাপ হওয়া গেল শেষমেষ?
তা এই আলেস্টার ক্রাউলির এক প্রেমিকা ছিল যার নাম লীলা ওয়াডেল। অবিনাশের তো লীলা বললেই মজুমদার মনে পড়ে। কিন্তু নাহ, পৃথিবীতে কি আর লীলার অভাব আছে? লীলা ছিল ডাকসাইটে সুন্দরী, অস্ট্রেলিয়ান, শিকড়ে তার আয়ারল্যান্ড। সে ভায়োলিন বাজাতো। শোনা যায় ক্রাউলির স্যাটানিক কাল্টে সঙ্গীত-সঙ্গ দিতে দিতেই তাদের সম্পর্ক। বিয়ে অবিশ্যি হয়নি। ক্রাউলির বেলেল্লাপনাই কাল হয়! থেলেমার জাদু-দুনিয়ায় লীলা শুধু ভায়োলিনিস্ট ছিল না, সে ছিল 'বাবালন' অর্থাত পৃথিবীমাতা--নারীর মুক্ত যৌনতার প্রতীক। বিশ্বাসমতে তার মাংস মানুষের ন্যাংটো আত্মার কাপড়। পৃথিবীর কাপড়। ক্রাউলির কাছে লীলা ছিল সেই প্রেতযোনি যার ভেতর দিয়ে সারা পৃথিবীর রক্ত বয়ে চলেছে। ব্যাবিলন থেকে বাবালন আর মা থেকে বেশ্যা, প্রেতের মা আর বাবা! কতটাই বা জানা গেল?
আসলে অবিনাশের এই ক্রাউলি-লীলাখেলা শুরু হয়েছিল একটা গোয়েন্দা গল্প থেকে। বিদঘুটে গল্পখানা কে লিখেছিল মনে নেই। বন্ধুর বাড়ির টেবিলে রাখা লিট-ম্যাগ থেকে রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলেছিল, আর গল্পটাও তাকে...নাগাড়ে, অনায়াস। গোয়েন্দা কিন্তু গোয়েন্দা নয় সে গল্প। একটা লোক নিজেকে ক্রাউলি, আরো সব কাদের যেন, উত্তরসূরী ভেবে নিয়েছিল। সেই তার অপরাধ-জীবনের শুরু। গোয়েন্দা দিয়ে শুরু হয়ে গল্প শেষ হয়েছিল ক্রিমিনালের ডায়েরীর ভেতরে। নিজেকে একুশ শতকের ক্রাউলি ভেবে নেওয়া সেই অসুস্থ লোকটার বিকৃত যৌনযাপনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল, যেন পৃথিবীটা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। অবিনাশ তখন স্বদেশে। বাড়ির লোকজনকে গল্পটা একটু-আধটু বলতে শুরু করামাত্র তারা তার মানসিক ও নৈতিক ভারসাম্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। গল্পটা কোথায় যেন খপ করে ধরেছিল। হরর ফিল্মের পোকা অবিনাশ তারপর থেকেই ক্রাউলি-কাতর। এখন কি আর পাওয়া যাবে গল্পটা? হয়ত না, তবে ক্রাউলি-লীলা রয়ে গ্যাছে।
আশেপাশে মিল না থাকলে কতকিছুই চোখে পড়ে না। ক্রাউলির জীবন নিয়ে মাঝে মধ্যে অনলাইন পড়াশোনা (দেখাশোনা) করা স্বত্ত্বেও আগে খেয়ালই হয়নি যে লীলা আদতে সিডনীর লোক। ১৯২৩ এ ক্রাউলি-পর্ব শেষ করে সে সিডনী ফেরে বৃদ্ধ বাবা-মার দেখাশোনা করতে, বাজনা কিন্তু চলতে থাকে। শয়তানের প্রেমিকা ইস্কুল শিক্ষিকা হয়। ন'বছর পর ক্যান্সারে অবিবাহিত লীলার মৃত্যু হয়। ১৯৩২র ১৪ই সেপ্টেম্বরের সিডনী মর্নিং হেরাল্ডে যে অবিচুয়ারী বেরিয়েছিল, মজার ব্যপার হলো তাতে কোথাও ক্রাউলির উল্লেখ নেই। হয়ত লীলা ও তার পরিবার দুঃস্বপ্নের মতই ভুলে যেতে চেয়েছিল তাকে। অবিচুয়ারী জুড়ে ছিল লীলার সাঙ্গীতিক প্রতিভার কথা। আর যেটা ছিল না, তা হল তাকে কোন কবরখানায় সমাধিস্থ করা হয়েছে সেই ডিটেইল। কর্মসূত্রে অবিনাশ এখন সিডনীতেই! আর কে পায়? মানুষ মরে গেলে সে যতই শয়তান হোক, তাকে ভালো বলে চালাবার একটা মনুষ্য প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অবিনাশকে অবশ্য বেশির ভাগ লোক খারাপ বলেই জানে। অবিনাশ নিজেও খানিক তেমনই মানে। বাকিটা ব্যক্তিগত...এমন গ্রেভ-হান্টিং এর হন্টিং সুযোগ কি আর ছেড়ে দিতে পারে? অতএব গোরস্থানে সাবধান!
সিডনীতে নয় নয় করে কবরখানার সংখ্যা নেহাত কম নয়। শহরের একটু বাইরে লিডকম্বে সুবিশাল রুকউড সেমেটারী রয়েছে। সেখান দিয়েই শুরু করেছিল অবিনাশ। হাতে ক্লু বলতে একটাই। কোন এক অনলাইন ক্রাউলি-নার্ড কলিন ম্যাকলীয়ডের তোলা সন্দেহজনক ছবি যেখানে লোকটা কবরখানার কোণে ফাঁকা এক জায়গায় একটা ব্যাগ বসিয়ে বলেছে, ওটাই নাকি লীলার আনমার্কড গ্রেভ। যত্তসব! লীলা বেশ বিখ্যাত ভায়োলিনিস্ট ছিল, ইউটিউবে তার ভায়োলিনও শুনেছে অবিনাশ। সে এক সম্মোহক সঙ্গীত। যেন অন্ধকারে দূরপথে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু অডিওর নীচে কমেন্ট সেকশন পড়ে দেখেছে সেখানে একজন জানিয়েছেন কম্পোজিশন লীলার হলেও রেকর্ডিং অন্য কারুর করা। তাতে কি সম্মোহন ভেঙে গেছে? ঠিক তা নয়। ইন্টারনেট তো এমনই! সেও কি রহস্য কম জানে? লীলা এমন কিছু প্রাগৈতিহাসিক যুগে মারা যায়নি অথচ তার কবর চিহ্নহীন কেন এটা একটা প্রশ্ন। কলিন লোকটা ভাঁওতা মারুক আর নাই মারুক, কোথাও থেকে কোন তথ্য না পেয়ে অবিনাশের মনে এই রহস্য থেকেই গেছিল । মাটির মাংস কি মাটিতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল?
ক্রাউলি লীলাকে লায়লা বলে ডাকত। একসাথে বসে তারা অকাল্ট পড়ত আর হ্যালুসিনোজেনিক নিত। সে ক্রাউলির ছাত্রী ছিল আবার মিউসও। ক্রাউলির বহু কবিতা ও গল্প লায়লাকে নিয়ে লেখা। লায়লার শেষ চিহ্নের খোঁজে অবিনাশ সিডনীর কবরখানাগুলোয় উইকএন্ড কাটাতে লাগলো। হাতে কলিন ম্যাকলীয়ডের সেই জালি মার্কা ছবি। রুকউডে লায়লার লীলা না মিললেও সারাদিনের হাঁটায় নানা অনুভব শিহরণ গজিয়ে উঠলো। কবরখানার একদিক থেকে অন্যদিকে নতুন থেকে ক্রমে পুরনো হতে থাকা কবরে টাটকা ফুলের তোড়া থেকে মাটি ফুঁড়ে, ভেঙ্গে গাছ হয়ে ওঠা টুম্বস্টোন--সময়ের বহতা রং বেরং দেখে অবিনাশের একটু উদাস লাগতে লাগলো। মৃতের পরের প্রজন্ম আর তারপর বড়জোড় আরেকটা। দুই প্রজন্ম পেরিয়ে গেলে কবর ভূতে পায়। আর কারো মনে থাকে না। 'In loving memory' তখন বিস্মরণে চুরমার। মাটির নিচে বহুযুগের রক্তমাংসের ধুলো। নিথর শরীরগুলোর আনুভূমিক অতীতের ওপর উল্লম্ব বর্তমান বলতে অবিনাশ। বিদেশের কবরখানায় বৈচিত্র বেশি। খ্রিষ্টধর্মের আলাদা আলাদা সেক্ট থেকে পেগান গ্রেভস, বিশ্বযুদ্ধের নানা কবর--কত কি! আর তার জন্য অপেক্ষমান লেলিহান শিখা। রবিবারগুলো মৃতদের সাথেই কাটাতে লাগলো অবিনাশ। সন্ধেবেলা কবরখানায় হাঁটা বারণ হলে শহরে ফিরে পানশালায় ঢুঁ মারত। রক্তের আগুন দেখেছ কখনো?
রুকউডের পর কয়েকটা ছোটখাটো কবরখানা সেরে ব্রন্টি বীচের পাশের ওয়েভরলি সেমেটারীতে এসে পৌঁছলো অবিনাশ। সমুদ্রসৈকতের জীবনস্রোতের পাশেই মৃতদের নিরবতা। আকাশে একফোঁটা মেঘ ছিল না। দিনের নীল যে কখন সন্ধ্যের ডুরে হয়ে গেল টেরই পেল না। ফটোগ্রাফে কলিন যে জায়গায়টায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখান থেকে ছবির বাঁদিক ধরে দিগন্তে তাকালে টুম্বস্টোনগুলো ছাড়িয়ে বিশাল ফাঁকা বিস্তার চোখে পড়ছে। সেখানে স্কাইলাইনে কোনো হাইরাইজ নেই। যেন একরাশ জল লুকিয়ে রয়েছে ছবির ঐখানে। আর সিডনীতে বীচের পাশে বড়সড় কবরখানা যা কিনা আবার ১৯৩২ সালে ছিল এরকম কন্টেনডার বলতে ওয়েভরলিই। কিন্তু এ খোঁজ যে এমনিতেই বৃথা। ছবিতে যে ফাঁকা সবুজ ঘাসে ভরা জায়গাটাকে লায়লা তথা লীলার কবর বলা হয়েছে সেখানে তো কিছুই নেই। সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে অবিনাশের মনে হল সে ঐ নেইটাকেই যেন খুঁজতে এসেছে। বিশাল কবরখানার কত যে অমন কোণ আছে কে জানে। এদেশে কবরখানায় প্রেম করার চল নেই বলে বাঁচোয়া নাহলে এই আসন্ন সন্ধ্যায় ভয়ারবাজি হয়ে যেত। এখানে কিছুক্ষণ পরপর ফিটনেস ফ্রিক ছুটন্ত মানুষ নামের একেকটা ঘটনা, তারপর আবার কবরের শান্তি। পড়ন্ত আলোয় তার মত দুএকটা লোক ইতি-উতি কবর খুঁজে ফিরছে। অবিনাশ একটা বেঞ্চ দেখে বসে পড়ল। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। স্মার্টফোনে ইউটিউব ধরে আলতো করে লীলার কম্পোজিশন 'A Tone Testament' চালিয়ে দিল। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিতেই আকাশে চাঁদ দেখা গেল। লীলার ইউটেরাসে ক্যান্সার হয়েছিল। মারক রোগই তার জন্মহীন শিশু। তাকে আকাশ জোড়া মৃত্যুর মা মনে হলো অবিনাশের, সঙ্গীত শুনতে শুনতে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো। ভায়োলিনের বাজনা থেমে যেতে না যেতেই অর্দ্ধঘুমন্ত অবিনাশ আকাশের ঘোরের ভেতর শুনতে পেল নারীকন্ঠে কে যেন মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গীতে বলছে:
"Dirt is matter in the wrong place.
Thought is mind in the wrong place.
Matter is mind; so thought is dirt."
অবিনাশ চোখ খোলার চেষ্টা করেও পারেনি যতক্ষণ না কানে গুনগুনানো অক্ষরগুলোর গর্তের ভেতর একটু একটু করে ঢুকে পড়েছিল তার শরীর। ধুলো হয়ে গেছিল রক্তমাংস। শয়তানের আকাশে তখন ফেরারী মেঘের পানসি। 'ডার্ট' শব্দটা প্রথম লাইন থেকে তৃতীয় লাইনে ফেরত আসার আগেই অবিনাশের শরীরের ওপরদিকটা, কোমরপর্যন্ত গলে রক্ত হয়ে গেছিল। এরপর সেই রক্তের পুকুর শুনেছিল বাকি লাইনগুলো:
"And worship Him that swore by His holy T that One
Should not be One except in so far as it is Two.
I am glad that LAYLAH is afar; no doubt clouds love."
এই লাইনগুলো বেঞ্চের ওপর পড়ন্ত রক্তের পুকুরের মধ্যে রাখা ইয়ারফোন থেকে আলতো স্বরে বেরিয়ে এসেছিল। ওয়েভরলিতে তখন ফিটনেসের ছোটাছুটির শেষে অন্ধকার নেমেছিল। অন্ধকারে রক্ত আরো নিকষ কালো হয়ে উঠেছিল। আর সমুদ্রের হাওয়ায় বালির শরীরে ধুলো এসে মিশছিল।
সেদিন ছিল ২০১৪র ১৬ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানের পেশাওয়ারের এক আর্মি পাবলিক স্কুলে ঢুকে সাতজন সন্ত্রাসবাদী ১৩২টি বাচ্চাকে হত্যা করে। জঙ্গী সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান ঘটনার দায় নিয়ে জানায় ওয়াজিরিস্থানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মিলিটারী ফোর্সের আগ্রাসনের বদলা এই আক্রমণ। বাবার অস্ত্রের খেসারত দিতে হয়েছিল ছেলেদের। দুদিকেই রক্তপাত। ক্লাসরুমের বেঞ্চে বেঞ্চে রক্তের পুকুর জমাট বেঁধে ছিল। অবিনাশকে খবরের কাগজে বা অনলাইন সেসব আর দেখতে হয়নি। সে রক্তপাত থেকে ধর্মপাতের শয় তানে গলে গিয়ে মহাকাশের ভায়োলিন হয়ে উঠেছিল। লায়লার প্রেতযোনির ভেতর ক্রাউলি তখন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন উপনিবেশের হালহকিকত দেখে মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। সে নির্দয় হাসি যেন বলছে, কতই বা আর খারাপ হতে পারে শেষমেষ? কতটা?
0 মন্তব্যসমূহ