
সূর্যটা একটু আগেই উঠতে শুরু করেছে। তীর্থনাথের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তালতলা যেতে যেতে ডগডগে দশায় চলে যাবে।হাসিম মৃধা কবিরাজ ততক্ষণে পাখিমারার উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন।তিনি বারবার বলেছেন, বাবারে, গান গাওয়া মামাবাড়ির আবদার না যে তুমি চাইলেই যখন খুশি গাইতে পারবা।এইটার সঙ্গে ভূমিমাতার আইনকানুন জড়িত। বর্ষাকালে বৃষ্টি হইবে, ধানের ডগা ফাল দিয়া বাড়বে। আবার শীতকালে বর্ষার বিষ্টি নামলেই বেপদ। মানুষজনের বাঁচাই কঠিন। সময়ের কাজ সময়ে করণ লাগবে। এরপর তিনি গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন, সময় গেলে সাধন হবে না।হারাধন মণ্ডল মশাই কালই বলে রেখেছিলেন তিনি উলপুর যাবেন। তীর্থনাথ হারাধন মণ্ডলকে চেনে। তিনি বড় ঢিলা মানুষ। সকালে বললে তিনি বিকেলে যান। বিকেলে বললে রাতে। তাকে নিয়ে বেরোলে পদে পদে বিপদ।
তিনি ওঠেন দেরী করে। দাঁত মাজেন ধীরে ধীরে। উঠে আবার একটু প্রভাতকীর্তন করেন। এই উঠছি—যাচ্ছি--এতো তাড়া কিসের, লঞ্চ না পাইলে হাইটা যামু। হাইটা না যাইতে পারলে ফিরে আসব। আজই যাইতে হইবে এমন কি কথা আছে নাকি ! এই সব কথার মধ্যে দিয়ে অনেক ঠেলেঠুলে তীর্থনাথ নৌকাটা ছেড়েছে। বলেছে, জেঠামুশায়—একটা ঘুম দেন। আপনেরে চক্ষের পলকে উলপুর নিয়া যাব। কিন্তু তিনি ঘুম তো দূরের কথা—একটু এদিক দেখেন তো ওদিক দেখেন। ধানগাছের কুশির চেহারা কেমন হইল, সুন্দিনাইলের বর্ণটা আগের মতোন হইল কিনা, খালের মধ্যে তিতপুটির ঝাঁক এবার কম দেখা যাচ্ছে কিনা এইসব ধানাইপানাই করতে করতে তার দম ফুরিয়ে দেন। মাঝখানে কালী ভিটায় একটু থামতে হয়েছে। বলেছে বুড়ির বটগাছতলায় একবার পা রাখবেন। বিলের মাঝখানে চখাপাখি দেখন যাইতেছে কিনা একটু দেইখা লই– বাবারে থাম। থামতে গেলেই এদিকে সূর্যটা ফস ফস করে উঠে যাচ্ছে।
সমস্যাটা হয়ে গেল নারিকেল বাড়ি গ্রামের ঠোঁটায় এসে। বাড়িটা একটু নিঝুম। ঘাটের একদিকে নলবন। আরেকদিকে খাড়া খাড়া হোগলা। এখনো পুষ্পবিকশিত হয়নি।
তীর্থনাথ একেবারে মুখ বেঁকিয়ে ফেলল। বলল, এখন থামন যাবে না। খাড়া উলপুর দেষ্টে লগি ধরছি। কিন্তু হারাধন মণ্ডল বনহোগলার দিকে চেয়ে বলে উঠছেন--অ মা জননী, এই বাড়িটা কার?
মা জননী যে কে বা কোথায় তা বুঝে ওঠার আগেই হারাধন মণ্ডল তীর্থনাথকে বললেন, নৌকা ফেরা। বাম দিক দিয়া জামগাছের নিচে থামা।
মা জননী যে কে বা কোথায় তা বুঝে ওঠার আগেই হারাধন মণ্ডল তীর্থনাথকে বললেন, নৌকা ফেরা। বাম দিক দিয়া জামগাছের নিচে থামা।
এর মধ্যে হোগলার পাশ থেকে কে একজন নড়েচড়ে উঠল। তার পরনে নীল ডুরে শাড়ি। আর বেনী করা চুল। গেঁড়ি--গুগলীর খোল ভাঙছে। মাথা না তুলেই বলল, এইটা মাস্টার বাবুর বাড়ি।
–কোন মাস্টার?
–বনিক মাস্টার বাবু।
উঠোনের দিক থেকে আরেকটি কণ্ঠ ভেসে এল, তুই কার লগে কথা কইতিছিস রে অঞ্জলি?
এই সময় নৌকাটা থেমে গেল। ধীরে ধীরে নল বনের পাশ দিয়ে জাম গাছের নিচে গেল।
অঞ্জলির কথা কওনের সময় নাই। এরপর তাকে বেলতলার গোড়াটা লেপতে হবে। ওখানে বিজুলি পিঠুলি দিয়ে নকশা কাটবে। বিকেলে ফেলা পাগলের ভোগ হবে।
–কোন মাস্টার?
–বনিক মাস্টার বাবু।
উঠোনের দিক থেকে আরেকটি কণ্ঠ ভেসে এল, তুই কার লগে কথা কইতিছিস রে অঞ্জলি?
এই সময় নৌকাটা থেমে গেল। ধীরে ধীরে নল বনের পাশ দিয়ে জাম গাছের নিচে গেল।
অঞ্জলির কথা কওনের সময় নাই। এরপর তাকে বেলতলার গোড়াটা লেপতে হবে। ওখানে বিজুলি পিঠুলি দিয়ে নকশা কাটবে। বিকেলে ফেলা পাগলের ভোগ হবে।
হারাধন মণ্ডল দুজন মা জননীর সন্ধান পেয়েছেন। মনে খুশি। ধুতি সামলে নৌকা থেকে নামলেন। ঘাটে কচুড়ি পানার ধাপ দেওয়া আছে। কাদা লাগল না। মচ মচ করে তার রাবারের পাম সুর ভেতরে গোপনে একটু জল ঢুকে গেল। শামুক গেড়ি আর কচুড়িপানার মিলিত গন্ধ নাকে এল।
অঞ্জলি হোগলার পাশে ততক্ষণে গেড়ি ভাঙ্গা শেষ করে এনেছে। হারাধন মণ্ডলের পায়ের ঘটনাটা বুঝতে পেরেছে। মাথা না ঘুরিয়েই বলল, আপনে বাড়ির মধ্যে যান। বিজুলি পা ধোয়ার জল গামছা দেবেনে।
পেছন থেকে অঞ্জলির মুখ দেখা যায় না। তার ইচ্ছে মুখটা দেখেই উঠোনে উঠবেন। একটু দোনামোনা করছেন।
এর মধ্যে উঠোনে বিজুলি হাঁসের বাক্স খুলে দিয়েছে। পাক পাক করতে করতে ছাও--পোনা সমেত এক ঝাঁক হাঁসাহাঁসি বেরিয়ে পড়েছে। তাদের সঙ্গে একটু এগিয়ে আসতেই অঞ্জলি হারাধন মণ্ডলকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ছুটে গিয়ে ঘর থেকে এক ঘটি জল, খড়ম এনে দিল। এগিয়ে দিল ছোট একটি টুল।
পেছন থেকে অঞ্জলির মুখ দেখা যায় না। তার ইচ্ছে মুখটা দেখেই উঠোনে উঠবেন। একটু দোনামোনা করছেন।
এর মধ্যে উঠোনে বিজুলি হাঁসের বাক্স খুলে দিয়েছে। পাক পাক করতে করতে ছাও--পোনা সমেত এক ঝাঁক হাঁসাহাঁসি বেরিয়ে পড়েছে। তাদের সঙ্গে একটু এগিয়ে আসতেই অঞ্জলি হারাধন মণ্ডলকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ছুটে গিয়ে ঘর থেকে এক ঘটি জল, খড়ম এনে দিল। এগিয়ে দিল ছোট একটি টুল।
হারাধন মণ্ডল পা ধোবেন কী তিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন উঠোনটা সদ্য গোবরে লেপা। এক পাশে বেলীফুলের ঝাড়—ফুল ফুটেছে। চালের ঠিক উপরে কয়েকটা জালালি বাকুম বাকুম করছে। এর মধ্যে শ্রীমতি বিজুলিবালা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য কতটা উঠল দেখার চেষ্টা করছে। মাথা সামান্য হেলানো। দেখে প্রাণ ভরে যায়।
হারাধন মণ্ডলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিজুলিবালা বলল, আপনি পা ধুইয়া নেন। আমি গামছা নিয়া আসি।
হারাধন মণ্ডলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিজুলিবালা বলল, আপনি পা ধুইয়া নেন। আমি গামছা নিয়া আসি।
হারাধন ঝুঁকে পড়ে পা ধুচ্ছেন বটে—কিন্তু মন চেয়ে আছে বিজুলিবালার দিকে। অঞ্জলি ঘাট থেকে উঠে এসেছে। হাতে একগোছা হেলেঞ্চা। হাঁসাহাঁসি শামুক গেড়ি খাচ্ছে। পায়ের আলতা মাখা ছিল—জলে ধুলে গেলেও লাল দাগ চলে যায় না। কোমরে আঁচল গোজা। অঞ্জলিকে দেখে ঘরের চাল থেকে জালালিগুলো নিচে নেমে এল। তার পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগল। তাদেরও খিদে পেয়েছে। তাদেরও খানাখাদ্য চাই। বিজুলিবালা ঘর থেকে একটি ধোয়া গামছা নিয়ে এল। আর নিয়ে এল এক থাল দীঘাধানের মুড়ি। সঙ্গে দুখণ্ড মুছি পাটালি। আর তিনটে তিলের নাড়ু।
হারাধন আপ্লুত হয়ে বলেন, খাইয়াই তো আইছি। আবার ক্যান।
হারাধন আপ্লুত হয়ে বলেন, খাইয়াই তো আইছি। আবার ক্যান।
খেতে খেতে দেখলেন বিজুলিবালা একটা হাতপাখা নিয়ে এসেছে। সুতো দিয়ে বোনা। ধীরে ধীরে বাতাস করছে। পাখার গায়ে লেখা—মলয় বাতাস। অঞ্জলি কিছু খেসারীর দানা ছড়িয়ে দিচ্ছে। জালালিরা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। দেখে মনে হল—এরা মানুষ নয়—লক্ষ্মী সরস্বতী দেবী। জননী যমুনা- জাহ্নবী। অপার মায়াময়। তার চোখে জল আসে। তিনি চোখ মুছে বললেন, মা জননী, আমাগো বাড়ি যদুপুরে। যদুপুরের হারাধন মণ্ডলের বাড়ি কইলে যে কেউই দেখায় দেবে। তোমরা দুইজনে আমাগো বাড়ি যাইবা। খুব খুশি হব।
দুই বোনে শুনে একটু চোখাচুখি করল। একটু হাসল। মাথা নাড়ল। যাবে নিশ্চয়ই।
এর মধ্যে ওদের মা আজ্ঞামনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ঘোমটা টেনে দিয়েছেন। ততক্ষণে মুড়ি খাওয়া শেষ। হাত জোড় করে প্রণাম করে হারাধন মণ্ডল বললেন, আপনার মাইয়া দুইডা ভারি মিষ্টি।
আজ্ঞামনি দূর থেকে কপালে হাত ঠেকিয়ে উত্তর দিলেন, এইবেলা থাইকা যান। দুগগা রান্না করি। খাইয়া যাইবেন। অগো বাবা আগামী শুক্কুরবার আসবে। তিনি জোতকুরা হাই স্কুলের হেড মাস্টার।
হারাধন মণ্ডল মাথা নাড়লেন। তিনি বিলক্ষণ বনিক মাস্টার বাবুকে চেনেন। তাঁর তুল্য পণ্ডিত অঞ্চলে নাই। তার নাম শুনেই এ বাড়িতে নেমেছেন।
এর মধ্যে ওদের মা আজ্ঞামনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ঘোমটা টেনে দিয়েছেন। ততক্ষণে মুড়ি খাওয়া শেষ। হাত জোড় করে প্রণাম করে হারাধন মণ্ডল বললেন, আপনার মাইয়া দুইডা ভারি মিষ্টি।
আজ্ঞামনি দূর থেকে কপালে হাত ঠেকিয়ে উত্তর দিলেন, এইবেলা থাইকা যান। দুগগা রান্না করি। খাইয়া যাইবেন। অগো বাবা আগামী শুক্কুরবার আসবে। তিনি জোতকুরা হাই স্কুলের হেড মাস্টার।
হারাধন মণ্ডল মাথা নাড়লেন। তিনি বিলক্ষণ বনিক মাস্টার বাবুকে চেনেন। তাঁর তুল্য পণ্ডিত অঞ্চলে নাই। তার নাম শুনেই এ বাড়িতে নেমেছেন।
এ সময় নৌকায় তীর্থনাথ আড় বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে। তার বেলা বয়ে যায়। হারাধন আর বসলেন না। উঠে পড়লেন। যেতে যেতে বললেন, তিনি নিশ্চয়ই জোত্কুরা যাবেন। মাস্টার বাবুর সঙ্গে দেখা করবেন। আজ আর সময় নাই। তার নৌকা ছেড়ে যাবে।
বাঁশির সুর শুনে অঞ্জলি--বিজুলির কান খাড়া হয়ে গেল। যেতে যেতে হারাধন মণ্ডল বললেন, আমার ভাইপো—তীর্থনাথ। পালাগানের দলে বাঁশি বাজায়। আরেকজন ভাইপো আছে। মাইজা ভাইয়ের ছেলে। যদুপুর বাজারে খলিফাগিরি করে। বিয়ের বয়স হইছে। বিয়ে করার নাম নাই।
এ সময় বাঁশির সুর একটু ঢেউ খেলে যায়। একটু কান পাতলেই বোঝা যায়—বাঁশি শুধু সুর নয়—কিছু কথা কয়ে উঠছে। কথা বুঝতে পারে না। কিন্তু সুরটি মনে লাগে। শুনে দুবোন চোখাচুখি করে। কি কথা কয়ে যায়। আর কেউ না দেখলেও তাদের মা আজ্ঞামনি দেখে ফেলেছেন।
তখনই আজ্ঞামনির মনে পড়ল হারাধনকে গুড় মুড়ি দেওয়া হয়েছে বটে—তার ভাইপো তীর্থনাথকে দেওয়া হয়নি। এটা গৃহস্থের জন্য অকল্যাণ। ঘর থকে তিনি আরেক থাল গুড় মুড়ি নিয়ে এসে দেখেন নৌকাটি নেই। হোগলা বনের আড়ালে চলে গেছে। এখন আর ডেকে ফেরানো যাবে না। নৌকা ছেড়ে গেছে। বাঁশি থেকে গেছে।
দিন সাতেক পরেই বনিক মাস্টার বাড়িতে ফিরেছেন। হাত মুখ ধুয়ে উঠোনের এক কোনায় বসেছেন। দুমেয়েকে ডাকলেন। তখনো সন্ধ্যে হবে হবে করছে। দুজনে হাত ধরাধরি করে এসে দাঁড়াল। আজ শুক্রবার। বুকের কাছে হাত জড়ো করে প্রার্থনা সঙ্গীত করবেন। বিজলী ও অঞ্জলি গলা মেলাবে
বনিক মাস্টার রবি বাবুর গান দিয়েই প্রার্থনা করেন। আজ হঠাৎ করে অন্য একটি গান ধরেছেন। গাইছেন—
চেয়ে চেয়ে মোর রাঙা হল কেনো
কাজল টানা কালো আঁখি,
শ্যাম তোর তরে তমাল তলায় চেয়ে থাকি।
অঞ্জলি--বিজুলির একটু শিহরণ হল এই গানটিতে। এই গানটিই সেদিন বাঁশিতে শুনেছিল তাদের ঘাটে। বাজিয়েছিল তীর্থনাথ। আজ তাদের বাবা গাইছেন। এটা প্রার্থনা সঙ্গীত নয়। অন্য কিছু।
গান শেষে বনিক মাস্টার দু মেয়ের হাত ধরলেন। বিজলী আঙ্গুল দিয়ে বাবার চুল নেড়ে চেড়ে দিতে লাগল। আর অঞ্জলি হাত টিপে দিতে লাগল। তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাগো, মনে যে কথা আছে—তাই দিয়েই প্রার্থনা করতে হয়। এর জন্য অন্য কোনো কথার দরকার নেই। তারপর একটু দম নিলেন। চোখ বুজে বললেন, প্রার্থনা করতে হয় নিজের কাছে—অন্য কারো কাছে নয়। কথা শেষে পকেট থেকে কাজলদানী বের করলেন। সংখ্যায় মাত্র একটি। দুমেয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। মুখে হাসি। একজনের হাতের উপরে আরেকজনের হাত।
দিন সাতেক পরেই বনিক মাস্টার বাড়িতে ফিরেছেন। হাত মুখ ধুয়ে উঠোনের এক কোনায় বসেছেন। দুমেয়েকে ডাকলেন। তখনো সন্ধ্যে হবে হবে করছে। দুজনে হাত ধরাধরি করে এসে দাঁড়াল। আজ শুক্রবার। বুকের কাছে হাত জড়ো করে প্রার্থনা সঙ্গীত করবেন। বিজলী ও অঞ্জলি গলা মেলাবে
বনিক মাস্টার রবি বাবুর গান দিয়েই প্রার্থনা করেন। আজ হঠাৎ করে অন্য একটি গান ধরেছেন। গাইছেন—
চেয়ে চেয়ে মোর রাঙা হল কেনো
কাজল টানা কালো আঁখি,
শ্যাম তোর তরে তমাল তলায় চেয়ে থাকি।
অঞ্জলি--বিজুলির একটু শিহরণ হল এই গানটিতে। এই গানটিই সেদিন বাঁশিতে শুনেছিল তাদের ঘাটে। বাজিয়েছিল তীর্থনাথ। আজ তাদের বাবা গাইছেন। এটা প্রার্থনা সঙ্গীত নয়। অন্য কিছু।
গান শেষে বনিক মাস্টার দু মেয়ের হাত ধরলেন। বিজলী আঙ্গুল দিয়ে বাবার চুল নেড়ে চেড়ে দিতে লাগল। আর অঞ্জলি হাত টিপে দিতে লাগল। তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাগো, মনে যে কথা আছে—তাই দিয়েই প্রার্থনা করতে হয়। এর জন্য অন্য কোনো কথার দরকার নেই। তারপর একটু দম নিলেন। চোখ বুজে বললেন, প্রার্থনা করতে হয় নিজের কাছে—অন্য কারো কাছে নয়। কথা শেষে পকেট থেকে কাজলদানী বের করলেন। সংখ্যায় মাত্র একটি। দুমেয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। মুখে হাসি। একজনের হাতের উপরে আরেকজনের হাত।
বনিক মাস্টার স্কুলের চেয়ারম্যান পরিতোষবাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। তার বড় মেয়ের পাকা দেখা করতে এসেছে। সেখানেই এই চেয়ে থাকি চেয়ে থাকি গানটি শুনেছেন। রেডিওতে বাজছিল। গানটি তার মনে গেঁথে গেছে। খেয়ে--দেয়ে ফেরার পথে বাসুদেবপুরের হাট। সেখান থেকে এই কাজলদানীটি পেয়েছেন। কিন্তু দুটো পাননি। দু মেয়েকে বললেন, এইটা রাখো। পরে আরেকটা কিনে দেবো।
অঞ্জলি--বিজলী এক সঙ্গে বলে উঠলো, আর লাগবে না বাবা। এইটাতেই আমাগো দুইজনের হবে।
তারা দুজনে ঘরে ছুটে গেল। চোখে কাজল টেনে এল। এসে বলল, বাবা, কেমন দেখাচ্ছে কওতো?
তিনি দেখে হাসলেন। আকাশের দিকে তাকালেন। চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। একটু গলা খুস খুস করলেন। অঞ্জলি--বিজুলি জানে এবার তাদের বাবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলবেন। তারা কান খাড়া করল।
তিনি বললেন, তোমাদের আমি বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেছি।
অঞ্জলি--বিজলী এক সঙ্গে বলে উঠলো, আর লাগবে না বাবা। এইটাতেই আমাগো দুইজনের হবে।
তারা দুজনে ঘরে ছুটে গেল। চোখে কাজল টেনে এল। এসে বলল, বাবা, কেমন দেখাচ্ছে কওতো?
তিনি দেখে হাসলেন। আকাশের দিকে তাকালেন। চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। একটু গলা খুস খুস করলেন। অঞ্জলি--বিজুলি জানে এবার তাদের বাবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলবেন। তারা কান খাড়া করল।
তিনি বললেন, তোমাদের আমি বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেছি।
এর বেশী কিছু তিনি বললেন না। বলবেনও না। এর আগে তিনি তার পাঁচটি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কাউকেও আগে থেকে কিছু বলেননি। এই দুটি তার বড় আদরের। জমজ হওয়ার পরে বাঁচে কি বাঁচে না বলে সন্দেহ ছিল। প্রায় শ্বাস উঠেছিল। শেষমেষ ফেলা পাগলার দোহাই পেয়ে টিকে আছে। একজন কাঁদলে আরেক জন কাঁদে। একজন হাসলে আরেকজন হাসে। ফেলা পাগলা বলেছিলেন, বাপুরে—ওরা যক্ষির জোড়া ধন। চেরকাল এক লগে ছিল। এক লগে রাইখো। আলেদা রাইখো না।
সেই কথা মনে করে বনিক মাস্টার মাথাটা ঝাঁকালেন। দুবার শব্দ করে ডাকলেন, ঈশ্বর। ঈশ্বর।
বিয়ের কথায় দু মেয়ে সরে গিয়েছে। তখন তাদের মা আজ্ঞামনি এলেন। তিনি আসবেন জেনে এই অবেলায় আরেকবার স্নান করেছেন। পরেছেন একটা ধোয়া শাড়ি। মাথার উপর ঘোমটা একটু নামিয়ে দিয়েছেন। এত ধীরে এসে দাঁড়িয়েছেন যে, মাটিও টের পেল না। শান্ত সৌম্য ভঙ্গীতে আলো--অন্ধকারের ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়েছেন। হাতে একটি থালা। কিছু খই মুড়ি। আর একখণ্ড মুছি পাটালি।
বিয়ের কথায় দু মেয়ে সরে গিয়েছে। তখন তাদের মা আজ্ঞামনি এলেন। তিনি আসবেন জেনে এই অবেলায় আরেকবার স্নান করেছেন। পরেছেন একটা ধোয়া শাড়ি। মাথার উপর ঘোমটা একটু নামিয়ে দিয়েছেন। এত ধীরে এসে দাঁড়িয়েছেন যে, মাটিও টের পেল না। শান্ত সৌম্য ভঙ্গীতে আলো--অন্ধকারের ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়েছেন। হাতে একটি থালা। কিছু খই মুড়ি। আর একখণ্ড মুছি পাটালি।
বনিক মাস্টার মুড়ির থালাটি সরিয়ে দিলেন। আজ্ঞামনি একটু কেঁপে উঠলেন। এগিয়ে এসে মাস্টার বাবুর কপালে হাত দিতে গেলেন। দিলেন না। কাছে পিঠে কেউ থাকতে পারে ভেবে হাত ফিরিয়ে আনলেন। এসময়ে বেলগাছের উপরে কী একটা পাখি নড়ে নড়ে উঠেছে। তাতে কয়েক ফোঁটা শিশির তার হাতের উপরে ঝরে পড়ল। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ?
তিনি মাথা নাড়লেন। শরীর ঠিক আছে। তবে মনটা খারাপ। বললেন, যদুপুরের হারাধন মণ্ডল আইছেলেন। অঞ্জলি--বিজুলির বিয়ার কথা পাড়ছেন।
আজ্ঞামনির মুখে হাসি ফুটল। বললেন, এইডা তো খুশির কথা। মাইয়া দুইটা বড় হইয়া যাইতেছে। অখন বিয়া দেওনই লাগে।
তিনি মাথা নাড়লেন। শরীর ঠিক আছে। তবে মনটা খারাপ। বললেন, যদুপুরের হারাধন মণ্ডল আইছেলেন। অঞ্জলি--বিজুলির বিয়ার কথা পাড়ছেন।
আজ্ঞামনির মুখে হাসি ফুটল। বললেন, এইডা তো খুশির কথা। মাইয়া দুইটা বড় হইয়া যাইতেছে। অখন বিয়া দেওনই লাগে।
বনিক মাস্টার একটু উদ্বিঘ্ন স্বরে বললেন, কিন্তু উনি কইছেন, ছেলে ওনার হাতে একজন আছে। দুইজন নাই।
আজ্ঞামনি বললেন, দুইজন ছেলে এক সাথে পাওয়া কঠিন। আগে একজনের বিয়া হোক। তারপর আরেকজনের হবে। অসুবিধা নাই। ফেলা পাগলার বাক্যকে হেলা করতে পারব না।
–আমি দুই মাইয়ারেই এক সাথে বিয়া দিতে চাই। এক পরিবারেই বিয়া দেব। দুই ভাইয়ের সাথে বিয়া হবে। এইটুকু তিনি জোরে জোরে বললেন। কিন্তু বিড়বিড় করে বললেন, ফেলা পাগলের দয়ায় আমার মাইয়া দুজনরে পাইছি। তার কথা হেলা করতে পারি না।
আজ্ঞামনি বললেন, দুইজন ছেলে এক সাথে পাওয়া কঠিন। আগে একজনের বিয়া হোক। তারপর আরেকজনের হবে। অসুবিধা নাই। ফেলা পাগলার বাক্যকে হেলা করতে পারব না।
–আমি দুই মাইয়ারেই এক সাথে বিয়া দিতে চাই। এক পরিবারেই বিয়া দেব। দুই ভাইয়ের সাথে বিয়া হবে। এইটুকু তিনি জোরে জোরে বললেন। কিন্তু বিড়বিড় করে বললেন, ফেলা পাগলের দয়ায় আমার মাইয়া দুজনরে পাইছি। তার কথা হেলা করতে পারি না।
আজ্ঞামনি একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তার স্বামীর চুল পেকেছে। কিন্তু এখনো মন পাকেনি। এখনো সংসার বুঝতে পারেন না। একবার যখন এক পরিবারের দুইভায়ের সঙ্গে বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করেছেন—সেটা থেকে সরে আসবেন না সহজে।
আজ্ঞামনি দীর্শ্বাস ছেড়ে বললেন, যার যেইখানে বিয়া লেখন আছে –সেইখানে তার বিয়া হইবে। সব কপালের লেখন। আমি আপনি কী করব?
আজ্ঞামনি দীর্শ্বাস ছেড়ে বললেন, যার যেইখানে বিয়া লেখন আছে –সেইখানে তার বিয়া হইবে। সব কপালের লেখন। আমি আপনি কী করব?
এই কথাগুলো আজ্ঞামণি এতো আস্তে করে বললেন যে, নিজেই নিজের কথাটুকু শুনতে পেলেন না। এটা তার মনের কথা। স্বামীকে বলা যাবে না। বলে লাভ নেই। বললে মনে কষ্ট পাবেন। এ জীবনে তিনি স্বামীর মনে কষ্ট দিতে চান না। তিনি ধীর ধীরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
এসময় বনিক মাস্টার একটু উঁচু গলায় বললেন, হারাধন মণ্ডলের নিজেরই দুই ভাইপো আছে। আমি কইছি–আপনি যদি এই দুই ভাইপোর সাথে মাইয়া দুইটার সম্বন্ধ করতে চান—তাইলে আইসেন। নাইলে না।
আজ্ঞামনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কিছু কইছেন?
–কিছু কন নাই। তবে কইবেন বলে মনে হয়।
–কী কইবেন বলে মনে হয় আপনার?
–দুই মাইয়ার জন্যই তার দুই ভাইপোর সম্বন্ধ আননের কথাই কইবেন। আমার মাইয়া দুইটা লক্ষ্মী--সরস্বতী। তাগো এক ঘরে নেওন ছাড়া তার উপায় নাই।
–বুঝলেন কী কইরা?
–বুঝছি। তিনি কইছেন, আপনে যা--ই কন না কেনো, আপনের বাড়িতে আমরা আসতিছি। আর বাকিটা ফেলা পাগলের দোহাই।
আজ্ঞামনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কিছু কইছেন?
–কিছু কন নাই। তবে কইবেন বলে মনে হয়।
–কী কইবেন বলে মনে হয় আপনার?
–দুই মাইয়ার জন্যই তার দুই ভাইপোর সম্বন্ধ আননের কথাই কইবেন। আমার মাইয়া দুইটা লক্ষ্মী--সরস্বতী। তাগো এক ঘরে নেওন ছাড়া তার উপায় নাই।
–বুঝলেন কী কইরা?
–বুঝছি। তিনি কইছেন, আপনে যা--ই কন না কেনো, আপনের বাড়িতে আমরা আসতিছি। আর বাকিটা ফেলা পাগলের দোহাই।
আজ্ঞামনির ধারণা হারাধন মণ্ডল আসবেন না। এটা তার স্বামীর কল্পনা। বনিক বাবু হাট থেকে দুই জোড়া নারিকেল কিনে আনলেন। বলেন, নাড়ু বানাও। আর বিশ্বাস বাড়ির ব্রজেনকে কইছি। সে দুটো শৈল মাছ ধইরা দেবে। লেবু গাছটি ভালো করে চেয়ে দেখলেন। বেশ কয়েকটা লেবু আছে। দুএক দিনের মধ্যেই বতি হয়ে উঠবে। চিনি দিয়ে লেবুর শরবৎ হবে। সেদিন স্কুলের চেয়ারম্যান পরিতোষ বাবুর বাড়িতে শরবত খেয়ে এসেছেন। সঙ্গে কিছু তোকমার দানা দিতে হবে। ঘরে তোকমার দানা আছে কিনা ঠিক মনে করতে পারলেন না। তার আগে একটি কথা মনে এসেছে। সেটা ভুলে যাওয়ার আগেই বলে ফেলা দরকার। আজ্ঞামনিকে বললেন, আমাগো সোমেদ খাঁরেও কইছি। এই রকম একটা দিনে তার থাকনের দরকার আছে। তার বুদ্ধি বরাদ্দ ভালো।
এই শুক্রবারে বনিক মাস্টার বাবু ছুটি নিয়েছেন। সকাল থেকে হৈ চৈ লাগিয়ে দিয়েছেন। একবার আজ্ঞামনিকে ডাকেন তো একবার অঞ্জলি বিজুলিকে ডাকন। রান্না--বান্নার যোগাড় যন্ত্র করতে তাড়া দেন। অতিথিদের ঘরে বসাবেন না বারান্দায় বসাবেন এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তার হাকডাক শুনে অঞ্জলি--বিজুলি এসে বলল, মা কইছে, তুমি বেলতলায় ছায়ায় বইসা থাকো। যা করার মা--ই করবে। তোমার চিন্তা করণ লাগবে না।
তিনি বসবেন না। রান্নাঘরের দিকে যেতে চাইলেন। মেয়েদুটোর দিকে তাকিয়ে কিন্তু নড়তে পারলেন না। তারা মিটি মিটি হাসতে হাসতে তাকে ধরে বেলতলায় বসিয়ে দিল। বলল, তুমি এইবার নেল্লা হইয়া ঘুমাও।
বেলতলায় বসলেন বটে, তবে ঘুমোবেন না। রবিবাবুর রবিবাবুর বই নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। রবিবাবু লিখেছেন—দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি—বেলা দ্বিপ্রহর।
দুপুর হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হারাধন মণ্ডল এলেন। সঙ্গে আরো জনা পাঁচেক লোক। তাদের নৌকা ভিড়েছে জামতোলায়। সেখানে হাঁসগুলি পাক পাক করছে। নৌকা দেখে সরে গেছে হোগলার ঝোঁপের দিকে। হারাধন ভেবে রেখেছিলেন এসময় মেয়ে দুটিকে কাছেপিঠে কোথাও দেখা যাবে। তাদের জন্য তিনি দুটো লজেঞ্জ এনেছেন। আজ আর দেখা গেল না তাদের। তার বদলে জামতোলায় সোমেদ খাঁ দাঁড়িয়ে আছেন। এগিয়ে এসে বললেন, সেলাম আলেকুম ভাই।
হারাধন মণ্ডল তার ধরেই পাড়ে উঠলেন। বলেন, খাঁ সাব—পেন্নাম।
খাঁ সাব কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে বললেন, ভাই সাব, শাড়ি কয়টা আনছেন?
এ প্রশ্নে মণ্ডল মশাই একটু থমকে গেলেন। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তার দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে খাঁ সাব তাকিয়ে আছেন দেখে খুব ধীরে উত্তর দিলেন, টিয়া রঙ। তবে তিনি কয়টা শাড়ি এনেছেন সেটা বললেন না।
এই শুক্রবারে বনিক মাস্টার বাবু ছুটি নিয়েছেন। সকাল থেকে হৈ চৈ লাগিয়ে দিয়েছেন। একবার আজ্ঞামনিকে ডাকেন তো একবার অঞ্জলি বিজুলিকে ডাকন। রান্না--বান্নার যোগাড় যন্ত্র করতে তাড়া দেন। অতিথিদের ঘরে বসাবেন না বারান্দায় বসাবেন এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তার হাকডাক শুনে অঞ্জলি--বিজুলি এসে বলল, মা কইছে, তুমি বেলতলায় ছায়ায় বইসা থাকো। যা করার মা--ই করবে। তোমার চিন্তা করণ লাগবে না।
তিনি বসবেন না। রান্নাঘরের দিকে যেতে চাইলেন। মেয়েদুটোর দিকে তাকিয়ে কিন্তু নড়তে পারলেন না। তারা মিটি মিটি হাসতে হাসতে তাকে ধরে বেলতলায় বসিয়ে দিল। বলল, তুমি এইবার নেল্লা হইয়া ঘুমাও।
বেলতলায় বসলেন বটে, তবে ঘুমোবেন না। রবিবাবুর রবিবাবুর বই নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। রবিবাবু লিখেছেন—দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি—বেলা দ্বিপ্রহর।
দুপুর হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হারাধন মণ্ডল এলেন। সঙ্গে আরো জনা পাঁচেক লোক। তাদের নৌকা ভিড়েছে জামতোলায়। সেখানে হাঁসগুলি পাক পাক করছে। নৌকা দেখে সরে গেছে হোগলার ঝোঁপের দিকে। হারাধন ভেবে রেখেছিলেন এসময় মেয়ে দুটিকে কাছেপিঠে কোথাও দেখা যাবে। তাদের জন্য তিনি দুটো লজেঞ্জ এনেছেন। আজ আর দেখা গেল না তাদের। তার বদলে জামতোলায় সোমেদ খাঁ দাঁড়িয়ে আছেন। এগিয়ে এসে বললেন, সেলাম আলেকুম ভাই।
হারাধন মণ্ডল তার ধরেই পাড়ে উঠলেন। বলেন, খাঁ সাব—পেন্নাম।
খাঁ সাব কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে বললেন, ভাই সাব, শাড়ি কয়টা আনছেন?
এ প্রশ্নে মণ্ডল মশাই একটু থমকে গেলেন। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তার দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে খাঁ সাব তাকিয়ে আছেন দেখে খুব ধীরে উত্তর দিলেন, টিয়া রঙ। তবে তিনি কয়টা শাড়ি এনেছেন সেটা বললেন না।
সোমেদ খাঁ একটু গম্ভীর হলেন। পরক্ষণেই হাসি হাসি মুখটা করে দুবার গলা খাকরি দিলেন। ঘরের দিকে রওনা দিলেন।
জামতোলার পাশেই একটা বাঁশের মাচান। সেখানে কুচোমুচো হয়ে একটি ছেলে ঘুমিয়েছিল। অতিথিরা উঠোনের দিকে যেতেই সে লাফিয়ে উঠল। সে তাদের সোজা নৌকায় গিয়ে উঠল। তখন নৌকার বাঁধতে ছিল তীর্থনাথ। তার সঙ্গে খোসগল্প জুড়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকাটি নিয়ে তারা পশ্চিম দিকে রওনা করে দিল। ছেলেটি সোমেদ খাঁর সেজো ছেলে শাজাহান।
জামতোলার পাশেই একটা বাঁশের মাচান। সেখানে কুচোমুচো হয়ে একটি ছেলে ঘুমিয়েছিল। অতিথিরা উঠোনের দিকে যেতেই সে লাফিয়ে উঠল। সে তাদের সোজা নৌকায় গিয়ে উঠল। তখন নৌকার বাঁধতে ছিল তীর্থনাথ। তার সঙ্গে খোসগল্প জুড়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকাটি নিয়ে তারা পশ্চিম দিকে রওনা করে দিল। ছেলেটি সোমেদ খাঁর সেজো ছেলে শাজাহান।
আজ্ঞামনি আজ দেরী করে রান্না শুরু করেছেন। ভয় ছিল আজ ওরা মেয়ে দেখতে আসবে না। ওদেরকে দেখে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পাশের ঘরের অনন্তের মা আর সুবলের বউকে ডেকে নিয়েছেন। আজ তার দুমেয়েকে আগুনের মধ্যে নামতে দেবেন না।
কিন্তু অঞ্জলি এসে হলুদ বাটতে শুরু করেছে। আর বিজুলি পায়েস নাড়ছে। বারবার বলছেন, পুকুর ঘাট থেকে সিনান কইরা আয়। তারা নড়ে না চড়ে না। পায়েসে নলেন গুড় দেয়া হয়েছে। আলাদা ঘ্রাণ বেরিয়েছে। অঞ্জলি হলুদ বাটতে বাটতে সেদিকে একবার তাকাল। বিজুলি একটা বাটিতে খানিকটা পায়েস ঢেলে দিল। ফু দিয়ে ঠাণ্ডা করতে করতে বলল, অঞ্জলি, দেখতো লবণ হইছে কিনা।
অঞ্জলি এসে নিজে খাবে কি-- তার বদলে বিজুলির মুখের দিকে পায়েস এগিয়ে দিল। বল, তুই আগে খা।
কে খাবে এই নিয়ে দুবোনের মধ্যে একটু ঠেলাঠেলি লেগে গেল। তাই দেখে আজ্ঞামনি ধমকে বললেন, তোরা গেলি।
ধমকটা একটু জোরেই হয়েছে। ফলে মেয়েদুটো একটু চমকে উঠেছে। আর দেরী না করে দুজন দুজনের মুখের মধ্যে পায়েস পুরে দিল। এটা করতে গিয়ে বিজুলির মুখে হলুদ লেগে গেল। আর অঞ্জলির মুখে লেগে গেল পায়েস। এবং আরেকবার ধমক খাওয়ার ভয়ে দুজনে বেরিয়ে গেল।
কে খাবে এই নিয়ে দুবোনের মধ্যে একটু ঠেলাঠেলি লেগে গেল। তাই দেখে আজ্ঞামনি ধমকে বললেন, তোরা গেলি।
ধমকটা একটু জোরেই হয়েছে। ফলে মেয়েদুটো একটু চমকে উঠেছে। আর দেরী না করে দুজন দুজনের মুখের মধ্যে পায়েস পুরে দিল। এটা করতে গিয়ে বিজুলির মুখে হলুদ লেগে গেল। আর অঞ্জলির মুখে লেগে গেল পায়েস। এবং আরেকবার ধমক খাওয়ার ভয়ে দুজনে বেরিয়ে গেল।
আজ্ঞামনি বললেন, ঘরের সামনে দিয়া পুকুর ঘাটে যাবি না। যাবি সাবধানে। ডালিম গাছটা আড়াল কইরা যাবি।
মেয়েরা চলে যেতেই আজ্ঞামনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই যমজ মেয়েদুটো কখনো আলাদা থাকেনি। একসাথে ওঠাবসা। একসাথে খাওয়া--দাওয়া। এবার বুঝি আলাদা হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে।
বিকেল নাগাদ একটু মেঘ করে এল। হারাধন মণ্ডল একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টি নামলে জোতকুরা ফিরতে সমস্যা হয়ে যাবে। তিনি একটু তাড়া দিতে লাগলেন। বললেন, আমার মা জননীরে দেখানোর ব্যবস্থা করেন। সোমেদ খাঁ বললেন—আগে খাওয়া দাওয়া হউক। তারপর গোধূলী লগ্নে মাইয়া দেখন যাইবে।
হারাধন মণ্ডল উত্তর দিলেন, তাইলে তো রাইত হয়ে যাবে। ফেরবো কেমন কইরা?
মেয়েরা চলে যেতেই আজ্ঞামনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই যমজ মেয়েদুটো কখনো আলাদা থাকেনি। একসাথে ওঠাবসা। একসাথে খাওয়া--দাওয়া। এবার বুঝি আলাদা হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে।
বিকেল নাগাদ একটু মেঘ করে এল। হারাধন মণ্ডল একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টি নামলে জোতকুরা ফিরতে সমস্যা হয়ে যাবে। তিনি একটু তাড়া দিতে লাগলেন। বললেন, আমার মা জননীরে দেখানোর ব্যবস্থা করেন। সোমেদ খাঁ বললেন—আগে খাওয়া দাওয়া হউক। তারপর গোধূলী লগ্নে মাইয়া দেখন যাইবে।
হারাধন মণ্ডল উত্তর দিলেন, তাইলে তো রাইত হয়ে যাবে। ফেরবো কেমন কইরা?
সোমেদ খাঁ হেসে বললেন, ফির্যা লাভ কী। এইখানে আইজ থাইক্যা যাবেন। বনে জঙ্গলে তো পড়েন নাই।
সোমেদ খাঁ জানেন—আগেই মাইয়া দেখন যাবে। কিন্তু তিনি দেরী করাচ্ছেন। বারবার ঘাটকূলের দিকে তাকাচ্ছেন। তার সেজো ছেলে শাজাহান এখনো ফেরে নাই।
সোমেদ খাঁ জানেন—আগেই মাইয়া দেখন যাবে। কিন্তু তিনি দেরী করাচ্ছেন। বারবার ঘাটকূলের দিকে তাকাচ্ছেন। তার সেজো ছেলে শাজাহান এখনো ফেরে নাই।
এর মধ্যে কোন মেয়ে সাজবে সেটা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কেউ কাউকে রেখে সাজবে না। অঞ্জলি পায়ে আলতা মাখতে গেলে বিজুলি নিজের পা এগিয়ে দিচ্ছে। আর অন্য হাতে অঞ্জলির বিনুনী বেঁধে দিচ্ছে। গেলো পূজায় ঢাকাই শাড়ী কেনা হয়েছিল। অঞ্জলির ইচ্ছা আজ সেটা বিজুলি পরুক। বাসন্তী শাড়িটা বিজুলি ওকে এগিয়ে দিচ্ছে। মাস্টার বাবুর সেদিন আনা কাজল কে কার চোখে লাগিয়ে দেবে এই নিয়ে হুড়াহুড়ি হচ্ছে। দুজনেরই গণ্ডদেশে কাজল লেগে গেছে। দেখে আজ্ঞামনি একটু রেগে গেলেন। রাগার মাঝখানেই দুমেয়ে দুজনের আঁচল দিয়ে কাজল মুছিয়ে দিয়েছে। দেখে আজ্ঞামনির মন ভরে গেছে। তার মেয়ে দুটি অপরূপ। কিন্তু আজ ছেলে পক্ষের সামনে এক সঙ্গে দুজনকে পাঠানো যাবে না। একজনকে ঘরে লুকিয়ে রাখতে হবে। কাকে লুকিয়ে রাখবেন সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তার চোখে জল চলে আসছে।
বনিক মাস্টার ঘরের কাছে মুখ বাড়িয়ে বলছেন, দেরী করছ ক্যান। বেলা যে চইলা যাচ্ছে।
বনিক মাস্টার ঘরের কাছে মুখ বাড়িয়ে বলছেন, দেরী করছ ক্যান। বেলা যে চইলা যাচ্ছে।
এ সময় মেয়ে দুটি হাতে চুরি পরছে। কানে দুল দিচ্ছে। বনিক বাবু দেখলেন আলো ক্রমে রঙীন হয়ে আসছে। ঘাটে নৌকা বাঁধার শব্দ হচ্ছে। সোমেদ খাঁর ছেলে ফিরেছে। তীর্থনাথ নৌকা বাঁধতে বাঁধতে গুণগুণ করে গান করছে। সোমেদ খাঁ সেদিকে একবার তাকিয়ে বললেন, অঞ্জু বিজু আম্মাজান, আপনেরা আইসা পড়েন।
হারাধন মণ্ডল একটু যাতনায় পড়লেন। তিনি সোমেদ খাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, দুই জনরে ডাকতেছেন ক্যান। আমরা তো একজনরে দ্যাখবো। ছেলে একজন। আরেকজন তো বিয়া করবে না।
হারাধন মণ্ডল একটু যাতনায় পড়লেন। তিনি সোমেদ খাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, দুই জনরে ডাকতেছেন ক্যান। আমরা তো একজনরে দ্যাখবো। ছেলে একজন। আরেকজন তো বিয়া করবে না।
সোমেদ খাঁ খুব হিসেবি মানুষ। তিনি হারাধন মণ্ডলের উদ্বেগ আমলে নিলেন না। তিনি এর মধ্যে দেখতে পেয়েছেন তার সেজো ছেলে শাজাহান নৌকার উপর বসে তীর্থনাথের বাঁশি নিয়ে বাজানোর মকসো করছে। তাই দেখে তীর্থনাথ হা হা করে হাসছে। তীর্থনাথের মুখে আলগা একটা শ্রী আছে—পালাগানের কৃষ্ণ কৃষ্ণ লাগে।
সোমেদ খাঁ বললেন, মণ্ডল মশাই, আপনেরা এখন এক লগে দুইটা মাইয়াই দ্যাখেন। তারপর সিদ্ধান্ত লইয়েন।
কথা মন্দ নয়। হারাধন মণ্ডল আর কথা বললেন না। মেয়ে দেখার ব্যবস্থা হয়েছে—বাইরে উঠোনে। আকাশে বিকেলে যতটুকু মেঘ জমেছিল—এখন তা মিলিয়ে গেছে। শান্ত হাওয়া বইছে। এর মধ্যে অঞ্জলি--বিজুলি জোড়া বোন ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। তাদের আসতে দেখে ঘরের চাল থেকে জালালি কবুতরগুলো উড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে হাটতে লাগল। পুকুর দেষ্টে থেকে এক ঝাঁক হাঁস পাক পাক করতে করতে ছুটে এল। দুজনে সবাইকে প্রণাম করে দাঁড়াল। ছেলেপক্ষ দেখে অবাক। মুখে রা নেই। শুধু কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কানাকানি করল, এই রকম মেয়ে এ তল্লাটে আর নাই। এই মেয়ে দুজনকেই তাদের ঘরে নেওন দরকার।
এটা বুঝে সোমেদ খাঁ হাসলেন। বললেন, আগের বার আপনি মাইয়াগো লগে কথা কইছেন। নাকি কি কন মণ্ডল মশাই?
হারাধন মণ্ডল মাথা নাড়লেন, কথা ঠিক। তারা কথাবার্তাতেও লক্ষ্মী--সরস্বতী।
সোমেদ খাঁ বললেন, মণ্ডল মশাই, আপনেরা এখন এক লগে দুইটা মাইয়াই দ্যাখেন। তারপর সিদ্ধান্ত লইয়েন।
কথা মন্দ নয়। হারাধন মণ্ডল আর কথা বললেন না। মেয়ে দেখার ব্যবস্থা হয়েছে—বাইরে উঠোনে। আকাশে বিকেলে যতটুকু মেঘ জমেছিল—এখন তা মিলিয়ে গেছে। শান্ত হাওয়া বইছে। এর মধ্যে অঞ্জলি--বিজুলি জোড়া বোন ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। তাদের আসতে দেখে ঘরের চাল থেকে জালালি কবুতরগুলো উড়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে হাটতে লাগল। পুকুর দেষ্টে থেকে এক ঝাঁক হাঁস পাক পাক করতে করতে ছুটে এল। দুজনে সবাইকে প্রণাম করে দাঁড়াল। ছেলেপক্ষ দেখে অবাক। মুখে রা নেই। শুধু কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কানাকানি করল, এই রকম মেয়ে এ তল্লাটে আর নাই। এই মেয়ে দুজনকেই তাদের ঘরে নেওন দরকার।
এটা বুঝে সোমেদ খাঁ হাসলেন। বললেন, আগের বার আপনি মাইয়াগো লগে কথা কইছেন। নাকি কি কন মণ্ডল মশাই?
হারাধন মণ্ডল মাথা নাড়লেন, কথা ঠিক। তারা কথাবার্তাতেও লক্ষ্মী--সরস্বতী।
সোমেদ খাঁ আর কথা বাড়াতে দিলেন না। বললেন। তাইলে এবার শাড়ি দিয়া আশীর্বাদ করেন। আর তো কথা নাই।
হারাধন মণ্ডল একটু দোনামোনা করছিলেন। শাড়ি আনতে তিনি নিজে যাবেন, না, তীর্থনাথকে আনতে বলবেন–বুঝতে পারছেন না। একটু ধন্ধে পড়ে গেছেন। বুঝতে পেরে সোমেদ খাঁ তাকে ইশারায় বসতে বললেন। তার সেজো ছেলেটার উদ্দেশ্যে হেকে বললেন, ওরে ও শাজাহান? নৌকা থেইকা বাবুগো শাড়ি কাপড় আইনা দেতো।
হারাধন মণ্ডল একটু দোনামোনা করছিলেন। শাড়ি আনতে তিনি নিজে যাবেন, না, তীর্থনাথকে আনতে বলবেন–বুঝতে পারছেন না। একটু ধন্ধে পড়ে গেছেন। বুঝতে পেরে সোমেদ খাঁ তাকে ইশারায় বসতে বললেন। তার সেজো ছেলেটার উদ্দেশ্যে হেকে বললেন, ওরে ও শাজাহান? নৌকা থেইকা বাবুগো শাড়ি কাপড় আইনা দেতো।
বেশি ডাকতে হল না। শাজাহান চোখের নিমিশে নৌকা থেকে দুইখান শাড়ি নিয়ে হাজির হল। দেখে হারাধন মণ্ডল হা হয়ে গেলেন। সোমেদ খাঁর কানে কানে বললেন, ইকি কাণ্ড! আমরা কাপড় আনছি একখান। এখন দুইখান হইল ক্যামনে?
সোমেদ খাঁ এবার বেশ গম্ভীর হলেন। বললেন। মাইয়া আমাগো দুইখান। কাপড় আনলেন একখান। সেইটা হয় কি কইরা।
–তাইলে আরেক খান আনল কেডা?
–আপনেরাই আনছেন। ভুইল্যা গেছেন। দেখেন—দুইটা শাড়িই তালতলার হাটের ভুবন সাহার দোকানের। ঠিক কিনা কন?
মণ্ডল মশাই মাথা নাড়লেন। তালতলা থেকেই তারা শাড়িটা কিনছিলেন। কথা সত্য।
–সোমেদ খাঁ প্রশ্ন করলেন, ভাইপো আপনার দুইখান। কথা সত্য কিনা কন?
--কথা সত্য।
–তারা বিয়ার যুগ্যি হইছে কিনা কন?
–হইছে।
–তাগো বিয়া দেবার চাইছেন কিনা কন?
–চাই। কিন্তু?
–এই রকম মাইয়া এ তল্লাটে আর নাই।এগো দেখলে কেউ না করতে পারবে না।আপনার দুই ভাইপোই একবার হ্যা কইবে।
মাথা নেড়ে হারাধন মণ্ডল সব সত্যি বলে মেনে নিলেন। কিন্তু সব সত্যির বাইরেই আরো কিছু সত্যি আছে। সেটা বলার সুযোগই পেলেন না।তাকে মাথা নাড়তে দেখে সোমেদ খা বললেন, দ্যান, আমাগো মাইয়া দুজনের হাতে শাড়ি দুইটা তুইল্যা দেন। আর দেরী করণ ঠিক না। শুভ কাজ তাড়াতাড়ি করনই ভালো।
সোমেদ খাঁ এবার বেশ গম্ভীর হলেন। বললেন। মাইয়া আমাগো দুইখান। কাপড় আনলেন একখান। সেইটা হয় কি কইরা।
–তাইলে আরেক খান আনল কেডা?
–আপনেরাই আনছেন। ভুইল্যা গেছেন। দেখেন—দুইটা শাড়িই তালতলার হাটের ভুবন সাহার দোকানের। ঠিক কিনা কন?
মণ্ডল মশাই মাথা নাড়লেন। তালতলা থেকেই তারা শাড়িটা কিনছিলেন। কথা সত্য।
–সোমেদ খাঁ প্রশ্ন করলেন, ভাইপো আপনার দুইখান। কথা সত্য কিনা কন?
--কথা সত্য।
–তারা বিয়ার যুগ্যি হইছে কিনা কন?
–হইছে।
–তাগো বিয়া দেবার চাইছেন কিনা কন?
–চাই। কিন্তু?
–এই রকম মাইয়া এ তল্লাটে আর নাই।এগো দেখলে কেউ না করতে পারবে না।আপনার দুই ভাইপোই একবার হ্যা কইবে।
মাথা নেড়ে হারাধন মণ্ডল সব সত্যি বলে মেনে নিলেন। কিন্তু সব সত্যির বাইরেই আরো কিছু সত্যি আছে। সেটা বলার সুযোগই পেলেন না।তাকে মাথা নাড়তে দেখে সোমেদ খা বললেন, দ্যান, আমাগো মাইয়া দুজনের হাতে শাড়ি দুইটা তুইল্যা দেন। আর দেরী করণ ঠিক না। শুভ কাজ তাড়াতাড়ি করনই ভালো।
সোমেদ খাঁ তার হাতের উপর শাড়ি দুইখান গুঁজে দিলেন। একটু ঠেলেই এগিয়ে দিলেন দুমেয়ের হাতের দিকে। বলে উঠলেন জোরে জোরে--সোবহান আল্লা। সোবহান আল্লা।
দুটো শাড়ি অঞ্জলি আর বিজুলির হাতে তুলে এল। তারা প্রণাম করে গ্রহণ করল। আর তখুনি পাশের বাড়ির বউঝিরা জুকাড় দিয়ে উঠল। আজ্ঞামনির চোখে জল এসেছে। বিড় বিড় করে বলছেন, দুগগা। দুগগা। সন্ধ্যা ঘুরে যাওয়ার মুখে হারাধন মণ্ডলদের নৌকা ছেড়ে গেল।
আকাশে তখন চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। বনিক মাস্টার বাবু একা একা ধ্যানে বসেছেন বেলতলায়। আজ তার মনে অপার আনন্দ। ঈশ্বর তার কথা রেখেছেন। দুমেয়েরই আজ বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়েছে। আজ্ঞামনি রান্নাঘর গোছাতে শুরু করেছেন।
দুটো শাড়ি অঞ্জলি আর বিজুলির হাতে তুলে এল। তারা প্রণাম করে গ্রহণ করল। আর তখুনি পাশের বাড়ির বউঝিরা জুকাড় দিয়ে উঠল। আজ্ঞামনির চোখে জল এসেছে। বিড় বিড় করে বলছেন, দুগগা। দুগগা। সন্ধ্যা ঘুরে যাওয়ার মুখে হারাধন মণ্ডলদের নৌকা ছেড়ে গেল।
আকাশে তখন চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। বনিক মাস্টার বাবু একা একা ধ্যানে বসেছেন বেলতলায়। আজ তার মনে অপার আনন্দ। ঈশ্বর তার কথা রেখেছেন। দুমেয়েরই আজ বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়েছে। আজ্ঞামনি রান্নাঘর গোছাতে শুরু করেছেন।
এই ফাঁকে দুবোনে ঘাটকুলে এসে দাড়াল। সেখানে একটি বাঁশি পড়ে আছে। এই বাঁশিটিই বেজেছিল। দুবোনে বাঁশিটি তুলে নিল। একবার মনে হল–ডাক দিয়ে ফেরায় নৌকাটিকে। ডেকে বলে—বাঁশিটি নিয়ে যান। তাকিয়ে দেখল—সন্ধ্যা ঘিরে ফেলেছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিছুই দেখা যায় না। নৌকার শব্দও মিলিয়ে গেছে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে।
বিয়ের তারিখ পড়েছে আশ্বিনের শুরুর দেষ্টে। ঠিক পূজার আগে। পূজায় জোড়ে আসতে পারবে। এই খবর নিয়ে এসেছিলেন হারাধন মণ্ডল। তিনি দিনে আসেননি। এসেছেন সন্ধ্যা ঘুরে গেলে। এবার তার মধ্যে বেশ ছটফটানি আছে।
সেদিন বনিক মাস্টার বাড়িতেই ছিলেন। খুব খুশি হয়ে হারাধন মণ্ডলকে বললেন, মানুষ যা যাঞ্চা করে—তা সত্যি সত্যি পূর্ণ হয়। ঈশ্বর কাউকে অখুশি করেন না।
সেদিন বনিক মাস্টার বাড়িতেই ছিলেন। খুব খুশি হয়ে হারাধন মণ্ডলকে বললেন, মানুষ যা যাঞ্চা করে—তা সত্যি সত্যি পূর্ণ হয়। ঈশ্বর কাউকে অখুশি করেন না।
হারাধন মণ্ডল কিছু বলার চেয়ে শুনলেন। বনিকবাবু তদগত হয়ে বলছেন, দেখেন, আপনারা যেদিন আমার দু মাইয়ার সম্বন্ধ আনলেন, তারপর থেকেই মাইয়া দুটো ডালিম চারা সংগ্রহ করে রেখেছে। জালালির বাসায় ঘনঘন উঁকি দিচ্ছে–ডিম ফোটার কত দেরী তাই দেখছে। নতুন যে শিশু জালালি আসবে—আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। আর অঞ্জলি কয়েকটা হাঁস বাইছা রাখছে। এগুলো তার সঙ্গে যাবে। দুবোনে কদিন ধইরা হাত পাখা বুনতে শুরু করেছে। বুঝলেন মণ্ডল মশাই, আমার মাইয়া দুটো জীবনে আলাদা হয় নাই। আপনাদের বাড়িতে দু বউ হইয়া থাকবে। এইটা ভাইবা দুবোনে এখন পরীর মতো উড়ছে। এই আনন্দ ওদের জন্য আপনিই আইনা দিছেন। ঈশ্বর আপনাদেরকে আমাদের বাড়িতে পাঠাইছেন—ওদের মনের আশা পূরণ করতে। এছাড়া আমারও আর কিছু চাওয়া নাই।
হারাধন মণ্ডল যা বলতে এসেছিলেন তা আর বলতে পারলেন না। তিনি এ সময় দেখতে পেলেন, বনিক মাস্টার বাবুর মুখটা প্রাচীন ঋষিদের মুখের মতো পুত পবিত্র। তার চোখ দুটো আনন্দরূপ জলে পূর্ণ। এই জল আকাশে থাকে। এই জল মেঘে মেঘে ঘোরে। এই জল বৃষ্টি হয়ে ঝরে। এই জলে ঈশ্বর থাকেন। ভোরে ফুল ফোটান। বনিক মাস্টারকে এরকম তদগত দেখে আজ তাঁর মন ভরে উঠল। এই রকম মানুষের কথা এতকাল তিনি শুনেছেন—কখনো দেখেননি। দেখলে পূন্য হয়। পূন্যবান এই মানুষটির সামনেই তিনি বসে আছেন। তার হাতটি ধরে আছেন পরম নির্ভরতায়। দেখতে পাচ্ছেন—তাঁর হাতের মধ্যে প্রাণবায়ূ বেত্রবতি নদীর মতো দপ দপ করে বয়ে চলেছে। আর কয়েকটি জোনাকি উড়ে বসেছে তার চুলের মধ্যে। তিনি জোড় হাত করে তাঁকে প্রণাম করলেন।
এর মধ্যে অঞ্জলি--বিজুলি ধানী রং শাড়িটা পরে এসেছে। কানে ডালিম ফুলের দুল। হাসি হাসি মুখ। কোনো খেদ নেই। দেখে মনে হয়না—মানুষের মেয়ে। মোল্লাকান্দির চৌধুরীদের বাড়ির প্রতিমা। এই মাত্র রং দেওয়া হয়েছে। তারা দুজনে বনিক মাস্টারের পাশে দাঁড়িয়ে গান ধরল—
এর মধ্যে অঞ্জলি--বিজুলি ধানী রং শাড়িটা পরে এসেছে। কানে ডালিম ফুলের দুল। হাসি হাসি মুখ। কোনো খেদ নেই। দেখে মনে হয়না—মানুষের মেয়ে। মোল্লাকান্দির চৌধুরীদের বাড়ির প্রতিমা। এই মাত্র রং দেওয়া হয়েছে। তারা দুজনে বনিক মাস্টারের পাশে দাঁড়িয়ে গান ধরল—
চেয়ে থাকি চেয়ে থাকি/
শ্যাম তোর তরে তমাল ত্লায় চেয়ে থাকি।
শ্যাম তোর তরে তমাল ত্লায় চেয়ে থাকি।
এই গানের সঙ্গে সঙ্গে অবাক হয়ে জোতকুরার হারাধন মণ্ডল দেখতে পেলেন—তাদের সামনে সত্যি সত্যি একটি কদমগাছ ফুটে উঠেছে। তার তলায় দুটো মেয়ে অপার হয়ে চেয়ে আছে। কৃষ্ণ কালা তাদের জন্য না এসে পারবেন না। তিনি এই দুই প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মাগো আর দেরী নাই। এই আশ্বিনেই তোমাগো দুজনরেই আমাগো বাড়ি নিয়া যাব।
ভাত খাওয়ার পরে আজ্ঞামনি হারাধন মণ্ডলকে পান দিলেন। এক ফাঁকে তিনি হারাধন মণ্ডলকে জিজ্ঞেস করলেন, দাদা, সত্যি কইরা কনতো, আপনি আজ কি কইতে আইছিলেন? হারাধন মণ্ডল বিষম খেলেন। কিছুক্ষণ পরে উত্তর করলেন, বিয়ের তারিখটা ফাইনাল করতে আইছিলাম। অন্য কিছু নয়।
ভাত খাওয়ার পরে আজ্ঞামনি হারাধন মণ্ডলকে পান দিলেন। এক ফাঁকে তিনি হারাধন মণ্ডলকে জিজ্ঞেস করলেন, দাদা, সত্যি কইরা কনতো, আপনি আজ কি কইতে আইছিলেন? হারাধন মণ্ডল বিষম খেলেন। কিছুক্ষণ পরে উত্তর করলেন, বিয়ের তারিখটা ফাইনাল করতে আইছিলাম। অন্য কিছু নয়।
আজ্ঞামণি আরেকটা পান দিলেন। বললেন, দাদাগো, আমি সব বুঝি। আমার মাইয়া দুইটা। বিয়ে দেওন লাগবে। আপনারা যত্ন কইরা নিতে আইছেন—দেনা পাওনার কোনো কথা কন নাই। আমাগো সে সামর্থ্যও নাই। কিছু মনে কইরেন না—আপনাগো ঘরে দুই মাইয়ার বদলে এক মাইয়া নিলেও আমার কোনো আপত্তি নাই। পরে আরেকজন বর যোগাড় কইরা দিয়েন।
এই রাতে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল হারাধন মণ্ডল। তিনি আর থাকলেন না। নৌকা ছেড়ে দিলেন। যাওয়ার আগে বললেন আজ্ঞামনিকে, আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি নাই। দুই মাইয়ার লগেই আমার দুই ভাইপোর বিয়া হইবে। যদি না হয় সেইটা দৈব দুর্বিপাক। আমার কোনো হাত নাই।
বিয়ের আগের দিন হারাধন মণ্ডল জোতকুরা থেকে একটি হাত চিঠি পাঠিয়েছেন আজ্ঞামনিকে। লিখেছেন-- দিদিগো, আপনার কথাই সত্যি হয়ে গেল। তীর্থনাথ এখন বিয়ে করবেনা। সে পালাগানে বাঁশি বাজাতেই পছন্দ করছে। তার ওস্তাদ হাসিম মৃধা কবিরাজ বলেছেন—এখন বিয়ে করলে—ঘরে আটকা পড়ে থাকতে হবে। বাঁশি আর বাজানো যাবে না। বিয়ে আর বাঁশি দুইটা এক লগে হয় না। যে কোনো একটা নিতে হবে।
এই রাতে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল হারাধন মণ্ডল। তিনি আর থাকলেন না। নৌকা ছেড়ে দিলেন। যাওয়ার আগে বললেন আজ্ঞামনিকে, আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি নাই। দুই মাইয়ার লগেই আমার দুই ভাইপোর বিয়া হইবে। যদি না হয় সেইটা দৈব দুর্বিপাক। আমার কোনো হাত নাই।
বিয়ের আগের দিন হারাধন মণ্ডল জোতকুরা থেকে একটি হাত চিঠি পাঠিয়েছেন আজ্ঞামনিকে। লিখেছেন-- দিদিগো, আপনার কথাই সত্যি হয়ে গেল। তীর্থনাথ এখন বিয়ে করবেনা। সে পালাগানে বাঁশি বাজাতেই পছন্দ করছে। তার ওস্তাদ হাসিম মৃধা কবিরাজ বলেছেন—এখন বিয়ে করলে—ঘরে আটকা পড়ে থাকতে হবে। বাঁশি আর বাজানো যাবে না। বিয়ে আর বাঁশি দুইটা এক লগে হয় না। যে কোনো একটা নিতে হবে।
আমাকে ক্ষমা দিয়েন। এই বেলা আপনারা একজনের বিয়ের ব্যবস্থাই করেন। পরে তীর্থনাথকে রাজী করাব। এখনো আমার আশা আছে।
আজ্ঞামনি আর না করলেন না। তিনি বরযাত্রীদের আসতে বললেন। সন্ধ্যা সন্ধ্যা বরযাত্রী এসে পড়েছে। হারাধন মণ্ডল আসেননি। তিনি খুব অসুস্থ। এ পর্যন্ত আজ্ঞামনি কিছু বলেননি দু মেয়েকে কিছু। দুবোন ঘরেই ছিল সারাদিন। এর মধ্যে পাশের বাড়ির অমলা—বিমলা দু’বোন এসেছে সাজাতে। তাদেরকে বলে অঞ্জলি--বিজুলি দুবোনে বাড়ির পিছনে পুকুরের দিকে চলে এসেছে। মুখে কোনো কথা নেই। পাড়ের দিকে দুজন দুজনের হাত ধরে ঝুঁকে পড়েছে। পুকুরের চারিদিকে টোপাপানা। যে জলের উপর তাদের মুখখানি উঠেছে সেখানে টোপাপানা নেই। উপরে আকাশ। মেঘ করেছে। দুটো ফড়িং উড়ে এসে ওদের চুলের উপর বসেছে। দুবোনে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে—ঠিক মুহুর্তেই বৃষ্টি নামল। কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি জলের উপর পড়ে তাদের দুজনের মুখচ্ছবি ভেঙ্গে দিল। আর তখনি আজ্ঞামনি পেছন থেকে ছুটে দুমেয়েকে টেনে ধরলেন। বললেন, মাগো—তোরা মরলে—তোর বাবার কি হবে!
সেদিন রাতে বিয়ে হলে গেল বিজুলির। অঞ্জলি তাকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিল। আজ্ঞামনি দু মেয়ের কানে কানে বললেন, তীর্থনাথ রাজী হবে কইছেন মণ্ডলবাবু। কয়ডা দিন ধৈর্য ধইরা থাকো।
বনিক মাস্টার নিথর হয়ে বসে রইলেন বেলতলায়। আজ তিনি ধ্যানে বসেননি। তার মনটা বিচ্ছিন্ন। একবার ভেবেছিলেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মাঝ বিলে যাবেন। জলের উপর বসে থাকবেন। সোমেদ খাঁ তাকে থামিয়েছেন। বলেছেন—মাস্টার বাবু, আপনে কইলে আমরা জোতকুরা গ্রাম থেকে তীর্থনাথকে ধইরা নিয়া আসতি পারি। আপনে কইলে এই হারাধন মণ্ডলরে নাই কইরা দিতে পারি।
মাস্টার বাবু তার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, আমি কিছুই কইতে পারিনা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, তার কথা ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ে না। আমি তুমি কিছুই করতে পারি না।
সোমেদ খাঁ রাগ করে বিয়ে বাড়িতেই থাকলেন না। বিলের মধ্যে নৌকা নিয়ে বসে রইলেন। তিনি অঞ্জলি নামের মেয়েটির দুঃখে কাঁদতে লাগলেন। তার নিজের মেয়ে নাই। এই মেয়ে দুটিই তার মেয়ের মতো।
এ সময় বিজুলিকে ধরে নিয়ে এসেছে অঞ্জলি। বনিক মাস্টারের কাছে এসে বলেছে, বাবা, বিজুলিকে আশীর্বাদ করো। বিয়ার লগন চইলা যায়।
সোমেদ খাঁ রাগ করে বিয়ে বাড়িতেই থাকলেন না। বিলের মধ্যে নৌকা নিয়ে বসে রইলেন। তিনি অঞ্জলি নামের মেয়েটির দুঃখে কাঁদতে লাগলেন। তার নিজের মেয়ে নাই। এই মেয়ে দুটিই তার মেয়ের মতো।
এ সময় বিজুলিকে ধরে নিয়ে এসেছে অঞ্জলি। বনিক মাস্টারের কাছে এসে বলেছে, বাবা, বিজুলিকে আশীর্বাদ করো। বিয়ার লগন চইলা যায়।
বনিক মাস্টার দু মেয়েকেই জড়িয়ে ধরলেন। তার মনে হল এভাবে দুমেয়েকে জড়িয়ে রেখে দেবেন। ছাড়বেন না। ছেড়ে দিলেই ওরা আলাদা হয়ে যাবে। আর এক সঙ্গে ওদের দেখা যাবে না।
তখন আজ্ঞামনি এলেন। বিজুলির হাত ধরে নিয়ে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, অঞ্জলি, তোর বাবার লগে বইসা থাক।
সেদিন সারারাত বেলতলায় বাবা আর মেয়ে দুজনে বসে রইল। এর মধ্যেই বারবার জুকার ধ্বনি শোনা গেল। কারা খে্লো কি খেলো না এই নিয়ে মৃদু হৈ চৈও শোনা গেলো। কারা কারা উঠোনে খড় বিছিয়ে তাস খেলতে লাগল। কে একজন রাত্রির শেষ প্রহরে বিজয় সরকারের গান গেয়ে উঠল—পোষা পাখি উড়ে যাবে একদিন, ভাবি নাই তো মনে।
সেদিন সারারাত বেলতলায় বাবা আর মেয়ে দুজনে বসে রইল। এর মধ্যেই বারবার জুকার ধ্বনি শোনা গেল। কারা খে্লো কি খেলো না এই নিয়ে মৃদু হৈ চৈও শোনা গেলো। কারা কারা উঠোনে খড় বিছিয়ে তাস খেলতে লাগল। কে একজন রাত্রির শেষ প্রহরে বিজয় সরকারের গান গেয়ে উঠল—পোষা পাখি উড়ে যাবে একদিন, ভাবি নাই তো মনে।
পরদিন বাঁশি বিয়ের পরে বিজুলি শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। যাওয়ার সময় অঞ্জলির কাছে এল বিজুলি। তাকে তীর্থনাথের ফেলে যাওয়া বাঁশিটা দিল। বলল, চিন্তা করিস না অঞ্জু। তীর্থনাথ আসবে। তোকে দেখলে সে আর না করতে পারবে না। আবার আমরা দুবোনে এক লগে থাকতে পারব। আর যদি সে না আসে, তাইলে আবার এক লগে তুই আর আমি জলে ডুইবা মরব।
পূজার সময় বিজুলির জোড়ে আসার কথা। এল না। জামাই শ্যামাপ্রসাদ খলিফাগিরি নিয়ে খুব ব্যস্ত। লক্ষ্মী পূজায় আসতে পারল না। তাদের বাড়িতে লক্ষ্মীর নতুন আসন পড়েছে। এখন আসতে পারবে না।
এ বাড়ির সবাই জোতকুরায় বিজুলির বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এল সরস্বতী পূজার সময়। শুধু অঞ্জলি গেল না। বিজুলি খবর পাঠাল, তীর্থনাথ হাসিম মৃধা কবিরাজের সঙ্গে দক্ষিণে গেছে পালাগান করতে। সেখান থেকে যাবে বরিশালে। তারপর ভাটিদেশে--নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে বায়না আছে। এসব শেষ না করে তার ফেরা হবে না।
চৈত্র মাস পড়লে হারাধন মণ্ডল রওনা ফিরবেন তীর্থনাথকে ফিরিয়ে আনতে। যেদিন করবেন ঠিক সেদিনই তিনি সন্যাস রোগে পড়লেন। আকারে ইঙ্গিতে বোঝালেন, অঞ্জলিকে যেন খবর দেওয়া হয়—তীর্থনাথ এবার নিশ্চয়ই আসবে। এসে অঞ্জলিকে বিয়ে করে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে। বিজুলির সঙ্গে মিলে মিশে থাকবে।
এর মধ্যে বেশ কিছু সম্বন্ধ এসেছিল। অঞ্জলি রাজী হয়নি। বনিক মাস্টারও বেশি জোর করেননি। তিনিও শুনেছেন হারাধন মণ্ডল মারা যাওয়ার আগে তার জামাই শ্যামাপ্রসাদকে বলেছেন—সে যেন মোহনগঞ্জে যায়। গিয়ে তীর্থনাথকে ফিরিয়ে আনে। শ্যামাপ্রসাদ নিজে যেতে পারেনি তার খলিফাগিরির কারণে। কিন্তু একজন বিশ্বস্ত লোককে খরচাপাতি দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোকটি খবর দিয়েছে—তীর্থনাথ ভাটি এলাকা থেকে পতিসরে গেছে। এরপর কুষ্টিয়ার ভাড়ারা গ্রামে কিছুদিন আখড়ায় থাকবে। সেখানে রওনা হয়ে গেছে।
এর মধ্যে বেশ কিছু সম্বন্ধ এসেছিল। অঞ্জলি রাজী হয়নি। বনিক মাস্টারও বেশি জোর করেননি। তিনিও শুনেছেন হারাধন মণ্ডল মারা যাওয়ার আগে তার জামাই শ্যামাপ্রসাদকে বলেছেন—সে যেন মোহনগঞ্জে যায়। গিয়ে তীর্থনাথকে ফিরিয়ে আনে। শ্যামাপ্রসাদ নিজে যেতে পারেনি তার খলিফাগিরির কারণে। কিন্তু একজন বিশ্বস্ত লোককে খরচাপাতি দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোকটি খবর দিয়েছে—তীর্থনাথ ভাটি এলাকা থেকে পতিসরে গেছে। এরপর কুষ্টিয়ার ভাড়ারা গ্রামে কিছুদিন আখড়ায় থাকবে। সেখানে রওনা হয়ে গেছে।
আরো ছয়মাস পরে খবর পাওয়া গেল—কুষ্টিয়া থেকে নবদ্বীপে আছে তীর্থনাথ। সেখানে রাস উৎসব শেষে ফিরে আসবে। এবং বলেছে—তার গুরু হাসিম মৃধা কবিরাজ তাকে এবার সংসারী হতে বলেছে। বলেছে—যে মেয়েটি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে সে আসলে রাধা। তাকে বিয়ে করলেই তার কৃষ্ণভাব এসে যাবে। কৃষ্ণ ছাড়া এ জগতে আর কোনো সার নেই। এই উপলক্ষে তীর্থনাথ একটি কৃষ্ণ--মূর্তি মূর্তি পাঠিয়েছে। সেটা অঞ্জলির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে বিজুলি। বলেছে—আর দেরী নাই।
এই মূর্তি নিয়ে অঞ্জলি বেশ খুশি। তার থাকার মধ্যে আগে ছিল তীর্থনাথের ফেলা যাওয়া বাঁশি। এখন হল কৃষ্ণ--মূর্তি। অদ্ভুত কালো কষ্টি পাথরে গড়া কৃষ্ণ লালা। মুখে হাসি। মাথায় মুকুট। গলায় কুন্দ ফুলের মালা। চোখে দেখে আশ মেটে না। এই মূর্তি দেখে তার মনে হল—সে কোনোদিন তীর্থনাথের মুখ দেখেনি। চোখও দেখেনি। লোকটি চিকন কি মোটা– কালো, না, ধলো কিছুই জানে না। শুধু তার বাঁশি শুনেছে। বাঁশির সুরটিই জানে। আর কিছু নয়।
অঞ্জলি এই মূর্তিকে করে স্নান করায়। ভোগ দেয়। সকাল সন্ধ্যা পূজা করে। আর বাঁশিটা বের করে চেয়ে চেয়ে দেখে। কানের কাছে মাঝে মাঝে চেপে ধরে। শুনতে পায় তীর্থনাথের চেয়ে থাকি চেয়ে থাকি গানটির সুর। আর চেয়ে চেয়ে থাকে ঘাটকূলের দিকে। তীর্থনাথ এই পথে ফিরবে। তাকে আবার বাঁশিটা দেবে। তীর্থনাথ বাঁশিতে সুর তুলবে—চেয়ে থাকি চেয়ে থাকি/ শ্যাম তোর তরে কদম তলায় চেয়ে থাকি। তীর্থনাথকে ফিরিয়ে আনবে।
তারও বছর খানেক পরে তীর্থনাথের কোনো খবর পাওয়া গেলো না। কেবা কারা বলল, সে বর্ডার পার হওয়ার সময় ধরা পড়েছে। জেলে আছে। তবে এই পারের জেলে, না, ওই পারের জেলে সেটা জানা গেল না। জেল থেকে ছাড়া পেলেই ফিরে আসবে।
জামাই শ্যামা প্রসাদ ভাইকে ছাড়িয়ে আনতে বর্ডারে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বিজুলি গর্ভবতী হওয়ার জন্য যেতে পারেনি। এরপরে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। শুধু একটি চিঠি পেয়েছে। অঞ্জলিকে লিখেছে বিজুলি—একজন দালাল খবর এনেছে বর্ডারে তীর্থনাথ ধরা পড়েনি। বর্ডার পার হওয়ার সময়ে গুলি খেয়েছে। আর কিছু জানা যায়নি।
বিজুলি লিখেছে, অঞ্জলি, বোন আমার, তোর কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। দুই বোনে এক লগে থাকব এই রকম আর আশা দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয়—এবার বাড়ি চলে আসি। তুই আর আমি পুকুরঘাটে জলে ডুবে মরি।
কিন্তু এরা এখন বাবার বাড়ি আসতে দেবে না। এরা বলেছে—অনেকদিন পরে বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে। এখানে রঞ্জিত ডাক্তার আছেন। তিনিই দেখাভাল করবেন। আর তাছাড়া এখন মরলে—পেটেরটাও মরবে। এটা ঠিক হবে না। ওর জন্মের পরই মরা ঠিক হবে।
এর মধ্যে বিজুলির ছেলে হয়েছে। ছেলেটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। আড়াল হলেই কান্নাকাটি করে। বিজুলি লিখেছে–আরেকটু বড় হোক। ওর ননদিনী শ্বশুরবাড়ি থেকে এলেই তার কাছে দিয়ে দিব। তখন আর সমস্যা থাকবে না। অঞ্জু, বোন আমার, তোকে তখন খবর দেব। দুজনে ঠিক ডুবে মরবে।
আরেকটি চিঠিতে লিখেছে ছেলেটি এখন হামা দিতে শিখেছে। মা মা করে ডাকে। আরো কিছুদিন পরে এক পা দুপা করে মাকে ধরে ধরে হাঁটতে শিখেছে।
বিজুলি লিখেছে, অঞ্জলি, বোন আমার, তোর কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। দুই বোনে এক লগে থাকব এই রকম আর আশা দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয়—এবার বাড়ি চলে আসি। তুই আর আমি পুকুরঘাটে জলে ডুবে মরি।
কিন্তু এরা এখন বাবার বাড়ি আসতে দেবে না। এরা বলেছে—অনেকদিন পরে বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছে। এখানে রঞ্জিত ডাক্তার আছেন। তিনিই দেখাভাল করবেন। আর তাছাড়া এখন মরলে—পেটেরটাও মরবে। এটা ঠিক হবে না। ওর জন্মের পরই মরা ঠিক হবে।
এর মধ্যে বিজুলির ছেলে হয়েছে। ছেলেটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। আড়াল হলেই কান্নাকাটি করে। বিজুলি লিখেছে–আরেকটু বড় হোক। ওর ননদিনী শ্বশুরবাড়ি থেকে এলেই তার কাছে দিয়ে দিব। তখন আর সমস্যা থাকবে না। অঞ্জু, বোন আমার, তোকে তখন খবর দেব। দুজনে ঠিক ডুবে মরবে।
আরেকটি চিঠিতে লিখেছে ছেলেটি এখন হামা দিতে শিখেছে। মা মা করে ডাকে। আরো কিছুদিন পরে এক পা দুপা করে মাকে ধরে ধরে হাঁটতে শিখেছে।
আরও কিছুদিন পরে লিখেছে –এই সময়টিতে আসার সুযোগটা ছিল। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে তার মেয়ে হবে। শ্যামাপ্রসাদ এই উপলক্ষে তার জন্য সোনার হার গড়িয়ে এনেছে। তার চেয়েও বড় কথা—তেতুলিয়ার কেশীর মায়ের কাছে সে গিয়েছিল। কেশীর মা দর্পণ পড়া করে বলেছে—তীর্থনাথ মরেনি। জীবিত আছে। এখন কোনো সমুদ্রপাড়ে তার ছায়া দেখা যায়। জায়গাটা পুরীর হতে পারে। মেয়ে হওয়ার পরেই শ্যামাপ্রসাদ তাকে পুরীতে নিয়ে যাবে।
এর মধ্যে ডালিমগাছটি ফলদান বন্ধ করেছে। জামগাছটি আশ্বিনের ঝড়ে পড়ে গেছে। সেখানে আরেকটি অরবরই গাছ ডগডগিয়ে উঠেছে। বনিক মাস্টার মশাই গত হয়েছেন বেশ আগেই। সোমেদ খাঁ ইন্তেকালের আগে তার ছেলেরা গঞ্জে চলে গেছে। সেখানে ব্যবসা বানিজ্যে থিতু হয়েছে। ঈদ--কোরবানীতে তারা কাপড়চোপড় পাঠায় তাদের এই অঞ্জলি বইনটিকে। হারাধন মণ্ডল নামে এ এলাকায় কেউ একজন ছিলেন সেটা লোকে ভুলে গেছে। হাসিম মৃধা কবিরাজের পালাগানের দলটি লুপ্ত। তার জায়গায় দীপালী অপেরা বেশ নাম করেছে। সেখানে মিস প্রভা ডানাকাটা পরী সাজে। বনিক মাস্টারের বেলতলাটি আছে। সেখানে একটি কুঁড়ে ঘর হয়েছে। অঞ্জলি সেখানে একা একা থাকে। কারো সামনে বের হয় না। লোকে বলে—তিনি সাক্ষাৎ জননী হয়েছেন। কৃষ্ণ--মূর্তির সঙ্গে তার প্রতিদিন ভালো--মন্দ কথা হয়। লোকে বলাবলি করে —এই অঞ্জলি যদি বলে তাহলে ফাঁকা আকাশ থেকে মেঘ তো মেঘ– বৃষ্টি ফাল দিয়ে নামতে পারে। আর তারা জানে, তাঁর কাছে একটি বাঁশি আছে। সেটা সাক্ষাৎ কৃষ্ণ ঠাকুরের বাঁশি। স্বয়ং কৃষ্ণ ঠাকুর এলে তাঁর হাতে তুলে দেবে। অঞ্জলিকে বাঁশি বাজিয়ে শোনাবে। তাকে হাত ধরে নিয়ে যাবে। এই ভেবে এই এলাকার লোকজন তাকে বিরক্ত করে না। দূর থেকে তাকে গড় করে যায়।
সেবার আমাবতির গোন চলে যায়তো বৃষ্টি নামে না। খালে জল নাই। শুকনো খটখটে। লোকজন ফেলা পাগলের থানে হত্যে দিল। ব্যাঙের বিয়েও দিল। দিল ন্যাংটার চিনি। মেঘ হয়। মেঘ চলে যায়। দূরে বিদ্যুত চমক দেখা যায়। কিন্তু বৃষ্টি নামে না। এদিকে জমি বুননের গোন চলে যায়। লোকজনের মাথায় হাত পড়ার দশা। তারা দিশা না পেয়ে অঞ্জলির কাছে ঘো্রাঘুরি করতে লাগল। অঞ্জলি ঘর থেকে বের হয়না। ঘরের ভেতরে কৃষ্ণ--মূর্তি নিয়ে সেধিয়ে আছে। আর মাঝে মাঝে শোনা যায়—গুণগুণ করে গাইছে—চেয়ে আছি চেয়ে আছি গানটি।
অঞ্জলির ছোটো ভাইয়ের বউ শেফালি বালা একদিন উঁকি মেরে বলল, দিদিগো, আর তো বাঁচন নাই মনে হইতেছে। আপনে এইবার কিছু কনগো। নাইলে সামনে অভাব আইসা পড়তেছে।
এর মধ্যে ডালিমগাছটি ফলদান বন্ধ করেছে। জামগাছটি আশ্বিনের ঝড়ে পড়ে গেছে। সেখানে আরেকটি অরবরই গাছ ডগডগিয়ে উঠেছে। বনিক মাস্টার মশাই গত হয়েছেন বেশ আগেই। সোমেদ খাঁ ইন্তেকালের আগে তার ছেলেরা গঞ্জে চলে গেছে। সেখানে ব্যবসা বানিজ্যে থিতু হয়েছে। ঈদ--কোরবানীতে তারা কাপড়চোপড় পাঠায় তাদের এই অঞ্জলি বইনটিকে। হারাধন মণ্ডল নামে এ এলাকায় কেউ একজন ছিলেন সেটা লোকে ভুলে গেছে। হাসিম মৃধা কবিরাজের পালাগানের দলটি লুপ্ত। তার জায়গায় দীপালী অপেরা বেশ নাম করেছে। সেখানে মিস প্রভা ডানাকাটা পরী সাজে। বনিক মাস্টারের বেলতলাটি আছে। সেখানে একটি কুঁড়ে ঘর হয়েছে। অঞ্জলি সেখানে একা একা থাকে। কারো সামনে বের হয় না। লোকে বলে—তিনি সাক্ষাৎ জননী হয়েছেন। কৃষ্ণ--মূর্তির সঙ্গে তার প্রতিদিন ভালো--মন্দ কথা হয়। লোকে বলাবলি করে —এই অঞ্জলি যদি বলে তাহলে ফাঁকা আকাশ থেকে মেঘ তো মেঘ– বৃষ্টি ফাল দিয়ে নামতে পারে। আর তারা জানে, তাঁর কাছে একটি বাঁশি আছে। সেটা সাক্ষাৎ কৃষ্ণ ঠাকুরের বাঁশি। স্বয়ং কৃষ্ণ ঠাকুর এলে তাঁর হাতে তুলে দেবে। অঞ্জলিকে বাঁশি বাজিয়ে শোনাবে। তাকে হাত ধরে নিয়ে যাবে। এই ভেবে এই এলাকার লোকজন তাকে বিরক্ত করে না। দূর থেকে তাকে গড় করে যায়।
সেবার আমাবতির গোন চলে যায়তো বৃষ্টি নামে না। খালে জল নাই। শুকনো খটখটে। লোকজন ফেলা পাগলের থানে হত্যে দিল। ব্যাঙের বিয়েও দিল। দিল ন্যাংটার চিনি। মেঘ হয়। মেঘ চলে যায়। দূরে বিদ্যুত চমক দেখা যায়। কিন্তু বৃষ্টি নামে না। এদিকে জমি বুননের গোন চলে যায়। লোকজনের মাথায় হাত পড়ার দশা। তারা দিশা না পেয়ে অঞ্জলির কাছে ঘো্রাঘুরি করতে লাগল। অঞ্জলি ঘর থেকে বের হয়না। ঘরের ভেতরে কৃষ্ণ--মূর্তি নিয়ে সেধিয়ে আছে। আর মাঝে মাঝে শোনা যায়—গুণগুণ করে গাইছে—চেয়ে আছি চেয়ে আছি গানটি।
অঞ্জলির ছোটো ভাইয়ের বউ শেফালি বালা একদিন উঁকি মেরে বলল, দিদিগো, আর তো বাঁচন নাই মনে হইতেছে। আপনে এইবার কিছু কনগো। নাইলে সামনে অভাব আইসা পড়তেছে।
বলতে বলতে শেফালি বালার গলা ধরে এল। আজ তার ছেলেটাকে গুড় দিতে পারেনি। গুড় কেনার কথা বললে ওর বাবা ছেলের মুখে চড় দিয়েছে। এর আগে কোনোদিন চড় কেনো—ধমকও দেয়নি। ছেলেটা চড় খেলে কান্না ভুলে গেছে। শুধু একবার চেঁচিয়ে বলেছে, পিসিমা।
সেদিনও কিছু বলল না অঞ্জলি। পরদিন খুব ভোর হওয়ার আগেই তার কুড়ে থেকে বের হল। বাইরে তখন আলো ফুটতে শুরু করেছে। স্নান শেষ করে বেল তলায় একটা প্রণাম করল। পুকুর পাড়ে আজ্ঞামনিকে রাখা হয়েছে এক বর্ষায়। তার পাশে বনিক মাষ্টার। গলবস্ত্র হয়ে দুজনকে প্রণাম করল। ততক্ষণে চাল থেকে জালালিরা তার দিকে উড়ে এসেছে। ওদেরকে ফিসফিস করে বলল, তোরা চরা--খরায় যা। যাইয়া দেখ কিছু আহার মেলে কিনা। হাঁসগুলি পাক পাক করে উঠল। তাদের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল, কাদা খুঁচে দেখ। পাইলেও কিছু পাইতে পারিস। তারপর শেফালী বালারে ডেকে বলল, যাই বউ?
শেফালী বালার হাই উঠেছে। বলল, আপনি কই যাইবেন গো দিদি?
–কালা যেদিকে নিয়া যায়।
–কালা কেডা?
শুনে অঞ্জলি হাসল। আঁচলের তলা থেকে কৃষ্ণ--মূর্তিটা বের করে বলল, এই যে কালা। তার কাছে যা চাইবা—তাই পাইবা।
তীর্থনাথের পাঠানো এই কালা চান্দের মূর্তিটা কখনো অঞ্জলি হাত ছাড়া করেনি। সদা সর্বদাই আঁচল চেপে রেখেছে। স্নানের সময়েও তাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। রাতে ঘুমিয়েছে বুকে করে। আর লুকিয়ে রেখেছে তীর্থনাথের বাঁশিটি। আজ শেফালীর দিকে কালা চান্দকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই লও গো বউ। আইজ হতে কালা চান্দ তোমার।
শেফালীবালা হাতে নিয়ে বলল, আমি কালা চান্দরে নিয়া কী করব? আমি তো বৈরাগী না দিদি। আমি নিলে আপনের কি হইবে?
অঞ্জলি বলল, কালা চান্দরে নায়ৈবা। খাওয়াইবা। ঘুম পাড়াইবা। আর মনের ইচ্ছা তার কাছে কইবা। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হৈবে।
– তিনি কি আমাগো বৃষ্টি আইনা দিতে পারবেন?
–পারবেন না ক্যান! তার কাছে মন দিয়া চাইলেই তিনি পূর্ণ করবেন। এছাড়া তার কাজ কি?
শুনে শেফালীবালা বলে উঠল, তিনি কি আপনের ইচ্ছা পূরন করছেন দিদি?
শুনে অঞ্জলি স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখ তির তির করে কাঁপতে লাগল। জল নেমে এল। বলল, আমি তো কালাচান্দের কাছে অন্য কিছু চাই নাই।
–তাইলে কি চাইছেন এতো কাল?
–কিছু চাই নাই বউ। কিছু চাই নাই।
–তাইলে যে লোকে কয়, আপনে চাইয়া চাইয়া দিন কাটাইতেছেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না অঞ্জলি। মুখে আঁচল দিয়ে বাড়ির নিচে নেমে গেল। মনে মনে বলল, কালা চান্দরেই চাইছিলাম। আর কিছু নয়। কিন্তু কালাচান্দ ধরা দিতে দিতে ধরা দেয় না।
শেফালী বালার হাই উঠেছে। বলল, আপনি কই যাইবেন গো দিদি?
–কালা যেদিকে নিয়া যায়।
–কালা কেডা?
শুনে অঞ্জলি হাসল। আঁচলের তলা থেকে কৃষ্ণ--মূর্তিটা বের করে বলল, এই যে কালা। তার কাছে যা চাইবা—তাই পাইবা।
তীর্থনাথের পাঠানো এই কালা চান্দের মূর্তিটা কখনো অঞ্জলি হাত ছাড়া করেনি। সদা সর্বদাই আঁচল চেপে রেখেছে। স্নানের সময়েও তাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। রাতে ঘুমিয়েছে বুকে করে। আর লুকিয়ে রেখেছে তীর্থনাথের বাঁশিটি। আজ শেফালীর দিকে কালা চান্দকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই লও গো বউ। আইজ হতে কালা চান্দ তোমার।
শেফালীবালা হাতে নিয়ে বলল, আমি কালা চান্দরে নিয়া কী করব? আমি তো বৈরাগী না দিদি। আমি নিলে আপনের কি হইবে?
অঞ্জলি বলল, কালা চান্দরে নায়ৈবা। খাওয়াইবা। ঘুম পাড়াইবা। আর মনের ইচ্ছা তার কাছে কইবা। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হৈবে।
– তিনি কি আমাগো বৃষ্টি আইনা দিতে পারবেন?
–পারবেন না ক্যান! তার কাছে মন দিয়া চাইলেই তিনি পূর্ণ করবেন। এছাড়া তার কাজ কি?
শুনে শেফালীবালা বলে উঠল, তিনি কি আপনের ইচ্ছা পূরন করছেন দিদি?
শুনে অঞ্জলি স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখ তির তির করে কাঁপতে লাগল। জল নেমে এল। বলল, আমি তো কালাচান্দের কাছে অন্য কিছু চাই নাই।
–তাইলে কি চাইছেন এতো কাল?
–কিছু চাই নাই বউ। কিছু চাই নাই।
–তাইলে যে লোকে কয়, আপনে চাইয়া চাইয়া দিন কাটাইতেছেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না অঞ্জলি। মুখে আঁচল দিয়ে বাড়ির নিচে নেমে গেল। মনে মনে বলল, কালা চান্দরেই চাইছিলাম। আর কিছু নয়। কিন্তু কালাচান্দ ধরা দিতে দিতে ধরা দেয় না।
বাড়ির হালট পার হবার আগেই শেফালী বালার ছেলে অনন্ত দৌড়ে এল। অনন্ত তার খুব নেওটা। সে অঞ্জলির ঘরের মধ্যে যেতে পারে। তার সঙ্গে থাকতে পারে। কথা বলতে পারে। অনন্ত ছুটে এসে বলল, পিসি, আমারে তোমার লগে নেও।
একা একা বহুদিন এই পথে ঘাটে বের হয়নি অঞ্জলি। আজ বের হয়ে ভয় ভয় করে। সব কিছু অচেনা মনে হয়। অনন্ত আসায় তার ভয় কমে গেল। শেফালীর দিকে চেয়ে বলল, ও বউ কি করি কও তো?
শেফালী কালাকেষ্টকে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, যাউক না আপনার লগে। অনন্ত থাকলে আপনার ফেরত আইতে কষ্ট হইবে না। ও ঠিক ফেরত নিয়া আসবে। তারা একটু এগিয়ে গেলে শেফালি বালা চেঁচিয়ে বলল, ওরে ও অনন্ত, তোর পিসির লগে বিষ্টি নিয়া ফেরত আসিস।
ফেরত আসবে কি আসবে না সেটা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই অঞ্জলি বালার। আগে জোতকুরা যাবে। বিজুলির কাছে যাবে। দুবোনে জলে ডুবে মরবে। আর কোনো ইচ্ছে নেই।
গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলল হেঁটে হেঁটে। কখনো অনন্ত অঞ্জলি বালাকে পিছনে ফেলে সামনে দৌঁড়ে দৌঁড়ে যায় আগে আগে।। আবার কখনো কখনো কোনো কিছু দেখে থেমে যায়। পিসিকে আগে যেতে দেখে দৌঁড়ে এসে তার হাত ধরে। গ্রামের লোক তাদের দেখে জোড় হাত করে। তাদের মনে আশা জেগেছে—এবার বৃষ্টি নামবে। বউ--ঝিরা জুকাড় দিয়ে ওঠে। মা জননীরে নিভৃতে পথ করে দেয়। আর চিন্তা নাই।
এইভাবে যেতে যেতে বিকেল নাগাদ মেঘ করে এল। ধুলো উড়িয়ে বাতাস বইল। কারা কারা ছুটে বেরিয়ে এসে তার স্বরে চেঁচাতে লাগল—বৃষ্টি ঝেঁপে। ধান দেব মেপে।
একা একা বহুদিন এই পথে ঘাটে বের হয়নি অঞ্জলি। আজ বের হয়ে ভয় ভয় করে। সব কিছু অচেনা মনে হয়। অনন্ত আসায় তার ভয় কমে গেল। শেফালীর দিকে চেয়ে বলল, ও বউ কি করি কও তো?
শেফালী কালাকেষ্টকে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, যাউক না আপনার লগে। অনন্ত থাকলে আপনার ফেরত আইতে কষ্ট হইবে না। ও ঠিক ফেরত নিয়া আসবে। তারা একটু এগিয়ে গেলে শেফালি বালা চেঁচিয়ে বলল, ওরে ও অনন্ত, তোর পিসির লগে বিষ্টি নিয়া ফেরত আসিস।
ফেরত আসবে কি আসবে না সেটা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই অঞ্জলি বালার। আগে জোতকুরা যাবে। বিজুলির কাছে যাবে। দুবোনে জলে ডুবে মরবে। আর কোনো ইচ্ছে নেই।
গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলল হেঁটে হেঁটে। কখনো অনন্ত অঞ্জলি বালাকে পিছনে ফেলে সামনে দৌঁড়ে দৌঁড়ে যায় আগে আগে।। আবার কখনো কখনো কোনো কিছু দেখে থেমে যায়। পিসিকে আগে যেতে দেখে দৌঁড়ে এসে তার হাত ধরে। গ্রামের লোক তাদের দেখে জোড় হাত করে। তাদের মনে আশা জেগেছে—এবার বৃষ্টি নামবে। বউ--ঝিরা জুকাড় দিয়ে ওঠে। মা জননীরে নিভৃতে পথ করে দেয়। আর চিন্তা নাই।
এইভাবে যেতে যেতে বিকেল নাগাদ মেঘ করে এল। ধুলো উড়িয়ে বাতাস বইল। কারা কারা ছুটে বেরিয়ে এসে তার স্বরে চেঁচাতে লাগল—বৃষ্টি ঝেঁপে। ধান দেব মেপে।
অনন্তও তাদের সঙ্গে নাচতে নাচতে গলা মেলালো। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সত্যি সত্যি আজ বৃষ্টি এল।
বৃষ্টি থেকে জলধারা শুকনো মাটিকে ভিজিয়ে দিতে লাগল। মাটি থেকে এক ধরনের ভাঁপ বের হতে লাগল।
বৃষ্টিতে ভিজে ভালোই লাগল অঞ্জলির—অনন্তর। এই বৃষ্টির মধ্যেই হেঁটে যেতে ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অনন্তর ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে ভেবে আর এগুলো না। কাছের একটি বাড়ির দিকে উঠে এল।
বাড়িটি নতুন। বছর দুয়েক হয়েছে। আকারে ছোটো খাটো। ছনের ঘর। হোগলার বেড়া। দরজা নেই। ভেতরে ঢুকে দেখতে পেল—তিনটে ছাগল আর দুটো ছেলে মেয়ে বসে আছে চুপ করে। এতোক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিল বলে এখন একটু ঠাণ্ডায় হি হি করছে। বাইরে হাওয়ার ঝাপ্টা এসে বেড়ার উপরে পড়লে ভয় পাচ্ছে– চেঁচিয়ে তাদের মাকে ডাকছে। তারা যখন চেঁচিয়ে ওঠে– ছাগল তিনটিও ম্যা ম্যা করে তারস্বরে ডেকে ওঠে। তাদের মা ঘরের মধ্যে নেই। বাইরে মেটে--আলু তুলতে গিয়েছিল। ছেলে--মেয়ের ডাক শুনতে পেয়ে ছুটে এল। তাকে দেখে এবার ছাগল তিনটি ল্যাজ নাড়তে লাগল। ভেঁজা আঁচল দিয়েই ছেলেদুটোকে মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, চুপ কইরা থাক। কাইল মেলা কাম। ধান বাইর করতে হবে। কাল বুনতে হবে। আর চিন্তা নাই।
বউটির বয়স বেশি নয়। ঢল ঢল মুখ। এক বাটিতে কিছু চাল ভাজা বের করে তার ছেলে দুটির সামনে দিল। অনন্তকেও দুটো দিয়ে বলল, বলল, আপনেরা যাইবেন কই?
এই প্রশ্নের জবাব নেই অঞ্জলির মুখে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অনন্ত চাল ভাজা খেতে খেতে উত্তর দিল, জোতকুরা। আমার বিজুলি পিসির বাড়ি।
বৃষ্টি থেকে জলধারা শুকনো মাটিকে ভিজিয়ে দিতে লাগল। মাটি থেকে এক ধরনের ভাঁপ বের হতে লাগল।
বৃষ্টিতে ভিজে ভালোই লাগল অঞ্জলির—অনন্তর। এই বৃষ্টির মধ্যেই হেঁটে যেতে ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অনন্তর ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে ভেবে আর এগুলো না। কাছের একটি বাড়ির দিকে উঠে এল।
বাড়িটি নতুন। বছর দুয়েক হয়েছে। আকারে ছোটো খাটো। ছনের ঘর। হোগলার বেড়া। দরজা নেই। ভেতরে ঢুকে দেখতে পেল—তিনটে ছাগল আর দুটো ছেলে মেয়ে বসে আছে চুপ করে। এতোক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিল বলে এখন একটু ঠাণ্ডায় হি হি করছে। বাইরে হাওয়ার ঝাপ্টা এসে বেড়ার উপরে পড়লে ভয় পাচ্ছে– চেঁচিয়ে তাদের মাকে ডাকছে। তারা যখন চেঁচিয়ে ওঠে– ছাগল তিনটিও ম্যা ম্যা করে তারস্বরে ডেকে ওঠে। তাদের মা ঘরের মধ্যে নেই। বাইরে মেটে--আলু তুলতে গিয়েছিল। ছেলে--মেয়ের ডাক শুনতে পেয়ে ছুটে এল। তাকে দেখে এবার ছাগল তিনটি ল্যাজ নাড়তে লাগল। ভেঁজা আঁচল দিয়েই ছেলেদুটোকে মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, চুপ কইরা থাক। কাইল মেলা কাম। ধান বাইর করতে হবে। কাল বুনতে হবে। আর চিন্তা নাই।
বউটির বয়স বেশি নয়। ঢল ঢল মুখ। এক বাটিতে কিছু চাল ভাজা বের করে তার ছেলে দুটির সামনে দিল। অনন্তকেও দুটো দিয়ে বলল, বলল, আপনেরা যাইবেন কই?
এই প্রশ্নের জবাব নেই অঞ্জলির মুখে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অনন্ত চাল ভাজা খেতে খেতে উত্তর দিল, জোতকুরা। আমার বিজুলি পিসির বাড়ি।
বউটি শুনে বলে, ও, জোতকুরা। আমাগো পরের গ্রামে। আর দেরী নাই। কোন বাড়ি?
অনন্ত তার পিসির নাম জানে বটে। কিন্তু বাড়িটির নাম জানে না। সে অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বলল, পিসি জানে।
অঞ্জলিও ঠিক জানে না কোন বাড়ি। শুধু জানে হারাধন মণ্ডলের নাম। আসতে করে বলল, জোতকুরার হারাধন মণ্ডলের বাড়ি।
অনন্ত তার পিসির নাম জানে বটে। কিন্তু বাড়িটির নাম জানে না। সে অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে বলল, পিসি জানে।
অঞ্জলিও ঠিক জানে না কোন বাড়ি। শুধু জানে হারাধন মণ্ডলের নাম। আসতে করে বলল, জোতকুরার হারাধন মণ্ডলের বাড়ি।
শুনে বউটি মাথার উপরে একটু ঘোমটা টেনে দিল। বলল, উনি নাই। দেহ রাখছেন। ওনার নিজের ছেলে মেয়ে নাই। দুই ভাইপোই তার নিজের ছেলেপেলে। বড়জনের নাম শ্যামাপ্রসাদ। যদুপুর বাজারে খলিফাগিরি করে। তিনি এ বাড়ির উনির বড় দাদা লাগে।
শুনে অঞ্জলি চমকে ওঠে। জিজ্ঞেস করে, তোমার এবাড়ির উনির নাম কি?
উনির নাম বলতে একটু শরম পায় বউটি। ছেলেমেয়ে দুটিকে বলে—হ্যাগো বাজান, ওনার নাম কতো।
ছেলেটি--মেয়ে দুটি নাম বলে না। ওরা বৃষ্টি দেখতে দেখতে চাল ভাজা খায়। ছাগল তিনটি ম্যা ম্যা করে ডাকে।
এ সময় ঘরের পেছন থেকে কোন এক পুরুষ কণ্ঠ শোনা যায়। বৃষ্টির মধ্যে গুনগুণ করে গান ধরেছে–
চেয়ে থাকি চেয়ে থাকি
শ্যাম তোর তরে কদম তলায় চেয়ে থাকি।
উনির নাম বলতে একটু শরম পায় বউটি। ছেলেমেয়ে দুটিকে বলে—হ্যাগো বাজান, ওনার নাম কতো।
ছেলেটি--মেয়ে দুটি নাম বলে না। ওরা বৃষ্টি দেখতে দেখতে চাল ভাজা খায়। ছাগল তিনটি ম্যা ম্যা করে ডাকে।
এ সময় ঘরের পেছন থেকে কোন এক পুরুষ কণ্ঠ শোনা যায়। বৃষ্টির মধ্যে গুনগুণ করে গান ধরেছে–
চেয়ে থাকি চেয়ে থাকি
শ্যাম তোর তরে কদম তলায় চেয়ে থাকি।
শুনে বউটি বলে, উনি গায়েন মানুষ। উলপুরের বিখ্যাত হাসিম মৃধা কবিরাজের দলে বাঁশি বাজাইতেন। উলপুরের চৌধুরী বাবুরা ওনার বাজন শুইনা একটা মেডেল দিছিলেন। রূপার। কইছিলেন—সামনের বার একটা সোনার মেডেল দেবেন।
অঞ্জলি জিজ্ঞেস করে, সোনার মেডেলটা পরেরবার পাইছিলেন?
–না, পান নাই। তার কি একটা বাঁশি হারানি যাওয়ায় আর বাঁশি বাজান নাই। হাসিম কবিরাজ কইছিলেন বাবারে পুরানো বাঁশি হারাইয়া গেলে নতুন বাঁশি লইলেই চলে। তিনি নতুন বাঁশি লইতে আর রাজী হন নাই। পরে সেইখান থিকা সুন্দর বনে বাওয়ালীগিরি করতি চইলা যান। সেইখানে আমার বাপজান মেনা শেখের লগে চিনপরিচয়। তখন তো আমি গ্যাদা মাইয়া। বড় হইতে হইতে আমার বাপেরে বাঘে ধরছে। মায়েরে কুমীরে খাইছে।
বউটি টিনের বাকসো থেকে একটা রূপোর মেডেল বের করে অঞ্জলির হাতে দিল। অঞ্জলি পড়ে দেখল–-সেখানে লেখা আছে তীর্থনাথ মণ্ডল। পড়ে তার গা থরথর করে কেঁপে উঠল। মেডেল বউটির হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়াল। দেখে বউটি হা হা করে উঠল, অখনো তো বৃষ্টি থামে নাই। আরেকটু বইসা যান।
অঞ্জলি বসবে না। অনন্তর হাত ধরে বৃষ্টির মধ্যেই উঠোন পেরিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেল—পেছনের বাগানে কে একজন লোক কুঁজো হয়ে বাঁশের ঠেকনা দিচ্ছে কলাগাছে। তার মুখটা দেখা যায় না। পেছনটা দেখা যায়। তার পিঠ বেয়ে লম্বা চুল বেয়ে নেমেছে। চুলগুলো সাদা। তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গানটি গাইছেন। তার মুখ দেখা যায় না। দেখার উপায়ও নেই। তার দিকে বউটি চেয়ে আছে। এই চোখ এড়ানো যায় না। আর দেখেই বা কী হবে? সে তো তীর্থনাথকে কোনোদিন চোখেই দেখে নি। কাছ থেকে দেখেনি। দূর থেকেও দেখেনি। শুধু তার বাঁশি মনে আছে। আর কিছু নয়। বাঁশির সুর শুনে কোনো অদেখা মানুষকে চেনা যায় না।
অঞ্জলি বসবে না। অনন্তর হাত ধরে বৃষ্টির মধ্যেই উঠোন পেরিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেল—পেছনের বাগানে কে একজন লোক কুঁজো হয়ে বাঁশের ঠেকনা দিচ্ছে কলাগাছে। তার মুখটা দেখা যায় না। পেছনটা দেখা যায়। তার পিঠ বেয়ে লম্বা চুল বেয়ে নেমেছে। চুলগুলো সাদা। তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গানটি গাইছেন। তার মুখ দেখা যায় না। দেখার উপায়ও নেই। তার দিকে বউটি চেয়ে আছে। এই চোখ এড়ানো যায় না। আর দেখেই বা কী হবে? সে তো তীর্থনাথকে কোনোদিন চোখেই দেখে নি। কাছ থেকে দেখেনি। দূর থেকেও দেখেনি। শুধু তার বাঁশি মনে আছে। আর কিছু নয়। বাঁশির সুর শুনে কোনো অদেখা মানুষকে চেনা যায় না।
একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছেড়ে অঞ্জলি একটু থামল। তার ছোটো পুটুলি থেকে একটা পুরনো আড় বাঁশি বের করে বউটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এইটা ওনারে দিয়েন। ভালো বাঁশি।
বউটি নিতে যাবে তার আগে অনন্ত বাঁশিটা ধরল। বলল, আমারে দেও পিসি। আমি বাজামু।
বউটি হেসে বলল, তুমিই নাও। উনি বুইড়া হইছেন। অখন আর বাজাইয়া কী করবেন। বুইড়া মাইনসের বাঁশি বাজনের শখ থাকন ভালো না।
বউটি নিতে যাবে তার আগে অনন্ত বাঁশিটা ধরল। বলল, আমারে দেও পিসি। আমি বাজামু।
বউটি হেসে বলল, তুমিই নাও। উনি বুইড়া হইছেন। অখন আর বাজাইয়া কী করবেন। বুইড়া মাইনসের বাঁশি বাজনের শখ থাকন ভালো না।
অনন্ত বাঁশিটা ফুঁ দিয়ে বাজাতে চেষ্টা করল। বাজল না। তবে বাজবে। বাজানোর কায়দা শিখে বাজাতে পারবে। সমস্যা হবে না।
বউটি ওদেরকে পথ অব্দি এগিয়ে দিতে আসতে আসতে বলল, ওনার লগে আমার বিয়া হয় নাই। উনি করবেন না। কিন্তু আমি যুবতি মাইয়া। আমি যাই কই। আছি ওনার লগে। এই জন্যি ওনার ভাই ওনারে জোতকুরায় ঠাঁই দেন নাই।
এ কথা শুনলো কি শুনল না অঞ্জলি—ঠিক বোঝা গেলো না। বউটি তাদের পিছনে পিছনে একটু এগিয়ে এল। একা একা বলে চলল, ওই ছেলে--মাইয়া দুইটার বাপ উনি নয়। ওদের বাপের নাম সরফুদিন মাঝি। বাওয়ালী। উনিই হ্যার লগে আমার বিয়া দিছিলেন। গেল বছর তারে বাঘে খাইছে।
কাছে--পিঠে বাজ পড়ল। অনন্ত ভয় পেয়ে অঞ্জলির গা ঘেষে এল। অঞ্জলি তার গায়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, হা, কৃষ্ণ।
হা কৃষ্ণ বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, কৃষ্ণ একা আছে। তার স্নান হয়নি। ভোগও দেওয়া হয়নি। কৃষ্ণমূর্তি পাওয়ার পরে এ হেলা কখনো হয়নি। যদি এ সময় কৃষ্ণ তীর্থনাথকে নিয়ে ফিরে আসে? যদি তার নাম ধরে ডাকে? যদি তার দেখা না পেয়ে ফিরে যায়?
সে অনন্তের হাত ধরে আগে আগে হাঁটতে লাগল। যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকে যেতে লাগল। দেখে অনন্ত বলল, ও পিসি, জোতকুরা যাবা না–বিজুলি পিসির বাড়ি যাবা না?
অঞ্জলি কিছু বলল না। একটু নিচু হল। পথের মধ্যে জল জমেছে। সে জলের মধ্যে বহুদিন পরে চোখ রাখল। দেখতে পেল—একটি অচেনা মুখ ভেসে উঠেছে। মুখটাতে বলিরেখা। চোখের নিচে কালি। চুলে পাক ধরেছে। তাকে চিনতে পারছে না। এ মুখ অঞ্জলিরও নয়—বিজুলিরও নয়। অন্য কারো। দেখে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। জল নেমে আসে। জলের মধ্যে ঝরে পড়ে। জলের মধ্যে ফুটে ওঠা মুখচ্ছবিটি ভেঙ্গে যায়। মনে হয় এই জল কাদার মধ্যে আর হাঁটতে পারবে না। হড়কে পড়ে যাবে।
এ কথা শুনলো কি শুনল না অঞ্জলি—ঠিক বোঝা গেলো না। বউটি তাদের পিছনে পিছনে একটু এগিয়ে এল। একা একা বলে চলল, ওই ছেলে--মাইয়া দুইটার বাপ উনি নয়। ওদের বাপের নাম সরফুদিন মাঝি। বাওয়ালী। উনিই হ্যার লগে আমার বিয়া দিছিলেন। গেল বছর তারে বাঘে খাইছে।
কাছে--পিঠে বাজ পড়ল। অনন্ত ভয় পেয়ে অঞ্জলির গা ঘেষে এল। অঞ্জলি তার গায়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, হা, কৃষ্ণ।
হা কৃষ্ণ বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, কৃষ্ণ একা আছে। তার স্নান হয়নি। ভোগও দেওয়া হয়নি। কৃষ্ণমূর্তি পাওয়ার পরে এ হেলা কখনো হয়নি। যদি এ সময় কৃষ্ণ তীর্থনাথকে নিয়ে ফিরে আসে? যদি তার নাম ধরে ডাকে? যদি তার দেখা না পেয়ে ফিরে যায়?
সে অনন্তের হাত ধরে আগে আগে হাঁটতে লাগল। যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকে যেতে লাগল। দেখে অনন্ত বলল, ও পিসি, জোতকুরা যাবা না–বিজুলি পিসির বাড়ি যাবা না?
অঞ্জলি কিছু বলল না। একটু নিচু হল। পথের মধ্যে জল জমেছে। সে জলের মধ্যে বহুদিন পরে চোখ রাখল। দেখতে পেল—একটি অচেনা মুখ ভেসে উঠেছে। মুখটাতে বলিরেখা। চোখের নিচে কালি। চুলে পাক ধরেছে। তাকে চিনতে পারছে না। এ মুখ অঞ্জলিরও নয়—বিজুলিরও নয়। অন্য কারো। দেখে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। জল নেমে আসে। জলের মধ্যে ঝরে পড়ে। জলের মধ্যে ফুটে ওঠা মুখচ্ছবিটি ভেঙ্গে যায়। মনে হয় এই জল কাদার মধ্যে আর হাঁটতে পারবে না। হড়কে পড়ে যাবে।
জল কাদার মধ্যে তার পা হড়কে যাতে না যায় সে জন্য একটা লাঠি খুঁজে নিয়েছে। এটা ধরে বেশ হাঁটা যায়। হাঁটতে হাঁটতে শুনল– বহুদিন পরে আজ ব্যাঙ ডাকছে।
কুলদা রায়
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক
নিউইয়র্কে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ