গৌর বৈরাগীর গল্প : গল্পের পরিমল

খট খট করে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠল দিবাকর।

গ্যাট, ডাংকেল আর মুক্ত অর্থনীতির প্রতিবাদে আজ বাংলা বন্ধ। আগে থেকে ঘোষিত থাকায় বেশ সুবিধে হয়েছে। লীলারা ছেলেমেয়ে নিয়ে পাশের বাড়ির সঙ্গে ফ্যামিলি পিকনিক করছে। অল রাউন্ডার ক্লাব ওয়ানডে কমপিটিশনের আয়োজন করেছে। সেখানে মাইকে পুরনো দিনের কিশোরকণ্ঠ।
দিবাকরের হইচই ভালো লাগে না। সে একটা বই এনেছে অফিস লাইব্রেরি থেকে। গল্পটি বেশ জমাটি।

সত্তর দশকের ঘটনা। ঘটনার ভেতরে একজন আত্মগোপনকারী বিপ্লবী। দুই খুনের মামলায় সে অভিযুক্ত। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। সে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কখনও একাকী পুরুলিয়ার নির্জন বনে। তিনদিন জল ছাড়া কিছু খায়নি। তবু তার চোখে স্বপ্ন স্বপ্ন। চারদিনের দিন সেই স্বপ্ন দিয়েই ভাত মেখে খেতে বসেছে এক সাঁওতাল পরিবারে। তখনই এল খবরটা। একটা চিঠি। ‘তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার বাড়ি এসো। আমাদের মোম শয্যাশায়ী।‘ চিঠির ভেতর একজন মা আর তার আশঙ্কা বাবাকেও ছুঁয়ে গেল। সে কাঁধে ব্যাগ ফেলে দ্রুত পথে নামে। রেলবাজারের পাশ দিয়ে সে বাড়ি যাবে। কিন্তু তার যাওয়ার আগেই খবর পৌঁছে যায় পুলিশের কাছে। ফাঁদ পাতে পুলিশ।

এই অবধি পড়ার পরই দরজার কড়া নাড়ার ভয়ঙ্কর শব্দে চটকা ভাঙে দিবাকরের। বিপ্লবী ছেলেটির নাম পরিমল। পরিমলকে মনে মনে ভালোবেসেছে সে। চাপা একমুখ দাড়িগোঁফ। বসা গলা, উশকোখুশকো চুল। নুয়ে পড়া ঘাড়। কিন্তু তীব্র আর মর্মভেদী চোখ দুটি। সে ভুলে যায় খুব। এমন ভুলোমন ছেলেকে কেউ কি সহজে ভুলতে পারে! তাই পুলিশের পাতা ফাঁদে সে যখন যখন আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে তখন বুকের মধ্যে ঢিব ঢিব করে ওঠে দিবাকরের। একটু শব্দ করেই দরজা খোলে সে। জরুরি কথা থাকলে সেটা সেরে নিয়ে এখনই বইটা শুরু করতে হবে আবার। রাস্তার দোকানপাঠই যা বন্ধ। এ দিকে সাইকেল যাচ্ছে। ভুরভুর করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তিনটে স্কুটার চলে গেল। একটির পেছনে চোখে কালো চশমা পরা প্রেমিকা। দরজার সামনে ছেলেটা দাঁড়িয়ে। সকাল নটার নরম রোদ্দুর এসে পড়েছে ছেলেটার কাঁধে।

কাকে চাই ভাই!

--আপনাকেই দরকার দিবাকরদা।

--আমাকে! বলে দিবাকর ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকে। কোথায় দেখেছি। কোথায় দেখেছি! তারপরই হঠাৎ ভীষণ রকম চমকে ওঠে সে। শালবনের ছায়া নেমেছিল মাটির উঠোনে। শালবনের গন্ধ। জ্যোৎস্নার গন্ধ। মোরগ-ফুল গাছের পাশে বসেছিল একটা শানকি নিয়ে।

কালো , ছিপছিপে ঢ্যাঙা, ঘিয়ে রঙের পেন্টুল, পুরনো ডিজাইনের হাওয়াই শার্ট। সরু সরু সিটে পরা আঙুলে ঝুরঝুরে শুকনো ভাত তুলে মুখে তুলছিল। এই ছেলেটাই না! কী আশ্চর্য। দিবাকরের গলা থমথম করে।

তুমি গল্পের পরিমল না!

--হ্যাঁ আমিই সে। ছেলেটা সতর্ক চোখে চারপাশে তাকায়। ঘন দাড়ির ভেতর হাত বুলিয়ে নেয়। তারপর চাপা গলায় বলে, ‘পুলিশ ঘিরে ফেলেছে আমাকে। আমাদের মোমের সঙ্গে আর বোধ হয় দেখা হল না।’

তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর দিবাকরকে ছোঁয় না। সে ভারী অবাক। আশ্চর্য, এ ঘটনাও তো পঁচিশ বছর আগের। হুবহু সেই ঘটনা। হুবহু সেই চরিত্র।

--দিবাকরদা। ছেলেটা চাপা গলায় আবার কথা বলে। আমার শেলটার দরকার। আপনি যদি......

মুহূর্তে বর্তমানে ফিরে আসে দিবাকর। রো রো ইয়োর বোট। জেন্টলি ডাউন দ্য স্ট্রিম। শুভশ্রী গানটা গায়। এবাড় ফাইভ হোবে। ক্লাশে র‍্যাঙ্ক করে। এ বি আই ম্যাগনামের দশ হাজার ইউনিট ডিম পাড়ছে। ছেলেটার দিকে তাকায় দিবাকর। দুটো খুন। একটা কি দুটো ডাকাতি। এইটুকু ভাবতে গিয়েই একটু সময় গড়িয়ে যায়। তার মধ্যেই ছেলেটা ফিরে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে দিবাকরের। কেমন যেন মায়াই হয় তার। দ্রুত পথে নামে সে, আমি—আমি কিন্তু তোমাকে ফিরিয়ে দিইনি পরিমল।

--আপনি দ্বিধাহীন গ্রহণও করেননি। সে নরম করে হাসে।

--কিন্তু এটা কি সম্ভব! দিবাকর চিৎকার করে। পঁচিশ বছর আগের গল্পের আবার নতুন করে ফিরে আসা।

--হ্যাঁ সম্ভব। শান্ত গলায় স্পষ্ট করে উচ্চারণ তকরে ছেলেটা। গল্পে একটা রাস্তা থাকে। গল্পে একটা বাড়ি থাকে। একটা চরিত্রও থাকে সেখানে। গল্পের রাস্তার ধারে গাছ বসিয়ে নেয় পাঠক। গল্পের বাড়ির জানলায় আকাশি রঙের পর্দা ঝুলিয়ে দেয় সেই পাঠকই।



ঠিক তেমন করেই গল্পের পরিমলকে সে দরজা খুলে ডেকে আনে কখনও পঁচিশ কখনও চল্লিশ আবার কখনও বা নাতিদূর কোনও ভবিষ্যতের কোন সময়ে......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ