একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যাওয়ার পর আমরা সবাই ভয়ে ও উদ্বেগে বাড়িওয়ালার বসবার ঘরে জামায়েত হই। আমাদের বাড়িওয়ালা বয়সে যুবক, মুসল্লি মানুষ, রাজনীতির সাতে-পাঁচে নেই। বাইরে গোলাগুলি চলছিল, কখনো শোনা যাচ্ছিল মৃত্যুচিৎকার।
ফলে আমাদের দিকে ভদ্রলোকের রাগ ও অবজ্ঞার অন্ত রইল না। মৃদুভাষী মানুষটির মধ্যে চেনা যায় না এমন একটি ঔদ্ধত্য ফুটে উঠতে দেখলাম। তখন বোধহয় রাত সাড়ে বারোটা। বাচ্চাদেরও ঘুম ভেঙে গেছে এবং তারা হাঁ করে তাকায় আমাদের দিকে। এই অবস্থায় বাড়িওয়ালা উত্তেজিত হয়ে ইসলাম সম্বন্ধে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। উপসংহারে ইসলামের মহিমার বদলে সিদ্ধান্ত দিলেন যে আওয়ামী লীগ মানেই বেয়াদব-বেতমিজের দল যারা আল্লা-রাসুলকে মানে না। আমরা তাঁর ভাড়াটেরা আর কী বলি, তিনি তখন অবিসংবাদিত বক্তা, প্রতিবাদের কোনো উপায় নেই। যাহোক, বক্তৃতা শেষ করে তিনি হাতে একটি পাকিস্তানি পতাকা নিলেন এবং ছাদের দিকে চলে গেলেন। বাড়ির ওপর হেলালি চাঁদের নিশান টাঙানোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত এই কথাটা জানানো যে, এই বাড়ি পাকিস্তানের। বিপদের মুখে আমরা গেরস্তরাও নিঃশব্দে অনুমোদন করলাম যে পতাকা টাঙানোই ভালো।
কিন্তু মুহূর্তকাল পরই তীক্ষ্ন একটি চিৎকার ভেসে এল সিঁড়ি-দরজার দিক থেকে। বাড়িওয়ালার চিৎকার। সম্ভবত তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে।
ছুটে গেলাম বলব না, ভয় ছিল, উদ্বেগ-উত্তেজনা ছিল, তার মধ্যে কীভাবে যে দৌড়ে গেলাম বলতে পারি না। সিঁড়ি-দরজার বাইরে দুজন অস্ত্রধারী দাঁড়িয়ে, সামনে বাড়িওয়ালা এবং তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে অত্যন্ত বাঙালি ধরনের উর্দু ভাষায় কথা বলছেন। সিঁড়ির আড়ালে দাঁড়ানো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। শুনলাম বাড়িওয়ালা বলছেন, আমি মুসলমান, আল্লার কসম মুসলমান, এই দ্যাখেন আমার হাতে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ।
এক সৈনিক বলল: শুয়োরের বাচ্চা, তুমি তো হিন্দু। তোমার বাপ হিন্দু, চৌদ্দপুরুষ হিন্দু।
বাড়িওয়ালা বলল: জি না, আমি মুসলমান, আমার বাপ মুসলমান, তার বাপ মুসলমান...।
এই স্বীকারোক্তির পর দ্বিতীয় সৈনিকটি বাড়িওয়ালাকে কলেমা পড়তে বলল। কলেমা বাড়িওয়ালা পড়লেন অত্যন্ত মর্মস্পর্শী গলায় এবং কলেমা পড়া শেষ হতেই পেটের দিকে সঙ্গিনের একটি খোঁচা খেলেন। দ্বিতীয় সৈনিকটি সঙ্গিনের ব্যবহার শুরু করে দিয়ে হাঁ হাঁ হাসিতে ভেঙে পড়ল। প্রথম সৈনিকটি বলল, আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও কিছু মজা করে নিই ইয়ার। কিন্তু ইয়ারকে তখন চমৎকার খেলায় পেয়ে বসেছে। সঙ্গিনের দ্বিতীয় খোঁচাটি সে দিল আমাদের নিরীহ, পরহেজগার বাড়িওয়ালার উরুদেশে। একটু বোধহয় গভীর ব্যবহার ছিল সেটি, কারণ বাড়িওয়ালা প্রাণঘাতী চিৎকার ও করুণ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাঁর চার বছরের পুতুলের মতো সুন্দর একটি মেয়ে আছে, তার নাম ধরে কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ কাঁদার সুযোগ পেলেন না। সৈনিক দুজন বোধহয় সামান্য দুটি সঙ্গিনের খোঁচায় বাড়িওয়ালার এতখানি চিৎকার দিয়ে ওটাকে বেয়াদবি মনে করল, হয়তো মনে করল চিৎকারটা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যায়। তারা দ্রুত রেগে গেল। মুহূর্তেই আমাদের বাড়িওয়ালার কান্না থেমে গেল আর তাঁর ভূপতিত দেহের ওপর মুষলধারে পড়তে লাগল লাথি, চড়, ঘুষি, মাঝেমধ্যে ব্যবহারের গভীরতার খাতিরে সঙ্গিনের খোঁচা। আমাদের মৃদুভাষী বাড়িওয়ালা একেবারে হতভম্ব, যত মার খান তত অবাক হন। বারবার তিনি হাত দিয়ে ঠেকাতে যান, আল্লার নাম আউড়ে অনুরোধ করতে যান। তখনো বোধহয় তাঁর বিশ্বাস হয়নি যে, ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নামটার ওপর এমন নির্মম নৃশংস হয়ে উঠেছে। বাড়িওয়ালা ফিসফিস করে বলেছিলেন, আর মারবেন না ভাই, টাকা-পয়সা, ঘরবাড়ি সব দিয়ে দেব, জানটা বাঁচান শুধু। আল্লার দোহাই লাগে, জানটা বাঁচান।
এই কথাগুলি বলছিলেন তিনি মার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে, যত মার খাচ্ছিলেন ততই বলছিলেন কথাগুলি। শেষে দ্বিতীয় সৈনিকটির বুটের লাথি খেয়ে তাঁর বাঁ চোখটা গলে যায়, প্রাণঘাতী চিৎকারে রাত্রির ইতিহাস-প্রমাণ উঁচু ও গভীর অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। চিৎকার করে বললেন, আমার একটা মেয়ে আছে গো। হায় আল্লা, আমার কী হবে!
সৈনিক দুজন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বোধহয়, হাজার হোক মানুষের গা হাত-পা তো, শেষে দুজনই সত্যিকারের সৈনিকের মতো আমাদের বাড়িওয়ালার ওপর বেয়নেট চার্জ করে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোঙাতে গোঙাতে আমাদের মৃদুভাষী বাড়িওয়ালা মারা গেলেন। যে কারণেই হোক, এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়ে সৈনিকদ্বয়ের আর বিশেষ উৎসাহ রইল না, তারা বাতাসে কিছু বোঁটকা গন্ধ, গালিগালাজ ও হুঙ্কার ছেড়ে চলে গেল।
এই ঘটনার দশ মাস পরের কথা। ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। ঢাকা বিমানবন্দরে লোকে লোকারণ্য। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসছেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ঢাকা বিমানবন্দরে ফাঁকা নীল আকাশের দিকে ছিল সবার চোখ, কখন রাজহংসের মতন একটি বিমানের দেখা মেলে আকাশে, সেই আবেগ-নিবিড় অপেক্ষা চলছে। বছর পাঁচেকের একটি ছোট্ট একরত্তি মেয়েও ছিল সেই ভিড়ের ভেতর। সবাই ছিল আবেগতপ্ত ও উত্তেজিত। এমন একটি দুঃখের ছায়াপাত ছিল। এমন সময় মাইকে ঘোষণা করা হলো, আর কয়েক মিনিট, তারপরই তিনি আসছেন। ছোট মেয়েটি এই ঘোষণা শুনে আমার হাত ধরল, মুখ ওপরে তুলে করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল: আমার আব্বু আসবে না?
ফলে আমাদের দিকে ভদ্রলোকের রাগ ও অবজ্ঞার অন্ত রইল না। মৃদুভাষী মানুষটির মধ্যে চেনা যায় না এমন একটি ঔদ্ধত্য ফুটে উঠতে দেখলাম। তখন বোধহয় রাত সাড়ে বারোটা। বাচ্চাদেরও ঘুম ভেঙে গেছে এবং তারা হাঁ করে তাকায় আমাদের দিকে। এই অবস্থায় বাড়িওয়ালা উত্তেজিত হয়ে ইসলাম সম্বন্ধে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। উপসংহারে ইসলামের মহিমার বদলে সিদ্ধান্ত দিলেন যে আওয়ামী লীগ মানেই বেয়াদব-বেতমিজের দল যারা আল্লা-রাসুলকে মানে না। আমরা তাঁর ভাড়াটেরা আর কী বলি, তিনি তখন অবিসংবাদিত বক্তা, প্রতিবাদের কোনো উপায় নেই। যাহোক, বক্তৃতা শেষ করে তিনি হাতে একটি পাকিস্তানি পতাকা নিলেন এবং ছাদের দিকে চলে গেলেন। বাড়ির ওপর হেলালি চাঁদের নিশান টাঙানোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত এই কথাটা জানানো যে, এই বাড়ি পাকিস্তানের। বিপদের মুখে আমরা গেরস্তরাও নিঃশব্দে অনুমোদন করলাম যে পতাকা টাঙানোই ভালো।
কিন্তু মুহূর্তকাল পরই তীক্ষ্ন একটি চিৎকার ভেসে এল সিঁড়ি-দরজার দিক থেকে। বাড়িওয়ালার চিৎকার। সম্ভবত তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে।
ছুটে গেলাম বলব না, ভয় ছিল, উদ্বেগ-উত্তেজনা ছিল, তার মধ্যে কীভাবে যে দৌড়ে গেলাম বলতে পারি না। সিঁড়ি-দরজার বাইরে দুজন অস্ত্রধারী দাঁড়িয়ে, সামনে বাড়িওয়ালা এবং তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে অত্যন্ত বাঙালি ধরনের উর্দু ভাষায় কথা বলছেন। সিঁড়ির আড়ালে দাঁড়ানো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। শুনলাম বাড়িওয়ালা বলছেন, আমি মুসলমান, আল্লার কসম মুসলমান, এই দ্যাখেন আমার হাতে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ।
এক সৈনিক বলল: শুয়োরের বাচ্চা, তুমি তো হিন্দু। তোমার বাপ হিন্দু, চৌদ্দপুরুষ হিন্দু।
বাড়িওয়ালা বলল: জি না, আমি মুসলমান, আমার বাপ মুসলমান, তার বাপ মুসলমান...।
এই স্বীকারোক্তির পর দ্বিতীয় সৈনিকটি বাড়িওয়ালাকে কলেমা পড়তে বলল। কলেমা বাড়িওয়ালা পড়লেন অত্যন্ত মর্মস্পর্শী গলায় এবং কলেমা পড়া শেষ হতেই পেটের দিকে সঙ্গিনের একটি খোঁচা খেলেন। দ্বিতীয় সৈনিকটি সঙ্গিনের ব্যবহার শুরু করে দিয়ে হাঁ হাঁ হাসিতে ভেঙে পড়ল। প্রথম সৈনিকটি বলল, আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও কিছু মজা করে নিই ইয়ার। কিন্তু ইয়ারকে তখন চমৎকার খেলায় পেয়ে বসেছে। সঙ্গিনের দ্বিতীয় খোঁচাটি সে দিল আমাদের নিরীহ, পরহেজগার বাড়িওয়ালার উরুদেশে। একটু বোধহয় গভীর ব্যবহার ছিল সেটি, কারণ বাড়িওয়ালা প্রাণঘাতী চিৎকার ও করুণ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাঁর চার বছরের পুতুলের মতো সুন্দর একটি মেয়ে আছে, তার নাম ধরে কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ কাঁদার সুযোগ পেলেন না। সৈনিক দুজন বোধহয় সামান্য দুটি সঙ্গিনের খোঁচায় বাড়িওয়ালার এতখানি চিৎকার দিয়ে ওটাকে বেয়াদবি মনে করল, হয়তো মনে করল চিৎকারটা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যায়। তারা দ্রুত রেগে গেল। মুহূর্তেই আমাদের বাড়িওয়ালার কান্না থেমে গেল আর তাঁর ভূপতিত দেহের ওপর মুষলধারে পড়তে লাগল লাথি, চড়, ঘুষি, মাঝেমধ্যে ব্যবহারের গভীরতার খাতিরে সঙ্গিনের খোঁচা। আমাদের মৃদুভাষী বাড়িওয়ালা একেবারে হতভম্ব, যত মার খান তত অবাক হন। বারবার তিনি হাত দিয়ে ঠেকাতে যান, আল্লার নাম আউড়ে অনুরোধ করতে যান। তখনো বোধহয় তাঁর বিশ্বাস হয়নি যে, ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি নামটার ওপর এমন নির্মম নৃশংস হয়ে উঠেছে। বাড়িওয়ালা ফিসফিস করে বলেছিলেন, আর মারবেন না ভাই, টাকা-পয়সা, ঘরবাড়ি সব দিয়ে দেব, জানটা বাঁচান শুধু। আল্লার দোহাই লাগে, জানটা বাঁচান।
এই কথাগুলি বলছিলেন তিনি মার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে, যত মার খাচ্ছিলেন ততই বলছিলেন কথাগুলি। শেষে দ্বিতীয় সৈনিকটির বুটের লাথি খেয়ে তাঁর বাঁ চোখটা গলে যায়, প্রাণঘাতী চিৎকারে রাত্রির ইতিহাস-প্রমাণ উঁচু ও গভীর অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। চিৎকার করে বললেন, আমার একটা মেয়ে আছে গো। হায় আল্লা, আমার কী হবে!
সৈনিক দুজন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বোধহয়, হাজার হোক মানুষের গা হাত-পা তো, শেষে দুজনই সত্যিকারের সৈনিকের মতো আমাদের বাড়িওয়ালার ওপর বেয়নেট চার্জ করে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোঙাতে গোঙাতে আমাদের মৃদুভাষী বাড়িওয়ালা মারা গেলেন। যে কারণেই হোক, এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়ে সৈনিকদ্বয়ের আর বিশেষ উৎসাহ রইল না, তারা বাতাসে কিছু বোঁটকা গন্ধ, গালিগালাজ ও হুঙ্কার ছেড়ে চলে গেল।
এই ঘটনার দশ মাস পরের কথা। ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। ঢাকা বিমানবন্দরে লোকে লোকারণ্য। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসছেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ঢাকা বিমানবন্দরে ফাঁকা নীল আকাশের দিকে ছিল সবার চোখ, কখন রাজহংসের মতন একটি বিমানের দেখা মেলে আকাশে, সেই আবেগ-নিবিড় অপেক্ষা চলছে। বছর পাঁচেকের একটি ছোট্ট একরত্তি মেয়েও ছিল সেই ভিড়ের ভেতর। সবাই ছিল আবেগতপ্ত ও উত্তেজিত। এমন একটি দুঃখের ছায়াপাত ছিল। এমন সময় মাইকে ঘোষণা করা হলো, আর কয়েক মিনিট, তারপরই তিনি আসছেন। ছোট মেয়েটি এই ঘোষণা শুনে আমার হাত ধরল, মুখ ওপরে তুলে করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল: আমার আব্বু আসবে না?
0 মন্তব্যসমূহ