খড়ে ছাওয়া গ্রাম্য পোষ্ট অফিসের ভিতরে, নড়বড়ে টেবিলের সামনে, হাতভাঙ্গা চেয়ারের উপর, বেগুনে রঙের আলোয়ান গায়ে ঐ যে যুবকটি বসিয়া কার্য করিতেছে, ওই এখানকার পোষ্ট মাষ্টার বা ডাকবাবু বিমলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। ঘড়িতে ঠং ঠং করিয়া দশটা বাজিতেই, বাহিরে ঝম্ ঝম্ শব্দ শুনা গেল : “রাণার ডাক লইয়া আসিয়াছে। ৱাণার প্রবেশ করিয়া ডাকের ব্যাগটি টেবিলের উপর রাখিল ; বাবুকে প্রণাম করিয়া কপালের ঘাম মুছিল। ডাকবাবু ব্যাগের শিলমোহর পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। রাণার তখন ‘তামুক’ খাইতে বাহিরে চলিয়া গেল।
অফিস গৃহ এখন জনশূন্য। পিয়নেরা রান্না খাওয়া সারিয়া লইতেছে—খানিক পরেই আসিয়া জুটিবে, এবং নিজ নিজ বীটের চিঠি মনিঅৰ্ডার, রেজিষ্টারি প্রভৃতি বুঝিয়া লইবে। ব্যাগটি কাটিয়া বিমল উহা টেবিলের উপর উবুড় করিয়া ধরিল। চিঠিপত্র পার্শেল প্রভৃতির সঙ্গে, একটা প্রসিদ্ধ মাসিক পত্রের পাঁচ ছয়টা বিভিন্ন প্যাকেটও বাহির হইল। একটা প্যাকেট লইয়া বিমল তাহার দেরাজের মধ্যে রাখিল । ( ইহা সে বাসায় লইয়া যাইবে এবং আহারাদির পর শয়ন করিয়া, খুলিয়া গল্প ও প্রেমের কবিতাগুলির রসাস্বাদন করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িবে। ) তারপর চিঠির গাদা পরীক্ষা করিতে লাগিল। তাহার মধ্য হইতে ৪৷৫ খানি বাছিয়া লইয়া, দেরাজের মধ্যে লুকাইল। এগুলি সমস্তই খামের চিঠি এবং পুরুষের হস্তাক্ষরে স্ত্রীলোকের নামে ঠিকানা লেখা। এগুলিও সে বাসায় লইয়া গিয়া, জল দিয়া খুলিয়া পাঠ করিবে ;—শুধু প্রেমের গল্প কবিতা নয়, প্রেমের চিঠি পড়িতেও বিমল অত্যন্ত ভালবাসে। এটা সে একটা নির্দোষ আমোদ বলিয়াই মনে করে ; কারণ, চিঠিগুলি সে নষ্ট করে না, আবার জুড়িয়া, পরদিন ছাপমোহর লাগাইয়া, বিলির জন্য দিয়া থাকে। ছয়মাসের অধিক কাল বিমল এখানে আসিয়াছে—প্ৰত্যহই এইরূপ চিঠি অপহরণ করে ;–এটা তাহার একটা নেশার মত দাঁড়াইয়া গিয়াছে। সাড়ে দশটা বাজিল ; পিয়নেরা একে একে আসিয়া টেবিলের উভয় পার্শ্বে বসিয়া গেল। বিমল তাহাদের বিভিন্ন গ্রামের পত্রাদি বণ্টন করিয়া দিতে লাগিল ; এই অবসরে আমরা এই মহাপুরুষের কিঞ্চিৎ পূৰ্ব্ব পরিচয় দিয়া রাখা উচিত বিবেচনা করি ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বিমলের নিবাস যশোহর জেলার কোনও এক গন্ডগ্রামে। তথায় একটি হাই স্কুল আছে—সেই স্কুলের উপরের ক্লাসগুলির প্রত্যেকটিতে দুই তিন বৎসর করিয়া কাটাইয়া বিমল যখন প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে উদ্যত হইল, তখন তাহার গোফদাড়ি বেশ পুষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, এবং বয়স হইয়াছে ২২ বৎসর। গ্রামের লোকে সে সময় বলিয়াছিল, বিমল যে দিন পাস হবে, সেদিন পূবের সূর্যি পশ্চিম দিকে উঠবে।’ এইরূপ মন্তব্যের যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান ছিল। গ্রামের যত বকাটে ছোকরাই ছিল বিমলের বন্ধু ; সখের থিয়েটার দলের সেই ছিল প্রধান পাণ্ডা, এবং গঞ্জিকা সেবন ত অনেকদিন হইতেই চলিতেছিল, ইদানীং থিয়েটারের রিহার্সলে যে বোতলও গোপনে আমদানী হইত, তাহার ও বিশ্বাসজনক প্রমাণ আছে। কিন্তু যে ঘটনা অভাবনীয়, তাহাই ঘটিয়া গেল, গেজেট বাহির হইলে দেখা গেল, বিমল তৃতীয় বিভাগে পাস হইয়াছে,—অথচ সুর্যদেব গ্রামের লোকের ভবিষ্যদ্বাণীর কোনও খাতিরই করিলেন না। বিমল ছোকরাটি দেখিতে বেশ সুপুরুষ, কিন্তু তাহার মন্দস্বভাব জন্য আজিও বিবাহ হয় নাই। সংসারে তাহার মা ও জ্যেঠাইমা ( উভয়েই বিধবা ), একটী ছোট ভাই, একটী বিধবা ভগিনী এবং দুইটী জেঠতুতো ভাই বর্তমান। বড়টি স্থানীয় জমিদারী, কাছারীতে সামান্য বেতনে সুমারনবীশের কৰ্ম্ম করে—ছোট ভাই দুটা স্কুলে পড়ে। বিমলেরও এখন অর্থোপার্জন করা আবশ্যক হইয়া পড়িল—সামান্য যাহা জোৎজমা আছে তাহাতে সংসার চলে না। তাহার এক আত্মীয়ের সঙ্গে, ২৪ পরগণার পোষ্ট্রাল সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট বাবুর বিশেষ হৃদ্যতা ছিল ; তাহারই সুপারিশে সে ডাক-বিভাগে কৰ্ম্ম পায়। আলিপুরের হেড আপিসে বৎসর খানেক শিক্ষানবিশী ও একটিনি করিয়া, আজ ছয় মাস হইল সে এই মহেশপুর ডাকঘরের সাব পোষ্ট মাষ্টার হইয়া আসিয়াছে।
হেড আপিসে থাকিতে পাচজন উপরওয়ালার অধীনস্থ হহয়া কৰ্ম্ম করিতে বিমলের মোটেই ভাল লাগিত না। এখানে আসিয়া সে স্বাধীন হইয়াছে । সরকারী বাসাটি ভাল, পিয়নেরা আজ্ঞাকারী, খাদ্যদ্রব্যাদি সুলভ, এমন কি, পল্লীগ্রাম হইলেও এখানে “বিলাতী” পাওয়া যায়—তবে সোডা পাওয়া যায় না, জল মিশাইয়া খাইতে হয়, এই যা একটু অসুবিধা । সুতরাং মোটের উপর বিমল এখানে ভালই আছে বলিতে হইবে ।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পিয়নগণ স্ব স্ব ব্যাগ ভরিয়া পত্রাদি লইয়া রওয়ান হয়ে গেলে, বিমল অপহৃত মাসিক পত্ৰখানি ও চিঠিগুলি হাতে করিয়া আপিস ঘর হইতে বাহির হইয়া তাহাতে তালাবদ্ধ করিল। বাসায় প্রবেশ করিয়া উঠান হইতে বলিল, “বামুন মা, রান্না কতদূর ?” একজন বর্ষীয়সী ব্রাহ্মণ বিধবা রান্নাঘর হইতে বাহির হইয়া বলিলেন, “রান্না আমার শেষ হয়েছে, তুমি চান করে এস বাবা।” ইহার বাড়ী এই পাড়াতেই, বড় গরীব, মাত্র চারিটি টাকা বেতনে বিমলকে দুই বেলা রাঁধিয়া খাওয়াইয়া যান। বিমল নিজ ঘরে গিয়া, চিঠিগুলি ও মাসিক পত্ৰখানি বালিশের নীচে গুজিয়া, কোট প্রভৃতি খুলিয়া রাখিয়া, একটা শিশি হইতে কিঞ্চিৎ তেল-ঢালিয়া মাথায় দিয়া, সাবান গামছা ও বস্ত্র লইয়া নিকটস্থ পুষ্করিণীতে স্নান করিতে গেল। স্নান করিয়া আসিয়া ভিজা কাপড়খানি শুকাইতে দিয়া, জামা পরিয়া, আসি চিরুণী ও বুরুষ লইয়া পরিপাটিরূপে নিজ কেশ সংস্কার করিল। তারপর রান্নাঘরের বারান্দায় বিছানে আসনখানির উপর বসিয়া ভোজনে প্রবৃত্ত হইল ।
বিমলকে খাওয়াইয়৷ বামুন মা যখন চলিয়া গেলেন তখন বেলা প্রায় ১২টা। বিমল পাণ চিবাইতে চিবাইতে সদর দরজা বন্ধ করিয়া আসিয়া, শয়ন ঘরে প্রবেশ করিল। এক গেলাস জল ও একখানি ছুরী লইয়া, শয্যাপার্শ্বস্থ ( সরকারী ) ছোট টেবিলখানির উপর রাখিয়া, বিছানায় বসিয়া, বালিশের তলা হইতে মাসিক পত্র ও চিঠিগুলি বাহির করিল। জলে আঙ্গুল ভিজাইয়া, প্রত্যেক চিঠির মুখে বেশ করিয়া বুলাইয়া সেগুলি সারবন্দি টেবিলের উপর রাখিয়া মাসিক পত্রখানির মোড়ক ছিড়িয়া ফেলিল। পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে মাঝে মাঝে চাহিয়া দেখিতে লাগিল, কোনও চিঠির মুখের জল শুষ্ক হইয়াছে কি না। মাঝে মাঝে সেগুলির মুখ আবার ভিজাইয়া দিতে লাগিল। যখন বুঝিল, এইবার সময় হইয়াছে, তখন মাসিক পত্ৰখানি রাখিয়া ছুরীর ফলা চিঠির মুখে ঢুকাইয়া উল্টাদিকের চাপ দিয়া একে একে চিঠিগুলি খুলিয়া ফেলিল ।
প্রথম চিঠিখানি বাহির করিয়া দেখিল, তাহার সহিত একখানি দশ টাকার নোট। বিমল আপন মনে বলিয়া উঠিল, "বাঃ, আজ বউনি হল মন্দ নয় । নোটখানি বালিশের তলায় গুজিয়া রাখিয়া চিঠির ভাজ খুলিল। প্ৰাণেশ্বরী’ বলিয়া সম্বোধন। বিমল সাগ্রহে চিঠিখানি পড়িতে লাগিল। কলিকাতা প্রবাসী বিরহী স্বামী স্ত্রীর বিরহ যন্ত্রণার অনেক বর্ণনা করিয়াছে ; লিখিয়াছে বড়দিনের ছুটিতে বাড়ী আসিয়া তাহার হৃদয়েশ্বরীকে হৃদয়ে ধরিয়া সকল জালা নিৰ্ব্বাণ করিতে পারিবে—সে জন্য দিন-গণনা করিতেছে। প্রথম মাসের মাহিনা পাইয়া, খোকার দুধ খরচের জন্য ১০টি টাকা পাঠাইতেছে।
এ ব্যক্তির আরও কয়েকখানি পত্র ইতিপূৰ্ব্বে বিমল পাঠ করিয়াছিল—সে জানিত, লোকটি কলিকাতায় চাকরির জন্য উমেদারী করিতেছিল। এ পত্ৰখানি রাখিয়া, বিমল দ্বিতীয় পত্ৰখানি খুলিল। পূজনীয়া পিসিমা ! সম্বোধন দেখিয়া “ধুত্তোর” বলিয়া সক্রোধে চিঠিখানি বিছানার উপর ফেলিয়া, তৃতীয় পত্ৰখানি উন্মোচন করিল।
এই লোকের চিঠিও মাঝে মাঝে বিমল পড়িয়াছে—তাহা হইতে ইহাদের পূৰ্ব্বকথা কিছু কিছু সে অবগত ছিল। মেয়েটির নাম চারুশীলা—সে বিধবা, বোধ হয় বাল্যবিধবা। এই মহেশপুর গ্রামের দক্ষিণে রসুলপুরে তাহার বসতি-খুব সম্ভব ঐ স্থানে তাহার শ্বশুরালয় । তাহার পিত্ৰালয় কলিকাতায় ;–কলিকাতা নিবাসী এই পত্ৰলেখকের সহিত তাহার প্রণয় সংঘটিত হয়। পত্ৰলেখককে পত্রশেষে কখনও নিজের নাম, স্বাক্ষর করতে দেখিয়াছে বলিয়া স্মরণ হয় না—সে সহি করে—“তোমার প্রেমাকাঙ্ক্ষী’, ‘তোমার ভালবাসা’, ‘তোমার সে”—এইরূপ সব মাথামুণ্ড । বিগত ৩/৪ মাস হইতে ইহাদের এইরূপ প্রেমপত্ৰ চলিতেছে—তবে মেয়েটির লেখা চিঠি বিমল কখনও দেখিবার সুযোগ পায় নাই,—নাম না জানাতে, রওয়ানা চিঠিগুলির মধ্য হইতে সেখানি বাছিয়া বাহির করা শক্ত বলিয়াও বটে ; এবং সময় পাওয়া যায় না বলিয়াও বটে,– কারণ ভিন্ন গ্রামের ডাকবাক্স হইতে পিয়নের চিঠি ঝাড়িয়া আনিবার সময় ডাকঘরে অনেক লোকজন থাকে, ছাপমোহর দিয়া বাগ ভৰ্ত্তি করিবার ধুম পড়িয়া যায়।
বিমল সাগ্রহে পত্ৰখানি পাঠ করিল। তাছাতে এইরূপ লেখা
ছিল—
কলিকাতা
২২শে অগ্রহায়ণ
আমার হৃদয়েশ্বরী, গতকলা তোমায় একখানি পত্র লিখিয়াছি—তাহা তুমি পাইয়া থাকিবে। তাহাতে লিখিয়াছিলাম, আমি আগামী শনিবার দিন গিয়া তোমায় লইয়া আসিব। কিন্তু শনিবারে যাওয়ার সুবিধা করিতে পারিলাম না। পরদিন অর্থাৎ রবিবার দিন আমি নিশ্চয় যাইব তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তুমি পূৰ্ব্ব পরামর্শ মত, রাত্রি ঠিক ১২টার সময় তোমাদের বাড়ীর পশ্চিমে সেই শিবমন্দিরের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইবে—আমি মন্দিরের পার্শ্বস্থ সেই বটবৃক্ষের ছায়ায় লুকাইয়া থাকিব ; এবং তুমি আসামাত্র তোমাকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় লইয়া আসিব । যানবাহনাদির কিরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উঠিতে পারিব তাহা এখন বলিতে পারি না—হয়ত হাটিয়াই উভয়ে ষ্টেশনে গিয়া ট্রেণে উঠিব। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আইন অনুসারে আমাদের বিবাহের সমস্ত আয়োজন আমি করিয়া রাখিয়াছি— পুরোহিতও ঠিক হইয়াছে—সোমবার দিন আমি যথাশাস্ত্র তোমার পাণিগ্রহণ করিব। এ সম্বন্ধে আমি উকীল ব্যারিষ্টারগণের পরামর্শ লইয়াছি। তাহারা বলেন, যদি তোমার শ্বশুরকুলের কেহ, এই লইয়া আমার উপর মামলা মোকৰ্দমা করিতে উদ্যত হয়, তবে তোমার বয়স ১৬ বৎসরের অধিক হইয়াছে এবং স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে আসিয়াছিলে, ইহা প্রমাণ করিতে পারিলেই, কেহ আর আমাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করিতে পারিবে না। সেইজন্য আমি জন্মমৃত্যুর রেজেষ্টারি অপিস হইতে তোমার জন্মদিনের সার্টিফিকেটের নকল পৰ্য্যন্ত আদায় করিয়া আনিয়াছি। সুতরাং সকল দিকেই আটঘাট বাঁধা রহিল । রবিবার সন্ধ্যার ট্রেণে আমি রওয়ানা হইয়া ষ্টেশনে নামিয়া, রাত্রি দশটার মধ্যেই তোমাদের গ্রামে প্রবেশ করিতে পারিব। ভগবানের নাম স্মরণ করিয়া, গৃহের বাহির হইও—আশা করি তাহার আশীৰ্ব্বাদে আমাদের মিলনের পথ হইতে সকল বাধাবিঘ্ন অপসারিত হইবে।
অধিক আর কি লিখিব। আমার শূন্য গৃহে আসিয়া তুমি লক্ষ্মীরূপে অবতীর্ণ হও—আমার শূন্য হৃদয়ে বসিয়া আমায় চিরসুখী কর । ইতি—
তোমার ( মন ) চোর
এই পত্ৰখানি পড়িয়া বিমল আপন মনে বলিয়া উঠিল—“কি চমৎকার! এ যে রীতিমত একটা নভেলী ব্যাপার । বাঃ—বা —ক্যা মজাদার । ক্যা তোফা বাহবা চারুশীলা—ব্রাভো! জিত রহো বাবা—থ্রি চিয়ার্স ফর চারুশীল। বেশ বেশ–বরের কাছে তুমি যাবে— মাইকেল ত বিধানই দিয়ে গেছে—“যে যাহারে ভালবাসে, সে যাইবে তার পাশে-ব্ৰজাঙ্গনা কাব্য দেখহ । গড ব্লেস দি হাপি পেয়ার –তোমাদের বিয়েতে আমায় নেমতন্ন করবে না বাবা ? নুচি খেয়ে আসতাম ?
অতঃপর বিমল বাকী পত্র দুইখানি পড়িয়া দেখিল । এ দুইখানিই মামুলি স্বামীর মামুলি প্রেমের চিঠি—তাহাতে প্রেমের চেয়ে ঘরকন্নার কথাই বেশী—কোনও বিশেষত্ব নাই। বিমল এই ছয় মাসের মধ্যে বৈধ ও অবৈধ সহস্ৰাধিক প্রেমপত্র পড়িয়াছে, সে জানে বৈধ প্রেমের চিঠি অপেক্ষা, অবৈধ প্রেমের চিঠিতেই “মজা” বেশী থাকে ; পত্রগুলি আবার জুড়িয়া রাখিয়া, বিমল মাসিক পত্ৰখানি পড়িতে আরম্ভ করিল। পড়িতে পড়িতে ক্রমে উহা তাহার হাত হইতে খসিয়া পড়িল ; সে তখন পাশ ফিরিয়া পাশের বালিশে পা দিয়া আরামে ঘুমাইতে লাগিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
অপরাহ্নকালে বিভিন্ন গ্রাম হইতে পিয়নেরা ফিরিয়া আসিলে বিমল তাহাদের নিকট হইতে মনিঅৰ্ডার, রেজিষ্টারি প্রভৃতির রসিদ বুঝিয়া লইয়া, খাতাপত্র লিখিতে আরম্ভ করিল। কাৰ্য্যশেষ হইলে, ভূত্যকে বলিল, “ওরে, যা দেখি, হরেন সা'র দোকান থেকে এক বোতল “বিহাইব্” নিয়ে আয় । চাদরের ভেতর বেশ করে নুকিয়ে আনবি–বুঝেছিস ? আর করিমদিকে আমার কাছে ডেকে দিয়ে যাস”-বলিয়া বিমল, সরকারী তহবিল হইতে ভৃত্যের হস্তে ছয়টি টাকা দিল ।
কিয়ৎক্ষণ পরে পিয়ন করিমদ্দি সেখ আসিয়া বলিল, “হুজুর ডেকেছেন ?”
বিমল বলিল, “হ্যাঁ। আজ একটা ফাউলের কারি বানিয়ে দিতে পারবে হে শেখের পো ?”
করিম বলিল, “কেন পারবো না হুজুর ?”
“আচ্ছা—এই টাকা নাও । বেশ মোট তাজা দেখে একটা মুরগী কিনে এনো। বেশ করে’ লঙ্কাবাটা দিও—আমরা বাঙ্গাল মানুষ, ঝালট কিছু বেশী খাই ।”—বলিয়া বিমল ক্যাশ হইতে তাহাকেও একটি টাকা দিল।
কাজকৰ্ম্ম শেষ হইলে, ক্যাশ হইতে আর তিনটি টাকা লইয়া, দ্বিপ্রহরে লব্ধ সেই দশ টাকার নোটখানি ক্যাশে রাখিয়া ক্যাশ পূরণ করিল। ক্যাশ মিলাইয়া তাহা লোহার সিন্দুকে বন্ধ করিয়া, আপিল ঘরে চাবি দিয়া বিমল বাসায় গেল। তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। বামুন মাকে দেখিয়া বলিল, “মা, আজ শরীরটে কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে, আজ রাত্রে আর ভাতটা খাব না, খানকতক পরোটা ভেজে রেখে যেও । তরকারী-ফরকারী বেশী কিছুর দরকার নেই—খানকতক আলুভাজা হলেই চলবে।”—বলিয়া সে মুখহাত ধুইতে চলিয়া গেল। (মাঝে মাঝে—বিশেষ বেতন পাইবার পর দুই চারিদিন বিমলের এরূপ গা ম্যাজ, ম্যাজ করিয়া থাকে—এবং রাত্রে ভাতের পরিবৰ্তে লুচি বা পরোটা ফরমাস করে।)
মুখ হাত ধুইয়া আসিয়া বিমল এক পেয়ালা চা পান করিয়া, পাণ মুখে দিয়া ঘোষেদের বৈঠকখানায় পাশা খেলিতে গেল--প্রত্যহই এইরূপ যায়।
রাত্রি ৮টা বাজিতেই বামুন মা পরোটা ও আলুভাজা বিমলের শয়ন ঘরে ঢাকিয়া রাখিয়া বাড়ী চলিয়া গেলেন। অর্দ্ধঘণ্টা পরে বিমল বাসায় আসিয়া রামচরণ ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, “করিমদ্দি এসেছিল ?”
রামচরণ বলিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। ঐ রেখে গেছে।”–বিমল দেখিল একটি এনামেলের বড় বাটিতে তাহার আকাঙ্খিত ফাউল কারি ঢাকা রহিয়াছে। বিমল তখন ভূত্যকে রাত্রের মত বিদায় দিয়া, সদর দরজা বন্ধ করিয়া, শয়ন ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। দেওয়ালে একটি ল্যাম্প জ্বলিতেছিল—তাহার আলো বাড়াইয়া দিয়া যথাস্থান হইতে বোতল, গ্লাস এবং ‘কাক ইস্কুরু বাহির করিয়া, শয্যাপার্শ্বস্থ (সরকারী ) টেবিলের উপর রাখিল ; জুতা মোজা ত্যাগ করিয়া, বিছানার ধারে বসিয়া বোতলটি খুলিয়া ফেলিল ।
এক গ্লাস পান করিয়া, বেহালাটি পাড়িয়া তাহাতে ছড়ি দিতে লাগিল। একটা গৎ বাজাইয়া আর এক গ্লাস পান করিয়া, বেহালা যথাস্থানে রাখিরা ভাবিল, সেই মজার চিঠিখান আর একবার পড়িতে হইবে। দেওয়াল-আলমারি খুলিয়া, চিঠিগুলি বাহির করিয়া, চারুশীলার খানি বাছিয়া লইয়া বলিল—“এঃ, জুড়ে ফেলেছি যে দেখছি ! কুছ পরোয় নেই—ফের পলবো ”—বলিয়া টলিতে টলিতে বিছানায় আসিয়া বসিল। চিঠিখানিকে সামনে ধরিয়া বলিল, “কি চাদ, জল পাৰে ? না ব্র্যাণ্ডি ?”—বলিয়া গেলাসে খানিক ব্র্যান্ডি ঢালিয়া, আঙ্গুলে একটু লইয়া চিঠির মুখ ভিজাইয়া বলিল, “যা বেটা, তোর চিঠিজন্ম সার্থক হ’য়ে গেল।” পরে ব্রান্ডিটুকু পান করিতে করিতে, চিঠিখানি খুলিতে চেষ্টা করিতেই উহার মুখ ছিড়িয়া গেল। চিঠিখানি উর্দ্ধে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, “ছিড়ে গেলি ? কাল বিলি হবি কি ক’রে রে শালা ?”—বলিয়া খাম হইতে চিঠি বাহির করিয়া, খামখানা ছিড়িয়া মেঝের উপর ফেলিয়া বলিল “জাহান্নামে যাও!” চিঠি খুলিয়া পড়িল—“আমার হৃদয়েশ্বরী !” চিঠি রাখিয়া নিজ বক্ষে হাত দিয়া, চক্ষু মুদিয়া অভিনেতার ভঙ্গিতে বলিতে লাগিল—“হৃদয়েশ্বরী –হৃদয় জলে গেল,—পুড়ে গেল,— খাক হয়ে গেল! আর একটু খাই”—বলিয়া চক্ষু খুলিয়া, গেলাসের বাকীটুকু পান করিয়া, পত্ৰখানি কুড়াইয়া লইয়া আবার পড়িতে আরম্ভ করিল। কিন্তু জিহ্বা তখন তাহার জড়াইয়া আসিয়াছে। তা ছাড়া, নেশা হইলে, সে আর ‘স উচ্চারণ করিতে পারিত না— ‘স’ স্থানে 'ছ' বলিত। একটি একটি কথায় জোর দিয়া পড়িতে লাগিল— “কিন্তু ছনিবারে, যাওয়ার ছুবিধা করিতে-পারিলাম না। পরদিন অর্থাৎ রবিবারে--আমি নিচ্চয় যাইব তাহাতে কোন ছন্দেহ নাই । তুমি–পূৰ্ব্ব পরামর্ছ' মত--রাত্রি ঠিক ১২টার ছময়—তোমাদের বাড়ীর পচ্চিমে ছেই ছিবমন্দিরের ছন্মুখে আছিয়া দাড়াইবে।” .
চিঠি রাখিয়া, আর কিঞ্চিৎ পান করিয়া, গম্ভীর মুখে কি ভাবিতে লাগিল ; অৰ্দ্ধমুদ্রিত নেত্রে মাথাটি নাড়িতে নাড়িতে বলিতে লাগিল— “এ চিঠি ত তুমি পাবে না মণি! খামখানাই যে ছিড়ে ফেলেছি। আগেকার চিঠি মত—তুমি ছনিবারে রাত বারটায় এছে ছিবমন্দিরের কাছে দাড়াবে ত ? তার আছাপথ চেয়ে—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে— অবছেছে ক্লাস্ত হয়ে বছে পড়বে—বছে বছে ক্রমে ছুয়ে পড়বে। কিন্তু ছে ত হায় আছবে না। অলরাইট—আমি যাব, আমি গিয়ে তোমায় বলবো—
উঠ উঠ হে ছুন্দরী,
তব পদছপচ্ছ যোগ্য নহে এ ধরণী !
তুমি কেন ধূলায় পতিত ?
তুমি চল, আমার ছঙ্গে চল। ছল ছখি তুমি আমার হৃদয়েচ্ছরী হবে। হৃদয়ের চ্ছরী—ন ছুরি ? হৃদয়ের ছুরি হোয়ো না দোহাই বাবা, ছাত দোহাই তোমার ”—বলিয়া চক্ষু খুলিয়া, আপন রসিকতায় মুগ্ধ হইয়া একটু হাসিল। গ্লাসের বাকীটুকু পান করিয়া ফেলিয়া আবার চিঠিখানি লইয়া পড়িতে বসিল। পড়িল—
“আমার ছুন্য গৃহে আছিয়া, তুমি লক্ষ্মীরূপে অবতীর্ণ হও । আমার ছুন্য হৃদয়ে বছিয়া আমায় চিরছুখী কর । ভগবানের নাম ছরণ করিয়া গৃহের বাহির হইও—আছা করি তাহার আছীৰ্ব্বাদে আমাদের মিলনের পথ হইতে ছকল বাধাবিঘ্ন অপছারিত হইবে।”
চিঠি রাখিয়া বিমল বলিতে লাগিল—“উত্তম কথা !—কিন্তু দাদা, তোমারই হৃদয় কি ছুন্য ? আমারও যে তাই ভাই ! আমার ছব ছুন্য ছব ছন্য ! আমার হৃদয় ছুন্য—প্রেম নেই ; গৃহ ছুন্য—ইছতিরি নেই—বাক্ছো ছুন্য, টাকা নেই ! আমার ছব ছুন্য—মহাবোম— বোম ভোলানাথ—ছনিবার রাত বারটায় আমি যাব—তোমার মন্দিরের কাছে বটগাছের নীচে আমি লুকিয়ে থাকবো–চারুছৗলাকে নিয়ে এছে, আমার ছুন্য গৃহ, ছুন্য হৃদয় পূর্ণ করবো। তুমি হচ্চ বিঘ্ন বিনাছনের বাপ—তাকে ছাবধান করে দিও—যদি কোনও বাধা বিন্ন ঘটে—তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্ত্বরকে এর জন্যে রেছপান্ছিবিল হতে হবে— এই ছাপ কথা আমি বলে রাখলাম।”—বলিয়া বিমল বীররসের সহিত বিছানায় এক মুষ্ট্যাঘাত করিয়া চক্ষু খুলিল। আর খানিকটা সুরা ঢালিয়া, জল মিশাইয়া পান করিয়া, হাত নাড়িয়া বক্তৃতার স্বরে বলিতে লাগিল, "লেডিজ এণ্ড জেনেলমেন, তোমরা ভাবছো–মাতালছা নানাভঙ্গি—এখন এ বেটা মদের খেয়ালে এই ছব ৰলছে—কাল এছব কিছুই মনে থাকবে না। তা নয় তা নয়—হাম যায়েঙ্গা –আলবৎ যায়েঙ্গা –ঢেকে যায়েঙ্গা—আমায় চিনতে পারবে না। তারপর এই বাছায় এনে তাকে বন্দিনী। আদরে যত্নে মিছটি কথায় তিরিলোককে বছীভূত করতে কতক্ষণ ?—আর আমার এ চেহারাটাও কি কোনও কাযে লাগবে না ?—এখন একটু ছোয়া যাক।”—বলিয়া মাতাল বিছানায় দেহ লুটাইয়া দিয়া, নিদ্রাঘোরে অচেতন হইয়া পড়িল ।
কোথায় রহিল তার পরোটা—আর কোথায় রহিল তার সাধের ফাউল কারি !
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পামের উপর শ্ৰীমতী চারুশীলা দাসী ঠিকানা লেখা থাকিলেও, এবং রসুলপুর গ্রামে যথার্থই একজন চারুশীলা দাসী থাকিলেও, পত্ৰখানি তাহার জন্য উদ্দিষ্ট নহে । তাহার নামেই পত্র আসে বটে, কিন্তু পত্র ন৷ খুলিয়াই, চারুশীলা সেখানি কাগজের মধ্যে লুকাইয়া পাশের বাড়ীতে তাহার প্রিয়সঙ্গী বনলতাকে দিয়া আসে। ইহাই গোপন বন্দোবস্ত । সব কথা তবে খুলিয়াই বলি ।
বনলতা বনে জন্মগ্রহণ করে নাচ- পাস কলিকাতা সহরে তাহার মাতুলালয়ে জন্মিয়াছিল। বাল্যকালেই পিতৃমাতৃহীন হইয়া বনলতা মামার বাড়ীতেই মানুষ হইতে থাকে । মামা বড়লোক ছিলেন, নিজের মেয়েদের সঙ্গে বনলতাকেও ভালরূপ লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন । তাহাঁদের স্বজাতীয় একটি যুবক কলিকাতায় মেসে থাকিয়া কলেজে পড়িত—তাহার সহিত বনলতার বিবাহ দিয়াছিলেন ; কিন্তু মাস কয়েক পরেই সেই হতভাগ্য যুবক কালকবলিত হয়। বনলতার মামা, অভাগিনী ভাগিনেয়ীকে আরও লেখাপড়া শিখাইতে লাগিলেন। গত বৎসর উইল করিয়া তাছাকে বিশ হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজ দিয়া ইহধাম হইতে মহাপ্রস্তান করিয়াছেন।
যে লোকটি ‘তোমার প্রেমাকাঙখী’ ‘তোমার মনচোর’ ইত্যাদি বলিয়া চিঠি সহি করে, তাহার নাম নরেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ইহাদেরই জ্ঞাতি । সে লোকটিও স্বশিক্ষিত এবং উদারমতাবলম্বী। ব্রহ্মদেশে সেগুন কাঠের তাহার বিস্তৃত কারখানা আছে—কলিকাতায় তাহার ব্র্যাঞ্চ আছে । বনলতার মামার শ্রাদ্ধ উপলক্ষেই বৰ্ম্মা হইতে নরেন কলিকাতায় আসে এবং বিধবা বনলতার সহিত পরিচিত হয় । তাহাদের বাড়ী ভিন্ন হইলেও, প্রত্যহই এ বাড়ীতে সে আসিতে লাগিল এবং এসব ক্ষেত্রে যাহা হয়—প্রথমে আঁখি মজিল, তারপর মন মজিল। ব্যাপার অবগত হইয়া বনলতার মামাতো ভাইয়েরা, নরেনের সহিত তাহার বিধবা-বিবাহ দিতেও কৃতসঙ্কল্প হইলেন।
এই খবর কাকমুখে রসুলপুর গ্রামেও আসিয়া পৌছিল। উইলের সংবাদও পূৰ্ব্বে পৌঁছিয়াছিল। বনলতার শ্বশুর কলিকাতায় গিয়া বনলতার মামাতো ভাইয়ের উপর উকিলের চিঠি দিয়া, মহা হাঙ্গামা করিয়া, পুত্রবধূকে “উদ্ধার” করিয়া আনেন।
রসুলপুরে আসিয়া বনলতা প্রথমে অত্যন্ত ম্রিয়মাণ হইয়া পড়ে। মাস খানেক পরে পাশের বাড়ীর সমবয়সী চারুশীলার সহিত তাহার সখিত্ব জন্মে। চারু তাহার স্বামীর অভিমতে, বনলতার সহিত তাহার হস্তাকাঙ্ক্ষীর পত্রবিনিময়ে এইভাবে সহায়তা করিতে সম্মত হয়।
অপহৃত পত্ৰখানিতে লেখা ছিল, গতকল্য তোমায় পত্র লিখিয়াছি যে, শনিবার রাত্রে গিয়া তোমায় লইয় আসিব ।’ সে পত্ৰখানি যথাসময়ে চারুর হস্তগত হয়, এবং যথানিয়মে বনলতাকে সেখানি সে দিয়াও আসে। অন্যান্য পত্র, বনলতা পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলিত । কিন্তু এ পত্ৰখানিতে সময় তারিখ হত্যাদি লেখা ছিল বলিয়া, বাক্সে লুকাইয়া রাখে । বনলতার শ্বাশুড়ী তাহাকে অতান্ত সন্দেহের চক্ষেই দেখিয়া থাকেন। তাহার অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে তিনি তাহার বাক্স পেটরা গোপনে থানাতল্লাসীও করিয়াছেন–কিন্তু এ পৰ্য্যন্ত “দোষজনক” কিছুই পান নাই। এই পত্ৰখানি পৌছিবার পর দিন, দ্বিপ্রহরে বনলতা চারুশীলাদের বাড়ী গিয়াছিল—সেই সুযোগে তাহার শ্বাশুড়ী অন্য চাবি দিয়া তাহার বাক্স খুলিয়া, পত্ৰখানি পাঠ করেন এবং স্বামীকে দেখান। স্বামী বলেন, "আচ্ছা, আসুক না পাজি, তাকে উচিত মত শিক্ষা দেওয়া যাবে।”
শনিবার দিন বনলতার শ্বশুর তাহার দুইজন বন্ধুকে রাত্রে আহারের জন্য নিমন্ত্রণ করেন। শ্বাশুড়ী, নানা অছিলায়, রান্নাবান্নায় বিলম্ব করিলেন। অতিথিদ্বয়ের আহার যখন শেষ হইল, রাত্রি তখন ১১টা। অন্য দিন রাত্রি ১০টা না বাজিতেই বাড়ীর সকলে ঘুমাইয়া পড়ে। আজ বনলতা. ছটফট করিতেছে, কিন্তু বাড়ীর সকলে জাগিয়া ; শ্বাশুড়ী-ননদেরা তাহাকে চোখে চোখে রাখিয়াছেন। ওদিকে বৈঠকখানা হইতে ১২টার কিঞ্চিৎ পূৰ্ব্বে, বনলতার শ্বশুর, তাহার বন্ধুদ্ধয় সহ, লাঠি ও দড়ি সঙ্গে লইয়া, শিব মন্দিরের পশ্চাতে গিয়া লুকাইয়া রহিলেন ।
কিছুক্ষণ পরেই, ওভারকোট গায়ে, মাথায় মুখে কম্ফটার জড়ানো, বিমল ধীরে ধীরে আসিয়া বটবৃক্ষের অন্ধকার ছায়ায় দাড়াইল। ক্ষণ পরেই তিন জন লোক আসিয়া তাহার মাথায়, পার্শ্বে, বুকে, পদদ্বয়ে লাঠি, কিল, চড়, ঘুসি ও লাথি মারিতে মারিতে তাহাকে মাটীতে পাড়িয়া ফেলিল। প্রহারের চোটে তৎপূৰ্ব্বেই বিমল সংজ্ঞাহীন হইয়াছিল।
লোক তিনজন তখন, অচেতন বিমলের হস্তপদ উত্তমরূপে রজ্জুবদ্ধ করিল। এক ব্যক্তি কহিল, “বেটা বেঁচে আছে ত ? না মরেছে?”
অপর ব্যক্তি তাহার নাকে হাত দিয়া বলিল, “না—নিশ্বাস বেশ পড়ছে।"
প্রথম ব্যক্তি বলিল, “এখন, একে কি করা যায় বল দেখি ? এই খানেই কি পড়ে থাকবে ?”
“না না—আমাদের বাড়ীর কাছে কেন ? শেষকালে কি কোনও পুলিশ হাঙ্গামায় পড়বো ?” “তবে চল বেটাকে নিয়ে খানিক দূরে কোথাও ফেলে রেখে আসা যাক ৷”
“দেশলাইটে জাল ত, লোকটা কে, দেখি ?”
এক ব্যক্তি দেশলাই জালিল। তিন জনেই তখন বলিয়া উঠিল, “এ কি ! এ যে মহেশপুরের পোষ্ট মাষ্টার ।"
দেশলাই পুড়িয়া গেল। আবার যেমন অন্ধকার তেমনই অন্ধকার। তখন তিন জনে ফিস ফিস করিয়া পরামর্শ চলিতে লাগিল। “এ বেটাই বা এখানে এল কেন ? যে বেটার আসবার কথা, সেই বা এল না কেন ?" -
“সে যা হোক তা হোক—এখন চল একে মহেশপুরে পোষ্ট আপিসের বারান্দায় শুইয়ে দিয়ে আসা যাক।”
তিনজনে তখন বিমলের অচেতন দেহ বহন করিয়া লইয়া চলিল । পল্লীগ্রামের পথ–রাত্রি দ্বিপ্রহর-রাস্তায় আলো নাই—জনমানবের সঞ্চার নাই ।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শীতে খোলা-বারান্দায় পড়িয়া থাকিয়া, ঘণ্টা দুই পরেই বিমলের জ্ঞান ফিরিয়া আসিল । সে সেই আবদ্ধ অবস্থায় পড়িয়া পড়িয়া, নানারূপ উপায় ফন্দি চিন্তা করিতে লাগিল ।
ক্রমে ভোর হইল। একজন পিয়নকে সেই দিকে আসিতে দেখিয়া, বিমল ক্ষীণকণ্ঠে তাহাকে ডাকিল।
পিয়ন আসিয়া বলিল, “বাবু, ব্যাপার কি ?”
বিমল চিঁ চিঁ করিয়া বলিল, “ডাকাতি রে, ডাকাতি! আগে আমার প্রাণটা বাঁচা।”
সে ব্যক্তি ছুটিয়া গিয়া অন্যান্য পিয়নকে ডাকিয় আনিল । সকলে মিলিয়া বিমলের বন্ধনরজ্জ্ব খুলিয়া দিল ।
বিমল বলিল, “আমার বুকপকেট থেকে চাবি নে। ডাকঘর খোল, খুলে মেঝের উপর আমায় শুইয়ে দিয়ে থানায় খবর দিগে যা।”
পিয়নেরা তাহাই করিল। বিমল কাৎরাইতে কাৎরাইতে বলিল, “সব পিয়ন যা । দারোগ প্রথমে তোদেরই জবানবন্দি নেবে কিনা !”
তাহারা জিজ্ঞাসা করিল, “কি বলবো হুজুর ?”
“যা জানিস—যা দেখেছিল—সবই বলবি ।”
পিয়নগণ যখন চলিয়া গেল তখন বেশ ফর্সা হইয়াছে। বিমল টলিতে টলিতে উঠিয়া, সরকারী লোহার সিন্দুক খুলিল। তাহার মধ্যে নোটে টাকায় ৫৪২ ছিল—সেগুলি সমস্ত বাহির করিয়া, রুমালে বাধিয়া, বাসায় গিয়া নিজ ট্রাঙ্কে লুকাইয়া রাখিয়া, ডাকঘরের মেঝেতে পূৰ্ব্ববৎ শুইয়া রহিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
দুইদিন পরে, কলিকাতার কাগজে কাগজে ছাপা হইল—
ভীষণ ডাকাতি। পোষ্ট অফিস লুট ।
বিগত শনিবার রাত্রে, ২৪ পরগণার অন্তর্গত মহেশপুর গ্রামের পোষ্ট অফিসে একটি ভয়ানক ডাকাতি হইয়া গিয়াছে। পোষ্ট মাষ্টার বিমলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, রাত্রি ১১টার সময় ডাকঘরে বসিয়া হিসাব মিলাইতেছিলেন, পিয়নের তৎপূৰ্ব্বেই চলিয়া গিয়াছিল, সেখানে আর কেহ ছিল না। ৫।৬ জন যুবক হঠাৎ ডাকঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া, রিভলভার বাহির করিয়া বলে—“খবরদার চীৎকার করিও না, গুলি করিব। লোহার সিন্দুকের চাবি দাও । ইহাতে পোষ্ট মাষ্টার বলেন, ‘তা কখনই দিব না—প্রাণ দিব, তবু সরকারের টাকা দিব না। একজন যুবক তৎক্ষণাং পিস্তলের বাট দিয়া বিমলবাবুর মস্তকে সজোরে প্রহার করে ; অপর যুবকগণ তাহাকে জাপটাইয়া ধরিয়া মাটিতে ফেলিয়া, তাহার বুকে বসিয়া মুখে কাপড় গুজিয়া মুখ বাধিয়া ফেলে। তারপর হস্তপদাদি রজ্জু, দ্বারা দৃঢ়রুপে বদ্ধ করিয়া চাবি খুজিতে থাকে।" চাবি পাইয়া লোহার সিন্দুক খুলিয়া পূৰ্ব্বদিনের ক্যাশ ৫৪২ লইয়া, সিন্দুক বন্ধ করণান্তর পোষ্ট মাষ্টারকে বাহিরের বারান্দায় শোয়াইয়া দেয় । ‘অফিস ঘরে তালাবদ্ধ করিয়া, চাবির গোছা পোষ্ট মাষ্টারের পকেটে ভরিয়া দিয়া তাহারা পলায়ন করে। প্রকাশ, ডাকাতগণের মুখে কালো মুখস, গায়ে কালে কোট, পায়ে বুটজুতা ছিল, এবং তাহারা পরস্পরের মধ্যে কথাবাৰ্তায় মাঝে মাঝে ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করিতেছিল। এই ডাকাতী সম্পর্কে গতকল্য কলিকাতার কয়েকটি ছাত্রাবাসে থানাতল্লাসী হইয়া গিয়াছে এবং পুলিশ তিনজন যুবককে সন্দেহক্রমে গ্রেপ্তার করিয়াছে।
শেষ পর্য্যন্ত ডাকাতেরা কেহই ধরা পড়ে নাই। বিমল আত্মপ্রাণ তুচ্ছ করিয়া সরকারের টাকা রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, এই বিশ্বাসে সদাশয় গভর্ণমেন্ট তাহাকে ইনস্পেক্টর পদে উন্নীত করিয়া দিলেন ।
রবিবার রাত্রে নরেন যথাস্থানে আসিয়া, বহুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া কলিকাতায় ফিরিয়া যায়। বনলতা পত্রে এখানকার সমস্ত ঘটনা জানাইয়াছিল। মাসখানেক পরে, একদিন দিবা দ্বিপ্রহরে, বনলতা পলায়ন করিয়া, পদব্রজে রেলের ষ্টেশনে গিয়া নরেনের সঙ্গে মিলিত হয় এবং উভয়ে কলিকাতায় চলিয়া যায়। তাহার শ্বশুর কলিকাতায় গিয়া থানায় এবং উকিল-বাড়ীতে অনেক ছুটাছুটি করিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুই করিতে পারেন নাই। নরেনের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছে।
1 মন্তব্যসমূহ
দেবী গল্পটি upload করবেন।
উত্তরমুছুন