দীপাঞ্জনা মণ্ডল'এর গল্প : নির্মাণ

১.১
লুকোচুরি খেলতে ভালোইবাসে মাটি। দেওয়ালে মুখ চেপে এক থেকে একশো গুনবে একজন আর বাকিরা সেই সময়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়বে স্থানে-অস্থানে। গোনা শেষ হলে একে একে খুঁজে নিতে হবে প্রত্যেক লুকোনোকে। এর মাঝে কাউকে খুঁজে পাবার আগেই যদি সে পিছন থেকে এসে ধাপ্পা দেয় তবে যে খুঁজছিল সে আবার নতুন করে এক থেকে একশো গুনে খুঁজতে শুরু করবে। আর যদি একে একে সব্বাইকে খুঁজে ফেলতে পারে তবে এক্কেবারে প্রথমে যাকে খুঁজেছিল সে হবে নতুন খোঁজারু। এক একটা বিকেলে শেষ কাকটার ঘরে ফিরবার আগে পর্যন্ত এরকম খেলার দান খুব বেশি হলে দুবার খেলা যেত।

কারণ ওদের বাড়ির একতলা দোতলার আটটি মধ্যবিত্ত চাকুরে পরিবারের তেরটি ইংলিশ মিডিয়াম বাংলাভাষী বাচ্চা আর তিনতলার চিলেকোঠার দারোয়ান পরিবারের তিনটে বাংলা মিডিয়ামের হিন্দিভাষী বাচ্চা মিলে মোট ষোলোজনের মধ্যে পনেরজনকে দেড় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দুবার পুরোপুরি খুঁজে ফেলা প্রদীপের জিনের পক্ষেও সহজ নয়। যদিও খেলাটা ক্রমশ উত্তেজনা হারাচ্ছিল। কারণ লুকোনোর জায়গাগুলো আর তেমন অভিনব থাকছিল না। আর বাড়ির অপেক্ষাকৃত বড়দের ছাত, কার্নিশ, একতলার উঠোন, পরিত্যক্ত চৌবাচ্চার ঘুপচি এই সব জায়গাতেই পনেরোআনা খেলুড়ে ধরা পড়ছিল। আর দরজার ফাঁক থেকে এসে ধাপ্পা দেবার আগেই পুরনো কাঠের ফোঁকর থেকে সঙ্গীর জামার রংবেরঙের পরিচয় নির্ভুল উদ্ধার হচ্ছিল।

মণি, সাথী, রূম্পা, ঝুম্পা, বান্টি, নকুল, সহদেবদের ষোলআনা দঙ্গলে মাটিও বুঝছিল এ বাড়ির সীমানায় ওদের খেলার আর কোনও উত্তেজনা নেই। সবচেয়ে নতুন পুঁচকেগুলো যদিবা সব জায়গা না চেনার জন্য একাধিকবার ধাপ্পা খায়, তবুও বড়গুলো নিশ্চিত জিত জেনেই কেমন মুষড়ে পড়ে। দলে সবচেয়ে ছোট মণি সেদিন পুলিশ হতে ক্লাস ফোরের বান্টি বলল, ‘যা তোর বদলে আমি পুলিশ হচ্ছি, নয়তো তোর এক দানে সন্ধ্যে!’ বাকিরা নিয়মের এই ফ্যাঁকড়া দেখেও বিনা বিতর্কে মেনে নেয় কারণ বান্টির এই স্বেচ্ছা-নির্বাচন অযৌক্তিক নয়। মণির বাকি পনেরোজনকে খুঁজে পাবার আগেই ধাপ্পা খাবার সম্ভাবনা বেশি, তা না হলেও সব্বাইকে খুঁজে পেতে পেতে ওদের মশার কামড় খেয়ে অস্থির অপেক্ষা করতে হবে। বান্টি মিনিট কুড়ির মধ্যে ছাত থেকে উঠোন পর্যন্ত একপাক ঘুরে সবাইকেই টেনে বের করে। প্রথমে ধরা পড়েছিল সেই মনিটা। এবার আর কেউ ওর পুলিশের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এল না। সুতরাং খেলা শেষ হবার আগেই মায়েদের হাঁক শুরু হল;আর একে একে সবাই ঢুকে পড়ল নিজেদের খোপে, রাতের মতো।


২.১

মাটি লুকোত অদ্ভুতভাবে। একশো গোনা শেষ হবার আগেই নিজেকে দুমড়েমুচড়ে কখনো পুরনো খবরের কাগজের বাণ্ডিলের পরতে, কখনো পাপোষের নিচে, কখনো তুলসীর বেদিতে সেঁটে ফেলত ও। আর এরকম লুকোতে গিয়েই একদিন ওদের বাড়ির পিছনের দরজার গলির একটা খাপরার ঘরের দরজার সামনে ঘাপটি মেরে বসেছিল ও। সেখান থেকে কি করে ঠিক না বুঝলেও ও নিজেকে আবিষ্কার করলো ওদের পাড়ার স্থায়ী শিবমন্দিরের দালানে, যেখানে সমস্ত পুজোর ঠাকুর তৈরি হয়।

মাটি তিন-চার মাস পরে পরে বাবার হাত ধরে সেলুনে যাবার সময়ে এখানে এক রকম আড়াআড়ি আটকানো দুটো বাঁশের ওপরে নানা আদল গড়ে উঠতে দেখেছে। যা দেখত তা অন্যদের আগে দেখার কৃতিত্ব নিত বিকেলের খেলার সময়ে,ওর খুব কাছেই অন্য কোনও খেলুড়ে লুকোলে তার সঙ্গে। অবশ্য প্রায় প্রতিবার-ই বুঝত বান্টি বা আর কেউ কেউ ওর আগেই দেখে এসেছে সে সব। এমনকি তারা সে ঠাকুরের নাম, তার বাহন আর পুজোর দিন পর্যন্ত জানে। মাটি সে সব নতুন তথ্য আবার চালান করত তার বছর দুয়ের বোনের কাছে। সে সবই বড় বড় চোখে শুনে দেয়ালের টিকটিকি ও আরশোলার গতাগতিতে মনোনিবেশ করত।

ক্রমশ মাটি আর অন্যরাও বুঝছিল পুজোগুলো এক রকম ফিরে ফিরে আসে। দুর্গামূর্তির সঙ্গে সঙ্গেই সরস্বতীর পুজো হলেও তার আলাদা পুজো না হওয়া অব্দি প্রতি বছর কুল না খেয়ে কাটাতে হয় ওদের। ব্যাপারটা পছন্দের নয় মোটেই।


১.২

বাড়িতে ওদের খেলা বন্ধ হল পাকাপাকি যেদিন বান্টি ওদের ঘরে লুকোতে গিয়ে ওর মায়ের মেঝেতে পড়ে থাকা শাড়িতে পা জড়িয়ে আছাড় খেল এবং ওর বাবা হাঁচোড়পাঁচোড় করে বিছানা ছেড়ে এসে ওকে ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করলেন। সেদিন ওই ঘরটায় ঠিক কি হচ্ছিল তা নিয়ে মায়েদের কানাকানি আন্দাজ করলেও কিছুই স্পষ্ট হল না মাটিদের কাছে এবং বিনা মেঘে বজ্রপাতের ওদের বড়রাস্তা পেরিয়ে মাঠে খেলতে যাওয়া অনুমোদিত হয়ে গেল। নকুল ওর মাসছয়েকের ভাইকে পাহারার জন্য আর মণি অনেকটা ছোট বলে পড়ে থাকা চোদ্দজন মাঠে পৌঁছল।

ওদের বাড়ির বড় দাদারা সেখানে বিভিন্ন রকম বল খেলে, আর দিদিরা মাঠের কিনারা বরাবর হেঁটে যাবার সময়ে কদাচিৎ সে সব বলের দ্বারা কিছু আহত হয়। নবাগত বান্টি, মাটিরা মাঠের বিন্যাস বুঝতে বুঝতে কেউ দাদা কেউ দিদিদের পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ল। বলের আঘাত সম্বন্ধে কোনও দ্বিমত যদিও ছিল না, তবু সে আঘাতের দায় কার সে নিয়ে বিতর্ক হত। বান্টি বলতো, ‘শ্রেয়াদির গায়ে বলটা ইচ্ছে করে ছুঁড়ল, ছোড়দা, দেখলি!’ আর মাটি বলতো, ‘তোর ছোড়দার পরপর চারটে শট এদিক দিয়ে গেল, শ্রেয়াদি দেখেনি না কি!’

সেই ছোড়দার সঙ্গে একবার শ্রেয়াদিকে দেখা করবার বার্তা ছোড়দার পক্ষ থেকে শ্রেয়াদিকে বলতে গিয়ে কানমলা খেল মাটি; আর পরদিন শুনল বান্টিকে তার ছোড়দা নিজের অ্যালবাম থেকে বেশ কটা ডাকটিকিট যেচে দান করেছে। শ্রেয়াদি আর বান্টির দাদার দোষগুণ এবং তার ও বান্টির বর্তমান অবস্থা বিষয়ে খুব জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ল মাটি। আরও আবিষ্কার করল বান্টির ছোড়দা আর শ্রেয়াদি দুজনেই তাকে এড়িয়ে চলছে আর বান্টিকে তোয়াজ করছে। খেলাটা কিছুই না বুঝে আগাগোড়া হতভম্ভ হয়ে রইল মাটি। আর সেই হতভম্ভ অবস্থার মধ্যেই সেই বাড়ি আর পাড়া দুটোই বদলে গেল মাটির। মাটিরা বড় হচ্ছিল বলে ওদের বাবা মায়েরা নিজেদের জন্য একটা বাড়ি তৈরি করছিলেন একটু একটু করে। এদিক ওদিক ছিটকে যাচ্ছিল সবাই।

২.২

গঙ্গামৃত্তিকার মণ্ডগুলোকে পায়ে করে পিষে নরম করছিল কুমোরেরা। মাটি মিশছিল। অপেক্ষা করছিল কোন মূর্তির গায়ে বসে বোঝার জন্য। হঠাৎ একতাল মাটি হয়ে ও উঠে গেল কুমোরদের পাড়ার পাগলাটে বুড়োদার হাতে। সে কোন এক কালে না কি বউ-ছেলে খুইয়ে এমন পাগলপারা। কাজ করতে ইচ্ছে হলে করে, না হলে নয়; কেউ ডেকে খেতে দিলে খায়,নয়তো এই দালানেই শুয়ে পড়ে। বড় নিখুঁত তার আঙুলের টান, ছোট ছোট মূর্তি বানায় যেগুলো ঘর সাজানোর জন্য কেনে নাকি বড়লোকেরা। কুমোরপাড়ার মাতব্বর হরিদা মাঝেমধ্যেই তার কাজ কাজে লাগাতে না পারার দরুন আক্ষেপ করে। মাটি যদিও ওই পুজোর পরে জলে পড়া মূর্তিগুলো বানায় না বলেই বুড়োদাকে কেমন একটা ভালবেসে ফেলেছে। তার হাতেি পড়ে মাটি মাটি হল আর কি! কোনও বাঁশের কাঠামো না নিয়েই বুড়ো মূর্তি গড়তে থাকলো, হাতখানেক মতো। বড় মিঠে হাত তার, মাটি নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল পুরোপুরি।

কালো রঙের পোঁচ, কিছু লালের টান ঘিরেছিল ওকে। চুপ করে বসেছিল ও। হঠাৎ যখন হরিদা আঁতকে বলল, ‘ও কি বুড়ো! ও কে কিনবে রে? কালীকৃষ্ণ গড়লি যে তুই!’ মাটি নিজেকে হরির চোখে দেখল, ঘন কাল গা, লাল চোখ, আদ্দেক জিভ বাইরে, ঠোঁটের অন্যপাশ বাঁকা, অনেকটা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা মণির দাদু! মাটি কাঁদতে পারল না। হয়তো বুড়োদার এঁকে দেওয়া চোখ ধুয়ে যাবে বলে, না কি এই মূর্তিও কোনও অভিজাত বাড়িতে ঠাঁই পেতে পারে সেই আশায়! কে জানে।


 ১.৩

নতুন বাড়ি, নতুন পাড়া, নতুন বন্ধু – খেই হারিয়ে ফেলছিল মাটি। এখন আর তেমন লুকোচুরি নেই। সবাই জানে ওরা কাজের কথা লুকোবে অন্যের থেকে, সুযোগ পেলেই উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কানে সহপকর্মীর নামে চুকলি করবে, অথবা সুযোগেসময়ে বন্ধুদের ভাবমূর্তি ছলেবলেকৌশলে ধ্বংস করে নিজেকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে। মাটি নিজের কাজের বাইরে আর কিছুই দেখতে চাইল না। এক তো এখন কোনটা ও সমর্থন করবে আর কোনটার বিরুদ্ধতা তা নিয়েই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে সেই মাঠের ঘটনার জন্য; তার ওপর এখানে কেমন সবাই সন্দেহ করছে সবাইকে। সবার কিছু না কিছু লুকোনো আছে কোনও ঘুপচি অন্ধকারে যা মরিয়া হয়ে আছে ধাপ্পা বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে ধরা পড়বার আগেই। আর প্রমাণ করে দেবে নিজের জিত। কিছুতেই কেউ পুলিশ হবে না এগিয়ে এসে, চোর হবে যে কোনও মূল্যে। অথচ কোনও পুলিশও নেই আসলে, কারণ এখানে কোনও ফুলিস নেই। সবাই সবসময় চোর আর পুলিশের দু-নৌকায় পা দিয়ে চলছে। একজন পুলিশ হয়ে পড়লে পাকে চক্রে গোপন কথা জেনে ফেলে, তাকে দুয়ো দিচ্ছে সবাই। আর সবাই নিজের চুরি বাঁচাবে বলে অন্যদের চুরিগুলোকে সামনে আসতে দিতে চাইছে না। আবার যেই বুঝছে তার চুরিটা ধরবার একাধিক সাক্ষ্যপ্রমাণ ওমনি রাজসাক্ষী হয়ে নিজের পিঠ বাঁচিয়ে অন্যকে ফাঁসাচ্ছে।

মাটি একদিন দেখে ফেলল ওদের কিছু গোপন ফাইল চালান হচ্ছে ওর পাশের কেবিন থেকে। জানাবে কি জানবে না এই দ্বন্দ্ব জয় করলো না জানালে অনেকের ক্ষতি নিশ্চিত জানে বলে। প্রথমে পাশের কেবিনে গিয়ে অনুরোধ করলো ফাইলটা ফিরিয়ে আনতে। কাজ না হতে গেল বসের কাছে। ‘লাল ফাইলটা যে প্রতিপক্ষের হাতে চলে যাচ্ছে। আপনি দেখুন।’ ‘দেখছি’, শুনে আশ্বস্ত হয়ে পিছন ফিরে দেখল দরজা খুলে ভেতরে আসছে ওর পাশের কেবিনের সেই উদ্ধত চোর। ঔদ্ধত্যের কারণ বুঝল। কিন্তু পাঁচটার সময় কাজ সেরে বেরনোর মুখে নিজের ছাঁটাই-এর চিঠি নিতে একটুও হাত কাঁপল না ওর, বরং অস্থায়ী বেয়ারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল একটু। ছোটবেলার ভাইকে সামলাতে দলছাড়া হওয়া সেই নকুলও একটা উজ্জ্বল কঠিন হাসি ফিরিয়ে দিল।

২.৩

কালীকৃষ্ণ মূর্তিটা পড়ে রইল দালানটার একটেরে। বুড়োদাকে ধরেবেঁধে বিয়ে দিল সব কুমোরেরা। বুড়ো আগের মতোই থমথমে থাকল বটে কথাবার্তায় কিন্তু কাজে হঠাৎ মন যেন ফিরল তার। রাধাকৃষ্ণ, মা লক্ষ্মী, গণেশ, এমনকি রবীন্দ্রনাথ,বিবেকানন্দ পর্যন্ত নামাতে লাগল; পেঁচা আর ঘোড়াও বাদ গেল না। হয়ত চাষি বউ আর বাউল-ও বেচবে কদিন পর। তাবড় বড়লোকেরা এসব শখ করে কিনে নিয়ে যায়। কাঁচের আড়ালে দেখা যায় অথচ ছুঁতে হয় না মতো কুঁজো হয়ে থাকে টানারিকশাওয়ালা বা কাস্তে হাতে চাষি। বুড়ো নিজের পাগল অবস্থায় বানানো মাটিকে দেখালে সে ঘেন্না আর ভয় পায়। মাটি লজ্জা পায় না।

আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকতে থাকতে শুধু বুঝতে পারে ওর থেকে এবার আসতে আসতে মুছে যাচ্ছে বুড়োর যাদুকরী আঙুল। মাটি হচ্ছে ও। আবারও।


লেখক পরিচিতি
দীপাঞ্জনা মণ্ডল
গ্রন্থ - পুকুরপাড়ের নোয়ানো গাছ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ