দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেলেন নীহারিকা। বিতান দাঁড়িয়ে আছে। তার
পাশে বিহারি রিকশাওলার মাথায় হোলড-অল, ব্যাগ ইত্যাদি। তিন বছর পরে বিতান আবার এল। অথচ
এই ক'বছরের ব্যবধানে তাকে বড়ো বয়স্ক মনে হচ্ছে,
যেন বিতান তিন হাজার বছর পেরিয়ে এসেছে। রিকশাওলা জিনিসগুলো দরজার মুখেই নাবিয়ে দিয়ে চলে যায়। বিতান আচমকা হেসে ফেলে।
একেবারে চলে এলাম, মা--
চাকরিটা ছেড়ে দিলি?
বাজপাড়া বাড়ির মতো কীরকম ফুটিফাঠা
চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল বিতান। কাল
সারারাত ট্রেনে ঘুম হয়নি। স্টেশন
থেকে বেরিয়ে ট্যাকসিতে গা এলিয়েই ঘুম পেয়েছিল তার,
বড়ো নির্ভরতার ঘুম। আঃ,
প্রিয় শহরটায় চিরকালের মতই তবে চলে এল সে আবার। সাদার্ন অ্যাভেনিউর ঘাসঢাকা বুলেভারে হাত-পা ছাড়িয়ে শুয়ে থেকে, শীতকালে তো বেশি রাতে
হিম জড়িয়ে যেত প্রতি রোমকূপে, প্রায় আকাশটাকে বুকে ধারণ
করার অনুভবে শুয়ে থেকে, শহরের প্রতিটি চিৎকার আর কোলাহল,
বাসের চাকার ঘষটানি, ট্যাকসির হর্ন,
সব-- সবই তো কেমন কল্লোলামুখর সিন্ধুশব্দের
মতো মনে হত তার।
তুই যে কুটুমের মতো দোরগোড়াতেই
দাঁড়িয়ে রইলি--
কেমন? ইষ্টিকুটুম পাখির মতো? জিনিসপত্রগুলি ঘরের ভিতরে
ঢোকাতে ঢোকাতে নীহারিকাকে দেখছিল বিতান। তোমরা
দেশ-গাঁয়ে ইষ্টিকুটুম পাখি দেখেছ না মা? আদ্ধেক শরীরটা বিছানাতেই মেলে দেয় সে। পা
দুখানি শূন্যে ঝোলে বিতানের।
ধরো না কেন, আমি আবার তোমার সেই ইষ্টিকুটুম পাখি হলাম--
এ আবার কেমনধারা কথা?
সেরকমই তো। নইলে তুমি ভেবেছিলে, আমি এমনভাবে চলে আসব? কথা বলতে বলতেই বিতানের চোখ
বুজে আসে। আসলে নীহারিকার মুখের দিকে সে
তাকাতে পারছিল না। এমন অতিথির মতো কেন মনে হল আজ
মার মুখোমুখি? ভ্রূণ, অমরা, রক্তের নানাগল্পের ছায়ায় তার চোখ বুযে
গেছে-- যেন বিপরীত এক রক্তস্রোতে ভেসে-ভেসে এল সে-- নীহারিকার কাছে, যে বিতান যেন বীশু, কুমারী মায়ের দিকে তাকিয়ে
নীরব প্রলাপে মুখর--
তাহলে রক্তেও কোনো নির্ভরতা নেই। বিতান
চোখ মেলে দেখল, নীহারিকা তার দিকে অভিনিবেশে
তাকিয়ে আছেন।
কোনো
গণ্ডগোল হয়েছিল? নীহারিকা বিছানার ধারে বিতানের
পাশে এসে বসলেন। জামার বোতাম খোলা,
হা হা বুকে পাঁজরগুলো স্পষ্ট দেখা যায়, এতটাই রোগা হয়ে গেছে বিতান। রুগ্ন
অবশ্য সে ছোটবেলা থেকেই। সে জন্মাবার বছরখানেক পর থেকেই
দু-দুবার বাঁচবার কোনো আশা ছিল না, টাইফয়েডের ওপর টাইফয়েড, তখন নীহারিকা সারা রাত
জেগে বসে থাকতেন ছেলের পাশে। মালিকের
সঙ্গে কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল?
না তো--। মা একটু চা খাওয়াবে? বিতান কনুইয়ের ওপর ভর রেখে, হাতের তালুতে মাথা
রাখল। মাকে আমি অনেকদিন এভাবে কাছ থেকে
দেখিনি, সে ভাবল। ছেলেবেলায়
কখনো মাকে কাছে না পেলে সে মায়ের কাপড়ে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকত। তখন হয়তো স্কুলে গ্রীষ্মাবকাশ চলছে। শহরের
অভ্যন্তরে গ্রীষ্মের দুপুরে সে মাতাল হয়ে যেত মায়েব কাপড়ের গন্ধে। দেশ-গাঁ সে দেখেনি, না ঘাস না জল, কিন্তু এমন গন্ধের তটরেখা ছুঁয়েছিল। বস্তুতপক্ষে এই গন্ধই ছিল তার কাছে মায়ের স্বাদ,
আজও, যেহেতু বড়ো হয়ে মার সঙ্গে তার জড়িয়ে
ছড়িয়ে কথা হয়নি কোনোদিন, আজ অব্দি, আর এই গন্ধেও সে ডুবে যেতে পারেনি বহু বছর। শুধু
একটা বিশেষ গন্ধের স্মৃতি, যা তার মা, তার নীহারিকা মা।
বিতান দেখল, নীহারিকা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। এই
তিন বছরে অনেক কিছুই নিশ্চয় বদলে গেছে, যেমন এই ঘরটি, আগের চেয়ে অনেক বেশি সাজানো গোছানো,
বাড়তি জিনিসও হয়েছে, যেমন সোফা, টিভি ইত্যাদি। তার
বাড়ির লোক, পরিচিতজনেরা জানত,
এই চাকরিটায় বিতান ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না বা ঠিক চাকরিও নয়,
আসলে দূরত্ব, এই শহর থেকে অনেক দূরে উত্তর
ভারতেব নিষ্প্রাণ শহরটিতে-- বিতানের প্রথম দিককার চিঠিগুলোতে
এরকমটাই থাকত। তবু তিন বছর পরে,
যে সময়সীমায় অস্তিত্বের নানা ক্ষত সাফসুরত হয়ে যায় বা হওয়াই সম্ভব,
ঠিক তখনই, বিতান হুট কবে চাকরিটা ছেড়ে চলে
আসবে, এমনটা তো অস্বাভাবিক মনে হতেই পারে। বিতানও তা জানে। চাকরিটা
কেন সে ছেড়ে দিল, সেই কারণটাও তো তার কাছে
স্বচ্ছ নয়, অর্থাৎ কারুর কাছে গুছিয়ে বলবার মতো যুক্তিপরম্পরাও
তার ভাঁড়ারে নেই। তবু চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে তার নিজেকে বেশ বিজেতার মতো মনে হয়েছিল,
যেন টিলায় উঠে সূর্যোদয় দেখার মতো, যেহেতু
আটাশ বছরের জীবনে এই প্রথম সে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। এর আগে দুবার বিভিন্ন কারণে তাকে কোম্পানি থেকে শো-কজ করা হয়েছিল। দুটি
চিঠিরই বয়ানের একটি অভিন্নতা তার মনে আছে, য়্যু হ্যাভ ডেভ্লপ্ড
আ মোড অব ইর্রেসপনসিবিলিটি...।
তুই কিছু খাবি না? আগে খেয়ে নে কিছু। রান্নাঘর
থেকে নীহারিকার কথা ভেসে এল। সেই
সঙ্গে স্টোভ ধারানোর শব্দ, জলের শব্দ, সেলফ থেকে কাপ নাবানো আর নীহারিকার পায়ের শব্দ, হালকা, ভূতের মতো। বিতান
উঠে বসতে বসতেই দেখল, নীহারিকা ভিতর দিকের দরজার
পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
নীহারিকা চেয়ে থাকলেন বিতানের
দিকে। তিন হাজার বছরের কত আঁকিবুকি মুখে
নিয়ে বসে আছে তার ছেলে। বিতানের দিকে তাকালেই তাঁর মনে
পড়ে নিজের বাবার কথা। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক
বছর পরেই--ভারত-পাকিস্তান হয়ে যাওয়া-- দূরে কাছে যখন কেবল গ্রামপতনের
শব্দ-- মূল্যবোধ আর নৈতিকতা যখন বুকটাকে দুফালি করে ভেঙেচুরে
যাচ্ছে--তার বাবা তখন সুবচনীর খোঁড়া হাঁসের মতো মানসসরোবরের
স্বপ্নে ডানা ঝাপটাচ্ছেন। রোগা,
ছ-ফুট লম্বা, গৌরবর্ণ
তার বাবা শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতেন। কথা
বলতেন খুব কম। ধীরে। একদিন
বলেছিলেন, রাজনীতি কখনো মানুষের হৃদয়ের
জিনিস নয়--
তবু রাজনীতি ছাড়া মানুষ আর কী
নিয়ে লড়বে? কেউ প্রশ্ন করেছিল তখন। বাবা এর কোনো উত্তর দিতে পারেননি। সময়ের
নানা বিভ্রান্তি এভাবেই আলাদা করে দিচ্ছিল সকলের থেকে,
হয়তো নিজের হৃদয়ের থেকেও। মৃত্যুর
কয়েক বছর আগে থেকে তিনি লিখছিলেন আত্মজীবনী, যা অসমাপ্ত, এখন নীহারিকর ট্রাঙ্কে, ন্যাপথলিনের গন্ধের ভিতরে। তার
বাবা বলতেন, ও জীবনী আমার নয়--আমার নয়--
তাহলে কার?
মধ্যরাত্রির। বাবা কি শেষকালে পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন? নীহারিকা জানেন না। বিতানও
কি তবে মধ্যরাত্রির সন্তান?
এই বাড়িটায় আর থাকতে ইচ্ছে
করে না। বিতান শুনল,
নীহারিকার গলার ভিতরে প্রাচীন বালি ঝরছে।
কেন?
কতদিন কোথাও যাইনি।
বেড়াতে যাবে?
না। মানুষ তো নতুন-নতুন বাড়ি
বদলায়--
ভালো বাড়ির লোভ হয় বুঝি।
হৃদয়পুরের দিকে একটা জমির সন্ধান
পেয়েছি--
বিতান
চুপ করে থাকল। মার জিজ্ঞাসার ধরন কি এইরকম?
এত স্বপ্নাভাসের মধ্য দিয়ে? চাকরিটা সে
এমন আকস্মিকভাবে ছেড়ে দিল--কেন--মা তবু সহজে জিজ্ঞেস করতে পারে না তাকে। সহজ
জিজ্ঞাসার রক্তপাতে তারা কেউ--এই মা আর ছেলে,
বিতান আর নীহারিকা দীর্ণ হয়নি কখনো, তবু
স্বপ্নে তো আমরা এখনও কথা বলি, বিতান ভাবল।
আকাশ দেখছিল বিতান। তার ছেলেবেলার সেই আকাশ আর নেই। ভাড়াবাড়ির
একতলার ছাদে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখতে-দেখতে ভাবছিল বিতান, আকাশ, সমুদ্র সবকিছুই বদলায়। মাতৃত্বের
সংজ্ঞা বদলায়। গন্ধের শরীর একসময় শুধু গন্ধের
স্মৃতি হয়ে যায়। নীহারিকার কথা ভেবে বিতানের গলার
কাছে সূক্ষ্ম ব্যথার কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে। কী
অসহায় তুমি নীহারিকা, যেন কুন্তীর মতো তুমি আজ
আমার সামনে এসে দাঁড়ালে... ভ্রূণের সন্তানের পরিচয় এভাবেই
বদলে যায় তবে!
ট্রেন জারনি করে এলি,
আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়--
আকাশের আলোয় নীহারিকাকে দেখতে
পেল বিতান।
তখন তুমি বাড়ির কথা বলছিলে--
হ্যাঁ, হৃদয়পুরের দিকে একটা জমির খোঁজ পাওয়া গেছে।
কত টাকা ?
চার হাজার কাঠা।
তুমি কি বাড়িতে পুকুর বানাবে--বাগান করবে--সুপুরি, নিম,
দোপাটি গাছ করবে?
তাতে তো অনেক জায়গা দরকার?
কত ? একটা পৃথিবী? এই মহাবিশ্ব--
আবার বুঝি আমার সঙ্গে ঠাট্টা
শুরু করলি? তোর বাবাও তো করেন।
বিতান চুপ করে গেল। পৌরুষের মুখোশটাকে তার মধ্যেও কি মা আবিষ্কার করতে চায়?
যেন সন্তান নয়, অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে
কথা বলছেন নীহারিকা।
কী হল ? শুতে যাবি না?
তুমি একটা মাদুর নিয়ে এসো--
এখনি শোব না--
কেন, ঘুম আসছে না?
না--
অন্ধকারে চোখ বুজে শুয়ে থাকলে
ঠিক ঘুমিয়ে পড়বি-- ক্লান্ত আছিস তো--
ক্লান্ত হয়ে কী জাগতে নেই?
তোর কথাবার্তার রকমসকম বুঝি না
বাবা।
কেন বোঝা না ?
তোর বাবা বলেন, আমরা পুরোনো যুগের মানুষ।
তোমার বাবা তোমার কথা বুঝতেন
না ?
তা বুঝবেন না কেন--
তাহলে তুমি বোঝ না কেন?
তুমি কত পুরোনো যুগের? তোমার বাবার চেয়েও? তোমার ঠাকুমার চেয়েও?
আমি তো লেখাপড়া শিখি নি।
বিতান কার্নিসের উপর ভর রেখে
নীচের দিকে তাকাল। নীচের গলি সুনসান। লাইটপোস্টের হলুদ আলো ছড়িয়ে আছে। যেন
নক্ষত্রদের মড়াটে ঘিলু, নাড়িভুঁড়ি। মা আর সন্তান, জ্ঞানের এই
আদিতম বীজ, এর বাইরেও আর কোন্ জ্ঞানের
প্রয়োজন থাকে পরস্পরকে বুঝে নেবার জন্য? নীহারিকার আর কোন্
জ্ঞান চাই? এই প্রশ্ন তো সে নীহারিককে করতে
পারবে না। কেননা সেই জ্ঞানের শরীরে দাঁতাল
শুয়োরের চিৎকারের জন্ম দিয়েছিল সে নিজেই, তার চেতনা। আড়াই
কোটি বছর আগে যে নক্ষত্রটি মারা গিয়েছে-- যার আলো ১৯৮৬-র ১৭ই নভেম্বর দাঁড়িয়ে সে দেখতে
পাচ্ছে-- সেই নক্ষত্রের জীবনকালের সঙ্গে সে নিজেকে সংযুক্ত
করবে কীভাবে? সে তো নীহারিকার সন্তান-- তাই কি এত সহস্র আলোকবর্ষের ব্যবধান? নিজের জন্মফলের
খাতাটি ওলটাতে-ওলটাতে সে একদিন দেখেছিল--'এই জাতকের জন্মনক্ষত্র কালপুরুষের মুখে পড়ায় জাতক অত্যন্ত ভোজনপ্রিয়
হইবে।'
-- তাই কি তার চেতনা এমন আগ্রাসী হয়ে সম্পর্কের অন্তঃসারগুলি বকরাক্ষসের
মতো গিলতে চায়?
আচ্ছা মা--। বিতান নীহারিকার দিকে ফিরে দাঁড়াল। নতুন
বাড়িতে তুমি একটা অ্যাকোরিয়াম রাখবে না?
নীহারিকা বিহ্বলের মতো বিতানের
দিকে চেয়ে থাকেন।
কী সব যেন নাম-- ব্ল্যাক ফিশ, অ্যানজেল, আর ওই লাল-লাল মাছগুলো-- বিতান হঠাৎ খিকখিক করে হেসে ফেলে-- তোমার মনে আছে
মা, তখনও এ-বাড়িতে ইলেকট্রিক আসে
নি, হারিকেনের আলো ছিল, সেবার রথের
মেলা থেকে অনেক মাছ কিনে আমি বয়ামে এনে রেখেছিলাম-- সেই যে
বয়ামটায় তুমি আখের গুড় রাখতে-- এইসব মাছেরা তো আলো ছাড়া
বাঁচে না--এইসব রঙিন মাছেরা-- আর
ঘুরে ফিরে বেড়ানোর জন্য অনেকটা জায়গা ওদের লাগে, সবুজ শ্যাওলা
চাই-- সে সব তো কিছুই ছিল না-- কী
যেন ঝাঁঝিগাছ, হ্যাঁ, তাও ছিল না--
ভোরবেলা উঠে দেখলাম, জোড়া অ্যানজেল মরে
গেছে-- সারাদিন আমার কী কান্না--তুমি
খাওয়াতে পর্যন্ত পারনি-- তারপর কয়েকদিনের মধ্যে সব মাছগুলোই
মরে গেল--
বাবা, এতসব তোর মনে আছে? বগাবগানিও জানিস--
তুমি জান না, জাতকের জন্মনক্ষত্র কালপুরুষের মুখে পড়ায় জাতক অত্যন্ত বাকপটু হইবে?
আচ্ছা, যদি অ্যাকোরিয়াম করি-- নীহারিকা হাসলেন
--করাই তো যায়, তাহলে কি তুই সেখানে রঙিন
মাছ হয়ে সাঁতার কাটবি?
বিতান মরা মাছের মতো চোখে নীহারিকার
দিকে তাকিয়ে থাকল। এই
নীহারিকাকে সে কোনোদিন দেখেনি-- যেন বিশাল
এক নারীমাছের মতো, যে নীহারিকা তার পঞ্চাশ বছরের জীবনের স্রোত
ভেঙে তার দিকে এগিয়ে আসছে-- তার রঙিন সন্তান মাছের দিকে। বিতান হাওয়ায় শ্যাওলার গন্ধ পেল। ঝাঁঝিরও।
কিন্তু জল বার করার সময় অমন
জাল দিয়ে ধরতে যেও না আমায় তুমি।
তুই কিন্তু আজেবাজে বকছিস তখন
থেকে। ঘুমোতে চল--
নীহারিকা বিতানের হাত ধরে টানলেন।
আচ্ছা মা, সত্যিই যদি হৃদয়পরের জমিটা কেনা হয়ে যায়-- তোমার
মনের মতন একটা বাড়িও সেখানে হতে পারে-- তবু এই বাড়িটা ছেড়ে
যেতে তোমার কষ্ট হবে না?
তা তো হবেই--
তাহলে?
তা বলে কি মানুষ নতুন বাড়িতে
যায় না?
যায়। কিন্তু কষ্ট নিয়ে তবু কেন যায়?
নিজের ঘর তো চায় মানুষ--
আপন বাসা ?
নীহারিকা হেসে ফেললেন।
কিন্তু ধর সেখানে যদি তোমার কোনো
ছেলে মরে যায়--
বিতান! নীহারিকার গলা সাদা পৃষ্ঠার মতো কেঁপে ওঠে। তোরা
আমার বাড়ির স্বপ্ন এভাবে ভেঙে দিবি! তাঁর গলা ছুঁয়ে ঝর্নাটি উঠে আসে চোখে। নীহারিকা
কাপড়ে মুখ ঢাকেন। শোনা যায় শিকনি টানার শব্দ। নীহারিকার ফ্যাসফ্যাসে গলা। নতুন
বাড়িটা শুধু আমার চাওয়া নয়--
তাহলে কী মা ? বিতান নীহারিকার পিঠে তার থাবা মেলে দেয়।
অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারেন
না নীহারিকা। তারপর একটা শব্দ তার মুখ থেকে
ছড়িয়ে যায়, আ--কা--ং--খা--
আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি মা--
এমনি মুখ ফস্কে--
তুই তো এভাবেই বলিস চিরদিন--
বিতান চুপ করে যায়।
ঘুমোতে যাবি না?
কটা বাজল ?
বারোটা বেজে গেছে নির্ঘাত--
তাহলে আরো একটু থাকি।
মাদুর আর বালিশটা নিয়ে আসি। এখানেই কিছুক্ষণ শুয়ে থাক।
তোমার বাড়ির সব জানলাগুলোয়
রঙিন কঁচ লাগিও, মা--
বাড়ির কথা থাক।
চাল বেটে তুমি যেমন আলপনা দিতে--
সিঁড়িতে তেমন ফুল-লতা-পাতা একে দিও--
বাড়ির কথা থাক। তুই শুবি চল।
একটা লাউমাচাও করতে পার--
বাড়ির কথা থাক। অনেক রাত হল।
বা লঙ্কার গাছ। লাল-লাল ফুলের মতো লঙ্কা--
সবটাই বুঝি আমাকে সাজাতে হবে?
নীহারিকা শ্লেষে হাসলেন। আর
তোরা? বাড়িটা কি
তোদের নয়?
বিতান ছাদের উপরেই হাঁটু ভেঙে
বসে পড়ে।
তুই যে নোংরাতেই বসে পড়লি--
কতদিন ঝাঁট পড়েনি--
নীহারিকার দিকে চেয়ে থাকে সে। --ছাদের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেঁড়া কাগজ, শুকনো পাতা, পালক-- যেন
কোনো মহাযুদ্ধেব শেষ অঙ্কের ভিতরে বসে আছে সে। শান্তিপর্বের
ভিতরে? যেখানে বিষাদ এসে জয়ের মুখোমুখি ভাঁড় হয়ে নাচে,
বিতান ভাবছিল, যেখানে স্বাধীনতা পবিণত হয়
দহনে। তবু এই শান্তিপর্বের শ্মশানে তার
পাশে তো নীহারিকাও আছেন-- হয়তো দশ হাজার বছর আগে
নীহারিকার নক্ষত্রমণ্ডলী ভেঙে গেছে-- তার আলো বিতানের পাশে
এখনও জেগে আছে।
নীহারিকাও বসে পড়েন বিতনের পাশে।
তুই তো কোনোদিন কিছু বলিস না--
বিতান চুপ করে থাকে।
আগেও যখন এখানে থাকতিস,
একা একাই থাকতিস। কখনো
জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলিস নি তুই--
কী? বিতান হাসে।
নিজের কথা। বল তুই, সেধে কোনোদিন আমার কাছে
একহাতা ভাত বেশি চেয়েছিস তুই?
তাতে কী ?
মানুষ তো কাউকে কিছু বলে--
কাকে ?
আমাকে তো বলতে পারিস তুই।
ও কিছু না। ও তুমি বুঝবে না।
কেন, তুই কত আগামী যুগের? তোর ছেলের মেয়ের চেয়েও?
তোর নাতির চেয়েও?
হাওয়ার ভিতরে বিতানের হাসি কেঁপে-কেঁপে ওঠে।
তুমি দেখছি কথার শিরোমণি হয়ে
উঠেছ মা--
আমি তো তোর পেটে জন্মাই নি।
বিতান আবার হো হো করে হেসে ওঠে। পেটে ধরেছ বলেই বুঝি--
কী?
রক্ত দিয়ে সব কিছু বোঝা যায়
না, মা।
তাহলে কী দিয়ে। বল তুই-- আমি সেভাবেই বুঝব।
আমি জানি না। আচ্ছা মা, চাকরিটা আমি কেন ছেড়ে দিয়ে
এলাম তা তুমি একবারও জিজ্ঞেস করলে না কেন ?
তুই তো উত্তর দিতিস না--
তবু জিজ্ঞেস করতে তো পারতে।
কী লাভ ?
আচ্ছা, যদি তোমায় উত্তর দিতাম-- তাহলেও কি আমাদের বোঝাবুঝি
সম্পূর্ণ হত?
তুই যেন অনেক দূরে সরে গেছিস--
তুমি তোমার মা-বাবার থেকে এতখানি দূরে সরে গিয়েছিলে কোনোদিন?
নীহারিকা চুপ করে থাকেন।
আচ্ছা, এই পুরোনো বাড়িটা ছেড়ে যেতে তোমার কষ্ট হবে না?
হ্যাঁ--
তুমি চলে গেলে তো এ বাড়িটা আর
ঠিক এভাবে বাঁচবে না--
নীহারিকা বিতানের দিকে চেয়ে
থাকেন।
জান মা, এই তিন বছরে, ওখানে আমি বার দশেক বাড়ি বদলেছি। সত্যি বলছি, প্রত্যেকটা বাড়িতেই কেমন ভূতের ভয় পেয়ে বসত আমায়।
ভূতের ভয় ? চিঠিতে তো লিখিসনি কোনোদিন--
দারুণ ভয় হত। রাত্তিরে শুলেই মনে হত, কারা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। পুরোনো
সব বাড়িরা ভূতের মতো তাড়া করে ফেরে।
কী আবোল তাবোল বকছিস! এত রাত্তিরে তোর মাথায় ভূত চেপেছে। চল,
শুবি চল।
বিতান আবার হেসে ওঠে।
তুমি ভয় পেয়ে গেছ, মা?
তোর শরীরে কোনো কষ্ট হচ্ছে?
না তো--
কোনো কষ্ট নেই?
না--
তাহলে এমন বানিয়ে-বানিয়ে কথা বলছিস কেন তুই?
বিতান দেখল নীহারিকার মুখ কিরকম
কুয়াশার মতো আবছা হয়ে যাচ্ছে। সেই
কুয়াশার মধ্য দিয়ে উড়ে যাচ্ছে অনেক জেটপ্লেন, উড়ুক্কু মাছ আর অরকিডের শেকড়।
মা, ওই বাড়িগুলোতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম খুব--
কেন?
ভূত ছিল--
কাদের ভুত ?
গত একশ বছরে যেসব সময় মরে গেছে--
তোর শরীর খারাপ লাগছে?
না, শোনো না--তোমাদের মা বাবা তো তোমাদের জানত--
হ্যাঁ--
তোমরাও তাদের জানতে--
হ্যাঁ--
তার আগের পুরুষেও জানত--
হ্যাঁ--
তারও আগের পুরুষ--
হ্যাঁ--
তাহলে এতদিনের জ্ঞান--জ্ঞানের ভূত--
তোর শরীর খারাপ লাগছে?
আমি এত মৃত জ্ঞান নিয়ে কী করব
বলতে পার, মা? কথাটি বিতানের গলার
ভিতরেই ডুবে যায়। নীহারিকার কানে পৌঁছয় না। বিতান জানে, কোনোদিন পৌঁছবে না। হৃদয়পুরের জমিটা যদি সত্যিই কেনা
যায়--
ওসব কথা থাক। তুই এবার ঘুমিয়ে পড়বি চল।
নতুন বাড়িটা সেই স্টেশন থেকে কতদূরে হবে?
1 মন্তব্যসমূহ
স্তব্ধবাক !
উত্তরমুছুন