তাপস গুপ্ত : ঋণ শোধ

গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। খেলাম না ছুঁলাম না, বলে নেয়ে এসো। আউট গোয়িং আর ডি ও (রুরাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার) বত্রিশ জন খাতকের লিষ্ট ধরিয়ে বললেন, এগুলো মহাত্যাঁদোর, মামলা দায়ের ছাড়া আদায়ের গত্যন্তর নেই।

ভ্যালারে বাপু, নতুন চাকরি পেয়ে লোন অফিসার হয়ে, না মামলাবাজ হয়ে এলুম রে বাবা! গাঁয়ে ঘরে বৌ ঝিরা ঝগড়ার সময় গাল পাড়ে – ঘরে চোর ঢুকুক, ডাক্তার, রাজমিস্ত্রী ঢুকুক, মামলা ঢুকুক। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে বাইশ, মামলার ঘের বেশি, চিঁড়ের বত্রিশ ফের। সেই মামলার সোপর্দ উমেদারিতে ভর্তি হলুম, পেটের দায়ে, মেটিরি গাঁয়ের ব্যাঙ্কে। কাবলিওলার চাকরি, পহেলে চুদতো দো পিছে চুলা জ্বালাও, নইলে উনুনে পা ঢুকিয়ে বসে থাকো। মামলাবাজ; রেডিওবাবু (রুরাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার), কিস্তিবাবু না খিস্তিবাবু অষ্টোত্তর শত হরেক নাম।

বকেয়া লিষ্টের লেজ ধরে ছুটতে ছুটতে ছ’নম্বরে পৌছতেই নাজেহাল। ভাজা ভাজা অবস্থা! চোখেমুখে দশাবতার দেখছি। সাত কি আট নম্বরে দেখলাম জোড়া ঘাতক, রঘুপতি এবং সীতাপতি ঘোষ। পিতা অধিপতি ঘোষ। ঘোষ দিগর। রামহাটি। বর্ধমান।

ওঃহো! সে-ই রামহাটি। নামেই চিত্তির পুলকিত হলো। আমার এক মহাপুরুষ বন্ধুর জন্ম ভূমি।

রামহাটির গুণে আগেই মোহিত ছিলাম। সেখানকার দাপুটে জমিদারিতে, লেঠেলে ডাকাতে এক ক্ষুরে মাথা কামায়। জমিদারির বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো মেজোবাবুর কনিষ্টনন্দনটি কান্তকানন বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে কাতু বাড়ুজ্জে আমার পূর্বপরিচিত। কিছুকাল চায়ের দোকানে এক বেঞ্চিতে বসেছি। বেঞ্চির দু’মুখো সুবিধে, একমুখে বসে চা পান করা যায়, অন্যমুখে বাংলু। একমুখো দোকানে দু’মুখো কেনাবেচায় আমরা দু’জন দু’দিকের খরিদ্দার। প্রতিদিন দুজনের একই সময়ে পাশাপাশি বসা। বসতে বসতে গা লাগালাগি। কথা চালাচালি। আলাপ জমে ওঠে। জমিদারি লোপাট হয়ে গেছে। সিং দরোজা আজো সাটপাট হয়নি, ঝুরঝুরিয়ে ঝরে । শিং এর নীচ দিয়ে ঢুকে জমিদারির দু’এক পিস মরা হাতি লাখ টাকার গল্প জমে ওঠে। চায়ের মিষ্টিকে ফিকে করে মানুষটি ঝুরঝুরে গল্প বলেন মন ভরিয়ে। গল্পের মিষ্টিতে মুখের গন্ধ আর বুকের বন্ধুত্ব গা পানে ঠেলে আসে। মদ তৈরি হয় চিনির গাদ দিয়ে। চায়ে চিনি আর গাদে চিনি। বন্ধু বন্ধু চেনাচিনি। আবিষ্কার করলুম, চিনির মিষ্টত্ব আর মদের গন্ধ মিশিয়ে যে বন্ধুত্ব তৈরী হয়, তাতে দু’একদিন মানিব্যাগ আনতে ভুলে যাওয়া কাতু বাড়ুজ্জের পয়সা মেটাতে আমার কোনো আক্ষেপ তৈরি হয় না। চায়ের ভাঁড়ে বন্ধুত্ব জমে ক্ষীর হয়ে ওঠে।



ভরসন্ধে, এদিক ওদিক শাঁখে ফুঁ পড়ছে, পথের ধারে দু’একটা বাড়িতে, সন্ধেপিদিম জ্বলছে। একদিন অফিস শেষে লালদিঘীর পশ্চিমপাড় দিয়ে যাচ্ছিলুম। পথটি সর্টকাট, সাধারণ গম্য নয়। লাল আলোয় চলতে হয়। আমিও যাই না। সময়ের টানাটানিতে সেদিন ও পথের পথিক। পায়ের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লো, এক ভদ্রলোক। চিনতে পারলুম, বন্ধু কাতু বাড়ুজ্জে। দু’তিনজন মহিলা তাকে পেটায় করছে। আর চিৎকার করে গাল পাড়ছে। বন্ধুকে আগে বুকে তুলে নিলুম। আর কিছুক্ষণ পেটায় চললে দেখা হতো হসপিটালে। সে দায় থেকেতো আগে বাঁচি! শরীর মাতোয়ারা করে শস্তার অগুরু চন্দন আর চেনা বাংলুর বান্ধবিক গন্ধে ভরপুর। নাক মুখ ঝাঁঝিয়ে উঠলো। পেটানিতে দেহখানা তখনো আস্ত থাকলেও, আর্দির পাঞ্জাবির হালত দেখে চামড়ার ভবিষ্যত টের পেলুম। পরনে পাজামা, আন্ডারওয়ার কিছু নেই। খবর নিয়ে জানলুম, দু’পাঁইট মাল আর চামেলির ভাড়া বাকি রাখতে চেয়েছিলেন, এবং আগে পাঁচ দিনের ভাড়া বাকি আছে। পাজামা আন্ডারওয়ার উদ্ধার করতে বাকি বকেয়া উসুল দিতে হলো। সদর রাস্তায় উঠে বন্ধু জানালেন, পয়সা কড়ি মেটানো কাজটা আমার মোটেই ঠিক হয়নি। বন্ধু লালআলোর পাড়ায় ঘর বদলে বদলে নাকি বাকি রাখেন, ধোলায় খাওয়ার জন্যেই। ধোলাই খাওয়াতে এক ধরনের সুখ আছে। তাকে মর্ষকাম সুখ বলে। প্রমান করে দিলেন, সুখ বিষয়ে আমার মতো আকাট মূর্খ তামাম ভূ-ভারতে নেই। এরকম ঠ্যাঙানি, বন্ধু শখ করে আগেও কয়েকবার খেয়েছেন। বিচিত্র সুখ উপভোগ করায় তার জীবনের উদ্দেশ্য। অনাস্বাদিত এরকম সুখ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছি দেখে যমরাজ আমাকে ক্ষমা করবেন না, বরং মরার পর নির্ঘাত মর্তে ফেরৎ পাঠিয়ে দেবেন। এ জন্য বন্ধু খুব দুঃখ পেয়েছেন। অনভিজ্ঞ অশিক্ষিতকে নেহাত বন্ধু বলেই রেয়াত করলেন। যাওয়ার আগে শূন্য মানিব্যাগ ঢুঁড়ে একখানা আত্মপরিচয়ের বাহারি কার্ড এবং একখানা পাশপোর্ট সাইজ়ের ছবি দিয়ে জমিদারিতে যাওয়ার সনির্বন্ধ নিমন্ত্রন জানালেন। বারবার ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, আমন্ত্রন নয়, নিমন্ত্রন। তখনই সমস্ত ধার দেনা সুদে আসলে পাইপয়সা মিটিয়ে দেবেন। তার চোদ্দপুরুষে বাকি রাখার ইতিহাস নেই, এবং আমার বীরত্বের জন্য পিঠ চাপড়ে দিয়ে এফ ইউ সি মাঠের সরু পায়ে চলা নিক ধরে হাঁটতে হাঁটতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সেই শেষ দেখা। সমবায়িকার মোড়ে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত বন্ধুকে দেখার পূণ্য অর্জন করলুম।

মানিব্যাগ হাতড়িয়ে দেখলুম, সেই বন্ধুর আইকার্ড এবং ছবিটি বহাল তবিয়তে ভাঁজ টাঁজ হয়ে এখনো আস্ত আছে। অতএব মাভৈ! দু’দুটো অনাদায়ি ঋণ মেটানোর আমন্ত্রণ এবং নিমন্ত্রণের লোভ সামলাতে পারলুম না। ।







ক্যাশিয়ারবাবু টাকার গরমে খাঁচায় বাস করেন। গাঁ গঞ্জ থেকে অধমের দু’পাঁচ টাকা আদায়ের উষ্ণতা তার কাছে খোলাম কুচি বৈ নয়। সংকল্পের কথা শুনে দুচ্ছাইতো করলেনই, উল্টে বললেন , ও মুখো হবেন না মশাই, ওটা ডাকাতের গাঁ। ডাকাত ঠান্ডা রাখতেই লোনখানা দেওয়া হয়েছে। নইলে কবেই লুঠতরাজ হয়ে খাঁ খাঁ করতো এই ব্যাঙ্ক।

ডাকাত দমনে ব্যাঙ্কের এই লোন-অভিযান আমার বিশ্বাস হলো না। ভুরোর বাঙাল পেয়েছে নাকি! কোলকাতা বরানগরের মুরুব্বি আমি। পুলিশ, আইন আমার ফাইলের কাগজে উঠবোস করে। অতএব ডাকাতের টিকি আমার হাতে বাঁধা। উপরন্তু বন্ধুত্বের অংশিদারীতে রামহাটির জমিদারবাবুও হাতের মুঠোয়। ডাকাতদের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দেওয়ার হিম্মত আমি রাখি।

ক্যাশিয়ারবাবুর স্যাঙাত ক্যাশপিয়ন, আমার হিম্মত হাওয়াই উড়িয়ে দিলেন, হাঃ হাঃ হাঃ ডাকাতে হাসি হেসে বললেন -স্যর, ওদের দেকলেই আপনি ভিমরি খাবেন। কালাপাহাড়ের মতো বডি, ভাঁটার মতো চোক, মহিষাসুরের মতো বাবরি চুল উড়িয়ে বনবন করে লাঠি ঘোরায়।

যত্তসব গাঁইয়া কল্পনা। একটাও বাস্তবের মাটিতে ফলে না। বরানগরের বীরপুঙ্গব, আমি যাবোই। বানিজ্যেতে যাবোই আমি যাবোই ।

ক্যাশপিয়ন ছড়া শুনিয়ে দিলে –পিপিলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে।



বাস চলছিলো মাঠের মধ্যে দিয়ে। মাটির রাস্তা। নৌকোর মতো দুলে দুলে। ঘ্যাঁচ করে থেমে ঘোষদিগরের মোড়ে যখন উগরে দিলো, স্টপে একটামাত্র বটগাছ, সরু একখানা নিক(রেখ)পথ। বাসরাস্তা থেকে নেমে হারিয়ে গেছে তেপান্তরের মাঠে। জনমনিষ্যি কি কাকপক্ষির একটুকরো ছায়াও পড়ে নেই। বাসখানা চলে গেলো। ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে যেতে, মাঠের এপার ওপার জুড়ে সার্ফএক্সেলে ধোয়া রোদ্দুরে মেলে দেওয়া নীল আকাশ আর ধু ধু দিকচক্রবালের নীচে একা আমি, একদলা রক্ত মাংসের এক লিলিপুটিয়ান। যেনো ঠেলা মেরে অচিন পৃথিবীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, হামবড়ো, তালেবর। বুক ফুলিয়ে মাথা তুলে সে একটা বিদ্রোহী কিংবা মাস্তান মাস্তান ভাবের সংগে এই নিসংগতার কোনো চারা নেই। পোড়োজমি, আর যতো দূর চোখ যায়, হা হা রোদ্দুরের নিষ্করুণ রহস্য।

ক্যাশপিয়নের হাসি আর ছড়া কানের কাছে উঁকি মেরে গেলো। - পিপিলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে।

আপনা থেকে ছাতা উঠে আসে মাথায়, ভ্রু নেমে আসে চোখের ঝুল বারান্দায়। হাঁটতে শুরু করি। আমি ছাড়া কেহ নাই, হাঁটা ছাড়া কাম। নিজেকেই বলি, রেডিওবাবু, হাঁটো হাঁটো। দেশের দশের মঙ্গল করো।

গ্রাম ছাড়া ওই সরু সুতোর পথে রোদ চাবকাচ্ছে। ছাতির টাকে উফ! চাঁদি ফাটায় রে। নেহাত বরানগরের গঙ্গা এখানে দূরগামী হলেও আমাকে চিনতে পেরেছে। একমাত্র তার আদরের মৃদুমন্দ বাতাসই আপন মনে হলো। রোদে তেতে আদিগন্ত বাঁজা জমি পাথর হয়ে পা টাটাচ্ছে। হাঁটছি তো হাঁটছি।

রূপকথায় ঘোড়া হারানো রাজপুত্রের মত, হাঁটতে হাঁটতে, হাঁটতে হাঁটতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি, নিজেই বুঝতে পারছিনে। একেই বলে কালাপানির মাঠ।

কোলকাতায় মানুষে মানুষে ফেঁসাফিঁসি, হাঁটা যায় না, গায়ের চামড়া ছিঁড়ে যায়। দু’দশ লাখতো এখেনে এসে বাস করতে পারে! ভীড়ে ডুবে বাস করাই যে কী বুকের জোর! কী সুখ! এখেনে না এলে বোঝা যায় না। জনপ্রাণীহীন এই বিশালত্বের মাঝে একক মানুষের হৃদয় ভীষণ ফাঁপা হয়ে আসে। ঢপ ঢপ করে। বুকখানা পলকা মনে হয়। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে, ক্রমাগত রোগা হয়ে যাচ্ছি। পুচকে হয়ে যাচ্ছি। হাল্কা পলকা হতে হতে একসময় বুঝি বাতাসে মিলিয়ে যাবো। আমার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।

হাঁটছি আর হাঁটছি। কোথায় রামহাটির সিংদরোজা! কোথায় রঘুপতি, সীতাপতি! মাথার ঘিলু শুকিয়ে গলায় ঘুঁটে হয়ে খটখটাচ্ছে। দু’এক গেলাশ জল পেলে অমৃত মনে হতো। ডাকাতের হাতে না মরলেও কালাপানির পিপাসায় বুক দগ্ধে মরে যাবো। কপালে ঘাম জমছে। ঘাম গড়িয়ে চোখের ভ্রু ছুঁয়ে ফেলেছে। চোখের পাতা ঠান্ডা। ঘামের ফোঁটায় দৃষ্টি ঝাপসা। গোঁফ ভিজিয়ে ঠোঁটে এসে পড়ছে বিরক্তিকর ঘাম। নোনতা স্বাদ লাগছে জিভে। এক এক ফোঁটা ঘাম যেনো পিপাসায় এক এক ফোঁটা অমৃত। জিভ দিয়ে চাটছি। মুখ, গলা, গেঞ্জি ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। কখনও গঙ্গার প্রিয় বাতাসে অজান্তেই শুকোচ্ছে, ভিজছে, শুকোচ্ছে করতে করতে জিভ যখন ছোটো হতে শুরু করেছে, হঠাৎ হঠাৎ চোখে ঘোর লাগছে, বাতাসে কালো ছোপ দেখছি, তখনই দেখতে পেলাম উ-ই দূরে উঁচু টঙে জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতর আবছা দেশলাই বাক্সের মতো দু’চারখানা কুঁড়েঘর। বোঝায় যেতো না, নেহাৎ ধোঁয়া উড়ছে তাই। মরীচিকা নাকি জলের আস্তানা! ট্রেনিংএ বলেছিলো, লোন আদায়ী আরডিও অর্ধেক চাষা। এখন দেখছি, চাষার বাপ। হেঁটেই মরছি। পা দুটোকে ব্যাগ্যাতা করছি, চল বাপ, আশায় চাষা খাটে, ওই তো ধোঁয়া দেখা যায়। চল চল চল উর্দ্ধ গগনে ডাকে জঙ্গল।



কেউ বলেনি রামহাটির এই দূর্গম পথের কথা। মনে হয় কেউ জানেই না। নদিয়া জেলার এক হুদোয় মেটিরি গ্রাম! রামহাটি বর্ধমানে, অন্য হুদোয়! মেটিরি ব্যাঙ্কের জমিদারি এতদূর বিস্তৃত, হয়তো স্ব্য়ং ম্যানেজারবাবুর হকিকতেও নেই। আমিতো দু’দিনের যুগি। জিভে গঙ্গা ছুঁইয়ে বলতে পারি, ব্যাঙ্কেরফুলটুসিবাবুরা এই গাঁয়ে কেঊ কস্মিন কালেও আসেননি। লোনি, জমি না দেখেই ব্যাঙ্কের টাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যে লোন দিয়েছে তার পা মচকে দেওয়া উচিত। আদৌ রঘুপতি, সীতাপতি কেঊ আছে কিনা সন্দেহ!

এতক্ষণে একটা পাকুড়্গাছ। শান্ত স্নিগ্ধ ছায়া। আহঃ! হাত পা ছড়িয়ে বসি। কী আরাম! গায়ের জামা তুলে, ভিজে গেঞ্জি টেনে বের করি। গেঞ্জির ঘেমো জলজল এককোনা গালে দিয়ে চুষি। মরুভূমি গলায় যদি মরুদ্যান দেখা দেয়! যতদূর চোখ যায়, এক বিয়েনি জমি। তিন ফসলের অপেক্ষায় হা পিত্যেস বসে আছে। আমি এলাকার রুরাল ডেভেলপমেন্ট অফিসার, এই মাঠ শ্যালো পাম্পসেটে, জলে জলে ভরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। সবুজে সবুজ হবে আমার হাতে। হাঃ,



হতোস্মি! আপাতত এক গেলাশ জলই আমার স্বপ্ন। পাতার ঝিরঝিরে সুরে ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুমঘুম পাচ্ছে। ঘুমুতেও ভয় করছে, এখানে ঘুমুলে সে কালঘুম নাকি আর ভাঙে না। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। নাকি কালাপানির মাঠে কালঘুমের গল্প সত্যি হয়ে আসছে! ক্যাশিয়ারবাবু পুরোনো মানুষ। অভিজ্ঞ। অভিজ্ঞতার কাছে শিখতে হয়।

হঠাৎ মোষের গাড়ির হটর মটর শব্দে চোখের আঠা গেলো কেটে । ক্যাশপিওনের বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে হুবহু সেই মহিষাসুর। এক গাড়ি ঝনঝনে পাকাধান, একজন ঠেলে, একজন টেনে নিয়ে চলেছে। আহ্‌! মানুষ, কী আশ্চর্য মধুর প্রাণী, এই সেই মানুষ! যাকে চোখে দেখলে আধমরা মানুষের প্রাণ জীবন্ত হয়ে ওঠে। ওরে প্রাণের দোসর মানুষ পেয়েছিরে! জল পিপাসা, ক্লান্তি, ঘুম এক নিমেষে হাওয়া! লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি কি আর, রেডিও আছি, জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে গেছি!

একজন মহিষাসুর গাড়ির গাড়োয়ান। মোষের পাশে পাশে পাচন হাতে গাড়ি টেনে নিয়ে চলেছে। আর এক মহিষাসুর গার্ড। গাড়ি পিছন ঠেলে নিয়ে চলেছে। দু’জনেরই আদুল গা। সারা গায়ে লোম ভর্তি। দেখলে দু’পায়ে হেঁটে যাওয়া দুটি বিশাল ভল্লুকের কথা মনে পড়ে। গাড়ি ভর্তি পাকা হলুদ সোনার ধান নাচতে নাচতে চলেছে। গাড়ি, দু’পাশে দুটো তাগড়াই মোষ। আর মোষের সমান উঁচু দুটো মুসকো ভল্লুক। পাঁচজন আয়েস করে চলেছে। খানিক ব্যস্তসমস্ত হয়ে আমিই এগিয়ে গেলুম। গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করলুম -এটি কি ঘোষদিগর?

কাঠ কাঠ বিনয়ের , কাঠ ঠোকরানো আওয়াজ শুনতে পেলাম,

-আজ্ঞা হ্যাঁ। কী চাই? কাকে চাই? মশায় কে? কোথায় যাওয়া হবে? কার বাড়ি?

একের পর এক বিশাল বিশাল প্রশ্নবোধক ধাক্কা। ভদ্রতার গদগদ কণ্ঠস্বরও যে বাঁজখাই হতে পারে এই প্রথম শুনলুম। আওয়াজখানা অভদ্র হলে পেটের পিলে চমকে যাবে এ বিষয়ে কোনো আদিখ্যেতা নেই। ডাকাতের আওয়াজে পোয়াতির বাচ্চা খসে যায় শুনেছি, মনে হচ্ছে, আসল আওয়াজ শুনলুম। এই সেই ডাকাত। আমি তাদের মুখোমুখি। পেটের পিলে ছোটো হতে আরম্ভ করেছে। আওয়াজ শুনে থমকে গেলেতো চলবে না। খোদ সরকারি ব্যাঙ্কওয়ালা! জিজ্ঞেস করলুম –ঘোষ রঘুপতি, সীতাপতিকে চেনো? পিতা, অধিপতি।

ওরা কোনো উত্তর দিলো না। পরষ্পর মুখ চাওয়াচায়ি করে, গার্ডসাহেব এগিয়ে এলো। আমাকে একবার আপাদ মস্তক মেপে নিয়ে আওয়াজ ছাড়লে –কেনো? কোত্থেকে আসা হচ্ছে?

-ব্যাঙ্ক থেকে আসছি। লোনের টাকা আদায় নিতে।

মোষেরগাড়ি এতক্ষণ ধিকিয়ে ধিকিয়ে চলছিলো। দাঁড়িয়ে গেলো। গাড়োয়ানও ততক্ষণে আমার মুখের সামনে সটান দাঁড়িয়ে গেছে। এতো কাছে যে, গা দিয়ে মাটি আর দুধেল গন্ধ পেলাম। পাক্কা ঘোষের বাচ্চা। দুধ জ্বালিয়ে, বেশি পাকের ঘৃতকুমার বডি। মাখনের গ্লেজ মেখে হয়তো পোড়া দুধে চান করা অভ্যেস। ভাঁটার মতো লাল গনগনে দুজোড়া চোখ আমার আপাদ মস্তক ওঠা নামা করছে। মেপেই চলেছে। নাকি মাপার নাম করে বুকের ধড়ফড়ানিতে চাপ দিচ্ছে? হাতে পাচন, নাচছে। মুখ সোজা মুখ। চোখেচোখ। কি জানি বাবা! দেবে নাকি কষিয়ে?

-মশায়ের আসা হচ্ছে কোন পথে?

উহু, এতো বাবা বরানগরের প্যাকাটি মাস্তান নয়! আমি খানিক কাঁচুমাঁচু হয়ে গেছি। কালা পানি মাঠ পেরিয়ে শেষে ডাকাতের মুখোমুখি! নরম করে চোখ নাড়িয়ে এক চিলতে সরু রোগা পথ দেখিয়ে দিলুম।

-কে পথ দেখিয়েছে?

কোনো উত্তর দিলুম না।

-মশায়ের ও পথেই ফিরে যাওয়া হোক। ওই পাকুড়গাছের ওপারেই ঘোষদিগর। তবে ও গাঁয়ে প্রাণ হাতে ঢোকা যায়, বেরুনো যায় না।

গার্ডসাহেব তখন গাড়োয়ানসাহেবের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। একই বাঁজখাঁই গলা, তবে একটু ব্যাঁকা একটু চাপা। বললে – মশায়কে যে পথ দেখিয়েছে, কানে কি এ কথা ঢুকিয়ে দেয়নি? বলি, প্রাণপাখি ক’টি?

বাপরে বাপ! চাপা আওয়াজে আমার আপাদ মস্তক কেঁপে উঠলো। অসময়ে পেচ্ছাবের বেগ পেয়ে গেলো।

কুঁউ কুঁই স্বরে উত্তর দিলাম –একটি।

-হাত ক’টা?

-আজ্ঞে, দু’টো।

-পা ক’টা?

-আজ্ঞে দুটো।

-হাতদুটো দিয়ে প্রাণপাখি চেপে, যে পথে, আসা হয়েছে, ও পথেই দুপায়ে ফিরে যাওয়া হোক। পিছন ফিরে তাকানো নিষেধ। ফিরে যাওয়ার কথা কিন্তু আমরা দু’বার বলি না।

গাড়োয়ান সাহেব বললেন – দু’বার বলার আগে তাকে আমরা মোষেরগাড়ির চাকায় বেঁধে নিই, সামনে পদ্মপুকুর। পাঁকের নিচে স্রেফ… ।

ভাববাচ্য এবং ইঙ্গিতের কথায় যে এতো ভয় মিশে থাকে হৃৎপিন্ডের উথালি পাথালি দিয়ে শিখলাম।



গলা শুকিয়ে গেছে। অন্তরাত্মায় জপ করে যাচ্ছি – হ্যাঁ স্যার, ইয়েস স্যার, যে আজ্ঞে স্যার…

গাড়োয়ান বললে- আমার নাম রঘুপতি।

গার্ড বললে –আমার নাম সীতাপতি।

গাড়োয়ান বললে –আমাদের নাম শোনোনি?

পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত থরথর করে কাঁপছে। ঈশ্বর করুন, যেনো প্যান্ট ভিজে না যায়! বুকের সমস্ত শক্তি জড়ো করে জিজ্ঞেস করলুম

– জমিদারবাড়ি কোনদিকে?

দু’জনে জোড়াগলায় ঝাঁপিয়ে পড়লো –কেনো?

-না, মানে, ইয়ে, মানে, জমিদারবাড়িতে নেমত্তন্ন আছে।

-এ্যাঁ!

-হ্যাঁ। মেজোবাবুর ছোটোছেলে আমার বন্ধু। আপনারা যদি অনুমতি দেন, তাহলে কোন পথে যাবো?

গার্ডসাহেব গাড়োয়ানসাহেব দু’জনেই তখন ইনস্পেকটর, তীব্র মুখ চাওয়াচায়ি করছে, জোড়া জোড়া চোখ আমার আপাদ মস্তক ঘন ঘন মাপ নিচ্ছে। নিজেকে এমন অসহায় কখনও মনে হয়নি। ভূমিকম্প ছেলেমানুষ। মানবাতঙ্ক ধরে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে ভেঙেচুরে চুরচুর হয়ে ভূমি শয্যা নেবো। ভূত হতে বেশি দেরি নেই ।

-আপনার বন্ধুর নাম কি?

-আজ্ঞে, কাতু। ডাকি কাতু, না না কাতুবাবু। ভালো নাম, কান্তকানন বন্দ্যোপাধ্যায়।

-আবার বলুন।

-কান্তকানন বন্দ্যোপাধ্যায়।

-ছোটোসোনা যে আপনার বন্ধু, কোনো নিশান আছে?

ছোটোসোনা যে কাতুবাবু, ঘুঁটে হয়ে আসা বুদ্ধি দিয়েও বুঝে ফেললুম। নিশান বুঝতেই হাড় হিম হয়ে এলো। ওপাশেও বাঁজখাই গলা কেমন নরম মনে হচ্ছে ।

-নিশান, ইয়ে সবুদ, আছে কিছু?

ভাগ্যিস সবুদ মানেটা ধরতে পেরেছি। ধড়ে প্রাণ এলো। মানিব্যাগ খুলে এদিক ওদিক পাঁতিপাঁতি করতেই পেয়ে গেলুম, দুমড়ানো ছবি, মোচড়ানো আই কার্ড। অঞ্জলি দেওয়ার মতো তুলে দিলুম গাড়োয়ানের হাতে। উল্টে পাল্টে দেখে গাড়োয়ান, গার্ড দু’জনেই খুব খুশি। দুই ভায়ের চোখে মুখে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। গাড়োয়ান, গার্ড দুই ভাই সোজা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে গেলো আমার সামনে। গদগদ গলায় বললে –বাবুর বাড়ি যাওয়ার আগে অধমের বাড়ি যদি একবার পায়ের ধুলো দেন!

শরীর বেয়ে ঘাম ছেড়ে যাচ্ছে। ধাতস্থ হচ্ছি। মুখে কিছুই বললাম না। মনে মনে বললুম –এস্‌সো হাজারি পান্তা খেয়ে। যে রোগের যে ওষুধ। জোঁকের মুখে নুন পড়েছে। তোমার বাড়ি যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েই আছি, বাছাধন।

হাত গলিয়ে লোনের মালকড়ি যদি কিছু নাও গলে, এক গেলাশ জল, এক মুঠো শুকনো চাল পেলেই আপাতত ধড়ে প্রাণ ফিরে আসবে।

নারায়ণ থুড়ি ছোটোসোনার নাম করে না হয় ভিক্ষে চেয়ে নেবো। এ যাত্রায় মনে হচ্ছে প্রাণে বেঁচে গেলুম। এখন আমার জপমালা এক এবং একমাত্র কাতুবাবু, উঠিতে কাতু, বসিতে কাতু, কাতুহি গলার হার.. ..। বেশ্যাদের হাতে ঠ্যাঙানি খাওয়া, পাজামা, আন্ডারওয়ার বন্ধক রাখা কান্তকানন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে যে এতো মহিমা, তা কে জানতো! কোথায় লাগে শালগ্রাম শিলা, লক্ষীপতিনারায়ণ! জীবনে মজা এলে, ক্ষিদেও তক্কে তক্কে থাকে, চনমন করে লাফিয়ে ওঠে। খিদেয় পেটের নাড়ি কুঁকড়ে নেড়িকুত্তার মতো কঁকিয়ে উঠলো।

বেঁচে যদি এলাকায় ফিরতে পারি বাছাধন, সীতাপতি হও আর রঘুপতি, তোমাদের দেখে নেবো। যে কষ্ট আর যে ভয় পেয়েছি তার উসুল কড়ায় গন্ডায় তুলে নেবো। জেলের ঘানি যদি না টানিয়েছি, পুলিশের দড়ি যদি কোমরে না পরাইতো আমি বরানগরের বাচ্চাই না!

ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখোনি!

চুপচাপ ওদের গাড়ির পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলুম।



অদ্ভুত ওদের গ্রাম। কমপক্ষে দেড়তলা উঁচু ঘন জঙ্গলে, মাটির পাহাড়ে। আম, জাম, নিম,হেতের গাছের কষাড় আঁধারে বাস। ঘর, বাসিন্দা খুঁজে পাওয়া, দুস্কর। কাঠ চ্যালা করার শব্দ, জঙ্গল ফুঁড়ে ধোঁয়া ওঠার দৃশ্য, এইসব খুঁজে বুঝে নিতে হচ্ছে কোথায় মানুষের সাড়া, কোথায় বাস করার কুঁড়ে। এককথায় জঙ্গল দূর্গ। যে কোনো গাছের মাথায় চড়লে দূরদিগন্ত পর্যন্ত দেখা যায়। ডাকাতের গ্রাম। শত্রুপক্ষের আক্রমন আসছে, টের পেলেই জঙ্গলের ভিতর গায়েব হওয়ার ব্যবস্থা।

পাহাড়ের নীচে, সীতাপতি মোষদুটোকে জোয়াল থেকে ছাড়িয়ে দিলো। মোষের বদলে দুই মহিসাসুর অবলীলায় ধান বোঝাই গাড়িখানা এক দমে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছিলো দেড়তলা সমান উঁচু বাড়ির উঠোনে। নিজেকে নিয়ে হেঁটে উঠতে আমার হাঁটু কটকট করে উঠলো। একবার গাছের গুঁড়িতে বসে, দু’বার হাঁফ জিরিয়ে কোমরের ব্যায়াম করে এদিক ওদিক ফালুক ফুলুক করে দেখে ডাকাতদের গোপন রহস্য আবিষ্কার করতে করতে শেষ পর্যন্ত ঠেলে উঠছিলুম।



গাড়ি থামিয়ে, সীতাপতি বললে –ঠাকুরমশায়, আপনার কষ্ট হচ্ছে গাড়িতে উঠে বসুন। গলা শুকিয়ে কাঠ। তখন না বলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। কোনো কথা শোনার ইচ্ছেও ওদের নেই। হাঁ করার আগেই, পুতুল তোলা করে এক বগলে হাত ঢুকিয়ে, আর এক হাত পেছনে রেখে এক ঠেলায় ছুঁড়ে দিলো ধানের গাড়ির ছাদে। গড়িয়ে দুমপটাশ হওয়ার আগে হাঁচড়ে পাঁচড়ে ধান আঁটি বাঁধার দড়ি আঁকড়ে সে যাত্রা রেহাই নিলুম।

উঠোনে পৌঁছে ধান বোঝায় গাড়ি থেকে নামতে ভাগ্যিস মই লাগিয়ে দিলো। নইলে এবার দুমপটাশ ঠিক হয়েই যেতুম। মুহূর্তে সীতাপতি, রঘুপতি হাওয়া। ভেলকি নাকি! বিঘে দেড় দুই ফাঁকা ধু ধু উঠোন। কেউ কোত্থাও নেই। কোথায় এলুমরে বাবা! গায়েব হয়ে যাবো নাতো? পেছনে জঙ্গলি জটিল পথ, যদি পালাতে হয় কিছুই চিনতে পারবো না। কোমর মটমটিয়ে সোজা হয়ে বুঝলুম এটা উঠোন নয়, একে বলে আঙিনা। ঝকঝকে তকতকে গোবর নিকানো। খোলা আকাশ বেয়ে রোদ্দুর নেমেছে। কুটোটুকুও পড়ে নেই। উঠোনের সীমানা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চার পাঁচখানা ছোটোছোটো খড়ের দোচালা, মাটির কুঁড়ে। হাতনের চাল অনেকটা ঝুঁকে নেমে এসেছে উঠোনের মুখে, মাথা অনেকখানি নিচু করে ঘরে ঢুকতে হয়। নিচু হয়ে আসা চালার আব্রুতে ঘরের ভিতর কিছু দেখা যায় না। পরিচ্ছন্ন আঙিনা খুব পবিত্র মনে হলো। পা দিলে যেনো কিছু অন্যায় করে ফেলবো ভেবে, সীমানায় দাঁড়িয়ে রইলুম। কিছুক্ষণের মধ্যে গুচ্ছের ন্যাংটো, উদোম, পেটমোটা, গলা সরু, কালো কালো কাচ্চা বাচ্চার পঙ্গপাল হাজির হয়ে গেলো উঠোনে। সাত হাত দূরে গায়ে গা ঘেঁষে এক জটলায় জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আজব প্রাণী, যেনো রূপ উঠেছে! কিংবা ঠাকুর দেবতা নেমে এসেছে আকাশ ফুঁড়ে। মুখ হাঁ করে, গোল্লা গোল্লা চোখে দেখছে।



একটুবাদেই জল ভরা কাঁসার কলসি কাঁখে বঙ্গের মধু ঘোমটাটানা বধু, এগিয়ে এলো। পাশে গাড়োয়ান রঘুপতি। বিগলিত করুণায়

বললে – ঠাকুর, ওইখানে দাঁড়ান।

উঠোনের একপ্রান্তে পড়ে আছে পাথরের তৈরি যাঁতার একপাটি। যথা আজ্ঞা। যাঁতার উপরে উঠে দাঁড়ালুম। বঙ্গের বধু জল ভর্তি কলসি থেকে জাহ্ণবি যমুনা ঢেলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। হাঁ হাঁ করে উঠলুম।

-করেন কি, করেন কি! এসব আমার লাগবে না। আমি নিজেই পারবো।

বিগলিত করুণা রঘুপতি বললে –আমাদের রীতি বাবু, নইলে পাপ লাগবে। অতিথি নারায়ণ।

বঙ্গের বধু জল ভরা কলসি নিয়ে হুমড়ি খেয়ে আমার পায়ে পড়ার উপক্রম। পড়বেই পড়বে। নিজে হাতে পা ধুইয়ে দেবে। ভ্যালারে বাপু। ভয়ের বিপদ পার হয়ে শেষে ভরসার বিপদে পড়ে গেলুম! লালরঙের শাড়ি মোড়ানো মহিলাকে না ছুঁয়ে, আড়ষ্ট আমি হাত পা ছুঁড়ে, বিদ্রোহ ঘোষণা করে কিছুতেই ঠেকাতে পারছি না। রঘুপতি হাতজোড় করে বললে,

–বাবু, থির হয়ে দাঁড়ান, পা ধুইয়ে, চুল দিয়ে মুছিয়ে দেবে।

ঘাবড়ে গিয়ে তড়িঘড়ি বলে উঠি –অহং অন ডিউটিং হ্যায়। কামিং ফ্রম অফিস। নট ইন এ অফিস ডেকোরম। এসব করবেন না মাইরি, থুড়ি দিদি। সেম সেম। খুব লজ্জা পাবো। আমাদের রীতিতে নেই। করলে আমাদের অমঙ্গল হয়।

সাপ ব্যাঙ কী বুঝলো জানিনে। বৌটি গলায় রাখা পাটভাঙা গামছা আমার হাতে ঝুলিয়ে নিরস্ত হলো। বৌয়ের ইঙ্গিতে রঘুপতি ঘড়া থেকে জল ঢেলে দিলো পায়ে। নিজে হাতে পা হাত মুখ ধুয়ে গামছায় মুছে ঘরে উঠে এলুম। খেজুরপাতার চাটাইয়ের মাঝখানে একখানা ভেড়ার লোমের আসন পাতা। আসন গেঁড়ে বাবু হয়ে বসলুম। মনের অজান্তে বলে ফেললুম -আঃ, শান্তি!

ঘরখানা ঘর নয়, খুপরি। এই উচপিচে গরমেও নিবিড় শীতল। মাটির মেঝে । ঝকঝকে নিকানো। সামনে মাচা। বাঁশের খুঁটি ঘরের মেঝেয় পুঁতে দাঁড় করানো। আট দশজন শুতে পারে এমন খাটের মাপে তৈরি। মাচার নীচে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, খেজুরগুড়ের ভাঁড়ে ঠাসা। মাচার উপরে সারি সারি জঙ্গলের কলা। পাকা, আধপাকা, কাঁদি কাঁদি। জঙ্গলে কলাবাগানের ঝাড়। আসার সময় দেখেছি । কাঁদির পায়ের কাছে গোল পাকানো ছেঁড়া বিছানা। বিছানার উপরের দেওয়ালে ঝুলে আছে, গোটাতিনেক বল্লম, তেল চকচকে বাঁশের লাঠি, দু’জোড়া রন পা, একখানা খাপেঢাকা তরোবারি। আরো দু’চারখান চাকু, ছুরি, রাম দা। ডানদিকের দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে সিঁদুর জবাফুলের ভীড়ে চাপা পড়ে যাওয়া গৃহদেবতা। সম্ভবত ডাকাতে কালি। ঠিক আমার মাথার উপরে একখানা সিঁদুর মাখা পেল্লায় খাঁড়া। কালি মূর্তির হাতে ফিনফিনে টিনের খেলনা খাঁড়া নয়। ধারে ভারে আকারে ভয়ংকর। ঘরের আবছা আঁধারেও চকচক করছে। খাঁড়ার কপালে আঁকা মা কালির লাল টকটকে চোখ। রেগে গেলে উপমা টানি রক্ত চক্ষু। এই হলো সেই রক্ত চক্ষু! বুকের ভিতরটা পেটের মতো আবার খালি খালি লাগছে। বুঝলুম, তড়পানো খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ভয়কে কিছু শেখাতে হয় না। নিজে নিজে ঠিক সময়ে হাজির হয়ে যায়। ভয়ের লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলুম। খাঁড়ার উপর একখানা বাঁধানো ছবি ঝুলছে। প্রাচীনত্বে ছবিখানা আর ছবি নেই। সাদা কালো ফ্যাকাসে মেরে কাঁচের নীচে হলদে একখানা কাগজ হয়ে আছে। আমার সামনে নতজানু প্রায় নীলডাউনের ভঙ্গিতে বসে আছে রঘুপতি। বললে – ওই হচ্ছে ছোটসোনার ছবি, কোলেপিঠে মানুষ করেছি কিনা! বড্ড নেওটা ছিলো। দেখলেও শান্তি।

বাবু, তোর ওই ছবিখানা দিয়ে যাবি? বড়ো সুন্দর দেখাচ্ছে। কত্তবড়ো হয়ে গেছেন তিনি। বেঁচে আছি ছবিখানার দয়ায়।

ঘাড় কাঁধের উপর ঝুলিয়ে জানিয়ে দিলুম, যাবো। প্রাণের বদলে এই মুহূর্তে তোমাদের অদেয় আমার কিছু নেই। মনে মনে গলে পড়লুম কাতুবাবুর দয়ালু মূর্তি স্মরণ করে। তিনি এখন আমার রক্ষাকর্তাও।





রঘুপতি টুকটুক করে অনেক গল্প বলছিলো। কিছু শুনছিলাম, কিছু কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। রঘুপতিরা জমিদারের লেঠেল। জমিদারি খাস হওয়ার আগে মেজোবাবু যতখানি সম্ভব এক্তিয়ার তাদের দিয়ে গেছেন। অন্দর মহলেও দুই ভাইয়ের অনায়াস যাতায়াত ছিলো। মেজগিন্নি ছোটসোনার মা। ছোটসোনার সাথে সাথে এরা দুই ভাইও মেজোগিন্নিকে মা বলে ডাকতো। তিনি রঘুপতি সীতাপতিকে খুব ভালবাসতেন। সেই সব গল্প করেই যাচ্ছিলো। বুঝলুম, এই গল্পেরই একটা ফ্যাকরা হচ্ছে, তাদের নামে জমি দান।



দরোজার বাইরে ক্যাঁচোড় ম্যাচোড় শুনে তাকালুম। দরোজায় আড়াল রেখে, কে আমাকে দেখার সবচেয়ে ভালো সুযোগ পাবে তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি শুরু করে দিয়েছে কাচ্চাবাচ্চাদের পঙ্গপাল। ঘোমটাটানা লালশাড়ি একে একে অতিথি সৎকারের আয়োজন শুরু করেছেন। প্রথমে আমার সামনে পাতা হয়েছে বিশাল একখানা বগি পাথরের থালা। জলে ধোয়া। শুন্য। কালো পাথরের জলে চমৎকার আয়না তৈরি হয়েছে। নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছি। থালার পাড়ে এক ধামা চিঁড়ে এসে প্রথম হাজির হলো। চিঁড়ের পাশে এককাঁদি কলা। পাকা হলুদ, মর্তমান (এরা অনুপম বলে)। তারপাশে এক কলসি আখের গুড়, এক পিতলের গামলা ভর্তি দুধ, কাঁসার এক ঘটি ভঁয়সা ঘি। পাথরের জামবাটি মুখোমুখি ভরা, ঘরে পাতা দৈ। এক পিতলের বালতি টলটলে পানীয় জল।

পাশে এসে বসেছে জ্যান্ত একখানা গরদের শাড়ির স্তুপ। হাতে একখানা ভিজে তালপাতার পাখা। শাড়ি ছেঁড়া পাড় দিয়ে পাখার পাড় বাঁধানো। আমার শরীর লক্ষ্য করে দুলেই চলেছে। রঘুপতি বললে

-আমার মা।

মনে হলো জগজ্জননী, ভরসার শ্রেষ্ঠ চরন। সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে দিলুম প্রণাম ঠুকে। ঘোমটার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো মুখ। নিকষ কালো যেনো কষ্টি পাথরে তৈরি। গরদের ভিতর সাক্ষাৎ মা কালির দর্শণ পেলুম। মায়ের বয়স হয়েছে। কাঁচাপাকা ঢেউ খেলানো চুল। টানটান চামড়ার তেল চুকচুকে বিশাল মুখখানা। কাঁসরের খ্যানখেনে নাদ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন –খাও, বাবা।

এই আওয়াজে ভয় পাওয়া যেতে পারে। আমি পেলুম বিচিত্র আদেশ। আদেশের কোথাও, যেনো পাহাড়ের গভীর ফাটলের নীচে স্নেহ মাখা জলস্রোত বইছে।

বললুম -মা, আপনার প্রসাদ। নিশ্চয় পেট ভরে খাবো। কিন্তু এতো খেতে পারবো না।

মা কালির সন্তান, বড়ো মহিসাসুর বললে –প্রসাদ কনিকা মাত্র দিয়েছি, ঠাকুর।

আমি কি ঠাকুর, নাকি গুরুদেব!

খ্যানখেনে জোয়ারি গলায় মা বললেন –খাও বাবা। বেলা গড়িয়ে এলো।

চড়াক করে মাথায় চিড়িক খেলে গেলো। বেলা শেষের অনেক আগেই এই ডাকাতে গ্রামের পথটুকু পার হয়ে যায় শেষ বাস। ফেরার দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। আমাকে উঠতেই হবে।

ধড়ফড় করে দাঁড়িয়ে গেলুম।

-না হয় অন্যদিন এসে সেবা করে যাবো। এরপরে আর ফিরতে পারবো না মা, আমাকে ক্ষমা করুন।

ধীর জলদ গম্ভীর স্বরে মা আদেশ দিলেন – সারাদিন খাওনি। খেয়ে নাও। গেরস্থের অকল্যাণ কোরো না। তুমি পোঁছে যাবে।

কী করি! তখনও দাঁড়িয়ে আছি। পাখা বসে বসে শুন্য আসনে পাহাড়িলয়ে দুলেই যাচ্ছে।

-ওরে বাবারে, এতো ডাকাতে মা! জল, ফলার, হাওয়া খেতেই হবে?

কালি নয়, সাক্ষাৎ চামুণ্ডা। ওই গম্ভীর অমোঘ আওয়াজে এবং ঝোলানো খাঁড়ার দিকে তাকিয়ে বসে পড়লুম। ঘরে বুঝি ফেরা আর হলো না। বহু ডাকাতের গল্প শুনেছি। সেখানে রাত কাটালে, হাঃ, যমদূত তুমি ক’দ্দুর! কাল সূর্য ওঠা আমার জ্ঞানচক্ষে নাই। এ রাতেই আমি নিকেশ। এরপর বরানগরের দাশগুপ্তসাহেবকে খুঁজতে হবে পদ্মপুকুরের পাঁকে। এই খাবারের আয়োজন সব ইট কাঠ পাথর মনে হচ্ছে। হে ধরণী দ্বিধা হও। হাত চলছে না। বুক কাঁপছে। হাত থেকে গ্রাস খসে খসে পড়ছে।

যা হয় আমার হোক! আপনাদের অকল্যাণ করবো না। চড়ুইপাখির মতো নাকি খাচ্ছিলুম। গরদের আড়ালে একজোড়া চোখের হুঙ্কারেই হাত মেসিনের মতো চলতে শুরু করলো। দুধের সঙ্গে চিঁড়ে, চিঁড়ের সঙ্গে দৈ, দৈএর সঙ্গে ঘি, কলা গুড় কিছু বাদ দিয়ে খাওয়ার উপায় ছিলো না। মা চামুণ্ডা আর খাঁড়া পাহারায় আছে। গঁদাগঁদ করে গিলছি আর ভাবছি ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। হে চামুণ্ডা, শেষ বাসটা যেনো পাই। খাওয়া নাতো পিন্ডি গেলা। সেটাও হলো না। চোখের ধমকানিতে ধীরেসুস্থে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হলো। যে করেই হোক পালাতেই হবে। আর এক মুহূর্ত নয়।



গোদের উপর বিষ ফোঁড়া। দাঁড়াতে গিয়ে টলে পড়লুম। অনভ্যাসে এতখানি হাঁটা। শরীর ব্যথায় টনটন করছে। পায়ের শিরায় টান ধরে গেছে, দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। অকর্মণ্য ভারী শরীর, এলিয়ে পড়বিতো পর মা চামুণ্ডার ঘাড়ে। মায়ের ডানহাতে পাখা। বামহাতে বিদ্যুৎ গতি। ধরে ফেললেন আমাকে। বৃদ্ধা মায়ের এক হাতের বাহুতে কী অপরিমেয় শক্তি মুহূর্তে বুঝে নিলুম। এক হাতের আশ্রয়ে ছেড়ে দিলুম নিজেকে। এঁটো হাত। অসহায়, অক্ষম শরীর বিছিয়ে দিলুম মায়ের কোলে। মা আমার পূর্বজন্মের নিশ্চয় স্নেহময়ী জননী একহাত মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছেন। অন্যহাতে পাখা টানছেন। চরম ভয়ে পরম শান্তি!





শুধু বলতে পারলুম -আমাকে ফিরতেই হবে।

ধাতস্থ হতেই মা ঠেলে তুলে দিলেন আমাকে। আচরণে বুঝিয়ে দিলেন আমাকে ফিরতে হবে। শোয়া চলবে না। নিজের মা মারা গেছে বহুকাল। রোগগ্রস্থ, হাড় জিরজিরে, বাতিক টিপটিপে, পান্তাভাত খাওয়া মা আমার। বরানগরের বিছানায় শুয়ে নাকি সুরে কথা বলতেন। কোথাও যেতে দিতেন না। অহরহ তার ভয়। এই বুঝি ছেলে হারিয়ে গেলো! ক্ষণে ক্ষণে ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকতেন

-খোকা,ও খোকা, গেলি কোথায়…

নোংরা এক চিলতে বিছানায় অদৃশ্য হতে হতে কবে যেনো মা টুপ করে হারিয়েই গেছেন, আশ্চর্য ভাবে মনে পড়ে গেলো।

খোঁড়া, বেঁকে যাওয়া আমি এক ঠেলাতেই সোজ়া দাঁড়িয়ে গেলুম। মনের জোরে দাঁড়িয়ে গেছি। জোর যেনো মা চামুণ্ডার শরীর থেকে আমার শরীরে ভর করেছে। ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারছি, ছুটতে হবে। কিন্তু ছুটে গেলেও বাস পাওয়া আর সম্ভব নয়। মা বোধ হয় বাসের সময় জানেন না। শরীরের যা অবস্থা, ছুটে যাওয়ার ক্ষমতাতো নেইই। হেঁটে যাওয়াও অসম্ভব, একমাত্র গড়িয়ে গড়িয়ে বাস স্টপে পৌঁছতে পারি। মা চামুণ্ডা আর একবার আমাকে ঝাঁকুনি দাও। দুর্বল চিন্তা মাথা থেকে খসে পড়ুক। আমি এখনই ফিরে যেতে চাই।



কিছু বোঝার আগে, হঠাৎ পিছন থেকে আমার চোখ বেঁধে দেওয়া হল। চ্যাংদোলা করে আমাকে তুলে দেওয়া হল একজনের কাঁধে।

গলা শুনে বুঝলুম, রঘুপতি; বললে –ঠাকুর, কোনো ভয় নেই। মাথা জাপটে ধরে রাখো। পথে কোনো প্রশ্ন করবে না।

দ্বিতীয় পর্বে রঘুপতি উঁচু, এতো উঁচু হয়ে গেলো, মনে হলো, ঘরের চাল ছাড়িয়ে গেছে। বুঝলুম, রঘুপতি রন পায়ে চড়লো। জাপটে ধরে আছি রঘুপতির মাথা। আর মনে মনে গাইছি,

–রঘুপতি রাঘব রাজারাম, বাঁচালে বাঁচাবে তুমি, মারলে মেরো বাবা, তাতেও আরাম।

রঘুপতি সিঁড়ি দিয়ে নামছে। কোথায় ছিলো সিঁড়ি! আসার সময়তো চোখে পড়েনি। স্যাঁতসেঁতে সোঁদা মাটির গন্ধ পাচ্ছি। সিঁড়ি দিয়ে নেমেই চলেছে। নিশ্চয় গোপন পথ। সিঁড়ি বেয়ে রন পায়ে নামা ভয়ংকর কঠিন। ভয়ে কুঁকড়ে এতোটুকু হয়ে আছি। পড়ে গেলে কোথায় হারিয়ে যাবো, হদিশ হবে না। এ ঠিক, পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নামার গোপন সুড়ঙ্গ!

হঠাৎ দৌড় শুরু হলো। বাতাস গায়ে বিঁধছে। বুঝলুম, মাঠে পড়েছি। সাঁ সাঁ রবে ছুট। একেই বলে বাতাসের বেগে যাওয়া। রঘুপতির কোঁকড়া শক্ত চুল ভর্তি মাথা প্রাণপনে জাপ্টে আছি।

-রঘুপতি রাঘব রাজারাম বাঁচালে বাঁচাবে তুমি.. ..



চোখ খুলে দিতে দুনিয়া আঁধারে আঁধার। অন্ধকারে চোখ সয়ে এলে দেখলুম, বেলা তখনো আছে। তবে যায় যায়। পাক্কা দু’ঘন্টার পথ পৌনেঘন্টায় পৌঁছে গেছি। সামনে বাস আর সীতাপতি দাঁড়িয়ে। তারমানে বাস থামাতে সীতাপতি আগেই এসেছে। দুই ভাই মাল কোঁচা মারা। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, দু’ দুটো কালো পাহাড়। রন পা কোথাও দেখলাম না। আধঘন্টা পার হয়ে গেছে, সীতাপতি বাস দাঁড় করিয়েছে। বাসে একজন প্যাসেঞ্জারও নেই। ফাঁকা ধু ধু। সীতাপতি ড্রাইভারকে ডেকে বুঝিয়ে দিলে, আমাকে ঠিকঠাক যেনো গঙ্গার ঘাটে নামিয়ে দেওয়া হয়। ঘাট পাড়ের নৌকায় তুলে দিয়ে তবে যেনো বাস ছাড়ে।

সীতাপতি বললে –ঠাকুর, তোমার গায়ে যমেও হাত দেবে না। নিশ্চিন্তে চলে যাও।

রঘুপতি বললে – লোনের টাকা, পনেরোদিনের মধ্যে ব্যাঙ্কে পৌঁছে যাবে। অন্যথা হবে না। মায়ের আদেশ।

সীতাপতি বললে – ঠাকুর, সোজা বাড়ি যেও, ঘর চিন্তায় আছে।

রঘুপতি সীতাপতি অকস্মাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলো। প্যাসেঞ্জাররা একে একে ফিরে এলো বাসে। ডাকাত পড়েছে জেনে, আশে পাশের জঙ্গলে কোথাও লুকিয়ে ছিলো। আলো জ্বলে উঠলো বাসের ভিতর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ