মেলা প্রাঙ্গণের উত্তর পশ্চিম কোণায় অপরিসর ক্যান্টিনে প্রতিদিনই দুপুরের পর থেকে ভিড় বাড়তে থাকে। তবে সেদিন বিকেলে ভিড়টা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই ছিল। ভেতরে পনের কুড়িজনের বসার মতো চেয়ার টেবিল থাকলেও দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা চল্লিশের কম নয়। কাউন্টার থেকে খাবারের কুপন সংগ্রহের জন্যে চলছিল রীতিমতো যুদ্ধ। পর্যটন করপোরেশন পরিচালিত বইমেলা ক্যান্টিনের এইসব অব্যবস্থা সত্ত্বেও অল্প সময়ের মধ্যেই ফখরুদ্দিন দুটি কফি কুপন জোগাড় করে ফেলে।
‘এতো ঝামেলা করি ফির কফি না খাইলেও হইল হয়!’ আবদুল গফ্ফার স্পষ্টতই বিব্রত হয়। অনেকদিন পরে বইমেলায় দেখা হবার পর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই বন্ধু কিছুক্ষণ তথ্যকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা মেরে কাটাবার পরে গফ্ফারই প্রস্তাব করে, ‘কোনঠায় বসি চা খাইলে হয়।’
‘চা কেন-- চল কফি খাওয়া যাক।’
‘সেই ভাল হামার নিলফামারির চায়ের দোকানত ওমরা কফি বানবারই পারে না।’ এরপর দুজনে ক্যান্টিনে ঢুকে পড়ে আর বিড়ম্বনার শুরু সেখানেই। কুপন নিয়ে ফখরুদ্দিন যখন কফি ভেন্ডিং মেশিনের কাছে পৌঁছাল ঠিক তখনই শেষ হয়ে গেল কফির গরম পানি। ডিসপোসেবল কফি কাপ হাতে নিয়ে মেশিনের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটা বোকা বোকা একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘পানি ফুরাইয়া গেছে স্যার। গরম পানি আসতে দশ মিনিট দেরি হইব।’
‘কুপন দুটো কি করবো?’ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো ফখরুদ্দিন।
‘কাছে রাইখা দ্যান-- পরে যখন আসবেন কফি রেডি পাইবেন।’
অগত্যা দুজনেই ভিড় ভারাক্রান্ত ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে আর সেই সময়েই বেজে ওঠে গফ্ফারের হাতের মোবাইল ফোন। মেলার মূল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কারো সাথে ফোনে একটু কথা বলেই গফ্ফার বললো, ‘হামার কলেজের লাইব্রেরিয়ান-- মুই এ্যালা গেট থাকি ঘুরি আসো।’
‘ওনাকে আসতে বলে দে না এখানে।’
‘থাক-- ওমাক বিদায় করি আসো। দশ মিনিট পরে তুই এটেই আসি খাড়াস।’
জলঢাকার একটি কলেজে বাংলা পড়ায় আবদুল গফ্ফার। কলেজ লাইব্রেরির বই কেনার জন্যে প্রতি বছরই বইমেলার সময় সে লাইব্রেরিয়ানসহ ঢাকায় আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাঝে গত বছর ওদের দেখা না হওয়ায় ফখরুদ্দিন ভেবেছিল এবারে চুটিয়ে আড্ডা দেবে। কিন্তু দশ মিনিট পরে গফ্ফারের পরিবর্তে মোবাইল ফোনে তার কণ্ঠ শোনা গেল।
‘ফখরুল-- লাইবিরিয়ানের সাথত মোক জিগাতলা যাবার নাগিবে। জরুরি ব্যাপার হঠাৎ আসি খাড়া হইছে।’
‘তুই অন্তত কফিটা খেয়ে যা।’
‘আরে কফি আরেক দিন হইবে। এ্যালা মুই যাঁও।’
এরপরই লাইনটা কেটে যায় অথবা লাইন কেটে দিয়ে আবদুল গফ্ফার তার গ্রন্থাগারিকসহ জিগাতলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
কিছুক্ষণ অকারণে ঘোরাঘুরি করে ফখরুদ্দিন। এবারের বইমেলায় একটি অখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিল সে। অনিয়মিতভাবে হলেও গত চব্বিশ বছর ধরে লিখে চলেছে। এবারের বইটিসহ অনিকেত ফখরুদ্দিন নামে তার তিনটি কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও কখনোই সে কবি হিসাবে পরিচিত হতে চায় না। তারপরেও বন্ধুবান্ধব এবং রাজধানীর যে কলেজে সে পড়ায় সেখানে ছাত্রছাত্রীরা জানে বাংলার সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ ফখরুদ্দিনই কবি অনিকেত ফখরুদ্দিন। ক্লাসে তার পড়াবার স্টাইলটিও সবার বেশ পছন্দ। বিশেষকরে ছাত্রীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়।
ফখরুদ্দিন পায়ে পায়ে তার নিজের প্রকাশনা সংস্থার দিকে এগিয়ে যায়। মেলায় সারা মাসে বিশ পঁচিশটা বই বিক্রি হবে কিনা সন্দেহ। তারপরেও মাঝে মধ্যে স্টলে বসলে প্রকাশক খুশি হয়। পুকুরের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে বাংলা একাডেমির নতুন ভবনের কাছে ছোট্ট স্টলটিতে পৌঁছাবার আগেই তার শায়লা নওশিনের সাথে দেখা হয়ে যায়। শায়লা এ বছর বাংলায় মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে, সেই সূত্রে ফখরুদ্দিনের সরাসারি ছাত্রী। অনার্সে মেয়েটা অল্পের জন্যে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। ফখরুদ্দিনকে দেখেই একটা ঝলমলে হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার-- এ বছর আপনার কোনো বই বের হয়নি?’
‘তোমাদের কি ধারণা শুধু বইমেলায় প্রকাশের জন্যেই লেখক বা কবিরা বই লিখে থাকেন?’ ফখরুদ্দিন হাসতে হাসতে বললেও শায়লা একটু অপ্রস্তুত হয়।
‘গত দু তিন বছরে তো আপনার নতুন কোনো বই দেখিনি-- তাই ভাবলাম মেলার সময় যদি নতুন কোনো বই এসে থাকে।’
‘তোমার অনুমান অবশ্য ঠিক-- পাঁচ বছর পরে আমার একটা কবিতার বই প্রকাশ করেছে ছোট্ট এক পাবলিশার।’
‘আপনার প্রকাশকের নাম কী স্যার? স্টলটা কোথায়? আমি এক্ষুণি একটা বই কিনে আপনার অটোগ্রাফ নিতে চাই।’ আবারও প্রগলভ হয়ে ওঠে শায়লা। প্রিয় ছাত্রীকে ফখরুদ্দিন একটা বই সৌজন্য কপি হিসাবেই দিতে চেয়েছিল কিন্তু শায়লা রাজি হয় না। বলে, ‘তা হবে না স্যার। এতোদিন পরে কবির একটা বই প্রকাশিত হয়েছে সে বই যদি অন্তত কিছু পাঠক কিনে না পড়ে তাহলে কবি উৎসাহিত হবেন কি করে!’
শায়লার কথায় হঠাৎ করেই একটি পুরোনো ছবি ফখরুদ্দিনের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। রওনকের বয়স যখন শায়লার মতো তখন সেই তো তাকে কবি হয়ে উঠতে উৎসাহিত করেছিল। সত্যিকার অর্থে কোনো প্রেমের সম্পর্ক তার সাথে গড়ে ওঠেনি, তবুও রওনকের চোখের দৃষ্টি, তার মুখের কথা, এমনকি শুধুমাত্র উপস্থিতিই ফখরুদ্দিনকে আবেগের আতিশয্যে পরিপূর্ণ করে ফেলতো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরপরই ফখরুদ্দিনের প্রেরণার উৎস ‘বিবাহিত জীবনের স্বাদ’ গ্রহণ করে দেশান্তরী হলে তার সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার সাথে সাথে কবিতার ঊর্বর ভূমিতেও যেনো আজন্মা দেখা দেয়।
বছর তিনেক আগে দেশে ফিরেছে রওনক এবং অবাক ব্যাপার ফখরুদ্দিনের কবিতাও বহুগুণ উচ্ছসিত হয়ে নতুন করে ফিরে এসেছে। নিয়মিত দেখা সাক্ষাত না হলেও এখন রওনক আছে এই দেশে, এই শহরে-- এই বইমেলার কেন্দ্র থেকে দু চার কিলোমিটারের মধ্যে সে ঘুরে বেড়ায় ভাবতেই তার ভাল লাগে। সম্প্রতি কোনো একটি বিদেশি সংস্থায় গবেষণার কাজে যোগ দিয়েছে রওনক। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে হঠাৎ করেই বইমেলায় তার সাথে দেখা হয়ে গেল-- ঠিক যেমনটা হয়েছে শায়লার ক্ষেত্রে। শায়লার বয়স এখন কতো হতে পারে! যাইহোক, ছাত্রীর দ্বিগুণ বয়সী ফখরুদ্দিন দ্রুত বাস্তবতায় ফিরে এসে বলে, ‘চলো আজ তোমাকে কফি খাওয়াবো।’
‘সত্যিই স্যার! খুব মজা হবে চলেন।’ ভীষণ খুশি হয় শায়লা।
প্রকাশনার স্টল থেকে ক্যান্টিনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফখরুদ্দিন শায়লাকে জিজ্ঞেস করে, ‘পরীক্ষা তো শেষ-- এখন তুমি কী করছো? সময় কাটে কী ভাবে?’
‘সত্যি কথা বলবো?’
‘তোমার কাছে তো মিথ্যে শুনতে চাই নি।’
‘আমি এখন একটা প্রেম করছি স্যার।’ নির্দ্বিধায় বলে ফেলে শায়লা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কেমন যেনো খোলামেলা। ওদের মুখে কোনো কিছুই আটকায় না। আমাদের সময়টা এমন হলে হয়তো... ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফখরুদ্দিন।
তথ্যকেন্দ্র পার হয়ে ক্যান্টিনের প্রায় কাছাকাছি আসতেই একটি আউলা ঝাউলা ধরণের তরুণ ওদের পথ আগলে দাঁড়ায়। ছেলেটি নিজের কাঁধে একটা অনাবশ্যক ঝাঁকুনি দিয়ে শায়লাকে বলে, ‘আমি তোরে সারা মেলায় গুগল সার্চ দিয়া খুঁজতাছি আর তুই কই জানি স্পাম বক্সে ঢুইকা বইসা আছস!’
‘মোবাইলে একটা কল দিলেই তো পারতিস-- সার্চ ইঞ্জিনের দরকার ছিল না।’
‘আমার তো ব্যালান্স হ্যাং হইয়া গেছে--’ থুতনির কাছে ছাগলের মতো দাড়িওয়ালা ছেলেটি হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু তার আগেই শায়লা তাকে থামিয়ে দেয়।
‘আমার স্যার-- বিশিষ্ট কবি অনিকেত ফখরুদ্দিন। আর স্যার-- এই যে ওর কথাই বলছিলাম একটু আগে।’ এবারে শায়লা একটু লজ্জা পায় বলে মনে হয় ফখরুদ্দিনের। ছাগল দাড়ি ডান হাতের দু আঙুল তুলে কোনো রকমে একটা সালাম দিয়েই শায়লাকে বলে, ‘চল-- এখন মেলা থিকা লগ-আউট করি।’
শায়লা আবারও একটু অপ্রস্তুত হয়ে ফখরুদ্দিনকে বলে, ‘স্যার আপনার কফিটা না হয় আরেকদিন খাবো-- মেলা তো এখনও বেশ কয়েকদিন আছে।’
শায়লা চলে যাবার পরে ফখরুদ্দিন অনেকটা সময় বিস্ময়ের সাথে ওদের গন্তব্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে একটু বিচলিত মনে হয়। ওরা যে ভাষায় কথা তা সে বুঝতে পারে না বলে অথবা বাংলা সাহিত্যে স্নাতোকোত্তর পড়া একজন ভাল ছাত্রীর পছন্দের এই দুর্ভিক্ষের ফলে নাকি তার পকেটে থাকা দু কাপ কফির কুপন নিয়ে শেষপর্যন্ত কী করা যায় ভেবে সে মনে মনে অস্থির হতে থাকে-- তার কোনো কারণ সে নিজেও জানে না। এ অবস্থায় কতক্ষণ কাটতো বলা যায় না, হঠাৎ অরুণোদয় প্রকাশনীর অরুণ কুমার মিত্র সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘প্রফেসর সাহেব-- কী এতো ভাবছেন?’
কবি হিসাবে ফখরুদ্দিনের যা পরিচিতি তারচেয়ে বাংলার অধ্যাপক হিসাবে তার পরিচিতি অনেক বেশি। সম্ভবত সেই কারণেই অরুণ মিত্র কবি অনিকেত ফখরুদ্দিনের কবিতার বই প্রকাশের চেয়ে অধ্যাপক আহমেদ ফখরুদ্দিনের নোটবই প্রকাশের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু যথেষ্ট রয়্যালটির বিনিময়েও কলেজ পাঠ্য নোটবই কিংবা স্কুলে পড়ানো ব্যকরণ গ্রন্থ লিখতে ফখরুদ্দিনের কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। শুধু এই কারণে অরুণের সাথে ফখরুদ্দিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক একটু শীতল হয়ে গেছে। এক সাথে কফি খেয়ে সেই শীতল সম্পর্ক একটু উষ্ণ করে তোলা যেতে পারে-- চিন্তাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই অবশ্য সেটা বাতিল করে দেয় ফখরুদ্দিন। অরুণ হয়তো ভাবতে পারে ভবিষ্যতের কোনো প্রকাশনার জন্যে তাকে তোয়াজ করা হচ্ছে। অতএব কিছু সময় অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তায় নিরুত্তাপ সময় কাটিয়ে ক্যান্টিনের দিকে ফিরে যায় সে।
দু কাপ কফি নিয়ে সে কী করবে বুঝতে পারে না। আরও একবার তার কল্পনায় রওনকের মুখ ভেসে আসে। পকেট থেকে কুপন দুটি বের করে কফি ভেডিং মেশিনে দাঁড়ানো ছেলেটির হাতে দেয় ফখরুদ্দিন।
‘তোমাদের কফির পানি গরম হয়েছে?’
‘গরম পানি একবার শেষ কইরা নতুন পানি ভরছি।’ কাপে কফি ঢালতে ঢালতে উত্তর দেয় ছেলেটি। কোনো কিছু না ভেবেই দুটি ডিসপোসেবল কফি কাপ দু হাতে নিয়ে ফখরুদ্দিন বেরিয়ে আসে। অনিশ্চিত পায়ে সামনে এগোতেই তার চোখে পড়ে শেষ বিকেলের আলোয় যেনো ভাসতে ভাসতে আসছে রওনক। আজ একুশে ফেব্রয়ারি নয়, তারপরেও কলো পেড়ে সাদা শাড়ি পরেছে সে। আগের সেই হালকা পাতলা মেয়েটির চেহারায় ছড়িয়ে পড়েছে বসয়ের বাড়তি লাবণ্য। তবে ঠোঁটের কোণে পরিচিত হাসি বদলায়নি এতোটুকুও। ফখরুদ্দিনের মুখোমুখি এসে রওনক জিজ্ঞেস করে, ‘কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছো কার জন্যে?’
‘তোমার জন্যে।’
একটা কাপ রওনকের হাতে তুলে দিয়ে দ্বিধাহীন বলে ওঠে কবি অনিকেত ফখরুদ্দিন।
‘এতো ঝামেলা করি ফির কফি না খাইলেও হইল হয়!’ আবদুল গফ্ফার স্পষ্টতই বিব্রত হয়। অনেকদিন পরে বইমেলায় দেখা হবার পর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই বন্ধু কিছুক্ষণ তথ্যকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা মেরে কাটাবার পরে গফ্ফারই প্রস্তাব করে, ‘কোনঠায় বসি চা খাইলে হয়।’
‘চা কেন-- চল কফি খাওয়া যাক।’
‘সেই ভাল হামার নিলফামারির চায়ের দোকানত ওমরা কফি বানবারই পারে না।’ এরপর দুজনে ক্যান্টিনে ঢুকে পড়ে আর বিড়ম্বনার শুরু সেখানেই। কুপন নিয়ে ফখরুদ্দিন যখন কফি ভেন্ডিং মেশিনের কাছে পৌঁছাল ঠিক তখনই শেষ হয়ে গেল কফির গরম পানি। ডিসপোসেবল কফি কাপ হাতে নিয়ে মেশিনের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটা বোকা বোকা একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘পানি ফুরাইয়া গেছে স্যার। গরম পানি আসতে দশ মিনিট দেরি হইব।’
‘কুপন দুটো কি করবো?’ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো ফখরুদ্দিন।
‘কাছে রাইখা দ্যান-- পরে যখন আসবেন কফি রেডি পাইবেন।’
অগত্যা দুজনেই ভিড় ভারাক্রান্ত ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে আর সেই সময়েই বেজে ওঠে গফ্ফারের হাতের মোবাইল ফোন। মেলার মূল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কারো সাথে ফোনে একটু কথা বলেই গফ্ফার বললো, ‘হামার কলেজের লাইব্রেরিয়ান-- মুই এ্যালা গেট থাকি ঘুরি আসো।’
‘ওনাকে আসতে বলে দে না এখানে।’
‘থাক-- ওমাক বিদায় করি আসো। দশ মিনিট পরে তুই এটেই আসি খাড়াস।’
জলঢাকার একটি কলেজে বাংলা পড়ায় আবদুল গফ্ফার। কলেজ লাইব্রেরির বই কেনার জন্যে প্রতি বছরই বইমেলার সময় সে লাইব্রেরিয়ানসহ ঢাকায় আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাঝে গত বছর ওদের দেখা না হওয়ায় ফখরুদ্দিন ভেবেছিল এবারে চুটিয়ে আড্ডা দেবে। কিন্তু দশ মিনিট পরে গফ্ফারের পরিবর্তে মোবাইল ফোনে তার কণ্ঠ শোনা গেল।
‘ফখরুল-- লাইবিরিয়ানের সাথত মোক জিগাতলা যাবার নাগিবে। জরুরি ব্যাপার হঠাৎ আসি খাড়া হইছে।’
‘তুই অন্তত কফিটা খেয়ে যা।’
‘আরে কফি আরেক দিন হইবে। এ্যালা মুই যাঁও।’
এরপরই লাইনটা কেটে যায় অথবা লাইন কেটে দিয়ে আবদুল গফ্ফার তার গ্রন্থাগারিকসহ জিগাতলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
কিছুক্ষণ অকারণে ঘোরাঘুরি করে ফখরুদ্দিন। এবারের বইমেলায় একটি অখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিল সে। অনিয়মিতভাবে হলেও গত চব্বিশ বছর ধরে লিখে চলেছে। এবারের বইটিসহ অনিকেত ফখরুদ্দিন নামে তার তিনটি কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও কখনোই সে কবি হিসাবে পরিচিত হতে চায় না। তারপরেও বন্ধুবান্ধব এবং রাজধানীর যে কলেজে সে পড়ায় সেখানে ছাত্রছাত্রীরা জানে বাংলার সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ ফখরুদ্দিনই কবি অনিকেত ফখরুদ্দিন। ক্লাসে তার পড়াবার স্টাইলটিও সবার বেশ পছন্দ। বিশেষকরে ছাত্রীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়।
ফখরুদ্দিন পায়ে পায়ে তার নিজের প্রকাশনা সংস্থার দিকে এগিয়ে যায়। মেলায় সারা মাসে বিশ পঁচিশটা বই বিক্রি হবে কিনা সন্দেহ। তারপরেও মাঝে মধ্যে স্টলে বসলে প্রকাশক খুশি হয়। পুকুরের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে বাংলা একাডেমির নতুন ভবনের কাছে ছোট্ট স্টলটিতে পৌঁছাবার আগেই তার শায়লা নওশিনের সাথে দেখা হয়ে যায়। শায়লা এ বছর বাংলায় মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে, সেই সূত্রে ফখরুদ্দিনের সরাসারি ছাত্রী। অনার্সে মেয়েটা অল্পের জন্যে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। ফখরুদ্দিনকে দেখেই একটা ঝলমলে হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্যার-- এ বছর আপনার কোনো বই বের হয়নি?’
‘তোমাদের কি ধারণা শুধু বইমেলায় প্রকাশের জন্যেই লেখক বা কবিরা বই লিখে থাকেন?’ ফখরুদ্দিন হাসতে হাসতে বললেও শায়লা একটু অপ্রস্তুত হয়।
‘গত দু তিন বছরে তো আপনার নতুন কোনো বই দেখিনি-- তাই ভাবলাম মেলার সময় যদি নতুন কোনো বই এসে থাকে।’
‘তোমার অনুমান অবশ্য ঠিক-- পাঁচ বছর পরে আমার একটা কবিতার বই প্রকাশ করেছে ছোট্ট এক পাবলিশার।’
‘আপনার প্রকাশকের নাম কী স্যার? স্টলটা কোথায়? আমি এক্ষুণি একটা বই কিনে আপনার অটোগ্রাফ নিতে চাই।’ আবারও প্রগলভ হয়ে ওঠে শায়লা। প্রিয় ছাত্রীকে ফখরুদ্দিন একটা বই সৌজন্য কপি হিসাবেই দিতে চেয়েছিল কিন্তু শায়লা রাজি হয় না। বলে, ‘তা হবে না স্যার। এতোদিন পরে কবির একটা বই প্রকাশিত হয়েছে সে বই যদি অন্তত কিছু পাঠক কিনে না পড়ে তাহলে কবি উৎসাহিত হবেন কি করে!’
শায়লার কথায় হঠাৎ করেই একটি পুরোনো ছবি ফখরুদ্দিনের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। রওনকের বয়স যখন শায়লার মতো তখন সেই তো তাকে কবি হয়ে উঠতে উৎসাহিত করেছিল। সত্যিকার অর্থে কোনো প্রেমের সম্পর্ক তার সাথে গড়ে ওঠেনি, তবুও রওনকের চোখের দৃষ্টি, তার মুখের কথা, এমনকি শুধুমাত্র উপস্থিতিই ফখরুদ্দিনকে আবেগের আতিশয্যে পরিপূর্ণ করে ফেলতো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরপরই ফখরুদ্দিনের প্রেরণার উৎস ‘বিবাহিত জীবনের স্বাদ’ গ্রহণ করে দেশান্তরী হলে তার সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার সাথে সাথে কবিতার ঊর্বর ভূমিতেও যেনো আজন্মা দেখা দেয়।
বছর তিনেক আগে দেশে ফিরেছে রওনক এবং অবাক ব্যাপার ফখরুদ্দিনের কবিতাও বহুগুণ উচ্ছসিত হয়ে নতুন করে ফিরে এসেছে। নিয়মিত দেখা সাক্ষাত না হলেও এখন রওনক আছে এই দেশে, এই শহরে-- এই বইমেলার কেন্দ্র থেকে দু চার কিলোমিটারের মধ্যে সে ঘুরে বেড়ায় ভাবতেই তার ভাল লাগে। সম্প্রতি কোনো একটি বিদেশি সংস্থায় গবেষণার কাজে যোগ দিয়েছে রওনক। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে হঠাৎ করেই বইমেলায় তার সাথে দেখা হয়ে গেল-- ঠিক যেমনটা হয়েছে শায়লার ক্ষেত্রে। শায়লার বয়স এখন কতো হতে পারে! যাইহোক, ছাত্রীর দ্বিগুণ বয়সী ফখরুদ্দিন দ্রুত বাস্তবতায় ফিরে এসে বলে, ‘চলো আজ তোমাকে কফি খাওয়াবো।’
‘সত্যিই স্যার! খুব মজা হবে চলেন।’ ভীষণ খুশি হয় শায়লা।
প্রকাশনার স্টল থেকে ক্যান্টিনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফখরুদ্দিন শায়লাকে জিজ্ঞেস করে, ‘পরীক্ষা তো শেষ-- এখন তুমি কী করছো? সময় কাটে কী ভাবে?’
‘সত্যি কথা বলবো?’
‘তোমার কাছে তো মিথ্যে শুনতে চাই নি।’
‘আমি এখন একটা প্রেম করছি স্যার।’ নির্দ্বিধায় বলে ফেলে শায়লা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কেমন যেনো খোলামেলা। ওদের মুখে কোনো কিছুই আটকায় না। আমাদের সময়টা এমন হলে হয়তো... ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফখরুদ্দিন।
তথ্যকেন্দ্র পার হয়ে ক্যান্টিনের প্রায় কাছাকাছি আসতেই একটি আউলা ঝাউলা ধরণের তরুণ ওদের পথ আগলে দাঁড়ায়। ছেলেটি নিজের কাঁধে একটা অনাবশ্যক ঝাঁকুনি দিয়ে শায়লাকে বলে, ‘আমি তোরে সারা মেলায় গুগল সার্চ দিয়া খুঁজতাছি আর তুই কই জানি স্পাম বক্সে ঢুইকা বইসা আছস!’
‘মোবাইলে একটা কল দিলেই তো পারতিস-- সার্চ ইঞ্জিনের দরকার ছিল না।’
‘আমার তো ব্যালান্স হ্যাং হইয়া গেছে--’ থুতনির কাছে ছাগলের মতো দাড়িওয়ালা ছেলেটি হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু তার আগেই শায়লা তাকে থামিয়ে দেয়।
‘আমার স্যার-- বিশিষ্ট কবি অনিকেত ফখরুদ্দিন। আর স্যার-- এই যে ওর কথাই বলছিলাম একটু আগে।’ এবারে শায়লা একটু লজ্জা পায় বলে মনে হয় ফখরুদ্দিনের। ছাগল দাড়ি ডান হাতের দু আঙুল তুলে কোনো রকমে একটা সালাম দিয়েই শায়লাকে বলে, ‘চল-- এখন মেলা থিকা লগ-আউট করি।’
শায়লা আবারও একটু অপ্রস্তুত হয়ে ফখরুদ্দিনকে বলে, ‘স্যার আপনার কফিটা না হয় আরেকদিন খাবো-- মেলা তো এখনও বেশ কয়েকদিন আছে।’
শায়লা চলে যাবার পরে ফখরুদ্দিন অনেকটা সময় বিস্ময়ের সাথে ওদের গন্তব্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে একটু বিচলিত মনে হয়। ওরা যে ভাষায় কথা তা সে বুঝতে পারে না বলে অথবা বাংলা সাহিত্যে স্নাতোকোত্তর পড়া একজন ভাল ছাত্রীর পছন্দের এই দুর্ভিক্ষের ফলে নাকি তার পকেটে থাকা দু কাপ কফির কুপন নিয়ে শেষপর্যন্ত কী করা যায় ভেবে সে মনে মনে অস্থির হতে থাকে-- তার কোনো কারণ সে নিজেও জানে না। এ অবস্থায় কতক্ষণ কাটতো বলা যায় না, হঠাৎ অরুণোদয় প্রকাশনীর অরুণ কুমার মিত্র সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘প্রফেসর সাহেব-- কী এতো ভাবছেন?’
কবি হিসাবে ফখরুদ্দিনের যা পরিচিতি তারচেয়ে বাংলার অধ্যাপক হিসাবে তার পরিচিতি অনেক বেশি। সম্ভবত সেই কারণেই অরুণ মিত্র কবি অনিকেত ফখরুদ্দিনের কবিতার বই প্রকাশের চেয়ে অধ্যাপক আহমেদ ফখরুদ্দিনের নোটবই প্রকাশের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু যথেষ্ট রয়্যালটির বিনিময়েও কলেজ পাঠ্য নোটবই কিংবা স্কুলে পড়ানো ব্যকরণ গ্রন্থ লিখতে ফখরুদ্দিনের কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। শুধু এই কারণে অরুণের সাথে ফখরুদ্দিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক একটু শীতল হয়ে গেছে। এক সাথে কফি খেয়ে সেই শীতল সম্পর্ক একটু উষ্ণ করে তোলা যেতে পারে-- চিন্তাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই অবশ্য সেটা বাতিল করে দেয় ফখরুদ্দিন। অরুণ হয়তো ভাবতে পারে ভবিষ্যতের কোনো প্রকাশনার জন্যে তাকে তোয়াজ করা হচ্ছে। অতএব কিছু সময় অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তায় নিরুত্তাপ সময় কাটিয়ে ক্যান্টিনের দিকে ফিরে যায় সে।
দু কাপ কফি নিয়ে সে কী করবে বুঝতে পারে না। আরও একবার তার কল্পনায় রওনকের মুখ ভেসে আসে। পকেট থেকে কুপন দুটি বের করে কফি ভেডিং মেশিনে দাঁড়ানো ছেলেটির হাতে দেয় ফখরুদ্দিন।
‘তোমাদের কফির পানি গরম হয়েছে?’
‘গরম পানি একবার শেষ কইরা নতুন পানি ভরছি।’ কাপে কফি ঢালতে ঢালতে উত্তর দেয় ছেলেটি। কোনো কিছু না ভেবেই দুটি ডিসপোসেবল কফি কাপ দু হাতে নিয়ে ফখরুদ্দিন বেরিয়ে আসে। অনিশ্চিত পায়ে সামনে এগোতেই তার চোখে পড়ে শেষ বিকেলের আলোয় যেনো ভাসতে ভাসতে আসছে রওনক। আজ একুশে ফেব্রয়ারি নয়, তারপরেও কলো পেড়ে সাদা শাড়ি পরেছে সে। আগের সেই হালকা পাতলা মেয়েটির চেহারায় ছড়িয়ে পড়েছে বসয়ের বাড়তি লাবণ্য। তবে ঠোঁটের কোণে পরিচিত হাসি বদলায়নি এতোটুকুও। ফখরুদ্দিনের মুখোমুখি এসে রওনক জিজ্ঞেস করে, ‘কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছো কার জন্যে?’
‘তোমার জন্যে।’
একটা কাপ রওনকের হাতে তুলে দিয়ে দ্বিধাহীন বলে ওঠে কবি অনিকেত ফখরুদ্দিন।
0 মন্তব্যসমূহ