ফরিদুর রহমান'এর গল্প : একটি অসমাপ্ত কাহিনি

গল্পটা আমার বন্ধু সুরজিৎ ধরের কাছ থেকে শুনেছিলাম। সুরজিৎ ফিল্ম ডিরেক্টার। পুণের ফিল্ম ইন্সটিটিউটে আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি। খুব নামকরা পরিচালক না হলেও গত কয়েক বছরে তার গোটা তিনেক পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা রিলিজ করেছে। এ সব ছবির একটিও যে ব্যবসায়িক সাফল্যের মুখ দেখেনি সে কথা না বললেও চলে। বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত তার বানানো টিভি সিরিয়ালের সংখ্যা আঠারোটি। এরমধ্যে ‘মধ্যরাতের গল্প’ নামে শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টাইটেল যুক্ত ধারাবাহিক আকাশ বাংলায় প্রচার শুরু হলে একটা হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল।
দিনের বেলা যারা অফিসে, খেলার মাঠে কিংবা কলেজের করিডোরে দাঁড়িয়ে এই সিরিয়াল প্রচারের বিপক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, তারাও গভীর রাতে এক অপরকে লুকিয়ে সিরিয়ালটা ঠিকই নিয়মিত দেখতেন বলে জানা যায়। তার তৈরি কর্পোরেট ডকুমেন্টারি এবং বিজ্ঞাপন ছবির সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তবে আজকের কাহিনির সূত্রপাত তার চতুর্থ ফিচার ফিল্ম স্যুটিং-এর শেষ দিনে। সুরজিতের মুখ থেকেই পুরোটা শোনা যাক। 

তিন দিন ধরে গোলপার্কের কাছে একটা বাড়ির ছাদে-- ইনফ্যাক্ট রুফ গার্ডেনে শেষ লটের স্যুটিং চলছে। সেদিন ছিল আমার চার নম্বর ছবির স্যুটিং-এর শেষ দিন। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই প্যাকআপ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ থেকে মাহফুজ বলে যে ছেলেটা এসেছে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, ওকে ছেড়ে দিতে পারবো। রূপা গাঙ্গুলীর অন্য একটা ছবির ডাবিং শুরু হবে পরদিন থেকে। এমন অবস্থায় স্যুটিং শিডিউল মতো শেষ হলে যে কোনো ডিরেক্টার প্রডিউসারের খুশি হবার কথা। কিন্তু আমার মনের মধ্যে কি যেনো একটা খচখচ করছে। একটা বড় কাজ শেষ হতে যাচ্ছে, কিন্তু ডিরেক্টারকে কেউ কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। পরিচালকের কোনো গুরুত্ব নেই, এটা তো হতে পারে না। একের পর এক শট নেয়া হচ্ছে। এ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টার নায়কের সামনে স্ক্রিপ্ট মেলে ধরছে। লাইট বয়েরা ক্যামেরাম্যানের কথা মতো কার্টার লাগাচ্ছে, বার্নডোর খুলে দিচ্ছে-- বন্ধ করছে। মেকআপম্যান নায়িকার গালে ব্রাশ বুলিয়ে দিচ্ছে। সকলেই পরবর্তী শটের জন্য প্রস্তুত।

সকাল থেকে আমার মাথাটা ঝিমঝিম করেছে--প্রোডাকশনের অফিসে বসেই টের পেয়েছিলাম। নিজেকে গুরুত্বহীন ভাবার বিষয়টি তার সাথে যুক্ত হয়ে মনের মধ্যে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। স্যুটিং-এর শেষ পর্যায়ে এসে বুকের বাঁ দিকটায় একটা ব্যথা টের পেলাম। বাঁ দিক নয়-- বোধহয় ডান দিকেও হতে পারে। কেমন চিনচিন করে একটা ব্যথা। প্রোডাকশনের লোকজন ছাড়াও অফিস থেকে কয়েকজন এসেছিল, স্যুটিং দেখতে। যা হয় আর কি! মাথায় ঝিমঝিম ভাব এবং বুকে চিনচিন ব্যথা নিয়েই শট কল করলাম, ‘লাইট-- ক্যামেরা-এ্যাকশান!’ এর পরপরই বেশ একটা হৈ চৈ-- আমার মনে হলো আমি পড়ে যাচ্ছি। আর কিছু বলতে পারবো না। পরে জেনেছি, সোজা বেলভিউ নার্সিংহোমে-- আইসিইউতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো সামান্য কারণে বেলভিউয়ের মতো একটা এক্সপেন্সিভ ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া বোধহয় একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে। প্রোডিউসার হয়তো ভেবেছিল সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে নাম করা ফিল্মমেকারদের অনেকেই যেহেতু এখানেই দেহ রেখেছেন-- সুরজিৎ ধরের নামডাক না থাক শুধুমাত্র বেলভিউয়ের কারণেও হয়তো তার ছবিটা বাড়তি প্রচার পেয়ে যেতে পারে। 

যাই হোক, নার্সিংহোমে পৌঁছাবার পরপরই সম্ভবত কড়া সিডাটিভ দেয়া হয়েছিল। আমি চেষ্টা করেও চোখ খুলতে পারছি না। তবে ট্রলি ঠেলে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, বিছানাটা নড়াচড়া করছে বেশ বুঝতে পারছিলাম। রাতেই আইসিইউ থেকে একটা টুইন শেয়ার কেবিনে শিফট করেছে। সকালে যখন ঘুমটা ভেঙেছে তখন আমি যেনো নিজের সাথেই খেলছি। চোখ খুললে এখন কি দেখবো! সকাল না দুপুর, দুপুর না বিকেল, সন্ধ্যে নাকি আর্লি মর্নিং...! চোখের উপরে একটু আলো ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে বুঝতে পারছি কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঝট করে চোখ খুলে দেখি ওই প্রান্তে একটা লোক কাত হয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে তাকিয়ে আছে আমিও তাকিয়ে আছি। কাঁহাতক তাকিয়ে থাকা যায় একজনের দিকে! একটু পরেই আমি বলে উঠলাম, ‘গুড মর্নিং’। যেই বলেছি গুড মর্নিং লোকটি বললেন, ‘বাব্বা! এযে দেখছি বকশীর মতোই আর একজন। ঠিক বকশীর মতো ইংরেজি উচ্চারণ।’ 

আমি বললাম, ‘বকশী কে? কোনো ডাক্তার নাকি সার্জন?’ একটু হেসে ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে না দাদা একজন পেসেন্ট! গতকাল আপনার বিছানায় ছিল।’ আমি বললাম, ‘চলে গেছেন? সব ঠিকঠাক থাকলে আমিও কাল পরশু নাগাদ চলে যাব্।ো’ ’যেতে আর পারলো কই। কাল রাতেই তো ওই বিছানা থেকে...’ এরপর আঙুলে একটা তুড়ি বাজিয়ে ইশারায় উপরের দিকে দেখিয়ে দিলেন। তারপর আবার একটু হাসি। আমার সেই মুহূর্তে সত্যি সত্যি হার্ট এ্যাটাক হবার যোগাড়। এই বিছানাটা কি তাহলে পরলোক যাত্রার লঞ্চিংপ্যাড! বিষয়টা তাকে বুঝতে না দিয়ে মুখে বললাম. ‘ভেরি স্যাড, ভেরি স্যাড।’ পার্শ্ববর্তী আমার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘ছেলে মেয়ে কয়টি?’ বললাম, ‘দুই মেয়ে।’ ‘বাবা-- এরকম মিলও পাওয়া যায়! বকশীরও দুই মেয়ে ছিল।’ মৃত বকশী বাবুর সাথে আমার সব রকম মিল প্রতিষ্ঠায় ভদ্রলোকের আগ্রহের শেষ নেই। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার জন্যে তার মাথার উপর দিয়ে বিছানার প্রান্তে পড়ে থাকা কাগজ দেখিয়ে বললাম, ‘খবরের কাগজটা একটু দিন না-- হেড লাইনগুলো দেখে নিই।’ আনন্দবাজারের হলুদ হয়ে যাওয়া একটি পুরোনো সংখ্যা তিনি আমার সামনে তুলে ধরেন। সম্ভবত আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায়, ‘ও বাংলা?’ ‘বকশীর মতোই-- স্টেটসম্যান ছাড়া সকালে চায়ের কাপ উঠতো না ঠোঁটে।’ পাশের লোকটির তাৎক্ষণিক উত্তর। 

ইতিমধ্যেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছে। ভেতরের অস্বস্তিটা বাড়ছে। ঠিক এই সময় একজন সিনিয়ার স্টাফনার্স বেশ হাসি হাসি মুখ করে কাছে এসে দাঁড়ান, ‘এই তো আপনি উঠে পড়েছেন। আপনার ব্রেকফাস্ট নিয়ে আমরা একটু আগে আমরা ঘুরে গেছি। দাঁড়ান আপনার ব্রেকফস্টের কথাটা বলে দিই।’ ‘দাঁড়ান দাঁড়ান আগে একটু অন্য কথা আছে-- আচ্ছা আমার জন্যে কি অন্য কোনো টুইন কেবিন বা অন্য কোনো রুমে একটা বেডের ব্যবস্থা করা যায়?’ আমি পার্শ্ববর্তীর কান এড়িয়ে নিচু গলায় কথা বলি, কিন্তু লোকটি আমাদের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে সারাক্ষণ লিপ রিডের চেষ্টা করে চলেছেন। ‘কেন-- উনি কি আপনাকে খুব বিরক্ত করছেন? অনেক কথা বলছেন তাই না?’ আমি বিস্তারিত না বললেও স্টাফনার্স বুঝে ফেলেন। আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, তবে--’ ‘বুঝেছি-- আজকে তো হবে না। চেষ্টা করে দেখবো। আপনি ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হয়ে থাকুন, কতগুলো টেস্ট করাতে হবে।’ 

স্টাফনার্স বেরিয়ে যাবার সাথে সাথেই পাশ্ববর্তী বলে ওঠেন, ‘অন্য কেবিনে যাবার চেষ্টা করছেন-- পারবেন না। বকশীও চেষ্টা করেছিল কোনো লাভ হয়নি।’ আমার এবারে একটু রাগই হয়। বেশ কড়া করে বলি, ‘দেখুন মশাই চিকিৎসা করাতে এসে আমি কোথায় থাকবো না থাকবো সেটা নিতান্তই আমার ব্যাপার। আপনি আর কিছু না বললেই আমি খুশি হই।’ আমার কথায় বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘এই যে আপনি বোধহয় রাগ করলেন। আপনার রাগ দেখ মনে হচ্ছে--’ হঠাৎ থেমে যান তিনি। আমিই প্রশ্ন করি, ‘কী মনে হচ্ছে?’ ‘কিছু মনে করবেন না-- আপনি কী ঘটি না বাঙাল?’ ‘আমার দাদুর বাড়ি ছিল ঢাকা শহরের লক্ষ্মীবাজারে। বাবা জগন্নাথ কলেজে পড়াশোনা করেছেন।’ ‘ঠিক ধরেছি। বকশী বাবুর বাবাও ওপার থেকে এসেছেন। ঢাকায় বকশী বাজার বলে একটা জায়গা নাকি আছে-- সেটা ওর দাদুর নামে।’ জলখাবার নিয়ে একজন নার্স এসে পড়ায় লোকটির কথাবার্তায় সাময়িক বিরতি ঘটে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়েন।

ঘণ্টাখানেক পরে, প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টে যাবার সময় ওয়ার্ডবয় আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিতে চেয়েছিল। বললাম, ’আমি তো রীতিমতো সুস্থ মানুষ-- হেঁটেই যেতে পারবো।’ করিডোরে বেরিয়ে যাবার পর পেছন থেকে পাশ্ববর্তী বেডের ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, ‘শুনুন-- বকশী বাবুও কিন্তু পায়ে হেঁটেই টেস্টগুলো করিয়ে ছিলেন।’ আমি বুঝতে পারি লোকটি যদি আর কয়েক ঘণ্টা সময় পায় তাহলে আমাকে বকশীর ক্লোন কপি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে সত্যি সত্যিই উপরে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। এরপর কোনো একজন ভৌমিক এই বিছানায় এলে তাকে ধরের গল্প শোনাবে। 

সিটিস্ক্যান থেকে শুরু করে ইউরোফ্লোমেট্রি পর্যন্ত নানা ধরনের প্রয়োজনীয় এবং বেশিরভাগ অপ্রয়োজনীয় টেস্ট শেষ করতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল। আমাদের কার্ডিওলজি ব্লকে ফেরার মুখে সকালের সেই স্টাফ নার্সের সাথে দেখা হতেই হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ‘আপনার জন্যে একটা ভালো খবর আছে। পাশের বেডের সেই টকেটিভ ভদ্রলোককে নিউরো মেডিসিন ব্লকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’ ‘তাই নাকি-- রিয়েলি ইটস এ গুড নিউজ। আসলে আমি আর ওকে টলারেট করতে পারছিলাম না।’ ‘সমস্যটা মিটে গেছে, এবারে কেবিনে ফিরে নিশ্চিন্তেরেস্ট নিন।’ ‘তা ছাড়া আমাকেও তো খুব বেশি দিন থাকতে হবে না।’ ‘নিশ্চয়ই। টেস্ট-এর রেজাল্টগুলো আসুক, আশা করছি কাল পরশু বাড়ি যেতে পারবেন।’ সিনিয়ার স্টাফ নার্স আমাকে আশ্বস্ত করে চলে যান। 

কেবিনে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি আশা করিনি। কিন্তু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়লো আমার পাশের বেডে একজন টেকো ভদ্রলোক আধা শোয়া হয়ে স্টেটসম্যান পড়ছেন। বেলভিউয়ের মতো নার্সিংহোমে বেড খালি থাকবে এটা আশা করা যায় না। আমাকে দেখে একটু নড়েচড়ে হাঁটুর উপরে একটা চাদও টেনে ত্রিভঙ্গ মুরারি মতো তিনি উঠে বসলেন। তারপর বেশ পরিশিলীত উচ্চারণে বললেন, ‘গুড আফটার নুন।’ প্রত্যুত্তরে আমি ‘গুড আফটার নুন’ বলার সাথে সাথেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি প্রাণতোষ বকশী। একটা মাইল্ড স্ট্রোকের কেস-- বুকের বাঁ পাশে চিনচিনে ব্যথা।’ 


আমার নিজের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। চিনচিনে ব্যথা নেই কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি ভীষণ চমকে যাই। এইবার বোধহয় সত্যিকারের বকশীবাবুর পাল্লায় পড়েছি। নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার ছেলে মেয়ে?’ ‘আমার দুটি মেয়ে।’ এরপর কোনো বিরতি না দিয়ে স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো আমি বলতে থাকি, ‘আপনার বাবা ওপার থেকে কোলকাতায় এসেছেন। ঢাকার বকশী বাজার বলে জায়গাটার নামকরণ হয়েছে আপনার দাদুর নামে।’ বকশী বাবু ভীষণ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনেকক্ষণ পরে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার সাথে কি আমার আগে কখনো কোথাও দেখা হয়েছে?’ আমি খুব নিশ্চিতভাবে বলে উঠি, ‘দেখা হয়নি-- তবে খুব শিগগিরই হবে।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ