বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য'এর গল্প : ধুলো

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে খানিকটা হেঁটে এসে চারজনের দলটা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে উঠে পড়ল। দলটার সবথেকে বয়স্ক সদস্য সুরেশ্বর মন্ডল। সে সবার আগে আগে যাচ্ছে। পরনে নতুন কাচা ধুতি আর বাংলা শার্ট। শার্টের ডানকাঁধে গামছা। বাকি তিনজন একটু পিছনে। তাদের মধ্যে একজন মধ্যবয়স্ক যুবক, এগারো-বারো বছরের একটি ছেলে এবং সুরেশ্বরের দ্বিতীয়পক্ষ। সুরেশ্বরের কাঠামোটি রোগা। কালো পোড়খাওয়া গর্ত গর্ত মুখ। মাথার টাক জুড়ে পাকা চুলের রেলিং। রোগা মুখে কপালটা বেমানান রকমের উঁচু। এক্ষুনি যেন মুখ থেকে খুলে পড়ে যাবে- এরকম একটা অবস্থা। ছোট চোখদুটো তার ভিতর থেকে পিটপিট করে। কপালে জমা ঘাম গামছা দিয়ে মাঝেমাঝে মুছে নিচ্ছে। বয়স ঠিক কত, তা ওভাবে বলা না গেলেও এটুকু বোঝা যায় যে, লোকটির রক্তে অন্তত একটি মহাযুদ্ধের জল-হাওয়া মিশে আছে। ও চাষি। এই সত্যটাও ওর শরীরের পেশিতে খোদাই করা আছে স্পষ্টভাবে. যে কেউ পড়ে নিতে পারে। নতুন কাচা ধুতির তলায় পায়ের ডিমটা লোহার বলের মতো। গোড়ালি থেকে মোটা আঁকাবাঁকা শিরা উঠে হাঁটু পেরিয়ে গিয়েছে। সারাজীবনে অন্তত পনেরোটা মানুষকে খুন করেছে। খুন করে দেহটা টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিত মাঠে। শেষ খুনটা করেছে বছর পঁচিশ আগে। সবই জমি আন্দোলনের ব্যাপার। খুন করার পর বাঁধা নিয়ম- বাড়ি ফিরে পুকুর থেকে কয়েকটা ডুব দিয়ে উঠে ট্যাংরা মাছের রগলগে ঝোল দিয়ে ও ভাত মেখে খাবে। মাছ না হলে ওর চলে না।

শিয়ালদহ স্টেশনে নামতে নামতেই এগারোটা বেজে গেল। কয়েকটি হোটেল খোলা ছিল তখনও। সেখান থেকেই ডাল, আলুছোকা আর পেঁয়াজ দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে উঠে দলের সবথেকে কনিষ্ঠ সদস্য এগারো-বারো বছরের ছেলেটি ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে সুন্দর করে একটা ঢেকুর তুলে বলল- খুব খ্যালাম। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরের এক গ্রামের ছেলে। দিনের বেলা সেখানে সাত-আটশো বিঘা জুড়ে ফকফক করে। ওরা কোনওদিন 'খেলাম' বলবে না।

কথাটা সুরেশ্বরের ভালোলাগল না। মাছ না পেলে ওর মেজাজ বিগড়ে যায়।

খেয়ে উঠেই হাঁটা। তাও প্রায় চল্লিশ মিনিট হতে চলল। গাড়ি করা যেত, কিন্তু তাতে শুধুশুধু কতগুলো পয়সা নষ্ট। পয়সা তো মাগনায় আসে না। হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ্বর কথা বলছিল। বিকাশ ওর ছেলে প্রভাসের বন্ধু। সুরেশ্বরের এই পক্ষের এই একটিই। আগের পক্ষের দুটো মেয়ে আছে। "কলকাতায় প্রথম যখন আসি, কী লোক! কী লোক শ্যালদায়! তখন আমি ছোট। নাক দিয়ে শিকনি পড়ছে। ট্রেনে এত ভিড়, জায়গা হল না। বরিশাল থেকে বাড়ির সব মেম্বার ওই লাইন ধরে হেঁটেহেঁটে আখ খেতে খেতে চলে এলাম। শ্যালদার ওখানেই রাস্তায় ছিলাম দু'দিন। সব রিফিউজি! পাঁউরুটির লাইনে গিয়ে দাঁড়াতাম খিদে পেলে। তাও সবসময় পেতাম না। কুপন বেলাক হত। আমার বড়দা ওই করতে গিয়েই খুন হয়ে গেল। নতুন দেশে আসার তিনদিনের মধ্যেই একটা মৃত্যু। বাবা বলল এখানে আর থাকবে না। এই শহরে অভিশাপ আছে। সেই যে গ্রামে গেলাম, তারপর কলকাতায় এলাম বত্রিশ বছর পর। উনআশি সালে। বাবা কথাটা তো ভুল বলেনি... কলকাতায় তো আছেই..." সুরেশ্বর এইখানে থেমে গেল। সুরেশ্বরের বউ পারুল ছোট ছেলেটির হাত ধরে হাঁটছে। বিকাশ বলল- প্রভাসের সঙ্গে আপনি কয়েক বছর আগে আসলেন না? হ্যাঁ। এসে আবার ফার্স্ট ট্রেন ধরে ফিরেও গেছিলাম। কলকাতা আমার ভালোলাগে না। ওহ! সেদিন রাতে বাড়ি ফেরার আগে প্রভাস আমায় একটা গুড়ের চা খাইয়েছিল। দারুণ খেতে! এখনও মুখে লেগে আছে। তুই জানিস, কোথায় পাওয়া যায়?

- না। কোনদিক দিয়ে গেছিলেন? ওর দোকানের ওদিকে?

- হ্যাঁ বোধহয়। ধুর! অত মনে আছে নাকি! তবে খেতে ভালো। বেশি গুড় দিলেও মিষ্টিটা মাপাজোকা হয়ে জিভে আসছে।

- প্রভাস কখনও আমায় বলেনি ওই চা নিয়ে।

- বলতো হয়তো পরে কখনও পরে। ওর তো পেটে কথা থাকে না...

বিকাশ এই কথার পিঠে আর কথা বলে না। কেউই কোনও কথা বলে না তারপর। সবাই হাঁটতে থাকে।

বিকাশের চেহারায় ভারিক্কী গ্রামীণ ছাপ। কলকাতায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল একটা রঙের দোকানে কাজ করছে। তবু ছাপটা এখনও যায়নি। তবে উচ্চারণে বদল এসেছে। গলাটা ঘাড়ের মধ্যে মেশানো। ও কম কথা বলে, নাকি কথা বলার সময় শব্দগুলো জমাট হয়ে গালের মাংসের ভিতর আটকে আর বেরোতে পারে না- বলা মুশকিল। পারুলের হাত ধরে আসছিল বাচ্চা ছেলেটি। কালোপানা রোগা চেহারা। সদ্য ন্যাড়া হওয়ায় মুখের হনুগুলো আরও বেশি করে বেরিয়ে এসে ছোবড়া ছাড়ানো নারকোলের আকার নিয়েছে। বিকাশ হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটির দিকে তাকাল। তারপর তার মুখের সামনে নিজের মুখটা বসিয়ে দিল- পল্টু, কষ্ট হচ্ছে না তো রে! ছেলেটা একটা হাত পারুলের হাতে দিয়ে অন্য হাতটা দিয়ে মন দিয়ে নাক খুঁটছিল। নতুন অ্যালজেব্রা শিখছে। মানচিত্র দেখে কোনটা নদী, কোনটা পাহাড়, কোনটা ওদের জেলা- সব বলে দিতে পারে। বিকাশ কাকা ওর বাবার বন্ধু। মানুষটা ভাল। ও স্পষ্ট বলল সত্যিটা। আর পারছি না। ঘুম পাচ্ছে। চলে যাই চলো। কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। ডান হাতের চেটোটা ওর মাথায় বুলিয়ে দিল সুরেশ্বর। তা বললে হয় বাবা! তোর জন্যই তো আসা। আর একটু কষ্ট করে নে। তাহলে কাল বাড়ি গিয়ে হাঁস কাটব। ছেলেটি প্রভাসের। সুরেশ্বরের একমাত্র বংশধর। মা মরেছিল অনেক ছোটবেলায়। ডাল খেতে বড্ড ভালবাসে। আজ হোটেলেও দু'বাটি আলাদা করে চেয়ে খেয়েছে। কিন্তু শরীরে লাগে না। সুরেশ্বর এই বয়সেও সুপুরি গাছ বেয়ে উঠে যেতে পারে। যা খায় হজম হয়ে যায়। বিছানায় শুলে এক কাতে ঘুমিয়ে রাত কাবার করে দেয়। ধানের সময় অন্তত ছ'ঘন্টা মাঠে থাকে। তার এই নাতি এতটা পারবে কি না সে জানে না। তবে, নাতিটিকে হাঁসের মাংসের লোভ দেখিয়ে আবার হাঁটা শুরু করতে করতে সে বুঝতে পারল- আর কিছু পাক বা না পাক, বাবার জেদটা পেয়েছে পুরোপুরি।

পারুলের মুখ অনেকটা আঁচল দিয়ে ঢাকা। বিয়ের পর কলকাতায় এই প্রথমবার এল। আঁচলে ঢাকা কপালে মোটা করে সিঁদুর। চেহারাটা বেঁটে বেঁটে। গালে মাংস। বিয়ের সময় সুরেশ্বরের বয়স উনচল্লিশ, ওর তেইশ। বিকাশকে বলল, ছেলেটাকে একটু কোলে নে বাবা। ঢুলে পড়ছে কেমন। সেই কোন সকালে বেরিয়েছে। পারুলের আসার ইচ্ছা ছিল না। কোনও মা-ই পারে না। কিন্তু ও নিরূপায়। সংসারের কুলগুরুর নির্দেশ- যেতেই হবে। অন্তত পল্টুর মুখ চেয়ে। পল্টু থাকবে। সঙ্গে ও আর সুরেশ্বর। রাস্তা চেনে না। তারওপর মাঝরাতের ব্যাপার। তাই সঙ্গে বিকাশ।

ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, তা হয়ে গেল হপ্তাখানেক। প্রভাস ব্রিজের উল্টোদিকের একটি দোকানে কাজ করত। ওই সময় খেতে যাচ্ছিল ছেলেটা। ব্রিজের তলা দিয়ে যাচ্ছিল। খবরটা পারুলকে কে কখন প্রথম দিল, তা খেয়াল নেই। শোনার পর থেকে একটি সত্যতম আতঙ্কের ভিতর স্যাঁতসেঁতে হয়ে বসেছিল সে কঠিন ক্ল্যাসিক ভাস্কর্যের মতো। সুরেশ্বর তখন খাচ্ছিল। খবরটা শুনে খেতে খেতে ভাত পাতেই কাটা কলাগাছ হয়ে পড়ে গেল। সমস্যা হল তারপর। প্রভাসের দেহটা খুঁজে পাওয়া গেল না। অনেক নেতা-পুলিশ ধরেও কিছু হল না। পরিষ্কার বলে দেওয়া হল- দেখো, তোমাদের ছেলে কোথায় কোন মেয়েছেলে নিয়ে পালিয়েছে! নইলে এত বডি পাওয়া গেলে ওরটা পাওয়া যাবে না কেন!

ব্যাপারটা সুরেশ্বর বুঝল। সে নিজেও তো একসময় কম বডি লোপাট করেনি!

বহু জন্ম-মৃত্যু, সাপের কামড় এবং আত্মার অমরতা দিয়ে যত্ন করে তৈরি এক ভূগোলের মধ্যে বেড়ে ওঠা সুরেশ্বরের এই সময় প্রথম মনে পড়ল গুরুদেবের কথা। তখন তিনি এই নিদান দিলেন...

বিকাশ পল্টুকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। পল্টুর ঘুম নেই এখন। জামাটা খুলে ঠাকুমার হাতে দিয়ে দিয়েছে। যা গরম!

এইভাবেই কখনও কথা বলতে বলতে কখনও মৌন হয়ে শহরের একের পর এক ক্রসিং পেরিয়ে যাচ্ছিল ওরা চারজন। মাথার ওপর হঠাৎ একটা শোঁ শোঁ শব্দ পেয়ে একসঙ্গে থেমে গেল সবাই। রাস্তার আলোতে দেখা গেল- বেশ নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা সাদা পাখির দল। তাদের পা পেছনে ফেরানো, গলা এগিয়ে দেওয়া সামনের দিকে। গলার কাছটা ফিকে নস্যি রঙের। রাস্তার আলোর ছিটে লেগে সেটা সোনালি হয়ে যাচ্ছে। এগুলো কি বালিহাঁস? পল্টুর প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে না। শহরের আকাশে মধ্যরাতে এতগুলো সাদা পাখি দেখে তারা পলকহীন চেয়ে ছিল। পাখির দলটার একটা বড়ো ত্রিভুজের আকার নিয়ে পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলে উঠল বিকাশ- চলে এসেছি!

পাখি দেখতে দেখতে কখন যে ব্রিজের সামনের রাস্তায় চলে এসেছে, তা খেয়াল করেনি কেউই। ব্রিজের ভাঙা অংশের কাছে মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে গেল ওরা। তারপর উলটোদিকের ফুটপাথে বেশ খানিকক্ষণ একদম ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পল্টু কাঁধ থেকে নেমে গিয়েছে। পুরনো বাড়ির জানলার তলায় বিভিন্ন বয়সী চারটে মাথা। অল্প কাঁপা। একটু ডলে দিলেই যেন চট করে মুছে যাবে ছবিটা।

পল্টু অবাক হয়ে দেখছিল। এই ব্রিজটাই ভেঙে পড়েছিল সেদিন। এই ব্রিজটার তলাতেই চাপা পড়ে গিয়েছিল ওর বাবা! নাকি পড়েনি? তা ও জানে না। কিন্তু অনেকে তো পড়েছিল! এত বড়ো ব্রিজ! ভাবতে ভাবতে ওর চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে থাকে। ও একবার ওর থুতনিতে টোকা মারে। একবার পাছাটা চুলকে নেয়।

ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল সুরেশ্বর। সে ভাবছিল অন্য কথা। গুরুদেব বলেছিল, দেহ না পাওয়া গেলে যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে সেই জায়গার মাটি কিংবা মাটি না পেলে ধুলো হলেও চলবে,নিয়ে এসে মৃতের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। নইলে অতৃপ্ত আত্মা পিছু ছাড়বে না। যেহেতু দাহ হয়নি, তাই শ্রাদ্ধ তিনদিনে করলেও চলবে। কিন্তু মৃত্যুর একুশদিনের দিন মৃতের সন্তান এবং পিতা-মাতাকে গিয়ে মধ্যরাতে ওখানকার ধুলো বা মাটি সংগ্রহ করে আনতে হবে। ব্যাপারটা কতটা সত্যি, তা ও জানে না। কিন্তু গুরুদেবের আদেশ... সে যাই হোক, সুরেশ্বরের মনে মনে বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল- পাওয়াই যায়নি যখন, তখন কি আর কিছু হয়েছে? ! নিশ্চয়ই আছে কোথাও। হয়তো কোনও মেয়ে নিয়েই গিয়েছে! সে করুক। বেঁচে থাকলে তো ওসব করাই যায়। সে নিজেও করেছে... অথচ ব্রিজের এই ভাঙা অংশের সামনে এসে ওর মাথা ধাঁ করে ঘুরে গেল।


ভেঙে পড়া জায়গাটায় একটা শান্ত স্তব্ধ গভীর চৌকোপানা শূন্যতা। কী শূন্য! এর জন্য এতকিছু! দুদিকে ব্রিজের দুটো অংশ দাঁড়িয়ে আছে চওড়া মানুষের মতো। আসলে একটা মানুষ। পেটটা কেটে নিয়ে চলে গিয়েছে কেউ। সেদিনের ঘটনার পর গলগল করে কত বাতাস এই কাটা পেটের চৌকো অংশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গিয়েছে। এরকমভাবে তো সুরেশ্বরও কেটে দিত... কত রক্ত-কান্না-মৃত্যু; সব এখন চাপা পড়ে গিয়েছে বাতাসের তলায়। এই বড়ো অসমর্থ কাঠামোটি সেই বাতাসকে গায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসকে তো খোঁড়া যায় না। সেই কারণেই তার থেকে বড়ো কৌতূকের ব্যাপার আর কিছু নেই। খুঁড়ে ফেলা গেলে সেদিন দুপুরে তার ছেলে এই ব্রিজের তলা দিয়ে যাওয়ার আগে শেষ যে কথাটুকু বলেছিল বা শেষ যে হাসিটুকু হেসেছিল- সেসব ছুঁয়ে ফেলা যেত। ওগুলো তো সেদিনের বাতাসেই রয়েছে। কথাটা ভেবে হঠাৎ খুব আফশোস হল ওর। আহা রে! একইসঙ্গে মনে হল, এই মাঝরাতে এই চৌকোমতো শূন্যতার ভিতর দিয়েই আকাশ থেকে যখন তখন দেবতারা নেমে আসতে পারে।

পারুল ডুকরে উঠছিল। ফুটপাথে তখন ওরা দুজন। একজন কাঁদছে। আরেকজন শূন্যতার কথা ভাবা শেষ করে ভেতর থেকে বলে বসল- অদ্ভুত! অদ্ভুত!

বিকাশ ব্রিজের তলায় চলে গিয়েছে পল্টুকে নিয়ে। সেখান থেকে মাটি নেবে। এখানে তো মাটি নেই, কংক্রিট। তা তো শাস্ত্রমতে সিদ্ধ নয়। তাই কিছু ধুলোই নিয়ে নেবে।

দু'হাতে মুঠো করে ধুলো, কংক্রিট যা পাচ্ছিল, পল্টু আর বিকাশ একটা বস্তায় ভরে নিচ্ছিল। সুরেশ্বর আর পারুল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওদের সামনে। ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে ব্রিজের তলায় চলে এসেছে ওরা। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল পল্টু। ও কাকা! ওই দেখো শাহরুখ খান! উলটোদিকের একটি বাড়ির টং-এর এক বিলবোর্ড থেকে শাহরুখ খান হাসছে। পল্টুর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল বিকাশ। ব্রিজটা যদি আজ না ভাঙত তাহলে কিন্তু এখান থেকে এত সহজে দেখতে পেতিস না!

ব্রিজটা যদি না ভাঙত... বিকাশের কথাটাই ধরে নিয়ে বলতে বলতে গলাটা কেঁপে গেল পারুলের। কথাটা শেষ করতে পারল না।

ঠিক এর পরের মুহূর্তেই আচমকা একটা ঘটনা ঘটে গেল। রাস্তাটা ফাঁকাই ছিল। গাড়ি-টাড়ি নেই একদমই। মধ্যরাত এখন শেষ রাতে পৌঁছেছে। আর ঘন্টাখানেক পরই এখানে সবার ব্যস্ত গতিবিধি ও অবিরাম চেঁচামেচি একটি মেলা তৈরি করবে। সুরেশ্বর বিভোর হয়ে ওই শূন্য স্থানটির দিকেই তাকিয়েছিল। কখন যে রাস্তার মাঝে চলে এসেছে খেয়াল করেনি। বিকাশ বস্তাটা অনেকটা ভরে হাতে তুলে নিয়েছে, এমন সময়ই একটা লরি সুরেশ্বরের দিকে হুড়মুড় করে এসে পড়ল। আরে! মরে যাবে তো! বলে সুরেশ্বরের হাত ধরে জোরে টান দিল বিকাশ। ওর হাত থেকে বস্তাটা পড়ে গেল। জায়গাটাকে মুহূর্তের মধ্যে ধুলোয় ভরিয়ে দিয়ে বস্তাটাকে পিষে বেরিয়ে গেল লরিটা।

একটি স্বগত মৃত্যুর পটভূমিতে ভয়াবহ নির্জনতাকে পাশে নিয়ে হতবাক হয়ে তারপর দাঁড়িয়ে রইল ওরা। এত কাছে চলে এসেছিল! এত হঠাৎ! এইভাবেই কি সেদিনও...কেউ কোনও কথা বলতে পারছিল না। মৃত্যুর অলৌকিক অবয়বকে ঘিরে থাকা শব্দলুপ্ত মুহূর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল ভিন্ন উচ্চতার চারটে ঠান্ডা সন্ত্রস্ত লাশ। জায়গাটা ধুলোয় ঢেকে গিয়েছিল। সেই ধুলোর মধ্যেই একসময় মুছে গেল তারা। ব্রিজের হ্যালোজেনের আলো তাদের গায়ে অল্প অল্প পড়ছিল...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ