মাহবুব ময়ূখ রিশাদ'এর গল্প : নন্দিনী, নন্দিনী

তুই কি পাখি? উড়তে চাইলেই তো হবে না। কথাটা শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। 

ছুটে এসেছিলেন মা। গলায় উদ্বেগভরে বলেছিলেন, কিরে ওকে কাঁদাচ্ছিস কেন?

মামা, তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলেছিলেন, তোমার ছেলে তো উড়তে চায়। 

আমি তখন ছোট। প্রথমবার গ্রামে পাখি দেখে, মামাকে বলেছিলাম- উড়ব। মানুষ উড়তে পারে না, এই তথ্যটি নির্মমভাবে জেনে গিয়েছিলাম শৈশবে। 

এত মিথ্যে কেউ বলতে পারে? কেন বলে? এই তো আমি উড়ছি পাখির ডানায় বসে। বিশাল শরীর নিয়ে ছোট্ট পাখির ডানায় ঠিকঠাকমতো উড়ে বেড়াচ্ছি।

সাদিক, কাজটা ঠিক হচ্ছে না একেবারে। নিচ থেকে বন্ধুর কন্ঠ ভেসে আছে।

এত উপর থেকে কিছু শোনা যায় না, উঠে আয়।

বন্ধু আবার বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে, আমি ততক্ষণে একপাক ঘুরে আসি ক্যাম্পাসের আকাশ। 

বন্ধুর কথা এবার শুনতে পাই। 

তুই এই নিরীহ প্রাণীটাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন? 

চুপ থাক, ব্যাটা তুই নিজে উড়তে পারিস না দেখে ভাব নিচ্ছিস?

সাদিক বলে, শালা নিজে তো হোস্টেলের ছাদে বইসে ভাব নিতেছিস আর আমারে বলিস উল্টো কথা।

আমার সাদিকের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সব জেনেশুনে মুড নষ্ট করতে এসেছে। আমি এই মুহূর্তটা চলে যেতে দিতে পারি না।

ছাদের কার্নিশে পা দুলিয়ে বসে আছি এই সত্যটা আমি এখন অস্বীকার করতে চাই। 

ছাদের সামনে কোনো পাহাড় নেই, পাহাড়ি গাছ নেই- অথচ পাখির ডানায় বসে একটি বিশাল বৃক্ষের ডালে গিয়ে কিচির-মিচির শুরু করি নিঃসংকোচে, যেন এটাই আমার ঘর, এটাই আমার বাড়ি; কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে বউপাখিকে ডাকছি।

অনেকদিন পর এমন একটি কাজবিহীন নিশ্চিন্ত সময় পেয়ে ভীষণ ভালো হয়ে থাকা মুহূর্তে প্রথমবারের মতো সমস্যাটির মুখোমুখি হই, কানের পাশে একটা ডাক শুনতে পাই। নিশি ডাক? পাহাড়ি জংগলের ভেতর থেকে কেউ আমাকে ডাকছে, মেরে ফেলবে বলে?

ইউফোরিক পরিবেশের সাইড ইফেক্ট ভেবে তখন আর পাত্তা না দিয়ে আমার পাখিযাত্রা অবহ্যত রাখি। 

টানা প্রায় ষোল ঘন্টা, কখনো চব্বিশ ঘন্টা, কোন বিশ্রাম নেই, কাজের পর কাজ, স্যারদের বকা- এভাবে জীবন হয়?

কথাটা আজ আড্ডায় বলতেই, তুই তো ভালো ছেলে। একটু খারাপ হয়ে দেখা, গলাটা ভিজিয়ে নে। সময়টা কিভাবে যেন পার হয়ে যায়। ভোরের আলো ফুটতে দেখি। মনে হলো, মাতৃগর্ভ থেকে কোন দেবশিশু একটু একটু করে বের হচ্ছে। কখন যে ঐখানে ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই না। পরদিন সকালে নিজেকে আবিষ্কার করি বিছানায়। কেউ দিয়ে গেছে, নাকি নিজেই চলে এসেছি মনে করতে পারি না। ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাই। কেউ নেই। কালকের ঘটনা বন্ধুরা ভিডিও করে রাখতে পারে। ওদের বিশ্বাস নেই। মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাটির সম্মুখীন হই। নিজেকে এই বলে ধমক দেই, যার যেটা কাজ নয় তার সেটা করা উচিত না। আমার অনভ্যস্ত শরীরে এলকোহল ঢোকানো একদম ঠিক হয় নি। আমি তো কখনো খাই না। কেন যে খেতে গেলাম। বন্ধুদের বলা যাবে না এই ঘটনাটি। এমনিতেই মজা নিচ্ছে, এটা বললে জীবন নরক বানিয়ে ছাড়বে।

দুদিন পরেও ঘটনাটির বারবার পুনরাবৃত্তিকে পাত্তা না দিয়ে আর পারি না। 

বাতাসে-আকাশে, পথে-গৃহে নাম উড়ে বেড়াচ্ছে এমন কথা শুনিনি কখনো। নাম উড়ে বেড়াবে আবার সেই নাম ঠিক আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করবে- এইসব বিষয় নিয়ে ভাবার আমার অবকাশ কিংবা দরকার ছিল না। অথচ নন্দিনী নামটি কেবল ফিসফিস করছে না বরং সময় যত পার হচ্ছে এই নামের পুরো একজন মানুষ মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেদিন রাতে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় কেবল নামটাই গুঞ্জরিত হচ্ছিল, এরপর একটু একটু পুরো একজন মানুষের অবয়ব দাঁড়িয়ে গেল। খালি চেহারাটা স্পষ্ট নয়। মনে হচ্ছে, খুব চেনা- আমি নন্দিনী বলে ডাকলেই এসে বলবে, এতদিনে সময় হলো আমাকে ডাকার? সুতরাং, এই নন্দিনী নামের উৎস সম্পর্কে ভাবতে আমি বাধ্য হই।
নন্দিনী নামে কাউকে চিনি বলে মনে করতে পারি না। দূরবর্তী স্মৃতি ঘেটেও এই নামের কারো অস্তিত্ব পাই না। এমন হতে পারে, হয়ত কাউকে চিনতাম কিন্তু মেয়েটি সুন্দর ছিল না অথবা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি তবে নামটি সুন্দর বিধায় তাই মাথার ভেতরে গেঁথে ছিল। আজ অনেকদিন পর হয়ত অজানা কারণে মাথার ভেতরে ঘুরঘুর করছে। অজানা কারণগুলো কী হতে পারে? 

এলকোহল খেলে মন উন্মুক্ত হয়ে যায় বলে শুনেছিলাম। তবে সে তো ক্ষণিকের জন্য। আমি তো কেমিক্যাল ইমব্যালেন্সের সময় পার করে ফেলেছি। নাকি আমার ক্ষেত্রে প্রভাব দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে? এমন হতে পারে, কৈশোরে এই নামের কারো প্রেমে পড়েছিলাম। তখন ঐ মুহূর্তে মনের গোপন কুঠুরী থেকে নামটি বের হয়ে এসেছে, দীর্ঘদিন আমার নজর পায় নি বলে ডেকেই চলেছে। নাকি কোন বিখ্যাত উপন্যাসের কোনো চরিত্র? নাকি নন্দিনীকে কেউ খুঁজছে? আমার কাছে জানতে চাইছে, নন্দিনী কোথায় আছে? আমি তো গোয়েন্দা পুলিশের লোক নই, এই তথ্যটা তার কাছে পৌঁছাবো কেমন করে। বিচলিত বোধ করি।
আবার এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারি না যে, হয়ত আশেপাশে কোন বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে, যে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে, আর তার মা তাকে নন্দিনী নন্দিনী বলে ঘুম থেকে ডাকতে থাকে। আর ঘুমমিশ্রিত সকালে অবচেতনভাবে নন্দিনী নামটি আমার মনের ভেতরে গেঁথে গেছে। সব সম্ভাব্য সূত্র নিজেই পরক্ষণে বাতিল করে দেই।

কেউ একজন কানের কাছে অনবরত ডেকেই চলছে—নন্দিনী, নন্দিনী বলে। আওয়াজ অত্যন্ত ক্ষীণ, তবে স্পষ্ট বোঝা যায়। আওয়াজ স্বল্প আয়ু নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলেও কিছুক্ষণ পর আবার এসে হাজির হয়। কখন শোনা যাবে, কতক্ষণ ধরে শোনা যাবে, কতক্ষণ পর আসবে তার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম খুঁজে পাই নি অবশ্য। শুরুর দিকে বিচলিত বোধ করলেও এখন আসলে ভালো লাগে। কিছুক্ষণের জন্য শব্দটি বিশ্রামে গেলে বরং বিচলিত বোধ করি। শরীর একটু একটু করে ঘামতে থাকে। 

নন্দিনীকে খুঁজে পাওয়া গেছে? নন্দিনী ঐ লোকের কাছে চলে গেছে যে তাকে ডাকছিল? অদৃশ্য শব্দধারী মানুষের নন্দিনী প্রাপ্তির সম্ভাবনা আমাকে আহত করে। পুনরায় যখন সেই ক্ষীণ শব্দ শোনা যায়, আমি আবার আশাবাদী হয়ে উঠি। এই আশাবাদের কারণ আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। হয়ত ঐ লোকটির আগে আমি নন্দিনীকে খুঁজে পেতে চাই।

নন্দিনীকে খুঁজে পেলে কী হবে, নিজের কাছে প্রশ্ন করি। প্রথমত, এতদিনের ডাকাডাকির একটা অবসান হবে। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ আমি জানতে পারব এই নন্দিনীটা আসলে কে ছিল, আমার সাথে তার কেন এত প্রয়োজন। অবশ্য এটাও হতে পারে, নন্দিনীর আমাকে প্রয়োজন নেই বরং আমাকেই নন্দিনীর প্রয়োজন।
নন্দিনী এতদিন ধরে কোথায় আছে? সে বাসায় আছে, নিজেকে প্রবোধ দিই। যুবতী মেয়ে, এত রাতে বাইরে থাকবে কেন? এখন রাত প্রায় তিনটা। নিজের প্রবোধ নিজের কাছেই মিথ্যে লাগে।

হয়ত এত রাতে নন্দিনী সত্যি বাইরে। কত বিপদ-আপদ হতে পারে। 

আমি আরেকটি নির্ঘুম রাত কাটাবার প্রস্তুতি নেই। যদিও আমি জানি ঘুমোনোর জন্য অনেক আয়োজন করা লাগে, না ঘুমোনোর জন্য চোখের পাতা খোলা রাখাই যথেষ্ঠ। আলাদা কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। সারারাত জেগে থাকলে যা হয়- পরদিন সকালে কাজের ফাকে ঢুলতে থাকি, যে কাজ দশমিনিটে হয়ে যাবার কথা, সে কাজ করতে ঘন্টা পার হয়ে যায় আর কানের কাছে অনবরত নন্দিনী ডাক উপেক্ষা করেও থাকা যায় না; চোখ এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে, ঘাড় বাকিয়ে নামটির বাস্তব অস্তিত্বের কথা চিন্তা করে আশাবাদি হয়ে উঠি- হয়ত কাউকে দেখা যাবে। কাউকে দেখা যায় না, আমি আবার হতাশায় ডুবে যাই।
এক বন্ধুকে ডেকে নিয়ে পুরো ঘটনা বলতেই সে বলল, প্রতিদিন খাচ্ছিস? গাজা ধরছিস নাকি?
বন্ধুর এমন উত্তরে আমি মর্মাহত হই। তাকে কিছু না বলে, চুপ করে থাকি। পরদিন কাজে এসে দেখি সবাই আমার দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছে। বুঝে গেলাম, বন্ধু সবাইকে বলে বেড়িয়েছে।
ভাইয়া, নন্দিনীর খোঁজ পেলেন?
আমি হাসার চেষ্টা করি। ঠিক তখন আবার শুনতে পাই, নন্দিনী, নন্দিনী! এবারের ডাকটা আগের মতো ফিসফিস করে নয় বরং বেশ জোরের সঙ্গে শোনা যায়। আমি প্রশ্নকারির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি, সে কিছু শুনেছে কি’না। তার মুখের অবস্থার কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করি না। সে আবার প্রশ্ন করে, কী ভাইয়া, কিছু বলছেন না?
আমি আবার হাসার চেষ্টা করি। এবার বলি, পেয়ে যাব।
পার্টি দিয়েন ভাইয়া। অপেক্ষায় থাকব।
কিছুক্ষণ পর বন্ধুটিকে পেয়ে গেলাম। সে আমাকে কিছু বলার আগেই, তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কাজটা কি তুই ঠিক করলি?
আমাকে কিছু না বলে, তুই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখা। অডিটরি হ্যালুসিনেশন। বুঝিস তো? দেখ আবার সিজোফ্রেনিয়া হলো কি’না।
তার এই শ্লেষ মাখানো জবাবে আমি খুব একটা বিচলিত বোধ করি না। আমি জানি, মানসিকভাবে সুস্থ আছি। তাকে ঠান্ডা স্বরে জবাব দেই, তোর উপদেশের জন্য ধন্যবাদ।
সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর কথা উড়িয়ে দিলেও ভেতরে ভেতরে খচখচ করতে থাকে। আসলেই কী অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি? নিজের চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞান হাতড়ে দেখার পর অসুস্থতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। মনে করার চেষ্টা করি, আমাদের পরিবারে সিজোফ্রেনিয়ার আক্রান্ত কেউ আছে কি’না। মনে করতে পারি না।

স্যার, ডিসচার্জটা দিবেন না? কাল অবরোধ। সন্ধ্যার ভেতরে যাইতে না পারলে বিপদে পইড়া যামু।
রোগীর কথায় ধ্যান ভাঙ্গে।
অবরোধের কারণে রোগী কম আসে। যারাও আসে তারা ঐ অবরোধের শিকার। পোড়া হাত-পার গন্ধে বিষাক্ত হয়ে থাকা হাসপাতালে আমরা দিব্যি মানিয়ে নিয়েছি। এর বাইরেও যেসব মুমূর্ষ রোগী ঐ পুড়ে যাওয়ার ভয়ে বের হয় না বাড়ি থেকে-আমাদের অলক্ষ্যে কত অবলীলায় মরে যাচ্ছে। তাই যখন রোগীটি বলল, আমার দেরি হওয়ার কারণে সে বিপদে পড়ে যেতে পারে, নন্দিনীর উপর তখন ভীষণ রাগ হলো।
আমি তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ লিখে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। নন্দিনীর কথা সবাই জেনে গেছে। হোস্টেলে যেতে তাই ইচ্ছে করছিল না।
বাসায় ঢোকামাত্র মা বললেন, তুই নাকি কী সব শুনিস?
তোমাকে কে বলল, এই প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে যাই। প্রশ্ন এখানে অবান্তর, আমাকে উত্তর দিতে হবে। আমার কাছে উত্তর আছে, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাব? এটা মা’কে জিজ্ঞেস করব ভাবি। তবে কিছু না বলেই রুমে চলে যাই।
পিছু ছাড়েন না মা। মাথার কাছে এসে বসেন। কী হয়েছে, বলবি না?
আমার কিছু হয় নি, এই কথা বলে পার পাওয়া যায় না। আর আসলেই তো আমার কী হয়েছে? কিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ডাক, যার উৎস খুঁজে বেড়াচ্ছি-এটা কী বলার মতো কোনো ঘটনা? হ্যাঙ্গারে ঝোলানো শার্ট একটু জোরে বাতাস হলে খসখস শব্দ করে আমাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়- ভয়ে আমরা এদিক-সেদিক তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি, খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনার করার সময় বিশ্রী শব্দে হর্ন বেজে ওঠে আমাদের মনোযোগ নাড়িয়ে দেয়- বিরক্তি নিয়ে আমরা আবার বই এর পাতায় ডুবে যায়। এই নন্দিনী ডাকটি তো এমন একটা শব্দ যার কেবল উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না।

মা’কে বলতে ইচ্ছে করে, তুমি কী তোমার জীবনের সব পছন্দনীয়-অপছন্দীয় শব্দ থেকে মুক্ত হতে পেরেছ? আমি মেনে নিয়েছি মা। ঠিক তখন আবার শুনতে পাই, নন্দিনী, নন্দিনী...


২)

আমি শুধু নন্দিনীর কথা জানতে চেয়েছিলাম। জানতে চাওয়া কথাটি নিঃসন্দেহে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা যায়। জানতে চাওয়া মানে কী নন্দিনীর সবকিছু জেনে ফেলা? নন্দিনী কিভাবে খায়, কিভাবে ঘুমায়, ঘুম থেকে কিভাবে আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে ওঠে? আমি জানি না। নাকি কেবল নন্দিনী কে এটাই জানতে চেয়েছিলাম কিংবা চাই?

মাঝে মনে হয় নিজের কথাই ভুলে যাই- অনেকটা গভীর রাতে বুকের উপর নিজের হাত দেখে চমকে ওঠা অথবা হ্যাঙ্গারে ঝোলানো কোনো শার্ট দেখে ভৌতিক কোনো কিছু আছে ভেবে চিৎকার দিয়ে ওঠার মতো। বড় হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় ঝামেলাগুলো মনে হয় এটাই- যখন তখন আর চিৎকার দেয়া যায় না। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠে চুপচাপ বসে থাকতে হয়। শেভ করা হয় না অনেকদিন। নিজেকে দেখে তাই ভয় পেয়ে চুপচাপ বসে আছি। আজ ডিউটি যেতে ইচ্ছে করছে না। ছোটবেলায় স্কুলে না যেতে চাইলে পেট ব্যথা বলে বিছানায় গড়াগড়ি খেলেই কাজ হয়ে যেত। এখন সমস্ত জীবন নিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি- তবু কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না। কিন্তু আজ হাসপাতালে যেতেই হবে। হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে একদিন যে সব রোগী মারা যায়, তারা কেন মারা গেল এই নিয়ে রিভিউ হয়, না থাকার কোনো উপায় নেই। যেতে যেতে দেরি হয়ে যায়। আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। আমি আলোচনায় মন না দিয়ে পেছনে চুপচাপ বসে থাকি। কয়েকজন আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। আবার চোখের দিকে চোখ পড়তেই গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে।

স্যারের কথা থেকে টুকরো একটি শব্দ কানে আসে। ৬৫ পারসেন্ট বার্ন। এরপর তিনি আরো কিছু বলছিলেন, আমি শুনতে পারছিলাম না। সবকিছুর মাঝে থেকেও স্তব্ধ হয়ে যাওয়া বোধহয় একেই বলে।
এই তো নির্বাচনের পরদিন ডিউটি ছিল আমার। রাতে- ঘুমিয়ে আছে সবাই। আমি ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ঠিক তখন রোগীটা এলো। প্রায় পুরো শরীর পুড়ে গেছে। নববধু- দুই দিন আগেই বিয়ে হয়েছিল। আমি গিয়ে দেখি প্রাণ নেই। স্বামীটি আমাকে বলছিল, স্যার ভোট দিতে গেসি দেখে পুড়াই দিসে। তখন অনেকদিন পর এক পুরোনো বন্ধু ফেসবুকে নক করেছিল। আমি ডিউটি রুমে চলে এসে ওয়ার্ড বয়কে দিয়ে খবর পাঠাই। বন্ধুর সঙ্গে চ্যাট করতে করতে লিখতে থাকি ডেথ সার্টিফিকেট। এই ফাঁকে লোকটা আসে, আমাকে নন্দিনীর ছবি দেখায়।

দেখেন স্যার, ছবিটা দেখেন। কত সুন্দর, আমার বউটা। আমি ছবিটির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। এই সুন্দর মানুষটাকে আর চেনা যাচ্ছে না, এই সুন্দর মানুষটা আর নেই। সেই সময়ে আমাকে একেবারেই বিচলিত করে নি।
মেয়েটির স্বামী তাকে ডাকছিল, ডেকেই যাচ্ছিল নন্দিনী, নন্দিনী বলে...
ফোন এসেছে এই ভান করে উঠে দাঁড়াই। বের হয়ে আসি।

কত মানুষ মারা যায়, কত ডেথ সার্টিফিকেট লিখি। কই কখনো তো এমন হয় নি। নন্দিনীর কথা জানতে চেয়ে কেবল তার বিদায়ের কথা জানতে পেরেছি। আজ আমি স্পষ্ট করে বুঝে যাই- কিছু কিছু ডেথ সার্টিফিকেট হয়ত লিখতে হয় সমস্ত জীবন ধরে। 

আমি চিৎকার দিয়ে বলি, নন্দিনীকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আমার কলিগেরা অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। 

এভাবে তাকে পাওয়া না গেলেই হতো, আমি নিজের মতো করে বানিয়ে নিতাম।

মামা বলেছিলেন, পাখি হওয়া যায় না। আমি উড়েছিলাম। পৃথিবী বলেছে, কল্পনা সত্যি হয় না। আমি সত্যি ধরে নিতাম। 

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসি। রাত হয়ে গেছে। অগোছালো রাত্রিতে একটি রিকশার সন্ধানে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েও কোনো রিকশা চোখে পড়ে না। বাড়ি ফেরার পথকে অনেক দীর্ঘ মনে হতে থাকে। রিকশা নেই, মোড়ে পরিচিত ফুচকার দোকান বন্ধ, টং এর দোকানে টিমটিমে আলো জ্বলছে;কেবল কোনো মানুষ নেই। কোনো এপার্টমেন্টে আলো জ্বলছে না। আজ পুরো শহর একসঙ্গে ঘুমোতে চলে গেল? এমন কী কখনো হয়, সবাই একসঙ্গে চলে যায় আবার একসঙ্গে ফিরে আসে? নাকি কেউ কেউ কখনোই আর ফেরে না? আমার চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে। আর যদি কখনো না ফেরা লাগত এই পরিচিত পথ ধরে হাসপাতালের কিংবা বাড়ির রাস্তায়! কানের কাছে নন্দিনী ডাকটাও বন্ধ হয়ে গেছে। 

যাবেন নাকি কোথাও?

যাব? চলেন যাই, কই যাবেন নিয়ে যাই।

আমি বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। সবাই ঘুমিয়ে আছে? এই রিকশা-ওয়ালা কেন জেগে আছে? তাও ঘামছে দরদর করে।আপনি তো বেশ ঘামছেন? চালাবেন কী করে?

আরে, মামা কী যে বলেন! আমি আর কী ঘামতেসি! নিজের দিকে তাকায়ে দেখেন। পুরা শার্ট তো একেবারে ত্যানা হয়ে গেছে। চলেন যাই। রিকশায় বসে তাকে প্রশ্ন করি, সারা শহর আজ অনেক ক্লান্ত। সবাই বাড়িতে। আপনি কেন বাইরে?

রিকশা-ওয়ালা জবাব দেয় না। তাকে আমার বলা হয় নি কোথায় যেতে হবে! তবু সে প্যাডেল চালাতে থাকে।সে বোধহয় বুঝে গেছে, এই ঘুমন্ত নগরীতে আমার কোনো স্থান নেই।

রিকশা এসে কোন এক অজানা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।

লাল শাড়ি পড়ে, মাথায় ঘোমটা দেয়া তরুণী বের হয়ে আসে।

আসেন, ভেতরে আসেন।

তুমি নন্দিনী? তুমি বেঁচে আছ?

নন্দিনী হাসতে শুরু করে। হাসিতে কোন শব্দ নেই। শব্দহীন হাসিতে ঝিমিয়ে থাকা অন্ধকার শহর যেন পুরো আলোকিত হয়ে যায়। 

আমি সম্মোহিত হয়ে ওর সাথে এগোতে থাকি। 

তোমার স্বামী কোথায়?

নাই। কাজে বাইরে গেছে।

বাসার সামনে গিয়ে থেমে যায়। স্বামী বাসায় নেই। এত গভীর রাতে অচেনা তরুণীর ঘরে যাওয়া ঠিক হবে?

আমি আমতা আমতা করে বলি, আজ যাই।

নন্দিনী আমার কথা শুনে না, আয় না ভেতরে আয়। দেখে যা আমাকে। সেদিন তো অনেক ব্যস্ত ছিলি, ভালো করে দেখতে পেরেছিলি, বল? আয়, তোকে দেখাব, আজ তোকে সব দেখাব হ্যাঁচকা টানে সে আমাকে ঘরে নিয়ে যায়। 


নন্দিনী ঘোমটা ওঠায়। পুড়ে যাওয়া চেহারা দেখে ওকে জড়িয়ে ধরি। এছাড়া আর কিছুই করার থাকে না আমার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. amazing!the story and writing are spontaneous and mesmerizing! <3

    উত্তরমুছুন
  2. দারুণ চলছিলো গল্পটা। শেষটায় নন্দিনী'র হাত ধরে টানাটানি আর 'তুই' সম্বোধনে একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হতে না হতেই মিলিয়ে গেলো। শেষটা অন্যরকম হতে পারতো। শুভকামনা।

    উত্তরমুছুন