রেলাইন ছাড়িয়ে কতদূরে ময়ূরাক্ষী ? আরও কত দূরে ?
কাঁকর-ছড়ানো মাটি। অসুর-মুণ্ডের মতো ছোট-বড় টিবি ছড়িয়ে আছে আচক্রবাল। যেন প্রাগৈতিহাসিক কোনও এক রণক্ষেত্রের স্মরণ-চিহ্ন এই মাঠ। কোনও কোনও টিবির ওপরে লক্ষ্মীছাড়া চেহারার এক আধটা খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে ত্ৰিভঙ্গ ভঙ্গিতে। হাঁপানি রোগীর গলায় অতিকায় মাদুলির মতো এক একটা হাঁড়ি ঝুলছে কোনও-কোনটাতে। রুক্ষ মাটির যা শ্রী--এক ফোঁটাও রস গড়ায় বলে মনে হয় না।
ক্যানভাসার শ্রীসুধাংশু চক্রবর্তী, হাল সাকিন বারোর সাত ছকু খানসামা লেন, জিলা--কলিকাতা--একবার থমকে দাঁড়াল। এ জেলায় এই তার প্রথম আবির্ভাব। শুনেছিল ময়ূরাক্ষী পার হয়ে--একটা শাল-পলাশের বন ছাড়ালেই ব্রজপুর গ্রাম। ময়ূরাক্ষী নদী, শাল-পলাশের বন, গ্রামের নাম ব্রজপুর। তিনটে একসঙ্গে মিলে মনের মধ্যে একটা কল্পলোক গড়ে উঠেছিল দস্তুর মতো। সুধাংশু চক্রবর্তী কল্পনাতে আরও খানিক জুড়ে নিয়েছিল এদের সঙ্গে সঙ্গে। হোক শীতকাল, থাকুক চারদিকে শস্যহীন মৃত্যুপাণ্ডুতা--তবু ব্রজপুর এদের চাইতে অনেকখানি আলাদাই হবে নিশ্চয়। তার গাছে গাছ কোকিল ডাকতে থাকবে, ফুলের গন্ধ বয়ে বেড়াবে বাতাস, তার মাঠে মাঠে শ্যামলী ইত্যাদি ধেনুরা চরে বেড়াবে। বেণু বাজবে এবং সন্ধে হলেই শ্বেতচন্দন ঘষা একখানি পাটার মতো পূর্ণচাঁদ উঠে আসবে আকাশে।
কিন্তু কোথায় কী!
আপাতত মাঠ আর মাঠ। দেড় বছরের পুরনো জুতোটা নতুন জুতোর মতো মচ্ মচ্ আওয়াজ করছে তলার কঠিন কাঁকরে। এদিকে কি ডালভাঙ্গা ক্রোশ ? তিন মাইল পথ যে আর ফুরোয় না।
সামনেই ছোট খাল একটা। রাস্তাটা তার মধ্যে গিয়ে নেমে পড়েছে অনেকখানি ঢালুতে। হোক মরা খাল--তবু তো এতক্ষণে জলের দেখা পাওয়া গেল। মনে হচ্ছিল, সে বুঝি বোখারা-সমরখন্দের কোনও মরুভূমির ভেতর দিয়ে পথ হাঁটছে।
একটা গরুর গাড়ি ছপ্ছপিয়ে উঠে এল খাল পেরিয়ে। চাকা থেকে তরল কাদা গলে গলে পড়ছে তার। গাড়োয়ান সাঁওতাল। খোলা ছাঁইয়ের ভেতরে রুপোর হাঁসুলিপরা একটি কালো মেয়ে বসে আছে--নিবিড় চোখের স্নিগ্ধ দৃষ্টি মেলে সে তাকাল সুধাংশুর দিকে। এক ফালি জলের সঙ্গে একটি তরল দৃষ্টি যেন সুধাংশুর সারা শরীরটাকে জুড়িয়ে দিলে।
-ভাই, ময়ূরাক্ষী কতদূর ?
গাড়ির ভেতরে মেয়েটি হেসে উঠল। গাড়োয়ান আপাদ-মস্তক লক্ষ করে দেখল সুধাংশুর। বিদেশী।
বললে, এটাই তো ময়ূরাক্ষী নদী।
--অ্যাঁ! এই নদী ।
কয়েক বছর আগে যে সুধাংশু চক্রবর্তী বাস করত মেঘনা নদীর ধারে এবং অধুনা বাস্তুহারা হয়ে সে বারোর সাত ছকু খানসামা লেনে বাসা বেঁধেছে, তার পক্ষে এটা শোনবার মতো খবর বটে! নদী এর নাম! এবং কাব্য করে একেই বলা হয় ময়ূরাক্ষী ।
কিন্তু বিস্ময়টা ঘোষণা করে শোনাবার মতো কাছাকাছি কেউ ছিল না। গরুর গাড়িটা ততক্ষণে বাঁধের মতো উচু রাস্তাটার ওপরে উঠে গেছে--শুধু খোলা ছইয়ের মধ্য থেকে দেখা যাচ্ছে সাঁওতাল মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে এখনও।
আপাতত নদী পার হতে হচ্ছে তা হলে।
খেয়া পাড়ি দেবার সমস্যা নেই--সীতারও দিতে হবেনা। এক হাতে জুতো, আর এক হাতে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে ধরলেই চলবে। সুধাংশুও তাই করল। পায়ের তলায় কিছু দলিত শ্যাওলা, ভাঙা ঝিনুকের টুকরো আর এঁটেল কাদা অতিক্রম করে সে ওপারে পৌঁছল। জুতোটা একরকম করে পরা গেল বটে, তবে পায়ের গোড়ালিতে আঠার মতো চটচট করতে লাগল।
নদী তো মিটল। এবারে শাল-পলাশের বন ?
সেও কাছাকাছিই ছিল, কিন্তু এর নাম বন? গোটা কয়েক মাঝারি ধরনের গাছ দাঁড়িয়ে আছে জড়াজড়ি করে। সুসঙ্গের পাহাড়ে-দেখা নিবিড় মেঘবর্ণ অরণ্য স্বপ্নের মতো ভেসে গেল চোখের সামনে দিয়ে। এটা পার হলেই ব্রজপুর। সুধাংশুর কল্পনা ফিকে হতে শুরু করেছে।
ব্রজধামই বটে, তবে শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পরে।
লালমাটির দেওয়াল--কিংবা টিনের চাল। খান দুই নোনা ধরা দালান। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের চারিদিকে অজস্র পোড়ামাটির ছোট ছোট ঘোড়া। ও জিনিসটা সুধাংশু আগেই চিনেছে--ধর্মঠাকুরের ঘোড়া এগুলো |
কিন্তু ঘোড়া জ্যান্তই হোক আর মাটিরই হোক সে কখনও কথা কয় না এবং যুগের মাহাত্ম্যে ধর্মঠাকুর সম্প্রতি নির্বাক। পতিতপাবনী এম ই স্কুলের হেড়মাস্টার নিশাকর সামন্তের হদিশটা পাওয়া যাবে কার কাছ থেকে? কাছাকাছি কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। দুপুরের রোদে গ্রামটা ঘুমিয়ে আছে যেন ।
আরও দু পা এগোতেই একটি ছোট দোকান।
তোলা উনুনে খোলা চাপিয়ে একটি লোক খাই ভাঁজছে। বাঁশের খুন্তি দিয়ে নাড়ছে। গরম বালি। পট্-পট্ করে ধান ফুটছে--মল্লিকা ফুলের মতো শুভ্র খইয়ের দল খোলা থেকে ছিটকে ছিটকে পড়ছে চারপাশে।
সুধাংশু তাকেই নিবেদন করল প্রশ্নটা।
—স্কুল ?—দু তিনটে বিদ্রোহী খইয়ের আঘাতে মুখখানাকে বিকৃত করে লোকটা বললে, এগিয়ে যান সামনে। লাল রঙের বাড়ি। ওপরে টিনের চাল। বাঁক ঘুরলেই দেখতে পাবেন।
এ বাঁকটা আর ডালভাঙা ক্রোশ নয়। --কাছাকাছিই ছিল এবং টিনের চালওয়ালা লাল রঙের বাড়িটাও আর বিশ্বাসঘাতকতা করল না। আশায়-আনন্দে উৎসুক পা চালিয়ে দিলে সুধাংশু। “দি গ্রেট ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং কোম্পানির” মালিক অক্ষয়বাবু আগেই চিঠি দিয়েছেন নিশাকর সামন্তকে। দু'জনে কীরকম একটা বন্ধুত্ব আছে। নিশাকর সামন্ত তার ওখানে সুধাংশুকে আশ্রয় দেবেন এবং তারই বাড়িতে দিন চারেক থেকে আশেপাশের স্কুলগুলোতে বইয়ের ক্যানভাস করবে সুধাংশু। স্কুলের দর্শন পেয়ে তাই স্বভাবতই প্রসন্ন হযে উঠল মনটা। অর্থাৎ থাকবার জায়গা পাওযা যাবে, কিছু খাদ্য জুটবে এবং হাত-পা ছড়িয়ে আরামে ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে ঘ্ণ্টা কয়েক!
স্কুলে টিফিন পিরিয়ড চলছে খুব সম্ভব। বাইরে দাপাদাপি করছে একদল ছোট ছোট ছেলে। একটা টিনের সাইনবোর্ডে কাত হয়ে ঝুলছে স্কুলের নাম। ‘প’টা মুছে গেছে--মনে হচ্ছে অতীতপাবনী।
জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়ে যাওয়া বারান্দাটা পার হয়ে সুধাংশু এসে ঢুকল টিচার্স রুমে। খান কয়েক কাঠের চেয়ার--মাঝখানে একটা লম্বা টেবিল। কাচভাঙা আলমারিতে ছেড়া- খোঁড়া খান ত্রিশেক বই, র্যাকে সাজানো গোটা কয়েক ম্যাপ। আলমারির মাথা থেকে তিন-চারখানা বেতের ডগা উঁকি মারছে। আর এই দীনতার ভেতরে সম্পূর্ণ বেমানানভাবে শোভা পাচ্ছে দেওয়ালে একটি সুহাসিনী সুন্দরী মহিলার মস্ত একখানা অয়েলপেইন্টিং। খুব সম্ভব উনিই পতিতপাবনী।
ঘরে পা দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সুধাংশু। কলাইকরা বড় একখানা থালায় একটি লোক তেল আর চীনে বাদাম দিয়ে মুড়ি মাখছে প্ৰাণপণে। খুব সম্ভব দপ্তরী। ছ'জোড়া চোখ লোলুপভাবে তাকিয়ে আছে তার হাতের দিকে। টিফিনের ব্যবস্থা।
সুধাংশু একবার গলা খাঁকারি দিলে।
ছ’জন মানুষ একসঙ্গে ফিরে তাকালেন। শীর্ণকান্তি জীর্ণদেহ ছ’টি খাঁটি স্কুল--মাস্টার। আসন্ন টিফিনের ব্যাপারে ব্যাঘাত পড়ায় স্পষ্ট অপ্রীতি ফুটে উঠেছে তাদের চোখে।
সমবেত ছ'জনের উদ্দেশ্যেই কপালে হাতটা ঠেকাল সুধাংশু। তারপর বললে, নমস্কার। আমি কলকাতা থেকে আসছি।
ততক্ষণে তার কাঁধে কলেজ-স্কোয়ারের শীতোদর ছিটের ঝোলাটি চোখে পড়েছে সকলের।
একজন চশমাটা নাকের নীচের দিকে ঠেলে নামালেন খানিকটা। বিরসমূখে বললেন, বইয়ের এজেন্ট তো?
--আজ্ঞে হ্যাঁ।
-বসুন। একটু।
একটা খালি টিনের চেয়ার ছিল একটেরোয়। সুধাংশু বসতেই ঠক-ঠক করে দুলে উঠল বারকয়েক। একটা পায়া একটু ছোট আছে খুব সম্ভব।
--আমি নিশাকার বাবুর কাছে এসেছিলাম—কলাই করা থালায় মুড়ি মাখবার শব্দটা সুধাংশুর অস্বস্তিকর মনে হতে লাগল।
--হেড়মাস্টারমশাই?- -প্রথম সম্ভাষণ যিনি করেছিলেন, তিনিই বললেন, তিনি তিন মাসের ছুটিতে দেশে আছেন। তার খুড়িমা মারা গেছেন। শ্রাদ্ধ-শান্তি সেরে তারপর বিষয়-সম্পত্তির কী সব ঝামেলা মিটিয়ে তবে ফিরে আসবেন।
চমকে উঠল সুধাংশু। ঢোক গিলিল একটা।
- -দিন চারেক আগে আমাদের পাবলিশার অক্ষয়বাবুকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন--
একটা প্লেটে করে খানিক মুড়ি নিজের দিকে টেনে নিয়ে আর একজন বললেন, সেটা নিশ্চয় রি-ডাইরেক্টেড হয়ে সাঁইথিয়ায় চলে গেছে--আপনি ভাববেন না।
না, ভাবনার আর কী আছে! মুড়ি চিবোনোর শব্দে সুধাংশু আবার ঢোক গিলল। মধ্যদুপুরের তীব্র ক্ষুধা এতক্ষণে পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠেছে তার। নিশাকরবাবুর বাড়িতে থাকার এবং খাওয়ার কথা লিখেছিলেন অক্ষয়বাবু--এই দুপুরেও অন্তত দুটি ভাতের একটা নিশ্চিত আশা মনের মধ্যে জেগেছিল তার। সুধাংশু এতক্ষণে বাস্তবভাবে অনুভব করল --ব্রজপুর সত্যিই অন্ধকার। তার কানু মথুরায় নয়--সাঁইথিয়ায় বিদায় নিয়েছেন।
কিছু ভাবতে না পারার আচ্ছন্নতায় সুধাংশু ঝিম ধরে বসে রইল কতক্ষণ। কী অদ্ভুত লোলুপভাবে যে মুড়ি খাচ্ছে লোকগুলো! একজন আবার টুকটুকে একটা পাকা লঙ্কায় কামড় দিচ্ছে--সুধাংশুর শুকনো জিভের আগায় খানিকটা লালা ঘনিয়ে এল। রিফ্লেক্স অ্যাকশন ! আঃ-অত শব্দ করে অমনভাবে চিবোচ্ছে কেন ওরা ? ওদের খাওয়া কি শেষ হবে না কখনও ?
আর থাকা যায় না। ওই একটানা শব্দটা অসহ্য।
- -বই দেখবেন না ?
-হাঁ-হাঁ নিশ্চয়।-- তিন চারজন ঘাড় ফেরালেন। মুড়ির পাত্রগুলো শূন্য হয়ে যাচ্ছে দ্রুতবেগে। দুজন উঠে গেলেন হাত ধুতে।
- -এই দেখুন--মুড়ি ছড়ানো টেবিলটার ওপরেই একরাশ বই ছড়িয়ে দিলে সুধাংশু ।
--ওঃ ! গ্রেট ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং ? আপনাদের অনেকগুলো বই তো আমাদের রয়েইছে মশাই ৷
-- ধুতির কোঁচায় হাত মুছে একজন একটা বই তুলে নিলেন : ‘জ্ঞানের আলো’, ‘স্বাস্থ্য সমাচার', “ভূগোলের গল্প'-- সবই তো আছে আমাদের।
--এবারেও যাতে থাকে, সেইজন্যেই আসা--অনুগত বিনয়ে সুধাংশু হাত কচলাল : তাছাড়া আমাদের নতুন ট্রানশ্লেসনের বইটা দেখেননি বোধ হয় ? বাই কে-পি পাঁজা, এম-এ, বি-টি, হেডমাস্টার, বামুনপুকুর এইচ-ই স্কুল- -
--হুঁ!
--বাড়িয়ে বলছি না স্যার, বাজারের যে কোনও চল্তি বইয়ের সঙ্গে একবার মিলিয়ে দেখুন। সিমপ্লেস্ট প্রোসেস্, নতুন নতুন আইটেম, একটা ওয়ার্ডবুকও আছে সঙ্গে--
ঠং ঠং করে ঘণ্টা বাজল। অবশিষ্ট টিচারেরা গোগ্রাসে মুড়ি শেষ করলেন।
প্রথম লোকটি হাই তুললেনঃ আপনি আপাতত এই এরিয়ায়ই তো আছেন ? কাল তা হলে একবার দশটার দিকে আসুন। তখনই কথাবার্তা হবে। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার--এবার আমার ওপরেই ভার। আচ্ছা--নমস্কার--নমস্কার। --
অগত্যা থলের মধ্যে বইগুলো পুরে সুধাংশু উঠে পড়ল।
আসুন। অর্থাৎ আবাহন নয়--বিসর্জন। আপনি যান, কিন্তু যাওয়া যায় কোথায় ?
গ্রামটা যখন মাঝারি, তখন জেলা বোর্ডের একটা ডাকবাংলো কোথাও থাকলেও থাকতে পারে,
কিন্তু এই জীর্ণ চেহারার দীন ক্যানভাসার--চৌকিদার কি আমল দেবে ? আর যদি বা থাকতেও দেয়--খাওয়া ছাড়াও দৈনিক দুটো টাকা চার্জ তো নির্ঘাত। স্কুল বইয়ের ক্যানভাসারের পক্ষে দৈনিক দু টাকা দিয়ে ডাকবাংলোয় থাকা আর বারোর সাত ছকু খানসামা লেন থেকে চৌরঙ্গির ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠা--এ দুইয়ের মধ্যে প্রভেদ নেই কিছু।
অতএব ব্রজধাম ছেড়ে আবার স্টেশনের দিকে যাত্রা ? উহু, সেও অসম্ভব। এ এরিয়াতে আশেপাশে পাঁচ-ছটা স্কুল রয়েছে। তাদের বাদ দিয়ে চলে গেলে নিস্তার নেই। অক্ষয়বাবু ঠিক টের পেয়ে যাবেন, এবং অক্ষয়বাবু কড়া লোক।
ক্ষিদেয় পেটের নড়িগুলো দাপাদাপি করছে। সেই খইয়ের দোকানটাকে মনে পড়ল। কয়েকটা কালো ছিটধরা চাঁপা কলাও ঝুলতে দেখেছিল সেখানে। কিঞ্চিৎ ফলারের ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়।
শুধু চাঁপা কলা নয়, মোষের দুধও ছিল এবং একটু মোদো-গন্ধধরা ভেলিগুড়। পনেরো পয়সায় খাওয়াটা নেহাত মন্দ হল না। আচমকা সুধাংশুব মনে হল, এমন খই-কলার ফলার কাছাকাছি থাকতে দুপুরবেলা খানিক শুকনো মুড়ি কেন চিবিয়ে মরে মাস্টারেরা ?
শীতের নরম রোদ। পেটে খাবার পড়ে গা এলিয়ে আসছে। একটু শুতে পারলে হত।
কাছেই ধর্মঠাকুরের বটগাছ। ছিমছাম জায়গাটি। দেবতার স্থান, অতএব সর্বজনীন সম্পত্তি। এখানে হত্যে দেবার নাম করে খানিকক্ষণ গড়িয়ে নিলে কেউ আপত্তি করবে না নিশ্চয়। যা ভাবা--তাই কাজ। ব্যাগের ভেতর থেকে সন্তর্পণে ভাজ করা র্যাপারটা সে বের করে আনল। পথে বিছানাটা এক জায়গায় রেখে এসে ভারী ভুল করেছে সে। নিশাকারবাবুর ওখানে বিছানা নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই--বন্ধু লোক।--অক্ষয়বাবু বুঝিয়েছেন।
ফিরেই যেতে হবে। থানা গাড়তে হবে তিন মাইল দুরের স্টেশনেই । ওখান থেকে যতটা "এরিয়া’ কভার করা যায়। ব্যাগটা মাথায় দিয়ে বটগাছের তলায় শুয়ে পড়ল সুধাংশু। ধর্মঠাকুরের মাটির ঘোড়াগুলো কেমন পিটি-পিট করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
কতক্ষণ ?
--ও মশাই--কত ঘুমুবেন ? উঠুন--উঠুন--
ঘোড়াগুলো ডাকছে নকি ? সুধাংশু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
--আপনি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন, আর আমি আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। নিন--চলুন এবার--
ঘোড়া নয়। একটি মানুষ এবং স্কুলের একজন মাস্টার।
-কেন বলুন তো ?
সুধাংশুর মনে পড়ল, এই লোকটিকেই টিচার্স রুমে বসে মুড়ির সঙ্গে কঁচা লঙ্কা চিবুতে দেখেছিল সে।
মাস্টার মিটি-মিটি হাসলেন : আছে মশাই, ব্যাপার আছে। সাধে কী আর এসেছি--ওপরওলার হুকুমে।
-ওপরওলার হুকুম --সুধাংশু বিস্থিত হয়ে বললে, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ?
--ছেঃ !--মাস্টার উত্তেজিত হয়ে উঠলেনঃ ওকে কে পরোয়া করে মশাই ? সেক্রেটারির কুটুম বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হয়েছে--নইলে ওর বিদ্যে তো ম্যাট্রিক অবধি। গুণের মধ্যে খালি সেক্রেটারির কান ভারী করতে পারে। আমিও শশধর বাড়ুয্যে মশাই--আই-এ পাশ করেছি, হেডমাস্টারের লেখাতে ভুল ধরেছি। দু-দুবার। গজেন বিশ্বাসকে আমি গ্রাহ্যও করি না।
--তবে কার তলব ? থানার দারোগার নয় তো --এবার ভয়ে সুধাংশুর গলা বুজে এল।
—দারোগা আবার কেন ?
—শশধর বাডুয্যে হা-হা করে হেসে উঠলেন : আপনি কি চোর ডাকাত ? দারোগা নয়--ম্যাজিস্ট্রেট ডেকেছে। চলুন।
ম্যাজিস্ট্রেট! রহস্য অতল!
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুধাংশু উঠে পড়ল।
এবং কী আশ্চর্য--যেতে হল ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে নয়, শশধর বাড়ুয্যের বাড়িতে।
বাড়ি রাস্তার ধারেই। সামনে একটি ফুলের বাগান। লাল মাটির দেওয়াল আর টিনের চাল। একটি ছোট ধানের মরাই আর এক পাশে।
বাইরের ঘরে ঢুকেই সুধাংশু থমকে গেল। শশধর বাড়ুয্যের বাড়িতে এতখানি আশা তার ছিল না।
একখানি তক্তপোষের ওপরে পরিষ্কার একটি সুজনী পাতা। শাদা কাপড়ে ঢাকা একটি টেবিল এবং পাশে একটি চেয়ার। আর সবচেয়ে আশ্চর্য--টেবিলের ওপরে কোনাভাঙা সস্তা একটি কাচের ফুলদানিতে সপত্র একগুচ্ছ গন্ধরাজ। এই শীতকালে গন্ধরাজ!
কিন্তু গন্ধরাজের চাইতেও বিস্ময়কর অভ্যর্থনার এই আয়োজনটা। মনে হচ্ছে--সুধাংশুর সম্মানেই ঘরখানাকে এমন করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেন কনে দেখতে এসেছে সে। শশধর বললেন, বসুন, আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে ডাকছি।--বলেই আবার হেসে উঠলেন হা-হা করে। তারপর পা বাড়ালেন ভেতরের দিকে।
সুধাংশু থ হয়ে রইল। এ আবার কোন পরিস্থিতি ! একটা দুর্বোধ্য নাটকের মতো ঠেকাছে সব। অসময়ের গন্ধরাজের একটা মৃদু সৌরভ রহস্যলোক সৃষ্টি করতে লাগল তার চারদিকে।
—মন্টুদা--চিনতে পারছি না ?--কপালের ওপর ঘোমটাটা একটুখানি সরিয়ে শ্যামবর্ণ একটি তরুণী মেয়ে ঢুকল ঘরে। হাসিতে মুখখানা উজ্জ্বল।
তটস্থ হয়ে সুধাংশু উঠে দাঁড়াল। মন্টুদা--কে মন্টুদা ?
- -দেখুন, আমি তো আপনাকে- -
--চিনতে পারোনি--না ? কিন্তু আমি তোমাকে দূর থেকে দেখেই চিনেছি। সকলের চোখকে ফাঁকি দিতে পারো--কিন্তু আমাকে নয়। কেমন ধরে আনলাম--দেখো।
একটা ভুল হচ্ছে--মারাত্মক ভুল। বলবার চেষ্টায় বার দুতিন হাঁ করল সুধাংশু ।
—আহা-হা, আর চালাকি করতে হবে না। তোমাকে আমি জব্দ করতে জানি। বেশি দুষ্টুমি করো তো সব ফাঁস করে দেব--মেয়েটি মৃদু হাসল : দাঁড়াও--তার আগে তোমার চা করে আনি। দিনে এখনও সে পনেরোবার চা খাওয়ার অভ্যাসটি আছে তো ? না--রত্নার শাসনে এখন কমেছে একটু?
রত্না ? এবার আর হাঁ-টা সুধাংশু বন্ধ করতে পারল না।
--ঐ দেখো, সাপের মুখে চুন পড়ল!--মেয়েটিসকৌতুকে হেসে উঠল।
গায়ে একটা জামা চড়িয়ে শশধর ফিরে এলেন। মেয়েটি একটুখানি নামিয়ে আনল মাথার ঘোমটা।
শশধর বললেন, তুমি তা হলে চায়ের ব্যবস্থা করো ওঁর জন্যে। আমি একবার ঘুরে আসি বাগ্দিপাড়া থেকে। দেখি বিল থেকে দু চারটি কই মাছ ওরা ধরে এনেছে কিনা।
--দেখুন শশধর বাবু--
---পরে দেখব মশাই। এখন সময় নেই--
শশধর বেরিয়ে গেলেন।
মেয়েটি হাসলঃ পালাবার ফন্দি ? ও হবে না। অনেকদিন পরে ধরেছি তোমাকে। এখন চুপ করে বসে। আমি চা আনছি --
অতঃপর আবার সেই বিব্রত প্রহর যাপনের পালা সুধাংশুর। এ কী হচ্ছে--এ কোথায় এল সে। মন্টুদা বলে তার কোনও নাম আছে একথা সে এই প্রথম শুনল । এবং রত্না । সেইই বা কে ? বারোর সাত ছিকু খানসামা লেনে যে তার ঘর আলো করে রয়েছে, তাকেও তো সে এতকাল নিভাননী ওরফে বুলু বলেই জানত । একটা ভুল হচ্ছে--ভয়ঙ্কর ভুল।
ভুলটা ভেঙে দিয়ে এই মুহুর্তে তার ভদ্রলোকের মতো সরে পড়া উচিত।
কিন্তু -
কিন্তু চা আসছে এবং এ-সময় এক কাপ চায়ের নিমন্ত্রণ তুচ্ছ করবার মতো মূঢ়তাকে সে প্রশ্রয় দিতে রাজি নয়। চা-টা খাওয়া শেষ হলেই এক ফাঁকে ঝোলাটা কাঁধে করে সে উঠে পড়বে। তারপর এক দৌঁড়ে শালবন ছাড়িয়ে ময়ূরাক্ষী পার হতে আর কতক্ষণ।
সামনে ফুলদানি থেকে গন্ধরাজের মৃদু সৌরভ ছড়াচ্ছে। শীতের ফুল । সমস্ত ঘরে একটা রহস্যময় আমেজ ছড়িয়ে রেখেছে। পড়ন্ত বেলায় ঘরময় শীতল ছায়া ঘনাচ্ছে। মশার গুঞ্জন উঠেছে। র্যাপারটা গায়ে জড়িয়ে সুধাংশু অভিভূতের মতো বসে রইল।
ভেতর থেকে গরম ঘিয়ের গন্ধ আসছে। খাবার তৈরি হচ্ছে- -এবং নিশ্চয় তারই সম্মানে। সুধাংশুর মুখে আবার লালাজমে উঠল। রিফ্লেক্স অ্যাকশন! খই জিনিসটা লঘুপাক, কিন্তু চাপাকলা আর মোষের দুধও যে এমন অবলীলাক্রমে হজম হয়ে যায়--সে রহস্যই বা কার জানা ছিল। চায়ের প্রলোভনটা আরও শক্ত পাকে জড়িয়ে ধরল ঘিয়ের গন্ধ। রাত্রে স্টেশনের হোটেলে তো জুটবে ঢ্যাড়শ-চচ্চড়ি আর কড়াইয়ের ডাল--এক টুকরো মাছ যদি পাওয়া যায়, তার স্বাদ মনে হবে পিস্বোর্ডের মতো। তার চাইতে এখান থেকে যথাসাধ্য রেশন নিয়ে নেওয়া যাক। হোক ভ্রান্তিবিলাস, তবু ধরে নেওয়া যাবে এটা বাংলা দেশের পুরনো আতিথেয়তার নমুনা মাত্র।
গন্ধরাজের সৌরভ ছাপিয়ে লুচির গন্ধ আসছে। সুধাংশু প্রতীক্ষা করে বসে রইল। একটু পরেই এক হাতে সধুম লুচির থালা, আর একহাতে লণ্ঠন নিয়ে ঢুকল মেয়েটি।
--এত কেন?
--খাওয়ার জন্য।--মেয়েটি হাসল : নাও--আর ভদ্রতা কোরো না। সামনেই গাড়ু-গামছা রয়েছে--ধুয়ে নাও হাতমুখ।
যা হওয়ার হোক। এস্পার কি ওস্পার । মেঘনার ধারের সুধাংশু চক্রবর্তী আর বিস্মিত হবে না ঠিক করল। দেশ ছেড়ে উর্ধ্বশ্বাসে পালানোর চরম বিস্ময়টাকেই যখন রপ্ত করতে হয়েছে--তখন শিশিরে আর ভয় নেই তার।
-- বেপরোয়া হয়ে লুচি-বেগুন ভাজায় মনোনিবেশ করল সে।
মেয়েটি পাশে দাঁড়িয়েছিল, আস্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
- -কত রোগা হয়ে গেছ আজকাল!
শুনে রোমাঞ্চ হয় যে সুধাংশুও একদিন মোটা ছিল!
মেয়েটি বললে, সেই দশ বছর আগে যখন রত্নাকে নিয়ে পালিয়েছিলে, সেদিন কত কথাই উঠেছিল গ্রামে, কিন্তু আমি তো জানতাম--যা করেছ, ভালই করেছ!
রত্নাকে নিয়ে পালানো। হে ভগবান, রক্ষা করো! সুধাংশুর গলায় লুচি আটকে আসতে লাগল। তাদের হেড্মাস্টার থাকলে এখন সাক্ষী দিয়ে বলতেন, স্কুলে বরাবর গুড কণ্ডাক্টের প্রাইজ পেয়েছে সে!
--কাকিমা তো অগ্নিমূর্তি!- -মেয়েটির চোখে স্মৃতির দূরত্ব ঘনিয়ে আসতে লাগল : আমাকে এসে বললেন, কণা, তুই দুঃখ পাসনি। ওর কপালে অনেক শাস্তি আছে--দেখে নিস্। সত্যি বলছি মন্টুদা--বিশ্বাস করো আমাকে। আমি খুশি হয়েছিলাম। জাত বড় নয়--রত্না সত্যিকারের ভাল মেয়ে। আর তোমাকেও তো জানি। প্রাণে ধরে রত্নাকে তুমি কখনও দুঃখ দেবে না।
আহা, এই কথাগুলো যদি বুলু শুনত! তার ধারণা, স্বামী হিসেবে যে বস্তুটি তার কপালে জুটেছে, পুরুষের অপদার্থতম নমুনা হচ্ছে সেইটিই।
--সত্যি, রত্নার কষ্ট চোখে দেখা যেত না। সৎমা কী অত্যাচারই করত ওর ওপরে। কতদিন খেতে পর্যন্ত দেয়নি। তবু মেয়েটা মুখ ফুটে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি কখনও। এমন ঠাণ্ডা লক্ষ্মী মেয়ে আর হয় না। জাতটা কিছু নয় মন্টুদা--জীবনে সত্যিই তুমি জিতেছ।
অজানা-অদেখা রত্নার জন্যে এবারে সুধাংশুরও দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মনে পড়ে গেল, ঝগড়া করবার আগে কোমরে হাত দিয়ে বুলুর সেই দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা। লুচির থালা শেষ হতে সয় লাগল না।
—আর দুখানা এনে দিই মন্টুদা ?
--না-না-সর্বনাশ !
কণা বলে চলল, তোমার চেহারা বদলেছে মন্টুদা--কত ভারী হয়েছে গলার আওয়াজ। তবু আমি কি ভুল করতে পারি ? সেই চোখ, সেই কেঁকড়া চুল, সেই মুখের আদল, সেই হাঁটাবার ভঙ্গি। বাড়ির সামনে দিয়ে যখন ধর্মখোলার দিকে চলে যাচ্ছিলে, তখনই আমি চিনে ফেললাম । তারপর উনি যখন স্কুল থেকে ফিরে এসে বললেন যে, কলকাতা থেকে বইয়ের এজেন্ট এসেছে, তখনই আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না। এখনও তো সেই বইয়ের কাজই করছ ?
- -হু!--সংক্ষিপ্ততম উত্তরই সব চেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা।
- -শোনো--কণার গলার স্বর নিচু হয়ে এল ; আমি ওকে বলেছি, তুমি সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই। --কণা অর্থগভীর হাসি হাসলত : তুমি কিন্তু আসল ব্যাপারটা ফাঁস করে দিয়ো না--কেমন ?
—না-না। --সুধাংশু আন্তরিকভাবে মাথা নাড়ল : তা কখনও বলতে পারি। তাহলে আজ বরং উঠি আমি। রাত হয়ে যাচ্ছে--আমাকে আবার স্টেশনে যেতে হবে।
—বা রে, ভেবেছ কী তুমি ? এমনি ছেড়ে দেব ? ওঁকে মাছ আনতে পাঠালাম--দেখলে না ?
আমার রান্না খেতে তুমি কত ভালবাসতে—এরই মধ্যে ভুলে গেলে? ও সব হবে না। যাও দেখি--কেমন যেতে পারো।
- -কিন্তু বিছানপত্র কিছু সঙ্গে নেই--
কণা গরিব হতে পারে, কিন্তু তোমাকে শুতে দেবার মতো একখানা লেপ আর একটা বালিশ তার জুটবে। বেশি ভদ্রতা কোরো না আমার সঙ্গে-- বুঝেছ?
বুঝেছে বৈকি সুধাংশু। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই প্রতারকের একটা চমৎকার ভূমিকায় নেমে পড়েছে সে। এখন আর সহজে পালাবার উপায় নেই। শশধর তাকে কখনওই দেখেনি এবং কণা তাকে মিন্টুদা বলে প্রমাণ করার জন্যে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ। অতএব জালিয়াতিটা অন্তত আজ রাতে ধরা পড়বে না। কাল ভোরেই তাকে পালাতে হবে- -এবং এ এরিয়া ছেড়ে। তারপরে অক্ষয়বাবু রইলেন আর সে রইল।
বাগানে টিনের গেট খুলে কে ভেতরে ঢুকল। পাওয়া গেল চটির আওয়াজ।
শশধর ফিরে এলেন। হাতের বাঁধা ন্যাকড়াটার মধ্যে উত্তেজিত দাপাদাপি চলছে। উল্লসিত হয়ে শশধর বললেন, অতিথি-সেবার পুণ্যে আজ ভাল মাছ পাওয়া গেল। কণা! দশটা বড় বড় কই।
কণার মুখ হাসিতে ভরে উঠল।
--মন্টুদার ভারী প্রিয় মাছ। মনে আছে মন্টুদা--রেলের বাঁধের তলা থেকে একবার তুমি আর আমি ছিপ দিয়ে এক কুড়ি কই ধরেছিলাম ? তারপর বাড়িতে ফিরে মার হাতে সে কী পিট্টি ।
শশধর সস্নেহ হাঁসি হাসলেন। ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারটায় : ভাই বোনে মিলে খুব দুষ্টুমি হত বুঝি? তা বেশ, কিন্তু শিবেনবাবুকে এখনও চা দাওনি ?
শিবেনবাবু ! সুধাংশু আর একবার ঢোক গিলল। নিজের নামটা প্রায় অষ্টোত্তর শতনামের গণ্ডিতে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে।
--তুমি আসবে বলেই দেরি করছিলাম।
--দাও--দাও।--শশধর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন : বিকেলের চা-তো এখনও জোটেনি ওঁর। কুটম মানুষ--বদনাম গাইবেন।
--মণ্টুদা খুব ভাল ছেলে--কারও বদনাম করে না--কণা ভেতরে চলে গেল।
খাওয়ার দিক থেকে কিছুমাত্র ত্রুটি হল না। বারোর সাত ছকু খানসামা লেনের সুধাংশু চক্রবর্তী এমন টাট্কা কই মাছ চোখে দেখেনি দেশ ছাড়বার পরে। এ অঞ্চল নাকি কাঁকরের জন্যে বিখ্যাত, কই চালে তো একটি দানা কাঁকরেরও সন্ধান পাওয়া গেল না!
শশধর গল্প করলেন অজস্র। দেশের কথা, স্কুলের কথা। যোগ্যতায় বি-এ ফেল হেড়মাস্টার নিশাকর সামন্তের পরেই তার স্থান--এ কথাও ঘোষণা করলেন বার বার। শুধু সেক্রেটারির কুটুম ওই গজেন বিশ্বাস! মামার জোরেই অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার--নইলে একটা ইংরেজি সেনটেন্সও কারেক্ট করে লিখতে জানে নাকি ?
--আপনাকে ভাবতে হবে না মশাই। আপনি আমার কুটুম--গ্রেট ইণ্ডিয়ানের সব বই আমি ধরিয়ে দেব স্কুলে। ও দায়িত্বটা এখন আমার ওপরেই ছেড়ে দিন।
বাইরে কনকনে শীতের রাত। ভারী হাওয়ায় অসময়ের গন্ধরাজের গন্ধ। মাটির দেওয়ালে কেরোসিনের আলোর কাঁপনলাগা ছায়া। বিমিশ্র অনুভূতি বিজড়িত একটা স্তব্ধ মন নিয়ে সুধাংশু আধশোয়া হয়ে রইল লেপের মধ্যে। আশ্চর্য । জীবনটা এত আশ্চর্য--কে জানত ।
মন্টুদা ?
কণা ঘরে ঢুকল।
--জেগেই আছি। শশধর বাবু কী করছেন ?
--ওঁর তো এখন মাঝ-রাত। পড়া আর মড়া। শুনছ না-- নাক ডাকছে ?--কণা খিল্-খিল্ করে হেসে উঠল : ওই নাকের ডাকের ভয়ে পাড়ায় চোর আসতে পারে না।
সুধাংশু অপ্রতিভের মতো হাসল। টেবিলের পাশ থেকে চেয়ারটা নিয়ে বসল কণা। কিছুক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগল লণ্ঠনের বাড়ানো কমানো চাবিটা। কিছু একটা বলতে চায়--বলতে পারে না।
সুধাংশু সংকুচিত হয়ে আসতে লাগল মনের ভেতরে। আড় চোখে একবার তাকিয়ে দেখল কণার দিকে। এক কালে সুশ্রীই ছিল মুখখানা। এখন পরিশ্রম আর চিন্তার একটা ম্লান আবরণ ছড়িয়ে পড়েছে তার ওপরে।
তারপর :
একটা কথা বলব ভাবছি মন্টুদা। বলব কিনা বুঝতে পারছি না।
--বলো। অতি সংকোচের কী আছে ?
--না, তোমার কাছে সংকোচের আমার কিছুই নেই। --কণা ভেতরের দিকে মাথা ফিরিয়ে একবার কী দেখল,যেন কান পেতে শুনল শশধরের নাকের ডাকটা। তারপর মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসল : রত্না অমন করে মাঝখানে এসে না দাঁড়ালে তোমার ঘরে হাঁড়ি ঠেলার ব্যবস্থাই যে আমার পাকা হয়ে গিয়েছিল সে কথা কি তুমি ভুলে গেলে ?
সুধাংশু শিউরে উঠল। লণ্ঠনের আলোয় আশ্চর্য দেখাচ্ছে কণার চোখ। ঘন বর্ষার মেঘের মতো কী যেন টলমল করছে সেখানে। কণা বললে, ভয় নেই। তুমি ভেবো না--আমি রাগ করেছি। আমি তো জানি রত্না কত ভাল মেয়ে- -কণার চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল বুকের ওপর : আমি সুখে আছি, খুব সুখে আছি মন্টুদা!--
-- আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেলে কণা আবার হেসে উঠল। শ্রাবণের মেঘ-রৌদ্রের লীলার মতো তার হাসি-কান্না দেখতে লাগল সুধাংশু । কণা বলে চলল, দশ বছর পরে দেখা, ভেবেছিলাম, কথাটা বলা ঠিক হবে না। তারপব ভেবে দেখলাম, পৃথিবীতে তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলতে পারি।--গলার স্বর নামিয়ে কণা বললে, মন্টুদা, কুড়িটা টাকা দেবে আমাকে ?
কুড়ি টাকা! ক্যানভাসার সুধাংশু চক্রবতী সভয়ে নড়ে উঠল। আঁচলের গিট থেকে একটা চিঠি বের করলে কণা। বললে, এইটে পড়ো।
সুধাংশু বিমূঢ়ের মতো হাত বাড়িয়ে নিল চিঠিখানা। বোলপুর থেকে কোন এক বিনু চিঠি দিযেছে দিদিকে। তার ম্যাট্রিকের ফি এ মাসেই দিতে হবে।--দিদি যেন একটা ব্যবস্থা করে দেয়।
হতবাক হয়ে চিঠিটার দিকে সে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ ।
- -অবাক হয়ে গেলে তো ? দশ বছর আগে যে ছোট বিনুকে দেখেছিলে, সে আর ছোটটি নেই। ম্যাট্রিক দেবে এবার। ভাল ছেলে--ভাল করেই পাশ করবে। অথচ ফিয়ের টাকা নিয়ে মুশকিল। বাবার অবস্থা তো সবই জানো--কোনমতে আধাপেটা খেয়ে আছেন। অথচ এদের কাছেও চাইতে পারিনা। নিজেরই সংসার চলেনা, তবু বাবাকে যখন পারেন দু পাঁচটাকা পাঠান। এই কুড়িটা টাকার জন্যে ওঁকে আর কী ভাবে চাপ দিই বলো ?
সুধাংশু তেমনি নির্বাক হয়ে রইল। কোমল গভীর গলায় কণা বললে, একদিন তোমার কাছে সবই আমার চাইবার দাবি ছিল মন্টুদা। আজ সেই সাহসেই কথাটা বলতে পারলাম। রত্নাকে আমি সবই তো দিয়েছি--কণার চোখে জল চকচক করতে লাগলঃ মোট কুড়িটা টাকাও কি আমি চাইতে পারব না?
অভিনেতা সুধাংশুর কাছে অভিনয়টা কখন সত্যি হয়ে উঠল সে নিজেই জানে না। তেমনি গভীর গলায় সেও বললে, নিশ্চয় কণা--নিশ্চয়। বালিশের তলায় রাখা মানিব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল।
--এখুনি- -কণা বললে, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি কলকাতা গিয়েও বিনুকে পাঠিয়ে দিতে পারো। ঠিকানাটা নিয়ে যাও বরং।
ব্যাগটা বের করে এনে সুধাংশু বললে, না--না। অঢেল কাজ নিয়ে থাকি, কলকাতায় গিয়ে ভুলে যেতে কতক্ষণ ? টাকাটা তুমিই রাখো কণা।
শীতের হাওয়ায় ঘরে গন্ধরাজের মৃদু সুরভি। দেওয়ালে ছায়া কাঁপছে। আশ্চর্য তরল কণার চোখ। জল গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু এবার আর সে তা মুছতে পারল না।
শাল-পলাশের বনে ভোরের কুয়াশা। পায়ের তলায় শিশিরভেজা ধুলো। ময়ূরাক্ষী আর
কতদূরে ?
ঠাণ্ডা নরম রোদে--শালের পাতায় সোনালি ঝিকিমিকি দেখতে দেখতে আর মন্থর পা ফেলে চলতে চলতে হঠাৎ ক্যানভাসার সুধাংশু চক্রবতীর মনে হল--অভিনয়টা সত্যি সত্যি করেছে কে --সে--না কণা? কে বলতে পারে, এই পরিচয়ের ছদ্মবেশটা কুড়িটা টাকা আদায় করার এক চক্রান্ত কিনা?
কিন্তু তা হলে কি এত মিষ্টি লাগত গন্ধরাজের গন্ধটা? এই সকালে কি এত সুন্দর দেখাত এ শাল-পলাশের বন? আর সামনে--সামনে ওই তো ময়ূরাক্ষী। ময়ূরের চোখের মতোই সোনা আলো-ছড়ানো কী অপরূপ নীল ওর জল।
এই কুড়িটা টাকার হিসেব সহজে বোঝানো যাবে না ব্যবসায়ী অক্ষয়বাবুকে। এ এরিয়ার কাজ সবই তো পড়ে রইল। আর অক্ষয়বাবু কড়া লোক।
এর ঋণ শোধ করতে হবে এক মাস রেশন না এনে,কণার চোখের জলের দাম শোধ করে দিতে হবে বুলুকে। পিঠের বোঝাটার কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল সুধাংশুর। এত বই--রাশি রাশি বই শুধু চিনির বলদের মতো বয়েই বেড়ায় সে--তার নিজের ছেলের কর্পোরেশনের স্কুলে পড়ার খরচ জোটে না। তবু একজন তো ম্যাট্রিকের ফি দিতে পারবে--একজন তো কৃতী হতে পারবে জীবনে।
কুড়িটা টাকার চেয়ে ঢের বেশি সত্য বুকের পকেটে এই গন্ধরাজ দুটো। অসময়ের ফুল। কাচের ফুলদানিটা থেকে চুরি করে এনেছে সুধাংশু--পালিয়ে এসেছে ভোরের অন্ধকারে। যে অন্ধকারে ব্রজপুর একটা স্বপ্নমাধুরী নিয়ে পেছনে পড়ে রইল ।
সামনে ময়ূরাক্ষী। কী আশ্চর্য নীল সোনালি ওর জল ।
কাঁকর-ছড়ানো মাটি। অসুর-মুণ্ডের মতো ছোট-বড় টিবি ছড়িয়ে আছে আচক্রবাল। যেন প্রাগৈতিহাসিক কোনও এক রণক্ষেত্রের স্মরণ-চিহ্ন এই মাঠ। কোনও কোনও টিবির ওপরে লক্ষ্মীছাড়া চেহারার এক আধটা খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে ত্ৰিভঙ্গ ভঙ্গিতে। হাঁপানি রোগীর গলায় অতিকায় মাদুলির মতো এক একটা হাঁড়ি ঝুলছে কোনও-কোনটাতে। রুক্ষ মাটির যা শ্রী--এক ফোঁটাও রস গড়ায় বলে মনে হয় না।
ক্যানভাসার শ্রীসুধাংশু চক্রবর্তী, হাল সাকিন বারোর সাত ছকু খানসামা লেন, জিলা--কলিকাতা--একবার থমকে দাঁড়াল। এ জেলায় এই তার প্রথম আবির্ভাব। শুনেছিল ময়ূরাক্ষী পার হয়ে--একটা শাল-পলাশের বন ছাড়ালেই ব্রজপুর গ্রাম। ময়ূরাক্ষী নদী, শাল-পলাশের বন, গ্রামের নাম ব্রজপুর। তিনটে একসঙ্গে মিলে মনের মধ্যে একটা কল্পলোক গড়ে উঠেছিল দস্তুর মতো। সুধাংশু চক্রবর্তী কল্পনাতে আরও খানিক জুড়ে নিয়েছিল এদের সঙ্গে সঙ্গে। হোক শীতকাল, থাকুক চারদিকে শস্যহীন মৃত্যুপাণ্ডুতা--তবু ব্রজপুর এদের চাইতে অনেকখানি আলাদাই হবে নিশ্চয়। তার গাছে গাছ কোকিল ডাকতে থাকবে, ফুলের গন্ধ বয়ে বেড়াবে বাতাস, তার মাঠে মাঠে শ্যামলী ইত্যাদি ধেনুরা চরে বেড়াবে। বেণু বাজবে এবং সন্ধে হলেই শ্বেতচন্দন ঘষা একখানি পাটার মতো পূর্ণচাঁদ উঠে আসবে আকাশে।
কিন্তু কোথায় কী!
আপাতত মাঠ আর মাঠ। দেড় বছরের পুরনো জুতোটা নতুন জুতোর মতো মচ্ মচ্ আওয়াজ করছে তলার কঠিন কাঁকরে। এদিকে কি ডালভাঙ্গা ক্রোশ ? তিন মাইল পথ যে আর ফুরোয় না।
সামনেই ছোট খাল একটা। রাস্তাটা তার মধ্যে গিয়ে নেমে পড়েছে অনেকখানি ঢালুতে। হোক মরা খাল--তবু তো এতক্ষণে জলের দেখা পাওয়া গেল। মনে হচ্ছিল, সে বুঝি বোখারা-সমরখন্দের কোনও মরুভূমির ভেতর দিয়ে পথ হাঁটছে।
একটা গরুর গাড়ি ছপ্ছপিয়ে উঠে এল খাল পেরিয়ে। চাকা থেকে তরল কাদা গলে গলে পড়ছে তার। গাড়োয়ান সাঁওতাল। খোলা ছাঁইয়ের ভেতরে রুপোর হাঁসুলিপরা একটি কালো মেয়ে বসে আছে--নিবিড় চোখের স্নিগ্ধ দৃষ্টি মেলে সে তাকাল সুধাংশুর দিকে। এক ফালি জলের সঙ্গে একটি তরল দৃষ্টি যেন সুধাংশুর সারা শরীরটাকে জুড়িয়ে দিলে।
-ভাই, ময়ূরাক্ষী কতদূর ?
গাড়ির ভেতরে মেয়েটি হেসে উঠল। গাড়োয়ান আপাদ-মস্তক লক্ষ করে দেখল সুধাংশুর। বিদেশী।
বললে, এটাই তো ময়ূরাক্ষী নদী।
--অ্যাঁ! এই নদী ।
কয়েক বছর আগে যে সুধাংশু চক্রবর্তী বাস করত মেঘনা নদীর ধারে এবং অধুনা বাস্তুহারা হয়ে সে বারোর সাত ছকু খানসামা লেনে বাসা বেঁধেছে, তার পক্ষে এটা শোনবার মতো খবর বটে! নদী এর নাম! এবং কাব্য করে একেই বলা হয় ময়ূরাক্ষী ।
কিন্তু বিস্ময়টা ঘোষণা করে শোনাবার মতো কাছাকাছি কেউ ছিল না। গরুর গাড়িটা ততক্ষণে বাঁধের মতো উচু রাস্তাটার ওপরে উঠে গেছে--শুধু খোলা ছইয়ের মধ্য থেকে দেখা যাচ্ছে সাঁওতাল মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে এখনও।
আপাতত নদী পার হতে হচ্ছে তা হলে।
খেয়া পাড়ি দেবার সমস্যা নেই--সীতারও দিতে হবেনা। এক হাতে জুতো, আর এক হাতে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে ধরলেই চলবে। সুধাংশুও তাই করল। পায়ের তলায় কিছু দলিত শ্যাওলা, ভাঙা ঝিনুকের টুকরো আর এঁটেল কাদা অতিক্রম করে সে ওপারে পৌঁছল। জুতোটা একরকম করে পরা গেল বটে, তবে পায়ের গোড়ালিতে আঠার মতো চটচট করতে লাগল।
নদী তো মিটল। এবারে শাল-পলাশের বন ?
সেও কাছাকাছিই ছিল, কিন্তু এর নাম বন? গোটা কয়েক মাঝারি ধরনের গাছ দাঁড়িয়ে আছে জড়াজড়ি করে। সুসঙ্গের পাহাড়ে-দেখা নিবিড় মেঘবর্ণ অরণ্য স্বপ্নের মতো ভেসে গেল চোখের সামনে দিয়ে। এটা পার হলেই ব্রজপুর। সুধাংশুর কল্পনা ফিকে হতে শুরু করেছে।
ব্রজধামই বটে, তবে শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পরে।
লালমাটির দেওয়াল--কিংবা টিনের চাল। খান দুই নোনা ধরা দালান। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের চারিদিকে অজস্র পোড়ামাটির ছোট ছোট ঘোড়া। ও জিনিসটা সুধাংশু আগেই চিনেছে--ধর্মঠাকুরের ঘোড়া এগুলো |
কিন্তু ঘোড়া জ্যান্তই হোক আর মাটিরই হোক সে কখনও কথা কয় না এবং যুগের মাহাত্ম্যে ধর্মঠাকুর সম্প্রতি নির্বাক। পতিতপাবনী এম ই স্কুলের হেড়মাস্টার নিশাকর সামন্তের হদিশটা পাওয়া যাবে কার কাছ থেকে? কাছাকাছি কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। দুপুরের রোদে গ্রামটা ঘুমিয়ে আছে যেন ।
আরও দু পা এগোতেই একটি ছোট দোকান।
তোলা উনুনে খোলা চাপিয়ে একটি লোক খাই ভাঁজছে। বাঁশের খুন্তি দিয়ে নাড়ছে। গরম বালি। পট্-পট্ করে ধান ফুটছে--মল্লিকা ফুলের মতো শুভ্র খইয়ের দল খোলা থেকে ছিটকে ছিটকে পড়ছে চারপাশে।
সুধাংশু তাকেই নিবেদন করল প্রশ্নটা।
—স্কুল ?—দু তিনটে বিদ্রোহী খইয়ের আঘাতে মুখখানাকে বিকৃত করে লোকটা বললে, এগিয়ে যান সামনে। লাল রঙের বাড়ি। ওপরে টিনের চাল। বাঁক ঘুরলেই দেখতে পাবেন।
এ বাঁকটা আর ডালভাঙা ক্রোশ নয়। --কাছাকাছিই ছিল এবং টিনের চালওয়ালা লাল রঙের বাড়িটাও আর বিশ্বাসঘাতকতা করল না। আশায়-আনন্দে উৎসুক পা চালিয়ে দিলে সুধাংশু। “দি গ্রেট ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং কোম্পানির” মালিক অক্ষয়বাবু আগেই চিঠি দিয়েছেন নিশাকর সামন্তকে। দু'জনে কীরকম একটা বন্ধুত্ব আছে। নিশাকর সামন্ত তার ওখানে সুধাংশুকে আশ্রয় দেবেন এবং তারই বাড়িতে দিন চারেক থেকে আশেপাশের স্কুলগুলোতে বইয়ের ক্যানভাস করবে সুধাংশু। স্কুলের দর্শন পেয়ে তাই স্বভাবতই প্রসন্ন হযে উঠল মনটা। অর্থাৎ থাকবার জায়গা পাওযা যাবে, কিছু খাদ্য জুটবে এবং হাত-পা ছড়িয়ে আরামে ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে ঘ্ণ্টা কয়েক!
স্কুলে টিফিন পিরিয়ড চলছে খুব সম্ভব। বাইরে দাপাদাপি করছে একদল ছোট ছোট ছেলে। একটা টিনের সাইনবোর্ডে কাত হয়ে ঝুলছে স্কুলের নাম। ‘প’টা মুছে গেছে--মনে হচ্ছে অতীতপাবনী।
জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়ে যাওয়া বারান্দাটা পার হয়ে সুধাংশু এসে ঢুকল টিচার্স রুমে। খান কয়েক কাঠের চেয়ার--মাঝখানে একটা লম্বা টেবিল। কাচভাঙা আলমারিতে ছেড়া- খোঁড়া খান ত্রিশেক বই, র্যাকে সাজানো গোটা কয়েক ম্যাপ। আলমারির মাথা থেকে তিন-চারখানা বেতের ডগা উঁকি মারছে। আর এই দীনতার ভেতরে সম্পূর্ণ বেমানানভাবে শোভা পাচ্ছে দেওয়ালে একটি সুহাসিনী সুন্দরী মহিলার মস্ত একখানা অয়েলপেইন্টিং। খুব সম্ভব উনিই পতিতপাবনী।
ঘরে পা দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সুধাংশু। কলাইকরা বড় একখানা থালায় একটি লোক তেল আর চীনে বাদাম দিয়ে মুড়ি মাখছে প্ৰাণপণে। খুব সম্ভব দপ্তরী। ছ'জোড়া চোখ লোলুপভাবে তাকিয়ে আছে তার হাতের দিকে। টিফিনের ব্যবস্থা।
সুধাংশু একবার গলা খাঁকারি দিলে।
ছ’জন মানুষ একসঙ্গে ফিরে তাকালেন। শীর্ণকান্তি জীর্ণদেহ ছ’টি খাঁটি স্কুল--মাস্টার। আসন্ন টিফিনের ব্যাপারে ব্যাঘাত পড়ায় স্পষ্ট অপ্রীতি ফুটে উঠেছে তাদের চোখে।
সমবেত ছ'জনের উদ্দেশ্যেই কপালে হাতটা ঠেকাল সুধাংশু। তারপর বললে, নমস্কার। আমি কলকাতা থেকে আসছি।
ততক্ষণে তার কাঁধে কলেজ-স্কোয়ারের শীতোদর ছিটের ঝোলাটি চোখে পড়েছে সকলের।
একজন চশমাটা নাকের নীচের দিকে ঠেলে নামালেন খানিকটা। বিরসমূখে বললেন, বইয়ের এজেন্ট তো?
--আজ্ঞে হ্যাঁ।
-বসুন। একটু।
একটা খালি টিনের চেয়ার ছিল একটেরোয়। সুধাংশু বসতেই ঠক-ঠক করে দুলে উঠল বারকয়েক। একটা পায়া একটু ছোট আছে খুব সম্ভব।
--আমি নিশাকার বাবুর কাছে এসেছিলাম—কলাই করা থালায় মুড়ি মাখবার শব্দটা সুধাংশুর অস্বস্তিকর মনে হতে লাগল।
--হেড়মাস্টারমশাই?- -প্রথম সম্ভাষণ যিনি করেছিলেন, তিনিই বললেন, তিনি তিন মাসের ছুটিতে দেশে আছেন। তার খুড়িমা মারা গেছেন। শ্রাদ্ধ-শান্তি সেরে তারপর বিষয়-সম্পত্তির কী সব ঝামেলা মিটিয়ে তবে ফিরে আসবেন।
চমকে উঠল সুধাংশু। ঢোক গিলিল একটা।
- -দিন চারেক আগে আমাদের পাবলিশার অক্ষয়বাবুকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন--
একটা প্লেটে করে খানিক মুড়ি নিজের দিকে টেনে নিয়ে আর একজন বললেন, সেটা নিশ্চয় রি-ডাইরেক্টেড হয়ে সাঁইথিয়ায় চলে গেছে--আপনি ভাববেন না।
না, ভাবনার আর কী আছে! মুড়ি চিবোনোর শব্দে সুধাংশু আবার ঢোক গিলল। মধ্যদুপুরের তীব্র ক্ষুধা এতক্ষণে পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠেছে তার। নিশাকরবাবুর বাড়িতে থাকার এবং খাওয়ার কথা লিখেছিলেন অক্ষয়বাবু--এই দুপুরেও অন্তত দুটি ভাতের একটা নিশ্চিত আশা মনের মধ্যে জেগেছিল তার। সুধাংশু এতক্ষণে বাস্তবভাবে অনুভব করল --ব্রজপুর সত্যিই অন্ধকার। তার কানু মথুরায় নয়--সাঁইথিয়ায় বিদায় নিয়েছেন।
কিছু ভাবতে না পারার আচ্ছন্নতায় সুধাংশু ঝিম ধরে বসে রইল কতক্ষণ। কী অদ্ভুত লোলুপভাবে যে মুড়ি খাচ্ছে লোকগুলো! একজন আবার টুকটুকে একটা পাকা লঙ্কায় কামড় দিচ্ছে--সুধাংশুর শুকনো জিভের আগায় খানিকটা লালা ঘনিয়ে এল। রিফ্লেক্স অ্যাকশন ! আঃ-অত শব্দ করে অমনভাবে চিবোচ্ছে কেন ওরা ? ওদের খাওয়া কি শেষ হবে না কখনও ?
আর থাকা যায় না। ওই একটানা শব্দটা অসহ্য।
- -বই দেখবেন না ?
-হাঁ-হাঁ নিশ্চয়।-- তিন চারজন ঘাড় ফেরালেন। মুড়ির পাত্রগুলো শূন্য হয়ে যাচ্ছে দ্রুতবেগে। দুজন উঠে গেলেন হাত ধুতে।
- -এই দেখুন--মুড়ি ছড়ানো টেবিলটার ওপরেই একরাশ বই ছড়িয়ে দিলে সুধাংশু ।
--ওঃ ! গ্রেট ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং ? আপনাদের অনেকগুলো বই তো আমাদের রয়েইছে মশাই ৷
-- ধুতির কোঁচায় হাত মুছে একজন একটা বই তুলে নিলেন : ‘জ্ঞানের আলো’, ‘স্বাস্থ্য সমাচার', “ভূগোলের গল্প'-- সবই তো আছে আমাদের।
--এবারেও যাতে থাকে, সেইজন্যেই আসা--অনুগত বিনয়ে সুধাংশু হাত কচলাল : তাছাড়া আমাদের নতুন ট্রানশ্লেসনের বইটা দেখেননি বোধ হয় ? বাই কে-পি পাঁজা, এম-এ, বি-টি, হেডমাস্টার, বামুনপুকুর এইচ-ই স্কুল- -
--হুঁ!
--বাড়িয়ে বলছি না স্যার, বাজারের যে কোনও চল্তি বইয়ের সঙ্গে একবার মিলিয়ে দেখুন। সিমপ্লেস্ট প্রোসেস্, নতুন নতুন আইটেম, একটা ওয়ার্ডবুকও আছে সঙ্গে--
ঠং ঠং করে ঘণ্টা বাজল। অবশিষ্ট টিচারেরা গোগ্রাসে মুড়ি শেষ করলেন।
প্রথম লোকটি হাই তুললেনঃ আপনি আপাতত এই এরিয়ায়ই তো আছেন ? কাল তা হলে একবার দশটার দিকে আসুন। তখনই কথাবার্তা হবে। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার--এবার আমার ওপরেই ভার। আচ্ছা--নমস্কার--নমস্কার। --
অগত্যা থলের মধ্যে বইগুলো পুরে সুধাংশু উঠে পড়ল।
আসুন। অর্থাৎ আবাহন নয়--বিসর্জন। আপনি যান, কিন্তু যাওয়া যায় কোথায় ?
গ্রামটা যখন মাঝারি, তখন জেলা বোর্ডের একটা ডাকবাংলো কোথাও থাকলেও থাকতে পারে,
কিন্তু এই জীর্ণ চেহারার দীন ক্যানভাসার--চৌকিদার কি আমল দেবে ? আর যদি বা থাকতেও দেয়--খাওয়া ছাড়াও দৈনিক দুটো টাকা চার্জ তো নির্ঘাত। স্কুল বইয়ের ক্যানভাসারের পক্ষে দৈনিক দু টাকা দিয়ে ডাকবাংলোয় থাকা আর বারোর সাত ছকু খানসামা লেন থেকে চৌরঙ্গির ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠা--এ দুইয়ের মধ্যে প্রভেদ নেই কিছু।
অতএব ব্রজধাম ছেড়ে আবার স্টেশনের দিকে যাত্রা ? উহু, সেও অসম্ভব। এ এরিয়াতে আশেপাশে পাঁচ-ছটা স্কুল রয়েছে। তাদের বাদ দিয়ে চলে গেলে নিস্তার নেই। অক্ষয়বাবু ঠিক টের পেয়ে যাবেন, এবং অক্ষয়বাবু কড়া লোক।
ক্ষিদেয় পেটের নড়িগুলো দাপাদাপি করছে। সেই খইয়ের দোকানটাকে মনে পড়ল। কয়েকটা কালো ছিটধরা চাঁপা কলাও ঝুলতে দেখেছিল সেখানে। কিঞ্চিৎ ফলারের ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়।
শুধু চাঁপা কলা নয়, মোষের দুধও ছিল এবং একটু মোদো-গন্ধধরা ভেলিগুড়। পনেরো পয়সায় খাওয়াটা নেহাত মন্দ হল না। আচমকা সুধাংশুব মনে হল, এমন খই-কলার ফলার কাছাকাছি থাকতে দুপুরবেলা খানিক শুকনো মুড়ি কেন চিবিয়ে মরে মাস্টারেরা ?
শীতের নরম রোদ। পেটে খাবার পড়ে গা এলিয়ে আসছে। একটু শুতে পারলে হত।
কাছেই ধর্মঠাকুরের বটগাছ। ছিমছাম জায়গাটি। দেবতার স্থান, অতএব সর্বজনীন সম্পত্তি। এখানে হত্যে দেবার নাম করে খানিকক্ষণ গড়িয়ে নিলে কেউ আপত্তি করবে না নিশ্চয়। যা ভাবা--তাই কাজ। ব্যাগের ভেতর থেকে সন্তর্পণে ভাজ করা র্যাপারটা সে বের করে আনল। পথে বিছানাটা এক জায়গায় রেখে এসে ভারী ভুল করেছে সে। নিশাকারবাবুর ওখানে বিছানা নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই--বন্ধু লোক।--অক্ষয়বাবু বুঝিয়েছেন।
ফিরেই যেতে হবে। থানা গাড়তে হবে তিন মাইল দুরের স্টেশনেই । ওখান থেকে যতটা "এরিয়া’ কভার করা যায়। ব্যাগটা মাথায় দিয়ে বটগাছের তলায় শুয়ে পড়ল সুধাংশু। ধর্মঠাকুরের মাটির ঘোড়াগুলো কেমন পিটি-পিট করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
কতক্ষণ ?
--ও মশাই--কত ঘুমুবেন ? উঠুন--উঠুন--
ঘোড়াগুলো ডাকছে নকি ? সুধাংশু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।
--আপনি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন, আর আমি আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। নিন--চলুন এবার--
ঘোড়া নয়। একটি মানুষ এবং স্কুলের একজন মাস্টার।
-কেন বলুন তো ?
সুধাংশুর মনে পড়ল, এই লোকটিকেই টিচার্স রুমে বসে মুড়ির সঙ্গে কঁচা লঙ্কা চিবুতে দেখেছিল সে।
মাস্টার মিটি-মিটি হাসলেন : আছে মশাই, ব্যাপার আছে। সাধে কী আর এসেছি--ওপরওলার হুকুমে।
-ওপরওলার হুকুম --সুধাংশু বিস্থিত হয়ে বললে, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ?
--ছেঃ !--মাস্টার উত্তেজিত হয়ে উঠলেনঃ ওকে কে পরোয়া করে মশাই ? সেক্রেটারির কুটুম বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হয়েছে--নইলে ওর বিদ্যে তো ম্যাট্রিক অবধি। গুণের মধ্যে খালি সেক্রেটারির কান ভারী করতে পারে। আমিও শশধর বাড়ুয্যে মশাই--আই-এ পাশ করেছি, হেডমাস্টারের লেখাতে ভুল ধরেছি। দু-দুবার। গজেন বিশ্বাসকে আমি গ্রাহ্যও করি না।
--তবে কার তলব ? থানার দারোগার নয় তো --এবার ভয়ে সুধাংশুর গলা বুজে এল।
—দারোগা আবার কেন ?
—শশধর বাডুয্যে হা-হা করে হেসে উঠলেন : আপনি কি চোর ডাকাত ? দারোগা নয়--ম্যাজিস্ট্রেট ডেকেছে। চলুন।
ম্যাজিস্ট্রেট! রহস্য অতল!
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুধাংশু উঠে পড়ল।
এবং কী আশ্চর্য--যেতে হল ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে নয়, শশধর বাড়ুয্যের বাড়িতে।
বাড়ি রাস্তার ধারেই। সামনে একটি ফুলের বাগান। লাল মাটির দেওয়াল আর টিনের চাল। একটি ছোট ধানের মরাই আর এক পাশে।
বাইরের ঘরে ঢুকেই সুধাংশু থমকে গেল। শশধর বাড়ুয্যের বাড়িতে এতখানি আশা তার ছিল না।
একখানি তক্তপোষের ওপরে পরিষ্কার একটি সুজনী পাতা। শাদা কাপড়ে ঢাকা একটি টেবিল এবং পাশে একটি চেয়ার। আর সবচেয়ে আশ্চর্য--টেবিলের ওপরে কোনাভাঙা সস্তা একটি কাচের ফুলদানিতে সপত্র একগুচ্ছ গন্ধরাজ। এই শীতকালে গন্ধরাজ!
কিন্তু গন্ধরাজের চাইতেও বিস্ময়কর অভ্যর্থনার এই আয়োজনটা। মনে হচ্ছে--সুধাংশুর সম্মানেই ঘরখানাকে এমন করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেন কনে দেখতে এসেছে সে। শশধর বললেন, বসুন, আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে ডাকছি।--বলেই আবার হেসে উঠলেন হা-হা করে। তারপর পা বাড়ালেন ভেতরের দিকে।
সুধাংশু থ হয়ে রইল। এ আবার কোন পরিস্থিতি ! একটা দুর্বোধ্য নাটকের মতো ঠেকাছে সব। অসময়ের গন্ধরাজের একটা মৃদু সৌরভ রহস্যলোক সৃষ্টি করতে লাগল তার চারদিকে।
—মন্টুদা--চিনতে পারছি না ?--কপালের ওপর ঘোমটাটা একটুখানি সরিয়ে শ্যামবর্ণ একটি তরুণী মেয়ে ঢুকল ঘরে। হাসিতে মুখখানা উজ্জ্বল।
তটস্থ হয়ে সুধাংশু উঠে দাঁড়াল। মন্টুদা--কে মন্টুদা ?
- -দেখুন, আমি তো আপনাকে- -
--চিনতে পারোনি--না ? কিন্তু আমি তোমাকে দূর থেকে দেখেই চিনেছি। সকলের চোখকে ফাঁকি দিতে পারো--কিন্তু আমাকে নয়। কেমন ধরে আনলাম--দেখো।
একটা ভুল হচ্ছে--মারাত্মক ভুল। বলবার চেষ্টায় বার দুতিন হাঁ করল সুধাংশু ।
—আহা-হা, আর চালাকি করতে হবে না। তোমাকে আমি জব্দ করতে জানি। বেশি দুষ্টুমি করো তো সব ফাঁস করে দেব--মেয়েটি মৃদু হাসল : দাঁড়াও--তার আগে তোমার চা করে আনি। দিনে এখনও সে পনেরোবার চা খাওয়ার অভ্যাসটি আছে তো ? না--রত্নার শাসনে এখন কমেছে একটু?
রত্না ? এবার আর হাঁ-টা সুধাংশু বন্ধ করতে পারল না।
--ঐ দেখো, সাপের মুখে চুন পড়ল!--মেয়েটিসকৌতুকে হেসে উঠল।
গায়ে একটা জামা চড়িয়ে শশধর ফিরে এলেন। মেয়েটি একটুখানি নামিয়ে আনল মাথার ঘোমটা।
শশধর বললেন, তুমি তা হলে চায়ের ব্যবস্থা করো ওঁর জন্যে। আমি একবার ঘুরে আসি বাগ্দিপাড়া থেকে। দেখি বিল থেকে দু চারটি কই মাছ ওরা ধরে এনেছে কিনা।
--দেখুন শশধর বাবু--
---পরে দেখব মশাই। এখন সময় নেই--
শশধর বেরিয়ে গেলেন।
মেয়েটি হাসলঃ পালাবার ফন্দি ? ও হবে না। অনেকদিন পরে ধরেছি তোমাকে। এখন চুপ করে বসে। আমি চা আনছি --
অতঃপর আবার সেই বিব্রত প্রহর যাপনের পালা সুধাংশুর। এ কী হচ্ছে--এ কোথায় এল সে। মন্টুদা বলে তার কোনও নাম আছে একথা সে এই প্রথম শুনল । এবং রত্না । সেইই বা কে ? বারোর সাত ছিকু খানসামা লেনে যে তার ঘর আলো করে রয়েছে, তাকেও তো সে এতকাল নিভাননী ওরফে বুলু বলেই জানত । একটা ভুল হচ্ছে--ভয়ঙ্কর ভুল।
ভুলটা ভেঙে দিয়ে এই মুহুর্তে তার ভদ্রলোকের মতো সরে পড়া উচিত।
কিন্তু -
কিন্তু চা আসছে এবং এ-সময় এক কাপ চায়ের নিমন্ত্রণ তুচ্ছ করবার মতো মূঢ়তাকে সে প্রশ্রয় দিতে রাজি নয়। চা-টা খাওয়া শেষ হলেই এক ফাঁকে ঝোলাটা কাঁধে করে সে উঠে পড়বে। তারপর এক দৌঁড়ে শালবন ছাড়িয়ে ময়ূরাক্ষী পার হতে আর কতক্ষণ।
সামনে ফুলদানি থেকে গন্ধরাজের মৃদু সৌরভ ছড়াচ্ছে। শীতের ফুল । সমস্ত ঘরে একটা রহস্যময় আমেজ ছড়িয়ে রেখেছে। পড়ন্ত বেলায় ঘরময় শীতল ছায়া ঘনাচ্ছে। মশার গুঞ্জন উঠেছে। র্যাপারটা গায়ে জড়িয়ে সুধাংশু অভিভূতের মতো বসে রইল।
ভেতর থেকে গরম ঘিয়ের গন্ধ আসছে। খাবার তৈরি হচ্ছে- -এবং নিশ্চয় তারই সম্মানে। সুধাংশুর মুখে আবার লালাজমে উঠল। রিফ্লেক্স অ্যাকশন! খই জিনিসটা লঘুপাক, কিন্তু চাপাকলা আর মোষের দুধও যে এমন অবলীলাক্রমে হজম হয়ে যায়--সে রহস্যই বা কার জানা ছিল। চায়ের প্রলোভনটা আরও শক্ত পাকে জড়িয়ে ধরল ঘিয়ের গন্ধ। রাত্রে স্টেশনের হোটেলে তো জুটবে ঢ্যাড়শ-চচ্চড়ি আর কড়াইয়ের ডাল--এক টুকরো মাছ যদি পাওয়া যায়, তার স্বাদ মনে হবে পিস্বোর্ডের মতো। তার চাইতে এখান থেকে যথাসাধ্য রেশন নিয়ে নেওয়া যাক। হোক ভ্রান্তিবিলাস, তবু ধরে নেওয়া যাবে এটা বাংলা দেশের পুরনো আতিথেয়তার নমুনা মাত্র।
গন্ধরাজের সৌরভ ছাপিয়ে লুচির গন্ধ আসছে। সুধাংশু প্রতীক্ষা করে বসে রইল। একটু পরেই এক হাতে সধুম লুচির থালা, আর একহাতে লণ্ঠন নিয়ে ঢুকল মেয়েটি।
--এত কেন?
--খাওয়ার জন্য।--মেয়েটি হাসল : নাও--আর ভদ্রতা কোরো না। সামনেই গাড়ু-গামছা রয়েছে--ধুয়ে নাও হাতমুখ।
যা হওয়ার হোক। এস্পার কি ওস্পার । মেঘনার ধারের সুধাংশু চক্রবর্তী আর বিস্মিত হবে না ঠিক করল। দেশ ছেড়ে উর্ধ্বশ্বাসে পালানোর চরম বিস্ময়টাকেই যখন রপ্ত করতে হয়েছে--তখন শিশিরে আর ভয় নেই তার।
-- বেপরোয়া হয়ে লুচি-বেগুন ভাজায় মনোনিবেশ করল সে।
মেয়েটি পাশে দাঁড়িয়েছিল, আস্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
- -কত রোগা হয়ে গেছ আজকাল!
শুনে রোমাঞ্চ হয় যে সুধাংশুও একদিন মোটা ছিল!
মেয়েটি বললে, সেই দশ বছর আগে যখন রত্নাকে নিয়ে পালিয়েছিলে, সেদিন কত কথাই উঠেছিল গ্রামে, কিন্তু আমি তো জানতাম--যা করেছ, ভালই করেছ!
রত্নাকে নিয়ে পালানো। হে ভগবান, রক্ষা করো! সুধাংশুর গলায় লুচি আটকে আসতে লাগল। তাদের হেড্মাস্টার থাকলে এখন সাক্ষী দিয়ে বলতেন, স্কুলে বরাবর গুড কণ্ডাক্টের প্রাইজ পেয়েছে সে!
--কাকিমা তো অগ্নিমূর্তি!- -মেয়েটির চোখে স্মৃতির দূরত্ব ঘনিয়ে আসতে লাগল : আমাকে এসে বললেন, কণা, তুই দুঃখ পাসনি। ওর কপালে অনেক শাস্তি আছে--দেখে নিস্। সত্যি বলছি মন্টুদা--বিশ্বাস করো আমাকে। আমি খুশি হয়েছিলাম। জাত বড় নয়--রত্না সত্যিকারের ভাল মেয়ে। আর তোমাকেও তো জানি। প্রাণে ধরে রত্নাকে তুমি কখনও দুঃখ দেবে না।
আহা, এই কথাগুলো যদি বুলু শুনত! তার ধারণা, স্বামী হিসেবে যে বস্তুটি তার কপালে জুটেছে, পুরুষের অপদার্থতম নমুনা হচ্ছে সেইটিই।
--সত্যি, রত্নার কষ্ট চোখে দেখা যেত না। সৎমা কী অত্যাচারই করত ওর ওপরে। কতদিন খেতে পর্যন্ত দেয়নি। তবু মেয়েটা মুখ ফুটে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি কখনও। এমন ঠাণ্ডা লক্ষ্মী মেয়ে আর হয় না। জাতটা কিছু নয় মন্টুদা--জীবনে সত্যিই তুমি জিতেছ।
অজানা-অদেখা রত্নার জন্যে এবারে সুধাংশুরও দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মনে পড়ে গেল, ঝগড়া করবার আগে কোমরে হাত দিয়ে বুলুর সেই দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা। লুচির থালা শেষ হতে সয় লাগল না।
—আর দুখানা এনে দিই মন্টুদা ?
--না-না-সর্বনাশ !
কণা বলে চলল, তোমার চেহারা বদলেছে মন্টুদা--কত ভারী হয়েছে গলার আওয়াজ। তবু আমি কি ভুল করতে পারি ? সেই চোখ, সেই কেঁকড়া চুল, সেই মুখের আদল, সেই হাঁটাবার ভঙ্গি। বাড়ির সামনে দিয়ে যখন ধর্মখোলার দিকে চলে যাচ্ছিলে, তখনই আমি চিনে ফেললাম । তারপর উনি যখন স্কুল থেকে ফিরে এসে বললেন যে, কলকাতা থেকে বইয়ের এজেন্ট এসেছে, তখনই আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না। এখনও তো সেই বইয়ের কাজই করছ ?
- -হু!--সংক্ষিপ্ততম উত্তরই সব চেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা।
- -শোনো--কণার গলার স্বর নিচু হয়ে এল ; আমি ওকে বলেছি, তুমি সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই। --কণা অর্থগভীর হাসি হাসলত : তুমি কিন্তু আসল ব্যাপারটা ফাঁস করে দিয়ো না--কেমন ?
—না-না। --সুধাংশু আন্তরিকভাবে মাথা নাড়ল : তা কখনও বলতে পারি। তাহলে আজ বরং উঠি আমি। রাত হয়ে যাচ্ছে--আমাকে আবার স্টেশনে যেতে হবে।
—বা রে, ভেবেছ কী তুমি ? এমনি ছেড়ে দেব ? ওঁকে মাছ আনতে পাঠালাম--দেখলে না ?
আমার রান্না খেতে তুমি কত ভালবাসতে—এরই মধ্যে ভুলে গেলে? ও সব হবে না। যাও দেখি--কেমন যেতে পারো।
- -কিন্তু বিছানপত্র কিছু সঙ্গে নেই--
কণা গরিব হতে পারে, কিন্তু তোমাকে শুতে দেবার মতো একখানা লেপ আর একটা বালিশ তার জুটবে। বেশি ভদ্রতা কোরো না আমার সঙ্গে-- বুঝেছ?
বুঝেছে বৈকি সুধাংশু। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই প্রতারকের একটা চমৎকার ভূমিকায় নেমে পড়েছে সে। এখন আর সহজে পালাবার উপায় নেই। শশধর তাকে কখনওই দেখেনি এবং কণা তাকে মিন্টুদা বলে প্রমাণ করার জন্যে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ। অতএব জালিয়াতিটা অন্তত আজ রাতে ধরা পড়বে না। কাল ভোরেই তাকে পালাতে হবে- -এবং এ এরিয়া ছেড়ে। তারপরে অক্ষয়বাবু রইলেন আর সে রইল।
বাগানে টিনের গেট খুলে কে ভেতরে ঢুকল। পাওয়া গেল চটির আওয়াজ।
শশধর ফিরে এলেন। হাতের বাঁধা ন্যাকড়াটার মধ্যে উত্তেজিত দাপাদাপি চলছে। উল্লসিত হয়ে শশধর বললেন, অতিথি-সেবার পুণ্যে আজ ভাল মাছ পাওয়া গেল। কণা! দশটা বড় বড় কই।
কণার মুখ হাসিতে ভরে উঠল।
--মন্টুদার ভারী প্রিয় মাছ। মনে আছে মন্টুদা--রেলের বাঁধের তলা থেকে একবার তুমি আর আমি ছিপ দিয়ে এক কুড়ি কই ধরেছিলাম ? তারপর বাড়িতে ফিরে মার হাতে সে কী পিট্টি ।
শশধর সস্নেহ হাঁসি হাসলেন। ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারটায় : ভাই বোনে মিলে খুব দুষ্টুমি হত বুঝি? তা বেশ, কিন্তু শিবেনবাবুকে এখনও চা দাওনি ?
শিবেনবাবু ! সুধাংশু আর একবার ঢোক গিলল। নিজের নামটা প্রায় অষ্টোত্তর শতনামের গণ্ডিতে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে।
--তুমি আসবে বলেই দেরি করছিলাম।
--দাও--দাও।--শশধর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন : বিকেলের চা-তো এখনও জোটেনি ওঁর। কুটম মানুষ--বদনাম গাইবেন।
--মণ্টুদা খুব ভাল ছেলে--কারও বদনাম করে না--কণা ভেতরে চলে গেল।
খাওয়ার দিক থেকে কিছুমাত্র ত্রুটি হল না। বারোর সাত ছকু খানসামা লেনের সুধাংশু চক্রবর্তী এমন টাট্কা কই মাছ চোখে দেখেনি দেশ ছাড়বার পরে। এ অঞ্চল নাকি কাঁকরের জন্যে বিখ্যাত, কই চালে তো একটি দানা কাঁকরেরও সন্ধান পাওয়া গেল না!
শশধর গল্প করলেন অজস্র। দেশের কথা, স্কুলের কথা। যোগ্যতায় বি-এ ফেল হেড়মাস্টার নিশাকর সামন্তের পরেই তার স্থান--এ কথাও ঘোষণা করলেন বার বার। শুধু সেক্রেটারির কুটুম ওই গজেন বিশ্বাস! মামার জোরেই অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার--নইলে একটা ইংরেজি সেনটেন্সও কারেক্ট করে লিখতে জানে নাকি ?
--আপনাকে ভাবতে হবে না মশাই। আপনি আমার কুটুম--গ্রেট ইণ্ডিয়ানের সব বই আমি ধরিয়ে দেব স্কুলে। ও দায়িত্বটা এখন আমার ওপরেই ছেড়ে দিন।
বাইরে কনকনে শীতের রাত। ভারী হাওয়ায় অসময়ের গন্ধরাজের গন্ধ। মাটির দেওয়ালে কেরোসিনের আলোর কাঁপনলাগা ছায়া। বিমিশ্র অনুভূতি বিজড়িত একটা স্তব্ধ মন নিয়ে সুধাংশু আধশোয়া হয়ে রইল লেপের মধ্যে। আশ্চর্য । জীবনটা এত আশ্চর্য--কে জানত ।
মন্টুদা ?
কণা ঘরে ঢুকল।
--জেগেই আছি। শশধর বাবু কী করছেন ?
--ওঁর তো এখন মাঝ-রাত। পড়া আর মড়া। শুনছ না-- নাক ডাকছে ?--কণা খিল্-খিল্ করে হেসে উঠল : ওই নাকের ডাকের ভয়ে পাড়ায় চোর আসতে পারে না।
সুধাংশু অপ্রতিভের মতো হাসল। টেবিলের পাশ থেকে চেয়ারটা নিয়ে বসল কণা। কিছুক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগল লণ্ঠনের বাড়ানো কমানো চাবিটা। কিছু একটা বলতে চায়--বলতে পারে না।
সুধাংশু সংকুচিত হয়ে আসতে লাগল মনের ভেতরে। আড় চোখে একবার তাকিয়ে দেখল কণার দিকে। এক কালে সুশ্রীই ছিল মুখখানা। এখন পরিশ্রম আর চিন্তার একটা ম্লান আবরণ ছড়িয়ে পড়েছে তার ওপরে।
তারপর :
একটা কথা বলব ভাবছি মন্টুদা। বলব কিনা বুঝতে পারছি না।
--বলো। অতি সংকোচের কী আছে ?
--না, তোমার কাছে সংকোচের আমার কিছুই নেই। --কণা ভেতরের দিকে মাথা ফিরিয়ে একবার কী দেখল,যেন কান পেতে শুনল শশধরের নাকের ডাকটা। তারপর মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসল : রত্না অমন করে মাঝখানে এসে না দাঁড়ালে তোমার ঘরে হাঁড়ি ঠেলার ব্যবস্থাই যে আমার পাকা হয়ে গিয়েছিল সে কথা কি তুমি ভুলে গেলে ?
সুধাংশু শিউরে উঠল। লণ্ঠনের আলোয় আশ্চর্য দেখাচ্ছে কণার চোখ। ঘন বর্ষার মেঘের মতো কী যেন টলমল করছে সেখানে। কণা বললে, ভয় নেই। তুমি ভেবো না--আমি রাগ করেছি। আমি তো জানি রত্না কত ভাল মেয়ে- -কণার চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল বুকের ওপর : আমি সুখে আছি, খুব সুখে আছি মন্টুদা!--
-- আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেলে কণা আবার হেসে উঠল। শ্রাবণের মেঘ-রৌদ্রের লীলার মতো তার হাসি-কান্না দেখতে লাগল সুধাংশু । কণা বলে চলল, দশ বছর পরে দেখা, ভেবেছিলাম, কথাটা বলা ঠিক হবে না। তারপব ভেবে দেখলাম, পৃথিবীতে তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলতে পারি।--গলার স্বর নামিয়ে কণা বললে, মন্টুদা, কুড়িটা টাকা দেবে আমাকে ?
কুড়ি টাকা! ক্যানভাসার সুধাংশু চক্রবতী সভয়ে নড়ে উঠল। আঁচলের গিট থেকে একটা চিঠি বের করলে কণা। বললে, এইটে পড়ো।
সুধাংশু বিমূঢ়ের মতো হাত বাড়িয়ে নিল চিঠিখানা। বোলপুর থেকে কোন এক বিনু চিঠি দিযেছে দিদিকে। তার ম্যাট্রিকের ফি এ মাসেই দিতে হবে।--দিদি যেন একটা ব্যবস্থা করে দেয়।
হতবাক হয়ে চিঠিটার দিকে সে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ ।
- -অবাক হয়ে গেলে তো ? দশ বছর আগে যে ছোট বিনুকে দেখেছিলে, সে আর ছোটটি নেই। ম্যাট্রিক দেবে এবার। ভাল ছেলে--ভাল করেই পাশ করবে। অথচ ফিয়ের টাকা নিয়ে মুশকিল। বাবার অবস্থা তো সবই জানো--কোনমতে আধাপেটা খেয়ে আছেন। অথচ এদের কাছেও চাইতে পারিনা। নিজেরই সংসার চলেনা, তবু বাবাকে যখন পারেন দু পাঁচটাকা পাঠান। এই কুড়িটা টাকার জন্যে ওঁকে আর কী ভাবে চাপ দিই বলো ?
সুধাংশু তেমনি নির্বাক হয়ে রইল। কোমল গভীর গলায় কণা বললে, একদিন তোমার কাছে সবই আমার চাইবার দাবি ছিল মন্টুদা। আজ সেই সাহসেই কথাটা বলতে পারলাম। রত্নাকে আমি সবই তো দিয়েছি--কণার চোখে জল চকচক করতে লাগলঃ মোট কুড়িটা টাকাও কি আমি চাইতে পারব না?
অভিনেতা সুধাংশুর কাছে অভিনয়টা কখন সত্যি হয়ে উঠল সে নিজেই জানে না। তেমনি গভীর গলায় সেও বললে, নিশ্চয় কণা--নিশ্চয়। বালিশের তলায় রাখা মানিব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল।
--এখুনি- -কণা বললে, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি কলকাতা গিয়েও বিনুকে পাঠিয়ে দিতে পারো। ঠিকানাটা নিয়ে যাও বরং।
ব্যাগটা বের করে এনে সুধাংশু বললে, না--না। অঢেল কাজ নিয়ে থাকি, কলকাতায় গিয়ে ভুলে যেতে কতক্ষণ ? টাকাটা তুমিই রাখো কণা।
শীতের হাওয়ায় ঘরে গন্ধরাজের মৃদু সুরভি। দেওয়ালে ছায়া কাঁপছে। আশ্চর্য তরল কণার চোখ। জল গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু এবার আর সে তা মুছতে পারল না।
***
শাল-পলাশের বনে ভোরের কুয়াশা। পায়ের তলায় শিশিরভেজা ধুলো। ময়ূরাক্ষী আর
কতদূরে ?
ঠাণ্ডা নরম রোদে--শালের পাতায় সোনালি ঝিকিমিকি দেখতে দেখতে আর মন্থর পা ফেলে চলতে চলতে হঠাৎ ক্যানভাসার সুধাংশু চক্রবতীর মনে হল--অভিনয়টা সত্যি সত্যি করেছে কে --সে--না কণা? কে বলতে পারে, এই পরিচয়ের ছদ্মবেশটা কুড়িটা টাকা আদায় করার এক চক্রান্ত কিনা?
কিন্তু তা হলে কি এত মিষ্টি লাগত গন্ধরাজের গন্ধটা? এই সকালে কি এত সুন্দর দেখাত এ শাল-পলাশের বন? আর সামনে--সামনে ওই তো ময়ূরাক্ষী। ময়ূরের চোখের মতোই সোনা আলো-ছড়ানো কী অপরূপ নীল ওর জল।
এই কুড়িটা টাকার হিসেব সহজে বোঝানো যাবে না ব্যবসায়ী অক্ষয়বাবুকে। এ এরিয়ার কাজ সবই তো পড়ে রইল। আর অক্ষয়বাবু কড়া লোক।
এর ঋণ শোধ করতে হবে এক মাস রেশন না এনে,কণার চোখের জলের দাম শোধ করে দিতে হবে বুলুকে। পিঠের বোঝাটার কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল সুধাংশুর। এত বই--রাশি রাশি বই শুধু চিনির বলদের মতো বয়েই বেড়ায় সে--তার নিজের ছেলের কর্পোরেশনের স্কুলে পড়ার খরচ জোটে না। তবু একজন তো ম্যাট্রিকের ফি দিতে পারবে--একজন তো কৃতী হতে পারবে জীবনে।
কুড়িটা টাকার চেয়ে ঢের বেশি সত্য বুকের পকেটে এই গন্ধরাজ দুটো। অসময়ের ফুল। কাচের ফুলদানিটা থেকে চুরি করে এনেছে সুধাংশু--পালিয়ে এসেছে ভোরের অন্ধকারে। যে অন্ধকারে ব্রজপুর একটা স্বপ্নমাধুরী নিয়ে পেছনে পড়ে রইল ।
সামনে ময়ূরাক্ষী। কী আশ্চর্য নীল সোনালি ওর জল ।
0 মন্তব্যসমূহ