আমি আর পাঁচটা মেয়ের থেকে একটু আলাদা। মেয়ে অবশ্য আর বলা উচিত না, পুরোদস্তুর মহিলা। মেয়ে এবার সরস্বতী-পুজোয় শাড়ি পরে ইস্কুলে গেল, অবাক হয়ে দেখছিলাম আমি। ও অধৈর্য হয়ে বলে –‘কি হল মা, আঁচলে পিনটা লাগিয়ে দাও’। আর আমি সেই কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল এ তো আমার মেয়ে নয় এটা তো আসলে আমি। এই আমার রোগ, মনের মধ্যেই কোথায় যেন হারিয়ে যাই। তখন আর খেয়াল থাকে না সংসারে। হয়ত গ্যাস-ওভেনে কিছু রান্না বসানো আছে, পুড়ে কালো হয়ে যায়। যদিও বাড়িতে রান্নার লোক এসে সকালে রান্না করে দিয়ে যায়, তাও এটা সেটা তো করতেই হয় মাঝে মধ্যে। আর জানলার কাছে চেয়ারটা টেনে বসলে তো আর কথাই নেই।
বাড়ি বড় রাস্তা থেকে ভেতরে তাই গাড়ি খুব একটা যে দেখা যায় তা না, তবে আকাশ দেখা যায়। আর দুটো গাছ, একটা রাধাচূড়া আর একটা কৃষ্ণচূড়া। রাস্তার দু-পাশে। জানি না কে লাগিয়েছিল এই গাছ, কবে লাগিয়েছিল। কিন্তু এই দুটো গাছ আছে বলেই যেন আমি রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যে বেঁচে থাকি। আর পুবদিকের এই আকাশ খানিকটা। জানলা দিয়ে এদের দেখে দেখে আমার কত যে বেলা কেটে যায়।আর ঠিক তখনই সেই অনেক দূর থেকে কার যেন আভাস ভেসে আসে ছলাত ছল ছলাত ছল ।
হ্যাঁ কংসাবতী, আমার কংসাবতী আমার মন থেকে সারা দেহে কুলকুল করে বয়ে চলে। কোনো কোনো দিন তো ওকে মানে আমার স্বামী সিদ্ধার্থকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতেও ভুলে যাই যে ও দুপুরে খেয়েছে কি না। তারপর বিকেল, সন্ধ্যেও পেরিয়ে যায়। ছেলে, মেয়েকে রাতের খাবার দিয়ে হয়ত আমিও খেয়ে শুয়ে পড়েছি। ফোনটা আসে তারপরই, কখনও রাত বারোটা পেরিয়ে। কর্কশ, রুক্ষ গলায় প্রায় ধমকে সিদ্ধার্থ বলে:
তুমি কি মানুষ? নিজের স্বামীর সারাদিনে একটা খোঁজ নাও না। খেটে মরছি শালা, আমি ঘর-বাড়ি ছেড়ে। বাড়ির কোনো হুঁশ নেই। এসি-তে বসে সারাদিন কাব্যিপাঠ হচ্ছে।
আমি ঘুম ঘুম চোখে শুনে যাই, সত্যিই তো আমি ওর খোঁজ নিইনি। অন্যায় তো করেছি। কিন্তু কিছুই বলি না। না ক্ষমা চাই, না নিজের পক্ষে কোনো কথা বলি। এসি-তে থাকতে আমি তেমন ভালোবাসি না। দিনে আমি জানলা খুলে রাখি। বাইরেটা না দেখলে আমার ভেতর ওঠে হাঁপিয়ে। আগেরবার সিদ্ধার্থ যখন বাড়ি এসেছিল তখন জানলা খোলা রাখা নিয়েও রাগারাগি করেছিল, ‘গরম হাওয়া ঢুকছে এগারোটা বাজে, জানলাগুলো হাট করে খোলা। আর পর্দাগুলো সরিয়ে রাখো কেন সবসময়? রাস্তার ধারে বাড়ি। নিজের সম্বন্ধে না হয় কোনো হুঁশই নেই, মেয়েটা তো বড় হচ্ছে, না কি?’ সম্বিৎ ফেরে ওর ফোন কাটার শব্দে। জানি আর ঘুম হবে না। বিছানায় পাশে মেয়ে ঘুমোচ্ছে। আমার মুঠোফোন ছিল বালিশের নিচে, ভাইব্রেশনে। ওর কেঁপে কেঁপে ওঠায় আমিও উঠলাম ধড়ফড় করে। আর প্রথম ঘুম এই চমকে একবার ভেঙে গেলে আমার ঘুম আসে না। সিদ্ধার্থও জানে এই ব্যাপারে। ঘুমের এই সমস্যার জন্য সিদ্ধার্থই কিনে এনে দেয় স্নায়ুকে নরম আর ঠাণ্ডা করে রাখার ওষুধ। রোজ রাতে শোবার বেশ খানিকটা আগে একটা করে খাওয়ার কথা বুঝিয়ে দেয়-
তোমার এখন মাঝ-বয়েসী ক্রাইসিস চলছে, বুঝলে। ইচ্ছে-টিচ্ছেও চাগাড় দেয় মাঝে মাঝে --
বলে চোখ টিপে ইঙ্গিত করে আবার বলে-
ওষুধটা নিয়ম করে খাও, সব শান্ত থাকবে। আমার না হয় অন্য রাস্তা আছে। কি করবে বলো শালার চাকরি যা, তিন মাসের আগে তো বাড়ি আসতেও পারি না শিলিগুড়ি থেকে।
সিদ্ধার্থের অন্য কি রাস্তা আছে এটা নিয়ে আমার বেশি ভাবতে ইচ্ছে করল না। তবে ও এদিক ওদিক যায় না বলেই আমার বিশ্বাস। হয়ত হস্ত-মৈথুনের উল্লেখ করেছে। আর ও দু-সপ্তাহ বা মাসে একবার করে বাড়িতে আসতেই পারে বলে আমার মনে হয়। শনি-রবি সপ্তাহে দুদিন ছুটি। শুক্রবার অফিস করে শিলিগুড়ি-কলকাতার বাসে চড়ে বসলেই ভোরে কলকাতা নামতে পারে। আসলে বড্ড টাকার খাই সিদ্ধার্থের। এমনকি আমি ছেলে-মেয়ে নিয়ে গিয়ে দু-দিন ওখানে থেকে আসি, তাও চায় না দেখেছি। শনি-রবিবারগুলোয়ও বেরোয়। অফিসে যায় না। দোকানে দোকানে যায়, আর কোথায় যায় ঠিক জানি না। আমার বিয়ের সময়ও এদিক-সেদিক থেকে ফিশফিশিনি শুনেছিলাম আমি –জামাই আবগারি বিভাগে আছে, দু-হাতে কামায়। যখন ইস্কুলে পড়তাম বা আরেকটু পরে কলেজে, তখন ভাবতাম ঘুষখোররা না জানি কেমন দেখতে হয়। চোর-ডাকাত সবই যেন এক আলাদা প্রাণী, আলাদা মানুষ, এসব কতই না ভাবতাম। আর ভাবি না। বাড়িতে এত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ---এসব ভাবলে আর চলে! ওর কিন্তু সংসারে খুব টান। সেই প্রথম থেকেই দেখছি, আমিই আলগা। তবে একটা রোম্যান্টিক সবুজ মন নিয়েই আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। কিন্তু অপরদিকে কোনো মনের ব্যবহার বা সহজভাব আমি পেলাম না। সবই ব্যবহারিক বা শারীরিক গতিবিধি যেন। নতুন বাড়িতে আমি খেলাম কি না সেকথা ওর মনে না পড়লেও বিয়ের পর যখন স্টুডিও’তে ছবি তোলাতে গেলাম তখন আমার শাড়ি, গয়না ও সাজগোজ যথার্থ আছে কি না সে ব্যাপারে ওর নজর ছিল খুব কড়া। এসব কত কি আর তেমন মনেও পড়ে না। তবে ওই যে বললাম সংসারে খুব টান সিদ্ধার্থর, সেটা বোঝা যায় তিন মাস ছাড়া যখন দুদিনের জন্য বাড়ি আসে তখন। বাথরুম দুটো ঘষে মেজে পরিষ্কার করবে নতুনের মতো। রান্নাঘর, গেট, গ্রিল , দরজা, জানলা কিছুই বাদ দেয় না মোছামুছি থেকে। সাথে চলে আমার সংসারের প্রতি বিমুখতার প্রসঙ্গ। অবশ্যই তা বেশ তিক্ততার সাথে। ওর এই বাড়ির প্রতিটি ইঁটের সাথে ভালোবাসা বা মায়া, যাই বলি না কেন। আমার মায়া রাস্তার গাছ দুটির প্রতি। খুব গরমে ওরা যখন লালে আর হলুদে দুলে দুলে একে অন্যের গায়ে হেলে পড়ে, মনে হয় একে অন্যের কাছে খানিক সহমর্মিতা বা সান্নিধ্য চাইছে। ছায়াও চাইছে বা। তখন ভাবি কাল ভোরে, ঘুম থেকে উঠে দু-বালতি জল ওদের গোড়ায় ঢেলে আসব। কিন্তু সাহস হয় না। ছেলে দেখতে পেলে যে কি বলবে আর কি বলবে না তার ঠিক নেই। আর মেয়ে আমায় কিছু না বললেও বাবাকে টেলিফোন করে ঠিক বলে দেবে। তার চেয়ে বরং থাক। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছেলেটা আমার খুব নেওটা ছিল। বাবার সাথেই ওর ভাব কম। কিন্তু পাল্টাতে শুরু করল , কলেজে ওঠার পর থেকেই। ক্লাসটেস্টের রেজাল্টও জানাতে চায় না , বুঝি ভালো হচ্ছে না আগের মতো। তাও এভাবেই চলে যাচ্ছিল, আমার তো আর অভিযোগ করার জো নেই, ইচ্ছেও হয় না। ভাবি চলুক যে ভাবে চলছে সেভা্বেই, এই তো বেশ। জানলায় চলে আসি একটু মনটা খারাপ হলেই। কিন্তু অঘটন যে ঘটারই ছিল।
......................................................................................................................................
ফোনটা এসেছিল দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ । সবে স্নান করেছি, ভেজা চুল নিয়ে নাড়াচাড়া করছি জানলার সামনে গাছ দুটোকে দেখতে দেখতে। এরকম সময় ফোন? নিশ্চয়ই কোনো বিপনণ কোম্পানির হবে, এই ভেবে একটু বিরক্তি নিয়েই বলি ‘হ্যালো’ |
আমি কি যশোধরা’র সাথে কথা বলছি?
অপরিচিত পুরুষ-কণ্ঠে নিজের নাম শুনে অবাক হলাম। ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দেওয়ায় জানলাম উনি ঝর্ণাদির সেই মামাতো ভাই, ক’দিন আগে যাঁর সাথে আলাপ হলো। মেয়েকে নিয়ে গেছিলাম গত সপ্তাহে ঝর্ণাদির বাড়ি, উনি পাড়ায় রবীন্দ্র-জয়ন্তী অনুষ্ঠানের জন্য একটা নৃত্যনাট্য করাচ্ছেন, তাই মেয়েকে নাচের জন্য ডেকে ছিলেন। সেখানেই আলাপ হয়েছিল ঝর্ণাদির ভাইয়ের সাথে। আলাপ বলতে ওই আর কি। আমি কিছুই বলিনি তেমন, তবে উনি অনেক কথা বলছিলেন আমাদের সাথে। ওনারই ফোন। আমি বেশ অবাক হলাম। উনি আমার ফোন নম্বর পেলেন কি করে।
আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন কি করে আপনার ফোন নাম্বার পেলাম। না ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করিনি।আসলে জানেন আমি যে ঘরে আছি সে ঘরেই ঝর্ণার ল্যান্ডলাইন ফোনটা আর তার পাশেই রাখা একটা ছোট্ট হাতে লেখা টেলিফোন ডিরেক্টরি। তাতেই মূল্যবান নামটি আর তাঁর ফোন-নাম্বারটি পেয়ে গেলাম।
সেদিনই আমাকে অনেকবার বলেছিলেন ওদের নৃত্যনাট্য বর্ষামঙ্গল-এর গ্রন্থনায় পাঠ করতে। তাহলে না কি উনিও করবেন। ঝর্ণাদি প্রতিবার সিডি চালিয়েই ছোটদের দিয়ে নাচ করান কিন্তু এবার ওনার ভাই নাকি বলেছেন যে গান ও পাঠ সবই করবে এখানকার ছেলে-মেয়েরা বা মহিলারা। পরপর তিন-চারদিন ফোন করে সেই একই অনুরোধ উনি আমায় করতে থাকেন। তখন সত্যি বলছি, খানিকটা ওনার ফোনের হাত থেকে নিস্তার পেতেই আমি ওখানে পাঠে রাজি হয়ে যাই।
জ্যোতির্দীপ্ত সেন কবিতা আবৃত্তি করার পাশাপাশি নিজেও একজন কবি। হয়ত বিশেষ নাম হয়নি। বই প্রকাশ হয়েছে খান-কতক। এদেশে থাকেন না কিন্তু এলে কাটিয়ে যান বেশ কিছু মাস। এবার এসেছেন এই সময়। শুরু হয় আমাদের রিহার্সাল। মেইন রিহার্সালের পরে আর সবাই চলে গেলেও উনি নিজের ঘরে আমায় আলাদা করে ডেকে নিয়ে গলার মড্যুলেশন শেখাতে লাগলেন। আর হতে লাগলো আরো অনেক কথা আর কবিতা-পাঠ। অপূর্ব গমগমে কণ্ঠ তাঁর। একদিকে কাজী সব্যসাচীর দৃপ্ততা আবার সাথে পার্থ ঘোষের মাদকতার মিশ্রণ জ্যোতির্দীপ্তর গলায়। যেন এক যাদুকরের সম্মোহনে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি এই আমি। জ্যোতির্দীপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত একের পর এক কবিতার মতো আবৃত্তি করে যেতেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ‘...দিন চলে যায়, আমি আনমনে তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে--’। কথাও বলতেন হয়ত কোনো কবিতার ছন্দে। কখনও বা কোনো বড় কবির কখনও বা নিজের লেখাই।
আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি সেই ক্লাস নাইন থেকে। ইস্কুলের ম্যাগাজিনে লজ্জা-মেশানো একটা কবিতা লিখেও ফেলেছিলাম। মনে পড়ে। আবার হঠাৎ যেন কোথা থেকে সব লাটাই থেকে হারিয়ে যাওয়া ঘুড়িগুলো আমার আকাশে ওড়া-উড়ি শুরু করে। আর হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকে, বলে ‘লাটাইটা হাতে নাও, আমরা ধরা দিতে এসেছি তোমার কাছে, ফিরিয়ে দিও না আমাদের’। আর পাশে জ্যোতির্দীপ্ত। সমানে আমাকে উজ্জীবিত করতে লাগলেন এই বলে যে আমারও নাকি বেশ কিছু গুণ আছে। আমি দেখতেও নাকি মন্দ না। বিশেষ করে বৈশাখের এই কাঠফাটা রোদে লাল শাড়িতে জ্যোতির্দীপ্তর চোখে আমি হয়েছি একেবারে ‘আগুন-রাঙা পলাশ’ । সোজাসুজি তাকিয়ে বলে ওঠেন – ‘এত দিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে। দেখা পেলেম ফাল্গুনে’। ভরা বৈশাখে ফাল্গুনের এই গান শুনে আমি হেসে গড়িয়ে পড়ি আর কি। আমি নিজেও জানতাম না যে আমি এমন করে হাসতে পারি ।
মিথ্যে বলবো না, আমরা প্রেমে পড়লাম। প্রেমে পড়লাম গান-হাসি-কবিতা জড়ানো এই পরিবেশের। জড়তা কাটিয়ে আমি যেন সেই ফুরফুরে কলেজের যশোধরা হয়ে উঠি। মনের মধ্যেকার শামুক একটু একটু করে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আমার বাইরের ‘আমি’র সাথে যেন এক হয়ে উঠল। আর মনমরা হয়ে থাকতাম না। হ্যাঁ, জানলায় দাঁড়াতাম। ফিশফিশ করে গাছ দুটিকে বলতাম – তোরা দুজন ছাড়াও আমাকে আরো একজন ভালোবাসে। পরিপাটি করে সাজতাম আমি। পাড়াতে দুটো বাড়ির পরেই যাবো দেখে কেউ বলবে না। একেকদিন একেকটি শাড়ি, যেগুলো শুধু আলমারি বন্দী হয়েছিল এযাবৎ, বের করে পরতে লাগলাম। জ্যোতির্দীপ্তর চোখে যদি ভালো না লাগে তাই খুব যত্ন করে নিজেকে আয়নার ওপর এদিক-ওদিক ফেলে দেখতাম। কখন বিকেল চারটে বাজবে তার অপেক্ষায় থাকতাম। মেয়ে তিনটেতে ইস্কুল থেকে ফেরার পর খেয়ে-দেয়ে একটু টিভি দেখতে চাইত। আমি তাড়া লাগাতাম – তৈরি হ, তৈরি হ’। বছর চোদ্দ’র মেয়ে মাকে এইরকম হাসি-খুশি সাজগোজ করা কখনও দেখেনি আগে। খুশি হয়, নাকি সন্দেহের চোখে দেখে ---সেসব জানার বা বোঝবার ইচ্ছে হয় না আমার। আমি এত বছরের না-পাওয়া সব কিছু পাওয়ার আবেগে গা ভাসিয়ে দিই।
চলো পাখি, কাল আমরা একাডেমি থেকে একটা নাটক দেখে আসি।
আমাকে দেওয়া নতুন নামে জ্যোতির্দীপ্ত বলে ওঠে। সেই শুরু এরপরই নন্দন, জোড়াসাঁকো, কফি-হাউস, বই-পাড়া চত্ত্বর আমরা দু-জন বেড়িয়ে বেড়াই। কখনও গাড়ি বুক করে কখনও বা মেট্রো। আর সেদিন কালবৈশাখির ঝড় আর বৃষ্টিতে আকুল সেই ভেজা, টপটপ করে জল ঝরছে আমার খোলা চুল দিয়ে। ‘...হাঁটু জলে ডুবো রিকসা, পর্দার ভিতরে বৃষ্টির কুসুমে গাঁথা ফুলশয্যা, নিভৃত বাসর।’
......................................................................................................................................
ঝর্ণাদি একদিন জ্যোতির্দীপ্তর আড়ালে আমায় ডেকে বলে-- যশোধরা তুমি সব কিছু বুঝে-শুনে করছো তো? আমি যতটুকু জানি তুমি ভীষণ সেনসিটিভ মেয়ে, এর ইমপ্যাক্ট বুঝতে পারছো কি হতে পারে? আমার ভাই কিন্তু দুদিন পর চলে যাবে। আর জ্যোতির্দীপ্ত তেমন দায়িত্ববান পুরুষও নয়।’
কিন্তু আমার এই ভালোলাগার জগৎ ভেঙে বেরিয়ে আসতে একটুও ইচ্ছে হয় না। তবে জ্যোতির্দীপ্তর এখানে থাকার মেয়াদ ফুরোলো একদিন। আমি ছটফট করছি, সংসার, ছেলে-মেয়ে সব ভুলে নিজেকে নিঃস্ব অসহায় লাগছে। ‘কি করবো আমি ? কি করবো? কি করে বেঁচে থাকবো জ্যোতির্দীপ্তকে ছেড়ে?’ গাড়িতে ওকে ছাড়তে যাই বর্ডারে। গাড়ি স্পিডে চলেছে ফাঁকা যশোর রোডের বুক চিরে । খোলা জানলা দিয়ে ভোরের ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে হু হু করে, আমার চুল, শাড়ির আঁচল সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মন আর তার ভেতর যে সবচাইতে অবুঝ ---আর কারো শাসন না-মানা জায়গাটা এত হাওয়াতেও ঠাণ্ডা হচ্ছে না। ঠোঁট জিভ সব শুকিয়ে যাচ্ছে, আর আমি পেছনের সিটে জ্যোতির্দীপ্তর ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে বসে আছি। ও শান্ত। খুবই সহজ ভাবে সব কিছু নিচ্ছে। কলকাতা ছাড়ার আগে প্রিয় শহরটাকে এবারকার মতো দেখে নিচ্ছে যতটা পারা যায়। গাড়ি থামে বিভাজন রেখার একটু আগে। সামনের সিটে রাখা ওর ব্যাগ আর ট্রলি স্যুটকেস বার করে নিয়ে টানতে টানতে ও চলে যায়। ও বারণ করা সত্বেও আমি নেমে পড়ি গাড়ি থেকে। জ্যোতির্দীপ্ত চলে যাচ্ছে পেট্রাপোল পার করে সাদা রেখা ছাড়িয়ে বেনাপোলের গহ্বরে। জানি না কতক্ষণ কেটে গেল, একবার কি তাকালো ওদিকে গিয়ে? বুঝলাম না। হুঁশ ফেরে ড্রাইভারের ডাকে-‘বউদি চলুন।’
আমার সারাদিন অস্থির অস্থির লাগে। কিছুই ভালো লাগে না। নাওয়া-খাওয়া ভুলে শুধু অপেক্ষা করতাম জ্যোতির্দীপ্ত কখন ফোন করবে। আমাকে ও ফোন করতে বারণ করেছিল। যখন ফোন আসত আমি সব ভুলে যেতাম। ছেলে-মেয়েরা যে শুনতে পাচ্ছে এসব মাথাতেই আসত না আমার।
আমার ছেলে টুবলাই বেশ কিছুদিন এসব নজর করলো। আর তারপরেই সেই বিভীষিকাময় রাত এল। সন্ধ্যে সাতটার জায়গায় টুবলাই পরপর বেশ কদিন ফিরছিল প্রায় রাত সাড়ে নটা নাগাদ। এরপর একরাতে আমি ওর মুখে পাই অজানা এক গন্ধ। সিগারেট ও খায় মাঝে মাঝে, আমার কাছেও খেয়েছে। কিন্তু এ গন্ধ আরো কিছুর। আমি আশ্চর্য হয়ে খুবই উত্তেজিত হয়ে ওকে বলে উঠি-- এসব কি হচ্ছে টুবলাই ? দিন দিন কি শুরু করেছো?’
আমার মুখের কথা তখনও শেষ হয়নি, ছেলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার পুঞ্জীভূত সমস্থ ক্ষোভ আর রাগ নিয়ে, ‘তোমার লজ্জা করে না? মা হয়েছো আর ছেলে-মেয়ের সামনে বেলেল্লাপনা। বাবা এখানে নেই বলে...’।
আমি তাকিয়ে ছিলাম আর কানে আসছিল বেশ জোরে জোরে কিছু আওয়াজ। কিন্তু সেগুলো আলাদা করে বুঝতে পারছিলাম না। তারপরে জানি না কে, মেয়েই বোধহয় সিদ্ধার্থকে ফোন করে আর সিদ্ধার্থ এই প্রথম শিলিগুড়ি থেকে রাতের বাসে চড়ে ভোর না হতেই বাড়ি এসে ঢোকে। টুবলাই’র কথার পরই তো আমি বোবা হয়েছিলাম আর কানেও কিছু ঢুকছিল না। ঈশ্বর আমায় আরো করুণা করেন সিদ্ধার্থ আসার পর, বোধশক্তিহীনও করে দেন। বাড়িতে একটা ভীষণ অবস্থার পর হয় থমথমে একটা ভাব। দুদিন পর আমি আস্তে আস্তে উঠে একটু খোলা আকাশের নিচে যাবো ভাবি। ছাদে যেতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
আমার বিছানার সামনের চেয়ারে এক অপরিচিত মহিলাকে বসে থাকতে দেখে আমি ধড়মড় করে উঠতে যাই আর মাথায় অসহ্য এক ব্যাথা অনুভব করি।
উঠো না দিদি। তোমার মাথায় চোট আছে।
তুমি?
আমি আয়া আছি। তুমার দেখাসুনার জন্য।
জানলাম আমি ছাদের সিঁড়িতে পড়ে গেছিলাম দুদিন আগে। সিদ্ধার্থ একজন আয়া রেখেছে আমাকে দেখাশোনার জন্য। নাকি পাহারা দেবার জন্য? একটা মানুষকে কাছে পেয়ে আমার ভালো লাগলো। মহিলাটিকে নাম জানতে চাওয়ায় বলে-‘ আমি সীতা। হা হা হা।’
ওমা হাসছো কেন? সীতা তো বেশ ভালো নাম। তা তুমি সিঁদুর-টিপ এসব পরোনি যে।
হামি তো বেধবা আছি।
এত অল্প বয়েসে স্বামী মারা গেছেন জেনে খারাপ লাগে। ঘরটাকে আলোবিহীন লাগে আমার। আর দমবন্ধ করা চারদিক। ওকে জানলাগুলো খুলে দিতে বলি, কতদিন দেখি না আমার রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়াকে। ইশশ ওদেরও কি আমি ভুলে ছিলাম? সীতার কথায় চমকে উঠি।
না দিদি জানলা খোলা চলবে না। দাদা মানা করেছে। ওই জানলার পাশের গাছগুলো নাকি তোমার মাথায় ভূত ঢোকায় গো দিদি। ব্যভিচার করো তাই তুমি।
সীতার কথায় চমকে উঠি। এসব কি বলছে ও। কারো কাছ থেকে নিশ্চয়ই শুনেছে নয়ত এসব কথা তো ওর জানার কথা নয়। বালিশের পাশে নিজের মোবাইলটা খুঁজি, নেই।
কি খুঁজছ গো দিদি? তোমার মোবাইল সব ওরা পড়ে নিয়েছে।
আর ভালো লাগছে না আমার সীতার এসব কথা শুনতে। মাথায় ঝিমঝিমে ভাবটা আবার ফিরে আসছে। প্রসঙ্গ পালটাই।
সীতা তোমার বয়েস অল্প, আর একটা বিয়ে করতে পারো তো|
চোখটা জ্বলে উঠল ওর।
কেন? শাদি করে কোন সগগো পাবো গো দিদি? সেই তো শরীর দিয়ে সারাদিন আয়ার কাজ করব। আবার রাতেও বাড়ির লোককে শরীর দিতে হবে, বিয়ে করা আছে না। মরণদশা। এই খুব ভালো আছি। নিজে কামাচ্ছি নিজে খাচ্ছি গো। তুমি নিজেকে দেখে বোঝো না? দিদি?
আমার খুব কংসাবতীর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। খানিক শান্ত, ধীর সেই আমার ছোটবেলাকার নদীর কাছে। আমার জানলা দিয়ে যদি একটা নদী দেখা যেত! কংসাবতী তুমি কেন আমার সাথে এলে না প্রেমশূন্য, নিরাশ এই নগরিতে। কুলকুল করে তুমি বয়ে যেতে আমার পাশ দিয়ে আর থাকত আমার প্রিয় রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া।
সীতা কি একটা ট্যাবলেট যেন জল দিয়ে খাইয়ে দিলো। আঃ আবার ঘুম পাচ্ছে। কংসাবতী তুমি বইতে বইতে কেমন দুভাগ হয়ে গেলে মিশে গেলে এদিকে রূ্পনারায়ণে আর ওদিকে গিয়ে পড়লে হলদি নদীতে। তুমি ভালো আছো তো ? আমার কংসাবতী। ‘ নদী ভরা ঢেউ, বোঝনা তো কেউ, কেন তরী নিজে বাও বাও রে’।
0 মন্তব্যসমূহ