জয়দীপ দে'এর গল্প : আটকে পড়া মানুষ


আমার সফরসঙ্গী দুই জন। দুইজনই নিজেস্ব বিবেচনায় তারা খুবই বুদ্ধিমান এবং তাদের হিন্দি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অসাধারণ। তাই আমি নিশ্চিন্ত ও নির্ভার। হিন্দি ভাষায় ক অক্ষর গোমাংস আমি নির্ভয়ে তাই মহাভারতের পথে হেঁটে বেড়াচ্ছি। এই দুই অসাধারণ ভাষাজ্ঞ সফরসঙ্গীর মধ্যে একজন আমার মাতৃদেবী। তিনি সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে দুই চারট্টি ‘যায়া’ ‘খায়া’ ঢুকিয়ে দুর্দান্ত এক উপভাষার জন্ম দিয়েছেন। যে ভাষাটি তার ধারণা হিন্দির চেয়েও উচ্চমার্গের ও সর্বজনবোধ্য। কারণ তার এই স্বরচিত হিন্দি শুনে সবাই মাথায় দোলায়। সম্ভ্রমে আচরণ করে।
তবে একটা ছোট্ট সমস্যা হয়। তিনি চান একটা লোকে দেয় আরেকটা। পানি আনতে বললে থালায় ভাত বেড়ে দেয় মেসিয়ার। গাড়ি দাঁড়াতে বললে উল্টো গতি বেড়ে যায়। এরকম ছোটখাটো সমস্যা অগ্রাহ্য করলে মাতৃদেবীর ভাষাটি অসাধারণ। তবে আরেক সফরসঙ্গী সত্যিকারের ভাষাবিদ। তার পড়াশোনাই ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে। বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে তিনি সাহিত্যজ্ঞান বিতরণ করে বেড়ান। কিন্তু হরিদাসপুর সীমান্ত অতিক্রম করার পর তিনি হয়ে উঠেছেন কালজয়ী উচ্চারণবিদ। এ যুগের নরেন বিশ্বাস। তবে সে উচ্চারণ বাংলা শব্দের নয়। হিন্দি। চ কে ছ, ড কে ঢ করে এক ভয়ংকর ভাষার জন্ম দিয়েছেন তিনি। তবে তার ভাষাটি আদৌ হিন্দি কিনা সে নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে। হঠাৎ শুনলে সাতক্ষীরার খাঁটি ‘বাঙাল ভাষা’র মতো লাগে। তবে একটু ভালো করে শুনলে বলবেন হিন্দিই। আরো নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করলে তেলেগু ভাষার কাছাকাছি কোন উপভাষা মনে হবে। তবে উনার আবিস্কৃত ভাষাটি আমার মাতৃদেবী উদ্ভাবিত ভাষাটির চেয়ে একটু নিম্নস্তরের। কারণ ভাষাটি অনেকেই বোঝে। এই বুঝে বলেই রক্ষা। এই দুই ভাষাবিদের বাগ্সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে আমার হাবি খাওয়ার দশা। মাঝে মাঝে এই গহীনজলের মধ্য থেকে আমাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়। যখন এই দুই ভাষাবিদ অক্ষম হয়ে পড়েন শ্রোতাকে তাদের মনোভাব বোঝাতে, তখন আমাকে চার্লি চ্যাপলিন সাজতে হয়। শ্রোতাকে ক্ষণিকের তরে হয়ে যেতে হয় দর্শক। আমার শারীরিক ক্যারিক্যাচার আর দমবন্ধ হয়ে আসা হিন্দি ভাষায় দুই ভাষাবিদের আরাদ্ধ কর্ম সমাপ্ত করতে হয়। 

এই ভাষার সমুদ্রে ভেসে ভেসে শেষমেশ বেনারসে এসে পড়লাম। বাস থেকে নামতেই টেক্সিঅলা পিন্টু পা-ার খপ্পরে পড়লাম। অত্যন্ত সজ্জন ও সদালাপী ব্যক্তি। হিন্দি-বাংলা-ইংরেজি-আরবি সকল ভাষায় সমান পারদর্শী। তবে হিন্দি ছাড়া অন্যকোন ভাষার একাধিক শব্দ একসঙ্গে প্রয়োগ করেন না। ভোজবাজির মতো দু’চাট্টা বাংলা ইংরেজি ছেড়ে আমাদের সমীহ আদায় করে নিচ্ছে। বাংলা ও বাঙালি বাবুলোকের প্রতি তার সীমাহীন শ্রদ্ধা। অনিচ্ছার সত্ত্বেও কেবল সদ্ব্যবহারের গুণে তার বাজাজ থ্রি হইলারের সাওয়ারী হলাম। পথে মাত্র ১০ মিনিট সময় নিল। এর মধ্যে সে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত গন্তব্যস্থল ভুলিয়ে দিল। আমরা কবুল করলাম তার নির্দেশিত স্থানেই আমাদের যাওয়া উচিত। অন্নপূর্ণা তেলওলার ধর্মশালায় ঢুকে পুরোপুরি সমর্পিত হলাম পিন্টু পাণ্ডার কাছে। সে বখশিসসমেত গাড়ির ভাড়া নিয়ে চলে গেলে ‘ফের মিলেঙ্গা’ বলে। তবে এটাই ছিল তার সঙ্গে আমাদের প্রথম ও সর্বশেষ মোলাকাত। পর দিন পিন্টু পাণ্ডার ভাই পরিচয়ে প্রক্সি দিতে আসে ঝিন্ডু পাণ্ডা নামে আরেক ব্যক্তি। এই ঝিন্টু পাণ্ডা কাশী দর্শনের নাম করে আমাদের গুহ্যদ্বারে বড়ো একটি ডাণ্ডা মেরে চলে যান। সে গল্প না হয় পরে বলা যাবে।

তেলাওলার ধর্মশালায় ঢুকে মনটা ভালো হয়ে গেলো। রুমটা বেশ পরিচ্ছন্ন ও আরামদায়ক। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় গিজার আছে বাথরুমে। ৬০০ রুপিতে যেন আমরা একটুকরো স্বর্গ কিনে নিলাম কাশীর বুকে। মা বললেন, ঠাকুর সহায়। নইলে কাশীতে পা দিয়েই পিন্টুর মতো একটা ভালো ছেলেকে পেয়ে যাই!

আমি একটু সর্তক করার চেষ্টা করলাম। কাশী জায়গাটা নাকি...

সঙ্গে সঙ্গে দুই ভাষাবিদ তেড়ে এলেন আমার দিকে। বিশেষ করে সাহিত্যের অধ্যাপক বিকাশ বাবু মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, সব কিছুতে ভাই আপনার এতো সন্দেহ কেন?

কাঁচুমাচু খেয়ে গেলাম। আমার অবিশ্বাসী অপবিত্র হৃদয় নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ি। মাতৃদেবী জানালা খুলেই পেছনে দেখতে পেলেন মন্দির। অন্নপূর্ণার মন্দির। সাথে সাথে তার ভক্তিরস বলক দিয়ে উঠল। আমার অবশ্য বলক দিল পিত্তিরস। সঙ্গে অন্নের নেশা। খাবারের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলাম। রুম থেকে বেরিয়ে রিসিপশনে খাবারের দোকানের খোঁজ নিলাম। ভদ্রলোক জানালেন গেট থেকে বের হলেই পেয়ে যাবেন। তবে আমিষের স্বাদ পেতে হলে যেতে হবে মোড়ে। রথযাত্রা মোড়। কাশী তথা হালের বেনারসের শাহবাগ বলা যেতে পারে। সব রাস্তা এখানে এসে পাক খেয়েছে।

রথযাত্রা দেখলাম কিন্তু কলা থুড়ি ‘ননভেজে’র ঘুন্টি পাওয়া গেলে না। নিরুপায় হয়ে ধর্মশালার গেটে এসে একটা খাবারের দোকানে ঢুকে পড়লাম। দুই কদম দিয়ে বুঝলাম ভুল হয়ে গেছে। এই বেশভূষা আর পকেট নিয়ে এহেন ভোজনালয়ে প্রবেশ ধৃষ্টতা। তারপরও তো আমরা বিদেশী। যেন তেন রেস্টুরেন্টে সেবা গ্রহণ ঠিক হবে না। ছোট্ট করে বলে রাখি বিশ পঁচিশ জন বসার মতো রেস্টুরেন্টের ইন্টরিয়র দেখার মতো। ঢাকার অনেক অভিজাত ভোজনালয়ের সাজসজ্জাকে ম্লান করে দেবে। মেন্যু নামের একটা থিসিস পেপার দিয়ে চলে গেল ওয়েটার। অধ্যাপক তা স্টাডি করতে বসে গেলেন। আমি হাবভাব দেখে বুঝলাম সবজি বিরানি ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ যৌক্তিক হবে না। অর্ডার দেয়ার আধাঘন্টা পর খাবার এলো। ছোট ছোট দুটো থালা আর জামবাটিভরা বিরিয়ানি। অধ্যাপকের জন্য দোসা। বিপুল আকারের একখানা রুটি। তথাকথিত বিরিয়ানি এক চামচ মুখে দেয়ার পর এর রন্ধন রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেল আমাদের কাছে। ভেজিটেবল ডালডায় চাল আর মটরশুটি ভেজে দিয়েছে। পরে কিছু পনিরের টুকরো ছড়িয়ে দিয়েছে মিশ্রণে। যেহেতু ভাজা পোড়ার ব্যাপার, চালগুলো তাই আধফোটা। কড়কড়ে। ওয়েটার খাবার সরবরাহ করে দূরে দাঁড়িয়ে আড়চোখে আমাদের দেখছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল। ভাবখানা এমন: খা ব্যাটারা, জন্মের মতো খা। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা আমাদের মুখে নেই। কারণ কাশীর সত্যিকারের সবজি বিরায়ানির স্বাদ আমাদের জানা নেই। উপরন্তু ‘অখাদ্যে’র হিন্দিও। অগত্যা ক্লান্ত বলদের মতো চোয়াল নাড়াতে লাগলাম। 

রাতে রুমে ফিরে অধ্যাপক বললেন, চলেন বেরুই। এই ‘বেরুই’র অভ্যাস হয়েছে গয়া থেকে। প্রতিদিন রাতে ছাইপাশ খাওয়ার পর সাপ্লিমেন্টারি ফুডের জন্য আমরা বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। ভারতের রাস্তা আন্ডা আর পান্ডায় ভরপুর। ফুটপাথের দোকান থেকে খুব সহজেই আট দশ রুপিতে পেয়ে যাবেন ডিমের কোন পদ। দীর্ঘযাত্রার কারণে আমার কাঠবডির কঙ্কালটা লকঝকে হয়ে উঠেছে। আর একটু ঝাঁকুনি দিলেই যেন নাটবল্টু খুলে খুলে পড়বে। তাই অধ্যাপকের বেরুই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে লেপের ভেতরে প্রবেশ করলাম।

রাতে ফিরে অধ্যাপক জানালেন রাস্তায় তিনি এক বাঙ্গালী দাদার দেখা পেয়েছেন। চাইলে একটা সিটিং হতে পারে। ঘুম ঘুম চোখে কথাগুলো শুনে চোখের শার্টার নামিয়ে ফেললাম। পরের দিন বেনারস ভ্রমণ শুরু। প্রথমেই গেলাম সারনাথ। আজ থেকে ১২-১৩ বছর আগে আসতে পারলে প্রাচ্য শিল্পকলার ক্লাসগুলো আরো উপভোগ্য হত। তারপর রামনগর ফোর্ট, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে সন্ধ্যায় দশঅশ্বমেধ ঘাটের বিখ্যাত গঙ্গার সন্ধ্যা আরতি। বর্ণে গন্ধে গীতি আনন্দে হৃদয়ে দোলা লাগার মতো কিছু মুহূর্ত। মহাকালের জলসা বসেছে। এই জলসা ভাঙবার নয়। সারা দুনিয়ার মানুষ সেই জলসা দেখছে। যাই হোক আরতি শেষে ছোটলাম বেনারস স্টেশনে। একটা ভুলচুকের সমাধানের চেষ্টা করা। হলো না। ধর্মশালায় ফেরার মুখে একটা ঠেলাভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন অধ্যাপক। পিসি সরকারের মতো আধভাঙা হাত বিস্তৃত করে বললেন এই সেই বাপ্পী দা। বুঝলাম রাত্রিতে আধোঘুম আধোজাগরণে শোনা বাঙ্গালী দাদার কথা। আমি সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম। জিগগেস করলাম, দাদা বাড়ি কোথায়?

কম দামের পরিপাটি পোশাক পরা চল্লিশের আশপাশের বয়সী এক ভদ্রলোক। নীল শার্টের ওপর রোঁয়াওঠা ঘিয়ে হাফ সুয়েটার। মুচকি হেসে বললেন, বাড়ি যদি বলেন সব তো ওপারে। 

একটা ধাক্কা খেলাম। কি বলে লোকটা!

কিন্তু ভদ্রলোক নির্বিকার। তার আপন কর্মে ব্যস্ত। ছোট্ট ঠেলা ভ্যানে গ্যাসের স্টোভ। তাতে বড়ো একটা তওয়া বসানো। তাতে খুব ক্ষিপ্রতার সাথে ডিম ভেঙে দিচ্ছেন। বড়ো একটা চাপাতি তাতে চাপিয়ে কখনো এগরোল কখনো কিচেন রোল করছেন। লোকজন বাইক কিংবা রিক্সা থামিয়ে কিনে নিচ্ছে হরদম।

- আর ঘর করেছি বর্ধমান।

- গিয়েছেন কখনো?

- হুম।

- কোথায়?

- মাদারীপুর।

- আসেন একবার দেখে যান।

- খুব যাওয়ার ইচ্ছে দাদা।

- আমি ঢাকাতেই চাকরি করি। আসলে থাকা খাওয়া ফ্রি। আমার ওখানেই থাকতে পারবেন।

অফারটি পেয়ে চকচক করে উঠল তার চোখের তারা দুটি। ছেনি দিয়ে কড়াইতে লেগে যাওয়া ডিম পোচটি তুলতে তুলতে বললেন, ঢাকা কি শহরেই থাকেন আপনি?

আমার অবস্থান তাকে বিশ্লেষণ করলাম।

- তা সেখান থেকে চরভদ্রাসন কেমন দূর?

তখন হার্ড ব্রেক কষে দাঁড়ালো এক বাইক। সুদর্শন যুবকের পিঠে উবু হয়ে আছে রোগা এক তরুণী। 

- দাদা চিকেন হবে।

বাপ্পী দা মুচকি হেসে উঠলেন, দাদা পরিচয় হয়ে নিন। অনেক দূর থেকে এনারা এসেছেন। বাঙালাদেশ।

যুবক মাথার হেলমেট খুলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে উঠল, আমরা তো ওখানকার লোক।

- কোন জায়গার।

- সে বলতে পারব না। আমার দাদার দাদা এসেছিলেন। তবে তারা করিমগঞ্জ এসে উঠেছিলেন পরে।

- আমার ধারণা আপনার আদি নিবাস সিলেট। সিলেটের পাঁচটি পরগানার একটি ছিল করিমগঞ্জ। ৪ টি পাকিস্তানের সাথে গেলেও ওটা যায় নি। সিলেটের হিন্দুরাই মূলতঃ করিমগঞ্জ গিয়ে ওঠে ...

- হতে পারে। সেটা কি শ্রীহট্ট। ছোট্টবেলায় অনেক শুনেছি।

- আজ্ঞে। আর যদি তাই হয় আমি আপনার এলাকার ছেলে।

অরুণাভ আমাকে জড়িয়ে ধরল। পরিচয় হলো। ও এখানে লোকজনদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দেয়। ওর স্ত্রী ফ্যাশন ডিজাইন পড়ায়। অরুণাভ আর বাপ্পী দা’র দুজোড়া উজ্জ্বল চোখ আমাকে ঘিরে ধরল।

- আচ্ছা দাদা তোমাদের ওখানে কি সব সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা?

- আচ্ছা দাদা মোসলমানরা কিভাবে কথা বলে একটু শোনাবে?

- ঢাকা কি এখন কলকাতার চেয়েও বড়ো?

- কতক্ষণ লাগল তোমাদের আসতে?

আমি গল্প শোনাই তাদের বাড়ি বলে পরিচিতি দেশটার। এই দেশ এখন জিন্স উৎপাদনে শীর্ষে। পোশাক কৃষি মৎস সকল ক্ষেত্রে যার সাফল্য ঈর্ষণীয়।

হাহাকার উঠে বাপ্পী দার কণ্ঠে, নেহেরু জিন্নারা যদি ভাগাভাগিতে না যেত ... আফসোসে তাওয়াতে ছেনি ঘঁষে। আঁশটে খাবার প্লেট তার ভ্যানে রাখতে গেলে হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে মায়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয়। 

- তা দাদা কেমন খরচ লাগতে পারে একবার যেতে।

- ধরুন, ভিসায় লাগবে ৩ শ রুপি, আর ট্রেনে সাড়ে পাঁচশে চলে যেতে পারেন, আর ঢাকায় গেলে তো আমার ওখানেই উঠবেন-। তবে চরভদ্রাসন যেতে আসতে শ পাঁচেকের মধ্যে হয়ে যাবে। ঢাকা থেকে ঘন্টা দুয়েক লাগে নবাবগঞ্জ। তারপর পদ্মা পেরুলেই চর ভদ্রাসন। দিনে গিয়ে দিনে আসতে পারবেন। তবে সেটা মাদারীপুর নয়। ফরিদপুর।

- ও, ছোটবেলায় ঠাকুর দার সাথে গিয়েছিলাম। তখন তো মাদারিপুর শুনলাম। আচ্ছা দাদা পাসপোর্ট লাগবে না।

- অবশ্যই লাগবে দাদা। বাংলাদেশ এখন বিদেশ। বিদেশে গেলেই পাসপোর্ট লাগে দাদা।

- কই দাদা, নেপাল ভুটানে তো আমাদের পাসপোর্ট লাগে না। ওখানে আমাদের আত্মীয় নেই স্বজন নেই মাটি নেই নদী নেই- তারপরও পাসপোর্ট লাগে না। আর আমাদের বাড়ি বলে বিদেশ। সেখানে যেতে পাসপোর্ট লাগবে, এটা একটা কথা দাদা।

আচমকা হওয়ার মতোই বাপ্পী দার কথাগুলো ধাক্কা মারল আমাকে। আমি যেন টাল মাটাল হয়ে পড়ি। কি দেব উত্তর?

অরুণাভ দুটো চিকেন রোল নিয়ে চলে যায়। আমি আর অধ্যাপক একটা আটকে পড়া মানুষের মুখোমুখি। সে যেন পথ খুঁজছে বেরিয়ে পড়ার। আর মুক্তির পথনকশা যেন আমাদের হাতে। দুটো চিকেন রোল আর এক বাটি চাউমিন নিয়ে ফিরলাম ধর্মশালায়। সকালে উঠে দেখি ভদ্রলোক হাজির। আমাদের নিয়ে গেলেন গঙ্গার ঘাটে। নৌকো ঠিক করে দিলেন ভ্রমণের। ফিরে এসে দেখি সাইকেল হাতে অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য। সঙ্গ দিলেন কেনাকাটায়। দুপুরে যখন কোন গাড়ি পাচ্ছিলাম না মোগলসরাই যাওয়ার, ফোন করার সাথে সাথে কাঁচা ঘুম ভেঙে চলে এলেন রাস্তায়। ছোটাছুটি করে একটা টেক্সি ঠিক করে দিলেন। টেক্সি ছাড়ার আগে হাত দুটো ধরে খুব আবেগভরে বললেন, আবার দেখা হবে দাদা।

- দেরি করবেন না দাদা। বদলির চাকরি তো, কখন ঢাকা থেকে সরিয়ে দেয়-

টেক্সি রওনা দেয়। অধ্যাপক মুচকি হাসেন, নিশ্চিন্ত থাকেন, ভদ্রলোকের ঢাকা যাওয়া হচ্ছে না। পাসপোর্ট ভিসা এতো কিছু করে আরেকটা দেশে যাওয়ার সময় ও সামর্থ্যই বা কই তার?


মনটা ভারী হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে বাপ্পী দার আত্মাটা আমাদের টেক্সির পিছনে পিছনে ছুটছে। একটু পরে আনন্দবিহারে চেপে বসবে। তারপর কলকাতা হয়ে ঢাকায়। আত্মার তো পাসপোর্ট ভিসা এতো কিছু লাগে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

8 মন্তব্যসমূহ

  1. সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম২৪ এপ্রিল, ২০১৭ এ ১২:০৫ PM

    বাক্য গঠনগুলো এমন আমোদ দিচ্ছিল।মনে হচ্ছিল তারাপদ পড়ছি।দারুণ বর্ণনা। শুরুটা যেমন করে হোল, ভেবেছি দুই ভাষাবিদের আরও কিছু ভাষা প্রয়োগের নমুনা পাবো। তবে কোন এক কারণবশত চরভদ্রাসন থেকে আগের প্রজন্মে যাওয়া বেনারসের ডিমওয়ালার জন্য মায়া তেমন হচ্ছেনা। সাময়িক একটা আক্ষেপ তাঁর হবে বা ইচ্ছে হবে আসার এরপর জীবনই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেবে, সারিয়ে দেবে। হয়ত দেশের বাড়ির প্রতি তাঁর মায়ার আরও কিছু বর্ণনা পেলে পাঠকের সহমর্মিতা বাড়ত। বরং বাংলাদেশের যারা আপনজনদের দেখতে বা চিকিৎসার জন্য ভারত যাবার ভিসা অফিসের লাইনে দাড়ান তাদের জন্যই মায়া। সারাদিন একটা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যদিও ফিকশন আর ফ্যাক্ট মিলিয়ে বললাম। সুন্দর লেখা জয়দীপ দে। /সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ। আমার কোন গল্পের পেছনে এ পর্যন্ত কেউ এতো শব্দ খরচ করেনি। আপনি প্রথম করলেন। এক ধরনের দায়বোধে বাধা পড়লাম। কত কি করার ছিল, কিন্তু এতো কিছু করার শক্তি আমাকে দেয় নি ঈশ্বর। আশা করি ভবিষতেও গল্পগুলো পড়বেন। ধন্যবাদ। আবার আসবেন। :)

      মুছুন
  2. ভালো লেগেছে। বলার ভঙ্গিটা সরস। তবে লেখা কনভার্ট করাতেই নাকি কে জানে কয়েক জায়গায় বর্ণ ভেঙে গেছে।-সাদিয়া সুলতানা

    উত্তরমুছুন
  3. Oshadharon lekha, aami benares er bangali
    Shunechi amaader o aadi badi Bangladesh chilo, shutoraang jyano khub beshi relate korte parlaam.
    Dhonnyobaad ei shundor lekhatir jonnye
    Arnab

    উত্তরমুছুন