সাধন দাস'এর গল্প : টোপ

যেহেতু রান্নাঘরের খোলা বারান্দাকে কোনো অভিযোগ করা চলে না। ভোরের উঠোনে বাইরে যাওয়ার পথে চোখ বাঁধার প্রশ্নও ওঠে না। তাই লবধনদাদাকে লুঙিতে গিঁট বেঁধে, কাছা মেরেই ঘুমুতে হতো। মেয়েদের লজ্জা নিবারণের আর কোনো উপায় ছিলো না। গায়ে ঢাকা দেওয়ার যে চাদরখানা, সেও পর্দায় পর্দায় ছেঁড়া, ফুটোফাটাতে ভর্তি। লুঙি উচাটন আর চাদরের ফুটোফাটাতে আকছার দুর্ঘটনা ঘটতোই। যে ঘুমোয় তার লজ্জা থাকে না। তবু লবধনদাদা সে দায় নিয়েই ঘুমুতেন। কেনো না, তাঁর দোষের অন্ত ছিলো না।

বিনি দোষের দায়ে কার না রাগ হয়! নেহাৎ তোতলা, রেগে ঊঠলে আরও তোতলাতে হয়। নইলে.. তিনি জানেন, রাগী মানুষেরাই.. .. ..তো, ত্তো তো আবিষ্কারক। অগত্যা ভোরের নির্দোষ উদয় এবং সংসারের মর্যাদার কথা ভেবে শেষমেষ লুঙিতে গিঁট বাঁধার উপায়টা তিনিই আবিষ্কার করেছেন। আর মেজকা বলে কিনা, উপায়টা তিনিই বাতলেছেন। সেই দুঃখেই লবধনদাদা রেগে ওঠেন। 

জেগে থাকলে তাঁর রেগে ওঠার আইন নেই। সংসারে রাগ করার অধিকার একমাত্র ঠাকুদ্দার। অগত্যা ঘুমুলেই লবধনদাদা বাঘের মতো গর্জন করেন। কিন্তু জানেন না, বাঘ জাতীয় পশু। বাঘের গর্জন জাতীয় গর্জন। ঘুমন্ত বাঘের দায়দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা করতেন,

–এ্যাঁঃ হ্যাঁ, ঘু ঘু ঘুমাইলে আমি বা বাঃঘের মতো গও গ অর্জন করি।

ঘোষণা করতেই হতো। করণীয় কিছু ছিলো না। গর্জনের দোষ তাঁর আদৌ ছিলো কিনা, তিনি জানতেন না। ঘুমিয়ে পড়লে, কানও ঘুমিয়ে থাকে। নিজে কোনোদিনই নিজের নাকের বেইমানি শোনেননি। অথচ এ বাড়ি ঢুকে পর্যন্ত শুনে আসছেন, তিনি একা নন, তাঁর চোদ্দপুরুষ একই দোষে দুষ্ট। বাপ ঠাকুদ্দার মুখেও শুনেছেন, নাকের গর্জন তাঁরাও কোনোদিন শোনেনি। দেড়ট্যাকার মাহিনদার হওয়ার দরুন, নিজের এবং চোদ্দপুরুষের দোষ তাঁকে মানতেই হতো। এমন কি পুচকে ভোম্বলের কাছেও। এবং প্রমাণ হয়ে যেতো তিনি ঘুমের মধ্যেও রাগী মানুষ। দেড়টাকার মুনিষ-মাহিনদারদের রাগ করা বে-আইনি, ঘুমের মধ্যে হলেও। 

ভোরেরবেলা রাগের মহড়া যখন বাইরেফেরৎমুখে মেয়েমহলে পৌঁছুতো, হাসাহাসির কেলেংকারি বেঁধে যেতো। হাসিতে হোঁচট খেয়ে লবধনদাদা উঠে বসতেন, ছেঁড়াছুটো দলাপাকানো বিছানায়। ঘুমঘুমে ভ্যাবলা চোখে তাকিয়ে থাকতেন। উঠোন ঝাঁটাতে ঝাঁটাতে নক্ষিপিসি বলে উঠতো 

– মরণদশা! 

আশ্চর্য ব্যাপার, লবধনদাদা নিজের দোষ কিছুতেই খুঁজে পেতেন না। নক্ষিপিসি যতো হাতে মুখে থাবা মেরে বাঁচাবার চেষ্টা করতো, তিনি ততো খেপে উঠতেন। বিনিদোষে মাপ চাওয়া তাঁর ধাতে সইতো না। মাথা উঁচু করে হাত পা গলা, সর্বাঙ্গ নেড়ে, গর্জন করেই যেতেন, তাঁর কোনো দোষই নেই। তু তুতলিয়ে যত প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন, আশেপাশের আকাশবাতাস ভেঙে চোদ্দপুরুষের দায় ঘাড়ে ভেঙে পড়তো। মেষশাবকের জল ঘোলা করার নিয়ম অনুযায়ী, অপরাধ ততো বেরিয়ে পড়তো, নির্ভুল প্রমাণের জালে আরও জড়িয়ে পড়তেন এবং আইন ভঙ্গের দায়ে শাস্তি পেতেন। তখন নক্ষিপিসির মুখনাড়াও খেতে হতো। 

- মুকখু, মরা ভ্যাবলা, নিরেট কোথাকার! 

গর্জনের শাস্তি হিসেবে নিদেন দিতেন ঠাকুদ্দা। বাড়ির পিছনে একুশ কাঠা বাগানচৌহদ্দি, সাড়েসাত পাক দৌড়। ভ্যাবলামরা গুনতেও জানে না। গুনতে হতো সেই নক্ষিপিসিকেই। নইলে মুকখুটা দৌড়েই যেতো দৌড়েই যেতো। 

মেজকা ছোটকার গোপন ষড়যন্ত্রে, গর্জনের প্রতিষেধক হিসেবে কোনোকোনো দিন কড়া পাকের (এন সি) নস্যি, অদৃশ্য বুড়োআঙুলতর্জণীর ফাঁক গলিয়ে গর্জায়মান নাকের ফুটোয় ঢুকে যেতো। ফাঁদে পড়া জাতীয় পশুর হ্যাঁআঁআচ্চো বিস্ফোরণে জেগে উঠতেন লবধনদাদা, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেন, কুয়াশাময় দশদিকে কেউ নেই। বোকার শেষ সম্বল হাসি আর অপমান ছেঁড়া চাদরে মুছে, আড়ামোড়া গোল্লায় দিয়ে, বিছানা গোটাতে লেগে পড়তেন।



খোরপোষের মদ্দামানুষ, মেয়েমানুষেরও অধম। বসলে কুষ্টা কাটে, উঠলে ছেলে ধরে। ভোরের আলো চৌকাঠ মাড়াতে না মাড়াতে কাজের হুকুম আর ধমক ঝাঁপিয়ে পড়তো। সংসার জ্বালার পাথারে হাবুডুবু খেতেন। তবু নক্ষিপিসির কাজের চাপ কমানোর সালিশ করেছিলেন একদা। সেই অপরাধে, খামারে গোবর নিকোনো, ফুলবাগানে জল দেওয়া, ধবলির দুধ দোয়ানো নক্ষিপিসির তাবৎ বাইরের কাজ লবধনদাদার ভাগে পড়ে গেছে। সেই গন্ধমাদন ঠেলে, আমাদের দাঁত মাজানো, মুখ ধোয়ানো, সাজানো, পড়তে বসানো, মাষ্টার পাহারা দেওয়া, কাজের পাহাড়ে প্রতিপদে, দ্বিতীয়ায়, পূর্ণিমায়, অমাবস্যায় ভুল আর দোষ করেই যেতেন। তোতলা মুখে কিছুতেই বোঝাতে পারতেন না, যে ঝাঁট দেয় তাঁরই উঠোনে কুটো পড়ে থাকে, যে মাজে তাঁরই বাসনে এঁটো লেগে থাকে। যে হাঁচে তাঁরই নাকছিটকে সর্দিমর্দি বেরোয়। যাঁরা কাজই করে না, তাঁদের ভুল হবে কোত্থেকে! 

লবধনদাদা বুদ্ধির ঢেঁকি। বুদ্ধি ভাঙানোই তাঁর অভ্যেস। নস্যির হ্যাঁচ্চো ঠাকুমা, মা-কাকিমাদের দিকে না সামলিয়ে, চাদর, লুঙি আর নক্ষিপিসির দিকে ঝাড়তেন। আর নক্ষিপিসির দোষ ঢাকতেন। তখন মা কাকিমারা হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তো। 

নক্ষি করুণাময়ী পিসি। হাসাহাসি, মুখ টেপাটিপি গায়ে মাখতো না। তাঁর কাছে লবধনদাদার সাতহাঁচি মাপ। দু’জনেরই সাত কুলে কেউ নেই। এপার বাংলা ওপার বাংলায় ভাসতে ভাসতে ডুবতে ডুবতে ওজলার মতো এ সংসারের চরে ঠেলে উঠেছে। নক্ষিপিসিকে সবাই বলে, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। 

লবধনদাদাকে বলে -যত্তোসব আপদ বালাই। 

সংসারের মাঝদরিয়ায় বাস করতেন ঠাকুর্দ্দা। সক্কাল সক্কাল ভোরসেরে বৈঠকখানায় এসে বসতেন। ফটফটে পাঞ্জাবী, কোকিল পেড়ে ধুতির কোঁচা ঝুলতো কেদারার পাশে। চব্বিশ ঘন্টা বৈঠকখানার দরোজা, জানালা খোলা থাকতো। ঠাকুদ্দার নজর এড়িয়ে পিঁপড়ে পর্যন্ত অন্দরে ঢুকতে-বেরুতে সাহস পেতো না। পান থেকে চুন খসলেই বাজখাঁই হাঁক পাড়তেন

–নক্ষিইইইই.. ..

নক্ষি ছুটতে ছুটতে হাজিরা না দিলে হুলুস্থুলু বাঁধিয়ে দিতেন। ‘লবধন’ আর ‘ঠাকুর’ দুই দাদার ঠেলায় বাড়িশুদ্দু মানুষ অস্থির। 

অনেক রাতে হাট থেকে গোরুরগাড়ি চড়ে আসতো ঠাকুদ্দার পান চুন টিকে তামাক.. ..আমাদের জন্যে দানাদার, জিলিপি, বোঁদে। গাড়ি এসে পৌঁছুলে, দিনের খবরাখবর নিয়ে ঠাকুর্দ্দা শুতে যেতেন। মিষ্টিমাষ্টা ভাগ করতো লবধনদাদা। তখন আমরা ঘুমিয়ে থাকতাম। ভাগের সাক্ষী থাকতো নক্ষিপিসি। 

ভোরের স্বপ্নে ঘুম ভেঙে বালিশের নীচে পেতাম হরেক মিষ্টি, দানাদার। ভাগের সমতা নিয়ে চুল চেরা বিচার হতো। রাত থাকতে উঠে এর ওর বালিশের তলা থেকে ছোটকা, মেজদা প্রায়ই দু এক পিস সরিয়ে ফেলতো। তাঁদের ভাগে কম পড়তো, সেজদি শেষ রাতে ঘুম চোখে দু এক পিস খেয়ে নিতো। কিন্তু ঘুমের মধ্যেই ভুলে যেতো। জেগে উঠে ভাগে কম পেয়ে কাঁদতে শুরু করতো। অরাজকতার দায় গিয়ে পড়তো লবধনদাদার ভাগে। ঠাকুর্দ্দার হুকুমে দোষপ্রতি শাস্তি ছিলো দু’ঘা বেত, নক্ষিপিসির দয়ার শরীল। দোষ ভাগ করে নিতো। এক ঘা পড়তো লবধনদাদার পিঠে, মেয়েমানুষ বলে আধখানা মকুব হয়ে আধখানা পড়তো নক্ষিপিসির হাতে। 

কেউ দাঁত না মেজে বাসি বিছানায় দানাদার খেয়ে ফেললে, ছোটোবোন চোখ খুঁটে পিঁচুটি চুষলে, ভোম্বল যদি বিছানায় পেচ্ছাপও করে ফেলতো দোষ হতো লবধনদাদার।, দোষ ভাগ করে নিতো, ছাই ফেলতে ভাঙাকুলো, নক্ষিপিসি। এই একজোড়া অকম্মারঢেঁকি, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে উঠবোস, কান মোলা, নাক ঘেঁষটানো শাস্তি ভোগ করতো, দেখতে দেখতে আমাদের বই পড়া চলতো পুব থেকে পশ্চিমমুখো দালানজুড়ে। ঠাকুদ্দা আলবোলা মুখে আরামকেদারায় বসে থাকতেন। ভুড়ুক ভুড়ুক ধোঁয়া ছাড়তেন। জ্ঞান অর্জন আর শাস্তির হিসেব রাখতেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। 

ভুড়ুক ভুড়ুক ধোঁয়া আকাশে উড়ে যেতো, মুক্তির অপেক্ষায় থাকতো অকম্মার ঢেঁকিরা। কখন শাস্তি শেষ হবে। আরাম কেদারা বলে উঠবে,

– থাক, থাক, হয়েছে। কাজে যা। এমন আর করিসনে।



সেদিন দুপুরে না ঘুমিয়ে মেজদা আর ছোটকা চুরি করে পালিয়েছিলো চিতেকচার মধু খেতে। চোর দায়ে ধরা পড়ে গেলো লবধনদাদা। শাস্তি পঞ্চাশবার কান মোলা, একশোবার উঠবোস। কান মোলা গেলো নক্ষিপিসির ভাগে। উঠবোস লবধনদাদার। করেই যাচ্ছে। অনন্ত কাল ধরে লবধনদাদা উঠবোস করেই যাচ্ছে, কানমুলেই যাচ্ছে নক্ষিপিসি। পঞ্চাশ একশো হয়ই না। হবে কী করে? নক্ষিপিসি এককুড়ির বেশিতো গুনতে জানে না। লবধনদাদা গুনতে জানেই না। গুনতে জানলেই বা লাভ কী হতো! কানমোলার মাঝে মাঝে গিয়ে কুটনো কোটা, বাটনা বাটা সব কাজই পিসিকে করতে হতো। আমাদের চান করানো, স্কুলে পাঠানো, ধবলির জল ধরানো সবই লবধনদাদাকে করতে হতো। ঠাকুদ্দা অর্ডার দিয়ে আলবোলার আরামে ঘুমিয়েই পড়তেন। আমরা স্কুল চলে যেতাম। 

সে একদিন দুপুরবেলা, ছুটির দিন, হয়েছে কি, উঠবোস কানমোলার মধ্যে আমরাও কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ দেখি, ঠাকুর্দ্দা ভীষণ রেগে গেছেন। হুঙ্কারে বাড়িশুদ্দু মানুষের ঘুম ভেঙে গেছে। এতো বড়ো আস্পর্দা, কানমোলা উঠবোস বন্ধ করে দিয়েছে! লবধনদাদা, নক্ষিপিসির বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে শুয়ে আছে! 

–ওখানে কী হচ্ছে? এ্যাঁ!! উঠে আয় হতচ্ছাড়া,

লবধনদাদা ধড়মড় করে থেবড়ে বসে পড়েছে মেঝেতে। দু’হাতে চোখ ডলছে। 

-উঠে আয় বলছি।

কেঁদেই ফেলেছে দু’জনে।

লবধনদাদা কঁকিয়ে উঠলো -এঁ এঁ এঁজ্ঞে, পা ট ট টঅন টন কচ্ছিলো। 

নক্ষিপিসি নাক গলিয়ে বললো – পা ফসকে পড়ে গিয়েছে, কাকা। ও কিছু করেনি। 

লবধনদাদা তখনও কেঁদেই চলেছে। উঁ উঁ উঁ উঁ.. ..

চেঁচামেচি শুনে সবাই, এমন কি বেতো ঠাকুমাও দুলতে দুলতে এসে হাজির। নক্ষিপিসি বিপদে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলো – বেহায়া মিনসে, ওঠ, উঠবোস কর। বাবুরবাড়ি আরাম খাওয়া, না? 

ঠাকুমা দেখেশুনে বললেন – দাও, ওদের বিয়ে দে দাও। 

ঠাকুমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে ঠাকুদ্দা বললেন- বিয়ে! ত্যাল পানা কলের গান? তখন ওরা ওদের সংসার সামলাবে, না আমাদের ?

ঠাকুমা ঘাড় দুলিয়ে স্বীকার করে নিলেন- তা বটে, তাদেরওতো বাচ্চাকাচ্চা হবে। তারাও বাঘের মতো গর্জন করবে।

ঠাকুদ্দা বাঘের মতো হুঙ্কার দিলেন- বেরো, বেরো বলছি বাড়ি থেকে। ভয়ে দু’জনই কেঁচোর মতো দরোজার দিকে পিছন-সরতে আরম্ভ করেছে। আবার হুঙ্কার – নক্ষিইই ই তুই যাচ্ছিস কুথায়? ওখেনে একপায়ে দাঁড়া। কেলংকারি না বাঁধালে নয়? লবাআ.. .. তুই একা যে চুলোয় যাবি যা। 

কারো মানা-চোনাতেই কিছু হলো না। লবধনদাদার সম্পত্তি, একটা কাপড়ের পুঁটলি আর একটা তামারঘটি, নিয়ে সে চলে গেলো। দুপুরে খায়নি। না খেয়ে মানুষটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। সেই কষ্টে নক্ষিপিসিও কিচ্ছুটি দাঁতে কাটলো না। উপবাস রয়ে গেলো। সংসারের কাজে কোনো খেতি করলো না। ঠাকুদ্দা অবেলায় লেজের মতো কোঁচা চেপে ধরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। বেলা তিনটের পান আর খেলেন না। 

ঠাকুমাও কবে থেকে বলে আসছেন, ওদের বিয়ে দে দাও। মেয়েমানুষের কথা কে শোনে? 

সেই দুঃখে ঠাকুমাও দোক্তা খেলেন না। 

মা ইচ্ছে প্রকাশ করলেন- ওদের ছেলেপুলে হলেতো কাজের লোকের অভাব থাকতো না। 

সবাই জানে, বিকেল নামতেই ঠাকুদ্দা, ঠাকুমার মাথার যন্ত্রণা শুরু হবে। 

মা বললেন, একজনের মাথা অন্তত ঠিক থাক। 

বলে, একজোরা পান মুড়িয়ে গালে ঠেসে দিলেন। 

সংসারে অনাসৃষ্টি কিছু ঘটলেই বিচারের দায় পড়তো ঠাকুদ্দার ভাগে, সব শাস্তিই গিয়ে বর্তাতো সবেধন নীলমণি লবধনদাদার ঘাড়ে। নীলমণির মুখস্থ হয়ে গেছে কোন কোন দোষে কী কী শাস্তি হয়। ভাগের শাস্তি খেতে খেতে নক্ষিপিসিও যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের অঙ্কে, উত্তরমালা হয়ে গেছে। খিটকেল হতো ঠাকুদ্দা যখন নিজে দোষী হতেন। মূহুর্তের হুঙ্কারে শাস্তি পেয়ে যেতো অকম্মার ঢেঁকিরা। নক্ষিপিসির 



অঙ্ক সব ঘুলিয়ে যেতো। ঠাকুদ্দা চেঁচিয়ে উঠতেন। – যা বেরিয়ে যা। হতভাগা, তোরা থাকতে আমার এই হেনস্থা! অকম্মার ঢেঁকি! থাকলেও যা, না থাকলেই তাই। 

দু’একবার ঠাকুমার ছিচরণে, মায়ের পদপল্লবে লুটোপুটি খেয়েছিলো দু’জনে। বুঝে গেছে, বিচার বিভাগে মেয়েমানুষের ঠাঁই নেই। হাকিম নড়েতো হুকুম নড়ে না। অগত্যা লবধনদাদা কাপড়ের পুটুলি, তামার ঘটি সম্বল নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতেন। আজকাল পুঁটুলি, ঘটি লবধনদাদার রেডি হয়েই থাকে। 

পান না খেলেও সন্ধেবেলা গড়গড়ায় টান পড়ে। তামাক সাজানো, টিকে ধরানো আলবোলার নল হাতে ধরিয়ে দেওয়া, অনেক কাজ। খোঁজ পড়লো লবধনদাদার। 

- কোথায় সে আপদবালাই ? 

অকম্মারঢেঁকি নক্ষির দ্বারা এসব হয় না। বাড়ি ছেড়ে যে ভাগাড়েই যাক, সন্ধেবেলা এসে গড়গড়াটা সাজিয়ে গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় ? চাকর-বাকর পোষা নাতো ভস্মে ঘি ঢালা। 

ডাক পড়তেই আমরা পড়াশুনো শিকেয় তুলে হেরিকেন আর লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়লাম লবধনদাদার খোঁজে । 

বাড়ির পিছন লাগোয়া একুশকাঠার আমবাগান। এখন গাছে গাছে খুঁজে বের করতে হবে, লবধনদাদা কোন গাছে চড়ে আছেন। দুঃখের গভীরতা, ব্যপ্তি এবং গোপনীয়তার মাপ অনুযায়ী গাছের বয়স, উচ্চতা, আয়তন বুঝে খুঁজতে হতো। খবর পেলে, ঠাকুর্দ্দা এক হাতে কোঁচা, অন্যহাতে ছড়ি বাগিয়ে নিজে আসতেন। যদি সাপে-খোপে কাটে, ঘুমের ঘোরে গাছ থেকে পড়ে হাত পা ভাঙে, সেই অপরাধে মারতে মারতে লবধনদাদাকে ফিরিয়ে আনতেন। আর বেত খাওয়ার ভাগ চেয়ে পায়ের কাছে লুটোপুটি খেতে খেতে নক্ষিপিসি গড়াতে গড়াতে আসতো। মারতে মারতে ঠাকুর্দ্দা বারবার ঘোষণা করতেন, 

-পাঁজি-পুঁথি দেখে এবার তোদের বিয়ে দেবোই। যার যার সংসার সে সে দেখে নেবে। আমি আর ক’দিন! 

বলে আরো দু’ঘা কষিয়ে দিতেন, 

- কেনো হুঁশ থাকে না, কেনো? তামাক সাজার সময় পার হয়ে যাচ্ছে? গাছ থেকে নেমে, তামাক সেজে এসে, হারামজাদা, গাছে চড়তে পারতো। 

তাহলে ঠাকুদ্দা তামাক খেয়ে, লাঠি হাতে ধীরে সুস্থে আসতে পারতেন। খুব বাড় বেড়েছে। 

বিচারের রায়ে, যতোবার লবধনদাদা গাছে চড়তো আমরা পড়ে যেতাম মহা মুশকিলে, মার খেতে খেতে ফেরার পথে ঠাকুদ্দা প্রত্যেকবার বিয়ে দেওয়ার টোপ ঝুলিয়ে রাখতো দুই হতচ্ছাড়ার সামনে। আমরা ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে যেতাম, পিসি আমাদের বৌদি হবে, না দাদা আমাদের পিসেমশায়! 

বড়দা মেজদা, ভোম্বল পর্যন্ত আমরা ঠাকুর্দ্দা হয়ে গেছি। সংসার ভাগ হয়ে গেছে। যার যার সংসার সে সে দেখে নিচ্ছি। হয়রানির আসান হয়নি, বৌদি, না পিসেমশায়! তাই নিয়ে নয়াযুগের মেয়ে মহলেও হাসাহাসি চলে। হাসাহাসির সংসার ভাগ হয়নি। আড়ে আবডালে নক্ষিপিসিকে বলে বৌদি। লবধনদাদাকে বলে পিশেমসাই। মা’র কাজের হিল্লে অবশ্য একটা হয়েছে। আড়েআবডালে দুটো বেওয়ারিশ মানুষেরবাচ্চা পাওয়া গেছে। বৌদি পিসেমশাইয়ের কাছেই মানুষ হচ্ছে। ওরাও বৌদিকে বলে- নক্ষিপিসি। পিসেমশাইকে বলে লবধনদাদা। 

বড়দা বলে-- দূরদর্শী ঠাকুদ্দা এটাইতো চেয়েছিলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ