সাত্যকি দত্ত'র গল্প : বৃক্ষ-পুত্র

সামনের সেপ্টেম্বরে শ্যামল বাবুর অবসর জীবনের দশ বছর সম্পূর্ণ হবে । স্ত্রী মারা গেছে বছর চারেক হয়েছে আর ছেলে অনেক দিন হলো কানাডাতে , বাবার কথা তার আর মনে নেই । এখনকার কাজের লোকের উপর তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না বলে , কাজের লোক রাখেননি , সব কিছু নিজের হাতেই করেন ।
দুবেলা অবশ্য খাবার আসে পাশের হোটেল থেকে কারণ কোনোদিনই ওর রান্না জিনিসটাকে ঠিক ভালো লাগে না । অনেক অবসর প্রাপ্ত মানুষের সাথে শ্যামল বাবুর পার্থক্য হচ্ছে , ওর জীবনের অবসরটা অখন্ড অবসর যেখানে স্ত্রীর বকাঝকা নেই , ছেলের মুখে বাবা ডাক নেই , বৌমার আদর নেই , নাতিকে রূপকথার গল্প শোনানোর নেই । সারাদিনে কী করেন শ্যামল বাবু ? খুব ভোরে উঠে হাঁটতে যান , ফিরে নিজেই চা বানিয়ে খান , তারপর অনেকদিন আগে পড়া বই গুলো আবার নতুন করে পড়তে বসেন , এরপর দুপুরের খাবার শেষ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্য চিঠি লেখেন , যেমন চিঠি তিনি চল্লিশ বছর আগে লিখতেন , লেখা শেষ করে বিকালে ছাদে গিয়ে বসেন , সন্ধ্যা নামা দেখেন , এই সময়টা বেশিরভাগ দিনই তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে , কোনো কারণে নয় এমনি এমনিই কাঁদতে ইচ্ছে করে , কোনো কোনো দিন কাঁদেনও ! সেদিন যেমন তিনি কাঁদছেন , হঠাৎ দেখেন একটা বিড়াল ছানা পায়ের কাছে এসে বসে বসে তাকে অবাক হয়ে দেখছে , শ্যামল বাবু তাকে কেক বিস্কুটের কত লোভ দেখালো , কিন্তু থাকলোই না , সেও চলে গেলো আর এলো না । সন্ধ্যার পর তিনি ঘরে বসে বসে রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন , শ্যামল বাবুর মনে হয় রবীন্দ্রনাথ আসলে কোনো সুখের গান লিখে যান নি , ওঁর সব সুখের গানে সুখ বাজে ঠিকই কিন্তু তাও ব্যথার মতো ! এরপর তিনি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েন । কিন্তু ইচ্ছে করে ঘুমান না ,কারণ ঘুমালেই আজকাল তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেন । দেখেন তার ছেলেটা কানাডায় চলে যাচ্ছে , স্ত্রী মারা যাচ্ছে - ওদের আরও একবার হারাতে তিনি চান না ।

বেশ কিছু দিন হলো শ্যামল বাবুর কিছু মানসিক সমস্যা হচ্ছে বলে হয় । কারণ তিনি মানুষের ভাষা ঠিক বুঝতে পারছেন না , এর বদলে তিনি বুঝতে পারছেন গাছের ভাষা , যদিও সব গাছের নয় , শুধুমাত্র একটি তেঁতুল গাছের । সেদিন হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ খুব হাঁফ লেগে যেতে তিনি একটি পুরাতন তেঁতুল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন , ওদিকে সূর্য উঠছে , বনে বনে পাখিরা ডাকছে , তেঁতুলের কচি সবুজ পাতায় নরম বাতাসের দোল লাগছে । ওমন সবুজ পাতার দোল দেখে শ্যামল বাবুর ভারী ভালো লাগলো , তিনি এমনি নিজের খেয়ালে বললেন - " এই যে বৃক্ষ , বেশ তো আছো এই বুড়ো বয়সেও ।" এরপরই তিনি আশ্চর্য ভাবে শুনতে পেলেন , " হ্যাঁ তা আছি । আপনি কেমন আছেন ? " শ্যামল বাবু চারিদিকে তাকালেন , না কেউ নেই , আবার তিনি গাছকে বললেন , " বৃক্ষ আমি কি ঠিক শুনলাম , তুমিই কথা বললে ? " আবার তিনি শুনলেন , হ্যাঁ আপনি ঠিকই শুনেছেন , " আমি বৃক্ষ বলছি । " শ্যামল বাবু হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলেন , বাড়ি ফিরলেন তীব্র মাথার যন্ত্রনা নিয়ে আর এরপর থেকেই তার মনে হচ্ছে যে তিনি আর মানুষের কথা বুঝতে পারছেন না । 

আজকাল শ্যামল বাবু প্রতিদিন স্খুব ভোরে উঠে হেঁটে হেঁটে সেই বৃক্ষ পর্যন্ত যান , অনেকক্ষণ ধরে তার সাথে গল্প করেন এবং বাড়ি ফেরেন তীব্র মাথার যন্ত্রনা নিয়ে । শ্যামল বাবুর পাড়ার সবাই গাছের সাথে গল্প করার সেই দৃশ্য দেখে ধরেই নিয়েছে উনি পাগল হয়ে গেছেন । তবে শ্যামল বাবু কিন্তু দিব্যি ভালো আছে , রাতে এখন ঘুমালে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেন না ! ওই মাথার যন্ত্রনার সময়টা ছাড়া বাকি সময়টায় তার মনে হচ্ছে তিনি যেন তার ষাট বছরের আগেকার জীবনে চলে গেছেন । এরমধ্যে তিনি বৃক্ষকে তার জীবনের সব ঘটনা বলে ফেলেছেন , এবং এটাও বলেছেন তার ডাক নাম ' বলাই ' । বৃক্ষ ' বলাই ' নাম শুনে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি বলে শ্যামল বাবু রবীন্দ্রনাথের ' বলাই ' গল্পটা পাঠ করে শুনিয়েছে তাকে । এখন তিনি দুপুরে আর স্ত্রীকে পত্র লেখেন না , এখন তিনি বৃক্ষকে শোনানোর জন্য ভালো ভালো লেখা খোঁজেন । সেদিন বৃক্ষ বলছিল , তার ত্বক ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হৃদয় চিহ্নের মধ্যে নিজেদের নাম লিখেছে , যদিও বৃক্ষ কষ্ট পেয়েছে কিন্তু ওদের ভালোবাসার দলিল গায়ে নিয়ে রাস্তার পাশে সে ভালোবাসার পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য প্রতীক্ষমান থাকতে পেরে তার আনন্দও হচ্ছে । শ্যামল বাবু বৃক্ষকে তার পরদিনই রফিক আজাদের ' প্রতীক্ষা ' কবিতাটা শুনিয়ে দিয়েছে । বৃক্ষ শেষ কয়েকটা লাইন মুখস্ত করেও নিয়েছে , শ্যামল বাবু লক্ষ্য করেছে বৃক্ষের স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো কারণ দুবার শুনেই এত গুলো লাইন মনে রাখা কম ব্যাপার নয় - 

আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো
দাঁড়িয়ে থাকবো-
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে
আমার পায়ে শিকড় গজাবে…

আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না…

আজ শ্যামল বাবু ঠিক করেছেন বৃক্ষকে রবীন্দ্রনাথের ' আফ্রিকা ' কবিতাটা শোনাবেন । সেই মতো তিনি সারা রাত ধরে কবিতাটা মুখস্ত করে ফেলেন - " উদ্‌ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত " । আজ যেন তাড়াতাড়ি আলো ফুটতেই চাইছে না , তিনি অধৈর্য হয়েই বেরিয়ে পড়লেন । প্রতিদিন কার মতো গাছটার কাছে এলেন , গায়ে হাত বোলানেন , বললেন - " বৃক্ষ বৃক্ষ দেখো আমি এসেছি । " কোনো সাড়া পেলেন না । শ্যামল বাবু আবার ডাকলেন , " বৃক্ষ , বৃক্ষ । " বৃক্ষ এবারে সাড়া দিলো , " বিদায় বন্ধু । আজই তোমার সাথে শেষ দেখা । " শ্যামল বাবু বললেন , " কী সব বলছ , বিদায় কেন ? " বৃক্ষ বললেন ," আজই আমাকে তোমাদের কেউ কেটে ফেলবে , তোমাদের বড় কষ্ট তাই সরু রাস্ত চওড়া হবে । " শ্যামল বাবু বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে বললেন , " না বন্ধু , কিছুই হবে না আমি হতে দেবো না ।" বৃক্ষ বললে , " বন্ধু আমি বৃক্ষ তোমাদের পিতা , সন্তানের কষ্ট লাঘবের জন্য আমি প্রাণপাত করবো এটাই আমার ধর্ম , তুমি কষ্ট পাচ্ছ কেন ! " শ্যামল বাবুর হঠাৎ মনে পড়ে যায় , কারখানা বন্ধ তার চকরি নেই , লোকের মাল পর্যন্ত বয়ে টাকা জোগার করে ছেলেটাকে ভালো স্কুলে পড়িয়েছে , তারপর আর একটা নতুন চাকরি পেয়ে অফিসে রাতের পর রাত ওভার টাইম করে , স্ত্রীর গহনা বেচে ছেলেকে কানাডাতে পড়তে পাঠিয়েছে , শেষে স্ত্রীর ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য কানাকড়িও ছিল না , চোখের সামনে রাতের পর রাত যন্ত্রনা পেতে পেতে স্ত্রীকে মরে যেতে দেখেছেন । আজ সেই ছেলের আর তার বাবাকে মনে নেই । 

শ্যামল বাবু চিৎকার করে উঠলেন , " বৃক্ষ ! ইতিহাস জুড়ে বারে বারে পিতারা নিজেদের নিঃশেষ করে এসেছে পুত্রের জন্য আজ পুত্রের প্রতিদান দেওয়ার সময় এসেছে । হে পিতা , হে বৃক্ষ , যতক্ষণ আমার শরীর আছে তোমার গায়ে একটা আঘাত লাগতে হলে তা আমার শরীরকে ভেদ করে তারপর তোমার কাছে পৌঁছাতে হবে । " এই বলে তিনি বৃক্ষকে সুতীব্র আলিঙ্গনে জড়ালেন । সমস্ত বৃক্ষদের মন উদ্বাহু হলো , বনে বনে বাতাসের হিল্লোল খেয়ে গেল ।

বেলা হলে লোক আসল , হাতে তাদের কুড়াল । দেখলো বৃক্ষকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ , কাছে এসে পরীক্ষা করে দেখলো তার দেহে প্রাণ নেই । বহু চেষ্টা করেও দুচার জনের হিংস্র হাত সেই বৃক্ষ পুত্রের আলিঙ্গন থেকে বৃক্ষকে মুক্ত করতে পারলো না ।




লেখক পরিচিতি
সাত্যকি দত্ত 


জন্ম সাল - ১৯৯৩
জন্মস্থান - বসিরহাট 
বর্তমান আবাসস্থল - কলকাতা

কোন কোন শাখায় লেখেন তার তালিকা - গল্প এবং রবীন্দ্র - জীবন

কোন কোন পত্রিকায় লেখেন তার তালিকা - মুক্তমনা ব্লগ , সিসিফাস , গল্পের সময় , শব্দের মিছিল , অন্যনিষাদ , বীরুৎজাতীয় , পুষ্পক প্রভৃতি পত্রিকাতে নিয়মিত লেখা লেখি করি । 


প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা - বাইশে শ্রাবণ প্রকাশিত হবে প্রথম গ্রন্থ " রবীন্দ্র - প্রসঙ্গ "

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ