গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ'এর গল্প : বড়মার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

বিশ্বের সমস্ত অবিশ্বাসীদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে এটাই হল বড়মার সত্যিকারের কাহিনি। তিনি ছিলেন মাকোন্দো রাজ্যের প্রবল প্রতাপান্বিত রানি। বিরানব্বই বছর বেঁচে থাকার পর গত সেপ্টেম্বর মাসের এক মঙ্গলবারে তার জীবনাবসান ঘটে। তার অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষ যাজক।


বড়মার মৃত্যুজনিত কারণে উদ্ভূত হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি দেশ এখন কাটিয়ে উঠেছে। "সান্‌ হাসিন্তো'-র বাঁশি বাজিয়েরা, 'গোয়াহিরা’-র চোরাচালানকারীরা, ‘সিনু’-র ধান চাষিরা, ‘কাউকামায়াল’- এর দেহোপজীবিনীরা, ‘সিয়েরপ'-এর জাদুকররা আর ‘আরাকাতাকা"-র কলা-বাগিচার শ্রমিকেরা বড়মার আসন্ন মৃত্যুর জন্যে এতদিন ধরে প্রতীক্ষার পরে ক্লান্ত হয়ে তাবু গুটিয়ে বিশ্রাম করতে চলে গেছে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীবৃন্দ ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরা এই ঐতিহাসিক এবং সাড়ম্বর অন্তেষ্ট্যিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন। উপস্থিত ছিলেন পারলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী গির্জার প্রতিভুবৃন্দ। এখন সবাই মানসিক শান্তি ফিরে পেয়ে নিজের নিজের কাজে যোগ দিয়েছেন। দেহে ও মনে যাজকের স্বর্গারোহণ সম্পূর্ণ হয়েছে। সারা রাস্তায় ছড়ানো আছে খালি বোতল, সিগারেটের টুকরো, শুকনো হাড়, টিন, ন্যাকরা ইত্যাদি জঞ্জাল। এ সবই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখতে আসা বিশাল জনতার অবদান। ফলে, পথে চলাফেরা করা প্রায অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিকরা পুঁথির পাতায় এ সব লিখে ফেলার আগে বড় রাস্তার ধারে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে এ রকম একটা জাতীয় শোকের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়ার এটাই সেরা সময়।

বহু দিন ধরেই রাতের দিকে বড়মার পেট ফাঁপছিল। সরষে বাটার পুলটিশ লাগানোয় কষ্টটা আরও বেড়েই চলছিল। অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে প্রায় শেষ অবস্থায় পৌঁছে গেছিলেন। তবু চোদ্দো সপ্তাহ আগে তিনি হুকুম দিলেন তাঁকে যেন লিয়ানা কাঠের দোলচেয়ারে বসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় যাতে তিনি সুষ্ঠভাবে তাঁর শেষ ইচ্ছা সবাইকে শুনিয়ে যেতে পারেন। মৃত্যুর প্রস্তুতির জন্যে এইটুকু কাজেই বাকি ছিল। এর মধ্যে সেদিন সকালেই তিনি ফাদার আন্তোনিও ইসাবেলের সাহায্যে নিজের আত্মার বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন। বাকি ছিল,-বাক্স-তোরঙ্গ-সিন্দুকে রাখা তাঁর যাবতীয় পার্থিব সম্পদের বিলিবন্দোবস্ত । ন’ জন ভাইপো-ভাগ্নের মধ্যে ওগুলো বিলোতে হবে। কারণ ওরাই তাঁর বৈধ ওয়ারিশ। ওরা পালা করে তার বিছানার পাশে বসে থাকত। নিজের মনে অনবরত কথা বলতে থাকা প্রায় একশো বছর বয়সী মাকোন্দোর প্রবীণ যাজক বড়মার ঘরেই প্রায় পাকাপাকিভাবে আস্তানা গেড়েছিলেন। ও ঘরে তাঁকে পৌঁছে দিতে জনা দশেক লোক লেগেছিল। তখন তিনি ঠিক করেন যে শেষ পর্যন্ত ওখানেই থাকবেন যাতে বারে বারে নামা-ওঠার হাঙ্গামা না পোয়াতে হয়। সব চেয়ে বড় কথা, এতে শেষ মুহূর্তে বড়মার পাশে থাকাটাও নিশ্চিত করা যাবে।

সবচেয়ে বড় ভাইপো নিকানোর আকৃতিতে দৈত্যের মতো আর প্রকৃতিতে বুনো এবং চোয়াড়ে। তার পরনে খাকি পোশাক আর পায়ে কাঁটা লাগানো বুট জুতো। তার জামার নিচে একটা o৩৮ ক্যালিবারের রিভলবার সদাপ্রস্তুত। উকিলের খোঁজ করতে নিকানোরই গেছিল। গুড় আর সুগন্ধি পাতার নির্যাসে সুবাসিত বিরাট দোতলা বাড়িটার খাঁজে খাঁজে বেশ কিছু লুকোনো ঘরে রাখা ছিল বিশাল সব বন্দুক আর ধুলোর সঙ্গে মিশে যাওযা চার প্রজন্মের টুকিটাকি জিনিসপত্র। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই যেন বাড়িটা এই মুহুর্তের প্রতীক্ষায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাড়ির মাঝখানের বিশাল বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে ছাল ছাড়ানো শুয়োর আর রক্ত বের করে নেওয়া হরিণের মৃতদেহ । নুন আর চাষের যন্ত্রপাতি ভরা বস্তার উপর ক্ষেতের মুনিষরা গুটিসুটি মেরে শুয়েছিল। আসলে নির্দেশ পাওয়া মাত্রই যাতে খচ্চরে চেপে ক্ষেতখামারের চতুর্দিকে খবরটা পৌছিয়ে দিতে পারে তারই জন্যে। ওরা অপেক্ষা করছিল। পরিবারের বাদবাকিরা বসার ঘরে সমবেত। মেয়েরা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। মরণাপন্ন মানুষটির মৃত্যুর জন্যে প্রতীক্ষা আর উত্তরাধিকারের চিন্তা যেন ওদের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। কুলকর্ত্রী হিসেবে বড়মার দাপটে বিষয়-সম্পদ আর বংশের সুনাম সুরক্ষিত। বড়মাকে না জানিয়ে, তাঁকে আড়াল করে কাকারা ভাইঝির মেয়েদের, জ্ঞাতি ভাইরা মাসি-পিসিদের আর ভাইরা নিকট আত্মীয়াদের বিয়ে করেছিল। এ ভাবেই গড়ে উঠেছিল পরিবার তথা গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্বিবাহের এক জটপাকানো জটিল চক্র। বংশবৃদ্ধি পরিণত হয়েছিল এক দুষ্টচক্রে। কেবলমাত্র সবচেয়ে ছোট ভাইঝি মাগদালেনা এই চক্র থেকে পালাতে পেরেছিল। অলৌকিক এক আতঙ্ক যেন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। ফাদার আন্তোনিও ইসাবেলের সাহায্যে সে নিজেকে অশুভ আত্মার হাত থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। শেষে সংসারের সব সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করে মাথা মুড়িয়ে মাগদালেনা সন্ন্যাসিনী হয়ে যায়।

বৈধ পরিবারের পাশাপাশি জমিদারির অধিকার খাটিয়ে এ বাড়ির পুরুষরা গাঁয়ে-গঞ্জে, ক্ষেতখামারে, পথে-ঘাটে অসংখ্যা জারজ বংশধর ছড়িয়ে দেয়। তাদের পদবির বালাই নেই। বড়মার ধর্ম সন্তান, পুষ্যি, প্রিয়পাত্র,-এ সবই তাদের পরিচিতি।

আসন্ন মৃত্যু ক্লান্তিকর প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। মৃতপ্রায় মহিলা সকলের বশ্যতা ও স্তুতিতে অভ্যস্ত। তার কণ্ঠস্বর অর্গানের মৃদু সুরের চেয়ে উঁচু তানের না হলেও, বাড়ির লাগোয়া ক্ষেতখামারের নির্জন কোনা থেকেও তা শোনা যেত। এই মৃত্যুটা সম্পর্কে কেউ উদাসীন ছিল না। পুরো শতাব্দী ধরে বড়মা ছিলেন মাকোন্দোর মধ্যমণি। আগেকার দিনে যেমন ছিলেন তাঁর ভাই, বাবা বা আরও প্রাচীন সব পূর্বপুরুষেরা। দু'শতাব্দী ধরে পারিবারিক রাজত্ব কায়েম থাকায় তাদের গোষ্ঠীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল জনবসতি। তাঁদের পদবি দিয়েই হয়েছিল এলাকাটার নামকরণ। এদের উৎপত্তি নিয়ে কেউ কখনও মাথা ঘামায়নি। এ পরিবারের বিষয়-সম্পত্তির সঠিক পরিমাণ ও মূল্যের হিসেব-নিকেশও কেউ কখনও করেনি। মানুষের বিশ্বাস,--বহতা জলধারা থেকে শুরু করে বন্ধ জলাধার, পৃথিবীর বুকে নেমে আসা বৃষ্টি, আশপাশের রাস্তাঘাট, টেলিগ্রাফের খুঁটি, ঋতুচক্র এমনকী সূর্যের তাপ পর্যন্ত সব কিছুই বড়মার সমতুল্য। তার উপর তিনি আবার উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষেতখামার আর সব মানুষের দণ্ডমুণ্ডেব কর্ত্রী। বড়মা যখন বাড়ির বারান্দায় বসে সন্ধ্যার হাওয়া খেতেন তাঁর নাড়িভুড়ি আর কর্তৃত্বের চাপ লিয়ান কাঠের দোলচেয়ারটার ওপর পড়ত। তখন মনে হত বাস্তবিকই তিনি অপরিসীম সম্পদের অধিকারিণী ও প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন। মনে হত তিনি দুনিয়ার সব চেয়ে ধনী ও ক্ষমতাশালিনী গৃহকর্ত্রী।

কোনওদিন যে বড়মার জীবনাবসান হতে পারে, এমন কথা তিনি নিজে আর তাঁর গোষ্ঠীর সদস্যরা ছাড়া আর কেউ ভাবেনি। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা ফাদার আন্তোনিও ইসাবেল অবিশ্য ভবিষ্যদ্বাণী মারফত বড়মাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। তবুও বড়মার বিশ্বাস ছিল যে নিজের দিদিমার মতো তিনিও একশো বছরের বেশি বাঁচবেন। সেই মহিলা ১৮৮৫-র গৃহযুদ্ধের সময় ক্ষেতখামারের ভেতরে ঘাটি গেড়ে বসা কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার এক রক্ষীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে এ বছর এপ্রিল মাস নাগাদ বড়মা বুঝতে পারলেন যে সামনাসামনি লড়াইয়ে বিপ্লবীদের দল 'হেদারালিস্ত মেসন'-কে পর্যুদস্ত করার সুযোগ ঈশ্বর তাঁকে দেবেন না।

যন্ত্রণা শুরুর প্রথম সপ্তাহে পারিবারিক ডাক্তার লক্ষ্য করলেন সরষের পুলটিশ লাগিয়ে তার ওপর উলের মোজা পরে রয়েছেন বড়মা। এই ডাক্তারটিও উত্তরাধিকারসূত্রে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। আদতে তিনি মন্তপোলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। দার্শনিক বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি বিজ্ঞানের তথা প্রগতিবিরোধী। বড়মার হুকুমনামার জোরে তিনি মাকোন্দোয় অন্য কোনও ডাক্তারের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। ঘোড়ায় চড়ে তিনি পুরো এলাকাটা চষে বেড়ান। সন্ধ্যার অন্ধকারে যন্ত্রণা-কাতর রোগীদের দেখতে যাওয়াটা তাঁর বহুদিনের পুরোনো অভ্যাস। প্রকৃতির আনুকূল্যে তিনি পেয়েছেন অজস্র অবৈধ সন্তানের বাবা হওয়ার অধিকার। তবে ইদানীং বাতের ব্যথায় অথর্ব হয়ে পড়ায় তিনি নিজের বাড়ির দোলনা ছেড়ে বিশেষ বেরোতে পারেন না। অসুখের লক্ষ্মণের কথা শুনে আর আন্দাজের বশে রোগীদের না দেখেই চিকিৎসা শুরু করেন। বড়মার নির্দেশে পায়জামা পরে, দুটো লাঠির ওপর ভর দিয়ে কোনওরকমে রোগিণীর ঘরে এসে পাকাপোক্তভাবে ঠাঁই নিলেন। বড়মার চরম অবস্থার আভাস পাওয়া মাত্র তিনি বাড়ি থেকে একটা সিন্দুক আনানোর বন্দোবস্ত করলেন। সিন্দুকটার মধ্যে ছিল অনেকগুলো ছোটো ছোটো কৌটা। কৌটোগুলোর গায়ে লাতিন ভাষায় নাম লেখা। সপ্তাহতিনেক ধরে তিনি মুমূর্ষু রোগিণীর সব রকমের স্বাস্থ্যসম্মত পরিচর্যা করলেন। কড়া ঝাঁজের উত্তেজক আরক দিলেন। প্রয়োগ করলেন সাংঘাতিক কড়া জোলাপ। এত কিছু করার পর প্রচণ্ড চিন্তাভাবনায় বিভোর হয়ে তিনি সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দিতে দিতে সেই ঘরেই বসে রইলেন। অবশেষে এল সেদিনের ভোর, যখন ডাক্তারের সামনে মাত্র দুটো রাস্তা,--হয় নাপিত ডেকে এনে বড়মার শরীরের দূষিত রক্ত বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা নয়তো ফাদার আন্তোনিও ইসাবেলকে ভূত তাড়াবার জন্যে অনুরোধ করতে হবে।

যাজককে ডেকে আনার হুকুম দিল নিকানোর। বাছাই করা জনা দশেক লোক বড়মার ঘরে বয়ে নিয়ে এল তাঁকে। বড়মা তখন চাঁদোয়া লাগানো উইলো কাঠের দোলচেয়ারে বসে। মরচে ধরা, ক্যাচোর-ক্যাঁচ শব্দ করা এই দোলচেয়ারটা সাধারণত উৎসব-অনুষ্ঠানে বাইরে আনা হত। সেপ্টেম্বর মাসের ভোরে, যখন হালকা গরম ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে, ঠিক তখনই গির্জার ছোট ঘণ্টার আওয়াজ মাকোন্দোর বাসিন্দাদের কাছে খবরটা পৌঁছিয়ে দেয়। সূর্য উঠতে না উঠতেই বড়মার বাড়ির সামনেকার রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য। মনে হচ্ছিল, কোনও মেলা বসেছে।

এইসব দেখে শুনে পুরোনানো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। নিজের সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে বড়মা এমন ধুমধাম করে জন্মদিন পালন করেছিলেন যা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। আনন্দ-উৎসবের যেন বান ডেকেছিল। মদ বিলোনো হয়েছিল সারা শহরে। শহরের প্রধান প্লাজায় মানে কেন্দ্রীয় চত্বরে কাটা হয়েছিল প্রচুর গোরু-ভেড়া ; আর একটা ব্যান্ডপার্টি তিনদিন ধরে একটানা বাজনা বাজায়। ধুলোমাখা যে আলামন্দ গাছটার তলায় এই শতাব্দীর প্রথম সপ্তাহে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সেনাবাহিনী তাঁবু খাটিয়েছিল, সেখানে হরেকরকম জিনিসপত্র বিক্রির ধূম লেগে যায়। কী না ছিল সেখানে--ধান আর ভুট্টার তৈরি মদ, পাউরুটির রোল, ভুট্টার রোল, পানীরের রোল, শুয়োরের মাংস দিয়ে রান্না করা রকমারি লোভনীয় খাদ্য, গলদা চিংড়ি ভাজা, নানানরকমের কেক-প্যাস্ট্রি, নারকেলের মিঠাই, আখের রস থেকে শুরু করে গয়নাগাটি-হাঁড়িকুড়ি পর্যন্ত,--এক কথায় সব কিছু। মোরগের লড়াই আর লটারির ব্যবস্থাও ছিল। উত্তেজিত জনতার কোলাহলের মধ্যে বিক্রি হচ্ছিল বড়মার ছাপা ছবি এবং তাঁর ছবি আঁকা জামা।

জন্মদিনের দু’দিন আগে উৎসবটা শুরু হয়ে জন্মদিনের সন্ধ্যায় কান ফাটানো আতসবাজির ঝলসানিতে শেষ হয়। রাতে বড়মার বাড়ির সেই বিশাল বসার ঘরটায় এক নাচের আসর বসে। বাছাই করা অতিথি আর পরিবারের বৈধ সদস্যেরা সেখানে উপস্থিত ছিল। পুরোনো পিয়ানোটায় বাজানো হচ্ছিল আধুনিক সুর। জারজ সন্তানদের সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে অতিথিরা বাজনার সঙ্গে তালে তালে নাচল। বড়মা পিঠের তলায় একটা বালিশ রেখে আরামকেদারায় বসে সব কিছুর তত্ত্বাবধান করছিলেন। প্রতিটি আঙুলে আংটি পরা ডান হাত নাড়িয়ে তিনি একের পর এক নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওখানে বসেই তিনি সেরে ফেললেন সেই সব বিয়েগুলোর পাকা কথাবার্তা যেগুলো পরের বছর হওয়ার কথা। প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছানুসারে কয়েকটা বিয়ে তিনি মেনে নিলেও বেশিরভাগ বিয়েই তাঁর মতানুযায়ী স্থির হল। উৎসবের একেবারে শেষ লগ্নে বড়মা মাথায় মুকুট পরে জাপানি লণ্ঠনের আলোয় বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে মুঠো মুঠো পয়সা-কড়ি ছড়াতে লাগলেন।

মাঝে কিছুদিন এই ঐতিহ্যে বাধা পড়ে। পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব আংশিকভাবে এর জন্যে দায়ী। আবার গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক ঘটনাবলিরও এ বিষয়ে অবদান আছে। নতুন প্রজন্ম এমন জাঁকজমকের গল্পই শুনে এসেছে, কোনওদিন দেখার সুযোগ পায়নি। বড়মার গির্জায় যাওয়ার দৃশ্য তারা কখনও নিজেদের চোখে দেখেনি। বড়দের কাছে তারা বরাবরই শুনে এসেছে যে গির্জায় যাওয়ার সময় জনৈক রাজপুরুষ নাকি বড়মাকে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে পথ চলত। এমনকী গির্জাও তাঁকে কিছু বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল। প্রার্থনাসভার পবিত্রতম মুহুর্তেও তিনি নতজানু হতেন না, পাছে তাঁর পোশাকের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যায়। যৌবনের কল্পনার মতো সেই দিনটার কথা প্রবীণরা আজও মনে করে যে দিন বড়মার পৈতৃক বাড়ি থেকে গির্জার সর্বোচ্চ বেদি পর্যন্ত দুশো গজ লম্বা মাদুর পাতা হয়েছিল। সেই সন্ধ্যায় মারিয়া দেল রোজারিও কাস্তাখেদাইমন্তেরো তাঁর বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। মাদুর বিছানো পথ পেরিয়ে মাত্র বাইশ বছর বয়সেই ‘বড়মা’ আখ্যায় ভূষিত হয়ে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। মধ্যযুগের এমন জীবনদর্শন কেবলমাত্র এই পরিবারের নয়, জাতীয় ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়। বেশিরভাগ সময়েই বড়মা একটা দূরত্ব রক্ষা করে চলতেন এবং নিজেকে কিছুটা প্রচ্ছন্ন করে রাখতেন। ক্বচিৎ তাঁকে গরমকালের সন্ধ্যায় বারান্দায় দেখা যেত। সেরানিয়াম ফুলের ভারে প্রায় দম বন্ধ করা অবস্থায়ও তাঁকে নিয়ে গড়ে ওঠা গল্পকথার আড়ালেই বড়মা অদৃশ্য হয়ে থাকতেন। নিকানোর মারফত তার কর্তৃত্ব বাস্তবে কার্যকরী হত। ঐতিহ্যনুযায়ী একটা অঘোষিত প্রতিশ্রুতি ছিল যে বড়মা যেদিন তাঁর অন্তিম ইচ্ছাপত্র বা উইল করবেন সে দিন তাঁর উত্তরাধিকারীরা জনসাধারণের জন্যে তিন রাত্রিব্যাপী এক উৎসবের ব্যবস্থা করবে। আবার লোকে এটাও জানত,--বড়মা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন যে মৃত্যুর মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে তিনি অন্তিম ইচ্ছাপত্র বা উইল রচনা করবেন। তবে বড়মা যে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষেরই মতো মারা যেতে পারেন, এমন কথা কেউ মন থেকে বিশ্বাস করেনি। কেবল সেদিন ভোরে গির্জার ঘণ্টার শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর মাকোন্দোর বাসিন্দারা বুঝতে পারল যে বড়মা অমর নন। এবং তিনি মরণাপন্ন।

তাঁর অন্তিম মুহূর্ত সমাসন্ন। তাঁর কান পর্যন্ত সুগন্ধি ছড়ানো। সুতির চাদর বিছানো বিছানায় ধুলো ভরা চাঁদোয়ার তলায় তিনি শায়িত। কুলকর্ত্রী বড়মার হৃৎস্পন্দনে জীবনের এতটুকু চিহ্নও খুঁজে পাওয়া ভার। পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত বড়মা তাঁর প্রেমে উত্তাল হয়ে ওঠা পাণিপ্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। প্রকৃতি তাঁকে যা ক্ষমতা দিয়েছিল তাতে তিনি একাই একটা গোটা প্রজাতির জন্ম দিতে পারতেন। অথচ, তিনি কুমারী ও নিঃসন্তান অবস্থায় মরণের দিকে এগিয়ে চলেছেন। শেষ মুহুর্তে ফাদার আন্তোনিও ইসাবেল বুঝতে পারলেন মৃত্যু পথযাত্রীর হাতের তালুতে তেল মাখানোর চেষ্টা করা বৃথা ; কারণ, মরণ যন্ত্রণায় বড়মা হাত দুটো মুঠো করে রয়েছেন। ভাইঝিদের সমবেত প্রচেষ্টাও কোনও কাজে এল না। এক সপ্তাহের টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে মুমুর্ষু মানুষটি এই প্রথম মূল্যবান অলংকারে ভূষিত নিজের বুকে হাত রাখলেন। ভাইঝিদের দিকে চাউনিবিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,-“মেয়ে ডাকাতের দল"। তারপর দেখলেন ফাদার আন্তোনিও ইসাবেল মৃত্যুকালীন ক্রিয়াকর্মাদি সম্পন্ন করার পোশাক পরে অপেক্ষা করছেন। তাঁর সহকারী প্রয়োজনীয় উপকরণাদি গোছগাছ করে ফেলেছে। বড়মা শান্ত স্বরে গভীর বিশ্বাস নিয়ে বললেন,--‘আমি মরতে চলেছি।‘ এবার তিনি সব চেয়ে বড় হিরে বসানো আংটিটা হাত থেকে খুলে নিয়ে বললেন,--‘এটা পাবে নবীন সন্ন্যাসিনী মাগদালেনা।’ সম্পত্তির সামান্য কিছু অংশ দিয়ে যাবেন বলে মাগদালেনাকে বড়মা আগেই চিঠি দিয়েছিলেন। এ ভাবেই একটা উত্তরাধিকারের অবসান হল। মাগদালেনা উত্তরাধিকার ত্যাগ করে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করল।

ভোরবেলায় নিকানোর ছাড়া আর সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে বড়মা হুকুম জারি করলেন। রীতিমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাক্কা আধা ঘণ্টা ধরে তিনি বিষয়-সম্পত্তির যাবতীয় খবরাখবর নিলেন। তার পর নিজের শেষকৃত্য, অন্ত্যেষ্টি, সমাধি ইত্যাদি নিয়ে সবিস্তারে অনুপুঙ্খ আলোচনা সেরে বড়মা বললেন,--‘সবসময় চোখ-কান খোলা রাখবে। দামি জিনিসপত্র তালা-চাবি দিয়ে সাবধানে রাখবে। জানো তো, অনেকেই এ সময় চুরি-চামারির মতলবে হাজির হয়।' এরপর গির্জার পাদ্রির সামনে বিশদাকারে স্বীকারোক্তির সময় বড়মার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অবশেষে ভাইপো-ভাইঝিদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হল বাইবেলের প্রথানুসারী আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তির অনুষ্ঠান। সব শেষে অন্তিম ইচ্ছা প্রকাশের উদ্দেশ্যে বেতের দোলচেয়ারটায় বসিয়ে দেওয়ার হুকুম তামিল করার পর বড়মার কাজ শুরু হল।

গোটা চব্বিশ দলিলে পরিষ্কার হাতের লেখায় নিকানোর বড়মার যাবতীয় বিষয়-আশয়ের বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করে রেখেছিল। ফাদার আন্তোনিও ইসাবেল আর ডাক্তারকে সাক্ষী রেখে, শান্তভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বড়মা সম্পত্তির তালিকা জোরে জোরে পড়ে গেলেন যাতে সরকারের আইন সংক্রান্ত আধিকারিকের কানে সব কটা কথা ঠিকমতো পৌঁছোয়। এটাই তাঁর ক্ষমতা ও মান-মর্যাদার চরম ও একমাত্র উৎস। বাস্তবে দেখা গেল বড়মার সম্পত্তি বলতে বোঝাচ্ছে মাত্র গুটি তিনেক জেলার ভূ-সম্পদ। উপনিবেশ শুরুর যুগে সরকারের দেওয়া দখলি সত্ত্বের দলিল অনুযায়ী এগুলো তাঁদের হাতে এসেছিল। তার পর কয়েক প্রজন্ম ধরে ধনী পরিবারে বিয়ে-শাদির ফলে সম্পত্তি অনেক ফুলে ফেঁপে গড়ে ওঠে বড়মার পরিবারের খাস তালুক। এই স্পষ্ট সীমারেখা ছাড়া আশপাশের পাঁচটা শহরে তাঁর মালিকানাধীন ছড়ানো-ছিটানো এমন অনেক জমি রয়েছে যেখানে কোনওদিনই ফসল ফলানো হয়নি। মালিকের গরজ না থাকলেও তিনশো-বাহান্নটা পরিবার এই সব জমিতে ঠিকা-প্রজা হিসেবে বসবাস করে। প্রতি বছর নিজের জন্মদিনের আগের তিনদিন ধরে বড়মা এদের কাছ থেকে নিয়ম করে খাজনা আদায় করতেন। নিজের কর্তৃত্বের এটাই ছিল একমাত্র পরিচয়। আর এর ফলেই এই সমস্ত জমি সরকারের হাতে ফিরে যায়নি। বাড়ির ভেতরকার দরদালানে বসে বড়মা নিজের হাতে জমিজমার ঠিকাসত্ত্বের খাজনা নিতেন। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে তাঁর পূর্বপুরুষেরা একইভাবে এইসব ঠিকাপ্রজাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে অভ্যস্ত ছিলেন। খাজনা নেওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার দিনতিনেক বাদে দেখা যেত বাড়ির উঠোনটা শুয়োর, মুরগি আর টার্কিতে ভরে গেছে। জমিতে ফলানো ফসল ও ফল-মূলের যে অংশটুকু মালকিনের পাওনা তা উপহার হিসেবে রেখে যাওয়া হত। ঐতিহাসিক কারণেই এই জমিদারির সীমানার মধ্যেই ছিল মাকোন্দো জেলার অধিকাংশ মানুষের বসবাস আর রমরমা। জেলা সদরও এখানেই অবস্থিত। ফলে ব্যাপারটা এমনই দাঁড়ায় যে যারা ওখানে বসবাস করত তাদেরও জানা ছিল যে নিজেদের বাড়ির ইট-বালি ছাড়া অন্য কোনও কিছুর উপরই তাদের মালিকানা নেই। জমির মালিক বড়মা। এর জন্যে তাঁকে নিয়মিত ভাড়া দেওয়া হয়, ঠিক যেমনভাবে রাস্তাঘাটের জন্যে সরকারকে কর দেওয়া হয়ে থাকে।

জমিদারির চতুর্দিকে অসংখ্য গোরু-ঘোড়া চড়ে বেড়াত। ওগুলোকে কেউ গুনত না আর সেগুলোর দেখভাল হত আরও কম। পশুগুলোর পেছন দিকে একটা করে তালার ছবি উল্কির মতো একে দেওয়া হত। শুধুমাত্র সংখ্যা নয়, যথেচ্ছভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে ওরা দূর দূর এলাকায় পরিচিত ছিল। গরমের দিনে তেষ্টায় ছটফট করতে থাকা প্রাণীগুলো কোথায় কোথায় না ছড়িয়ে পড়ত! কে জানে কেন শেষ গৃহযুদ্ধের পর থেকেই বড়মার বাড়ির গোয়াল আর আস্তাবলগুলো ক্রমশ শূন্য হয়ে পড়েছিল। ইদানীং সেখানে চালু হয়েছে চিনির কল, দুধের ডেয়ারি। আর ধানের কল।

এই তালিকাটা ছাড়াও ‘অন্তিম ইচ্ছা' প্রকাশের সময় বড়মা তিন ঘড়া সোনার মোহরের কথা ভুললেন না। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ওগুলো যেন বাড়ির কোথায় পুঁতে রাখা হয়েছিল। পরে অনেক খোঁড়াখুড়ি করেও ওগুলোর আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। ঠিকাসত্ত্ব বাবদ খাজনা আদায়ের দায়িত্বের পাশাপাশি ওয়ারিশেরা পেল এই লুকোনো ধনরত্ন উদ্ধার করার একটা পরিকল্পনা। একের পর এক প্রতিটি প্রজন্মের হাতে উত্তরাধিকার সূত্রে তুলে দেওয়ার জন্যেই পরিকল্পনাটি এমন নিখুঁতভাবে রচিত হয়েছিল।

বৈষয়িক কথাবার্তা শেষ করতে বড়মার ঘণ্টা তিনেক লেগে গেল। দম বন্ধ হয়ে আসা ঘরের ভেতর মৃত্যুপথযাত্রিণীর কণ্ঠস্বর যেন হিসেব করে প্রতিটি জিনিসকে মর্যাদা দিচ্ছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে বড়মা যখন অন্তিম ইচ্ছাপত্রে স্বাক্ষর করলেন আর তার তলায় সাক্ষীদের সই শেষ হল, তখন বাড়ির সামনেকার ধুলো মাখা আলোমন্দ গাছের ছায়ায় জড়ো হতে শুরু করা জনসমুদ্রের হৃদয়ে গোপনে বয়ে গেল অদ্ভুত এক শিহরন।

এবার বাকি রইল কেবল অ-পার্থিব সম্পত্তির তালিকা। অনেক কষ্টে বিশাল শরীরটাকে কোনওরকমে সামলিয়ে তিনি উঠে বসলেন। বংশের প্রতাপ-প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন রাখার জন্যে তাঁর পূর্বপুরুষেরাও অন্তিমকালে ঠিক এই কাজটি করে এসেছিলেন। স্মৃতির গহনে অবগাহন করে, জোরালো ও আন্তরিক কণ্ঠে বড়মা উচ্চারণ করলেন তার যাবতীয় অদৃশ্য সম্পদের তালিকা : মাটির তলার সম্পদ, দেশের জল, জাতীয় পতাকার রং, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, প্রচলিত রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা, বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব, আবেদনের অধিকার, আইনসভার বিতর্ক, সুপারিশের চিঠি, ঐতিহাসিক নথি, স্বচ্ছ নির্বাচন, সৌন্দর্যের রানিরা, আধ্যাত্মিক কথাবার্তা, বিশাল মিছিল, সম্ভ্রান্ত যুবতী নারী, যথার্থ ভদ্রলোক, মর্যাদাসম্পন্ন সামরিকবাহিনী, রাষ্ট্রের উচ্চ গৌরব, সর্বোচ্চ আদালত, যে সব জিনিসের আমদানি নিষিদ্ধ, উদার মহিলাবৃন্দ, মাংস সংক্রান্ত সমস্যা, ভাষার পবিত্রতা,দৃষ্টান্ত সৃষ্টির যোগ্য উদাহরণ, স্বাধীন অথচ দায়িত্বশীল প্রচারমাধ্যম, দক্ষিণ আমেরিকার এথেন্স, জনমত, গণতন্ত্রের শিক্ষা, খ্রিস্টীয় নীতিবোধ, বৈদেশিক মুদ্রার অভাব, আশ্রয়প্রার্থীদের অধিকার, কমিউনিস্ট বিপদ, রাষ্ট্রের জাহাজ, নিত্য প্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দাম, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষেরা এবং রাজনৈতিক সমর্থন জানানোর প্রস্তাব।

বড়মা অবিশ্যি তালিকার শেষ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারলেন না। দীর্ঘ তালিকা আউড়ে যাওয়ার পরিশ্রমে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। বিমূর্ত সূত্রের যে মহাসাগর দুই শতাব্দী ধরে এই পরিবারের ক্ষমতার নৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি করেছিল, তার মধ্যে ডুবে গিয়ে বড়মা সশব্দে হেঁচকি তুলে মারা গেলেন।

সে দিন বিকেলে রাজধানীর বিষণ্ন নাগরিকেরা খবরের কাগজের বিশেষ সংস্করণের প্রথম পাতায় বছর কুড়ি বয়সের একটি মেয়ের ছবি দেখে মনে করল,--নতুন কোনও সুন্দরী। দরকার মতো তুলি বুলিয়ে ঠিকঠাক করে খবরের কাগজের চার কলাম ধরে ছাপানো ছবিটার মধ্যে বড়মার যৌবন মুহূর্তের জন্যে ধরা পড়ল। ছবিতে তার আলুলায়িত কেশরাশি হাতির দাঁতের চিরুনি দিয়ে মাথার ওপর চূড়ো করে বাঁধা। আর তার ওপরে শোভা পাচ্ছে--মুকুট। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে জনৈক ফোটোগ্রাফার মাকোন্দোর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এই ছবিটা তুলেছিল। বহু বছর ধরে ছবিটি খবরের কাগজের দপ্তরে ‘অচেনা মানুষ'-এর ছবি হিসেবে পড়ে থাকার পর এই বিশেষ সংস্করণের দৌলতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে গেল। হয়তো এমনই ছিল তার ভাগ্যলিপি। ভাঙাচোরা বাসের মধ্যে, সরকারি দপ্তরের লিফটে, বিবর্ণ ছবি টাঙানো চায়ের দোকানো--সর্বত্র লোকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে তাঁকে নিয়ে বলাবলি করতে থাকল। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে পর্যন্ত বড়মার নিজের জেলা মানে সেই গরমে ক্লান্ত, ঘামে সিক্ত ও ম্যালেরিয়া পীড়িত ‘মাকোন্দো’ ছাড়া বাদবাকি দেশে উঠার নামই প্রায় কারও জানা ছিল না। বড়মার বহু আলোচিত মৃত্যুই মাকোন্দোকে বিখ্যাত করে তোলে। অবিশ্বাস আর কুয়াশাকে পথচারীদের সামনে থেকে আড়াল করেছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি। গির্জায় গির্জায় তাঁর স্মৃতিতে ঘণ্টা বাজছিল। সদ্য উত্তীর্ণ হওয়া সামরিক বাহিনীর নবীন সেনাদের অভিবাদন নেওয়ার সময় প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির কাছে খবরটা পৌঁছায়। অনুষ্ঠানের শেষে বড়মার স্মৃতিতে এক মিনিটের নীরবতা পালনের পরামর্শ প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে দিয়ে, রাষ্ট্রপতি নিজের হাতে বড়মার জন্যে শোকবার্তা লিখলেন।

এই মৃত্যুর দরুন সমাজ ব্যবস্থায় একটা চিড় ধরে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নিজে ব্যাপারটা অনুধাবন করেন। শহরের বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া তার কাছে সবসময়েই একটু পরিশোধিত হয়ে পৌঁছোয়। তবে এবার গাড়িতে যেতে যেতে আচমকা কয়েকটা নির্মম দৃশ্যের মাধ্যমে নাগরিকদের একনিষ্ঠ নীরবতা আন্দাজ করলেন। কেবল মাত্র গুটি কয়েক ছোট ছোট কফির দোকান খোলা রয়েছে। আর শহরের প্রধান গির্জাটি ন’দিন ধরে বড়মার শেষকৃত্য পালনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। দেশের রাজধানীতে রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনেকার চত্বরে প্রাচীন গ্রিক স্থাপত্যের অনুকরণে গড়ে তোলা স্তম্ভ আর তার মধ্যে রাখা প্রয়াত রাষ্ট্রপতিদের মূর্তির ছায়ায় যেখানে ভিখিরিরা খবরের কাগজ মুড়ি দিয়ে ঘুমোয়, সেখানে আলো ঝলমলিয়ে উঠল। শোকবিহ্বল শহরের হালচাল স্বচক্ষে দেখে নিজের দপ্তরে ঢোকার সময় রাষ্ট্রপতির নজরে এল, তার মন্ত্রীমণ্ডলী কালো রঙের শোক-পরিচ্ছদ পরে তাঁর জনো অপেক্ষা করছে। অন্য দিনের তুলনায় তাদের মুখ অনেক বেশি বিবর্ণ ও বিষণ্ন।

সেই রাতের এবং তার পরের ঘটনাবলি পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়। শুধুমাত্র সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়কদের মনে খ্রিস্টীয় অনুভূতির বান ডেকেছিল এমন নয় ; --সমস্ত রকম পরস্পরবিরোধী স্বার্থ বা মতাদর্শের ভেদাভেদও যেন মুছে গিয়েছিল। মতৈক্য হয়েছিল মহিয়সী নারীর মরদেহ সমাধিস্থ করার প্রস্তাবে। তিন ট্রাংক ভর্তি নকল নির্বাচনী পরিচয়পত্রর মালিকানা সূত্রে বহু বছর ধরে বড়মা নিজের এলাকায় সামাজিক শান্তি ও রাজনৈতিক ঐক্য বজায় রেখেছিলেন। বড়মার চাকর-বাবুর্চিরা, তার আশ্রিত মানুষ ও ঠিকা-প্রজারা, সাবালক বা নাবালক যাই হোক না কেন, তারা যে কেবল নিজেদের ভোট দিত তা নয়, এই শতাব্দীতে যত ভোটার মারা গেছে, তাদের সকলের নামে জাল ভোট দিয়ে আসত। বড়মা ছিলেন ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতার প্রতীক। সরকার তো সাময়িক। ফলে তাঁর মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের ওপর ছড়ি ঘোরানো অভিজাততন্ত্রের আদর্শ দৃষ্টান্ত। জোড়াতালি দিয়ে জীবন কাটিয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন। ঐশ্বরিক জ্ঞানের শেষ কথা। শান্তির সময়ে তার একচ্ছত্র আধিপত্য সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তিদেরও রীতিমতো চিন্তিত রাখত। তবে তিনি নিজের সাথি ও সহযোগীদের ভালো-মন্দ দেখতেন। তার জন্যে ষড়যন্ত্র বা জাল ভোটের পথে যেতে তিনি পিছপা হতেন না। যুদ্ধ বিগ্রহের সময় বড়মা নিজের দলের লোকেদের গোপনে অস্ত্রশস্ত্র জোগাতেন। আবার এই সব লোকেরা যাদের ওপর হামলা করত, জনসমক্ষে বড়মা সে সমস্ত নিগৃহীতদের সাহায্য করতেন। এমন বিশুদ্ধ দেশপ্রেমের জন্যেই তিনি শ্রেষ্ঠ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।

প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নিজের দায়িত্বের বোঝা কমানোর জন্যে উপদেষ্টাদের সহায়তা পছন্দ করতেন না। রাষ্ট্রপতি ভবনের যে হলঘরে বসে তিনি জনগণের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন তার অন্য পাশে ছিল একটা শান-বাঁধানো উঠোন। ঔপনিবেশিক আমলের লাটসাহেবরা সেটাকে গুদাম বা অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার কাজে ব্যবহার করতেন। হলঘর আর উঠোনের মধ্যিখানে ছিল সাইপ্রাস গাছে ঘেরা এক ঘরোয়া বাগান। প্রেমঘটিত কারণে ঔপনিবেশিক আমলের শেষদিকে এক পর্তুগিজ সন্ন্যাসী সেখানে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। বহু পুরস্কারে ভূষিত দেহরক্ষীবাহিনীর সতর্ক পাহারায় থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি কিন্তু সন্ধ্যার পর এখান দিয়ে যাওয়ার সময় গা ছমছম ভাব এড়াতে পারতেন না। সে রাতে কিন্তু শিহরণ এত গভীর ছিল যে সেটাকে অশুভ সংকেত বলে মনে না করে উপায় ছিল না। রাষ্ট্রপতি তাঁর ঐতিহাসিক ভবিতব্য সম্পর্কে সচেতন হলেন। নির্দেশ জারি হল,--ন’দিন ধরে জাতীয় শোক পালন করা হবে। আর বড়মাকে ভূষিত করা হবে দেশের জন্যে রণক্ষেত্রে নিহত বীরাঙ্গনার মরণোত্তর সম্মানে। ভোরবেলা রাষ্ট্রপতি রেডিও, টেলিভিশনসহ সমস্ত প্রচার মাধ্যম মারফত তামাম দেশবাসীর কাছে এই নাটকীয় ঘোষণা করলেন। সেই সঙ্গে আশা প্রকাশ করলেন যে বড়মার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সারা পৃথিবীর কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এ হেন প্রস্তাব যে খুব সহজে বিনা বাধায় কার্যকরী করা সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য। যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে তার জন্যে বড়মার পূর্বপুরুষদের তৈরি করা দেশের আইনি কাঠামো যথেষ্ট নয়। আইনজ্ঞ পণ্ডিতের দল, সংবিধান বিশেষজ্ঞরা আইনি তর্কে জড়িয়ে গিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে এমন এক সূত্র অনুসন্ধান শুরু করলেন যার ফলে বড়মার আন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি আইনত সিদ্ধ হয়। ক’দিন ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় মহলে তুলাকালাম চলল। এক শতাব্দীরও পুরোনো, বিমূর্ত আইনের জমিতে শিকড় গজিয়ে যাওয়া আইনসভা গৃহে জাতীয় নেতা ও গ্রিক চিন্তাবিদদের আবক্ষ মূর্তির অন্তরালে বড়মাকে নিয়ে এমন বিতর্ক শুরু হল যা শেষ হওয়ার কোনও লক্ষণই নেই। এ দিকে সেপ্টেম্বরের গরমে মাকোন্দোয় তার মৃতদেহে ততদিনে পচন ধরতে শুরু করেছে। বেতের দোলচেয়ার, দুপুর দু’টোর দিবানিদ্রা বা সর্ষের পুলটিশ ছাড়াই তার সম্বন্ধে এই প্রথম লোকজন কথা বলতে বা ভাবতে শুরু করল। নাম-গোত্র সম্পন্ন মানবীরূপে নয়, বিমূর্ত কিংবদন্তির নায়িকা হিসেবে লোকে তাকে দেখতে লাগল।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বকবকানি আর গুলতানি চলল। সারা প্রজাতন্ত্র জুড়ে যেন ছড়িয়ে পড়ল তার প্রতিধ্বনি। অবশেষে সেই বিশুদ্ধ আইন বিশারদদের মধ্যে থেকে এমন একজন মুখ খুললেন যার বাস্তব সম্পর্কে অন্তত কিছুটা জ্ঞানগামি আছে। ঐতিহাসিক কচকচানি থামিয়ে তিনি মনে করিয়ে দিলেন যে তাদের সিন্ধান্তের অপেক্ষায় বড়মার মরদেহ ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় পড়ে রয়েছে। লিখিত আইনের তাত্ত্বিক পরিবেশে হঠাৎ যেন সাধারণ বোধের বিস্ফোরণ ঘটল। প্রতিবাদ করার সাহস কারও হল না। সুগন্ধি যুক্ত ওষুধ লাগিয়ে মৃতদেহটা তাজা রাখার নির্দেশ দেওয়া হল। ওদিকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আইনসিদ্ধভাবে রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি নিশ্চিন্ত করার জন্যে সমাধান-সূত্র সন্ধান, মত পার্থক্য মেটানো সংবিধান সংশোধন ইত্যাদির উদ্যোগ নেওয়া হল।

এত কথা হয়েছিল যে সে সব আলোচনা দেশের সীমানা পেরিয়ে, মহাসাগর ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের ইঙ্গিতের মতো "কাস্তেল গানদোলফো'-তে অবস্থিত পোপের প্রাসাদেও পৌঁছে যায়। আগস্ট মাসের তীব্র গরমের দিনে দিবানিদ্রা সেরে মহামান্য পোপ তখন সবে জানালার কাছে এসে বসেছেন। জানালা দিয়ে তিনি দেখছিলেন যে ডুবুরিরা পুকুরে ডুব দিয়ে একটি মেয়ের কাটা মাথা খুঁজে চলেছে। মেয়েটিকে মাথা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সান্ধ্য সংবাদপত্রে এই হত্যাকাণ্ডের খবর ছাড়া অন্য কোনও বিষয় ছিল না বললেই চলে। নিজের গ্রীষ্ম-আবাসের এত কাছে ঘটে যাওয়া এই রহস্যময় অপরাধ সম্বন্ধে স্বাভাবিক কারণেই মহামান্য পোপ উদাসীন থাকতে পারেননি। তবে সেদিন সন্ধ্যাবেলায় দেখা গেল, খবরের কাগজগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে বিষয় বদল করেছে। যে সব নিরুদিষ্ট মেয়েদের একজন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে থাকতে পারে, এতদিন নিয়ম করে প্রতিদিনই তাদের ছবি ছাপা হচ্ছিল। তার বদলে একটি বছর বিশেকের তরুণীর ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিটির চার পাশে মোটা করে কালো দাগ দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে মেয়েটি প্রয়াত। মহামান্য পোপ চেঁচিয়ে উঠলেন,--“বড়মা।' বহু বছর আগে যখন তিনি সেন্ট পিটারের আসন প্রথম অলংকৃত করেছিলেন, তখন এই অস্পষ্ট ছবিটি তাকে দেওয়া হয়েছিল। ফোটোগ্রাফির প্রথম যুগে যখন রুপোর পাতের উপর ফোটো তোলা হত, সেই পদ্ধতিতে তোলা ছবিটি তিনি দেখামাত্রই চিনতে পারলেন। পোপের সহকারী অন্যান্য যাজকরাও নিজের নিজের বাসস্থানে বসে একইভাবে সমবেত সুরে চিৎকার করলেন,--“বড়মা’। কুড়ি শতাব্দীর মধ্যে এই নিয়ে তৃতীয়বার খ্রিস্টান ধর্মের সীমাহীন সাম্রাজ্য ভীত, বিচলিত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। অবশেষে মহামান্য পোপ বড়মার অত্যাশ্চর্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হওয়ার জন্যে তাঁর বিশাল গণ্ডোলা জলে ভাসিয়ে সুদূরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

চকচকে পিচফলের বাগিচা পিছনে পড়ে রইল। রোম শহর থেকে আলবান পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত প্রাচীন রোমান যুগে নির্মিত “ভিয়া আপিয়া আন্তিকা'নামের ঐতিহাসিক রাস্তার দু'পাশের অভিজাত বাড়িগুলোর ছাদে শুয়ে চলচ্চিত্রভিনেত্রীরা তখন রৌদ্র-স্নান করে ত্বকের চাকচিক্য বাড়াচ্ছিলেন। গোলমাল নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা কারও খেয়াল ছিল না। রোম শহরের অন্য প্রান্তে টাইবার নদীর তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে "কাস্তেল সন্ত আঞ্জেলো'-র ছোটখাট অথচ গম্ভীর দর্শন পাহাড়। সন্ধ্যাবেলায় মাকোন্দোর ভাঙা ঘন্টার আওয়াজের সঙ্গে সেন্ট পিটারের গির্জার ঘণ্টাধ্বনি সৃষ্টি করল বিচিত্র সুর- মূর্চ্ছ্বনা। রোমান সাম্রাজ্য আর বড়মার নিজস্ব এলাকার মধ্যে সীমারেখা নির্ধারণ করেছিল ঘাসআগাছায় ভরা চোরা জলাভূমি। সেখানে দমবন্ধ হওয়া তাবুর ভিতরে শুয়ে সারারাত ধরে মহামান্য পোপ শুনতে পেতেন বাঁদরদের কিচিরমিচির। লোকজনের চলাফেরায় ওরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। নৈশ সফরের সময় ইউকা গাছের বস্তা, কাঁদি কাঁদি কাঁচাকলা আর মুরগির ঝাঁকায় তার নৌকো ভরে উঠত। যে সব নারী-পুরুষ নিজেদের রোজাকার কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করে কিছু কামানোর জন্যে বড়মার আন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে যাচ্ছিল, তারা উঠে পড়ে মহামান্য পোপের নৌকোয়। মহামান্য পোপ সে রাতে জ্বর জ্বর ভাবের জন্য গা ঘুমোতে পারলেন না। মশার কামড়ে সারাটা রাত ছটফট করে কাটালেন। তবে মহান বৃদ্ধার এলাকায় অপূর্ব সূর্যোদয় দেখে তিনি মোহিত হয়ে গেলেন। একই সঙ্গে সুগন্ধি আপেল আর ইগুয়ানা জাতীয় বিশালাকার টিকটিকির জন্মস্থান দেখে বিভোর হয়ে যাওয়ায় মহামান্য পোপের মন থেকে দীর্ঘ সফরের সব কষ্টের স্মৃতি মুছে গিয়ে মনে হল,--এত কষ্টের বিনিময়ে এ যাত্রায় যা পেয়েছেন তা কিছু কম নয়।

দরজায় তিনটি টোকা শুনে নিকানোরের ঘুম ভেঙেছিল, আসলে সেই তিনটি টোকাই মহামান্য পোপের আবির্ভাব ঘোষণা করেছিল। মৃত্যু যেন বাড়িটার মালিকানা দখল করে রীতিমতো জাঁকিয়ে বসেছে। রাষ্ট্রপতি বারেবারে বড়মার মৃত্যু নিয়ে ভাষণ দেওয়ায় বিষয়টির গুরুত্ব ফুটে ওঠে। সংসদ সদস্যরা তো প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে তর্ক করতে করতে গলাই ভেঙে ফেললেন, তার পর ইঙ্গিত-ঈশারায় চালিয়ে গেলেন তাদের বিতর্ক। এই সব দেখে-শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজারে হাজারে মানুষ নিজেদের কাজ-কর্ম শিকেয় তুলে বড়মার বাড়িতে জড়ো হয়। অন্ধকার বারান্দা, জিনিসপত্রে ঠাসা দরদালান, দমবন্ধ করা চিলেকোঠা সব লোকে লোকারণ্য। যারা দেরিতে পৌঁছোল, তারা বেড়ার ওপর, পাহারাদারের গুমটিতে, কাঠের কাজ করা দেওয়ালে বা ঝোপঝাড় বেয়ে উঠে বেশ আরামেই আস্তানা গড়ে তোলে। বড় হলঘরটায়, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধাস্তের অপেক্ষায় মমিতে পরিণত হওয়া বড়মার মরদেহ চিরনিদ্রায় শায়িত। তার ওপর জমে ওঠে টেলিগ্রামের পাহাড়। কান্নায় অবশ হয়ে যাওয়া ন’জন ভাইপো গভীর আবেগ ও পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে সারা রাত জেগে মৃতদেহের পাশে বসে নজরদারি করে যাচ্ছিল।

তারপরেও বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা না করে উপায় ছিল না। পুরসভা ভবনের একটি ঘরে মহামান্য পোপের থাকার বন্দোবস্ত হল। সেখানে আসবাবপত্র বলতে ছিল গোটা চারেক চামড়ার গদি আঁটা টুল। বিশুদ্ধ পানীয় জলে ভরা একটি মাটির কলসি আর একটা দড়ির দোলনা। ঘেমে নেয়ে, অনিদ্রার যন্ত্রণায় ভুগে পোপ সেখানে দমবন্ধ করা রাত কাটাতেন। দপ্তরের পুরোনো নথি পড়ে তার সময় কাটে। যে সমস্ত বাচ্চা জানালার বাইরে থেকে তাঁকে দিনের বেলায় দেখতে আসত,তাদের তিনি মুঠো মুঠো ইতালিয়ান চকোলেট বিলোতেন। আর হিবিস্কাস জাতীয় গাছ দিয়ে ছাওয়া ছাউনির তলায় বসে কখনও ফাদার আন্তোনিও ইসাবেল আবার কখনও বা নিকানোরের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারেন। প্রতীক আর উষ্ণতায় ভরা দিনগুলো যেন বড় দীর্ঘ আর প্রলম্বিত মনে হচ্ছিল। সময় যেন আর কাটতেই চায় না। অবশেষে একদিন ফাদার পাসত্রানা একজন ঢুলিকে সঙ্গে করে শহরের কেন্দ্রীয় চত্বরে দাঁড়িয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত চিৎকার করে পড়তে শুরু করলেন। ‘সরকারের তরফ থেকে বলছি'--টাক ডুম ডুম করে ঢোল বেজে উঠল। ফাদার আবার সুর ধরলেন,--‘বিশেষ আইন চালু হওয়ার দরুন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি বড়মার আন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে পারবেন।‘ তার বয়ান ভালোমতো শেষ হওয়ার আগেই টাকা ডুমা ডুম আওয়াজ করে ঢোল বেজে উঠল।

শেষপর্যন্ত এসে গেল সেই স্মরণীয় দিন। রকমারি জুয়া-লটারি, নানান রকমের ভাজা ভুজি, খাবার দাবারের দোকান-পাটে ভরে গেল সব রাস্তা-ঘাট। জনাকয়েক লোক গলায় সাপ জড়িয়ে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে এক ধরনের মলম বিক্রি করতে শুরু করে দিল। ওটা নাকি যে কোন সংক্রমণজনিত রোগের অব্যর্থ ওষুধ। এমনকী অমরত্ব লাভের উপায় বলেও দাবি করা হচ্ছিল। কেন্দ্রীয় চত্বরে লোকজনেরা টাঙিয়েছিল নানান রঙের তাবু। বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিচিত্র সব বিছানার চাদর। সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত তীরন্দাজেরা কর্তব্যক্তিদের জন্যে পথ পরিষ্কার করছিল। "সান খোর্খে”-র ধোপানীরা, 'কেপ ভোলা'-র মুক্তো-তোলা জেলেদের বাহিনী, "সিয়েনাগা'-র মাছের জাল বানানোর কারিগরেরা, ‘তাসাহেরা'র চিংড়িমাছ ধরা জেলেদের দল, "মোহাহানা'র জাদুকরেরা, 'মানাউরে’-র লবণ খনির শ্রমিক বাহিনী, ‘ভাইয়েদুপার'-এর বেহালা বাজিয়ের দল, 'আয়াপোল'-এর দক্ষ ঘোড়সওয়ারেরা, সান পেলায়ো'-র দরিদ্র সঙ্গীতশিল্পীবৃন্দ, ‘লা কুয়েভা’-র মুরগি পালনকারীরা, সাবানাস দে বলিভা'-র জাত শিল্পীর দল, ‘রোবোলো'-র ফুলবাবুদের দল, ‘মাগদালেনা’-র দাঁড়-টানা মাঝিরা, ‘মোনপক্স'-এর কলম পেশা করণিককুল, আর যাদের নাম এই কাহিনির সূচনায় বলা হয়েছে,--সবাই চরম মুহুর্তের প্রতীক্ষায় জড়ো হয়েছিল। এমনকী কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পুরোনো সৈন্যেরা বড়মার ওপর তাদের একশো বছরের পুরোনো রাগ ভুলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে এল। তাদের পুরোভাগে ছিলেন বাঘের নখ-দাঁত-ছাল দিয়ে তৈরি পোশাক পরা ডিউক অফ মালবারো। গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই সৈনিকেরা তাদের প্রাপ্য পেনশনের জন্যে ষাট বছর অপেক্ষা করেছে। এই সুযোগে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতিকে পাওনা পেনশন বরাদ্দ করার অনুরোধ জানানোর উদ্দেশ্যে তারা সমবেত হয়েছিল।

জনতা প্রায় উন্মত্ত। গরমে তাদের দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। সৈনিকের পোশাকে সুসজ্জিত অভিজাত সেনাবাহিনী কোনওরকমে জনতাকে সামলায়।

বেলা এগারোটা নাগাদ জনতা আনন্দে সমস্বরে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। জ্যাকেট আর আনুষ্ঠানিক টুপি পরে গভীর, সৌম্য দর্শন রাষ্ট্রপতি উপস্থিত। সঙ্গে রয়েছে মন্ত্রীমণ্ডলী, মাননীয় সাংসদ বৃন্দ,সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারকমণ্ডলী, সংবিধান স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলির প্রধানেরা, দেশ-বিদেশের পাদ্রিকুল এবং ব্যাঙ্ক-বাণিজ্য-শিল্পের প্রতিনিধিবৃন্দ। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আসা এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা টেলিগ্রাফ অফিসের পাশে সমবেত হলেন। বেঁটে, মোটা, বৃদ্ধ রাষ্ট্রপতির মাথা জোড়া টাকা। অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি জনগণকে বিস্মিত করে রীতিমতো প্যারেডের ভঙ্গিতে হেঁটে গেলেন। এরাই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তবে সামনাসামনি কখনও দেখেনি। এই সুযোগে লোকে তার অস্তিত্ব নিয়ে নিশ্চিন্ত হল। পদমর্যাদার ভারে নুইয়ে যাওয়া পাদ্রি আর প্রশস্ত বুকে তকমা লটকানো সামরিক কর্তাব্যক্তিদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের অধিপতি যেন ক্ষমতার জ্যোতি বিকিরণ করলেন।

এবার দেখা দিল দ্বিতীয় সারি। শোকের পোশাক পরিহিত শান্ত মিছিলে দেশের রানিরা পা মেলাল। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে এবং যারা হতে পারে সব কিছুর রানি, তারা জীবনে এই প্রথম কোনও রকম পার্থিব জাঁকজমক ছাড়া এখান দিয়ে হেঁটে গেল। সবার আগে বিশ্ব রানি , তার পিছনে সার দিয়ে সয়াবিন রানি, কলা রানি, টুকরো ফলের রানি, ময়দার মতো ইউকা রানি, পেয়ারা রানি, ডাবের রানি, কালো দানার সয়াবিন রানি, ৪.২৬ কিলোমিটার লম্বা ফিতে-ওয়ালা ইগুয়ানার ডিমের রানি, এবং আরও অনেক কিছুর রানি। সব কিছুর নাম এখানে করা সম্ভব নয়। কারণ, তাহলে কাহিনি শেষ করা যাবে না।

বড়মা এখন লালচে বেগুনি রঙের কাপড়ের পাকে মোড়া কফিনে শায়িত। তামার তৈরি আটটা টার্নবাকল গোছের বোতাম তাকে বাস্তব থেকে আলাদা করে রেখেছে। নিয়মমাফিকভাবেই বড়মা এখন চিরন্তনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। আর এভাবেই তাঁর মহত্ত্বের মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যখন গরমে ঘুমোতে না পেরে তিনি বারান্দায় বসে স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর মধ্যে থেকে ফুটে বেরোত এক বিশেষ ধরনের ঔজ্জ্বল্য আর মর্যাদা। এখন তার সঙ্গে মিশে গেছে আটচল্লিশ জন রানি, যারা তার স্মৃতিকে জানিয়েছে মরণোত্তর সম্মান। স্বয়ং পোপ মানসিকভাবে অস্থির অবস্থায় কল্পনা করছিলেন, বড়মা যেন এক চোখ ঝলসানো গাড়িতে চড়ে ভ্যাটিকানের বাগানের ওপর শূন্যে ঝুলছেন। তবুও গরম অগ্রাহ্য করে, নকশা কাটা তাল পাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে নিজের উপস্থিতির মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে জমকালো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে সম্মানিত করলেন।

কে সবচেয়ে পদমর্যাদা সম্পন্ন, কারা কফিন বয়ে নিয়ে যাওয়ার অধিকার পাবে, তা নিয়ে বিতর্ক শেষমেশ মিটল। সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিরা কাঁধে করে কফিন পথে নিয়ে এলেন। ঠিক তখনই আকাশে উড়তে থাকা পায়রাদের ছায়া প্রহরীর মতো কফিনটাকে আগলে রেখেছিল। লোকেরা অবিশ্যি ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি। ক্ষমতার জৌলুশে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। মাকোন্দোর মাথাগরম মানুষেরা যখন শোক মিছিলে চলেছিল, এক পাল তীক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন অশুভ শকুনও যে তাদের অনুসরণ করছিল, তা কেউ নজর করেনি। কর্তব্যক্তিদের চলার পথে যে জঞ্জালের স্তুপ সৃষ্টি হচ্ছিল, তা কেউ খেয়াল করেনি। মৃতদেহ বাড়ি থেকে বেরোতে না বেরোতেই বড়মার ভাইপো, পুষ্যি, আশ্রিত আর কাজের লোকেরা বাড়ির সব দরজা-জানালা বন্ধ করে বাড়ি ভাগের আগ্রহে এখানে-ওখানে সর্বত্র খোঁড়াখুড়ি শুরু করে দেয় ; এই বিষয়টা অবিশ্যি কারও নজরেই এল না। আরও একটা বিষয় কারও চোখে পড়েনি --একটানা চোদ্দোদিনব্যাপী প্রার্থনা, আবেগ, উচ্ছ্বাস শেষ হওয়ার পর দস্তার ডালা দিয়ে বড়মার সমাধি পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে দেওয়ার পর মুহূর্তেই সমবেত জনতা যেন এক বিশাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে স্বচ্ছ দৃষ্টি সম্পন্ন কয়েকজন বুঝতে পারে যে তারা এক নতুন যুগের জন্ম দেখছে। এখন মহামান্য পোপ দেহ ও আত্মাসহ স্বর্গে আরোহণ করতে পারেন। মর্ত্যলোকে তাঁর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নিজের বিবেচনা অনুযায়ী দেশ শাসন করতে পারেন। রানিরা বিয়েশাদি করে সুখী হতে পারে। জন্ম দিতে পারে বহু পুত্রসন্তানেব। জনগণ খাঁটি মানুষ হিসেবে নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে বড়মার সীমাহীন জমিদারির যে কোনও অংশে তাঁবু খাটাতে পারে। কেননা সেই একটি মানুষই তাদের বাধা দেওয়ার হিম্মত রাখতেন। দস্তার ডালার তলায় রাখা তার দেহটা এখন ধুলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কেবল একটা কাজই বাকি। সবার সামনে একটা টুলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে কোনও একজনের এই কাহিনিটা বলে যাওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। দুনিয়ার কোনও অবিশ্বাসী মানুষ বড়মার ইতিবৃত্ত না জেনে পারবে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী এ সংবাদ প্রবাহিত হবে। এদিকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ফলে জমে ওঠা যাবতীয় জঞ্জাল কাল সকালে ঝাড়ুদারেরা এসে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দেবে।

মূল শিরোনাম. Los funerales de la Mamá Grande

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ