বার্মিংহাম থেকে দিল্লি । তারপর কলকাতা । দীর্ঘ আকাশপথ কখনই দীর্ঘ বলে মনে হলনা । পঁচিশ বছরে অন্তত কুড়ি বার যাতায়াত করেছে , তবু ভাল লাগে । যেন কোন অদৃশ্য সুতোতে ঝুলে ঝুলে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফিয়ে নেমে পড়া ! বাহান্ন বছরের অমিত্র এখনও যেন সেভাবেই পাশের বাড়ির সুকোমলের সঙ্গে টারজান টারজান খেলে । একা । একা ।
কেউ ওর জন্য অপেক্ষমান নয় । একা একাই এসে দাঁড়াল বিমানবন্দরের চাতালে । আকাশজুড়ে কী ভীষণ নীল ছিড়িয়ে আছে । ঘাড় উঁচু করে দাঁড়াল অমিত্র । ঠিক এই ভঙ্গীতে আকাশ দেখতে ভালবাসে ও । ছেলেবেলায় ছাদে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে আকাশ দেখতো । অভ্যেসটা অনেকদিনের । মুহূর্তে মাটির দুনিয়াটা হারিয়ে গেল অদৃশ্য বাটনের প্রেশারে । কতটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে নীল শূন্যতা। এসব সময়ে নিজের কথা মনে হয় । ঠিক যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অমিত্র । একরাশ শূন্যতা !
-কী যে বল , বড়বউদি চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে হাসল – তোমার সৌভাগ্যে আমাদের ঈর্ষা হয় , কী আরামে আছ । বিলেতে লোকে যেতে পায় না , আর তোমার কেবল শূন্যতা আর শুন্যতা ! থাকতে আমাদের মত , বুঝতে !
চায়ের কাপে জমে থাকা লিকারের স্পষ্ট দাগ ।ওকে দেখে বড়বউদির মুখে স্বস্তি ফুটে আছে । মনি আর সাজু বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠেছে । বোঝে অমিত্র । বউদির স্বস্তির কারণও বোঝে । অমিত্রর ছায়া এখানে আলো ছড়াতে আসে । সূর্য থেকে আসে অমিত্র ! ওর উপস্থতি কারও কাছে আলোক সদৃশ , ভাবতে ভাল লাগে । আজ রোদ ঝলমলে জন্মভূমি ওর জন্য দাঁড়িয়ে ! বরাবরের মত এবারেও হোটেলে উঠতে হল । দাদার দু কামরার বাসা বাড়িতে পা রাখার উপায় নেই । অসুবিধে বুঝে দাদাই বলেছে – হোটেলই ভাল । তোর আবার বাথরুমে গরম জল টল ... । হোটেল থেকে দাদার বাসার দূরত্ব বেশি নয়। অমিত্র দাদার সঙ্গে সময় কাটাতে চাচ্ছিল । মাত্র চারটে দিন । তারপর আবার ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের যাত্রী ও । ফের ফিরে যাওয়া । গাড়িতে বসে শহরটা দেখার চেষ্টা করছিল অমিত্র ।উঁচু হাম্পে পড়ে গাড়িটা লাফিয়ে উঠল । জায়গাটা একইরকম রয়ে গেছে ।ঘ্যাস শব্দে থেমে গেল গাড়িটা । টায়ার লিক করেছে । এখন ডিকি খুলে মজুত করা টায়ার বের হবে । অমিত্র গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল । চারপাশে বহুতল বাড়ি । প্রমোটার – রাজ চলছে । ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকাল অমিত্র । লিক হওয়া চাকাটা পড়ে আছে । সামনের চাকা রিসোলিং করাতে হবে । চাকা প্লেইন হয়ে এসেছে ।
ফের ছুটল গাড়ি । ফাঁকা রাস্তা পেলে গতি বাড়তো , এখানে তা হওয়ার নয় । প্যাঁ প্যাঁ শব্দে হর্ন দিচ্ছে ড্রাইভার । কান ঝালাপালা হয়ে গেল । ডেসিবেল বলে কিছু নেই এখানে ?
উগ্র গন্ধটা নাকে এল ।মনি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে শ্যাওলা ধুচ্ছিল । প্রথমটা অপ্রস্তুত হলেও সামলে নিল – এস , এস , কেমন আছ কাকু ? আধময়লা আধ ভেজা শাড়ির আঁচলটা নিয়ে হাত মুছল মনি । শ্যামলা মুখে পরিশ্রমের ঘাম ফুটে আছে ।
- ওমা , এসে পড়েছ তাহলে ?এবারে থাকছ তো কদিন ? বউদি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে ।
-চারদিন । ফের হুস । হাত দিয়ে প্লেনের গতি বোঝায় অমিত্র ।
-কি মজা , নীল মেঘের ভেতর দিয়ে উড়ে যাও । ছেলেমানুষের মত খুশিতে উজ্জ্বল বউদি । বউদিকে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে অমিত্র । জীবনে সব পেয়ে যাওয়া ভাল নয় । কিছু জিনিস অধরা থাকা ভাল । তাতে খুশি হওয়া ভুলে যেতে হয়না ।
-ওকে ভেতরে ঢুকতে দাও । দাদার গলা পাওয়া যাচ্ছে । বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে যেতেই দাদাকে দেখতে পেল । ইজিচেয়ারে আধশোয়া দাদা ঘাড় কাত করে অমিত্রকে দেখল- কেমন আছিস ?
-ভাল , তুমি ?
-যেমন দেখছিস । ভাল থাকা অত সহজ নাকি ? কত সহজে জটিল অঙ্ককে মেনে নিয়েছে দাদা । অমিত্র পারলনা । এই মেনে নেওয়াটা যে কি কঠিন ... ।
-তুই ভাল করেছিস । কী হত এখানে থেকে ? দু কামরার বাসা বাড়িতে দুজন বয়স্কা মেয়েকে নিয়ে অনিশ্চচিত ভবিষ্যৎ দেখতে পায় দাদা । অমিত্রকে দেখে নিজের ব্যর্থতা টের পায় ।
-সত্যি ,কিভাবে গেছিলে ...ঝগড়া করে , সম্পর্ক ত্যাগ করে ...। নাহলে যাওয়াই হতোনা ! বউদি হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ।
পেছনের দিকে তাকাতে ভাল লাগছিল না । তবু বউদির কথায় সেসব দিন হুড়হাড় করে চলে এল । অমিত্র তখন টগবগে ঘোড়া । কোথায় ম্যাগাল্লান প্রণালী , আটলান্টিক ,আরবসাগর , বিস্কে উপসাগর...জাহাজে জাহাজে ভেসে চলা । এক সময় থামতে হল । বিদেশের মোহে বন্দী তখন । মনেই পড়েনি দেশকে ।
-কতক্ষন লাগে গো যেতে ? বরাবর এই প্রশ্নটা করে মানু ।
-প্রায় দশ ঘন্টা ।
-এবারে থিতু হও । বউদি অমিত্রর দিকে তাকায় । সেটল হও । মেয়ে রয়েছে অনেক । পছন্দমত বেছে নাও ।
ঘর ? সংসার ? জীবনের অনেক বছর জলে কাটিয়েছে । মাটির স্বাদ সেভাবে পাওয়া হল কোথায় ? অথচ মাটি ওকে প্রবল ভাবে টানে ।
-তোমার ছেলে … রিচমন্ড , কেমন আছে ? মানু চা নিয়ে এসেছে ।
- ও এখন আমেরিকায় । ফিলম স্টাডিজ পড়ছে ।
বিস্ফারিত চোখে আমেরিকা শব্দটাকে চাখল মানু ।এই আধ ময়লা শাড়ি , ম্লান মুখ মেয়েটির পাশে লিজাকে মনে পড়ে । সে ছিল একটা সময় । জাহাজ থেকে মাটিতে পা রাখত লিজার অভিকর্ষে । মনে পড়ে দু মাস দেখা হয়নি । । মাটিতে পা রেখেই ছুটেছে । পার্কের স্মোকি লাইটের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা লিজাকে স্পষ্ট মনে পড়ে । অথচ বনলো না ওদের । রিচমন্ডকে নিয়ে অমিত্রকে ত্যাগ করল লিজা ।খুবই আনপ্রেডিকটেবল ছিল লিজা । আসলে একটা সময় নিজেকে খুঁজতে শুরু করল অমিত্র ।টেমসের জলে তিস্তাকে খুঁজতো । পাইন বীথিতে ডুয়ার্সের বুনো গন্ধ খুঁজতো । দাদা ওকে জঙ্গল চিনিয়েছিল । চা বাগান থেকে চা পাতা ছিঁড়ে এনে গরম জলে ফুটিয়ে খেত । সেইসব দিন গুলোকে হন্যে হয়ে খুঁজতো অমিত্র । লিজা ওকে সহ্য করতে পারছিল না । লিজার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখেছিল অমিত্র ।সেই আকাশে পার্সিউস নক্ষত্র পুঞ্জ আলো দেখাচ্ছিল । তবু পথ খুঁজে পাচ্ছিল না ও । ওর অন্যমনস্ক মুখটা দেখছিল দাদা – তুই কি এখানে থাকতে চাস ? এই দেশে ? দাদার ভ্রু কুঁচকে ওঠে – যা অবস্থা দেশের ! কয়েক কোটিতে পৌঁছে গেছি আমরা । এই দি্নযাপন , সহ্য করতে পারবি ?
-তুমি কি পাগল ? কী পাবে এখানে ? ক্লান্তি ঝরে পড়ে বউদির গলা থেকে ।
-যখন পাসপোর্ট পেয়েছিলাম , ভিসা আর কিছু ফরেন এক্সচেঞ্জ জোগাড় করে চলে গিয়েছিলাম, তখন সত্যি ভাবিনি যে ফিরে আসার কথা ভাববো ।অন্যমনস্ক অমিত্র ।
-আফটার অল , তোর ছেলে ওখানে আছে , এখানে কিসের জন্য আসবি ? কে আছে এখানে ?
-জন্মভূমির একটা টান আছে দাদা । ভীষন টান। ওখানে সব আছে , আপন কে আছে বল ! রিচমন্ড আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় না । লজ্জা পায় । ওদের একটা সোসাইটি আছে । অমিত্র মনেমনে কথা বলছিল । কাউকে শোনাতে নয় ।
-ওখানে প্রাচুর্য আছে । বেঁচে থাকার স্বাধীনতা আছে । দাদা ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁরিয়েছে ।
-এখানে স্বাধীনতা নেই বলছ ?
-অমি , যখন দেখবি , সদ্যোজাত সন্তান ড্রেনে পড়ে আছে , তখন বুঝবি স্বাধীনতা কাকে বলে । বিয়ে করে ওখানেই রয়ে যা ।অতীত ভুলে যা । দাদা ভেতরের ঘরে চলে যাচ্ছে । কত সহজে বলা যায়, অতীত ভুলে যা ! ছয়টি বর্ণের একত্র মিলন । অথচ ধ্বংসের ছায়া তাকে জড়িয়ে আছে । কি করে তাকে ভুলে যাবে অমিত্র ?তখন রাসেল স্কোয়ারে লিজার অফিস । মায়ের জন্য কাঁদছিল রিচমন্ড । অফিসে লিজার কাছে নিয়ে গিয়েছিল অমিত্র । কী মজা হয়েছিল সেদিন । কত মজার ঘটনা …কত কথা ! অথচ নিয়ম মেনে অতীত ভুলে যেতে হবে । চড়া রোদের মধ্যে এক কঠিন শীতলতা ছড়িয়ে থাকে ওখানে । খাঁড়ির নীল জলে লিজার ছায়া পড়েছিল । সেদিনই প্রথম দেখা !
লেবু চা খেতে খেতে ওকে দেখছিল দাদা । ওর জন্য অপেক্ষারত ওরা । দুপুরে এখানেই খাবে ও । স্নান সেরে চওড়া করে সিঁদুর পরেছে বউদি । বউদিকে দেখে মাকে মনে পড়ছিল অমিত্রর । মায়ের মৃত্যুর সময় আসতে পারেনি ও । তখন ভূমধ্যসাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
-আসতে চাস এখানে ? কিভাবে ভীড় বাড়ছে …দ্যাখ , দাদা খবরের কাগজটা এগিয়ে দিল – দ্যাখ , সীমান্তের জিরো পয়েন্টে আটকে আছে অনুপ্রবেশকারীরা । বি এস এফ আটকে রেখেছে । দেখ কান্ড !বুঝতে পারছিল না অমিত্র – অনুপ্রবেশকারী মানে ?
- অন্য দেশ থেকে ইন্ডিয়ায় ঢুকে পড়েছিল কিছু লোক । ব্যাপারটা পুরোই বেআইনি । কিন্তু এখন , ওদের দেশ , ওদের স্বীকার করছে না । ওরা ফিরে যাবে কোথায় !
- ব্যাপারটা খুলে বল , আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা । অমিত্র হাতড়ে মরে । মাউসে ডবল ক্লিক , আর মনিটরে ছবিটা চলে এল - এমনটা হলে ওর পক্ষে সহজ হত ।
- ঘটনাটা ঘটেছে সীমান্তের জিরো পয়েন্ট পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশের দিকে পঞ্চাশ থেকে সত্তর গজের মধ্যে । ওই দেশের একটি বাজিকরের দল ইন্ডিয়ায় ঢুকে পড়েছিল । হয়তো নেহাতই পেশাগত কারণে । পরে তারা যখন স্বদেশে ঢুকতে যাবে , দেশ তাদের স্বীকার করছে না । ঢুকতে দিচ্ছে না ।
- বাপরে ! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার ! এতে কূটনৈতিক উত্তেজনাও বেড়েছে নিশ্চয় ?
-সে তো বেড়েছে !
-ঠিক কোন জায়গায় ওরা আটকে আছে দাদা ?
- পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে ।
নো ম্যানস ল্যান্ড ! অমিত্র স্পষ্ট করে বুঝে উঠতে পারেনা ভূগোলের বা রাজনীতির চেহারাটা ! দাদার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে খেলা করে বহু বছরের সংগ্রামের ছায়া । অমিত্র নিজের অজান্তে নিজের গালে , কপালে হাত বুলোয় - ওই বাজিকরের দলটা যে ইন্ডিয়ার নাগরিক নয় , তার কী প্রমাণ ?
-আরে বাবা , কাগজটা পড়ে দেখ না । ইলেকট্রিক বিলের মত ওদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের নথিপত্র আছে যে !
- তাহলে ?
-তাহলে ওদের সরকারের উচিত হবে ওদের স্বীকার করে নেওয়া ।
অমিত্র ওদের অবস্থাটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে । এমনও হতে পারে , ওদের সরকার মনে করছে ওদের কাছে যেসব কাগজপত্র আছে , সব ফলস ।
-এই টানাপোড়েনে মানুষগুলোর দশা যা দাঁড়িয়েছে … ত্রিশঙ্কু ! খাদ্য নেই , পানিয় নেই । খোলা মাঠের নীচে পড়ে আছে । সঙ্গে মেয়েরা আছে । বাচ্চারাও ।
দুপুরে খেতে বসেও মাথা থেকে ব্যাপারটা সরলো না । ভাতের উপর ডালের বাটি উপুর করতে করতে অমিত্র ফের পুরনো প্রসঙ্গে – অনুপ্রবেশ হয় বলছ ?
-হরদম । রাতারাতি নাগরিক । দালাল মারফত ঢোকে ।আমাদের জনসঙ্খা কত এখন জানিস ? এরপর খেতে পাব কিনা … ।
সব কথা মাথায় ঢুকছে না । কিছু কিছু কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল । ভাতের ভেতরে আঙ্গুল নাড়াচাড়া করে ও – এই বাজিকরের দলে কত লোক আছে ?
-তা পড়ে দেখিস । প্রায় শ দুই হবে … ।সঠিক মনে পড়ছে না । খেলা দেখাতে ঢুকেছিল , এখন খেলা দেখছে ।
কী দুর্বিষহ অবস্থা ! সীমান্তের জিরো পয়েন্টে আটকে রয়েছে । আপনজন , চেনা মাটির গন্ধ …কিছুই নেই । খেতে পারছিল না অমিত্র । অজানা আশঙ্কায় বুকে শূণ্য দশমিক দুই রিখটার স্কেলে মৃদু কম্পন হচ্ছে ।লিজার কাছে ও বড্ড পুরনো হয়ে গেছিল । ফার্নিচার পাল্টানোর মত লিজা ওকে ত্যাগ করেছে। শেষ বার গেছিল , লিজা কথা বলেনি । গেলাসের বাকি ক্লারেট ছুঁড়ে দিয়েছিল অমিত্রর দিকে । হতচকিত অমিত্র নিজের বুক বেয়ে রক্তের মত লাল ক্লারেটকে গড়িয়ে নামতে দেখেছিল ।
-লিখেছে , দুই দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে পঞ্চম ফ্ল্যাগ মিটিংও নাকি ব্যর্থ ! দাদার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে । শব্দ করে জল খেল দাদা । অথচ ওখানে টেবিল ম্যানার্সে অভ্যস্ত অমিত্রর কানে শব্দটা ভাল লাগল । মনে হচ্ছিল , সেই ছেলেবেলায় পৌঁছে গেছে । যেখানে আইন কানুনের বাড়াবাড়ি নেই । সেই দাদা , যে স্টেশনের পেছনের বন থেকে বুনো মুরগির ডিম এনে বলেছিল , মনে হচ্ছে সাপের ডিম রে ! ভয় পেয়ে দাদাকে জাপটে ধরেছিল অমিত্র –বাড়ি চল দাদা ! মা কাঁদবে !...আজও মনে হল দাদাকে জড়িয়ে ধরে , সেভাবেই অনুরোধ করে বাড়ি নিয়ে যেতে ।
-এই তৃতীয় বিশ্বের দেশে কী আছে বলতো ? এখানে কেউ বাস করে ? এ তো নরক !
দাদার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া বর্ণ গুলো এলমেলো ভাবে ছুটোছুটি করে । কেউ চায়না যে অমিত্র এখানে ফিরে আসুক । বউদি ভরসা করে আছে একদিন সব অভাব মিটিয়ে দেবে অমিত্র । সোনার খনিতে সে বাস করে । সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে মেরে ফেলার মত নির্বোধ নয় কেউ ।
-তুমি ভাল করে খাচ্ছনা ! মানু , সাজু কাকার কাছে এসে বস । বউদি মেয়েদের অমিত্রর কাছাকাছি রাখতে চায় । মানু আঙ্গুলে আঁচলের কোণ জড়াচ্ছিল । শ্যামলা মেয়েটির শান্ত মুখশ্রীতে বিষন্নতা ছড়ানো ।
-রান্না খুব ভাল হয়েছে । হাসল অমিত্র । ডাইনিং টেবিলের অভাব বেশ অণুভূত হচ্ছে । অমিত্র বউদির দিকে তাকায় – মানুর সম্মন্ধ টম্মন্ধ দেখছ ?
-লাগছে না । ফরসা নয় ।টাকাই বা কোথায় ? বউদি মুখটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে ।
তাহলে ? তাহলে মানু কি চিরকাল ব্লিচিং দিয়ে শ্যাওলা ধরা বারান্দা ধুয়ে যাবে ? নিজের জগত কি ও কখনও তৈরি করতে পারবে না ? শেষবিকেলের ছায়া বাড়িময় নেমে আসছে ।
-ওকে...... তোমার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারনা ? বউদির গলায় আর্তি ।
- আমার সঙ্গে ? পাগল হয়েছ নাকি ? অমিত্র অবাক প্রায় ।
বউদি কথা বলল না । দাদাও । মানুও ।
সীমান্তের জিরো পয়েন্টে আটকে থাকা বাজিকরদের বাজি দেখতে ইচ্ছে করছিল । মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের করে বাতাসে ছুঁড়ে দেয় ওরা । একটা দড়িকে শূণ্যে দাঁড় করিয়ে রাখে । এত ক্ষমতা যখন , তাহলে ওরা কেন নিজের চাঁদ সূর্য তৈরি করতে পারছে না ? যাকে কেউ স্বীকার করেনা , সে কেন নিজের পৃথিবী বানিয়ে নেয়না ? হয়তো সেই ক্ষমতাই নেই । হয়তো শ্যাওলা ধরা বারান্দায় ব্লিচিং ছড়ানো পর্যন্ত এদের অগ্রগতি । এরপর কেবল থেমে যাওয়া আর উৎসুক দৃষ্টি মেলে নিজস্ব জনদের খুঁজে ফেরা ! হাইপার টেক্সট করে এইচ টি এম এন এর মাধ্যমে তত্য খুঁজে ফেরে অমিত্র । বিশেষভাবে চিনহিত তথ্য চাই ওর । কী করবে সেই অস্তিত্বহীন মানুষ ? কম্পিউটার সব পারে । এর জবাব দিতে পারবে না ? কি বোর্ডে আঙ্গুল চলে । মাউসে ডবল ক্লিক হয় । জবাব আসেনা ।ভাসমান বস্তু হয়ে ভেসে আছে ও ।কখন দক্ষিন চিন সাগরে , কখনও নর্থ সী তে । সেখানে রিচমন্ডের কলরব আছে ঢেউয়ের মাথায় ।
ওরা কি সত্যি পারবে না?
-তুমি পেরেছ অমিত্র ?
কে ? চমকে ওঠে অমিত্র । কেউ নয় । বুকের পাঁজরে বাসা বেঁধে আছে যে , সেই লোকটা বের হয়ে আসে মাঝে মাঝে । এসে চমকে দেয় । বাজে লোক ।
তুমি নিজের পৃথিবী খুঁজে পেলেনা ? না পারলে দেশকে আপন করে নিতে , না পেলে জন্মভূমির পাসপোর্ট । অমিত্র , তুমিও কি নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছ ?
-কাকু , চা খাবে তো ? মানু দাঁড়িয়ে আছে প্রশ্ন নিয়ে । তন্দ্রাচ্ছন্ন অমিত্র মানুকে নয় , এক অচেনা রমণীকে দেখে । শূণ্যে হেঁটে চলা এই মানুষেরা ক্রমশ দলবদ্ধ হচ্ছে ।
-কাকু , চা দেব ?
মানু কোথায় যাবে ? বাজিকরের দলটাই বা কোথায় যাবে ! আর অমিত্র ? ওকোথায় যাবে , ! পা দুটো রাখার মত মাটি কোথায় পাবে ? এই পৃথিবী কি ওর জন্য মাটি তৈরি করেনি ?
-কাকু , ঘুমিয়ে পড়েছ ?
কেউ কি অমিত্রকে ডাকছে ? কে ডাকবে !চারপাশে কেউ নেই ওকে ডাকার মত । আতঙ্কিত অমিত্র দেখে খাদ্য নেই , পানীয় নেই , মাথার উপর খোলা আকাশ । আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে একা অমিত্র । কিন্তু অসীম শূণ্যতা এতো হাহাকার ছুঁড়ে দিচ্ছে কেন ওর দিকে ! দাদা কোথায় ? দাদা বলেছিল কাঁঠালি চাঁপার গন্ধ অলা কাঁঠাল এনে দেবে ! আনলো না এখনও । দাদা , রাক্ষস খোক্ষসের বইটা কি তুই লুকিয়েছিস ? দাদা তোর মার্বেলগুলির সাদা কৌটোটা ...।
- কাকু , ও কাকু , ঘুমিয়ে পড়লে ?
এত জোরে ডেকেছে মানু , অমিত্র ভীষণ চমকে উঠেছে । দিবানিদ্রার অভ্যেস কোনকালে নেই , অথচ ... !ধড়মড়িয়ে উঠে বসে অমিত্র । আগামিকাল ভোরে ফ্লাইট । এখানে কেউ ওকে স্বাগত জানাল না । দাদা ফিরতে বারণ করেছে । বউদিও । লোকসংখ্যা বাড়াতে ভয় পাচ্ছে এরা । ফিরিয়ে দিয়েছে অমিত্রকে । ওদেশে রিচমন্ড , লিজাও ওকে চায়না । কেউ ওকে স্বীকার করছে না । জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে দুই দেশের মাটি দেখে অমিত্র ।
দাদা হোটেলে দেখা করতে এসেছিল । অন্যবারের মত খাম গুঁজে দিল দাদার হাতে । বিষণ্ণ দাদা একটু সময়ের জন্য ছেলেবেলায় ফিরে গেছিল । দৃশ্যটা গেলে অমিত্র ।
-মজার কান্ড দেখেছিস ?ভোরবেলা দেখা গেছে জিরো পয়েন্টে আটকে থাকা অনুপ্রবেশকারীরা রাতারাতি উধাও !কেউ নেই কোথাও । কিছু ছেঁড়া ন্যাকড়া , ছেঁড়া কাগজ ...পড়ে আছে !
-মানে ? বাজিকরের দল উধাও ? সত্যি ঘটনা ? সহসা এক প্রবল বন্যার উচ্ছাসে ভেসে যায় অমিত্র । শিরা , ধমনীতে সেই তরঙ্গ টের পাচ্ছিল ও । ব্রেনের হার্ডডিস্ক থেকে আনন্দের শব্দধারা ছুটে আসছিল। শেষবার বাজি দেখিয়ে গেল বাজিকরের দল । মুখ থেকে আগুন বের করা , শরীরকে টুকরো টুকরো করে ফেলা ...সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল শেষ বাজি ।
ওদের দেশ ওদের ফিরিয়ে নিয়েছে রাতের অন্ধকারে । দাদা সম্ভাব্য ঘটনার তদন্ত করে ।
না , অমিত্র জানে তা নয় । দেশ ওদের ফিরিয়ে নেয়নি । ভোজবাজি দিয়ে নিজস্ব জগত ওরা বানিয়ে নিয়েছে । নিজস্ব মাটি খুঁজে নিয়েছে । নিজস্ব চাঁদ , সূর্য ... সব ।
তাহলে সব আছে । একটু খুঁজে নিতে হয় । ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকার সুতোটা ছিঁড়বে বলে হাত বাড়ায় অমিত্র । এবার ও মাটিতে পা রাখবে । শিস দিতে দিতে পা তোলে অমিত্র । নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে ।
1 মন্তব্যসমূহ
opurbo
উত্তরমুছুন