জয়ন্ত দে'র গল্প : নিহিত পাতাল



বাড়ি চিনতে কষ্ট হল না।

জয়নগরে ট্রেন প্রায় ফাঁকা। পরের স্টেশন মথুরাপুর। স্টেশনে নেমে রিকশা খুঁজল তুষার। যে দু’একটা ছিল তারা লোক তুলে ভোঁ। পেল না। একটা ভ্যানরিকশা এগিয়ে এল, জনা চারেক লোক বসে। - যাবেন বাবু?


তুষার ঘাড় ঘুরিয়ে ডাইনে বাঁয়ে দেখল। কেউ যেন দেখছে তাকে, মুখ টিপে হাসছে। শেষে কি এই ভ্যানরিকশা করে যেতে হবে? হেঁটে গেলে হয় না। কতটা পথ কে জানে। তুষার বলল, চরমাধবপুর যাবে?

--ওঠেন। জনা চারেক সাওয়ারি তুষারকে দেখে, নড়েচড়ে না। স্থির, যেমন কে তেমনই, শুধু হাঁ করে তুষারকে গিলছিল। তুষারও ইতস্তত করে, কোথায় বসবে সে! বলতে বলতে আরও দুজন এসে হুড়মুড় করে বসে। রিকশাআলা হাঁক দেয়, বাবু আপনি সামনে আসেন।

ক্যাঁচাকোঁচ করে বেশ অনেকখানি রাস্তা। চরমাধবপুরে নেমে তিনজনকে জিগ্যেস করে রত্নাদের বাড়ি। দু তিনটে বাঁক ঘুরে ঘুরে নরেশ পালের নাম বলতে বাড়ি দেখিয়ে দিল। বাড়ির চৌহদ্দি রাংচিতার বেড়া। সামনে শাক সবজির বাগান, বাগানে শশার মাচা। বেশ ভেতর দিক করে বাড়ি। বাগানের মধ্যে দিয়েই পথ।

তুষার নিচু বাখারির গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। শরীরের ভেতর যেন ট্রেনের দোলানি। কি করবে ভাবছিল, গেট ঠেলে কি ঢুকে পড়বে বাড়ির ভেতর। আসলে বলতে তো গেটের গায়ে বাঁধা নারকেল দড়ি বেড়ার একটা বাঁশের মাথায় গলিয়ে দেওয়া। তবে কি দড়িটা খুলে ভেতরে গিয়ে রত্নাকে ডাকবে? না এখান থেকে? এখান থেকে ডাকলে কি শুনতে পাবে? কার নাম ধরে ডাকবে -- রত্না, না, নরেশবাবু? এই বাড়িটাই তো? ধারে কাছে কেউ নেই। একটানা ঘুঘু ডেকে চলেছে। ঘু ঘু ঘু ঘু।

তুষার দেখল, মাচার নীচে সবুজ পাতা শুকনো পাতার ফাঁক ফোকর গলে একটা বাচ্চা ছেলের মুখ, তাকে দেখছে। চোখাচুখি হতেই ছ্যাঁক করে উঠল বুকের ভেতর। হাতইশারায় ডাকতেই ছেলেটা উর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়ল বাড়ির ভেতর। ছেলেটার পেছন পেছন বেরিয়ে এল রত্না। প্রথমে যেন চিনতে পারল না। তারপরই কিছুটা লাফিয়ে নেমে এল বারান্দা থেকে বাগানের মাটিতে। বেড়ার গেট খুলে এগিয়ে গেল তুষার। বিস্মিত রত্না, দাদাবাবু!

তুষার হাসল। চিনতে পারলে তাহলে। ভাবছিলাম বুঝি চিনতেই পারবে না।

এগিয়ে আসা রত্না হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। যেন বইখাতা হুড়মুড় করে পড়ে গেল,আলমারির কোণে রত্না, ছোট খাটের ওপরে। তুষার মুখের ওপর, বুকের খাঁজে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে চলেছে, তুমি তুমি রত্না তুমি! সকলের সামনে ডাকা ‘তুই’ সম্বোধনটা শুধু পালটে দেওয়া -- আর কিছু না।

তুষার এলোমেলো। গলার স্বর ফাঁকা ফাঁকা শোনাল। মুহূর্তে ঠিক করে নিল নিজেকে। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, হঠাৎ মনে হল তোর বাড়ি থেকে একবার ঘুরে যাই, তাই এলে এলাম।

ভাল করেছ। খুব ভাল করেছ দাদাবাবু। কতদিন তোমাদের দেখিনি।

ঘরে ঢুকে তুষার লম্বা করে রাখা বেঞ্চে বসে। রত্না বলল, না না দাদাবাবু, বিছানায় উঠে বসো। তুষার বসল। রত্না বলল, পা দুটো তুলে ভাল করে বসো।

তুষার হাসল। জল দে এক গ্লাস।

জল দিচ্ছি। তার আগে তুমি বরং হাত মুখটা ধুয়ে এসো।

আমি কিন্তু এক্ষুণি চলে যাব। তোর কাছে এলাম রত্না, শুধু একটা কথা জানতে এলাম--। এক গ্লাশ জল দে--চলে যাব।

যাই বললে কি যাওয়া হয় দাদাবাবু? জল নিয়ে এল রত্না।

ঘটি নিতে গিয়ে আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে গেল। চমকে উঠল তুষার। রত্না কি বুঝতে পেরেছে সে হঠাৎ আসেনি। এ ভাবে কোনও খোঁজ না নিয়ে, না জেনে আসা যায় না। সব কিছু জেনে বুঝে আসার জন্যই সে এসেছে। তুষার স্বাভাবিক, ভীষণ স্বাভাবিক হয়ে বিছানায় এলিয়ে বসতে চায়। বিছানার চাদরটা খাবলা মেরে কুঁচকে থাকে। রত্নার দেশ-গ্রাম জানত তুষার। এই লক্ষ্মীকান্তপুর লাইনেই। বহডু। রত্নার মা মারা গেছে। তবু গ্রাম প্রতিবেশীর কাছ থেকে খোঁজ পেয়ে গেল ওর শ্বশুরবাড়ির। রত্না কি সব জানে! ও কি জানতে পেরেছে, ওর গ্রামে গিয়ে খোঁজ করেছে তুষার, ওর স্বামীর নাম গ্রাম সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনেছে। রত্নার কাছে কি এ খবর গ্রামের কেউ বয়ে আনেনি? তবে কি ও জানত তুষার আসবে? কেন আসবে তাও কি জানে? যা, তা কি করে জানবে? তুষার হাত বাড়িয়ে বিছানার চাদর সমান করে, টানটান হয়ে বসে।

বাচ্চাটা দৌঁড়ে এসে রত্নাকে জড়িয়ে ধরে। রত্না হাসে, আমার ছেলে।

তুষারের বুকের খাঁচা খালি- - পাখি নেই। এত বড় হয়েছে।

ন বছর বয়স হল। রত্না ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। বল তো এটা কে? কে হয় জানিস?

ছেলেটা ঘাড় নাড়ে। ফ্যালফেলে চোখ। রত্না হঠাৎ কথা থামায়। যেন কে হয়, কে হতে পারে এসব ভাবতেই তার সব তালগোল পাকিয়ে গেল। প্রসঙ্গ পালটায়। বলে, তোর বাপ কোথা গেল রে, দেখ তো। বল, ঘরে লোক এসেছে।

ছেলেটা ঘর বারান্দা বাগান ভেঙে দৌঁড়ে যায়। লোক। তুষার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বলুক, যা খুশি বলুক। শুধু একবার রত্নাকে সে জিগ্যেস করবে। শুধু একবার জানা কথাটা আরও একবার জেনে সে ফিরে যাবে।

সে যে অক্ষম পুরুষদের দলে নয় - এ কথা সে বিশ্বাস করে। কিন্তু অনুরাধা বিশ্বাস করে না। ভাবে, ওই রিপোর্ট ঠিক, ডাক্তার ঠিক, তুষার ভুল।

অনুরাধা চোয়াল চেপে, মাথানিচু করে বেরিয়ে গেল ডাক্তারের চেম্বার থেকে। তুষারের মনে হল, আজ যেন অনুরাধা তার জন্যে মাথা নিচু করে আছে। কিন্তু সেদিন, যে দিন অনুরাধার রিপোর্ট বেরিয়েছিল, তখন জেতার ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে চেম্বার ছেড়েছিল অনুরাধা। আর আজ যেন তুষারের ভূমিকায়।

ডাক্তারের মুখোমুখি তুষার। ভেতর ভেতর ফিস ফিস করে দু' চারবার ডাক্তারকে ডাকল। কিন্তু ডাক্তার শুনতে পেল না। শুনতে পেলে তুষার অন্য কথা বলত। যে কথা অনুরাধাকে বলতে পারেনি -- সেই কথা। এ রিপোর্ট যে ঠিক নয় তুষার প্রমাণ করে দিত। বলতে পারল না। আসলে তুষার নিজেকে ভাঙতে পারল না।

তাই আজ তার এত দূর ছুটে আসা। একবার রত্নার মুখোমুখি দাঁড়ানো। একবার বলুক রত্না, দোষ দিক, ঘেন্নায় জ্বালায় তাকে ছিঁড়েখুড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিক।

আর এই অপরাধবোধেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে তুষার। এই অপরাধেই তার ভেতরের জ্বালা মিটবে। কিন্তু অনুরাধাকে বলতে পারবে না,ডাক্তারকে বলতে পারবে না তবু। শুধু সামনে ভেসে থাকা ডাক্তারের গম্ভীর মুখটা ভেঙে তছনচ করে, রিপোর্টের গা গাঁতরের অসংখ্য ফাটা চোরা দিয়ে রোদ এসে পড়বে সেই ছোট্ট চৌ-খুপি ঘরে। যেখানে টেস্টটিউব হাতে সে আর একবার দাঁড়াবে। পৃথিবীর বুকের অন্ধি-সন্ধি পেট নাভি থেকে নেমে মন গুঁজে শরীর মুচড়ে বলবে, আয় আয়, এ কাচের পাত্র ভরে যাক প্রাণ-সুধা।

রত্না বিছানায় চা রাখে। মুড়ির থালা সামনে ধরে। দাদাবাবু এই ক’টা খেয়ে নাও।

তুষার বলে, এত।

থালায় মুড়ি আলুভাজা, একপাশে একটা কঁচালঙ্কা। দেখতে দেখতে তুষার সব মুড়িই খেয়ে ফেলল। সেই কোন সকালে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে স্রেফ চা আর দুটো বিস্কুট। অনুরাধা বার দুই ‘কোথায় যাচ্ছো’ জিগ্যেস করার জন্যে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু নিরুত্তাপ তুষারকে দেখে জিগ্যেস করেনি। অবশ্য জিগ্যেস করলে, তুষার একটা উত্তর তৈরি করেই রেখেছিল।

রত্না থালা কাপ নিতে এসে থমকে দাঁড়াল। কাকিমা কেমন আছে দাদাবাবু?

মা। স্বগতোক্তির ঢঙে তুষার বিড়বিড় করে। মা নেই রে।

রত্না চমকে ওঠে, কাকিমা নেই। কবে গো - ?

সে অনেক দিন - বছর সাতেক হবে। নির্লিপ্ত তুষার। রান্না করতে গিয়ে আগুন লেগে গিয়েছিল।

আহা কি ভালমানুষ ছিল গো। আমাকে নিজের মেয়ের মতো দেখত। এই পাপ মুখে তার কথা বললেও পাপ হয়। সেই মানুষটা কি না শেষকালে আগুন-- ।

তারপর বাবা। মায়ের মৃত্যুর বছর ঘুরতে না ঘুরতে। বাবাও কম পুণ্যবান ছিল না; ঘুমের মধ্যে চলে গেল— কোনও রোগ ভোগ যন্ত্রণা না। মা এত কষ্ট পেল, অথচ বাবা টুপ করে- - । তুষার থামে।

দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় রত্না। ওর ছেলেটাও আচমকা ঘরে ঢুকে আরও দ্রুত চলে যায়। তুষার ভাবে, যা বাচ্চাটার তো নাম জানা হল না।

একা ঘরের ভেতর বসে থাকে তুষার। বেশ বোঝা যায় এই ঘরটা নতুন। এই একটিমাত্র ঘর ইট সিমেন্টে গাঁথা, দেওয়ালে পরিপাটি করে প্লাস্টার, চুনকামে এখনও ময়লা ধরেনি। মাথার ওপর চাঁছা বেড়ার সিলিং, চালে টিন। তবে মেঝে মাটির। অন্যসব ঘরগুলোও মাটির। লম্বা টানা বারান্দা এল হয়ে বেঁকে গেছে। তার প্রান্তে দুঘর, মাথায় খড়। ওটা কি রান্না ঘর হবে? তুষার বিছানায় শরীর একটু কোনাকুনি রেখে ওদিকে দেখার চেষ্টা করে।

একটানা ঘুঘু ডেকে চলে। জানা অজানা পাখির ডাক। তুষার কান খাড়া করে রত্নার পায়ের শব্দের প্রতীক্ষায়, কথাটা বলতে হবে এবার ওকে। রত্না কি বলবে তুষার জানে। হয়তো চুপ করে থাকবে। সেই চুপ করা ভাষা পড়ে সে চলে যাবে। তার তো আর কোনও প্রয়োজন নেই।

ছেলেটা আবার ঘরের ভেতর দিয়ে এসে দরজা ধরে দাঁড়ায়। চুপচাপ। তুষারকে এক দৃষ্টে দেখে। তুষার ডাকে, শোনো।

ছেলেটা হালকা ঘাড় নাড়ায়। না-হ্যার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে।

তুষার বলে, এদিকে এসো, কি নাম তোমার !

ছেলেটা দু-এক পা এগিয়ে আসে। অস্ফূটে কী যেন বলে। এর মধ্যেই হুড়মুড় করে এসে পড়ে রত্না। কি করছিলি তুই এখানে ? ধাই করে পিঠের চালে একটা চড় কষিয়ে দেয়। তুষার বারণ করতে যাবার আগেই রত্না ছেলেটাকো টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে চলে গেছে।

তুষার থম মেরে বসে থাকে। ছেলেটাকে ধারে কাছে দেখছে না কোথাও। বাগানের দিকে তাকল। রোদের তেজে গাছগুলো ম্লান হয়ে আছে। তাকে দেখে, আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল রত্না। কি হল দাদাবাবু, বিছানায় বরং একটু গড়িয়ে নাও।

এতক্ষণ তো গড়ালাম, ঘাড় পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে। ছেলেটাকে ওভাবে মারলি কেন তুই? ওকে যে আমিই ডেকেছিলাম। বেচারা সবে কথা বলতে এল।

তুমি জানো না দাদাবাবু, ও খুব শয়তান! একটু সুযোগ পেলে তোমাকে বিরক্তের এক শেষ করে দেবে।

না না, তবু মারবি না।

খুব যে বাপ হয়েছ দেখছি। কটা ছেলে মেয়ে তোমার? তাদের বুঝি শাসন করো না?

লম্বা টানা বারান্দায় সার সার খুঁটি। খুঁটির সারিতে তুষারও খুঁটি হয়ে থাকে। শুধু কাঠ। প্রাণের অতল আহ্বান নেই কোনো। তবু মাথায় ভার বহন, পায়ের নীচে শক্ত, আরও শক্তি মাটির তল্লাশ।

অসম্ভব - হতেই পারে না। তুষার ফাঁপা গলায় চিৎকার করে ওঠে।

অনুরাধা চোয়াল চেপে নীরবে এঘর ওঘর করছিল। যেন সবই ও জানে, সবই জানত, শোনার কোনও তাগিদ নেই তার।

তুষার টেবিল থেকে রিপোর্টটা তুলে আর এক পলক চোখ বোলায়। এটাকে কি করে মানবো, একটা ভুল রিপোর্ট। ক্ষিপ্ত হাতে দলা মোচড়া পাকায়, ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝোয়।

এবার অনুরাধা থামল। স্থির চোখ। ছেলেমানুষী করছ কেন?

আমি সিওর ওটা ভুল রিপোর্ট। এই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট আমি মানি না।

ওখানের ঠিকানা তো ডাক্তারবাবুই লিখে দিলেন, তবে?

ও সব কমিশন খাওয়ার লোভ। নাহলে কলকাতায় কি ভাল জায়গার অভাব। একটা নতুন জায়গায় পাঠিয়ে দিল। ওদের প্রথমেই আমার বিশ্বাস হয়নি। ডাক্তারবাবুকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললাম, কিন্তু উনি তো ওই জায়গার কথা ধরে বসে থাকল। ওদের রিপোর্ট কখনই পারফেক্ট হতে পারে না।

ওদের রিপোর্ট পারফেক্ট নয়! ওদের সব রিপোর্টই ভুল বলছি? থরথর অনুরাধার গলা কঁপে। আমার রিপোর্টটাও তাহলে ভুল।

নানা, তোমার রিপোর্ট ভুল হবে কেন? তোমার তো পজেটিভ, তোমার তো সবকিছুই ঠিক আছে।

আসলে তুমি,তোমার বাড়ির লোকজন--সবাই ভেবেছিল দোষটা আমারই। এখন দেখছি আমার সব ঠিক আছে, দোষটা তোমারই--এটা আর তুমি মানতে পারছনা। ডাক্তারবাবুতো বললেন, তোমার স্পার্মই তৈরি হয় না। তবে তোমার স্বাভাবিক হবে কি করে?

অনুরাধা মাথা উঁচু করে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিন ঠিক এরকম, উঁচু আর কঠিন হয়ে, নিজের রিপোর্টের ফাইলটা বুকে আঁকড়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়েছিল।

তুষার ঘরের ভেতর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা অনুরাধার দিকে তাকাতে পারল না। এত উঁচু যেন চোখ তুলতে গেলে ঘাড় টনটন করে, এত কঠিন ছোঁয়া যায় না। তুষার বিড়বিড় করল, বিশ্বাস করো আর পাঁচজনের যেমন, আমারও তেমন। কোথাও কোনও ভুল.. আমি আবার টেস্ট করাব। অন্য জায়গায়, ভাল কোথাও ।

সে তো ডাক্তারবাবুও বললেন, এক মাস বাদ দিয়ে আরও দুটো টেস্ট করিয়ে কনফার্মড হতে। কিন্তু আমার মনে হয়, আবার করানো মানে ফালতু কিছু টাকা খরচ। তোমার যদি ঠিকই থাকে তবে আমাদের সন্তান হচ্ছে না কেন?

তুষার ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রত্না রান্নাঘরে। তুষার একবার কি দাঁড়াবে ওর সামনে। বলবে, সে কেন এসেছে। সে তো এমনও ভেবেছিল, রত্না তাকে না চেনার ভান করে ঢুকে যাবে ঘরের ভেতরে। কিংবা দেখামাত্র চিৎকার করে উঠবে ভূত দেখার মতো, ওর স্বামী এসে হয়তো গলা ধাক্কাও দেবে। আর সে যে প্রশ্নের উত্তর আরও একবার জানতে গেছে, তা জানতে চাওয়ার আগেই জেনে যাবে। এক বুক টাটকা স্বস্তির হাওয়া নিয়ে ফিবে আসবে বাড়িতে। অনুরাধার মুখোমুখি দাঁড়াবে। কিন্তু বলতে পারবে না। চুপ করেও থাকবে না। সমস্ত উৎসে যেন সে গর্জন শুনবে। একা।

তুষার পায়ে পায়ে, রান্নাঘরের দরজার তিন কাঠের ভেতরে এসে দাঁড়াল। রত্নার মুখে হাসির আভা। একা এক ভাল লাগছে না বুঝি? একটু তো ঘুমিয়ে নিতে পারতে --

আমি পাপ করেছি রত্না - -।

রত্না গরম কড়া শুধু হাতে ঝপ করে নামিয়ে ফেলে।

আমি এই পাপের অভিশাপে — তুই আনায় ক্ষমা করে দে।

রত্না উনুনে কাঠ গোঁজে। এই কাঠাকুটো জ্বালিয়ে রান্না, বড্ড ধোঁয়া!! দাদাবাবু তুমি ঘরে যাও।

আমার পাপে আজ অনুরাধা কষ্ট পাচ্ছে।

রত্না হাসে। বউদি কেমন হল দাদাবাবু? বউদিকে তো নিয়েই আসতে পারতে।

সেদিন বাবা না থাকলে আমি জেল খাটতাম। আমার সে শাস্তি ভোগ করাই উচিত ছিল।

একটু ডাল পাতা গুঁজে দিতে আগুন ঝলসে ওঠে। লাল আগুনের আভা। তেতে পুড়ে উঠেছে রত্নার মুখ। গনগনে। কঠিন মুখ। দাদাবাবু ঘরে যাও।

বাবার জন্যে সেদিন আমি বেঁচে গেছি — রত্না তুই আমায় আজ শাস্তি দে।

মুহূর্তে রত্না উনুন থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ টেনে বের করে। ঝলক আগুন নিয়ে কাঠটা ছোবল তুলে ফুঁসে ওঠে। টুকরো টুকরো আগুন ছাই হয়ে খসে পড়ে। তুমি যাবে? তুমি আর একটা কথা বললে পুড়ে মরব আমি।



। দুই ।
ওয়ান মিলিলিটার সিমেনে টোয়েন্টি মিলিয়ন স্পার্ম থাকা জরুরী। এই স্পার্মের ফোর্টি পার্সেন্ট চার ঘণ্টার পরও বেঁচে থাকতে হবে। এবং স্পার্মের সিক্সটি পার্সেন্ট হবে নরমাল ফর্ম। এগুলো থাকলেই আমরা স্বাভাবিক ধরে নি। তার স্পার্ম কাউন্ট যদি কম হয়। অথবা সামনের দিকে এগোবার ক্ষমতা না থাকে, যেটা ভীষণ জরুরী। এছাড়া স্পার্ম এক বিশেষ ধরনের সেল। এই সেলের প্রাচীরের গঠন সম্পূর্ণ না হলেই আমরা ধরে নি অ্যাবনরমাল কেস। শেষমেশ আছে শুক্রনালীতে কোনও বাধা বা ব্লকেজ। কিন্তু তুষারবাবু আপনার এসব কিছুই না। আপনার কেসটা আরও ডিফিকাল্ট। আপনার শুক্রাশয়ে শুক্রাণু তৈরিই হয় না। আপনাদের মতো দম্পতির সংখ্যা শতকরা পনেরো জন।

ডাক্তারের মুখ ক্রমাগত ভেঙে আবার স্পষ্ট হচ্ছিল। বসে বসে তন্দ্রা মতো এসেছিল তুষারের। রত্না ছাড়ল না কিছুতেই। যা হোক চাডিড খেয়ে যাও। খিড়কি পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে এলো তুষার। খেতে বসার জন্যে জোরাজুরি করল রত্না, তুষার রাজি হল না। বলল, নরেশবাবু ফিরুক একসঙ্গে বসব। সবে তো একটা।

তখনও রত্নার স্বামী ফেরেনি। রত্না ঘর-বার করছিল। বাইরের দিকে চোখ রেখে বলল, ওর ফেরার কি ঠিক আছে। আমি বুদ্ধকে দিয়ে বটতলায় খবর পাঠিয়েছি - এই এসে পড়ল বলে। তুমি বরং বসো, খেতে খেতে ও এসে পড়বে -- ।

না রে একা খাব না -- তবে তোর ছেলেকেও দে। দুজনে একসঙ্গে খাই।

হঠাৎ রত্না সিঁটিয়ে যায়। না না,তুমি বসো দাদাবাবু।ও বড় শয়তান। ওকে বারান্দায় দিচ্ছি।

ছেলেটা দরজার আড়াল থেকে তুষারকে দেখছিল। রত্না যেন কিছুটা সরে ওকে আড়াল করল। তবু তুষার হাত ইশারা করে ওকে ডাকে। ছেলেটা এল না। বরং ভোঁ করে দৌঁড়ে চলে গেল।

তুষার হাসল। বল রত্না, ও যেভাবে দৌঁড়াল যদি আমার জায়গায় বাবা থাকত তবে নির্ঘাত ওকে তাড়া করত এখন, তারপর ধরতে পারলে এই উঁচুতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে লোফালুফি করত। তুষার হাসে। নিজের মেনেই হেসে চলে। রত্না হাসে না, বরং একটু যেন গম্ভীর। ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটে।

নরেশ ফেরে। পক্‌ পক্‌ দুবার হর্ন দিয়ে ভ্যানরিকাশা নিয়ে সোজা চলে আসে বারান্দার কাছে। মানুষটার চোখে মুখে একটা খুঁজে যাওয়া ভাব, প্রশ্ন। কোন কুটুম এলো? বারান্দায় উঠতে না উঠতে রত্না ডাকে, কে এসেছে দেখবে এসো। রত্না রান্নাঘরের দরজা ভেজিয়ে বারান্দার দিকে উঠে আসে।

ছেলেটা এক দৌঁড়ে কাছে চলে যায়, হাতটা আঁকড়ে ধরে। নরেশ রত্নার পাশে দরজায় এসে দাঁড়ায়। অবাক চোখমুখ। রত্না বলে, এই হল তুতু দাদাবাবু। নরেশের বিস্ময় কাটে না। রত্না বলে, সেই গো--ভাবানীপুরের বাড়ি। কলকাতায়।

এবার হাত জোড় করে নমস্কারে নরেশের মাথা ঝুঁকে আসে। নরেশ ফিসফিস করে কিছু বলে রত্নাকে। রত্না ঘাড় নেড়ে রান্না ঘরের দিকে যায়। নরেশ বলে,আমি দুটো ডুব দিয়ে আসি বাবু।

এই তেতে পুড়ে এলেন -- একটু বিশ্রাম নিয়ে চান করুন।

নরেশ হাসে। ছেলেকে গায়ের সঙ্গে চেপে ধরে বারান্দায় পাতা বেঞ্চে বসে।

তুষার বলে, তারপর একসঙ্গে খেতে বসা যাবে। রত্না তো আর একটু হলেই আমাকে জোর করে একা খেতে বসিয়ে দিচ্ছিল আর কি!

ঝটকা মেরে উঠে পড়ে নরেশ, আমার জন্য আপনি বসে আছেন! ছিঃ ছিঃ ! আমি এই দুটো ডুব মেরে এলাম বলে।

রান্নাঘর থেকে রত্না বলে ওঠে, না না দাদাবাবুকে আমি দিয়ে দিচ্ছি। সব আমার বাড়া। তোমার তাড়ার কিছু নেই,তুমি ধীরে সুস্থে এসো।

বিব্রত তুষার। ইস্‌ আর একটু পরে বসলে হত না। নরেশবাবু আসুক, একসঙ্গে বসছি।

না না তুমি বসে। ওর অনেক দেরি। রত্ন আসন পেতে, জল দিয়ে থালা এগিয়ে দেয়। রত্না যেন তার কোনও কথাই শুনবে না। তুষারকে একা খেতে বসতে হয়। খেয়ে উঠে, মূখ ধুতে বাইরে এসে দেখল, বারান্দায় নরেশ আর বুদ্ধ বসে খাচ্ছে। তুষারের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন ভারী হয়ে যায়। রত্না কি তার স্বামী সন্তান থেকে তাকে আলাদা ভাবে রাখতে চাইছে। আড়াল রাখতে চাইছে তার সব কিছু। নাকি লজ্জা পাচ্ছে, অথবা ভয় ?

তুষার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট এগিয়ে দেয় নরেশকে। নরেশ দু'হাত বাড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে সিগারেট নেয়। তুষার নিজের সিগারেট ধরিয়ে আগুনটা নরেশের দিকে এগিয়ে দেয়। নরেশ ইতস্তত করে। আগুন নিভে যায়। এবার দেশলাই দেয়। নরেশের ঠিক পিছনে সেঁটে আছে বুদ্ধ। মাঝে মাঝে আড়াল থেকে চোখ বের কবে অবাক হয়ে তুষারকে দেখছে। তড়িঘড়ি রত্না উঠে আসে বারান্দায়। দাদাবাবু একটু ঘুমিয়ে নাও ঘরে গিয়ে। তারপর নরেশের দিকে তাকায়, রান্নাঘরের দাবায় মাদুর পেতে দিয়েছি, যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো।

তুষার বলল, আমরা গল্প করতে বসলাম,আর তুই শুয়ে পড়ার ব্যবস্থা করে ফেললি। আমরা শোবো না। তুইও বরং বস,গল্প করি।

রত্না ঠোঁট ওলটায়,দেশ ঘরে কি আর গল্প আছে যে করবে?

নরেশবাবুকে আমি আমার মা বাবার কথা বলছিলাম। আর তাদের দেখা পাবেন না। নিশ্চয় গল্প শুনেছেন। আমার মা মেয়ের মতো ভালবাসত রত্নাকে। শুধু মা কেন ? বাবাও। তো রত্না বলতে পাগল। সব কিছুতেই রত্না আর রত্না।

কি হল বসে রইলে যে তুমি। তুমি না শুলে বুদ্ধ ঘুমাবে? যাও,গিয়ে বৃন্ধুকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। নইলে একটু পরেই চরতে বেরুবে।

শূন্য মুখে বুদ্ধকে বুকে চেপে উঠে পড়ে নরেশ। আপনিও বাবু বরঞ্চ একটু গড়িয়ে নিন।

নরেশ যায়। রত্না খিড়কি পুকুরের দিকে যায়। সিগাবেটে লম্বা শেষ টান দিয়ে উঠে পড়ে তুষার। ঘরে ঢুকে বিছানায় শরীর ফেলে দেয়। বুকের ভেতর দাউ দাউ জ্বলছে। সেই সাতসকাল থেকেই আকাশ গাছপালা এ বাড়ি ঘর বিছানা শরীরের অন্ধি সন্ধি পুড়ছে যেন।

এই দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে উঠে আসত রত্না। প্রথমে কিছুটা আপত্তি ছিল যেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় এসে দাঁড়াত এই নির্জনে। দরজায় পিঠ দিয়ে, সিঁড়ির শেষ ধাপে। তুষার টানত, রত্না কাঠপুতুল।

তারপর হঠাৎ একদিন কেঁদে কেটে বাড়ি চলে গেল রত্না। ফিরল তারও বেশ কিছুদিন পরে, সঙ্গে মা। এসে দাঁড়াল তুষারের মায়ের মুখোমুখি। রত্না কাঁদল। রত্নার মা কাঁদল।

ওদের কান্না আর টুকরো টুকরো কথায় প্রথমে হতভম্ব মা। তারপর ক্রমশ গভীর হতে হতে তীব্র রাগে ফেটে পড়ল। এত আস্পর্ধা হল কি করে -- দূর করে দেব। পড়ে মরুক রাস্তায় ।

রত্নার মা বলল, আপনি না দেখলে কে দেখবে ওকে? আপনিই ওর মা বাপ। ও ছোটটি থেকে এখানেই আছে।

মা বলল,এই পাপ আমি রাখব না কিছুতেই।

ফুঁসে উঠল রত্নার মা,এই পাপ কে ঢোকাল পেটে?

যেখানে করেছে সেখানে যাক। নাহলে আমি জুতো মেরে তাড়াব।

বাবা ঠেকাল। এতে হিতে বিপরীত হবে। বাইরে জানাজানি হলে,ছিঃ ছিঃ,একটা গরিব মানুষের জীবন। তাছাড়া থানা পুলিস,সর্বনাশ হয়ে যাবে।

রত্নার মা বলল,ও তো বছর ঘুরতে গেল বাড়িমুখো হয়নি।

মা বলল,কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো বাইরের কেউ আসেনি।

বাইরের লোক কেন,আপনাদের বাড়িতে তো দু দুটো ব্যাটাছেলে।

মা তখনও ভাবেনি,এ বাড়িতে দু দুটো পুরুষ। মা ভাবল,অনেক কিছু,সাত পাঁচ। তারপর তীব্র আক্রোশে চেপে ধরল বাবার কলার। তুমি কেন এমন সর্বনাশ করলে। তোমার মেয়ের বয়সী,ছিঃ ছিঃ। আমার অনেকদিন আগেই বোঝা উচিত ছিল তোমার মতিগতি ভাল না। তুমি যেন বড় বেশি বেশি করছিলে।

বাবা স্থির। ঠাণ্ডা। তুমিই তো ভুল করেছ। ছেলে তোমার ছোট নয়। সে নয় চিলেকোঠায় পড়াশোনা করে, সেখানে কি হাটহাট একটা মেয়েকে তোমার পাঠানো উচিত হয়েছে? ভুল তো ওরা করবেই। বয়সের ধর্ম।

মা স্তম্ভিত। মুখে হাত চাপা দিয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ঘরের আলো নিভিয়ে তুষার চুপচাপ বসে থাকে। কেউ কিছু বলল না তাকে। তবু সে তো ধরা পড়ে গেল সবার কাছে।

বাবাই সব ব্যবস্থা করল। নার্সিং হোম ঘুরিয়ে ট্রেনে তুলে দিল। ওর মা রত্নার বিয়ের জন্য পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছিল। বাবা সব কিছু আগের মতো করার জন্য অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু দিন দিন মা যেন কেমন হয়ে গেল। তুষারের মুখ দেখত না। কথা বলত না। শুধু তুষার নয়। বাবার সঙ্গেও। চুপচাপ। একদিন রান্না করতে গিয়ে কাপড়ে আগুন ধরিয়ে ফেলল। কেউ ছিল না বাড়িতে। মা একা একাই পুড়ে গেল।

তুষার ভাবে,মা কি এমনি এমনি মরে গেল। সত্যিই কি রান্নার আগুন! সত্যিই কি সে আগুন ছুঁয়েছিল মায়ের শাড়ি। নাকি মা ছুঁয়েছিল আগুন। মা কি কোনও চিৎকার করেনি। কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুড়ে গেল। রান্নাঘরের বালতিতে জল। মা জল ছুঁল না। তাই আরও যত দিন যায় এ সংসারের ভেতরে যেন আগুনের ছারখার। তাত।

তুষার ডাক্তারবাবুকে হস্তমৈথুনের কথা বলেছিল। আগে খুব, বেশি বেশি তাতেই কি?




।তিন।

এবার বিখ্যাত কোনও ডায়গানিস্টক সেন্টার। কাচের কাউন্টারের ওপারে মহিলা কিংবা পুরুষ। চোখের সামনে গুম মারা প্রেসক্রিপশন। তাদের চোখে ঝিলিক। ঠোঁটের কোণ বেঁকে সূতোর মতো। কাচের এপারে কুঁকড়ে তুষার। মানুষগুলো ঝলক মেরে মেরে তুষারকে দেখছিল। তুষারের চোখে যেন ছবি উলটে পালটে যাচ্ছে,ক্লান্তির ছাপ। যেন একটু সুখের খোঁজে,যেন জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে করতে ওরা ক্লান্ত। কত কনডোম,কত পিল,কতদিন গুনে সারা মাসের হিসাব রাখা,কত কায়দাকানুন।

আর এসব ঝক্কি বিয়ের প্রথম বছর তিন সাড়ে তিন তুষারও সামলেছিল। অনুরাধারা বউদি বলেছিল, একটু আনন্দ ফুর্তি করে নিন। সাত তাড়াতাড়ি চ্যাঁ ভ্যাঁ এসে গেলে সব শেষ।

অফিসে বিপুল বিব্রত গলায় বলেছিল,বুঝলি এ হল আমাদের রেকারিং প্রবলেম। কেন যে ফুলের সঙ্গে এমন কাঁটা দিল বুঝি না।

সেই কাঁটার খোঁজে তুষার এসে আবার দাঁড়াবে। ডাক্তার বলবে,আপনি কবে দিতে চান সিমেন। এটাই কি ফাস্ট?

কি বলবে তুষার। চোখ কান বুজিয়ে বলে দেবে,এটাই প্রথম। ডাক্তার বলবে,সিমেন দেওয়ার আগের তিন চার দিন ইন্টারকোর্স করবেন না।

রাতে অনুরাধার দিকে একটু সরে শুতে গেলে,অনুরাধা বলবে,এমনি করো না। একটু স্থির হও --কবে যেন যাবে তুমি?

তারপর আবার টিউব হাতে ছোট্টঘরে। একা। শরীরের কাছে তীব্র আকুতি নতজানু। মাথা ঘোরা। শরীর ছুঁয়ে মহার্ঘ্য ফোঁটা ফোঁটা। আবার টিউব হাতে ডাক্তারের সামনে। তুষার জানে,যে যাই বলুক,এই টিউবের ভেতর প্রাণের তুড়িলাফ। এবার ডাক্তার জানবে,অনুরাধা জানবে। একদিন তুষার জানত। তার বাবা-মা জানত,রত্না - রত্নার মা জানত। এবার অনুরাধা জানবে,এই জানাটুকুই আজ তুষারের কাছে বড় প্রয়োজন। ব্যস। আর কিছু চায় না সে। সন্তানও না। সে শুধু প্রমাণ দিতে চায়,ওই রিপোর্ট ভুল। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। সে পুরুষ!

এর মধ্যে রত্না এসে দাঁড়ায় ঘরে। চাপা গলার স্বর, দাদাবাবু তুমি ঘুমালে?

চোখ খুলে তুষার উঠে বসে,তুই তো গল্প করতে দিলি না। ঘুমাতেই বললি।

রত্না হাসে। তবে তুমি ঘুমিয়ে পড়। আমি তো তোমার সঙ্গে গল্প করতেই এলাম।

বস তাহলে। এখানে এসে বস। তুষার পিছন দিকে একটু সরে গিয়ে বিছানা দেখায়। রত্না বিছানায় বসে না, দেওয়াল ঘেঁষা নিচু বেঞ্চে বসে। বলো কি গল্প করবে?

তুষার যেন আটকে যায়। একটা একটা পেরেক তার শরীরে পোতা। কি গল্প করবে সে। সেই চিলেকোঠা, সেই রত্না,সেই বাবা মা,আর এই অভিশাপের গল্প!

রত্না বলে,কি হল চুপ করে রইলে যে,তোমার সঙ্গে গল্প করতে এলাম।

বাইরের রোদে এখনও আগুনের আঁচড়। জ্বালা পোড়া। এই ঘরের ভেতর বিছানার ওপর বসে বসে তুষার যেন ক্রমশ ন্যাড়া প্রান্তরে এসে পড়ে। সেখানে ঘাস পোড়া হলুদ পাতা ঝরা আর ধুলোর ঝড়। দুচোখ অন্ধ,তুষার যেন ধুলোর আড়ালে ঢেকে যাবে। বাঁচার জন্য দু’ হাত আকাশে তুলে ছটফট করে দেখে,আগুন-তাতে হাত দুটো শুখনো শীর্ণ হয়ে শরীরের সঙ্গে লটপট করছে।

তুষার বলে,বাচ্চাদের অত মারবি না। তোর ছেলে তো খুব ভাল,শান্ত শিষ্ট। তুষার যেন নিজেকে মেরামত করে, ভীষণ সতর্ক হয়ে অন্য গল্পে ঢুকে পড়তে চায়।

ছোট থেকেই একটু শাসনে রাখতে হয় দাদাবাবু। একটু ভয় পাইয়ে রাখতে হয়। ওর স্বভাব চরিত্রটা তো আমাদেরই তৈরি করে দিতে হবে।

তাই বলে মেরে? মার খেতে খেতে ভয় তো ভেঙে যাবে - ।

তুমি তো কোনওদিন মার খাওনি দাদাবাবু। কেউ কোনওদিন তোমায় শাসনও করেনি। তাই জন্যে কি তুমি এত বেপরোয়া ছিলে,ভালমন্দ কিছুই বুঝতে না।

তুষার চুপ করে থাকে। না,এবার কথাটা তুলতেই হবে। অন্তত প্রশ্নটা জুড়ে চুপচাপ রত্নার মুখের ঘনিষ্ঠ রেখার বদলে যাওয়া দেখতে হবে। বিছানার ওপর আধশোয়া তুষার ভেতর ভেতর বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যেন এখন মার খেতে খেতেই এই বেপরোয়াভাব।

বাইরে বেলা পুড়ে যাচ্ছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে।

রত্না বলে, কাকিমা কি এমনি এমনি পুড়ে গেল দাদাবাবু? নাকি আগুনটা কেউ ধরিয়ে দিয়েছিল গায়ে?

আঁতকে ওঠে তুষার। কি বলছিস কি তুই। আগুন! মায়ের গায়ে কে আগুন ধরাবে?

কেন ? যে কেউ আগুন দিতে পারে। তুমি দিতে পারো,তোমার বাবা দিতে পারে। বাড়িতে পুরুষ বলতে তো তোমরা দুজনেই। একটা মেয়েমানুষের গায়ে আগুন আর কে দিতে যাবে?

কি বলছিস-- আমরা মাকে? ছিঃ ছিঃ ! তুই কি প্রতিশোধ নিতে চাইছিস? আমার কথা বলছিস বল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবাকেও ৷

প্রতিশোধ! ফুঁসে ওঠে রত্না। কার ওপর প্রতিশোধ নেব আমি ? তোমার ওপর! কি করেছ তুমি আমার ?

তুষার বিছানার ওপর শরীর ঠেলে ওঠে। আমি অন্যান্য করেছি রত্না। সেই অভিশাপেই আজ আমি দগ্ধে মরছি। সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে হাসছে। নিজের স্ত্রীর কাছেও আমি ছোট হয়ে গেছি। আমি পুরুষ না। আমি মানুষ না। কিন্তু তুই তো জানিস। আমায় ক্ষমা করে দে।

রত্না থমকে যায়। সরীসৃপের মতো বুকে ভর করে ঠেলে ওঠা তুষারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ফিসফিস বাতাস-লাগা গলায় বলে,তুমি কি এত দূরে শুধু ক্ষমা চাইতে ছুটে এলে দাদাবাবু? নাকি অন্য কিছু -- তুমি, না,তোমার বাপ -- কে কত দরের ব্যাটাছেলে সেটাই জানতে এলে?

তুষার মেরুদণ্ডের ভরে ঝটকা মেরে ফণা তুলতে চয়, কিন্তু তার আগেই রত্না দু-এক পা এগিয়ে বিছানা ঘেঁষে দাঁড়ায়। তুষার শরীর গুটিয়ে বলে, মৃত বাবা আমার! তাকে আনছিস কেন? আমি পাপ করেছি। — তুই আমার কথা বল।

কাঁধ থেকে আঁচল খসে যায়,রত্না ঠিকরে ওঠে,কেন? ব্যাটাছেলে তো তোমরা দুজন,আর আমি মেয়েমানুষ, তা আমি কি করে তোমাদের আলাদা করি!

তুষারের ভেতর হিম কালো রক্তের স্রোত। সেই স্রোতে কিলবিল করে উঠে বলে, তুই আমায় যত পারিস অভিশাপ দে- - শুধু বল তোর সেই সর্বনাশ আমিই করেছি।

রত্না ধীর স্থির,কঠোর মুখ। তা আমি কি করে বুঝব --অত বোঝার ক্ষমতা কি আমার ছিল – কে আগুন দিল, আর কে বাতাস করল।

রত্না যেন মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। আঁচলটা পিঠ ঘুরিয়ে ডান দিকে টেনে নিয়ে বলে, আজ তোমাকে দেখে বড় ঘেন্না হল।

আঁচলে মুখ মুছে রত্না বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, গলা তোলে, কই তুমি ঘুমালে? দাদাবাবু যে বেরবে এবার। ভ্যানটা বের করে পৌঁছে দিয়ে এসো।

বিছানায় বসে তুষার রত্নার গলা শোনে, বোঝে যাবার সময় হয়েছে।

নরেশ উঠে আসে গুটি গুটি পায়ে। ভ্যান রিকাশাটা বারান্দার কোণ থেকে টেনে, বাগান পেরিয়ে রাস্তায় নিয়ে দাঁড়ায়।

ধারে কাছে রত্না নেই। একা তুষার ঘরের ভেতর দাঁডিয়ে। ক্রমশ ঘরের দেওয়াল যেন সরে সরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সেই ছোট্ট ঘর হয়ে যায়। বাইরে স্বচ্ছ দিনের আলো কাচের টেস্ট টিউবের মতো ঝলসে ওঠে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ