সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত'র গল্প : পুরুষকার

রূপাঞ্জনা’কে প্রথম দেখি এক বর্ষার দুপুরে। ঠিক দুপুরও না, বেলা চারটে বাজে তখন । আর শ্রাবণের এই মাঝামাঝি দিনগুলোয় মেঘের পেছনে সূর্য ডোবার আগেই কেমন যেন ঘোর লাগা সন্ধ্যে নেমে আসে। ঘরের বাইরে বেরোলে একরকম কিন্তু বাড়িতে থাকলে এরকম দিনে মনখারাপ করা কোনো নস্টালজিয়া এসে চেপে ধরে। আমার মতো কাঠখোট্টা মানুষও কেমন মিইয়ে পড়ে। শুনেছি কবি-টবিদের কলমের ডগায় কবিতা এসে ভর করে এসব দিনে। এমনই এক কবিদের আড্ডায় আজ দায় পড়ে যেতে হচ্ছে।
সকালে দ্বৈপায়ন ফোন করে বলল ওদের সল্টলেকের বাড়িতে কবি-আড্ডায় যেতে, এড়িয়ে যাবার জন্য অনেক গাঁইগুই করেছিলাম কিন্তু ও নাছোড়। সপ্তাহে পাঁচদিন শুকনো মুখে থাকলেও শনি রবিতে সন্ধ্যে সাতটা থেকেই আমি গেলাস আর বোতল খুলে বসে পড়ি। ইদানিং কোলেস্টরেল বেড়েছে সাংঘাতিক, এসব জেনেই হয়ত দ্বৈপায়ন এত জোর করল। ওর অবশ্য আরো একটা বায়না ছিল। জামশেদপুর থেকে আগত এক মহিলা, নাম রূপাঞ্জনা, তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে দ্বৈপায়নের বাড়ি। কারণ আমার গড়িয়ার ফ্ল্যাটের কাছাকাছিই তিনি এসে উঠেছেন। ছুটির দিন বেরোলে আমি আর নিজে গাড়ি চালাই না, বাইরের ড্রাইভারই নিই। রূপাঞ্জনা’কে গাড়ির পেছনের সিটের দরজা খুলে দিই, আমার পাশে এসে বসেন। কোনো কারণ ছিল না, তবু গড়িয়া থেকে এতটা আসা পর্যন্ত এতক্ষণ, আমি ঠিক বিপরীত এক মহিলার চিত্র কল্পনা করেছিলাম। মনে মনে হাসলাম। রূপাঞ্জনা’র ঝাঁকড়া চুল কপালে পড়ে ভুরু অব্দি ঢেকে দিচ্ছিল। পোশাকটিও ছিল অদ্ভুত। ঢিলে পাজামা আর ওপরে গেঞ্জি জাতীয় কিছু। ওপরে একটা শার্টও পরেছিলেন কিন্তু শার্টের একটাও বোতামও লাগানো ছিল না। উঠেই আমায় জিগ্যেস করলেন,

‘আপনিও কি আবৃত্তি করেন দ্বৈপায়নের মতো?’

জবাবে ‘না’ বলায় বুঝলাম আমার প্রতি তাঁর আগ্রহ কম, অবশ্য থাকার কথাও নয়। আমার মাথায় কেন যে এসব উদ্ভট চিন্তা আসছে। অফিসের বাইরে কোনো মেয়ের সাথে আমার যোগাযোগ প্রায় নেই। বেশ কিছু বছর পর কোনো মহিলার সাথে এত কাছাকাছি বসে আছি। কিন্তু দুজনের কেউই আমরা পরস্পরের পছন্দের নই বলেই মনে হচ্ছে। তবু দ্বৈপায়নের অতিথির মান রেখে যাতায়াতে কিছু কথাবার্তা চালিয়ে গেলাম। খেয়াল করলাম দ্বৈপায়ন’কে নিয়ে রূপাঞ্জনা’র খুব কৌতূহল। আমাকে তাঁর সব প্রশ্নও দ্বৈপায়নকে নিয়েই। কিছু প্রেমের কবিতা, শ্রুতিনাটক দুজনে মঞ্চস্থ করবে নাকি জামশেদপুরে। সে সূত্রেই রূপাঞ্জনা’র কলকাতায় আসা।

‘দ্বৈপায়নের কণ্ঠ কী অদ্ভুত তাই না? আপনার বন্ধু কি তাঁর কন্ঠের মতো নিজেও রোম্যান্টিক?’

আমি অবশ্য এসব নাটক-কবিতা থেকে শত হস্তে দূরে থাকি, তবে দ্বৈপায়নের গলার আওয়াজ সত্যিই খুব ভালো এটা বুঝতে পারি। তবে একজন যুবতী মহিলা, পাশে বসে যাচ্ছে আর কেবলই অন্য একটি পুরুষের সম্পর্কে কথা বলছে, গুণগান গাইছে, এ আর কাঁহাতক সহ্য হয়। আমি প্রসঙ্গ পালটানোর চেষ্টা করি।

‘আচ্ছা, আপনার আমার এই গাড়িটায় কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? লেগ-স্পেস ইত্যাদি সব ঠিক আছে তো?’

রূপাঞ্জনা অবাক হয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে পুরো গাড়িটা আর নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করলো সামান্য।

‘না, আসলে এই গাড়িটা আমি ক-মাস হলো কিনেছি। আগে ছোট গাড়ি ছিল, কিন্তু এখন তো বড় গাড়ির যুগ, তাই না? বলুন আপনি। নিজেই ড্রাইভ করি, আজ আর ইচ্ছে করলো না। ক্লান্তি লাগে বুঝলেন। সারা সপ্তাহ যা যায়। আমার তো আর দ্বৈপায়নের মতো কেরানিগিরি নয়। কি আর বলবো, বড্ড খাটুনি’।

দেখলাম রূপাঞ্জনা কথার মাঝেই জানলার বাইরে চোখ রেখেছে। গাড়িও পৌঁছোল দ্বৈপায়নের আবাসনের সামনে। আমার বন্ধুদের মধ্যে সোমেন আর অভীক আগেই এসেছে। আমি ছাড়া এরা সকলেই কোনও না কোনোভাবে সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যুক্ত। রূপাঞ্জনা’র সাথে একে একে সবার আলাপ হচ্ছে। দ্বৈপায়নের সাথেও চাক্ষুষ আলাপ আজকেই ওর। এর আগে টেলিফোনে কথা হয়েছে। দ্বৈপায়নের সাথে কথার সময় দেখলাম রূপাঞ্জনা’র চোখেমুখে খানিক ব্রীড়ার আগমন যেন। অবাক হই দুটি কারণে। প্রথমত রূপাঞ্জনার ব্যক্তিত্বের সাথে ব্রীড়া একেবারেই বেমানান, দ্বিতীয়ত, এরা একসাথে নাটক-কবিতা করবে কেমন করে, এত যদি লজ্জা পায়। দ্বৈপায়নের স্ত্রীও বাড়ি নেই । আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে ওঠে এই যে আজকের জমায়েত, তার ভেতরে একটা খেলা চলবে। দ্বৈপায়নের আনা কফির কাপ হাতে নিয়ে আমি সেই খেলা দেখার জন্য প্রস্তুত হলাম।

রূপাঞ্জনা নিজে লিখে এনেছে বেশ কিছু রোম্যান্টিক এবং প্রেমের নাটক, দ্বৈপায়নের সাথে অভিনয় করবে বলে। খানিক পরেই বুঝলাম, আমি, সোমেন আর অভীক একেবারেই গৌন হয়ে গেছি। আমরা যে আছি তাও যেন ওরা ভুলে গেছে। দুজনেই অভিনয়ের লোক। অভিনয় করছে না সত্যিই প্রেমে মজেছে, বুঝলাম না। বুকটা চিনচিন করতে শুরু করে। আমি এতক্ষণ গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে এলাম, একটুও পাত্তা দিল না আমাকে, আর দ্বৈপায়নের সাথে কিরকম আন্তরিক ব্যবহার করছে! দ্বৈপায়নের সাথে ওর সামনাসামনি দেখা আজই প্রথম হলেও টেলিফোনে যোগাযোগ বেশ গাঢ় হয়েছে বলেই মনে হয়।

--অভীক, সোমেন তোদের মিউজিকের সাথে পরে রিহার্সাল করব, আগে আমি একবার রূপাঞ্জনার সাথে প্রাকটিস করে নিই।

অভীক আর সোমেনের সাথে আমি ব্যালকনিতে এসে সিগারেট ধরাই। ওদের দুজনের মুখেই ফিচলেমির হাসি। আমি পারলাম না হাসতে। মনে পড়ে গেল উচ্চ-মাধ্যমিকের আগে সেই কোচিং-ক্লাসের কথা। তুলিকা বলে খুব সুন্দর একটি মেয়ে ভর্তি হল ক্লাস শুরু হবার এক মাস পর থেকে। স্যার আমাকে বললেন ‘তুই তুলিকাকে একমাসের নোটগুলো দিবি আর দরকার মতো ওকে সাহায্য করবি’। আমার তো পোয়া বারো। নিজের পড়াশুনোর চেয়েও দ্বিগুণ উৎসাহে তুলিকা’কে নোট বোঝাতে লাগলাম। বন্ধুত্বও হচ্ছিল। ওই বয়সে সুন্দরী বান্ধবী পেলে স্বাভাবিকভাবেই পৌরুষ লাফ দিয়ে বেড়ে যায় অনেকখানি। পঁচিশ-ছাব্বিশ দিনের মাথায় সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে আমার পা মচকালো, আর সেজন্য কোচিং ক্লাশে আমি প্রায় চার-পাঁচদিন যেতেই পারলাম না। যেদিন আবার গেলাম সেদিন স্যারের পড়ানোর পর যখন তুলিকাকে যখন নোটস বোঝানোর কথা বলি, ও উত্তর দেয়,

--‘না, আমার সব নোট নেওয়া হয়ে গেছে দ্বৈপায়নের কাছ থেকে। আর তোমার সাহায্য লাগবে না’।
এরপর দেখলাম যে দ্বৈপায়ন আর তুলিকা ক্লাশের পর রোজ একসাথে ফেরে। আমি পড়াশুনোয় দ্বৈপায়নের চেয়ে অনেকটাই ভালো। আমি লম্বা, দেখতে ভালো । আর দ্বৈপায়ন রোগা, ছোটখাটো চেহারার, পড়াশুনোয়ও গড়পড়তা। হ্যাঁ, গলার আওয়াজ বেশ পাকা, গম্ভীর। কি যে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা হয়েছিল সেই আঠেরো বছর বয়সে। বড্ড পৌরুষে ঘা লেগেছিল। আজ দু’যুগ পর সেসব পুরনো কথা মনে পড়ে গেল।

--‘দ্বৈপায়নকে দেখছিস ? শালা, মেয়ে পটানোর মাস্টার। এখনও কেমন চালিয়ে যাচ্ছে!’

সোমেনের কথায় অভীকও সায় দেয়, ‘গুরুদেব লোক মাইরি দ্বৈপায়ন। অবশ্য এইসব কবি-আবৃত্তিকারদের প্রতি মহিলাদের খুব টান দেখেছি। যাক গে! মানব শোন, সোমেন আর আমি আরও এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনি, তুই বরং থাক এখানে। ওর বউ এলে ওকে খবর দিস, নয়ত ঢুকে পড়লে আবার আরেক কেলেঙ্কারি’।

স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে আজ আমরা সবাই যে যার মত সংসারে, কর্মক্ষেত্রের খাপে খাপে নিজেদের বসিয়ে নিয়েছি। পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ আছে, মাঝেমধ্যে দেখা হয়, এটুকুই। নীচে দেখলাম একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল, একজন মহিলা। হ্যাঁ, দ্বৈপায়নের বউই নেমে ট্যাক্সির ভাড়া মেটাচ্ছে। আমি দেয়ালের দিকে সেঁটে দাঁড়ালাম, যাতে আমায় খেয়াল না করে। না, আমি ভেতরের ঘরে গিয়ে দ্বৈপায়নকে বললাম না যে, ‘তোর বউ কিন্তু এসে গেছে’। অস্বস্তি হল? জানি না। আমি যেন প্রতীক্ষা করতে লাগলাম কিছু ঘটার।

-- কি ব্যাপার ? উনি কে? কি হচ্ছে এখানে?

দ্বৈপায়নের বউ, শ্রীলেখা’র অবাক হওয়া গলায় উষ্মার ছোঁয়া। দ্বৈপায়নও কিছু মিনমিন করে বলল যেন, ঠিক শুনতে পেলাম না। বাইরে থেকেই বুঝতে পারছি রূপাঞ্জনা, দ্বৈপায়ন আর দ্বৈপায়নের বউ, সকলেই খুব অপ্রস্তুতকর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন। 

--  তোমার বন্ধুরা কোথায়? মানবদা, অভীকদা, সোমেনদা ওরা? আমাকে তো বলেছিলে ওদের মিউজিকের সাথে রিহার্সাল।

আমার কেমন একটা তৃপ্তির স্বাদ যেন মাথার দিক থেকে গলা দিয়ে বুকের কাছে এসে নামছে। এটা কেন ? কত জল গড়িয়ে গেছে স্কুল-জীবনের পর আজ কিসের আমার আনন্দ? কিসের তৃপ্তি? নাকি রূপাঞ্জনা সারা রাস্তা আমাকে পুরুষ হিসেবে পাত্তাই দেয়নি বলে এখন দ্বৈপায়নের বউয়ের কাছে দ্বৈপায়নের এই হেনস্থায় আমার ভালো লাগছে? কিন্তু আমার তো এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। আমি তো বিয়েই করলাম না এখনও পর্যন্ত। বান্ধবিও নেই। এড়িয়ে যাই মেয়েদের তা ঠিক না, কিন্তু ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করি না বন্ধুত্বের জন্য। তাহলে কি আমি দ্বৈপায়নকে হিংসে করেছি এযাবৎ কাল? ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে ‘মানব এ হচ্ছে পৌরুষের প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতায় তুমি বারবার দ্বৈপায়নের কাছে হেরে যাও। সেই কৈশোর থেকে। একটি মেয়ে তোমায় পাশ কাটিয়ে আর এক পুরুষের কাছে ধরা দিচ্ছে তা তুমি সহ্য করতে না পারলেও, তুমি কিছুই করতে পারো না’।

সোমেন আর অভীক এখনও ফিরছে না। এদিকে ভেতরের ঘরে গণ্ডগোল বাড়ছে বুঝতে পারছি। বক্তা যদিও শুধু দ্বৈপায়নের বউ। ওরা স্বামী-স্ত্রী না হয় পরে মিটিয়ে নেবে কিন্তু রূপাঞ্জনা’র অবস্থা যে বেশ শোচনীয়, তা আন্দাজ করতে পারছি। ভেতরে ঢুকলাম আমি।

-- কি রে দ্বৈপায়ন, কিছু টিপস দিতে পারলি রূপাঞ্জনাকে ? নাকি এমনিই নিয়ে এলাম আমি ওকে ? তাহলে কিন্তু ফেরার সময় মাথাটা খারাপ করে দেবে আমার। কি রূপাঞ্জনা তুমি কিছু বলো ডিয়ার।

ঘরের তিনজনই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, সবচেয়ে অবাক হল দ্বৈপায়ন। আস্তে আস্তে ওর চোখে একটা কৃতজ্ঞতার ঝলক দেখলাম। রূপাঞ্জনা আর দ্বৈপায়ন দুজনেই অভিনয়ের জগতের, তাই এর পরের দৃশ্যগুলোয় বেশ ভালোই ওরা অভিনয় করে গেল। রূপাঞ্জনা আমার পাশ ঘেঁষে এল, আর দ্বৈপায়নও কি যেন এক ঠাট্টা করে উঠল আমাকে আর রূপাঞ্জনা’কে নিয়ে। আমিও আরো তৃপ্তি ভরে রূপাঞ্জনা’র কাঁধে হাত রেখে সোফায় আরাম করে বসলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ