নাসরিন জাহানের গল্প : অন্যরকম

মাঝখানে বাতি।

তার ওপাশে আমার মেয়ের মুখ কখনো স্পষ্ট, কখনো তামাটে, আবার কখনো জলের মতো, সমস্ত ঘরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি এই প্রথম ওকে পরিপূর্ণ চোখে দেখি। ঠাঠা নিস্তব্ধতায় আমার আবিষ্কার করতে অদ্ভুত লাগে, এই রকম জোয়ান হয়ে ওঠা একজন নারীকে আমি একদিন আমার ওই খুদে তলপেটে ধারণ করেছিলাম।


দরজায় খটখট শব্দ হয়। তার পরপরই প্রচণ্ড তিক্ততায় আমার মেয়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে, এই বিংশ শতাব্দীতে কেউ হারিকেন জ্বালায় ? আমি দরজার কাছে যাই। লম্বা পা-টায় ঝিঁঝি ধরে গেছে। সেটার ওপর ভর দিয়ে ছিটকিনিতে হাত দিয়ে সচেতন হই, কে ? 

কেউ কথা বলে না।

কে ? 

কোনো শব্দ নেই। 

ইদানীং এমন হচ্ছে। দরজায় কেউ নক করে। দিনে, রাতে, মাঝেমধ্যে। দিনে হলে খুলে দেখেছি, বারান্দায় হুহু ঠান্ডা। নিশ্চয়ই সেই বাতাস ? মেয়ে হাসে। 

তাই তো দেখছি, বলতে বলতে ফিরে আসি। বাতির এপাশের আলোয় অর্ধ সমাপ্ত কুরুশকাঁটার কাজটি মেলে দেখতে থাকি। 

মেয়ে বলে, যাই বলো মা, তুমি খুব কিপটে। কী হয় চার্জলাইট কিনলে ? দু’দিন পর পরই তো টানা কারেন্ট যাচ্ছে। 

শহরে অনেকে চার্জলাইট কিনছে, এ আর কী এমন অভিনব ? 

অভিনবত্বের প্রশণ্ন আসছে না, সামর্থ্যরে মধ্যের আধুনিক সুবিধাগুলো তুমি ভোগ করবে না ? মেয়ে বলে, তবে টিভি, ফ্রিজ এসব ফেলে দাও। এখনো অনেক গ্রামে, অনেক মফস্বলে হারিকেন আছে। 

কিন্তু শহর থেকে হারিকেন সরে যাচ্ছে। সবই যদি সবার মতো হয়ে যায়...। আমি টের পাই খেই হারাতে শুরু করেছি, ওর আরও অগ্রসর যুক্তির সামনে দ্রুত পরাজিত হতে হবে, তবুও চালিয়ে যাই, আসলে এমন কিছু আমাদের থাকা উচিত যা দিয়ে আমাদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। তাই বলে হারিকেন দিয়ে ? মেয়ে হাসে।

এই যেমন কুরুশকাঁটার কাজ, আমি প্রবল আগ্রহে বলি, ভীষণ ধৈর্যের কাজ বলে প্রায় সব বাড়ি থেকেই এর চলন উঠে যাচ্ছে। হ্যাঁ হারিকেন, মন্দ কী ? কী রহস্যময় আলো ছড়িয়ে যায় সবখানে। অথচ মোমবাতির মতো খোলামেলা নয়, দেখলেই মনে হবে জিভ বাড়িয়ে গ্রাস করতে চাইছে। 

মেয়ে হাসতে থাকে, এসব কোনো যুক্তি হলো ? তুমি আমাকে কী সব উল্টাপাল্টা শিখিয়ে বড় করছ, তাই ভাবছি। 

আমি আমার কোনো যুক্তি তোর ওপর চাপিয়েছি ? 

এ-তো চাপানোই। আমাকে হারিকেন সহ্য করতে হচ্ছে। মা, নতুন কিছু আবিষ্কার যদি করতে না পারো বর্তমানের সব সুবিধাকে ভোগ কর। পুরোনো, যা ছিল ঘরে ঘরে প্রচলিত, তাকে ধরে রাখায় কী এমন অভিনবত্ব ? 

আমি ঘুমুতে যাই। 

ঘুমিয়ে স্বপেণ্ন দেখি, দুটো সমান পা নিয়ে আমি দৌড়াচ্ছি। আমার বয়স দশ-বারো, আমার মেয়ের চেয়েও অনেক কম। এমন স্বপণ্ন আমি এই জীবনে কমই দেখেছি। অথচ খুব বেশি দেখাটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। তাহলে মানতে হবে দুটো অসম পা নিয়ে আমার কোনো বিকার নেই ? অনেক ভেবেছি, হয়তো বিকার ঠেকাতে সচেতনতা এত বেশি, সেই লোহার দেয়াল ফুঁটো করে স্বপণ্নও প্রবেশ করতে পারে না। তবুও দেখেছি, সহজ পায়ে হাঁটছি। সেসব স্বপেণ্ন সহজ পায়ে হাঁটতেই কেমন আড়ষ্ট লাগত, কখনো আমি আমার বয়স থেকে বেরোতে পারি নি। 

আজকের স্বপণ্ন বৈশিষ্ট্যময়। অনাবিল দৌড়াচ্ছি, কোনো আড়ষ্টতা নেই, এ ছাড়া আমি শৈশবে। ঘুম ভেঙে গেলে দীর্ঘ বছর পর বাতি জ্বালিয়ে আমার পা দুটি দেখি। যেন দুটো দু’বয়সের কিশোর ভাই, পাশাপাশি বড় হচ্ছে। একজন আরেকজনকে ছাড়িয়ে যেতে পারছে না। এর মধ্যে দেয়ালের এলোচুলের মেয়েটি অদ্ভুত কণ্ঠে হেসে ওঠে। কেন যে এলোচুল, উষ্কো মেয়ের ছবি ঘরে রাখি--মেয়ে রেগে ওঠে। শুভাকাঙক্ষীরা বলে, আমার সব অস্বাভাবিক। তা তো বলবেই। আসলে তারা ইঙ্গিত করে আমার অস্বাভাবিক গড়নকে। গড়িয়ে গড়িয়ে হাঁটি, অস্বাভাবিকই তো! 

ভেতরে এক সময় কী কানণ্না ছিল, কী দুর্মর বেদনা--দোজখ-বেহেশ্ত এক হয়ে যেত। যখন যুবতী হয়ে উঠছি--এই আমার আকৃতি ? একেই বহন করে যেতে হবে আজীবন ? কেউ সামনে এলে হাঁটতাম না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাঁট হয়ে বসে থাকতাম বিছানায়। 

একসময় কী সুন্দর নিজেকে সব বুঝিয়ে ফেললাম। 

বুঝিয়ে ফেললাম, সবার দুটো সমান পা থাকে। সবাই সহজভাবে হাঁটে। যত বিচ্ছিরি দেখাক, আমি আলাদা।

ফুলের বাগান করার নেশা ছিল, ছেনি দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সেই বীভৎস পাঁক থেকে ফোটাতাম কত বিচিত্র রহস্য লাল, হলুদ...। 

এই নেশা অনেক সাধারণ মানুষের থাকে। যে যত বেশি সাধারণ, তার হাতে তত বেশি ফুল ফোটে। সারাক্ষণ ধান্দা--এমন কী করা যায়, যা সবাই করে না ? 

খটখট।

বুক ধড়াস করে ওঠে। উজ্জ্বল বাতিঘরের সবুজ রং শুষে নেয়। এত রাতে সেই অলৌকিক হাওয়া ? নিজেকে হেঁচড়ে দরজা খুলি--আমার মেয়ে। 

আশ্চর্য কণ্ঠে বলে, মা, বড় বাজে স্বপণ্ন দেখেছি। 

আমি বলি বাজে স্বপণ্ন দেখা ভালো। এসো, আমার সঙ্গে শোও। 

তোমার তো সব সময়ই অন্যরকম বলা চাই, মেয়ে মায়ের মতো শাসন-করা কণ্ঠে বলে--তুমি দরজা বন্ধ রাখলে যে ? 

বিছানায় শুয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে বলি, কী যে মনে হয়েছে, রাতে বাইরের দরজা ভেবে নিজের দরজা বন্ধ করে রেখেছি।

বাজে স্বপণ্ন দেখা ভালো বললে, মেয়ে কুটকুট হাসে, তুমিও কুসংস্কারে বিশ্বাস কর ? 

লেপের ওমে তলিয়ে যেতে যেতে বলি, আমার যুক্তি আছে। আমি আশা করছি এই যুক্তিটা তুই তর্কের খাতিরে অগ্রাহ্য করবি না।

মা, তোমার তলপেট এত ঠান্ডা। 

এর মধ্যে একসময় তুই ছিলি। 

এমন করে বলছ, যেন এমনটা আর কারও ক্ষেত্রে হয় নি। 

তোদের কাছে পৃথিবীটা এত জলের মতো! আসলে আমারই সমস্যা, এই যে টের পাচ্ছি, তোর শরীরটা কেমন যুবতী হচ্ছে, আমার আর তোকে নিজের মেয়ে মনে হচ্ছে না। 

কী মনে হচ্ছে, বান্ধবী ? 

না তা-ও না। মনে হচ্ছে, তুই আমার থলের মধ্যে দীর্ঘকাল ছিলি, এখন রোদ-হাওয়ায় বেরিয়ে পড়েছিস আর ফিরবি না, তুই অনেক দূরের কেউ। এভাবে বলো না, মেয়ে আমার উষ্ণ হাতের তালুতে তার ঠান্ডা হাত ঘষে, ভীষণ মন খারাপ লাগে। আচ্ছা, স্বপেণ্নর যুক্তিটা বললে না ?

আমার ক্ষেত্রে এমন হয়, খুব সুন্দর স্বপণ্ন দেখলাম, ধর দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি, অথবা দুর্লভ কিছু পেয়ে গেছি, ঘুম থেকে উঠে ভেতরটা বিষিয়ে যায়। এ বাস্তবে ঘটে নি ভেবে সারা দিন খারাপ লাগে। অথচ ধর, স্বপেণ্ন হত্যাকারী তোর পেছনে ছুটছে, অনন্ত পথ ধরে তুই দৌড়োচ্ছিস, একসময় তোর ভয়ার্ত দেহটা ওরা খপ করে ধরে ফেলল, অথবা আমি মরে গেছি, সারা বাড়িতে তুই একা। আমার শরীরটা শাদা কাপড়ে তুই ঢেকে দিলি, ঘুম থেকে উঠে টের পাবি মাথাটা ভীষণ ফাঁকা লাগছে। সারা দিন এই ভেবে ফুরফুরে থাকবি--যাক স্বপেণ্নর ওপর দিয়ে গেছে, বাস্তবে ঘটে নি। কিরে ঘুমিয়ে গেলি এরই মধ্যে ? লুকিয়ে খোয়াবনামা পড়ি। স্বপেণ্নর যুক্তি তো খুব ঝেড়ে দিলাম। আসলে আমি স্বপেণ্নর ভালো-মন্দ অনেকটাই বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি হাতের রেখায়। সবচেয়ে বেশি পাথরে। আমার আঙুলের সোনার আংটির ভেতর তেমন দুটি পাথর আছে। আমার মেয়ে জানে এ সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। সব কি ওকে দেখানো যায় ? 

না, খোয়াবনামার কোথাও খোঁড়া পায়ের মেয়ের সহজভাবে দৌড়োনোর স্বপেণ্নর সুফল কিংবা কুফল সম্পর্কে লেখা নেই। 

দরজায় খটখট। 

পাশের বিল্ডিংয়ের পিন্টু এসেছে। আমার মেয়ে বই রেখে ড্রয়িংরুমে। মেয়েকে শিখিয়েছি আড়িপাতা অন্যায়। মেয়ে এটা হাড়ে-মজ্জায় শিখেছে। আমি ডাইনিংয়ের বেসিনে হাত ধোয়ার ছলে আড়ি পাতি। 

সাংঘাতিক ফ্রি ওরা। স্রেফ বন্ধুত্ব, আমি জানি, পিন্টু বিয়ের প্রস্তাব দিলে আমার মেয়ে হেসে গড়াগড়ি খাবে। অথচ কথা বলছে যাবতীয় সেক্সুয়েল প্রসঙ্গে। পিন্টু তার পতিতাপল্লীতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে। 

আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে। আমার মেয়ে পনেরো অতিক্রম করে নি। কেমন বিপনণ্ন বোধ করি। মাথা ধরলে বিছানায় আছড়ে পড়ি। নিজেকে বোঝাই, আমিই তো অন্য মা-দের মতো হব না বলে বাড়ন্ত বয়স থেকে সব শিখিয়েছি ওকে। প্রথম রক্তপাত, গর্ভের সন্তান, কীভাবে সে ভূমিষ্ঠ হয়, প্রেম, বিয়ে ইত্যাদি। বাইরের দেশে এসবের ক্লাস হয়। আমি এসব কিছুতে কোনো অসুবিধা দেখি নি। 

আমি তো এও শিখিয়েছি সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট বয়স আছে। আমার মেয়ে কি আমার শেখানো আবর্তেই শুধু ঘুরবে ?

এ ওর নিজস্বতা--তাই ও প্রমাণ করছে। কোনোদিন কোনো উড়নচণ্ডী মস্তানকে ধরে এনে আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে থাকবে, এই ওর জীবনের যথার্থ মানুষ। 

ভয় হয়। বড্ড ভয় হয়। আমার সমস্যা এই যে আমার প্রতি কেউ আকৃষ্ট হয় না। তাই দিনরাত ওর প্রতিই তাক করে থাকি। অন্য কোনো কিছুর দিকে নিজেকে মনোযোগী করতে পারলে এ জাতীয় সেণ্নহের বিষ থেকে মুক্তি পেতে পারতাম। 

দীর্ঘ বছর ধরে একটা বই খুঁজছি। কোনো পঙ্গু মহিলার আত্মজীবনী। তাঁর জীবনকে দেখার বোধ, উপলব্ধি। অন্ধ হেলেন কেলারের জীবন পড়েছি। যেহেতু জন্মান্ধ, তার রোদ-ছায়াকে স্পর্শ--এসবের সঙ্গে নিজের উপলব্ধি মেলাতে পারি না। তাহলে একথা কি মানতে হবে এই পৃথিবীতে কোনো বিকৃত আকৃতির মহিলা লেখক হয় নি ? এরপর দুর্মর জেদ চাপে, এ-ই অন্যরকম হওয়ার পথ। নিজের আত্মজীবনী লিখব। তা প্রকাশ করব। 

আমার বেড়ে ওঠা, বাবার অপার্থিব সেণ্নহ, আমার দিকে তাকিয়ে মা’র কানণ্না--এর মধ্যে এমন কী বিচিত্রতা আছে ? মা-বাবার মৃত্যু, ভাইদের বিচ্ছিনণ্নতা, এই বাড়িটি আমার নামে লিখে দেয়া, এ বাড়ির লোভে এক অপদার্থ লোকের আমাকে বিয়ে করা, তার মৃত্যু--হ্যাঁ, আমার চারপাশে ঘনঘন মৃত্যু আছে। নিচের তলা ভাড়া দিয়ে আমরা মা-মেয়ে দিব্যি বেঁচে আছি, জীবনে সংগ্রাম কোথায় ? 

দুটি স্বাভাবিক পায়ের, একজন সুন্দর পুরুষের জন্য কতটা কাল বুভুক্ষু হয়ে আছি! 

না, সবাই সহজভাবে হাঁটে, আর আমি ব্যাঙের মতো থপথপ করে লাফিয়ে এ আমার বিশেষত্ব--বইয়ের ভাঁজে মুখ ঢোকাই, কী ভেজা গন্ধ! দেয়ালে বিষণণ্ন মেয়ের পোস্টার খুলে ফেলি। 

কুরুশকাঁটার শাদা মিহি কাজে নিজেকে ডুবিয়ে চলে যাই সেই গহিন অরণ্য মাধবকুণ্ডে, যে হিমশীতল বনের খোপে নিভৃতে ঝরে যাচ্ছে চিকন ঝরনার জল। বাবার আঙুল চেপে বলেছিলাম, সুন্দর!

কতদিন সুন্দর দেখি না! 

দেয়ালে অন্য ছবি সেঁটে দিই--একটি উড়ো চুলের পুরুষের মুখ অর্ধেক ঢেকে রেখেছে হুলোবিড়াল! আমার মেয়ে নিশ্চয়ই বলবে, তুমি যে কোত্থেকে এসব জোগাড় কর! ঘর থেকে বেরিয়ে টানা স্কুটারের পথ। তারপর সিঁড়ি টপকে টপকে ওপরে। চারতলায়। তুই এই অসময়ে ? মাহমুদার দুই চোখে বিস্ময়। সোফায় নিজেকে ঢেলে দিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকি। 

কোনো দুঃসংবাদ ? 

ওর ঘরে আজ অদ্ভুত বাতাস। মনে মনে বলি, এই গন্ধ আমার চেনা। কী করে চেনা ? আমাদের বাড়ির বেড়ালটার শরীরে ছিল। হ্যাঁ, ওটাও মরে গেছে। শীতের রাতে নর্দমায় পড়ে ছিল। আমি নাক কুঞ্চিত করে বেড়াল খুঁজি। প্রশণ্ন করি, পোষে কি না। 

না তো ? তুই জানিস ওটায় আমার এলার্জি। 

তা-ই তো জানতাম। বিড়বিড় করি, আহ্ এ কিসের গন্ধ ? আমার অতীত-বর্তমান নাড়িভুঁড়ি উল্টে দিচ্ছে ? 

বলি, তোর এমন কোনো পরিচিত মহিলা আছে কিনা যিনি সাহিত্য করেন ? 

মাহমুদা আমাকে চেনে। বলে, তা একেবারে নেই, তা নয়। কেন ? 

আমি আমার আত্মজীবনী লিখাব। নিজেই লিখতে চেয়েছিলাম। অনেক কষ্ট করেছি, কিছুতেই ভাষায় রূপ দিতে পারি না। অথচ সব ঠিক মতো ভাবতে পারি। 

এক্ষেত্রে পুরুষ লেখক হলে অসুবিধা কী ? 

তুই বুঝছিস না, গর্ভে সন্তান আসা, আমি ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছি, এই শিশু নির্ঘাত আমার আকৃতি নিয়ে জন্ম নেবে, রাতের পর রাত কী হিমশীতল আতঙ্ক! এ হয় বেড়াল, নয় কুকুর হয়ে জন্মাবে। এরপর ডাক্তার টান দিয়ে বের করতেই মৃত্যুর মতো আমি দু’চোখের পাতা এক করেছিলাম। দীর্ঘসময় পর রোদ ঝলমল শিশুটিকে যখন ট্রের মধ্যে শুয়ে থাকতে দেখলাম, তখনো ওর পেটের মধ্যে কাঁচি বাঁধা ছিল। আমি উদ্ভাসিত হয়ে তার দুটি সমান্তরাল পা দেখি। পরক্ষণেই মিশ্র অনুভূতি-- এ সন্তান আমার নয়। ডাক্তার বদলে ফেলেছে। আমার সন্তানের এমন হওয়ার কথা নয়। 


অনেক দিন আমার মধ্যে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল ছিল। অনেক পরে ওকে নিজের সন্তানের মায়ায় টেনে নিয়েছিলাম। এসব কি পুরুষ লেখক বুঝবে ? মাহমুদা গম্ভীর হয়। 

কিসের গন্ধ এটা, এ তো চেনা ? মাঝেমধ্যেই এমন হয়। কাউকে দেখে খুবই চেনা মনে হয়। কথা বলে হয়তো জানা গেল, সে কলকাতার অধিবাসী। এই প্রথম এদেশে এসেছে। 

আমার স্বামীরও বিয়ের রাতে এমন হয়েছিল, বলেছিল, তোমার মুখটা বড় চেনা মনে হয়। 

আমি বলেছিলাম, তা তো হবেই, আমাদের দুজনের যে একটা মিল আছে, তুমি মানুষ, আমিও মানুষ। এই হয়তো মানুষের স্বভাব, চেনার প্রতি নয়, চেনা চেনার প্রতি আকর্ষণ। মাহমুদা বলে, এখানে যে দু-একজন লেখিকাকে চিনি, তারা বড় রক্ষণশীল। তাদের সাহিত্য যথেষ্ট বদ্ধ। এদের লেখায় শুধু শাশুড়ির নির্যাতন, স্বামীর পরকীয়া, সন্তান দেখছে না, এসব সংকট। এর হয়তো কারণও আছে। ওরা তোর এইসব জটিলতা, ভ্রƒণ, তার বেড়ে ওঠা, শিশুর জন্ম ইত্যাদি নিয়ে লিখতে অস্বস্তি বোধ করবে। সেদিন আমার এক পরিচিত লেখিকা-বান্ধবী বলেছিল, সে এক নারীর পরকীয়া বিষয়ে গল্প লিখেছিল। সেটা ছাপানোর আগে স্বামীকে পড়তে দিলে স্বামীর সে কী রাগ! এরপর থেকে লেখিকা স্ত্রীকে তার স্বামী সন্দেহের চোখে দেখে আসছে। 

বড্ড ঘুম পায়। 

দেহে কি শিথিলতা জমছে ? 

জলের মধ্যে সাঁতার কাটছে রঙিন মাছ। চেয়ে থাকি। একসময় ফিসফিস করে বলি, তুই এমন কাউকে চিনিস, সে জিনের তাবিজ দিতে পারে ? 

মাহমুদা অবাক, তুই বিশ্বাস করিস এসব ? 

আমার দরজায় মাঝেমধ্যে খটখট করে, দিনে রাতে। আমি জানি, জিন। মেয়েকে বলি না, হাসবে। তুই জানিস না যাদের বিকৃত আকৃতি, তাদের সঙ্গে সব সময়ই জিন থাকে ? আশ্চর্য! তোর মাথা বিগড়ে যাচ্ছে। 

তুই এমন ভাব করছিস! আমি ক্ষেপে উঠি, এমনিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িস। ইসলামে জিন আছে না ? আমি এর বাইরের কিছু বলেছি ? ওর বাড়ি থেকে চলে এসে বিছানায় এলিয়ে পড়ি। কত সুখে আছি। মানুষ কত যুদ্ধ করে, রাস্তায় ঘুমোয়, একবেলা খেতে পায় না। আমাকে অর্থের জন্য যুদ্ধ করতে হয় না। বাবা এই বাড়িটা না রেখে গেলে এই পা দেখিয়েই অর্থের সংস্থান করতে হতো। মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ওঠে, কী রকম চৌকস বানাতে চেয়েছি। একসময় ওর গানের পেছনে কী মরিয়া হয়ে লেগেছিলাম! বলে, ওতো অনেকেই গায়। 

আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দেয়। তাহলে আজীবন এই থাকবি ? স্রেফ একটি মেয়ে হয়ে ? আমাকে বলে, তাহলে মাথা নিচে দিয়ে উল্টো করে হাঁটতে শিখি ? তাহলে অন্যরকম হবে। সেই মেয়ে এখন কী সব প্রসঙ্গে কথা বলে পিন্টুর সঙ্গে! তাহলে কি সব জানিয়ে ভুল করেছি ? কিন্তু ওর বান্ধবীদের দু-একজন, যাদের বাবা-মায়ের এসব যে-কোনো প্রসঙ্গে জিভ খসে পড়ে, তারা যে আরও মারাত্মক ? মেয়ের মুখে তাদের পাকামোর কথা শুনে আমার শিরা দপদপ করে। এই বয়সেই কেউ কেউ সেক্স করেছে, কেউ--। 

আমার মেয়ে স্রেফ কথা বলছে। কেন এমন টনটন চোখে দেখছি ? ও কিছুই গোপন করে না আমার কাছে, আর কী চাই আমি ? 

ও অন্যরকম কিছু হতে পারল না। 

বুক চিরে ধোঁয়ার মতো দীর্ঘশ্বাস ওঠে। এই জন্যই নিজের দিকে তাকাই। জন্মাবধি দেখে এসেছি বড় স্টারদের যেভাবে লোকজন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, আমাকেও দেখছে। কিন্তু তাদের চাউনি আমাকে নিরন্তর কুঁকড়ে রেখেছে। কেউ কেউ দমকা কণ্ঠে হেসেছে, আহা! এখনো এর মধ্যেই পথ চলি। যত চলি, তত যন্ত্রণা, যত জেদ তত নিজেকে বিকশিত করার পথ খুঁজি। কী করলে এই বিকৃতিই এক সময় আদর্শ হবে ? 

এক সময় মনে হতো একটা পা কেটে দুটোকে সমান করি। এই চিন্তা এক সময় আমার ভেতর মর্মঘাতী বোধ এনে দিয়েছিল। কী করে এটাকে দ্বিখণ্ডিত করা যায়, গভীরভাবে এই চিন্তায় মগণ্ন থাকতাম। একবার বিপরীত চিন্তা ঝেড়ে অর্ডার দিয়ে কাঠের জুতো বানিয়েছিলাম। একটায় হিল আছে, আরেকটায় নেই। পা ঘষটে হাঁটছিলাম, এক ছোকড়া পেছন থেকে টিপ্পনী ছুড়ে দিল, এই ল্যাংড়া কবে ঠিক হলো ? 

এমন সব ক্ষেত্রে মানুষ খুব নিষ্ঠুর হয়। জুতো ছুড়ে ফেলে পুনরায় অকৃত্রিম হয়েছিলাম। এসব যখন ভাবছি তখন রোমকূপে অদৃশ্য শিরশির। টের পাই মশারির ওপারে কেউ হাঁটছে। এরপরই বাইরের দরজায় খট্। 

আমি কি শুয়ে আছি ? নিজেকে অনেকক্ষণ শনাক্ত করতে পারি না, নাকি এ আমারই পায়ের শব্দ ? কে এমন ভয় দেখায় ? কেন নিরন্তর দরজায় খটখট ? 

আমি জানি এ কে ? ভীষণ ভয় লাগে। দরজা খুলে মেয়ের কাছে যাওয়ার সময় করিডোরে নিঃশ্বাসের শব্দ টের পাই। দৌড়ে গিয়ে মেয়ের বুকে আছড়ে পড়ি, ভীষণ ভয় লাগছে। 

মেয়ে আমার চুলে হাত বুলিয়ে বলে, তুমি ভীষণ একা, এটা ভাবলেই খারাপ লাগে। এরপর দীর্ঘসময় চুপ থেকে বলে, তুমি একটা বিয়ে করলেই পারতে। 

তোর তাহলে কী হতো ? 

আমি ওই লোককে বাবা ডাকতাম।

করি নি, তাই বলছিস। করলে অন্যভাবে শাস্তি দিতি। 

আমাকে তুমি চেনই না। 

তোকে আমি চিনি না ? কিছুদিন আগে অন্যরকম ছিলি, বান্ধবীদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য কী কানণ্না! বলতি, আমার মা খোঁড়া হোক, ভাঙাচোরা হোক আমার অহংকার। কেউ হাসলে ঝগড়া বাধাতি। এখন বলিস, ওসব জায়গায় গেলে তোমার শরীর খারাপ হবে মা, অত গ্যাঞ্জাম তোমার সহ্য হবে না। 

আসলে তা নয়, মেয়ে ইতস্তত করে, বান্ধবীরা বলে, তুমি সারাক্ষণ আমার পাহারাদার। 

আসলে অনেক বড় হচ্ছে তোর পৃথিবী, আমি বলি, এ মানতে আমার কোনো কষ্ট নেই, তোর মা তোর সঙ্গে উল্টোপাল্টা হাঁটছে--এতে সেই পৃথিবীতে তোরই সৌন্দর্য নষ্ট হয়। 

তুমি নিজেই অনেক বদলে যাচ্ছ মা, আমিও তোমাকে আর বুঝি না। আমি বহু বছর পর আমার মায়ের কষ্ট অনুভব করি। কেন গর্ভেই তোর মৃত্যু হলো না--মায়ের এ জাতীয় আহাজারির কারণে চিরকাল তাকে শত্র“ ভেবেছি। আসলে একেকজনের যন্ত্রণা প্রকাশের ধরন একেক রকম। মৃত্যুর সময় তিনি আমাকে অনেক খুঁজেছেন, যাই নি। এখন অনুভব করি। কোনো কারণ ছাড়াই সন্তান যেন একটা পর্যায় পর্যন্ত মায়ের সম্পত্তি হয়ে থাকে। কী অসম্ভব জেদ ছিল তখন! আমি একসময় মায়ের তেমনই অসহ্য যন্ত্রণাকর একটা সম্পত্তি ছিলাম। মা আমাকে ফেলতে পারতেন না বলে নিজের মতো উল্টোপাল্টা ব্যবহার করতেন। আমার মেয়ের সামান্য স্বকীয়তা এই জন্যই আমাকে ভীত করে। মৃত্যুর সময় আমার দেখা তার অমানবিক কষ্টের কথা স্মরণ করে ফুঁস ফুঁস কাঁদি। বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে দূরের পথটি দেখি। শহরের এই জায়গাটা এখনো অতটা ঘিঞ্জি হয়ে ওঠে নি। ওই পথ, পামট্রি, আমাকে সারাক্ষণ স্বস্তি দেয়। ডানদিকের বাসাটার পেছন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে এক যুবক। আমি কখনো ওকে দেখি নি। আলোছায়ায় দোল খাচ্ছি, খুব কি অভিনব দেখাচ্ছে ? ছেলেটি কীরকম অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে। আমি কুঁকড়ে গিয়ে টের পাই, না, ও আমার পা দেখতে পাচ্ছে না। দীর্ঘ বছর পর আমার সমস্ত সণ্নায়ুতন্ত্রে কী এক হুল্লোড় শুরু হয়। ভাবি, ও অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি ওর সামনে দিয়ে হেঁটে ঘরে যাব না। মেয়ে আসে বারান্দায়। বরফ হয়ে জমে থাকি। ও বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে। মেহেদির চাপে ওর হাত যখন সবুজ, ও বলে--ছেলেটা কি হ্যাংলা, না মা ? আমি অনেক ভাবি, লিখব। ছবি আঁকায় হাত নেই আমার। গলায় সুর নেই। বাংলা ভাষা জানি। এর মধ্যস্থতায় নিজের অনুভূতি ফুটিয়ে তুলব। কতরকম করে ভাবি, কিন্তু অধিকাংশ ভাবনার থিম একরকম। ঘুরে ফিরে, পঙ্গুত্ব, বিকৃতি। ভাবি, এরকম একটি গল্প লিখব--এক লোক তার সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র স্ত্রীর কাছ থেকে চুরি করল, কেননা তার দুটি হাত ছিল না। ওকে নদীর জলে ফেলে দেয়ার জন্য লোকটি সবুজ মাঠ ধরে দৌড়োচ্ছে দৌড়োচ্ছে। অমনি সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। তার নবজাতক শিশুটি বাবাকে বলে উঠল, বাবা আমাকে খুঁজে পাচ্ছ না ? এই যে আমি ধানক্ষেতের ভেতর। 

ধুর! এ কোনো কাহিনিই নয়। পাশের বাড়ির প্রতিবেশী ভাবিকে বলি, খুব লিখতে ইচ্ছে হয়। সে বলে, হুবহু আমার দশা। জীবনে কত ঘটনা! লিখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কাগজ-কলম হাতে নিই, এক লাইনও যদি পারতাম! না, এইরকম ইচ্ছে যদি ওই রকম আটপৌরে মহিলারও হয়, আজ থেকে এই ইচ্ছে বাতিল। মেয়েকে বলি, তোর মধ্যে নিজেকে যদি পেতাম! তোর তো সময় আছে। জীবন সবে শুরু হলো।

আমি কিসে কম ? মেয়ের গ্রীবা উচ্চকিত হয়। 

পড়াশোনায় খুব-একটা খারাপ করছিস বলব না। সে তো গড়পড়তা সবাই করে। এসএসসি’তে একটা রেজাল্ট করবি, আমি তো বেশি কিছুই দেখছি না। 

তুমি মেট্রিক পাস করেই বিয়ে করেছ, মেয়ে বলে, আমি এমএ করব--ভালো চাকরি করব। তুমি এতে কমই-বা দেখছ কী! আমি নিঃশ্বাস চেপে বলি সে-কি আমি ইচ্ছে করে ? কলেজে গিয়েছিলাম। প্রথম দিনই আমাকে হাঁটতে দেখে ছেলেরা এমন হুল্লোড় দিল--আর যাই নি। 

মেয়ে তার দুটি সমান্তরাল পা আমার সামনে মেলে ধরে বলে, এই দেখ, এই নিয়েই তোমার অনেক বেশি সুখী হওয়া উচিত ছিল। সন্ধ্যা যখন সমস্ত ঘরে আসন পাতছে, মেয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে সিঁড়ির কাছে যায়। আমি ভুতুড়ে পায়ে দরজার এপাশে। সিঁড়ি দিয়ে কেউ ওপরে উঠছে। কয়েলের গন্ধ এত কটু! আমার নাক কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। মেয়ের কণ্ঠ শুনি, কাউকে বলছে, তুমিই খটখট কর আমি জানি, বীরপুরুষ, নক করে পালাও কেন ? এখন যদি মা-কে বলে দিই ? কেউ হাসছে। আমি জমে যাই। মেয়ে বলে, তোমার ঘুম নেই ? মধ্য রাতেও, পাগল! কেউ বলছে, আরও করব। আমি যদি পিন্টুর ঠ্যাং না ভাঙি! 

এইভাবে একটি দিনের সঙ্গে আরেকটি দিন জোড়া লেগে প্রহর লম্বা হয়। আমি শীতের ভারে ন্যূব্জ হতে থাকি। 

একদিন খোয়াবনামায় আরও একটি স্বপেণ্নর অর্থ উদ্ধার করে উত্তেজিত হয়ে উঠি। এই স্বপণ্ন দেখলে যার যা চিরন্তন রোগ, কেটে যায়। আমি গতরাতে সেই স্বপণ্ন দেখেছি। দিনেরবেলা এর অর্থ উদ্ধার করে কেমন ঘেমে উঠতে থাকি। এ জীবনে আমার আর আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন নেই। আমি এই পৃথিবীর মাটিতে দু’পায়ে সমানভাবে দাঁড়াতে চাই। আমি প্রাণপণে নিজের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রবল করি, অবশ্যই এই স্বপেণ্নর সুফল আমি এক সময় ভোগ করব। প্রহর গুনি। কী করে, কখন আমার একটি পা লম্বা হবে! বাইরের ঘরে পিন্টুর গলা, পায়ের নখে মেন্দি কেন ? তোর পা এসব ছাড়াই সুন্দর। আমার মেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, জানিস, মা আমাকে ঈর্ষা করে। রচনাকাল : ২০০৩


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ