হাসির একটা দাঁত বের করা ইমো দিলো বিপাশা।
‘আরে চট করে তুমি আসেনা তো । ইনবক্সে জবাব দিচ্ছে তপন।
‘’সত্যি, মেয়েদের সাথে কথা বলতে এমনিতেই আমার খুব অস্বস্তি আর তুমি বলতে তো আরো। বছরখানেক পরে বলবো। ‘’
’ এক বছর কথা বলতে হবে ইশ, বেশী চালাকি। তুমি করে বললে কথারাও আপন হয়। ‘
‘কথারা এমনিই কাছে আসে তারা কি আর আমি তুমি বোঝে?’’ তপনের শান্ত ভাষা।
’সত্যি বলেছেন, কথারা জমে জমে প্রথমে মেঘ হয় পরে গিয়ে ঝরোঝরো বৃষ্টি হয়। দালানগুলো হলদেটে হয়ে যায়, পাখিগুলো আধাভেজা বিরতি নিয়ে আনমনা ওড়ে । ''
''বাবা, এ যে দেখি কবি! তপন অবাক , ''কই আগে তো কাঠ কাঠ ছিলেন । ''
''মাঝে মাঝে কি যেন পায় আমাকে । তখন কাউকে ভেবে ভেবে কত কথা যে বলতে থাকি একা একা । আকাশ আঁধার হয় বেশ লাগে। ঘরে তো ছেলে ছাড়া কেউ নেই। ভাগ্যিস সে কবিতার নেপথ্যটা বোঝেনা। ভাগ্যিস সে মায়ের ব্যস্ততার বা অবসরের হিসেব করার মত স্বাভাবিক নয়। ‘’
তপন চুপ । বিপাশার লেখা পড়ছে ।সে বরাবর সুপ্রিয় শান্ত। ফেসবুকে কখনো কারো সাথে এভাবে অকারণে কথা হয়নি। বিপাশাই খুঁজে খুঁজে মাঝে মাঝে কথা বলে।
বিপাশা একনদী । তার কন্ঠের আকুলতা যেন পাথরকুচির সবুজে হুমড়ি খেয়ে পড়া ঢেউ । তার মুখরতার কারণ , হাসির ভঙ্গিমা এসব তপনের ভাবনা সীমানায় কখন যেন এসে পড়েছে সে সব জানে, কিন্তু কিছু বলেনা।
‘’জানেন রাঙ্গামাটি যাচ্ছি।''
‘’ছেলেকে নিয়ে? বাহ ঘুরে আসুন। আমি তো বেড়াতে যাবার জন্য পায়ে জুতো পরে থাকি কিন্তু সুযোগ মেলেনা। অফিসে সময় শুদ্ধ জীবনটাও জমা দেয়া।''
‘’ছেলেকে তো নেবোই সাথে খালাকেও যে ছেলেকে দেখে।
এছাড়া সে বাইরে গেলে তাকে একা সামলানো যায় না। তার সকল এক্টিভিটিসের স্পিড বেড়ে যায়। সে এত খুশী হয় যে কোথাও বসতে চায়না । শধু হাঁটবে আর হাঁটবে। আর খুশী জানাবে আওয়াজ করে, সে তো আর বলতে জানে না।
এই বড় হয়ে যাওয়া কুড়ি বছরের শিশুটিকে যখন স্বাভাবিক মানুষ ভয় পায় তখন বড় হাসি পায় জানেন । তারা নিজেরা কত অস্বাভাবিক বলেন। তারা মনে করে আমার ছেলে বুঝি তার এত দশাসই শরীর নিয়ে তাদের গায়ের উপর পড়ে যাবে, কি খাবার গায়ে ফেলে দেবে কিম্বা স্পর্শ লাগলে কি যেন ঘটে যাবে।‘’
তপন চট করে প্রসংগ বদলে দিলো, ‘’আজ কি রান্না করলেন ? রান্নার ছবি দেন দেখি। একদিন এসে আপনার রান্না খেতে হবে।‘’
‘’সত্যি আসবেন? জানেন এক সংসার করতে গিয়ে চুটিয়ে, রেঁধেছি । কত কিছু খুঁজে খুঁজে আনকমন আইটেম রাঁধতাম। আমার স্বামী মহাজন যেন তেন খেয়ে উঠে যেতেন। আমি তার পাশে বসে থেকেছি ।ভেবেছি সে খেয়াল করবে আমি খেতে বসিনি। কখনও খেয়াল করেনি।‘’ বিপাশা আবার শুরু করেছে।
‘’একদিন আসবোই আপনার হাতের ভালোমন্দ খেতে। আপনাকে বলেই আসবো। আজ উঠছি। রাদ কে খেয়াল করবেন ভালো থাকবেন। ‘’
তপন ফেইসবুক থেকে চলে গেলো। বিপাশা চুপ তাকিয়ে আছে। সে যাবার দৃশ্যটা দেখতে পায় , হাত নেড়ে বাই বলে। যেন সিড়ি দিয়ে তপন ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে । একসময় শুধু হাতটা নাড়তে দেখা যাচ্ছে , সে বাই বলতে বলতে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
এরকম বানিয়ে বানিয়ে অনেক দৃশ্য সে দেখে। যেন তপন এসেছে তাকে বেশী ঝাল দিয়ে চটপটি খেতে দেয়া হলো। , সেই ঝাল খেয়ে তপনের গমরঙ গাল লাল টুকটুক। নাক দিয়ে টপটপ কলের পানি। কিন্তু তবু ’খুব মজা হয়েছে দারুণ। টকটা দেন তো’’ বলে আবার কিছুটা ফুচকা ভেঙ্গে চটপটি নিচ্ছে। ‘
বিপাশা’র কাছ থেকে বিদায় নিলেও নেট থেকে যায়নি তপন। বসে বসে অফিসিয়াল কিছু মেইল চেক করে। তার বিভিন্ন বিষয়ের আর্টিকেল আছে পেইজে সেগুলোতে কারা কি কমেন্ট করে দেখে।
বছর খানেক আগে বিপাশা এসেছে তার আইডিতে, নাকি জীবনে সে এখনও জানে না। অনেক কিছুতেই নিয়মের একপেশে দেয়াল তোলা আছে ।সে চাইলেই নিজেকে ভাংগতে পারেনা। স্ত্রী রিয়ার উপস্থিতি জানে বিপাশা । শুধু এটুকুই। বিপাশাও এক ছেলে ছাড়া আর কারো কথাই বলে না। তাদের সময়টুকু শুধু তাদের নিজস্ব।
অকারণ অন্যমষ্কতা গ্রাস করে ইদানিং । কখনও বিকেলের বিদায়ের সময়, কখনও বা ভোরে। এই অন্যমনষ্কতা কতদূর নিয়ে যাবে ঠিক নেই ।কোন গন্তব্যবিহীন সম্পর্ক তো কেটে যাওয়া ঘুড়ির মত গোত্তা খেয়ে খেয়ে নিচে নামতে থাকে । কোথায় যে হাল ছেড়ে পড়ে যাবে ছিঁড়ে যাবে কেউ জানে না। শুধু একসময় আকাশের নীল তাচ্ছিল্যে কেটে পড়া দলছুট সুতোটা মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে ।
রাদ শারার কে নিয়ে খাওয়াতে বসেছে বিপাশা । আজ মিনুখালার জ্বর । ছেলেকে খাওয়ানো যে কি বিরাট ভেজাল সে জানে । ইদানিং রাদ অনেক দুষ্টমি করে। সব খাবার ফিটকে ফেলে সারা মেঝেতে ঘাস বোনে । আবার খাওয়াতে হয়। অনেক কষ্ট এ জীবন। দশটি শিশুকে পালা যায় এই পরিশ্রমে। তবু সব কিছুর বিনিময়ে সোনা বাচ্চাটা ভালো হোক তার।
ছুটির দিন খুব লক্ষী থাকে রাদ। মুম্মা মুম্মা বলে ডাকে । দুইঠোঁট একসাথে করে ''ম'' বলে । মা' বলে না। কি আদর তার আওয়াজে। কত সময় যে উঠে উঠে বাচ্চাকে আদর করে ,বুকে চেপে রাখে তার ঠিক নেই। পারলে চাকরীটা ছেড়ে দিতো , কিন্তু উপায় কি। চাকরী করেই খেতে হবে।
''কেমন হলো বেড়ানো? অনেকদিন কথা নেই তো, বেশ ভুলে গেছেন ভালো তো।‘’ তপন আজ ফোন করেছে।
‘’দাঁড়ান দাঁড়ান দম নেন বাহ। একটানা যে বলেই চলেছেন্। ‘’ হাসতে থাকে বিপাশা।
বেড়ানো তখন তখনই, শেষ। এর মধ্যে তো এক মাসের বেশী গেলো । খুব বুঝি ব্যস্ততা ?’’
ফোন করার জন্য যত আকুলতা তপনের, ফোন করার পর সে চুপ হয়ে যায়। যেন তার কোন কথা নেই। বিপাশা একাই বকে চলে। সে কিছু শোনে, কিছু আওয়াজ পায় ।
‘’খুব ভাবছিলাম আপনার কথা সত্যি বলছি। কেন ভাবছিলাম জিজ্ঞেস করবেন না দয়া করে। ‘’ চুপচাপ হাসে তপন।
‘’কি মনে মনে হাসছেন তো আমি কিন্তু বুঝি। '
‘’আরে মহা মুশকিল তো আমি হাসলাম কোথায়। ‘’
‘’ও, সব হাসি যেমন শব্দ হয় না, সব কান্নারও শব্দ হয়না তপন। আমি যে আপনাকে লিখতে লিখতে কতবার করে কাঁদি আপনি কি বোঝেন? বোঝেন না। ''
‘’আচ্ছা বলেন কি বলছিলেন। ‘’ তপন চকিতে খেয়াল করে,
''বলা তো কখন শেষ, আপনার মন আজ খারাপ তপন। ''
''না না আপনি বলুন বিপাশা।''
‘’আজ আমার বিয়ের দিন ছিলো ।আজ সব বলতে ইছে করছে বলি। আপনাকে ভালবাসি খুব। চমকে গেলেন? তেমনটা না যেরকম সবাই বাসে। অনেক শ্রদ্ধা করি আপনাকে।
ছেলেটা অটিস্টিক ,স্বামী আরেক সংসার করছে। সংসারে এই রকম মেয়েদের চার আনাও দাম নেই ভালোবাসা তো দূর।
অফিস থেকে বাসে করে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। প্রতিবেশীরা আড়ে ঠাড়ে তাকায়। যেন কার কার সাথে শুয়ে এসেছি।
কিছুই ভ্রুক্ষেপ করিনা। ছেলের জন্য তো লড়াই আমার মৃত্যুর আগ অব্দি।এর মধ্যে যারাই প্রেম ভাব নিয়ে কাছে আসতে চায়, আমার ব্রেস্টের মাপ দেখেই আসতে চায়। অন্য কিছু না। শাড়ির উপরেই চোখ চেটে চেটে খায় লকলকে জিভওয়ালাগুলা।
তার চেয়ে বরং কল্পনার বৃষ্টিতে ছাতা ফেলে দিয়ে আপনার সাথে ভিজবো সেই আমার ভালো। আপনি জ্বর আসবে বলে বকতে থাকবেন। আমি আপনার হাতের নাগাল থেকে বেড়িয়ে গিয়ে সমানে ভিজবো।
এ আনন্দ ভাবনাটুকু আর কাউকে নিয়ে নয় তপন। কোন তরফের কোন কিছু বদলানোর দরকার নেই। এ আমার একার আনন্দ শুধু একার। ‘’
তপনের খুব অসহায় লাগছে।আজ বিপাশাকে কথায় পেয়েছে।
‘’আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো। মাসে একবার হড়হড় করে ফোনে বক বক করে নেবো আচ্ছা? আপনার শুনতে হবে না তপন কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শোনেন। আর আমার মাথায় সমস্যা আছে ভেবে না হয় মাফ দিয়েন।‘’ বিপাশার সরল হাসি।
''আমি মোটেই বিরক্ত নই বিপাশা। চলুন আজ কফি খাওয়াই আপনাকে।''
‘’যার স্বামী, নিজের বাচ্চার এরকম অসুস্থতা টের পেয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায় আর খোঁজ নেয়না সেদিন থেকেই সেই স্ত্রীর বদ্ধ উন্মাদ অবস্থা হয়। । যার সন্তান কথা বলতে পারেনা গোঙ্গায়, সমস্তটা ভবিষৎ খাতায় হিজিবিজি আঁকে, অনেক উজ্জ্বল আলোতেও সে মায়ের আঁধার কাটেনা।
মাঝে মাঝে ফেবুতে এসে আপনার অক্ষরের ঘ্রাণ নিয়ে যাব।কখনো যেন দেখা না হয় । আমি চাই না । নকলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তপন, নকল বৃষ্টি নকল চটপটি, তাতে নকল ঝাল।''
ম্লান আলোয় মনের ভাবনা চলাচল ধীর লয়ে হয়। তপন স্পষ্ট বুঝেছে আজ বিপাশা কিভাবে কেঁদেছে শব্দ ছাড়াই। ভাবনা তো কোন ভিসার দরকার নেই । বুকের ভেতর ভাইব্রেশনটা টের পায় তপন। রিয়ার মুখটা কেন যেন চট করে মনে পড়ে । শরীরবিহীন দাম্পত্য সম্পর্কের তাদেরও আজ দশ বছর। রিয়া তার প্রয়োজনেই তপনের কাছে এসেছে। তপন তাকে ফিরিয়েও দেয়নি আবার নিতেও পারেনি । এর নাম আর যাই হোক সহবাস হয়তো নয়, তবু দাম্পত্য।
হঠাৎ শব্দ করে কি যেন ভাঙ্গলো। দৌড়ে গিয়ে দেখে ড্রইং রুমের শোকেসে রাখা ইজিপ্টের ফ্লাওয়ার ভাস একা একাই পর্দা লেগে পড়ে গেছে, এমন বাতাস। এ সমস্ত বাতাসেরা অনায়েসে প্রথা ভাঙ্গে।
প্রবল বেগে আসছে বৈশাখ । সব কিছুই কিন্তু তছনছ হয় না । অনেক সময় ঝড়ের পর যে পরিষ্কার আকাশ দেখা যায় তাতে ঝকঝকে তারা ওঠে । জল ফুটে থাকা আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় তপন। ভোরের শুকতারাটির নাম দেয় বিপাশা।
ভোরের শুকতারাটির নাম বিপাশা
উত্তর দিনমুছুনদারুণ দারুণ
খুব ভালো লাগল। এই সময়ের যাপিত জীবনের নান্দনিক ছবি!
উত্তর দিনমুছুনখুব ভালো লাগল। এই সময়ের যাপিত জীবনের নান্দনিক ছবি!
উত্তর দিনমুছুনখুব ভালো লাগল,যাপিত জীবনের নান্দনিক ছবি!
উত্তর দিনমুছুন