শিপা সুলতানা'র গল্প : রাজবংশ

যাইতে যাইতে আর কয়জন বাকি রইলা...

মনমতো পরিবেশ পেলেই বুড়া মিনমিন করে দিনেশের কানের কাছে।

-দেখো কাকা... কয়জন আর সবরে এক করবায় না, মিজাজ ঠিক থাকেনা আমার কইলাম...

বুড়া তবু উ উ করতে থাকে। ছুকড়ার সাথে কথায় পারে না সে। হারামজাদা বুঝেনা যে কথা দিয়া দিন যায়না, কোনো কিছু দিয়েই যায়না, ভাত ছাড়া। সে কথাই ফের বলতে চাইছিলো সে। তার আগেই 'ধুশ শালার বুড়া' বলে হাতের ঝুড়ি ছুঁড়ে মারে পাশের বাল্লায়। খাড়া পাহাড়ে বাড়ির দুই জোড়া কমলা, একটা আনারস, দুইটা ছফেদা ঠুক্কর খেতে খেতে নীচের দিকে গড়াতে থাকে। বুড়া লুকটি ছুবার ডালে কাঁপা কাঁপা হাত মুষ্টি করে ধরে গড়িয়ে যাওয়া ফল ফলাদির দিকে কাতর চোখে চেয়ে থাকে। রং বেরংয়ের ফলগুলো নীচের খাড়িতে গিয়ে পড়বে। কেউ যদি গরু চরাতে আসে অথবা মুখ ধুইতে আসে ছড়ার পানিতে, দুয়েকটা ফল পেয়েও যেতে পারে। বুড়ো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। টিলার বাঁকে নাই হয়ে গেছে দিনেশ। এরপর খালি হাতে রমলা বুড়িকে দেখতে যাবার কথা ভাবেনা সে। একা একা বাড়ি ফেরার কথাও ভাবা যায়না, তাই আশা করে একবার নীচে আরেকবার উপরের দিকে তাকায়। কাউকে না পেলে আর বাড়ি ফেরা হচ্ছেনা তার। বুড়ো তাই লুকটি ঝুপের গোড়ায়ই বসে থাকে।

গুয়ার হারামজাদা...পেটো নাই অন্ন, পাছাত নাই তেনা, যেতে যেতে বাকী রইলো কয়জন! বুড়া কি বুড়া জন্য বলে, ছুকড়ার ভাইরা পর্যন্ত গেলো আর সে আছে রোদ পোড়া পাথরের তেজ নিয়ে! বেশিক্ষণ ভাবতেও পারেনা, ঝিমুনি তাড়ানোর জন্য ধুতির গিঁট খুঁজে বিড়ি বের করে, বিড়িখানা বাঁচিয়েছিলো রমলা বুড়ির সাথে টানবে বলে। মরতে মরতে একটা বিড়ি যে মুখে ধরবে, সেই মানুষটাও আর নাই বুড়ির! সবাই চলে গেছে সমতলে। আর দিনেশ হারামজাদার চেত দেখো...ঠোঁটে বিড়ি গুঁজে ফের ধুতির গিঁট খুলে মনটা বিষিয়ে উঠে তার। এখন দেয়াশলাই পাবে কই। বুড়ির সাথে টানবে বলেই না দেশলাই মলাইয়ের কথা ভাবেনি আগে। হারামী যে গেলো, আগামাথা ভাবার মুরাদ নাই খালি ফাল পাড়ে খালি ফাল পাড়ে...

বাঁক পেরিয়ে লতানো ছড়া লাফ দিয়ে পার হয় দিনেশ। ওপাশের ভরাট ঘাসে পা ফেলতেই ঠান্ডা স্রোত গলা পর্যন্ত বয়ে যায় তার। বুড়ার উপর রাগে শরীর চড়চড় করছিলো, দপ করে নিভে যায় সে। চোত মাস। এ সময় ছড়ার পানিতে মাছ ধরতে, আর গা ধুইতে পাহাড় থেকে নেমে আসে আলদ। খরগোশ ও আসে ছানাপোনা নিয়ে। চকিতে চকিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে গা ধুয়ে যায় সেও। দিনেশ তাই তফাতে ঢিবির উপর গিয়ে বসে। ডানে বামে সামনে তাকালে কেবলই পাহাড়। আরো দূর চোখ সরু দেখলে তামাম দুনিয়াকেই বেড় দিয়ে আগলে রেখেছে এই পাহাড়। লুঙ্গি টেনে পাথরে হেলান দেয় সে। কতো দীর্ঘ দিনের আকাশ, কতো শত বছরের নিঝুমতা পাহাড়ের আড়ালে আড়ালে। একেক খাদের ভেতর একেক রঙ্গের অন্ধকার, একেক বনের একেক গন্ধ! এসব ছেড়ে বুড়ার হাউশ গজিয়েছে শহরে যাবে, ভাল খাবে, ক্ষয় রোগের চিকিৎসা করাবে। দিনেশ যাবে বাউটাদের মাঝে বসবাস করতে, পাহাড়ের বেড় ভেঙ্গে! জোরসে পা চালিয়ে কক্ করে উঠে দিনেশ। সামনের ঝামা পাথরে বুড়ো আঙ্গুল পুরাই থেঁতলে গেছে। শালার বুড়া রে...বুড়ার উপর ক্ষোভে নাকী শহস্র বছরের সংগ্রামে চোখ ভরে পানি আসে তার। কেনো জানি এখানে এসে বসলেই বুকের ভেতরটা পুবের কেরুর মাঠের মতো হু হু করে উঠে। আজো গোঙ্গিয়ে গোঙ্গিয়ে কাঁদতে থাকে দিনেশ...

বাবা থাকলে কি যেত? বুঝতে পারেনা সে। তার তো এখনো মনে আছে সমতলের নাম শুনলে বাবার গলার শিরা-উপশিরা ফুলে বাঁকাতেড়া হয়ে যেতো। তার ছেলেরা কীভাবে ছোট জাতদের সামনে মিনমিন করে মাথা নুইয়ে থাকে আবার সিটে বসিয়ে প্যাডেল মারতে মারতে পাছার ছাল ও খোয়ায়। থু:..দিনেশ দাদাদের মুখ কল্পনা করে একমুখ থুথু ছুঁড়ে। বুড়ার এক পা চিতায় উঠে গেছে তবু দেখো জাত মারার জন্য দশহাত লম্বা জিহ্বা দিয়ে শহরের দিকে ঠেলছে তাকেও। কালই শহরের দোরগোড়ায় ছেড়ে আসবে বুড়া শয়তানকে। ....পাহাড়ো অন্ন নাই, পিন্দনের ত্যানা নাই, মনিষর পোয়া কিলা শিক্ষিত অর শহরো গিয়া, তুই আমার লাখান মরবে রে বাপ, দিন থাকতে পথ গন...দুইবেলা ভাত বন্ধ হলেই বুড়ার গা থেকে সাড়ে সাতশো বছরের অপমান খসে পড়ে।

কত পাহাড়, কত গাঁ-এতো সব মনেও করতে চায় না দিনেশ। নিজের জন্মতো এই পাহাড়েই। পিতা ধনেশ পাত্র, সে দিনেশ পাত্র। পাত্রদের একজন হয়ে এই পাহাড়ে পাহাড়ে আত্মগোপন, ঘর, মাচাং, বিয়ে, মৃত্যু, ঠাকুর কীত্তন... স্তম্ভের খসে পড়া ইটের মতন নিন্মগামী হতে হতে দিনেশের চোখের সামনে পুরো গাঁওখানি চিতা হয়ে গেলো! বুড়া বলে কীনা সেও স্রোতের কিট হয়ে যাক। পিন্দনে কাপড় নাইতো কি হয়েছে, পেটে অন্ন নাই তো কি হয়েছে, ধনেশ পাত্রের ছেলে দিনেশ পাত্র শহরে গিয়ে দেড়হাতি জায়গার জন্য ছোটজাতদের পায়ে ভিখ মাঙ্গবে? ছুহ বুড়া...

ঝুপ ঝুপ করে অন্ধকার পড়ছে বনের ভেতর। ঘাসেদের মাথা কালো কালো লাগছে, কোনো কোনো ডালে খয়েরি ফিতার মত লটকে আছে সরু সরু আলো। বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া নেই তার। বুড়োকেও কেউ না কেউ পৌঁছে দিয়েছে। তবু উঠে দাঁড়ায় সে। আজকাল পরিচিত পথে পালাই পালাই মুখেদের মুখোমুখি হতে ভাল লাগেনা তার তাই কোনাকুনি পথ ধরে দিনেশ। এক সময়ের রাজধর্মের মানুষগুলো ভিনদেশিদের তাড়া খেয়ে আত্মসম্মান, ভয়ে আত্মগোপন করলে বহুকাল আর সমতলমুখী হয়নি তারা। তাদের রাজা গৌড় গোবিন্দই যেখানে ঠিকতে পারেনি, সেখানে তারা কোন মুখে ফিরে! আর এখন দেখো, খসে পড়া পাথরের মত সমতলমুখী কেবল স্রোত আর স্রোত! একটা অজানা আক্রোশ ফের ভেতরে জেগে উঠে দিনেশের। একটা অদেখা জানোয়ার জেগে উঠে কুয়োর ভেতর থেকে। কীভাবে বুড়ার যাত্রা রোধ করা যায়, একদা ভুবনদের বাড়ির গন্ধওয়ালা অন্ধকার হাইন্দে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে দিনেশ...

উবু হয়ে কি করে বুড়া! পুরো বাড়ি জোড়ে খাবলা খাবলা অন্ধকার। বুড়োর ওপাশ থেকে কুপির আলো বেরিয়ে উঠানোর অন্ধকার ফালা ফালা করে দিয়েছে। বাড়িতে সে আর বুড়া ছাড়া তিনটি ডিমাল মুরগী। জোড়া দুই কবুতর। আগ রাতেই ঘুমে তলিয়ে পড়েছে তারা। পেটে দুটি পড়তেই এ সময় চিৎ হয়ে থাকে বুড়াও। আজ একেবারে বাল্লার গোড়ায়! এতো সহজে সুযোগ পেয়ে যাবে ভাবেনি দিনেশ। কেবল হাতের ঠেলা, তারপর কত শত ফুট নীচে গিয়ে সকল সুখ সাঙ্গ হবে বুড়ার, সে আর না দেখলেও চলবে। কিন্তু পড়ো পড়ো কাঁঠাল গাছের শিকড়ে দু হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে কি করে বুড়া! বেড়ালের চেয়েও মন্থর পায়ে এগুতে থাকে সে...

কে রে.. দিনু নি? অবায় আয় রে বাপ

চমকে নিজের ভেতর শব্দ গুলো গিলে ফেলে সে.. ধুশ শালার বুড়া....

ধর রে বাপ, যতনে রাখিস...

বুড়ো দিনেশের দিকে কিছু একটার পুঁটলি বাড়িয়ে ধরে। শক্ত চট, চটের ভেতর হাজার বছর নাকী শত বছরের পুরনো গামছা অথবা তাঁতের শাড়ি, সেই তাঁত দিয়ে মোড়া শক্ত কিছুর অস্থিত্ব। কুপির আলোয় পরতের পর পরত তাঁত খুলতে থাকে সে। বুড়োর কাছে জানতেও চায় না, তবু সে জানে ভেতরে কি আছে। তার বাবাও দেখেনি, তার ঠাকুর্দা ও না, কেউ নাকী কখনো দেখেনি, শুধু যার যার পালা এলে জানতো জিনিসটা কোথায় আছে, তবে কি তার পালা এখন!

তাঁতের শেষ পরতের পর জিনিসটি বেরিয়ে অল্প আলোতেও চোখ ধাঁধিয়ে দেয় দিনেশের। রাধাকৃষ্ণের কষ্টি পাথরের যুগল মুর্তি! রাজা গৌড় গোবিন্দর শেষ চিহ্ন!

তুই ঠিকই কইছত। আমরা অইলাম রাজার বংশ, পাত্র অইয়া জন্মাইছি, জাত খুয়ানি ভালা কথা নায় রে বাপ...

কুপি নিভে গেছে, নিরেট অন্ধকার উঠান জোড়ে, তবু নির্বিঘ্নে ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে বুড়া...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ