শমীক ঘোষ'এর গল্প : সেই সব কথা যা লুসিকে বলা হয়নি

মানুষটার কোনো আকাশ নেই। চারচালা টিনের একটা ছাদ। তার গায়ে একটা জোরালো আলো লাগানো। ওইটুকুই। হ্যাঁ আলোর তারতম্য অবশ্য আছে। আলোটা নেভে প্রতিদিন নিয়ম করে। খোলা জানলার ফাঁক দিয়ে কিছুটা দিনের আলো, সেও জলে ভিজে স্পর্শ করে মানুষটার শরীর। আর মানুষটা সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা একটাই কাজ করে যায়। একটা বড় লাল রঙের ধাতব গোল জিনিস দু’হাত দিয়ে তোলে মাথার উপর। আবার নামায়। আবার তোলে আবার নামায়। এই কাজ। এই কাজেও ছুটি আছে। যখন লোডশেডিং হয়। কিংবা যখন লুসি সুইচ অফ করে। আর এই কাজের সময় মানুষটার মাথা বেয়ে ওপরে উঠে যায় বুদবুদ। মাছগুলো খেলে যায় মানুষটার শরীরের আনাচে কানাচে।

মানুষটা ডুবুরি। অন্তত মানুষটাকে দেখতে সেইরকমই। যদিও মানুষটা মোটেও মানুষ নয়। নকল। প্লাস্টিকের। মানুষটার পোশাক-আশাক, হেলমেট, হাতে ধরা ধাতব গোলাকার চাকতি। সবই আসলে প্লাস্টিকের। আসলে অ্যাকোরিয়ামের একটা খেলনা। 

মারা যাওয়ার দিন ভোরবেলায় বাবা এসেছিল আমাদের ঘরে। মা ততক্ষণে উঠে গিয়েছে। বাবা এসে চাদর সরিয়ে ধাক্কা মেরেছিল আমায়। ঘুম চোখে বাবাকে দেখে আমি হঠাৎ উঠে বসতে চেয়েছিলাম। অস্ফুটে একবার বলে উঠেছিলাম, ‘মা’। বাবা খুব সন্তর্পণে একবার পিছনটা দেখে নিয়েছিল। তারপর ঠোঁটের ওপর আঙুল এনে আমাকে চুপ করার ইশারা করেছিল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল, ‘ছিপ! ছিপখান রাখছস কই?’ হতভম্ব আমি চুপ করেছিলাম। বাবা একবার বারান্দার দিকে তাকিয়েছিল। ‘দেখছস না, হে আইসে।’ বাবার মুখে অনেকদিনের না কাটা দাঁড়ি। চোখগুলো প্রায় কোটরে ঢুকে গিয়েছে। গায়ের চামড়ায় কালচে ছোপ। বাবা আরো এগিয়ে এসেছিল, প্রায় আমার মুখে কাছাকাছি। আমি বাবার না ধোয়া মুখের বিচ্ছিরি গন্ধ টের পাচ্ছিলাম। বাবা মুখটা আমার আরো কাছে নিয়ে এসেছিল। বাবার মুখে না-ধোয়া টকটক গন্ধ। ‘ঘোড়ামুখো রুই। আইসে। আইয়া বইসে বারান্দার রেলিঙে। ছিপখান দে। মাছে উইড়া যাইব।’ আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। চিৎকার করে উঠেছিলাম, ‘মা।’ 

বাবা এবার আমার মুখটা চেপে ধরেছিল, “শয়তান, ক ছিপখান কোথায় রাখছস। মাছটা কী বইয়্যা বইয়্যা উইড়্যা যাইব?” আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম, ‘মা। বাবা মেরে ফেলবে।’ বাবা ততক্ষণে আরো রেগে গিয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে নাড়াতে লেগেছে। “মাইরাই ফ্যালামু। ছিপখান হারাইয়া ফেললি। এতদিন ধইর‍্যা বইস্যা আছি ঘোড়ামুখো রুই যদি আসে, আজ আইল আর আমার ছিপখান...” আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে এসেছিল মা আর সেজজ্যাঠা। দু’জনে মিলে চেপে ধরে বাবাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ঘরের বাইরে। আর বাবা হাত পা ছুঁড়ছিল। আমি ভয়ে বিছানার উপর বসে ছিলাম চুপ করে। খানিক পরেই খুব জোরে একটা শব্দ শুনেছিলাম আমি। আর বোধহয় তার একটু আগেই চিৎকার করে উঠেছিল মা। ঘোড়ামুখো রুই ধরতে বাবা মা আর সেজজ্যাঠার হাত ছাড়িয়ে লাফ দিয়েছিল তিনতলার বারান্দা থেকে। 

‘অ্যাকোরিয়াম!’ লুসি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। সদ্য স্নান করে। তোয়ালে জড়ানো মাথার চুলে। গেঞ্জি আর শর্টস পরা। লুসির নগ্ন হাতগুলোয় তখনও জলের ফোঁটা লেগে আছে। আমার মনে হল লুসি ব্রা পরেনি। লুসির সঙ্গে আমার আলাপ মাসখানেক। কাজের সূত্রে। তারপর কখন যেন লুসিই আমাকে বলেছিল অফিসের পর দেখা করবার কথা। জায়গাটা অদ্ভুত। ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিন। 

একটেরা অনেকগুলো পিচ বাঁধানো রাস্তা। দু’পাশে গাছ। স্ট্রীটল্যাম্পের আলোগুলো সেই গাছের পাতায় ঢেকে গিয়ে আলো আঁধারি। লুসি আর আমি প্রায় রোজ দেখা করতাম ওই ক্যান্টিনে। শানবাঁধানো গাছের তলায় বসে কথা বলতাম আমরা। 

আজ বিকেলেও আমরা ওখানেই দেখা করেছিলাম। কিন্তু মুখোমুখি বসেও আজ পারতপক্ষে আমরা কেউ কথা বলিনি। অবশ্য বলার চেষ্টা করেছিলাম আমিই। লুসি উত্তর দেয়নি। সত্যি কথা হল লুসি আজকে আমার দিকে তাকায়ইনি। বরং কী যেন দেখছিল আমার মাথার পিছনে। একদৃষ্টে। আমার খুব ইচ্ছে করেছিল একবার পিছনে ফিরে দেখি কী দেখছে। কিন্তু কেমন যেন সংকোচ হয়েছিল। আমিও তাই দেখতে শুরু করলাম লুসির ডানগালের পিছনে থাকা ক্যান্টিনটাকে। মেরুন টি শার্ট পরা মেয়েটাকে। যে হাসতে হাসতে বারবর গলে পড়ছিল পাশে বসা ছেলেটার গায়ে। কিংবা আরো পিছনে কালো শর্ট পরা মেয়েটাকে। সিগারেট টানতে টানতে অন্যমনস্ক কথা বলে যাচ্ছে মোবাইলে। 

এইখানে আমরা দু’জনে সত্যিই বেমানান। আমাদের আশেপাশে বসা ছেলেমেয়েদের থেকে আমাদের দু’জনেরই বয়স অন্তত এক দশক বেশী। তাছাড়া ফর্সা কটা চোখের লুসি সত্যিই খুব সুন্দরী। আর আমার চুল অনেকদিন কাটা হয়নি। পেকে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়। একদিনের না কাটা দাড়িতে সাদার ছোপ। এইখানে অনেকেই আমাদের দেখে। হয়ত হাসেও আমাদের নিয়ে। আমাদের? 

হঠাৎ লুসি উঠে দাঁড়িয়েছিল। ‘যাই।’

ঘাড়টা একটু তুলে আমি তাকিয়েছিলাম। সত্যিই আজ প্রায় কোনো কথাই হয়নি আমাদের। ‘যাবি।’ লুসি ঘড়ি দেখেছিল। ‘হ্যাঁ। তাড়া আছে।’

মাঠের দিকের সরু রাস্তাটা নিয়েছিল লুসি। দু’পাশের ঘন গাছের পাতায় ঢেকে যায় স্ট্রীট ল্যাম্পের ঔজ্জ্বল্য। আলোআঁধারি রাস্তাটার দু’পাশে অসংখ্য শরীর সিল্যুয়েট হয়ে মিশে যায় গাছের গায়ে। অন্ধকারে শরীর হয়ে যায় প্রেম। হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিল লুসি। আমি সামান্য পিছনে। দূরে হলুদ আলোর নিচে একজন যুবা তার প্রেমিকাকে তুলে নিয়েছে দু’হাত দিয়ে। মেয়েটি নাক ঘষে আদর করছে তাকে। বোধহয় এটা চোখে পড়ায় থমকালো লুসি। আর আমি পিছন থেকে গিয়ে ধরে ফেললাম লুসির হাতটা। ‘লুসি।’

দমকা একটা হাওয়া উত্তরের পুকুরের পাশ দিয়ে হেঁটে এসে আমার শরীর ছুঁয়ে দিল। হাওয়ায় অজস্র বুদবুদ। বুদবুদগুলোর ভিতরে পাক খায় অসংখ্য ঘোড়া মুখো রুই মাছ। হাওয়ায় উড়তে উড়তে, গাছে ধাক্কা খেতে খেতে বুদবুদগুলো মাটিতে এসে পড়ে। ফাটে না। ড্রপ খায়। হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টানে আমি লুসিকে নিয়ে এসেছিলাম আরো কাছে। ওর ঠোঁটের কাছে নামিয়ে এনেছিলাম আমার ঠোঁট। 

লুসি জানে না। সেই ছাত্রবয়স থেকে বাজারের গেলেই আমি ঘোড়ামুখো রুই মাছের খোঁজ করি। কেউ শোনেনি। শুধু একবার একজন মাছওয়ালা বলেছিল ভাঙন মাছ। সেটাই নাকি ঘোড়া মুখো রুই। 

শ্যামবাজারে আমাদের পাড়ায় কেউ বাঙালভাষায় কথা বলত না। বলত শুধু আমাদের বাড়িতে। পাটনা থেকে সেইবার ফেরার সময় বাবা আমার জন্য কিছু আনেনি। বাবাকে আনতে গিয়েছিল আমার দুই জ্যাঠা। 

বাবা তখন পুরো শিশুর মত। এসে বসেছিল আমাদের শোয়ার ঘরে। আর আমি দরজার বাইরে থেকে উঁকি মেরে মেরে বাবাকে দেখছিলাম। বাবা যে পালটে গিয়েছে সেটা বোঝার মত বয়স ততদিনে আমার হয়ে গিয়েছে। তবু একবার আমার মনে হয়েছিল বাবা বোধহয় আগের মত ডাকবে আমায়, পকেট থেকে বার করে দেবে লজেন্স। কিন্তু বাবা খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর, হঠাৎ নিচু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গিয়েছিল খাটের তলায়। টেনে বার করে এনেছিল আমার খেলনাগুলো। তারপর সেইগুলো নিয়ে খেলতে শুরু করেছিল একমনে। আমার একবার মনে হয়েছিল বাবার সাথে আমিও খেলব। কিন্তু মেজজ্যেঠি এসে আমায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল ওদের ঘরে। “বইয়্যা থাক চুপ কইর‍্যা। তোর বাপে পাগল হইয়্যা গ্যাসেগা। কামড়াইয়া দিব।” মেজজ্যেঠি মুখ টিপে হেসেছিল কথাটা বলার সময়। আমার খুব রাগ হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল মেজজ্যেঠির হাতটা কামড়ে দিয়ে ছুটে পালাই। 

সেইদিন বিকেলবেলাতেই আমি দেখেছিলাম দোতলার বারান্দায় হরিমোহনের খাঁচাটা দু’হাতে ধরে ঝাঁকাচ্ছিল বাবা। আর এক মনে বলে যাচ্ছিল, “বাইর হ, বাইর হ, আমার খাঁচায় হালা ঢুইক্যা বইস্যা আছে।” মেজজেঠির পোষা টিয়া হরিমোহন খাঁচা ভিতর ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চেঁচাচ্ছিল আর কখন ফাঁক বুঝে ঠুকরে দিয়েছিল বাবার হাতে। বাবার হাত থেকে রক্ত টপ টপ করে ঝরে পড়ছিল মেঝেতে। তারপর থেকে বাবাকে বেঁধে রাখা হত। 

বুদবুদগুলো ফেটে গিয়েছিল কখন জানি না। শুধু বেশ খানিক্ষণ লুসিকে চুমু খাওয়ার পর আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম পায়ের শব্দ। লুসির মুখ থেকে মুখ সরিয়ে আমি দেখতে পেয়েছিলাম ছেলেদুটোকে। কালো স্যান্ডো, চকচকে শর্ট পরা ছেলে দুটো দৌড়তে দৌড়তে ঘুরে আমাদের দেখছিল। তারপর দৌড়তে দৌড়তেই ওদের মধ্যে একজন সিটি দিয়েছিল খুব জোরে। 

লুসি শুধু আমাকে বলেছিল, ‘আমার বাড়ি চল।’ বাড়িতে আসার পর আমাকে বসিয়ে, লুসি চলে গিয়েছিল স্নান করতে। আর আমি একদৃষ্টে চেয়ে দেখছিলাম অ্যাকোয়্যারিয়ামটা। লুসি আবার বলল, ‘তোর অ্যাকোয়্যারিয়াম ভালো লাগে? মাছ ভালোবাসিস তুই?’ 

‘খেতে।’ আমি হেসেছিলাম। 

‘ধুর! হাঁ করে তো দেখছিলি। শালা। চা খাবি।’

‘হ্যাঁ। কফি হলে আরো ভালো হয়।’

চুল মুছতে মুছতেই কিচেনে ঢুকে গেল লুসি । আমি সরে এলাম জানলার কাছে। একতলায় পিছনের ফ্ল্যাট। হলদে একটা দেওয়াল দেখা যায় বাইরে। তার উপরে ওপাশের ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা। কাপড় শুকোতে দেওয়া আছে। বাবাকে বেঁধে রাখায় আপত্তি করেছিল মা। চেয়েছিল আমাদের শোবার ঘরেই থাকুক বাবা। মেজজ্যাঠা বুঝিয়েছিল, ‘বোঝতাসো না বউমা। ঘরে ওইটুকুন পোলাপান। সমীরের কী আর হুঁশজ্ঞান আছে? রাতদুপুরে যদি পোলাডার গলা টিপ্যা ধরে...।’ ‘হ, মাইঝ রাইতে মাইরা থুইলে!’ ফোড়ন কেটেছিল মেজজেঠিও। সেই রাত্রেও আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল হঠাৎ। অনেকগুলো কুকুর সুর করে ডেকে যাচ্ছিল দূরে কোথাও। আর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল দেওয়াল ঘড়িটার প্রতিটি সেকেন্ডের শব্দ। আর তার মধ্যেই আমি যেন টের পেয়েছিলাম মা কাঁদছে। মার শরীরের আরো কাছে সরে আসতে চেয়েছিলাম আমি যেন। আমার গায়ে হাত রেখেছিল মা। আর ঘুম জড়ানো গলায় আমি মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘মা সব পাগলরাই কী মানুষকে মেরে ফেলে?’ মা উত্তর দেয়নি। শুধু আমার গা থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে উপুড় হয়ে গিয়েছিল। তারপর বালিশে মুখ চেপে কেঁদে উঠেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। জানলার বাইরের স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো মৃদু ছাপ ফেলেছিল আমাদের দেওয়ালে। তার গায়ে লোহার শিকের লম্বা ছায়া।

অ্যাকোরিয়ামের পিছনে একটা গাছগাছালির ছবি। পিছনের কাচের সঙ্গে সাঁটা। অ্যাকোরিয়ামের নীচে সাদা আর নীল পাথরের কুচি। তার উপর কিছু সবুজ গাছ। একটা দুটো নুড়ি। নুড়ির উপর থমকে দাঁড়িয়ে ছিল একটা কালো মাছ। অনেকক্ষণ। তারপরেই হঠাৎ হেলে গিয়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ঢুকে গিয়েছিল বাঁদিকে ঘন গাছপালার ভিতরে। মিশে গিয়েছিল হঠাৎ। মাছটাকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ আমি দেখতে পেয়েছিলাম আমাদের কুয়োতলাটা। অ্যাকোরিয়ামের গাছটার গায়ে আমাদের দোতলা চৌকো বারান্দাটা। বারান্দার রেলিং-এর টানা শিকগুলো। অনেক নীচে কুয়োর পাশে মা আর বাবা। বাবা সম্পূর্ণ নগ্ন। শিশুর মত। বসে আছে চুপ করে। আর কুয়ো থেকে তুলে বালতি বালতি জল ঢালছে মা। বাবাকে নগ্ন দেখে আমি লজ্জা পাচ্ছি খুব। চিৎকার করে বলছি, ‘একি বাবা এমন কেন, মা।’ আসলে ন্যাংটো শব্দটা বোধহয় তখনও শিখিনি আমি। বা শিখলেও বলতে লজ্জা পেতাম। 

‘একি! মা মা করে চিৎকার করছিস কেন?’ লুসির হাতে একটা ট্রেতে দুটো চায়ের কাপ। একটা কমলা বাটিতে সেউভাজা। কয়েকটা কুকি। 

‘কী হয়েছে বলতো। তুই কী পাগল হয়ে গেলি নাকি। এত বড় ছেলে মা, মা করছিস একা দাঁড়িয়ে।’

‘তোকে ডাকছিলাম বোধহয়।’ আমি কথাটা বলি লুসির চোখে চোখ রেখে। 

‘আমি! তোর মা! শালা। লাথ মেরে বাড়ি থেকে বার করে দেব।’

আমি হেসে ফেলি। ‘আইনমাল ইস্ট কাইনমাল।’

‘মানে?’

‘ওয়ান্স ডাজন্ট কাউন্ট।’ ‘ধুর! আবার আঁতলামো করছিস। লিখিস তো ওই বালের টেলিভিশনের স্ক্রিপ্ট। আজকে তোর কী হয়েছে বলতো?’

লুসি বসে সোফার উপর। আমি এগিয়ে যাই। চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিই। 

‘আজকে তোর হঠাৎ এত সাহস বেড়ে গেল?’

‘কীসের সাহস!’

লুসি ঠোঁটটা টিপে হাসল। চোখ মেলে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। চায়ের কাপটা রেখে আমি আবার এগিয়ে গেলাম লুসির দিকে। লুসিকে চুমু খেতে খেতে আমার মনে পড়ল নির্জন সেই দুপুরটার কথা। 

খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিল বাড়ির সবাই। মা ছিল না। মেজজেঠির হরিমোহন খাঁচার বারান্দার দিকে পিঠ দিয়ে বসে ছিল রোদের দিক মুখ করে। বোধহয় আকাশ দেখছিল। মাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি নেমে গিয়েছিলাম সিঁড়ি দিয়ে। চলে গিয়েছিলাম চিলতে ঘরটার সামনে। ঘরের শিকল খোলা। ভেজানো দরজার মাঝে আলতো ফাঁক। আমি উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম শিকল বাঁধা আমার বাবাকে। মা একটা থালা থেকে ভাত মেখে বাবাকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর ভাতটা মুখে নিয়ে টোপলা করে বসে আছে বাবা। মা বলছে, ‘খাইয়া লও, চিবাও। কী গো। খাইবা না।’

চুপ করে তক্তপোষে বসা বাবা হঠাৎ বাঁধা হাতদুটো দিয়ে ধাক্কা দিল মায়ের থালাটাকে। চিৎকার করে উঠল, ‘হুউউউউ। ছাড় আমারে। ছাড়। আমার রক্ত আমারেই খাওয়াস তুই ভাত কইয়্যা। খানকী। বারো ভাতারি মাগি।’

বাবার চিৎকার শুনে আমার ভয় করেছিল খুব। সরে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত জোরে নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম আমি। তারপর দৌড়ে উঠে গিয়েছিলাম সিঁড়ি দিয়ে। রেলিং-এর উপর, ছাদ থেকে ঝোলা হরিমোহনের খাঁচা ছিল আমার নাগালের বাইরে। তাই বারান্দার আরেকপ্রান্ত থেকে টুলটা টেনে নিয়ে এসে আমি উঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার উপর। তারপর উঠে খুলে দিতে গিয়েছিলাম খাঁচাটা। আর মেজজেঠি ঠিক সেই সময়েই কীভাবে যেন ঘুম থেকে উঠে ছুটে এসেছিল।

‘বান্দর পোলা। বাপে পাগল হইসে, ইনিও কম যান না। যত আপদ আমাগো। বলি হেডা তোর বাপে তো তোগো খাওয়াইবো না আর। খাওয়াইবোটা কেডায়?’

আমি আবার দৌড় দিয়েছিলাম। এইবার ছাদে। দুপুরের রোদের ছাদের মেঝে তেতে ছিল। ওলটানো কড়াইয়ের মত আকাশটায় পাক খাচ্ছিল দুটো ঘুড়ি। একটা আরেকটার গায়ে গায়ে। মেজ জেঠিও পিছনে তেড়ে এসেছিল আমার। চড়টা খেতে খেতেই আকাশে মাথা তুলে আমি দেখেছিলাম একটা ঘুড়ির পড়ে যাওয়া। কারা যেন চিৎকার করে উঠেছিল ভোক্কাট্টা। 

চুমু খেতে খেতে লুসিকে আমি প্রায় শুইয়ে ফেলেছি সোফার উপর। চেপে বসেছি ওর উপর। লুসির নিঃশ্বাস ফেলছিল খুব জোরে। বোধহয় কিছু বলতেও চাইছিল। 

বাবা মারা যাওয়ার পর আমি যেদিন কাছা ছাড়লাম। তারপরের দিনই আমাকে আর মাকে নেমে যেতে হয়েছিল নীচে। সিঁড়ির তলায়। কয়েকমাসের মধ্যেই মা যেন কেমন একটা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ঘরটা তখন বরুণদার। বরুণদা মেজজ্যাঠার ছেলে। 

রাতে সিঁড়ির তলায় গাদাগাদি করে শুতাম আমি আর মা। মায়ের হাতে আমি ছাইয়ের গন্ধ পেতাম। শোয়ার আগে বাসন মাজত আমার মা। কখনও কখনও টিকটিকি হেঁটে যেত আমাদের মাথার উপরে হেলানো সিড়ির নীচ দিয়ে। আমি উপুড় হয়ে শুতাম সব সময়। আমার ভয় করত যদি চিত হয়ে শুলে আমার হাঁ করা মুখের ভেতরে টিকটিকি ঢুকে যায়। 

আমাদের পুরোনো বাড়িটা। দোতালার চৌকো বারান্দাটা। সিঁড়ির রেলিং, হরিমোহনের খাঁচা সব যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছিল আমার কাছে। চিলতে ঘরটার শিকলে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল বোধহয় সেজজ্যেঠা। দুপুরগুলো মা ওপরে কাজ করতে গেলে আমি ওই দরজাটার সামনে দাঁড়াতাম। আমার স্থির বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল একটা প্রকান্ড ঘোড়ামুখো রুই মাছ ওই ঘরের ভেতরের বাতাসের সাঁতার কাটে। দরজার এপার থেকে আমি তার পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ পেতাম। আর রাত্রে ঘুমের ভিতর, আমার বাবা, সেই ঘোড়ামুখো রুই মাছটার পিঠে চেপে নেমে আসত আমাদের কুয়োতলার উঠোনে। বাবার শরীরে পোশাক থাকত না। কিন্তু টিভিতে দেখা ঘোড়সওয়ারের মত বাবা দু’পা দিয়ে কষে চাপ দিলে মাছটা একলাফে উঠে যেত দোতালার বারান্দায়। বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে ডাকত বাবা। “ছিপখান লুকাইয়া রাইখ্যা কী হইল, হেই আমার মাছ আমি ধইর‍্যাই ছাড়ছি। টফি খাবি?’

আমি নীচ থেকে চিৎকার করতাম। ‘বাবা রেলিং এ উঠো না বাবা। পড়ে যাবে। তোমার ছিপ আমি লুকিয়ে রাখিনি। সত্যি বলছি বাবা।’

বাবা বলত, ‘সইত্য। আমি জানি রে বুলু। ছিপ তোর কাছে নাই। এই দেখ।’ বলেই বাবা ঘোড়া মুখো রুই মাছটার পিঠে কাছ থেকে একটা প্রকান্ড ছিপ ঝুলিয়ে দিত দোতলা থেকে। আর আমাদের বাড়িটা, উঠোনটা, সিঁড়ির তলাটা সব ডুবে যেত জলের তলায়। সেই জলে ভাসতে ভাসতে আমি ছিপটা আঁকড়ে ধরতে চাইতাম প্রাণপণে। 

লুসির সঙ্গে আজ হঠাৎ এতটা এগিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। আসলে লুসিকে গত কয়েকদিন ধরে আমার বেশ বিরক্তিকর লাগছিল। আজ দুপুরেই হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছিলাম আমি। ‘আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দেখা না করাই ভালো।’ লুসি পালটা উত্তর দেয়নি। শুধু একটু পরে ফোন করে আমাকে বলেছিল, ‘আজ একবার দেখা কর।’ 

ইউনিভার্সিটির ক্যানটিনের ভেতর বসে লুসি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কেন?’

‘কী কেন?’

‘হোয়াটসঅ্যাপটা কেন? আমার সঙ্গে দেখা করতে চাস না কেন?’

‘আমার ভালো লাগছে না লুসি।’ লুসি চুপ করে গিয়েছিল। আমিও। মুখোমুখি বসেও আমরা দেখছিলাম না পরস্পরকে। 

আর এখন এই যে লুসি, সোফার উপর, পোশাক আলুথালু, এখন আমাকে নিয়ে কী ভাবছে? লুসি কী ভাবছে আমার এখন সত্যিই ওকে ভালোলাগছে? সত্যিই কী লুসিকে ভালো লাগছে আমার? আমি লুসির শরীর থেকে গেঞ্জিটা সরিয়ে ওর স্তন দুটো অনাবৃত করে দিচ্ছিলাম। 

জোর হাওয়ার ধাক্কায় ঠোকাঠুকি লেগে শব্দ করছিল একটা টিন। রাশিরাশি বুদবুদ গড়িয়ে নেমে আসছিল সিঁড়ি দিয়ে। দোতালার বারান্দায় হরিমোহন টি টি করে ডেকে উঠেছিল একবার। দুটো টিকটিকি নেচে বেড়াচ্ছিল আমার মাথার ওপরে। সিঁড়ির নীচে। অন্ধকারে ভয় পেয়ে আমি মাকে খুঁজেছিলাম। আমার পাশ থেকে কখন উঠে গিয়েছিল মা। ভয়ে আমি উঠে বসেছিলাম তক্তপোষের উপর। ‘মা, মা।’ খুব আস্তে আমি ডেকেছিলাম একবার। যদি মেজজেঠির ঘুম ভেঙে যায় জোরে ডাকলে। মার কোনো সাড়া পাইনি। তক্তপোষ থেকে আমি নেমে এসেছিলাম কলপাড়ে। সেই প্রথম আমি উপরে তাকিয়ে আবিস্কার করেছিলাম আমাদের বাড়িটা চৌকো নয় মোটেই। বরং একটু বাঁকা। রাতের আকাশে কয়েকটা নিভু নিভু তারা ঝিম মেরে পড়েছিল। আমি দেখেছিলাম সেজজ্যাঠার ঘরের আলো জ্বলছে। অন্ধকার সিঁড়িটা। অন্ধকার কলতলা। অন্ধকার উপরের দোতালা বারান্দা। নিঝুম। আমার পিঠের কাছটা শিরশির করছিল।

ভয় পেয়েই আমি দৌড়ে উঠে গিয়েছিলাম উপরে। কালো বারান্দায় সেজজ্যাঠার ঘরের আলোর সামান্য আভাস। আমি ছুট লাগিয়েছিলাম সেজজ্যাঠার ঘরের দিকে। বন্ধ দরজার ওপারে আবছা গলার আওয়াজ। মায়ের! মায়েরই তো। আমি ভেবেছিলাম ডাকব। ‘মা, ভয় করছে। মা তুমি এইখানে কী করছ।’

অন্ধকারের শব্দ করে উড়ে গিয়েছিল কয়েকটা চামচিকে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিলাম আমাদের বারান্দার রেলিং-এ দাঁড়িয়ে বাবা। আর অন্ধকার বারান্দার উপরে শুয়ে আছে একটা প্রকান্ড মাছ। মাছটার মাথাটা ঠিক ঘোড়ার মত। কেশর আছে। আমি কী করব বুঝতে না পেরে আবার দৌড়ালাম উলটো দিকে সিড়ি দিয়ে উঠে গেলাম ছাদে। মাথার উপর প্রকান্ড গোল একটা আকাশ। আমার পায়ের ধাক্কায় যেন টাল খেয়ে গেল পৃথিবী। আকাশটা আমার পায়ের তলায় চলে এলো। আর মাথার উপরে আমাদের প্রকান্ড বাড়িখানা। উলটো। সেজজেঠার ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। কড়াইয়ের মত আকাশটার ঢাল বেয়ে নেমে আবার উঠছিলাম আমি। আমার পায়ে বিঁধছিল ধারালো তারারা। ঘোড়ামুখো অসংখ্য রুইমাছ আমার মাথার উপর। বাড়িটার নীচে। কিন্তু বাবা কোথাও নেই।

পরের দিন সকালে হরিমোহনের খাঁচার দরজা খোলা দেখেছিল মেজজেঠি। হরিমোহনকে পাওয়া যায়নি। শুধু পাওয়া গিয়েছিল কয়েকটা টিয়া পাখির সবুজ পালক। কয়েক ফোঁটা পাখির রক্ত বারান্দার মেঝেতে। বারান্দার টুলটা যেমন ছিল তেমনই। শুধু পাশের বাড়ির মোটা কেঁদো বেড়ালটাকে দেখে কিছুদিন তেড়ে যেত মেজজ্যেঠি। ঠিক কতদিন জানি না। কারণ তার আগেই আমাকে হস্টেলে রেখে এসেছিল সেজজ্যাঠা।

লুসিকে টেনে আমি নামিয়ে এনেছি মাটির উপর। লুসি কিছু একটা বলছিল। বোধহয় বলছিল,‘ এখন ভালোলাগছে তোর তাই না।’ এই কথার উত্তর দিই নি আমি। আমরা লুসির ঘরে আর নেই। পুরো ঘরটাই স্বচ্ছ কাচের। প্রকান্ড অ্যাকোরিয়াম। মিথ্যে ল্যান্ডস্কেপের সামনে, লাল কালো ভেসে যাওয়া মাছগুলোর মধ্যে আমার দু’হাতে ধরা লুসি। আমি লুসিকে ধরে তুলছি আমার মাথার উপর। আবার নামাচ্ছি। আবার তুলছি আবার নামাচ্ছি। লুসির পিছনে জলজ গাছগুলোর ভেতরে আমাদের কুয়োতলাটা। মাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কাকে যেন স্নান করাচ্ছে মা। কাকে সেটা দেখা যাচ্ছে না। ঢেকে যাচ্ছে লুসির শরীরে। আমি দেখতেও চাইনা। আইনমাল ইস্ট কাইনমাল। ওয়ান্স ডাজন্ট কাউন্ট। 

অবশ্য লুসিকে এইসব কিছুই বলব না আমি। যেমন বলব না আজ আমার বাবার মৃত্যুদিন ছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ