এই হাটকে হামেদ খাঁ’র হাটখোলা বলে ডাকে লোকজন এই অঞ্চলে। একটা বিশাল কাঠের সেতু পেরিয়ে হাটে পৌঁছাতে হয়। সপ্তাহে ২ দিন এই হাট বসবে। মঙ্গল ও শুক্র। পাশের বড় বন্দর হলো পিঙ্গলাকাঠি। নৌকা বোঝাই করে পণ্য এসে হাজির হবে আড়িয়াল খাঁ নদী ধরে। কালকিনি থানায় এই হামেদ খাঁর হাটের সুনাম
আছে।
আসিফ মেমোরিয়াল স্কুলের পাশেই একটা কাঠের ঘাট নিচে নেমে আড়িয়াল খাঁ নদীটার গায়ে গায়ে। দীর্ঘ পানি ঘষে ঘষে শ্যাওলা পিচ্ছিল। কুমোর উদয় পাল নৌকার
পাশে ও মাচায় লাল কালো পোড়া রঙের হাড়ি পাতিল সাজাতে থাকে সকালের রোদ থাকতে থাকতে। বউ তাকে সাহায্য করছে নৌকায় তুলতে। ছোট ছেলেটা ন্যাংটা কোমরে ঘুঙ্গুর বাঁধা,টুনটুন ঘুরে বেড়াচ্ছে রোদের ভাসানে।
আজ মঙ্গলবার হাট। আজ যা বিক্রি করবে তাতে তার সংসার,মাটি কেনার,লাকড়ি কেনার পাওনা মেটাবে সুদে আসলে। বউয়ের সিঁথির রঙ রোদের ঝলসানে ফ্যাকাশে। অনেকক্ষণ উপবাসের শুকনো লাবণ্যহীন মুখ। সারাক্ষণ ধমকের উপর যার জীবন,ভাত,বেঁচে থাকা;তার এসব স্বামী খ্যাঁক খ্যাঁকে কিছু যায় আসে না। সময় সময় এই সব হাড়ি পাতিল হাটখোলায় পৌঁছাতে হবে।
ঘাটের ইজারাদার হাওলাদার ছাতা মাথায় পায়চারী করছে। রসিদ বই নিয়ে ব্যস্ত। টোল আদায় বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। হাওলাদার জোরে চ্যাঁচায়;
: এই নমোর পুত,হবিরে (জলদি) নৌকা ছাড়। আজ কোলম সব কেরায়া একলগে দিবি ( আজ কিন্তু সব ভাড়া একসাথে দিবি )
উদয় পাল ঘামে ভিজে তেলতেলে। মিনমিন করে যা বলে তার সংক্ষেপ হলো;
: সব দেমা হানে ( সব দিব )
খাড়া রোদের একটা দাপট আছে,নদীর স্রোতে চিকচিক করে। মাঝি নৌকা তামুক ধরায়। ভাঙ্গা গাল ফুলিয়ে হুক্কার মাচানে জোরে ফুঁ দেয় নদীর বাতাস ছাপিয়ে। নৌকা ছাড়ার আগে একবার জুত করে তামুক সেবন না করলে আবার কখন যে সে সুযোগ পাওয়া যাবে। জোয়ার না ধরতে পারলে ভাটাতে নৌকা বাওয়া কঠিন,কষ্টের। আবার এর মাঝে তার প্রস্রাব চেপেছে। পাশে কাশবন আছে। লুঙ্গিটা তুলে বসে পড়লেই হয়। গলা খাকারি দিয়ে মাঝি হুক্কাটা হাতে নিয়েই একটু ঝোপ দেখে বসে পড়ে। রোদের পর এই ঝোপ ছায়ায় সে ত্যাগ করতে করতে আরাম বোধ করে। চোখ বন্ধ করে আবার তাকিয়ে কুমোরের বউটাকে দেখে। ঘামে জুবজুব বউ।
মাঝি ভুস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। একটা অচেনা হাহাকার। হায়রে সেই যৌবন আর নেই। নিজের নিস্তরঙ্গ সাড়া না দেয়া শরীর দিন দিন কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝি ঝুপ করে উঠে পড়ে কাজ শেষ করে। চিন্তাটাকে হুক্কায় বড় এক টান দিয়ে চিমনীর মতো ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। দূরের পিঙ্গলাকাঠির পূবে টুকরো মেঘ। না জানি কখন বৃষ্টি নামবে নদী কাঁপিয়ে।
নৌকা ছেড়ে দিতেই ছোট ছেলেটা কুটুস করে বউয়ের সাথে নৌকায় উঠে বসে। কুমোর হৈ রৈ করে উঠেছিল ছেলের নৌকায় উঠে আসা দেখে। এই ছেলেকে হাটে নিয়ে আসা মানে হলো একে এখন ৬/৭ ঘন্টা দেখে রাখা। খাওয়ানো,হাটের মধ্যে পায়খানা প্রস্রাব করানো-এক বিশাল ঝামেলা। বউ মনে মনে খুশি। স্বামীর চিৎকার পাত্তা না দিয়ে আঁচল দিয়ে ছোট ছেলের গায়ের ঘাম মুছে দেয়। নৌকার মাঝে রাখা পোটলা থেকে একটা ইলাস্টিক হাফ প্যান্ট পরিয়ে দেয়।
যত্ন করে আঁচলে বেঁধে রাখা ২টা বাতাসা খেতে দিলো। সাথে কাঁসার গেলাসে ঢকঢক জল। মা মুখ ঝামটা মেরে স্বামীর দিকে না তাকিয়েই বলে;
: ও গেলে সমেস্যাডা কি? বাড়িতে একলা থাকবে আনে কেমনে? হে লইয়া তোমার ভাবতে হইবে না তো। মুই আছি কি হরতে?
( ও গেলে সমস্যা কি? বাড়িতে ও একা কেমন করে থাকবে? এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি আছি কি করতে?)
কুমোর গজ গজ করলো। বউয়ের চৌদ্দগুষ্টি নিয়ে মনে মনে গালাগালি করল।
: মাঝি ভাই,নৌকা ছাড়েন।
বৈঠা বা্ওয়া হালের ক্যাঁচরক্যাঁচর শব্দে কেরায়া নৌকা নদীর পাশ ধরে যাত্রা শুরু করে। মাঝি গামছা দিয়ে মাথা বাঁধে,রোদ ঠেকায়। কি যেন সুরা পড়ে।
: এই নমোর পোলা,ভগবানের নাম নিছস?
বউ বড় করে ঘোমটা মাথায় তুলে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে। দুর্গা দুর্গা।
*
নদীর পাড় ঘেঁষেই এই সব বীর লাঠিয়ালদের বসার জায়গা..খানা খাদ্য বিড়ি সিগারেট,লা রে লা প্পা গানের আসর। লাঠিয়ালদের তেমন কোনো কাজ নেই। হাট কমিটির ভাড়াটে। এতদ অঞ্চলে প্রচুর চর,জায়গা দখলের লড়াই আছে নিরন্তর। হামেদ খাঁ’ প্রতিপত্তির মানুষ। তার অনুগত দাসানুদাস এই বাহিনী। হাটের শৃংখলার নামে হামেদ খাঁ’র আধিপত্য দখলের প্রতীক ওরা। সরিষার তেল মাখা সুঠাম এসব পুরুষের হাতের মাসল,লুঙ্গি মালকোচা করে পরার একটা দর্শনমূল্য আছে। নিরীহ মানুষ সপ্রশংস তাকায় গোল হয়ে বসে থাকা এইসব তেলাক্রান্ত মানুষের দিকে।
দূর দূরান্ত থেকে বোঝাই পণ্য আসে নৌকায়,ঘাটে ভিড়ে,গলুইয়ে বসে থাকা ক্লান্ত মাঝির হাঁক ডাকে মুখরিত হয়। নৌকার ছইয়ে শাড়ি দিয়ে পর্দা ঘেরা থাকলে লাঠিয়ালকূল নড়েচড়ে বসে। উৎসাহী কেউ কেউ গ্রাম্য ধ্বনি করে ওঠে।
: এ মনু চুপ কর তো। জিনিষ নামবে..
জিনিষ মানে হলো মেয়ে।
দুপুরের গনগন সূর্য খানিকটা পশ্চিমে হেলতেই উদয় পাল,তার বউ,তার ছোট ছেলে সহ মাটির হাড়ি পাতিল বোঝাই নৌকা ঘাটে এসে হুস করে ভেড়ে। আগে থেকে হাটের কামলা জাতীয় লোক রেডি। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যায় আড়িয়াল খাঁর পাড়ে। নামতে থাকে নানা রঙের নানা ডিজাইনের মাটির বাসনপত্র।
উদয় পাল তটস্থ থাকে। হেই হেই করে ‘সাবধান সাবধান’ বললেও কিছু ভাঙ্গবেই। উদয় পাল ময়লা ধুতির কোচড় থেকে পকেট বই বের করে পেন্সিল দিয়ে লিখে রাখতে চেষ্টা করে।
হাট পাড়ে নামার সময় ভাঙ্গার তালিকা:
১. কালো সরা ( ঢাকনি)-৬ খানা
২.বড় পাতিল-২ খানা
৩.জামাই ভান্ড-৩ খানা
৪.চিতই পিঠার কলোই-৪ খানা
ইলাস্টিক হাফ প্যান্ট পরা ছোট ছেলেটা চঞ্চল হয়ে ওঠে নৌকা থেকে নেমে। মায়ের গা ঘেঁষে ফিসফিস করে;
: ও মা মুতমু
মা খুব গুরুত্ব না দিয়ে চোখের এক দিক ইশারা করে বলল;
: ওইহানে বইসা পড়ো বাবা
মা’টা নদী পাড়ে পাতিল নামানোর বিলম্ব দেখে উসখুস করে। লাঠিয়ালদের দেখে তার ভালো লাগছে না। বাইম মাছ তার একদম পছন্দ না। লোকগুলোকে বাইম মাছের মতো পিচ্ছিল লাগে। ওদের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে,ওরা ‘জিনিষ’ মাপছে।
*
উদয় কুমোরের মন ফুরফুরে। তার বানানো কালো রঙের ছোট কলসিগুলো হু হু বিক্রি হচ্ছে আজ। সামনে শীতকাল আসছে। খেজুরের রস সংগ্রহ করা লোকজন,যাদেরকে স্থানীয় ভাষায় শিয়ালী বলে তারা দেদারসে কিনছে এই ঠিলা ( ছোট কলসি)। রসের বড় বড় হাড়িও বিক্রি হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আজ আর মালসামান বাড়ি ফেরত নিতে হবে না। ধুতির কোঁচড়ে ভাংতি পয়সা,টাকা জমতে থাকে। বেশির ভাগ টাকাই ময়লা তবুও উদয় কেমন যেন হাটের লোকজনের ভিড়-গরম ছাপিয়ে অন্য রকম মাদকতা উপভোগ করে। হাটের ভিড়,মানুষের ঘামের গন্ধ,দূরে নদী পাড়ের হাওলাদার রাইস মিলের ভট ভট শব্দ সব সুরের যাদু লাগে।
রঙচঙা পোশাক পরা এক লোক মজার এক সাজে বায়োস্কোপ দেখাচ্ছে ডুগডুগি বাজিয়ে। ছোটদের লম্বা লাইন পড়ে গেছে। এক আনা দিলেই শো দেখা যাবে। এক সাথে ৪ জন উবু হয়ে দেখতে পারে। বায়োস্কোপের ভেতরে সিনেমার কেটে ফেলা রিলের সমাহার।
ছেলেরা দেখছে। লোকটা ডুগডুগি বাজিয়ে গান করছে;
কী চমেতকার দেখা গেলে
উত্তম সুচিত্রা আইয়া পড়লে।
তারপরেতে কি হবে
শান্ত হইয়া দাঁড়ান সবে
সাবিহা ইউসুফ আসতে আছে
প্রেমের ডালিম ধরে গাছে।
উদয়ের ছেলেটা মায়ের আঁচল ধরে খুটমুট করে। তার মন অস্থির কখন সে বায়োস্কোপ দেখবে। মা কনুই দিয়ে আলতো করে স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। উদয় আজ অন্যরকম হাজী মুহাম্মদ মহসিন। কোমর থেকে সাবধানে কয়েকটা টাকা বের করে বউয়ের হাতে দেয়। নাভারন কোম্পানীর একটা বিড়ি ফস করে ধরিয়ে গম্ভীর মুখে বলল;
: যাও পোলারে সিনেমা দেহাইয়া আনো। তুমিও গরম জিলাপি খাইও
বউ ঝামটা মেরে ওঠে;
:ক্যা এই সব কাম তুমি একলা হরছো? মুই করি নাই? টাহা দেবার বেলায় মুখটা পাতিলের তলার লাহান করো ক্যা? টাহার কোলাম মোরও ভাগ আছে।
( কেন এসব কাজ কি তুমি একা করেছো? আমি করিনি? টাকা দেবার বেলায় মুখটা পাতিলের তলার মতো কেনো করছো? টাকার কিন্তু আমারও ভাগ আছে)
ছেলেকে বায়োস্কোপের লাইনে দাঁড় করিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে সাবধান করে মা।
: খবরদার,কোনোহানে যাবি না। এহেনে দাঁড়াইয়া থাক। মুই যামু আর আমু।
ছেলেটা মহা আনন্দে লাইনে দাঁড়ায়। বউ ভিড় বাঁচিয়ে মাথায় আঁচল তুলে গরম জিলাপির খোঁজে দ্রুত ইতিউতি তাকায়।
যে লোকটা মাটির চুলায় বিশাল কড়াই বসিয়ে জিলাপি বিক্রি করছে,তার সহকারী গরম তেলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ময়দার কাই ছেড়ে দিচ্ছে। টগবগ করছে গরম তেল। বউ আঙ্গুল তুলে জিলাপি দেখিয়ে বলে;
: মোরে ২ পোয়া দেন তো
কে যেন বউটার ঘাড় বরাবর এসে দাঁড়ায়। জিলাপির ঘ্রাণ ছাপিয়ে ত্রিফলা তেলের ঘ্রাণ। কানের কাছে সেই পরাণ উতলা হুম হুম শব্দ।
উহুম না উহুম না..
জিলাপির গরম ঠোঙ্গা হাতে নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মাথা থেকে বিবর্ণ আঁচল খসে পড়ে। চমকে ওঠে প্রায় সন্ধ্যার ওড়না কালো অন্ধকারে।
*
মেদাকুল বাজার থেকে এই হাটের দূরত্ব আছে বেশ। মেদাকুল বাজারের পাশ ঘিরে বেশ কতোগুলো পুরানো মন্দির আছে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যে নদীটা ঘেঁষে চলে গেছে দূরে,এই নদী পথই শেষে কালকিনি হয়ে হামেদখাঁর হাট। মন্দিরের পাশের লাগোয়া গ্রামটাতে অনেকগুলো বেহারা সম্প্রদায়ের বাস। তাদের আলাদা মন্দির,আলাদা পুকুর,আলাদা ডিপ টিউবওয়েল। আজকাল বেহারাদের পড়ন্ত মওসুম। জমি জিরাত নেই বললেই চলে। বিয়েতেও আজকাল লোকজন খুব একটা পালকি ব্যবহার করে না বলেই এই পেশার পসার নেই। বেহারার ছেলে পড়াশুনা শিখে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে,চাকরি খোঁজে। আস্তে আস্তে খালি হয়ে যাচ্ছে এই বসত গ্রাম।
তুলসীরাম কাহার যখন স্কুলে যেত তখন অনেকদিন তাকে স্কুলের বারান্দায় বসে থাকতে হতো। ক্লাসের বেঞ্চিতে বসতে পারত না। নিম্ন বর্ণের হিন্দু এই কাহার। তুলসীরাম কয়েকদিন কান্নাকাটি করলে স্কুলের হেড মাস্টার তাকে বুঝিয়েছে যে কাহারদের উৎপত্তি হয়েছে নিম্নবর্ণের এক হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এবং এ শ্রেণি ব্রাহ্মণ পিতা ও চন্ডাল মাতার বংশোদ্ভূত এক মিশ্রবর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী। কাহারগণ অবশ্য নিজেদের মগধের রাজা ‘জরাসন্ধের’ বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। একই সামাজিক মর্যাদার অন্যান্য বর্ণের অনুসৃত ধর্মের মতোই কাহারদের ধর্ম। তাদের অধিকাংশই শিব বা শক্তির পূজারী এবং তাদের মধ্যে বৈষ্ণবদের সংখ্যা ন্যূন। সামাজিক বিচারে কাহারগণ কুর্মি ও গোয়ালা বর্ণের সমকক্ষ।
প্রচণ্ড গরমে যখন তুলসীরামের গলা শুকিয়ে চৌচির তখন নিবেদিতা লুকিয়ে জল এনে দিত এই তুলসীরামকে। এতো সুন্দর চোখ আর টেরিকাটা চুল,চুলে সুবাসিত রিগার্ডের ত্রিফলা তেল। তুলসী যখন গ্রামের পথ ধরে বই খাতা হাতে নিয়ে হেঁটে যেত,নিবেদিতা টের পেত মৌ মৌ ত্রিফলা আর পালকি বহনের সেই ধ্বনি
উহুম না উহুম না...
মেদাকুল বাজারে সন্ধ্যা নেমে এলে উলুধ্বনি বেজে ওঠে। শংখ ফুঁ। একটা বট গাছের ডালে ঝুলে থাকা সারি সারি বাদুরের কোলাহল ছাপিয়ে তুলসীরাম জোরে জোরে বলত;
সাড়ে চারশো বছর আগে ভারতে এক কবি খুন হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম তুকারাম। শূদ্র কবিতা লিখতে পারবে না এই অজুহাতে ব্রাহ্মণেরা তাঁর কবিতা নদীর জলে ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু মরাঠিরা বিশ্বাস করে তাঁর কবিতা জল থেকে উঠে এসেছিল। মাত্র ৩৮ বছরে তুকারামকে সরিয়ে দিয়েছিল জাতের নামে বজ্জাতি করা অভিজাতরা।
সন্ধ্যা নেমে রাত হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে তুলসীরাম একাকী বসে থাকে বট গাছের মায়ায়। হু হু করে কান্না জেগে থাকে তার বুকের সাথে।
বার্তা রটে গেল মেদাকুল সহ আশে পাশের গ্রামে।
*
বেহারা নিচু জাত। শূদ্র। অসৎ শূদ্র। যার ছায়া মাড়ানো পাপ। নিবেদিতারা নমশূদ্র। কৃষিকাজ করা সম্প্রদায়। নিবেদিতা এসব বোঝে না ভালো করে। আকুল হয়ে উঠেছিল তুলসীরামের কবিতা আর চুলের ভুরভুর সুঘ্রাণে।
বার্থী স্কুলের পাশেই এক মন্দির। বিশাল মন্দির। ভট্টাচার্য মশায় সম্মানিত মানুষ। নামী ব্রাহ্মণ। একবার তার ছেলে মেদাকুল বেড়াতে এলে বিকালে বেরিয়েছে স্বজন বিহারে স্থানীয় মন্দিরে। গ্রামের অসমতল কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় রাস্তা ভেঙ্গে যাবার পর আর মেরামত হয়নি। একই রাস্তা করে বাড়ি ফিরছিল প্রায় সন্ধ্যায় তুলসীরাম। পারিষদ তুলসীকে দেখেই ইশারা করে ব্রাহ্মণের ১২ বছরের ছেলেকে গড় প্রণাম করতে।
তুলসী তখন মেট্রিক দেবে। সে তার পরিপাটি চুল কপাল থেকে সরিয়ে বিদ্রোহ করে ওঠে। কেন সে গড় প্রণাম করবে এই বালককে? যে তার কনিষ্ঠ।
মুহূর্তে এই অধর্ম,নরক সমান পাপ খবর ছড়ালো গ্রামময়। বিরাট অধর্ম। পাপ পাপ পাপ। তুলসীরামের বাবাকে মাথা নত করে সালিশে বসালো পুরুত সকল। গ্রাম ছাড়া করা হলো এই বেহারা পরিবার। গোপালগঞ্জ মহকুমার কোটালিপাড়া থানায় তুলসীরামের বাবার দূর সম্পর্কের এক দিদি আছে। ওখানে উঠল সবাই কোনক্রমে। তুলসীর মেট্রিক দেয়া অনিশ্চিত।
এই কোটালিপাড়ায় এক মিশনারী আছে। ফাদার এক বৃষ্টি ভেজা শনিবার সকালে এই পরিবারকে ডেকে পানি ছিটিয়ে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করলেন। ফাদার বললেন;
পবিত্র আত্মার অনুভূতি প্রাপ্তি, যা আমাদের জিহ্বার সাহায্যে কথা বলার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, প্রমাণ যে আমরা স্বর্গরাজ্যের উত্তরাধিকার
পদ পরিষ্কার করার আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় পুরো পরিবারকে প্রভূ যীশুর সাথে একটি অংশের অংশীদারিত্বের সুযোগ করে দেয়া হলো। ফাদার স্মরণ করিয়ে দিলেন যে একজন ব্যক্তির অবশ্যই প্রেম, পবিত্রতা, নম্রতা, ক্ষমাশীলতা এবং পরার্থপরায়ণতা থাকবে। পানি বা ওয়াটার ব্যাপ্টিজমের মাধ্যমে যীশু খ্রিস্টের নামে তাদের পদ ধৌতকরণ করা হলো।
পরিবারটি প্রাণে বাঁচল। ফাদার তুলসীরামকে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন।
নিবেদিতার তখন পার্বতী দশা। হু হু উদাস হুতাসন। ধরে বেঁধে নিবেদিতাকে বিশাল পণে বিয়ে দেয়া হলো কুমোর উদয় পালের সাথে পিঙ্গলাকাঠি গ্রামে।
*
: ওরে মোর দুইন্যা। এ আমি কারে দেখতে আছি। তুলসীদা। পেরনাম।
: চিনতে পেরেছো? বাহ
: ওরে এইয়া কি কও। তোমারে চিনমু না মুই? কও কি! মাথায় এহনো হেই ত্যাল মাহো?
: না মাখি না। আজই মাখলাম।
: তুলসীদা তোমার ভাষা কোলম বদলাইয়া গেছে। কেমন কইরা জানি কতা কও। নদীয়া শান্তিপুরের লাহান।
তুলসী জবাব দেয় না। মৃদু হাসে। বিকেলের পারাণির কড়ি সুন্দর রোদ তেরসা করে ওদের মুখে পড়ে। নিবেদিতা হাটের ভিড়ের মাঝে আবার বড় করে ঘোমটা টেনে নেয়। জিলাপির দাম শোধ করে ঠোঙ্গা হাতে নেয়। ঠোঙ্গাটা তুলসীকে ইশারায় দেখিয়ে জানতে চায় খাবে কিনা। তুলসী মাথা নাড়ে,খাবে না। ভিড় এড়িয়ে দুজন খুব নিকট করে হাঁটতে থাকে। নিবেদিতার গন্তব্য বায়োস্কোপের ওখানে,ছেলেকে লাইনে দাঁড় করিয়ে এসেছে। তুলসীর কোনো গন্তব্য নেই।
একটা নদী ভাসানের মতো। স্রোতের গতির মতো,ভাসতে ভাসতে যেদিকে যাক,কোনো মোহনায় বা কোনো বড় নদীর বক্ষে। এই তো ধুলো মাটি পথ। এই তো সেই মানুষের কোলাহল,ভিড়,এই তো মানুষে মানুষে আলাদা আলাদা জাত,ধর্ম। আলাদা মুখ,আলাদা ঘাম,আলাদা ঘ্রাণ।
ভিড়ের কোনো জাত পাত নেই। কলাপাতার মতো বাতাসে দোলে,কলাপাতার মতো সব খাবারই বুকে ধারণ করে।
এক বিঘারও কম দূরত্ব রেখে দুজন পাশাপাশি হাঁটে,কখনো আলতো করে গা লেগে যায় দুজনের ভিড়ের শ্লাঘায়। চমকে ওঠে দুজন। কতো কতো প্রশ্ন বুদবুদ করে উঠছে মনের আলপথে। কতো কথা। কোথা থেকে শুরু করবে প্রশ্নমালা!
নিবেদিতা ফস করে বলে ওঠে;
: তুলসীদা তুমি বলে খেরেস্তান (খ্রিস্টান) হইছো? বৌদিরে এট্টু (একটু) দেহাইবা না মোরে?
তুলসীরাম জবাব দেয় না। তার ভেতরে একটা অজাগতিক অনিত্যতা ভেসে বেড়ায়। ভিড়ের মাঝেও সে নির্ঘুমের মতো অসংসারী মানুষের মতো একা। চারপাশের ভিড়,কিছু কৌতুহলী মুখ,হাটখোলার হুমহুম শব্দ,পাশের আড়িয়াল খাঁ নদীর শান্ত ঢেউ সন্ধ্যার প্রাক প্রণয়ে উমউম।
সন্ধ্যা নেমে এলো তরাসে। তুলসীরাম আর নিবেদিতা দেখলো ভিড়ের সন্ধ্যা,ধুলো ওড়া দূর জনপদ,গ্রাম আর হু হু কৈবর্ত।
: কোনদিকে যাচ্ছি আমরা নিবু?
তুলসীর প্রশ্ন।
নিবেদিতার বুকটা শুশুকের মতো ঘাই দিলো আচানক। মুচড়ে উঠলো হিজল সন্ধ্যা। কতো দিন পর সেই প্রিয় ‘নিবু’ ডাক। সেই নিবু নিবু।
এক সহস্র বছর ধরে যেন প্রতিধ্বনিত হলো ডাক। তারও বেশি ক্ষণ ধরে সে চুপ। মন বলছে তুলসীদা আরো ডাকুক ডাকুক।
হ্যাজাকের আলো ছড়িয়ে পড়লো পাশের পুঁথি পাঠের আসর থেকে। চিকচিক করছে নিবেদিতার ক্লান্ত ক্ষুধার্ত মুখ। উদয় সংসার,স্বামী প্রভু জীবন,সন্তানের মাতৃত্ব। বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে নিবু নিবু ডাক। গুনাই বিবি গাইছে;
তুমি যে আমার বন্ধু ওগো আমি বন্ধু তোমার
তোমার সুখে সুখী আমি,তোমার দুখে দুখ আমার।।
তোমার কথা যখন তখন পড়ে আমার মনে
কতো কষ্ট দিয়াছি গো তোমায় অকারণে,
তোমার কোনো কাজে বন্ধু পাই না আমি ব্যথা
সকল কিছু যাই গো ভুলে শুনলে তোমার কথা।।
নিবেদিতা আস্তে আস্তে হাঁটে। কতো প্রশ্ন মনে তার। এতোদিন কোথায় ছিল,তুলসীদা বিয়ে করেছে কিনা,ছেলেমেয়ে কজন,এই হাটে কেনো এসেছে,ওকে কি করে দেখল জিলাপির দোকানে,তুলসী জানে কিনা তার ২ ছেলে,স্বামী সংসার আছে। কতো কি !
ওরা হেঁটে হেঁটে বায়োস্কোপ জটলার সামনে এসে যায়। নিবেদিতা ছেলেকে খুঁজে নেয়। ছেলেটা অচেনা এক লোককে মায়ের সাথে দেখে কৌতুহলে লোকটাকে দেখতে থাকে মায়ের গা ঘেঁষে। তুলসীরাম আচানক বলে বসে;
: নিবু পালকিতে চড়বে?
*
হাটের একটু দূরে ৩/৪ জন বেহারা একটা রঙচঙা পালকি নিয়ে বসে আছে। অলস ঝিমুনীর মতো। পালকির সেই রমরমা দিন আজকাল আর নেই। কাহার সম্প্রদায়ের লোকজনও আজকাল অন্য পেশায় ভিড় করছে। কারো কারো ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করে শহরে চাকরির চেষ্টা করছে।
সারাদিন অপেক্ষার পরও কোনো নতুন বায়না নেই। বেহারাদের চোখে ঈগল পায়ের মতো দুশ্চিন্তা। বায়না না হলে চলবে কি করে?
তুলসীরাম,নিবেদিতা ধুলো মাখা পথ ধরে হাঁটছে। ছোট ছেলেটা মায়ের হাত ধরে আছে। অচেনা লাগছে চারপাশ। একটা মলিন ভয়। অন্য হাতে জিলাপির ঠোঙ্গাটা ধরা। কী এক ছোট্ট ভয়ে জিলাপি খেতে ইচ্ছা করছে না। হেঁটে ওরা পালকির সামনে এসে দাঁড়াল। যেন অনেক দীর্ঘ পথ,দীর্ঘ কালো করুণ রাত পার করে কূলে এসে দাঁড়াল। যেন সবুজ শিহরণের ডাঙ্গা,যেন তীর্থ চরাচর। তুলসীকে দেখে বেহারা লোকগুলো উঠে দাঁড়াল,মাথা নিচু করে কুন্ঠা ভঙ্গি। প্রথম লোকটা মাথা নিচু করেই মোলায়েম বলল;
: পেন্নাম দাদা।
: প্রণাম
তুলসীরাম দুই হাত জড়ো করে প্রণাম করলো যেন এক ঘাড় ভাঙ্গা ঘোড়াকে।
বহুদিন পর এই মেধাবী তুলসী দাদাকে দেখে ওরা অবাক ধন্য। আবার ভেতরে অন্য চোরা স্রোত। এই দাদা জাত মান কূল ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছে।
: তোমাদের নাম কি? কোন বাড়ি?
তুলসী জানতে চাইল।
ওরা সবাই একে একে নাম বলল হাত জড়ো করে। সময়টা সন্ধ্যার বাতাসে কাঁপছে। সময়টা কালো ওড়নায় হামাগুড়ি। দলনেতা অরুণকে কাছে ডেকে কি যেন মৃদু স্বরে বলল কাঁধে হাত রেখে। তুলসীর এরকম স্পর্শে অরুণ আর্দ্র হয়ে উঠল নিমিষে। হাত দিয়ে ইশারা করল নিবেদিতাকে পালকিতে উঠতে।
: ওডেন ( উঠুন) বৌদি।
একটা তিরতির শিহরণ শংকা ঘিরে নেচে গেল নিবুর পরাণে। সেই কবেকার পূজার ঘন্টা ধ্বনি,ঢাকের ঢাকগুড়গুড় শব্দ পেটের ভেতর মোচড় দিলো ক্ষণিকায়। কানে ভেসে এলো সেই কবেকার মাসী,ছোড়দি,পাশের বাড়ির সই সবার অস্পষ্ট উলুধ্বনি। অসাধারণ এক দীপ্তি ছড়িয়ে নিবেদিতা ছোট ছেলেটার হাত ধরে পালকিতে উঠে বসল।
লাল রঙের পর্দাটা আধো সরিয়ে শরমে নিবেদিতা দেখল পালকির সামনের অংশটা কাঁধে তুলে নিয়েছে তার তুলসীরাম,সবল ছেনির মতো সবল তুলসীদা।
সন্ধ্যা নামছে। দূরের ঝোপ থেকে একটা লাউডুগি সাপ লকলক করে জিভ বের করে সরসর করে নেমে গেল বোরো ধানের ক্ষেতে। হাট থেকে ভেসে আসা হ্যাজাকের আলো হলুদ জন্ডিস করে দিচ্ছে চারপাশের গ্রামীন প্রাণ ভোমরা। পর্দা গলে নিবেদিতার চিবুকে পড়েছে এই সোনার আলো। কী সুন্দর দেখাচ্ছে নিবেদিতাকে। ছোট ছেলেটা রাজ্যের বিস্ময় ছড়িয়ে ভয়ে ভয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল;
: ও মা মোরা কই যামু?
: নতুন দ্যাশে
মা খিলখিল করে হাসে।
*
কে যেন দৌড়ে খবর দেয় উদয় পালের কাছে।
: তোমার বউ ভাগছে তুলসীরামের লগে।
উদয়ের আজ মন ভালো। দূর থেকে ভেসে আসা পেশাবের কাঁচা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ তার নাকে লাগছে না। কোলাহলটাকে অমৃত লাগছে। আজ উদয় পালের প্রায় সব জিনিষপত্র বিক্রি হয়ে গেছে। অনেক দেনা শোধ করা যাবে। নিবেদিতার জন্য একটা শাড়ি কিনতে পারবে। অনেক দিন বউটা ঘ্যান ঘ্যান করছে। ছোট ছেলেটার জন্য একটা গরম জামা। সামনে শীত আসছে।
লোকটার পৌঁছে দেয়া এই খবরের অর্থ প্রথমে সে বুঝতে পারে না। একটু সম্বিত ফিরে পেতেই মনে হলো ছেলে আর বউ তো বায়োস্কোপ দেখতে গেছে আর জিলাপি খাবে। অনেক ক্ষণ হয়ে গেল। লোকটা হড়বড় করে উদয়কে সব বলতেই উদয় ধুতিটা বাম হাতে সামলে খিঁচে সোজা দৌঁড়। পাশের দোকানের লোকটা আর কোনো প্রশ্ন করারই সুযোগ পেল না,শুধু শুনল উদয় তাকে বলছে;
: দাদা মোর জিনিষপাতি সব রইল। মুই আইতে আছি। মোর সর্বনাশ হইয়া গেছে।
হাটের পূর্ব দিকে হামেদ খাঁর একটা আটচালা ঘর আছে। মূলত: ওটা তার গদি ঘর। ওখানেই হাটের্ আয় ব্যয়ের হিসাব,সালিশ সব কাজ। উনি এখন বয়সের ভারে সবসময় আসতে পারেন না। তার দুই ছেলে ওখানে নিয়মিত বসে। আজ অনেক দিন পর খাঁ সাহেব নিজেই এসেছেন সফেদ পাজামা পাঞ্জাবি পরে। কানের এক পাশে মুশকে আম্বর আতর মাখা তুলো গোঁজা। এক কোয়াক ডাক্তার তার প্রেসার মাপছে। নাড়ি দেখছে পকেট ঘড়ি বের করে।
এমন সময় বাঘে তাড়া খাওয়া হরিণের মতো উদয় এসে খাঁ সাহেবের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হাউমাউ করে ওঠে।
: কর্তা মোর সর্বনাশ হইছে। মোর পরিবার বাঁচান।
খাঁ সাহেব এসময়ে এরকম উটকো ঝামেলায় বিরক্ত হন। পা সরিয়ে নেন উদয়ের কাছ থেকে। বড় গোমস্তা ভট্টাচর্য মশায়কে ডেকে পাঠান। গদি ঘরে রাষ্ট্র হয়ে যায় যে কুমোর উদয় পালের বউ নিবেদিতা ছোট ছেলেকে নিয়ে মেদাকুল নিবাসী তুলসীরামের সাথে পালিয়েছে।
*
উহুম না উহুম না করে পালকির একপাশে তুলসী,অন্য পাশে অন্য বেহারা। একটা মৌ বুনো গ্রাম ঘ্রাণ চারিদিকে। বোরো ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে নানা রঙের আবির মাখা পালকিটা আজ অন্য দোলনায় দুলছে।
দূর থেকে ‘সাবধান হুশিয়ার..জাগো জাগো..ইয়া আলী’ প্রচণ্ড ধ্বনিতে খাঁ সাহেবের লাঠিয়াল বাহিনী ধেয়ে আসছে পালকির দিকে। তেল মাখা চকচকে লাঠিয়াল বাহিনী অনেক্ষণ পর একটা বীর কাজ পেয়ে উদ্বেলিত,রোমাঞ্চিত। হা রে রে রে বলে পালকিটা ঘিরে ধরে। তুলসীরামের সাথীরা ভয়ে হতবাক। তুলসীরাম হাত তুলে সবাইকে শান্ত থাকতে বলে আস্তে করে কাঁধ থেকে পালকিটা নামিয়ে রাখে ক্ষেতের পাশে।
পালকির দুলুনীতে ছেলেটার তন্দ্রা লেগেছিল। লাঠিয়ালদের বিকট চেঁচামেচিতে মা ছেলে লাল পর্দাটা সরিয়ে বাইরের অন্ধকারে মুখ রাখে। পালকির সামনে ঝুলানো হারিকেনের আলোতে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না সব। অস্পষ্ট অনেক মানুষ তার তুলসীদাকে ঘিরে। ঠাণ্ডা একটা লাউ ডুগডুগি সাপ ভয় তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। চোখ বন্ধ করে ফেলে তীব্র বিষ ভয়ে।
ভগবান ভগবান শব্দ ধ্বনি ছোট ছেলেটাকে গ্রাস করলো। সে মায়ের আঁচলে ঘিরে রেখেছে তার ছোট্ট নিষ্পাপ মুখ। এতো নিকষ অন্ধকার চারপাশ। পাশের আশুকাঠি গ্রাম।
*
তুলসীরামের কালই যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনী সংলাপ আছে পার্টি অফিসে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রথম তফসিলে তাদের পূর্ব বংশ নামের উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যাক্টের আওতায় বঙ্গীয় আইনসভায় তফসিলী সম্প্রদায়ের জন্য বিশ শতাংশ (২০%) আসন সংরক্ষিত করা হয়। নমশুদ্র শ্রেণির মতো অনুন্নত না হলেও এ আইনে মুসলমান জনগোষ্ঠীও তাদের জন্য সংরক্ষিত সাধারণ আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার লাভ করে।
*
ক্ষেতের আল ধরে লাল রঙা রক্তের একটা ছিপছিপে ফিতা। সাহেবরামপুর গ্রামের এই জমিন খুব ভালো। পিচকারীর মতো রক্তের এই বেগমান বেগ সে শুষে নিচ্ছে। কোথাও রক্তের দাগ কালচে হতে শুরু করেছে। কতোগুলো লাল কালো পিঁপড়া রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।
উদয় পালের কেরায়া নৌকার মাঝির মন খারাপ। আজ তার যাত্রী মাল সামান নিয়ে উঠবে না। আড়িয়াল খাঁ নদীর বুকে হারিকনের আলো মাখা পানসি নৌকা,গয়না নৌকা। কোথাও ঝপাত ঝপাত শব্দ।
কোথাও পাড় ভাঙ্গছে। ভাঙ্গনেরও তো শব্দ আছে।
রশীদ বয়াতি,হাটে এতোক্ষণ যে পুঁথি পাঠ করেছে;সে তার ছোট নৌকা প্রস্তুত করছে বাড়ি ফিরবে। রাত হলো বেশ। দীর্ঘদিন আলকাতরা না মাখার কারণে আজকাল অল্পতেই নৌকাতে পানি ওঠে। পুরানো এক সানকি দিয়ে নৌকার পানি সেঁচতে হয়। রশীদ বয়াতির ছেলে পানি সেঁচে।
বয়াতি গান ধরে;
একটি কলির দুইটি পাত , তাহি তো , প্যাটের ভাত
পাহি পাহি পাতা তরি ,তকরি ভরাই
হায়রে ,হায়রে হায় ,হায়রে হায়রে হায়রে হায় এ সখি জিয়ে কি উপায় ...
দু টাকার বাজার করি ,বাকি আনি লাউ পানি
সারাদিন পাতা তরি হপ্তা হিসাব পাই
হায়রে ,হায়রে হায় ,হায়রে হায়রে হায়রে হায় এ সখি জিয়ে কি উপায় ...
বাবু ভাই এর ছানা পোনা ইস্কুল পরে যায় রে
মজুর ছানা পোকা বিচে যায়
হায়রে ,হায়রে হায় ,হায়রে হায়রে হায়রে হায় এ সখি জিয়ে কি উপায় ...
আছে।
আসিফ মেমোরিয়াল স্কুলের পাশেই একটা কাঠের ঘাট নিচে নেমে আড়িয়াল খাঁ নদীটার গায়ে গায়ে। দীর্ঘ পানি ঘষে ঘষে শ্যাওলা পিচ্ছিল। কুমোর উদয় পাল নৌকার
পাশে ও মাচায় লাল কালো পোড়া রঙের হাড়ি পাতিল সাজাতে থাকে সকালের রোদ থাকতে থাকতে। বউ তাকে সাহায্য করছে নৌকায় তুলতে। ছোট ছেলেটা ন্যাংটা কোমরে ঘুঙ্গুর বাঁধা,টুনটুন ঘুরে বেড়াচ্ছে রোদের ভাসানে।
আজ মঙ্গলবার হাট। আজ যা বিক্রি করবে তাতে তার সংসার,মাটি কেনার,লাকড়ি কেনার পাওনা মেটাবে সুদে আসলে। বউয়ের সিঁথির রঙ রোদের ঝলসানে ফ্যাকাশে। অনেকক্ষণ উপবাসের শুকনো লাবণ্যহীন মুখ। সারাক্ষণ ধমকের উপর যার জীবন,ভাত,বেঁচে থাকা;তার এসব স্বামী খ্যাঁক খ্যাঁকে কিছু যায় আসে না। সময় সময় এই সব হাড়ি পাতিল হাটখোলায় পৌঁছাতে হবে।
ঘাটের ইজারাদার হাওলাদার ছাতা মাথায় পায়চারী করছে। রসিদ বই নিয়ে ব্যস্ত। টোল আদায় বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। হাওলাদার জোরে চ্যাঁচায়;
: এই নমোর পুত,হবিরে (জলদি) নৌকা ছাড়। আজ কোলম সব কেরায়া একলগে দিবি ( আজ কিন্তু সব ভাড়া একসাথে দিবি )
উদয় পাল ঘামে ভিজে তেলতেলে। মিনমিন করে যা বলে তার সংক্ষেপ হলো;
: সব দেমা হানে ( সব দিব )
খাড়া রোদের একটা দাপট আছে,নদীর স্রোতে চিকচিক করে। মাঝি নৌকা তামুক ধরায়। ভাঙ্গা গাল ফুলিয়ে হুক্কার মাচানে জোরে ফুঁ দেয় নদীর বাতাস ছাপিয়ে। নৌকা ছাড়ার আগে একবার জুত করে তামুক সেবন না করলে আবার কখন যে সে সুযোগ পাওয়া যাবে। জোয়ার না ধরতে পারলে ভাটাতে নৌকা বাওয়া কঠিন,কষ্টের। আবার এর মাঝে তার প্রস্রাব চেপেছে। পাশে কাশবন আছে। লুঙ্গিটা তুলে বসে পড়লেই হয়। গলা খাকারি দিয়ে মাঝি হুক্কাটা হাতে নিয়েই একটু ঝোপ দেখে বসে পড়ে। রোদের পর এই ঝোপ ছায়ায় সে ত্যাগ করতে করতে আরাম বোধ করে। চোখ বন্ধ করে আবার তাকিয়ে কুমোরের বউটাকে দেখে। ঘামে জুবজুব বউ।
মাঝি ভুস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। একটা অচেনা হাহাকার। হায়রে সেই যৌবন আর নেই। নিজের নিস্তরঙ্গ সাড়া না দেয়া শরীর দিন দিন কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝি ঝুপ করে উঠে পড়ে কাজ শেষ করে। চিন্তাটাকে হুক্কায় বড় এক টান দিয়ে চিমনীর মতো ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। দূরের পিঙ্গলাকাঠির পূবে টুকরো মেঘ। না জানি কখন বৃষ্টি নামবে নদী কাঁপিয়ে।
নৌকা ছেড়ে দিতেই ছোট ছেলেটা কুটুস করে বউয়ের সাথে নৌকায় উঠে বসে। কুমোর হৈ রৈ করে উঠেছিল ছেলের নৌকায় উঠে আসা দেখে। এই ছেলেকে হাটে নিয়ে আসা মানে হলো একে এখন ৬/৭ ঘন্টা দেখে রাখা। খাওয়ানো,হাটের মধ্যে পায়খানা প্রস্রাব করানো-এক বিশাল ঝামেলা। বউ মনে মনে খুশি। স্বামীর চিৎকার পাত্তা না দিয়ে আঁচল দিয়ে ছোট ছেলের গায়ের ঘাম মুছে দেয়। নৌকার মাঝে রাখা পোটলা থেকে একটা ইলাস্টিক হাফ প্যান্ট পরিয়ে দেয়।
যত্ন করে আঁচলে বেঁধে রাখা ২টা বাতাসা খেতে দিলো। সাথে কাঁসার গেলাসে ঢকঢক জল। মা মুখ ঝামটা মেরে স্বামীর দিকে না তাকিয়েই বলে;
: ও গেলে সমেস্যাডা কি? বাড়িতে একলা থাকবে আনে কেমনে? হে লইয়া তোমার ভাবতে হইবে না তো। মুই আছি কি হরতে?
( ও গেলে সমস্যা কি? বাড়িতে ও একা কেমন করে থাকবে? এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি আছি কি করতে?)
কুমোর গজ গজ করলো। বউয়ের চৌদ্দগুষ্টি নিয়ে মনে মনে গালাগালি করল।
: মাঝি ভাই,নৌকা ছাড়েন।
বৈঠা বা্ওয়া হালের ক্যাঁচরক্যাঁচর শব্দে কেরায়া নৌকা নদীর পাশ ধরে যাত্রা শুরু করে। মাঝি গামছা দিয়ে মাথা বাঁধে,রোদ ঠেকায়। কি যেন সুরা পড়ে।
: এই নমোর পোলা,ভগবানের নাম নিছস?
বউ বড় করে ঘোমটা মাথায় তুলে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে। দুর্গা দুর্গা।
*
নদীর পাড় ঘেঁষেই এই সব বীর লাঠিয়ালদের বসার জায়গা..খানা খাদ্য বিড়ি সিগারেট,লা রে লা প্পা গানের আসর। লাঠিয়ালদের তেমন কোনো কাজ নেই। হাট কমিটির ভাড়াটে। এতদ অঞ্চলে প্রচুর চর,জায়গা দখলের লড়াই আছে নিরন্তর। হামেদ খাঁ’ প্রতিপত্তির মানুষ। তার অনুগত দাসানুদাস এই বাহিনী। হাটের শৃংখলার নামে হামেদ খাঁ’র আধিপত্য দখলের প্রতীক ওরা। সরিষার তেল মাখা সুঠাম এসব পুরুষের হাতের মাসল,লুঙ্গি মালকোচা করে পরার একটা দর্শনমূল্য আছে। নিরীহ মানুষ সপ্রশংস তাকায় গোল হয়ে বসে থাকা এইসব তেলাক্রান্ত মানুষের দিকে।
দূর দূরান্ত থেকে বোঝাই পণ্য আসে নৌকায়,ঘাটে ভিড়ে,গলুইয়ে বসে থাকা ক্লান্ত মাঝির হাঁক ডাকে মুখরিত হয়। নৌকার ছইয়ে শাড়ি দিয়ে পর্দা ঘেরা থাকলে লাঠিয়ালকূল নড়েচড়ে বসে। উৎসাহী কেউ কেউ গ্রাম্য ধ্বনি করে ওঠে।
: এ মনু চুপ কর তো। জিনিষ নামবে..
জিনিষ মানে হলো মেয়ে।
দুপুরের গনগন সূর্য খানিকটা পশ্চিমে হেলতেই উদয় পাল,তার বউ,তার ছোট ছেলে সহ মাটির হাড়ি পাতিল বোঝাই নৌকা ঘাটে এসে হুস করে ভেড়ে। আগে থেকে হাটের কামলা জাতীয় লোক রেডি। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যায় আড়িয়াল খাঁর পাড়ে। নামতে থাকে নানা রঙের নানা ডিজাইনের মাটির বাসনপত্র।
উদয় পাল তটস্থ থাকে। হেই হেই করে ‘সাবধান সাবধান’ বললেও কিছু ভাঙ্গবেই। উদয় পাল ময়লা ধুতির কোচড় থেকে পকেট বই বের করে পেন্সিল দিয়ে লিখে রাখতে চেষ্টা করে।
হাট পাড়ে নামার সময় ভাঙ্গার তালিকা:
১. কালো সরা ( ঢাকনি)-৬ খানা
২.বড় পাতিল-২ খানা
৩.জামাই ভান্ড-৩ খানা
৪.চিতই পিঠার কলোই-৪ খানা
ইলাস্টিক হাফ প্যান্ট পরা ছোট ছেলেটা চঞ্চল হয়ে ওঠে নৌকা থেকে নেমে। মায়ের গা ঘেঁষে ফিসফিস করে;
: ও মা মুতমু
মা খুব গুরুত্ব না দিয়ে চোখের এক দিক ইশারা করে বলল;
: ওইহানে বইসা পড়ো বাবা
মা’টা নদী পাড়ে পাতিল নামানোর বিলম্ব দেখে উসখুস করে। লাঠিয়ালদের দেখে তার ভালো লাগছে না। বাইম মাছ তার একদম পছন্দ না। লোকগুলোকে বাইম মাছের মতো পিচ্ছিল লাগে। ওদের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে,ওরা ‘জিনিষ’ মাপছে।
*
উদয় কুমোরের মন ফুরফুরে। তার বানানো কালো রঙের ছোট কলসিগুলো হু হু বিক্রি হচ্ছে আজ। সামনে শীতকাল আসছে। খেজুরের রস সংগ্রহ করা লোকজন,যাদেরকে স্থানীয় ভাষায় শিয়ালী বলে তারা দেদারসে কিনছে এই ঠিলা ( ছোট কলসি)। রসের বড় বড় হাড়িও বিক্রি হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আজ আর মালসামান বাড়ি ফেরত নিতে হবে না। ধুতির কোঁচড়ে ভাংতি পয়সা,টাকা জমতে থাকে। বেশির ভাগ টাকাই ময়লা তবুও উদয় কেমন যেন হাটের লোকজনের ভিড়-গরম ছাপিয়ে অন্য রকম মাদকতা উপভোগ করে। হাটের ভিড়,মানুষের ঘামের গন্ধ,দূরে নদী পাড়ের হাওলাদার রাইস মিলের ভট ভট শব্দ সব সুরের যাদু লাগে।
রঙচঙা পোশাক পরা এক লোক মজার এক সাজে বায়োস্কোপ দেখাচ্ছে ডুগডুগি বাজিয়ে। ছোটদের লম্বা লাইন পড়ে গেছে। এক আনা দিলেই শো দেখা যাবে। এক সাথে ৪ জন উবু হয়ে দেখতে পারে। বায়োস্কোপের ভেতরে সিনেমার কেটে ফেলা রিলের সমাহার।
ছেলেরা দেখছে। লোকটা ডুগডুগি বাজিয়ে গান করছে;
কী চমেতকার দেখা গেলে
উত্তম সুচিত্রা আইয়া পড়লে।
তারপরেতে কি হবে
শান্ত হইয়া দাঁড়ান সবে
সাবিহা ইউসুফ আসতে আছে
প্রেমের ডালিম ধরে গাছে।
উদয়ের ছেলেটা মায়ের আঁচল ধরে খুটমুট করে। তার মন অস্থির কখন সে বায়োস্কোপ দেখবে। মা কনুই দিয়ে আলতো করে স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। উদয় আজ অন্যরকম হাজী মুহাম্মদ মহসিন। কোমর থেকে সাবধানে কয়েকটা টাকা বের করে বউয়ের হাতে দেয়। নাভারন কোম্পানীর একটা বিড়ি ফস করে ধরিয়ে গম্ভীর মুখে বলল;
: যাও পোলারে সিনেমা দেহাইয়া আনো। তুমিও গরম জিলাপি খাইও
বউ ঝামটা মেরে ওঠে;
:ক্যা এই সব কাম তুমি একলা হরছো? মুই করি নাই? টাহা দেবার বেলায় মুখটা পাতিলের তলার লাহান করো ক্যা? টাহার কোলাম মোরও ভাগ আছে।
( কেন এসব কাজ কি তুমি একা করেছো? আমি করিনি? টাকা দেবার বেলায় মুখটা পাতিলের তলার মতো কেনো করছো? টাকার কিন্তু আমারও ভাগ আছে)
ছেলেকে বায়োস্কোপের লাইনে দাঁড় করিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে সাবধান করে মা।
: খবরদার,কোনোহানে যাবি না। এহেনে দাঁড়াইয়া থাক। মুই যামু আর আমু।
ছেলেটা মহা আনন্দে লাইনে দাঁড়ায়। বউ ভিড় বাঁচিয়ে মাথায় আঁচল তুলে গরম জিলাপির খোঁজে দ্রুত ইতিউতি তাকায়।
যে লোকটা মাটির চুলায় বিশাল কড়াই বসিয়ে জিলাপি বিক্রি করছে,তার সহকারী গরম তেলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ময়দার কাই ছেড়ে দিচ্ছে। টগবগ করছে গরম তেল। বউ আঙ্গুল তুলে জিলাপি দেখিয়ে বলে;
: মোরে ২ পোয়া দেন তো
কে যেন বউটার ঘাড় বরাবর এসে দাঁড়ায়। জিলাপির ঘ্রাণ ছাপিয়ে ত্রিফলা তেলের ঘ্রাণ। কানের কাছে সেই পরাণ উতলা হুম হুম শব্দ।
উহুম না উহুম না..
জিলাপির গরম ঠোঙ্গা হাতে নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মাথা থেকে বিবর্ণ আঁচল খসে পড়ে। চমকে ওঠে প্রায় সন্ধ্যার ওড়না কালো অন্ধকারে।
*
মেদাকুল বাজার থেকে এই হাটের দূরত্ব আছে বেশ। মেদাকুল বাজারের পাশ ঘিরে বেশ কতোগুলো পুরানো মন্দির আছে। মন্দিরের পাশ দিয়ে যে নদীটা ঘেঁষে চলে গেছে দূরে,এই নদী পথই শেষে কালকিনি হয়ে হামেদখাঁর হাট। মন্দিরের পাশের লাগোয়া গ্রামটাতে অনেকগুলো বেহারা সম্প্রদায়ের বাস। তাদের আলাদা মন্দির,আলাদা পুকুর,আলাদা ডিপ টিউবওয়েল। আজকাল বেহারাদের পড়ন্ত মওসুম। জমি জিরাত নেই বললেই চলে। বিয়েতেও আজকাল লোকজন খুব একটা পালকি ব্যবহার করে না বলেই এই পেশার পসার নেই। বেহারার ছেলে পড়াশুনা শিখে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে,চাকরি খোঁজে। আস্তে আস্তে খালি হয়ে যাচ্ছে এই বসত গ্রাম।
তুলসীরাম কাহার যখন স্কুলে যেত তখন অনেকদিন তাকে স্কুলের বারান্দায় বসে থাকতে হতো। ক্লাসের বেঞ্চিতে বসতে পারত না। নিম্ন বর্ণের হিন্দু এই কাহার। তুলসীরাম কয়েকদিন কান্নাকাটি করলে স্কুলের হেড মাস্টার তাকে বুঝিয়েছে যে কাহারদের উৎপত্তি হয়েছে নিম্নবর্ণের এক হিন্দু সম্প্রদায় থেকে এবং এ শ্রেণি ব্রাহ্মণ পিতা ও চন্ডাল মাতার বংশোদ্ভূত এক মিশ্রবর্ণের প্রতিনিধিত্বকারী। কাহারগণ অবশ্য নিজেদের মগধের রাজা ‘জরাসন্ধের’ বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। একই সামাজিক মর্যাদার অন্যান্য বর্ণের অনুসৃত ধর্মের মতোই কাহারদের ধর্ম। তাদের অধিকাংশই শিব বা শক্তির পূজারী এবং তাদের মধ্যে বৈষ্ণবদের সংখ্যা ন্যূন। সামাজিক বিচারে কাহারগণ কুর্মি ও গোয়ালা বর্ণের সমকক্ষ।
প্রচণ্ড গরমে যখন তুলসীরামের গলা শুকিয়ে চৌচির তখন নিবেদিতা লুকিয়ে জল এনে দিত এই তুলসীরামকে। এতো সুন্দর চোখ আর টেরিকাটা চুল,চুলে সুবাসিত রিগার্ডের ত্রিফলা তেল। তুলসী যখন গ্রামের পথ ধরে বই খাতা হাতে নিয়ে হেঁটে যেত,নিবেদিতা টের পেত মৌ মৌ ত্রিফলা আর পালকি বহনের সেই ধ্বনি
উহুম না উহুম না...
মেদাকুল বাজারে সন্ধ্যা নেমে এলে উলুধ্বনি বেজে ওঠে। শংখ ফুঁ। একটা বট গাছের ডালে ঝুলে থাকা সারি সারি বাদুরের কোলাহল ছাপিয়ে তুলসীরাম জোরে জোরে বলত;
সাড়ে চারশো বছর আগে ভারতে এক কবি খুন হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম তুকারাম। শূদ্র কবিতা লিখতে পারবে না এই অজুহাতে ব্রাহ্মণেরা তাঁর কবিতা নদীর জলে ফেলে দিয়েছিল, কিন্তু মরাঠিরা বিশ্বাস করে তাঁর কবিতা জল থেকে উঠে এসেছিল। মাত্র ৩৮ বছরে তুকারামকে সরিয়ে দিয়েছিল জাতের নামে বজ্জাতি করা অভিজাতরা।
সন্ধ্যা নেমে রাত হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে তুলসীরাম একাকী বসে থাকে বট গাছের মায়ায়। হু হু করে কান্না জেগে থাকে তার বুকের সাথে।
বার্তা রটে গেল মেদাকুল সহ আশে পাশের গ্রামে।
*
বেহারা নিচু জাত। শূদ্র। অসৎ শূদ্র। যার ছায়া মাড়ানো পাপ। নিবেদিতারা নমশূদ্র। কৃষিকাজ করা সম্প্রদায়। নিবেদিতা এসব বোঝে না ভালো করে। আকুল হয়ে উঠেছিল তুলসীরামের কবিতা আর চুলের ভুরভুর সুঘ্রাণে।
বার্থী স্কুলের পাশেই এক মন্দির। বিশাল মন্দির। ভট্টাচার্য মশায় সম্মানিত মানুষ। নামী ব্রাহ্মণ। একবার তার ছেলে মেদাকুল বেড়াতে এলে বিকালে বেরিয়েছে স্বজন বিহারে স্থানীয় মন্দিরে। গ্রামের অসমতল কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় রাস্তা ভেঙ্গে যাবার পর আর মেরামত হয়নি। একই রাস্তা করে বাড়ি ফিরছিল প্রায় সন্ধ্যায় তুলসীরাম। পারিষদ তুলসীকে দেখেই ইশারা করে ব্রাহ্মণের ১২ বছরের ছেলেকে গড় প্রণাম করতে।
তুলসী তখন মেট্রিক দেবে। সে তার পরিপাটি চুল কপাল থেকে সরিয়ে বিদ্রোহ করে ওঠে। কেন সে গড় প্রণাম করবে এই বালককে? যে তার কনিষ্ঠ।
মুহূর্তে এই অধর্ম,নরক সমান পাপ খবর ছড়ালো গ্রামময়। বিরাট অধর্ম। পাপ পাপ পাপ। তুলসীরামের বাবাকে মাথা নত করে সালিশে বসালো পুরুত সকল। গ্রাম ছাড়া করা হলো এই বেহারা পরিবার। গোপালগঞ্জ মহকুমার কোটালিপাড়া থানায় তুলসীরামের বাবার দূর সম্পর্কের এক দিদি আছে। ওখানে উঠল সবাই কোনক্রমে। তুলসীর মেট্রিক দেয়া অনিশ্চিত।
এই কোটালিপাড়ায় এক মিশনারী আছে। ফাদার এক বৃষ্টি ভেজা শনিবার সকালে এই পরিবারকে ডেকে পানি ছিটিয়ে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করলেন। ফাদার বললেন;
পবিত্র আত্মার অনুভূতি প্রাপ্তি, যা আমাদের জিহ্বার সাহায্যে কথা বলার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, প্রমাণ যে আমরা স্বর্গরাজ্যের উত্তরাধিকার
পদ পরিষ্কার করার আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় পুরো পরিবারকে প্রভূ যীশুর সাথে একটি অংশের অংশীদারিত্বের সুযোগ করে দেয়া হলো। ফাদার স্মরণ করিয়ে দিলেন যে একজন ব্যক্তির অবশ্যই প্রেম, পবিত্রতা, নম্রতা, ক্ষমাশীলতা এবং পরার্থপরায়ণতা থাকবে। পানি বা ওয়াটার ব্যাপ্টিজমের মাধ্যমে যীশু খ্রিস্টের নামে তাদের পদ ধৌতকরণ করা হলো।
পরিবারটি প্রাণে বাঁচল। ফাদার তুলসীরামকে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন।
নিবেদিতার তখন পার্বতী দশা। হু হু উদাস হুতাসন। ধরে বেঁধে নিবেদিতাকে বিশাল পণে বিয়ে দেয়া হলো কুমোর উদয় পালের সাথে পিঙ্গলাকাঠি গ্রামে।
*
: ওরে মোর দুইন্যা। এ আমি কারে দেখতে আছি। তুলসীদা। পেরনাম।
: চিনতে পেরেছো? বাহ
: ওরে এইয়া কি কও। তোমারে চিনমু না মুই? কও কি! মাথায় এহনো হেই ত্যাল মাহো?
: না মাখি না। আজই মাখলাম।
: তুলসীদা তোমার ভাষা কোলম বদলাইয়া গেছে। কেমন কইরা জানি কতা কও। নদীয়া শান্তিপুরের লাহান।
তুলসী জবাব দেয় না। মৃদু হাসে। বিকেলের পারাণির কড়ি সুন্দর রোদ তেরসা করে ওদের মুখে পড়ে। নিবেদিতা হাটের ভিড়ের মাঝে আবার বড় করে ঘোমটা টেনে নেয়। জিলাপির দাম শোধ করে ঠোঙ্গা হাতে নেয়। ঠোঙ্গাটা তুলসীকে ইশারায় দেখিয়ে জানতে চায় খাবে কিনা। তুলসী মাথা নাড়ে,খাবে না। ভিড় এড়িয়ে দুজন খুব নিকট করে হাঁটতে থাকে। নিবেদিতার গন্তব্য বায়োস্কোপের ওখানে,ছেলেকে লাইনে দাঁড় করিয়ে এসেছে। তুলসীর কোনো গন্তব্য নেই।
একটা নদী ভাসানের মতো। স্রোতের গতির মতো,ভাসতে ভাসতে যেদিকে যাক,কোনো মোহনায় বা কোনো বড় নদীর বক্ষে। এই তো ধুলো মাটি পথ। এই তো সেই মানুষের কোলাহল,ভিড়,এই তো মানুষে মানুষে আলাদা আলাদা জাত,ধর্ম। আলাদা মুখ,আলাদা ঘাম,আলাদা ঘ্রাণ।
ভিড়ের কোনো জাত পাত নেই। কলাপাতার মতো বাতাসে দোলে,কলাপাতার মতো সব খাবারই বুকে ধারণ করে।
এক বিঘারও কম দূরত্ব রেখে দুজন পাশাপাশি হাঁটে,কখনো আলতো করে গা লেগে যায় দুজনের ভিড়ের শ্লাঘায়। চমকে ওঠে দুজন। কতো কতো প্রশ্ন বুদবুদ করে উঠছে মনের আলপথে। কতো কথা। কোথা থেকে শুরু করবে প্রশ্নমালা!
নিবেদিতা ফস করে বলে ওঠে;
: তুলসীদা তুমি বলে খেরেস্তান (খ্রিস্টান) হইছো? বৌদিরে এট্টু (একটু) দেহাইবা না মোরে?
তুলসীরাম জবাব দেয় না। তার ভেতরে একটা অজাগতিক অনিত্যতা ভেসে বেড়ায়। ভিড়ের মাঝেও সে নির্ঘুমের মতো অসংসারী মানুষের মতো একা। চারপাশের ভিড়,কিছু কৌতুহলী মুখ,হাটখোলার হুমহুম শব্দ,পাশের আড়িয়াল খাঁ নদীর শান্ত ঢেউ সন্ধ্যার প্রাক প্রণয়ে উমউম।
সন্ধ্যা নেমে এলো তরাসে। তুলসীরাম আর নিবেদিতা দেখলো ভিড়ের সন্ধ্যা,ধুলো ওড়া দূর জনপদ,গ্রাম আর হু হু কৈবর্ত।
: কোনদিকে যাচ্ছি আমরা নিবু?
তুলসীর প্রশ্ন।
নিবেদিতার বুকটা শুশুকের মতো ঘাই দিলো আচানক। মুচড়ে উঠলো হিজল সন্ধ্যা। কতো দিন পর সেই প্রিয় ‘নিবু’ ডাক। সেই নিবু নিবু।
এক সহস্র বছর ধরে যেন প্রতিধ্বনিত হলো ডাক। তারও বেশি ক্ষণ ধরে সে চুপ। মন বলছে তুলসীদা আরো ডাকুক ডাকুক।
হ্যাজাকের আলো ছড়িয়ে পড়লো পাশের পুঁথি পাঠের আসর থেকে। চিকচিক করছে নিবেদিতার ক্লান্ত ক্ষুধার্ত মুখ। উদয় সংসার,স্বামী প্রভু জীবন,সন্তানের মাতৃত্ব। বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে নিবু নিবু ডাক। গুনাই বিবি গাইছে;
তুমি যে আমার বন্ধু ওগো আমি বন্ধু তোমার
তোমার সুখে সুখী আমি,তোমার দুখে দুখ আমার।।
তোমার কথা যখন তখন পড়ে আমার মনে
কতো কষ্ট দিয়াছি গো তোমায় অকারণে,
তোমার কোনো কাজে বন্ধু পাই না আমি ব্যথা
সকল কিছু যাই গো ভুলে শুনলে তোমার কথা।।
নিবেদিতা আস্তে আস্তে হাঁটে। কতো প্রশ্ন মনে তার। এতোদিন কোথায় ছিল,তুলসীদা বিয়ে করেছে কিনা,ছেলেমেয়ে কজন,এই হাটে কেনো এসেছে,ওকে কি করে দেখল জিলাপির দোকানে,তুলসী জানে কিনা তার ২ ছেলে,স্বামী সংসার আছে। কতো কি !
ওরা হেঁটে হেঁটে বায়োস্কোপ জটলার সামনে এসে যায়। নিবেদিতা ছেলেকে খুঁজে নেয়। ছেলেটা অচেনা এক লোককে মায়ের সাথে দেখে কৌতুহলে লোকটাকে দেখতে থাকে মায়ের গা ঘেঁষে। তুলসীরাম আচানক বলে বসে;
: নিবু পালকিতে চড়বে?
*
হাটের একটু দূরে ৩/৪ জন বেহারা একটা রঙচঙা পালকি নিয়ে বসে আছে। অলস ঝিমুনীর মতো। পালকির সেই রমরমা দিন আজকাল আর নেই। কাহার সম্প্রদায়ের লোকজনও আজকাল অন্য পেশায় ভিড় করছে। কারো কারো ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করে শহরে চাকরির চেষ্টা করছে।
সারাদিন অপেক্ষার পরও কোনো নতুন বায়না নেই। বেহারাদের চোখে ঈগল পায়ের মতো দুশ্চিন্তা। বায়না না হলে চলবে কি করে?
তুলসীরাম,নিবেদিতা ধুলো মাখা পথ ধরে হাঁটছে। ছোট ছেলেটা মায়ের হাত ধরে আছে। অচেনা লাগছে চারপাশ। একটা মলিন ভয়। অন্য হাতে জিলাপির ঠোঙ্গাটা ধরা। কী এক ছোট্ট ভয়ে জিলাপি খেতে ইচ্ছা করছে না। হেঁটে ওরা পালকির সামনে এসে দাঁড়াল। যেন অনেক দীর্ঘ পথ,দীর্ঘ কালো করুণ রাত পার করে কূলে এসে দাঁড়াল। যেন সবুজ শিহরণের ডাঙ্গা,যেন তীর্থ চরাচর। তুলসীকে দেখে বেহারা লোকগুলো উঠে দাঁড়াল,মাথা নিচু করে কুন্ঠা ভঙ্গি। প্রথম লোকটা মাথা নিচু করেই মোলায়েম বলল;
: পেন্নাম দাদা।
: প্রণাম
তুলসীরাম দুই হাত জড়ো করে প্রণাম করলো যেন এক ঘাড় ভাঙ্গা ঘোড়াকে।
বহুদিন পর এই মেধাবী তুলসী দাদাকে দেখে ওরা অবাক ধন্য। আবার ভেতরে অন্য চোরা স্রোত। এই দাদা জাত মান কূল ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছে।
: তোমাদের নাম কি? কোন বাড়ি?
তুলসী জানতে চাইল।
ওরা সবাই একে একে নাম বলল হাত জড়ো করে। সময়টা সন্ধ্যার বাতাসে কাঁপছে। সময়টা কালো ওড়নায় হামাগুড়ি। দলনেতা অরুণকে কাছে ডেকে কি যেন মৃদু স্বরে বলল কাঁধে হাত রেখে। তুলসীর এরকম স্পর্শে অরুণ আর্দ্র হয়ে উঠল নিমিষে। হাত দিয়ে ইশারা করল নিবেদিতাকে পালকিতে উঠতে।
: ওডেন ( উঠুন) বৌদি।
একটা তিরতির শিহরণ শংকা ঘিরে নেচে গেল নিবুর পরাণে। সেই কবেকার পূজার ঘন্টা ধ্বনি,ঢাকের ঢাকগুড়গুড় শব্দ পেটের ভেতর মোচড় দিলো ক্ষণিকায়। কানে ভেসে এলো সেই কবেকার মাসী,ছোড়দি,পাশের বাড়ির সই সবার অস্পষ্ট উলুধ্বনি। অসাধারণ এক দীপ্তি ছড়িয়ে নিবেদিতা ছোট ছেলেটার হাত ধরে পালকিতে উঠে বসল।
লাল রঙের পর্দাটা আধো সরিয়ে শরমে নিবেদিতা দেখল পালকির সামনের অংশটা কাঁধে তুলে নিয়েছে তার তুলসীরাম,সবল ছেনির মতো সবল তুলসীদা।
সন্ধ্যা নামছে। দূরের ঝোপ থেকে একটা লাউডুগি সাপ লকলক করে জিভ বের করে সরসর করে নেমে গেল বোরো ধানের ক্ষেতে। হাট থেকে ভেসে আসা হ্যাজাকের আলো হলুদ জন্ডিস করে দিচ্ছে চারপাশের গ্রামীন প্রাণ ভোমরা। পর্দা গলে নিবেদিতার চিবুকে পড়েছে এই সোনার আলো। কী সুন্দর দেখাচ্ছে নিবেদিতাকে। ছোট ছেলেটা রাজ্যের বিস্ময় ছড়িয়ে ভয়ে ভয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল;
: ও মা মোরা কই যামু?
: নতুন দ্যাশে
মা খিলখিল করে হাসে।
*
কে যেন দৌড়ে খবর দেয় উদয় পালের কাছে।
: তোমার বউ ভাগছে তুলসীরামের লগে।
উদয়ের আজ মন ভালো। দূর থেকে ভেসে আসা পেশাবের কাঁচা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ তার নাকে লাগছে না। কোলাহলটাকে অমৃত লাগছে। আজ উদয় পালের প্রায় সব জিনিষপত্র বিক্রি হয়ে গেছে। অনেক দেনা শোধ করা যাবে। নিবেদিতার জন্য একটা শাড়ি কিনতে পারবে। অনেক দিন বউটা ঘ্যান ঘ্যান করছে। ছোট ছেলেটার জন্য একটা গরম জামা। সামনে শীত আসছে।
লোকটার পৌঁছে দেয়া এই খবরের অর্থ প্রথমে সে বুঝতে পারে না। একটু সম্বিত ফিরে পেতেই মনে হলো ছেলে আর বউ তো বায়োস্কোপ দেখতে গেছে আর জিলাপি খাবে। অনেক ক্ষণ হয়ে গেল। লোকটা হড়বড় করে উদয়কে সব বলতেই উদয় ধুতিটা বাম হাতে সামলে খিঁচে সোজা দৌঁড়। পাশের দোকানের লোকটা আর কোনো প্রশ্ন করারই সুযোগ পেল না,শুধু শুনল উদয় তাকে বলছে;
: দাদা মোর জিনিষপাতি সব রইল। মুই আইতে আছি। মোর সর্বনাশ হইয়া গেছে।
হাটের পূর্ব দিকে হামেদ খাঁর একটা আটচালা ঘর আছে। মূলত: ওটা তার গদি ঘর। ওখানেই হাটের্ আয় ব্যয়ের হিসাব,সালিশ সব কাজ। উনি এখন বয়সের ভারে সবসময় আসতে পারেন না। তার দুই ছেলে ওখানে নিয়মিত বসে। আজ অনেক দিন পর খাঁ সাহেব নিজেই এসেছেন সফেদ পাজামা পাঞ্জাবি পরে। কানের এক পাশে মুশকে আম্বর আতর মাখা তুলো গোঁজা। এক কোয়াক ডাক্তার তার প্রেসার মাপছে। নাড়ি দেখছে পকেট ঘড়ি বের করে।
এমন সময় বাঘে তাড়া খাওয়া হরিণের মতো উদয় এসে খাঁ সাহেবের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হাউমাউ করে ওঠে।
: কর্তা মোর সর্বনাশ হইছে। মোর পরিবার বাঁচান।
খাঁ সাহেব এসময়ে এরকম উটকো ঝামেলায় বিরক্ত হন। পা সরিয়ে নেন উদয়ের কাছ থেকে। বড় গোমস্তা ভট্টাচর্য মশায়কে ডেকে পাঠান। গদি ঘরে রাষ্ট্র হয়ে যায় যে কুমোর উদয় পালের বউ নিবেদিতা ছোট ছেলেকে নিয়ে মেদাকুল নিবাসী তুলসীরামের সাথে পালিয়েছে।
*
উহুম না উহুম না করে পালকির একপাশে তুলসী,অন্য পাশে অন্য বেহারা। একটা মৌ বুনো গ্রাম ঘ্রাণ চারিদিকে। বোরো ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে নানা রঙের আবির মাখা পালকিটা আজ অন্য দোলনায় দুলছে।
দূর থেকে ‘সাবধান হুশিয়ার..জাগো জাগো..ইয়া আলী’ প্রচণ্ড ধ্বনিতে খাঁ সাহেবের লাঠিয়াল বাহিনী ধেয়ে আসছে পালকির দিকে। তেল মাখা চকচকে লাঠিয়াল বাহিনী অনেক্ষণ পর একটা বীর কাজ পেয়ে উদ্বেলিত,রোমাঞ্চিত। হা রে রে রে বলে পালকিটা ঘিরে ধরে। তুলসীরামের সাথীরা ভয়ে হতবাক। তুলসীরাম হাত তুলে সবাইকে শান্ত থাকতে বলে আস্তে করে কাঁধ থেকে পালকিটা নামিয়ে রাখে ক্ষেতের পাশে।
পালকির দুলুনীতে ছেলেটার তন্দ্রা লেগেছিল। লাঠিয়ালদের বিকট চেঁচামেচিতে মা ছেলে লাল পর্দাটা সরিয়ে বাইরের অন্ধকারে মুখ রাখে। পালকির সামনে ঝুলানো হারিকেনের আলোতে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না সব। অস্পষ্ট অনেক মানুষ তার তুলসীদাকে ঘিরে। ঠাণ্ডা একটা লাউ ডুগডুগি সাপ ভয় তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায়। চোখ বন্ধ করে ফেলে তীব্র বিষ ভয়ে।
ভগবান ভগবান শব্দ ধ্বনি ছোট ছেলেটাকে গ্রাস করলো। সে মায়ের আঁচলে ঘিরে রেখেছে তার ছোট্ট নিষ্পাপ মুখ। এতো নিকষ অন্ধকার চারপাশ। পাশের আশুকাঠি গ্রাম।
*
তুলসীরামের কালই যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনী সংলাপ আছে পার্টি অফিসে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রথম তফসিলে তাদের পূর্ব বংশ নামের উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যাক্টের আওতায় বঙ্গীয় আইনসভায় তফসিলী সম্প্রদায়ের জন্য বিশ শতাংশ (২০%) আসন সংরক্ষিত করা হয়। নমশুদ্র শ্রেণির মতো অনুন্নত না হলেও এ আইনে মুসলমান জনগোষ্ঠীও তাদের জন্য সংরক্ষিত সাধারণ আসনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার লাভ করে।
*
ক্ষেতের আল ধরে লাল রঙা রক্তের একটা ছিপছিপে ফিতা। সাহেবরামপুর গ্রামের এই জমিন খুব ভালো। পিচকারীর মতো রক্তের এই বেগমান বেগ সে শুষে নিচ্ছে। কোথাও রক্তের দাগ কালচে হতে শুরু করেছে। কতোগুলো লাল কালো পিঁপড়া রক্তের ঘ্রাণ পেয়ে বেরিয়ে এসেছে।
উদয় পালের কেরায়া নৌকার মাঝির মন খারাপ। আজ তার যাত্রী মাল সামান নিয়ে উঠবে না। আড়িয়াল খাঁ নদীর বুকে হারিকনের আলো মাখা পানসি নৌকা,গয়না নৌকা। কোথাও ঝপাত ঝপাত শব্দ।
কোথাও পাড় ভাঙ্গছে। ভাঙ্গনেরও তো শব্দ আছে।
রশীদ বয়াতি,হাটে এতোক্ষণ যে পুঁথি পাঠ করেছে;সে তার ছোট নৌকা প্রস্তুত করছে বাড়ি ফিরবে। রাত হলো বেশ। দীর্ঘদিন আলকাতরা না মাখার কারণে আজকাল অল্পতেই নৌকাতে পানি ওঠে। পুরানো এক সানকি দিয়ে নৌকার পানি সেঁচতে হয়। রশীদ বয়াতির ছেলে পানি সেঁচে।
বয়াতি গান ধরে;
একটি কলির দুইটি পাত , তাহি তো , প্যাটের ভাত
পাহি পাহি পাতা তরি ,তকরি ভরাই
হায়রে ,হায়রে হায় ,হায়রে হায়রে হায়রে হায় এ সখি জিয়ে কি উপায় ...
দু টাকার বাজার করি ,বাকি আনি লাউ পানি
সারাদিন পাতা তরি হপ্তা হিসাব পাই
হায়রে ,হায়রে হায় ,হায়রে হায়রে হায়রে হায় এ সখি জিয়ে কি উপায় ...
বাবু ভাই এর ছানা পোনা ইস্কুল পরে যায় রে
মজুর ছানা পোকা বিচে যায়
হায়রে ,হায়রে হায় ,হায়রে হায়রে হায়রে হায় এ সখি জিয়ে কি উপায় ...
3 মন্তব্যসমূহ
পড়া সার্থক। এমন গল্প বারবার পড়তে মন চায়। সবকিছু ছড়িয়ে থাকে সুখী বিষণ্ণতার মতো। মুগ্ধ পাঠক হয়ে থাকলাম এ গল্পের!
উত্তরমুছুনখুব ভালো লেগেছে। মাটির ঘ্রান, ব্যস্ত গঞ্জের কোলাহল আর বরিশালের কিছু এলাকার খ্রিস্টান্দের উৎপত্তির গল্প খুব সুনিপুনভাবে ফুটে উঠেছে এই গল্পে। আরো লিখো বন্ধু।
উত্তরমুছুনপড়ার পর আপনি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল. অতীত যে এখানে কথা বলে উঠল.
উত্তরমুছুন