শিপা সুলতানা'র গল্প : উলুধ্বনি

বুলবুলি... এ্যাই বুলবুলি...

আব্বাস এতো কুনকুন করে ভাতিজিকে ডাকে যে, বুবলি শুনেও না শোনার ভান করে। এই না শোনাতে তার মায়ের শতভাগ মত আছে জানে বুবলি। চাচা মোটেও ভাল না। তার নাম ভাল ভাবে বলে না। চাচা খুব 'গেয়ো', না হলে বুবলিকে কেউ বুলবুলি ডাকে! ভেংচি কেটে খেলায় মন দিলো সে। আব্বাস তখন সুর পাল্টে 'মাই ডিয়ার বুবলি... ডাকতেই চাচার কোলে ঝাপিয়ে পড়লো সে। এখন যদি আব্বাস তার পা থেকে পায়েল খুলতে যায় বা ভেঙে একটা দানা ভাঙতে যায়, বুবলি নাটক করে বাড়ি মাথায় তুলবে, তাই আব্বাস বললো, চাচ্চু, পায়ে ছিঃ লেগেছে, আসো ধুয়ে দেই...

রুপা ধোয়া পানিও জোগাড় হলো, রীতা ভাবি গা ধুতে গেলেই হাত গলা থেকে সোনা খুলে সেলফে রাখে, আব্বাস চায়ের কাপে করে সোনা ধোয়া পানি আগেই তুলে রেখেছে। এখন সেই পানি দিয়ে
লেখার টেবিল মুছে বিসমিল্লাহ বলে বসলেই হলো। 'চাচ্চু গান বলো...বিছানায় না বসে বরাবরের মতো বালিশের উপর ঝেঁকে বসেছে বুবলি। বলতেই কুনকুন করে ছড়া কাটতে লাগলো আব্বাস

'বুলবুলি গো সই/দুক্ষের কথা কই
মা মরলা ছোট থাকতে/বাপে করলা বিয়া
হাতন মা'য় ভাত দিলা/ মুখ মুরা দিয়া...

মুখ মুরা বলতে গেলে সত্যি সত্যি মুখে মোচড় দিতে হয়, তাতেই খলখল করে হেসে ওঠে মেয়েটা। যদিও আসল ছড়ায় মুখের বদলে পুটকি/পাছা শব্দটি ছিলো। ভাবির কানে গেলে ঘাড় ধাক্কায় বিলম্ব নাই, তাই আপনা থেকেই সতর্ক আব্বাস।

কাগজ কলম আর চায়ের মগ। এই মগটি মন্টুর বৌদির কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে আনা। কে জানে এটা মগের প্রত্যাবর্তন নাকী সৌজন্য সফর। মন্টুর বৌদির দাদা ঠার্কুদা তো বেশিদিন হয়নি ওপারে গেলো। যাই হোক, মগটির গায়ে হাড় দিয়ে করা কাছিমের কারুকাজ দেখে রান্নাঘরের সেলফে রাখতে দেয়নি ভাবি। আব্বাস পাঁচ নাম্বার চুমুক দিয়ে সাবধানে ভেতরটা দেখে নেয়, আরামসে আরো দশ চুমুক দেয়া যাবে, তবু সামনের চেয়ারটায় এসে বসলো না সে। শালার সোনা রুপায়ও ভেজাল ঢুকে গেছে? ছিঃছিঃ... পাক কামে গালাগালি করা যাবেনা, আঙুল দিয়ে ফের পানির ছাঁট দেয় সে।

এ্যাই বাবলু...এ্যাই....দুইটা ফুল পেড়ে দিয়ে যা তো! জবা ফুলের ডাঁটা তিনটি এ্যশট্রে চাপা দিতেই দেখে নাতী অথবা নাতনীর কালো একটি পিন্ড কাঁখে ফেলে নানী অথবা দাদী নামে একটি কুঁজো বুড়ি এগিয়ে আসছে তার দিকে। আব্বাস লেখালেখি নিয়ে খুব চিন্তিত এমন ভাব ধরে থাকে মুখের পেশিতে। সামনে খালি চেয়ার দেখেও অভ্যাসবশত বুড়ি গিয়ে বসলো সামনের বারান্দায় আর প্রশস্ত উঠান আর গড়াগড়ির বিস্তর বালু দেখেও কালো পিণ্ডটি আরো সেঁটে থাকলো বুড়ির গায়ে। ধুর এই শুরু হলো। কার জন্য বসে আছি আর এলেন দেখো কে! এখন উনার লেজ ধরে ধরে না চৌদ্দগুষ্ঠি রওয়ানা হয়। আব্বাস উদাস হবার ভাব করে গেটের পাশের রক্তজবার ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাড়িতে ফুলগাছ বলতে এই এক জবাফুল। ঘুম ভাঙার পর এই গাছটিই তো রঙ মাখিয়ে দেয় চোখের ভেতর। শীত নাই গ্রীষ্ম নাই, রোদ বৃষ্টির ধার না ধেরে ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ফুটিয়ে বাড়ির সামনে আলো ধরে আছে। আর কোন গাছ বারটা মাস এমন পরিশ্রম করে ভাবতে চেষ্টা করে আব্বাস...

বাবারে বো....আইজ সাত আটদিন অইলো আমার পুড়ির কোনো খুজ নাই, দুধর নাতিরে লইয়া কতো যে দিগদারিত আছি...আল্লারে বা ...আমার অতো ভালা পুড়ি...

দ্যাখো অবস্থা। আগে পিছে কিছু নাই, হুট করে সীতার বনবাস। তার উপর নালিশ জানানোর ধরনও পছন্দ হচ্ছেনা তার। নালিশ কি তার কাছে না আল্লা মাবুদের কাছে, তাই তো পরিস্কার না।

তা আমি কি করবো...জবা ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে মুখ খুলে আব্বাস। আরে আরে...ফুলের উপর উড়তে থাকা মথের ঝাঁক থেকে একটা মথ ঠুক করে মুখে পুরে মজনুদের টঙ্গি ঘরের কোনায় উড়ে গেলো একটা চড়ুই। কোনায় বুড়ো নিমগাছের ডালে এক ঘর কবুতরও থাকে। চার/পাঁচ বছরে একবার দেশে আসে মজনুরা। তার আগে তার মামারা এসে ঘরবাড়ি বসবাস যোগ্য করে রাখে। সেই বাড়িতে বছরের পর বছর কতো কিছুর যে বাস, বিদায়। আব্বাস জনে জনে নাম মনে রাখেতে পারে।

খুঁজে টুজে দেখো...বুড়ির তবু উঠার নাম নাই। তার বদলে পা থেকে চিনে জোঁক ছাড়ানোর মতো নাতিকে উঠানে নামিয়ে দিলো, যেনো চরে টরে খাক কিছু।

গেটের ভেতর ঢুকতে গিয়ে মাথার ছাতাটা গুটিয়ে নিতে নিতে দুবার কেশে নিলেন বশির মাস্টার। টেবিলের তলায় আব্বাসের পা জোড়া অজান্তে শিরশির করে উঠে। পা জোড়ার এ্যনাটমি না পোস্টমর্টেম কি যেনো করলে এখনো বশির স্যারের বেতের বাড়ির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে। সালাম দেবার আগে সতর্ক চোখে সামনের চেয়ারটার দিকে তাকায়, তার ইচ্ছা নয় স্যার এখানে বসুক। কী মনে করে বশির মাস্টারও বাড়ির ভেতর চোখ বুলিয়ে বুড়ির মা হারা নাতির উপর দৃষ্টি ফেলে রাখেন।

আমি কাকে বলি.. কি করি.. কোথা যে যাই...সৌরভ, জানোইতো দুই গাধার বড় গাধা...মেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের বিয়াল্লিশ হাজার টাকা নিয়া লাপাত্তা। হরতালের জন্য ব্যাংক বন্ধ, পরদিন আবার শুক্রবার। ভাবলাম বাড়িতে রাখি, একদিনই তো...তিনদিন থেকে কতো খুঁজতেছি...

ফের নিঁখোজ সংবাদ। আব্বাস কি থানা খুলে বসেছে! কিছু বলতে যাবে, দেখে গোটানো ছাতা খুলতে খুলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন স্যার। কেনো এলেন কেনোইবা কিছু না শুনে বেরিয়ে গেলেন, পেছন থেকে ডাকতে গিয়ে পায়ে শিরশিরানি টের পায় আব্বাস।

বুড়ির নাতিটা উঠানের কোনায় এক ছোবা দূর্বা ঘাস আবিস্কার করে তা থেকে পোকা, জোঁক কিংবা দূর্বার নরম ডগা ছিঁড়ে মুখে পুরলো, বুড়ি সেদিকে তাকিয়ে কিছু দেখলো না বা উঠে গেলোনা।

আমি নিজে সাক্ষি... তে আবার সাক্ষি কিতা বেটা....খালি বড় বড় মাত...

যেলা মাতরা অলা কথাকান টিক থাকে যেন

না থাকলে কিতা আমার বাল....

এ্যাই এ্যাই খবরদার...মুখ খারাপ করা চলবে না! আব্বাস দ্রুত সোনা রুপার পানি ছিটাতে থাকে টেবিলে। আগত দুজন হকচকিয়ে গেলেও মুখ বন্ধ করে ফেলে বাড়ির ভেতর চোখ বুলাতে থাকে।

কথা নাই বার্তা নাই হুটহাট মানুষের বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়া, তার উপর জবানের কী ছিরি। লোক দুটোর দিকে চোখ ফেলে সে। দুজনের দ্বিতীয়জন টেট্রনের হলুদ প্যান্টের সাথে খয়েরি ফুলহাতা শার্ট ইন করে পরেছে, শার্টের পকেটে গোলাপী সুতা দিয়ে গোলাপ ফুল আঁকার কসরত করে দুধফুল এঁকে দিয়েছে কেউ একজন। পায়ে সস্তার একজোড়া স্যান্ডেল, মাথার চুলে সরিষা তেল দিয়ে বাঁকা সি্ঁথি কাটা। লোকটার পরিচয় বের করার চেষ্টা করতে থাকে সে। পাথর বালুর জোগানদার? তরিতরকারীর ফড়িয়া? শারিঘাটের দালাল? তবে লোকটার ছিপছিপে শরীরে সাপের পিচ্ছিলতা, ভাড়াটে খুনিও হতে পারে আসাম ত্রিপুরার।

প্রথমজনের শাদা শার্টের নীচে লন্ড্রি ফেরত শাদা লুঙ্গি, পায়ে বাটার স্যান্ডেল, কুতকুতে চোখে সুরমা মাখা, ঠোঁটে পানের রসের উপর স্টার সিগারেট, এই লোকটাই তার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে, জুত হয়ে বসতে বসতে ভাবে আব্বাস, এইটা ট্রাকের না লাইটেসের ড্রাইভার!

দালাল লোকটা চুপ মেরে বারান্দায় বসে সিঁড়ির তিন নাম্বার ধাপে তার ঢ্যাঙ্গা পা জোড়া বিছিয়ে বুড়ির নাতির ঘাস না পোকা খাওয়া দেখতে লাগলো আর লুঙ্গির কোছা ঝাড়া দিয়ে বুড়ির দিকে এগিয়ে গেলো ড্রাইভার।

ও বুড়ি..কিতা বেপার? ভাগ বাটুরার কেইস নি?

বুড়ি কথার জবাব দেয় না, ফিরেও তাকায় না দেখে আব্বাস খুশি হয়। তার বাড়ি তার উঠান আর কথা বলে কি ভঙ্গিতে দ্যাখো...

বুড়ি তুমি বাড়িতে যাও, দেখি কী করা যায়...গলায় আন্তরিকতা মেখে বুড়িকে আশ্বাস দেয় সে কিন্তু বুড়ি তোয়াক্কা করেনা আব্বাসকেও। আব্বাস খাতা টেনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তার দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠে ড্রাইভার।

আমরার দিমাগি বিবি...তানর দিমাগ অইছে, মিঠা জরদা দি পান গুয়া দেউক্কা বিবিরে...হো হো হো...

ড্রাইভার ভাববাচ্যে কথাবার্তা শুরু করলে দ্রুত লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে আব্বাস। যেনো ঢ্যাঙ্গা আর ড্রাইভার বুঝে তাদের ফালতু বাতচিতে তার মতো মানুষের কোনো আগ্রহ নাই। দিনের পর দিন যায়, বছর ঘুরে বছরের সংখ্যা বাড়ে, সামনের চেয়ারটায় তার এসে বসার অপেক্ষায় জীবন গড়িয়ে যায় আব্বাসের। ঘরের ভেতর বসে না সে, যদি সে আসে, যদি সে এসে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে, যদি ছুঁয়ে দেয় আব্বাসের একটি আঙ্গুল, সেই আগুনের তাপে কি সে পুড়ে যাবে না! বন পোড়া শালকাঠের মতো ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়বে না সে! তার চেয়ে খোলামেলা উঠান, উঠান ভর্তি দিনের রোদ, দুপুরের নির্জনতা, সে আর মজনুদের নিমগাছের চড়ুই, আসুক সে, এসে একবার বসুক, একটি কথা বলুক কেবল, বলেই চলে যাক, চিরতরে ক্ষমা পেয়ে যাবে সে।

মাথার শিরা কখন যে চেপে ধরেছিলো, চোখের সামনে কুচিকুচি আলোর টুকরা উড়ছিলো দেখে হাত দুটো ছেড়ে দেয়। কি মতলব নিয়ে লোক দুটো আসতে পারে, ভাবতে থাকে সে। ড্রাইভার কি হাতেনাতে ধরেছে ঢ্যাঙ্গাকে? বালু পাথরের চালানের দুই নাম্বারী? মদ? নারী চালানে ঘাপলা? আসুক যার যা ইচ্ছা নিয়া, কি বলবে বলে বিদায় হোক হারামজাদারা। দিন নাই রাত নাই খালি আনাগোনা...নেতিয়ে পড়া জবাগুলোর দিকে তাকায় সে। এক জোড়া গোলাপ নিয়ে যে বসবে তার উপায় নেই। একজোড়া গোলাপের দাম দশ টাকা। ভাবা যায়! তার উপর অগা মগা বগা সবার বিয়েতে গাড়ি গাড়ি ফুল, বাড়ি ভর্তি ফুল, গেটে ফুল, খোঁপায় ফুল, ডাস্টবিনে, বাসরঘরে হাঁটু সমান ফুল। ফুল যেনো আবর্জনা, ঝাড়ু দিয়ে স্তুপ করে রাখা ফুলের ঢেকি। গোলাপের কথা মনে হলে বমি আসে তার।

বাবলু...এ্যাই...আরো দুইটা ফুল দিয়ে যা ভাই...জবা ঝাড়ের দিকে অপার নয়নে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে। মা বলতো বেহায়া গাছ! কনি আঙ্গুল সমান ডাল, মাটির নাগাল পেলে দিন পনেরো পর ফুল ছাড়তে শুরু করে। আব্বাসের ইচ্ছা করে মায়ের মতো ঝাপটে ধরে গাছটিকে। আমার গাছ...আমার মা গাছ...আমার জবা...

এই জন্যে বলে নিজের খেয়ে বনের ভইষ তাড়ানো...অশিক্ষিত পাবলিক...আমার কি দরকার আছিল ইলেকশন করার, ভাবলাম গরিব চাসা টাসার উপকারে আসি...

থপথপ করে উঠানের মাটি কাঁপিয়ে আসছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। লোকটা সব সময় কথা বলে বিপক্ষ দলের এমপি সামাদ খানের ঢংয়ে। কথায় কথায় পাবলিক, নির্বাচন, দূর্নীতি, ইশতেহার ইস্যু, উন্নয়ন... ভাবখানা যেনো নেক্সট ন্যাশনাল ইলেকশনে পার্টিসিপেট করবে সে, অথচ আব্বাস জানে এবারের ইলেকশনেই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ার থেকে পাছায় লাথি দিয়ে ফেলে দেবে তার পেয়ারের পাবলিক। লোকটা সবচেয়ে বেশি কসরত করে 'শুদ্ধ' ভাষায় কথা বলতে।

আমি বারবার কইছি, পাবলিকের সহযোগিতা না পাইলে দূর্নীতি নির্মূল সম্ভব নায়, কে হুনে কার কথা...

বকোয়াস বন্ধ কর বেটা, নইলে মুখেদি পাও ঢুকাই দিমু...

ড্রাইভার তার লন্ড্রি ফেরত লুঙ্গির কোচা ধরে এমন ঝাঁকুনি দিলো যে বুড়ি পর্যন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ারম্যানকে দেখলো!

চুপ...চুপ...চুপ..বললাম না আমার এখানে মুখ খারাপ করা চলবেনা?

শুওরের বাচ্চা শুওর...বলতে বলতে সিঁড়ির গোড়ায় শোয়া কুকুরের পেটে কষে এমন লাথি বসায় ড্রাইভার যে সেটা একবার মাত্র কু...উ... করে বুড়ির কোলের উপর গিয়ে পড়ে। আব্বাস হিসাব কষে দেখে যে এদিকে পড়লে একেবারে তার টেবিলের উপর এসে পড়তো। সবোর্চ্চ ব্যস্ততায় কাগজ কলমে মন ঢালে সে। এক সময় চেয়ারম্যানও ঢ্যাঙ্গার পাশে বসে পড়লে আব্বাস ফের জবা ঝাড়ের ওপারে তার চোখজোড়া পাঠায়। জবাঝাড়ের ওপারে গেট, গেটের ওপারে সদর রাস্তা থেকে নেমেই মাঠ, মাঠের উপর বিছানো লালরঙা মেঠোপথ, পথের উপর শীতের শুকিয়ে যাওয়া ঠান্ডা শিশির, পায়ের তলায় শিরশির করে তার...

বড় দাদা...রোজ রোজ এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখো?

বাড়ি

ওঠাতো মাঠ

মাঠের পরে

মাঠের পরে তো বন

বনের পরে

শুনেছি নদী

নদীর ওপারে সোনাঝুরি পাহাড়, তারপর হাওর, হাওরের দক্ষিন কোণায় আমার বাবার ভিটা...আমার মাইজি বাবাজির কবর...

তুমি দেখতে পাও?

স...ব...

কিতা মিয়া..সারাদিন রইদো বওয়াইয়া রাখতায় নি? ড্রাইভার এসে টেবিলের উপর থাপ্পর দিলে ফাতিমা বুবুর দাদা, তার অসমাপ্ত কথা, মাঠ, চিতার পাহাড়, সোনাঝুরি, হাওর, বাড়ি, কবর, এক নিমেষে নাই হয়ে বুকের ঢিপঢিপানি কানের ভেতর বাজতে শুনে আব্বাস। সামনের খালি চেয়ারে চোখ বুলিয়ে মাথার শিরা চেপে ধরতে যাবে, দেখে ড্রাউভার দুই লাফে চলে গেছে গেটের বাইরে।

আল্লার গজব পড়বো...ঠাঠা পড়বো...বংশ নির্বংশ অইবো...আল্লারে বা তুমি তারার মাথাত গজব ফালাইয়ো...

বাড়ির সামনে দিয়ে বিলাপ করতে করতে যাচ্ছে লোকমানের মা।

ও বুড়ি কই রওয়ানা?

ড্রাইভার দুদিকে দুহাত মেলে বুড়ির পথ আগলে দাঁড়ায়।

আর কইওনা, আমার একজোড়া পন্জ উঠানো থইয়া ফরিদার মার ঘরো গেছি, কুন চুরুনি যে চুরি করি লাইলো, আল্লাগো...যাইবার বড়পোতার মুকামো, বাত্তি দিয়া আইমু, চুরুনির গতরো আগুন লাগলে আমার জুতা বারইবো...একজোড়া মোমবাতি আগলাতে আগলাতে চলে গেলো বুড়ি।

একা এক ঝুপড়িতে থাকে বুড়ি। লোকমান নামে কাওকে কোনোদিন দেখেনি কেউ, তবু নাকী তার' আসমানর চান্দর লাখান এক পোয়া আছিল আমার লোকমান'। বুড়ির সেই ঝুপড়ি থেকে, উঠান থেকে প্রায়ই নারকেলের খোল, ভাত নাড়ার কাঠের হাতা, দেয়াশলাই থেকে কাঠি, কাঁকই, গাছের বরই, ঘটি থেকে চুন ইত্যাদি ডাকাতি হয়ে যায়। বুড়িও শাপ শাপান্ত করতে করতে দুই টাকার মোমবাতি দিয়ে আসে মোকামে। তখন কিছুদিন কারো মাথায় বায়ূ চড়লে বা তরকারীতে বাগাড় দিতে গিয়ে হাতে গরম তেলের ছিটা পড়লেও উফ: টা গিলে ফেলতে হয় বুড়ির ভয়ে। বুড়ির হক টাকার বাতি, বেরথা যাবেনা। কোমরের কাপড় মাথায় তুলে মুখের সুখ নিয়ে তবেই থামবে বুড়ি। পথ থেকে ফিরিয়ে চোখজোড়া ঘরের ভেতর পাঠায় আব্বাস। এক কাপ চা পেলে হতো কিন্তু বাড়ি ভর্তি মরার গুস্টির উঠার কোনো নাম নাই। খালি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে বুকের অবশিষ্ট বাতাস বেরিয়ে আসে তার।

আবার হইচই। ড্রাইভার যেনো মজার হাঁড়ি পেয়ে গেছে আজ, ফের চলে গেছে বাড়ির বাইরে, তার পিছে পিছে ঢ্যাঙ্গা, বুড়ি, চেয়ারম্যান এমনকি নেতিয়ে পড়া কুকুরটি পর্যন্ত। নানি তাকে ফাঁকি দিচ্ছে ভেবে ঘাস খাওয়া ছেড়ে কালো পিন্ডটি পর্যন্ত হামাগুড়ি দিয়ে গেটের দিকে যাচ্ছে, অথচ আব্বাসের নড়ার উপায় নেই। তার মন বলছে যে আসার কথা সে আজই আসবে, আসার হয়তো এটাই লগ্ন, এসে যদি দেখে আব্বাস নাই! না না, মুহূর্তের ভুলে সব খুইয়ে ফেলবে না সে।

বাইরে শব্দ তুমুল হচ্ছে, আব্বাস শক্ত হয়ে বসে থাকে। শব্দ তুমুলতর হচ্ছে, আব্বাস প্রথমে চেয়ার পরে টেবিলের উপর উঠে বাউন্ডারীর ওপারে গলা লম্বা করে দেখতে থাকে। পথের এপার ওপার, বজলুদের পুকুর পাড়, মান কচুর পাতার ফাঁকে কুদ্দুসের নয়া বউ, বাঁকের মুখে বাজারের থলে হাতে এমনকি বশির স্যার পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই তাকিয়ে আছে বামন বাড়ির দিকে। বাড়ি ঘরের চিপা চাপা, মায়ের কাঁখ থেকে কাঁখের বাচ্চা, ডোবা থেকে কচুরিপানার ফুল ছিঁড়ছিলো বজলুর ভাতিজি, এক হাতে এক গোছা বেগুনি ফুল, অন্যহাত ছিঁড়তে যাওয়া আরেকটি ফুল, সেভাবেই তাকিয়ে আছে ও বাড়ির দিকে। দুপুরের দিকে বাতাস দম নিয়েছিলো, খানিক আগে শুরু হয়েছিলো ঝিরঝিরে হাওয়া, আব্বাসের মনে হলো হঠাৎ করে থেমে গেছে তা ও। রাত্রি নামার আগে যার যার অবস্থান নিচ্ছিলো মেঘগুলো, হঠাৎ করে থেমে পড়েছে গাঁয়ের উপর, আগ বিকেলেই তাই সমস্ত গাঁয়ের উপর খয়েরি খয়েরি অশুভ আলো, সব দেখে শুনে ভয় পেয়ে বাঁধা দড়ি ছিঁড়ে গ্রামের বাইরের দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছে সোনা মিয়ার গাই গরুটি, তখুনি একদল মানুষের উলুধ্বনি, বিলাপ ক্রমে ক্রমে আব্বাসের কানের আওতায় চলে আসছিলো। আগুন, ভূমিকম্প? বজ্রপাত? বাতাস যেভাবে দম ধরেছে, মেঘ যেভাবে থেমে পড়েছে গাঁয়ের উপর, যে যেখানে ছিলো তাকিয়ে আছে একই দিকে, এমন দিনে কি রোজ কেয়ামত হবে? আজ কি সেই দিন আম্মা? কেয়ামত যেনো বুধ না বৃহস্পতিবারে হবে! আজ কি বার? এমন দিনেই তো হিন্দু বাড়ির মেয়েরা উলুধ্বনি দিয়ে আপদ তাড়ায়। কিন্তু ও বাড়িতে তো আজাদ রা থাকে। উলুধ্বনি আসছে তাহলে কোথ্থেকে! আর আগুন লাগলে তো ও বাড়ির দিকে লোটা বদনা নিয়ে দৌঁড় দেবার কথা গ্রামসুদ্ধ লোকে।

আব্বাস দু পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে ভর দেয়, পঁচিশ ত্রিশ জনের একটি দল চোখের আওতায় আসে। যুবক যুবতী, শিশু কিশোর, বুড়ো বুড়ি। প্রত্যেকের কাছেই কিছু না কিছুর বোচকা, পুটলি, বস্তা, সাপের মতো প্যাঁচানো গোল গোল পাটি, টিনের বাক্স। আজাদদের বাড়ি থেকে নেমে জোড় দীঘির মাঝপথ দিয়ে সদর রাস্তায় উঠে আসছে। দলের মাঝখান থেকে হঠাৎ এক পৌঢা মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলো, বাকী কেউ এগিয়ে এলো না ঠিক কিন্তু গগনবিদারী বিলাপ উঠলো বয়স্কদের কন্ঠে...পা হড়কে পড়ে যাচ্ছিলো আব্বাস, দ্রুত সামলে চারপাশে বাড়িঘর কোনাকাঞ্চি মানুষের মুখ ঘুরে এসে কান খাড়া করে...পরেশ বামন দশ হাজার টাকায় প্রায় সমস্ত জমিদারি বন্ধক রেখে যুদ্ধের সময় ওপারে গিয়েছিলো। পনেরো বছর পর ফিরে আসছে তার বংশ বিরাদর। বাড়িতে উঠতেই দেয়নি আজাদরা। দরকার হলে দু চারটা বডি ফেলে দেবে কুপের ভেতর...

দুহাতে মাথার দুপাশ চেপে ধরে জানলা ছেড়ে বিছানায় উপুড় হয় আব্বাস। মাথায় টনটনে ব্যথা শুরু হতেই পুরো গ্রাম উধাও হয়ে গেলো সামনে থেকে। এতো বছর পর আজ ইচ্ছা করছে টেবিল, টেবিলের উপর রাখা খাতা, কলম সব লাথি মেরে ছয় তলার উপর থেকে নিচে ফেলে দেয়। কেউ কোনোদিন তার সামনে বসবে না, বসে তার মগজের লক্ষ কোটি কোষ থেকে উলুধ্বনির যন্ত্রনা ও মুছে দেবে না কোনো অদ্ভুত মন্ত্রবলে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ