দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত'র গল্প : সৈকত

ফের রক্তাক্ত ফ্রান্স। হেডলাইনটা চোখে পড়তেই মুখ ব্যাজার করলেন ধীমান । এই এক ফ্যাশন হয়েছে মিডিয়ার – সন্ত্রাস আর সন্ত্রাস । ধুত্তোর । আগে টেকনোলজি ছিল না, ভূ- ভারতের বাইরে সুলুক সন্ধানে সময় লাগতো । এখন ভূমিকম্প ,আগুন বন্যা , বিক্ষুব্ধ মিছিল যাই হোক –ড্রয়িং রুমের মধ্যে দিয়ে তা পার করাবে সেকেন্ডের মধ্যে। এরই নাম গ্লোবালাইজেসন । জাপানে সুনামি । তুমি পরমুহূর্তেই জলের তলায়। নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প ।
তোমার ইয়ের তলা ঠকঠক করবে । পাঁচ বছরের নাতিটাও আজকাল ভূতের গল্পে ভয় পায় না। বরং টিভির দিকে নিশানা করে। দাদু, ঐ দ্যাখো - রিয়েল টেরর। তাদের ছোটোকালে সন্ধেবেলা আমলকি গাছের মগডালে তাকাতেই ভয় পেতেন।
ঠাকুরমা একবার শুধু বলেছিলেন বেহ্মদত্যি আছে। সেদিন শুনলেন বউমা মোবাইলে কাকে যেন ফিসফিসিয়ে বলছে ‘খুব ভয়ের ব্যাপার। হোয়াটস অ্যাপ প্রোফাইলে নিজের ফটো দিবি না কক্ষনও । টেররিস্টরা হ্যাক করে নেবে।‘ ভয় আর ভয়। ধীমান বাঁ হাতে সরিয়ে রাখলেন খবরের কাগজ।

শুভ্রা চলে যাবার পর থেকেই রোগে ধরেছে ধীমানকে। কোনও কাজে পুরোপুরি মন বসে না। পঁয়তাল্লিশ বছরের দাম্পত্য খুব কম সময় নয়। শুভ্রা অবশ্য বেশি ভোগে নি। সুগারের রোগী ছিল। সংযমী জীবনযাপন করত। অথচ সে-ই চলে গেল ঘুমের মধ্যে অতর্কিতে । ডাক্তার বলল সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক । ডায়বেটিকদের নাকি হামেশাই এমন হয়। ধীমান বোঝে মৃত্যুর পরই শুভ্রার সাথে তার সত্যি বোঝাপড়া শুরু হল । শেষের দিকেও ঝগড়ার সময় অনুযোগ করত ধীমান তাকে বোঝেই না, নিজের তালে চলে। সেটা খুব একটা মিথ্যে নয় । ধীমানের যা চাকরি ছিল – শুভ্রার আঁচলের ছায়ায় জিরনোর ফুরসত মিলত কই ? শুভ্রা আর দুটো মাস অপেক্ষা করতে পারল না ? রিটায়ারমেন্টের দিন সে কি উৎসব অফিস জুড়ে । বড়সাহেব অবসর নিচ্ছেন বলে কথা। বিরাট বিরাট উপহার , গান বাজনা, খাওয়া দাওয়া –এলাহি ব্যাপার। অদ্ভুত ব্যাপার হল কর্মজীবনেরও সেই শেষদিনেই ধীমানের উপলব্ধি হয়েছিল যে তার কর্মচারীরা তাকে কতটা ভালোবাসে । দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে হয়। ধীমান এখন হাড়ে হাড়ে টের পান। 

ব্রেকফাস্ট টেবিলে টাটকা ছানা দিয়ে গেল বউমা। সাথে দু টুকরো আপেল, শসা আর ডিমপোচের সাদা অংশটুকু । কোলেস্টেরল বেড়েছে । ডায়েট তাই চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক । ছেলে অফিস যাবার আগে নিয়ম করে রোজ বাবার শরীরস্বাস্থ্যের খোঁজ নেয়। একটা হেলথ ক্লাবে ভর্তিও করে দিয়েছে ধীমানকে। 

রোজ একসাথে হাঁটবে ,বুঝলে বাবা ? সবাই তোমার মতো রিটায়ার্ড সিনিয়র। 

ধীমান যান। ছেলের কথা অমান্য করার কোনও কারন নেই। বাবার প্রতি এমন যত্নশীল ছেলে আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। কে বলবে যে দুদিন অন্তর বহুজাতিক কোম্পানির কাজে বাইরে যেতে হয়। আজ নিউইয়র্ক তো কাল সিডনি। পরশু দুবাই তো পরদিন স্টকহোম । যেখানেই যাক সারাদিনে অন্তত একবার ফোনে বাবার খবর নেবেই। 

কলিং বেল বাজলো । নিশ্চয়ই পাশের ফ্ল্যাটের মিস্টার মেহতা এসেছেন। নিপাট ভদ্রলোক। হগ মার্কেটে ওঁদের অনেক পুরনো ব্যবসা। ফ্লোরিস্ট । মেহতার দুই ছেলে দেখাশোনা করে। মেহতারও পত্নী বিয়োগ হয়েছে বছর তিনেক। ধীমানের সাহচর্য খুবই পছন্দ করেন। রোজই একসঙ্গে হেলথ ক্লাবে যান । যোগব্যায়াম করেন। বিলিয়ার্ড খেলেন। তাস , দাবাও। মেহতা ঢুকেই সোফায় বসে পড়লেন ধপ করে। 

ভেবেছিলাম ছেলেরা পারবে বাট দে আর স্টিল আনকেপেবল ।

কি হল ? 

আর বলবেন না দত্তবাবু , ফরাসি দূতাবাস থেকে আজ একটা বড় অর্ডার হঠাৎ এল কিন্তু ছেলেরা সাপ্লাই করতে পারল না। অনেক ফুল চেয়েছে ওরা । গতকালের খবরটা শুনেছেন নিশ্চয়ই । নিস এর দুর্ঘটনার । 

না মানে ইয়ে ; ধীমান আলতো করে কাগজটা টেনে নিলেন।

প্রথম পাতাতেই বড় বড় করে দিয়েছে। ফ্রান্সের জাতীয় দিবস ‘বাস্তিল ডে’ ছিল গতকাল। নিস এর সমুদ্র সৈকতে তখন হাজার হাজার মানুষের ভিড় । উৎসবের ভাইরাসে আক্রান্ত আমজনতার খুশির চেহারাটা বদলে গেল এক মুহূর্তেই । আচমকা ঢুকে পড়ল একটি ট্রাক । কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘাতক ট্রাকটি লোকজনকে পিষে দিতে দিতেই ছুটতে থাকে। প্রায় চুরাশি জন মৃত । আহত দুশোর বেশি । ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে এই সন্ত্রাস মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে । 

দত্ত , প্রি-অর্ডার তো সবাই ডেলিভারি দিতে পারে। ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট ইজ দ্য রিয়েল চ্যালেঞ্জ ইন বিজনেস । 

ধীমান চুপ করে গেলেন। পুরনো একটা প্রবাদ মনে পড়ল । কারোর সর্বনাশ তো কারোর পৌষমাস। 

নিস এর সৈকতে কতজন নিরীহ মানুষ কাল মারা গেলো । আর এই মেহতা লোকটি হিসাব করছে শোকাদীর্ণ ফরাসি দূতাবাসের বড় দাঁওটা কেন মারতে পারল না তার কামিয়াব পুত্তুররা। দূতাবাসেরই বা দরদ কত। রাজনৈতিক ধান্দাবাজি । 

মেহতা গড়গড় করে বলে চলেছেন কোন ফুলের কিরকম দাম। সাদা লিলি তো খুব আক্রা এসময়ে। ধীমান সটান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন । 

বউমা , আজ একটু চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ যেতে হবে । বাড়িটা দেখে আসি। 

সেকি বাবা , আগে বলেননি তো । ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছি। ব্রেকফাস্টও পুরো খেলেন না । 

আরে গাড়ি লাগবে না। এগারো নম্বর আছে কি করতে- 

আপনার ছেলে জানলে রাগারাগি করবে।

ওকে বলার দরকার কি । এই তো মেহতাজিকে জিজ্ঞেস করো আমার ফিটনেস কিরকম। হেঁটে পার করে দেব। 

মেহতার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকালেন ধীমান । আসলে হাঁফিয়ে উঠেছেন এই অনুশাসন আর পরিবেশে । 

তার ঠাকুরদার বাবা বঙ্গভঙ্গের সময় চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে বাড়িটি কেনেন। থাম কড়ি বরগা আর নকশা করা খিলানের বাড়ি । পরস্পর গায়ে গা লাগা । প্রতিটি বাড়ির সামনে রক। বাচ্চাবয়সে ধীমান তার দাদুকে আড্ডা মারতে দেখেছেন ঐ রকে বসে। ও পাড়ার ল্যান্ডমার্ক- লিবার্টি সিনেমা হল। কাঁচা বয়সে লিবার্টিতে লুকিয়ে কতবার যে ম্যাটিনি শো দেখেছেন। মাঝে মাঝে না গেলে দম ফুরিয়ে আসে ধীমানের । এই পঁয়ত্রিশ তলা আবাসনের ছায়া কোনদিন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণই না করে ফেলে। 

লিফট বেয়ে নীচে নামতেই দেখা হল প্রতিবেশী মিসেস পাকড়াশি আর একপাল তরুণ তরুণীর সাথে। আঙ্কল হ্যাভ ইউ সিন দ্য অনলাইন ফুটেজ ? জানেন , আমাদের কমপ্লেক্সের রোনিতা সামন্ত ওর ব্যাচমেটদের সাথে ফ্রান্সে গেছে । কাল নিসে যাবার পর আর কোনও খোঁজ নেই। মিসেস পাকড়াশি খুব চিন্তিত মুখে বললেন এমনকি বিচও আর সেফ রইল না। সিডনি হারবারে গত বছর ইয়ার এন্ডিংয়ে গেছিলাম দিওয়ালির মতো ফেস্টিভ্যাল দেখতে। নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে বাজি যা পোড়ায়- ফ্যান্টাসটিক। সেম থিং হ্যাপেন ইন নিস এভরি ইয়ার ফর বাস্তিল ডে। কী আলো আর বাজি। বাট উইল নেভার গো । টেরিবল । 

ধীমানের মেজাজটা খিচড়ে গেল। দেশে কি আতসবাজির রোশনাই কম পড়েছে ! তার জন্য বিদেশের সৈকতে যাবার প্রয়োজনটা কী । অবশ্য সৈকত মানে এক এক জনের কাছে এক এক রকম। তার ঠাকুমা ছিলেন নিষ্ঠাবতী সংসারী । বছরে দশ মাস সংসার করতেন যেন পোয়াতির যত্ন করছেন । । কাঁথার নিপুণ ফোঁড় থেকে পিকদানির ঢাকা , মোচার ঘণ্ট থেকে শুক্তো অম্বল ডালনা চচ্চড়া – প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিসে ঠাকুমার ছোঁওয়া থাকতো । কিন্তু শীত পড়ার শুরুতেই উসখুস করতো ঠাকুমা । ঐ দুটো মাস তার ‘সমুদ্দুর পারে’ যাওয়া চাইই চাই। তখন তিনি এমনকি ঠাকুরদাকেও নিতে চাইতেন না। নিজের ছেলেবেলার সই এলোকেশীকে নিয়ে দু মাস কাটিয়ে আসতেন সমুদ্রের পাড়ে । ধীমানের মনে আছে ঠাকুরদা একবার পুরীর মন্দির ঘুরতে চেয়েছিলেন । ঠাকুমা বলেছিলেন হ্যাঁগো - মন্দিরে গিয়ে কি হবে , জগন্নাথ আছেন সমুদ্রে আর জনসমুদ্রে । দেখার চোখ চাই। 

গা শিরশিরিয়ে উঠল ধীমানের । শুভ্রা খুব ভিতু ছিল। সমুদ্রে নামতেই চাইত না। বিয়ের পর একবার কোভালাম বিচে নিয়ে গেছিলেন ওকে । পা ভিজাতেই ভয় পাচ্ছিল। নারকেলবীথি দেখেই সেবার মন ভরাতে হয়েছিল ধীমানকে। অথচ কত শত ফরেনার তাদের সৈকতে লুটোপুটি করল। ভোগ করে নিল ভারতের ভার্জিন বিচ। পারল না গর্তে ঢোকা লাল কাঁকড়ার দল । দেশি ঘরকুনো প্রজাতি। 

ফ্লাইওভারের মুখ থেকেই অটো পেয়ে গেলেন ধীমান । অটোচালক ছোকরা খুচরো চাইছে কিন্তু তিনি অপারগ।

খুচরো নেই বললাম তো 

উঠলেন কেন গাড়িতে ? ফালতু পাব্লিক যতোসব 

অন্যসময় হয়তো মাথা ঠাণ্ডা রাখা যেত কিন্তু একটু আগেই দেখেছেন ছেলেটা ওর পাশে বসা একটা কমবয়সী মেয়ের সৈকত ছুঁয়ে দিচ্ছে । মেয়েটি দশ এগারো বছরের হবে। বলি বলি করে কিছু না বলতে পেরে অটো থামিয়ে হঠাৎই নেমে গেল। 

মুখ সামলে । ধীমান কেঁপে উঠলেন । শহরটা দ্রুত চরিত্র হারাচ্ছে। এইসব ছেলেছোকরার দল বাপের বয়সী লোককে খিস্তি করতে এক সেকেন্ডও সময় নেয় না।

অটোচালক অদ্ভুত মুখব্যাদান করল। যান উঠুন। আপনার ভাড়া নেব না। 

তোমার সার্ভিস নেব কেন মুফতে ?

বেশি হ্যাজাবেন না দাদু । আসুন এখন । মটকা গরম হয়ে আছে। 

সেকেন্ডের ভগ্নাংশে মনে হল জায়গাটা নিস এর সৈকত । অটোওয়ালা ছেলেটি ঐ নিস এর বেপরোয়া ট্রাক ড্রাইভার । 

ধীমান বিনাবাক্যব্যয়ে উঠে গেলেন। আশুতোষ দে লেনের ভিতর দিয়ে শর্টকাট হবে। প্রপিতামহের আমলের বাড়ি । এখন ঝুরো ঝুরো অবস্থা। পাঁচ ঘর ভাড়াটে আছে বলে প্রোমোটার বাদশা খান এখনও হাত করে উঠতে পারেনি। লোকাল কাউন্সিলর মারফৎ বেশ ক’বার ঘ্যানঘ্যান করেছে ফ্ল্যাট আর শপিং মল তোলার জন্য। ধীমান গায়ে মাখেননি। নেহাত ছেলেটা বাবার সেন্টিমেন্ট বোঝে – অন্য ছেলে হলে কবেই বাড়ি সঁপে দিতো প্রোমোটারের হাতে । 

অদ্বৈত মল্লিক লেনের সব গাছগুলোকে কেটে কি ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে। এহে , সবুজহীন করে দিল পাড়াটাকে । দাশুর চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়লেন ধীমান । এদিকটায় অনেকদিন আসা হয়নি। দাশু আগের থেকে আরও একটু বুড়ো হয়েছে। কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি । ধীমানকে দেখেই চিনতে পেরে একগাল হাসল । 

দু ভাঁড় চা খেয়ে তৃপ্তি করে একটা ফিল্টার উইলস ধরালেন ধীমান । এখানে ছেলের বন্ধুবান্ধব কেউ নেই। চুকলি কাটার বিপদও কম । 

হ্যাঁরে গাছ কেটে ফেললো সব । পাড়া তো মরুভূমি হয়ে যাবে । গরম বাড়ছে প্রতি বছর হু হু করে। 

ইলেকটিকের তারের উপর ডালপালা ভেঙ্গে পড়তিসে । আবার ক্যাবলের তার ছিঁড়ে যায় । বাবুদের এসি মেশিনে পাখির বাসা । গিন্নিমাদেরও অসুবিধে । 

ধীমান একটু বিষম খেলেন।

গিন্নিমাদের ?

সিনথেটিক চুড়িদার পরা একটা মেয়ে এসেছে মোবাইলের রি চার্জ করাতে। 

কুড়ি টাকার টকটাইম দাও 

আজকাল এইসব চায়ের দোকানেই মোবাইলের টাকা ভরা যায় । দাশু টাকাটা নিতে নিতে ধীমানের দিকে তাকিয়ে অর্থবহ হাসল । 

এরেই জিগান না। 

মেয়েটি চট করে আঁচ করেছে ব্যাপারটা । 

গাছ উপড়িয়েছে তাই ? বেশ করেচে। বাসন মাজা, কাপড় কাচা। সারাদিন খাটনির পর শুধু তিনটে সিরিয়াল দেখি। মৌ কতা কও , মধুবরণ আর বেশ করেচি পেম করেচি । তা গাছের আগায় কেবলের তার জড়িয়ে আদ্ধেক দিন ঝামেলা। বউদিরা সব গণসই দিয়েচে গাছ কাটতে হবে । 

ধুর শালা গাছই তো কেটেছে , মানুষ তো মারেনি। কালকের ফরেন কেসটা টিভিতে দেখলি ? 

উরিব্বাস। মালটা ষাঁড়ের মতো লরি নিয়ে তেড়ে যাচ্ছিল । যেদিকে লোক পেয়েছে সেদিকেই পিষেছে ।

বউ ছেড়ে গেলে অমনই হয় রে পাগলা। মাথার ঠিক থাকে না। পেস্টিজ পাংচার। 

মান্তুদা , আমাদের এখানেও শুনছি মেট্রো রেলে ব্যোম মারবে। 

আ বে রাখ তো । অমন অনেক শুনেছি । এখানে কোনও অশান্তি হবে না। সরেস মালের অভাব নেই। পোষাচ্ছে না ছেড়ে দাও। আগের কালে সন্নিসি হতো এখন সন্ত্রাসী হয়। 

ধীমান ঘাড় ঘোরালেন। পিছনের বেঞ্চে জটলা । 

আসল বন্দুক হল এইটা বুঝলি। তুমি প্লেন ঢোকালে কি ট্রাক ঢোকালে ওতে কিস্যু লাভ নেই। একদল খ্যা খ্যা করে হাসছে। ধীমান নিঃশব্দে উঠে পড়লেন । চায়ের দোকানে আদিরসের তুফান উঠেছে । জনাকীর্ণ বেঞ্চে বসেও নিঃসঙ্গ লাগল নিজেকে। 

এরা কী মানুষ ? হুটপাট ফুটপাথে গাড়ি তুলে ঘুমন্ত মানুষ মারা নায়ককে ‘দেব’জ্ঞানে পুজো করে। পোস্টার সাঁটায় ! 

তাদের সময় সত্যিকারের হিরোদের দেখে নিয়েছেন তাঁরা । চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে কত বড়মাপের মানুষ যেতেন । রাস্তাও যেমন চওড়া ছিল , তাঁদের ভিতরটাও । সুভাষ বোস , মুজফফর আহমেদ, বিধান রায়। 

লিবার্টির সামনে এসে একটু থমকে দাঁড়ালেন ধীমান । এপাড়ার ল্যান্ডমার্ক এই বায়োস্কোপ এক সময় জুপিটার নামে পরিচিত ছিল। পরে নাম বদলিয়ে চিত্রলেখা। তারও পরে লিবার্টি । 

এগলি সেগলি করে ধীমান এসে পড়লেন বাড়ির কাছে। 

পাঁচ ঘর ভাড়াটিয়ার মধ্যে তিনঘর ভাড়াই দেয় না। বাকিরা অল্পস্বল্প দিয়ে ঠেকায় । এবাজারে এতো কম ভাড়ায় কলকাতায় থাকার সুবিধা কোথায় মিলবে ? ধীমান কিচ্ছু বলেন না। বেঁচে থাকুক বাপ ঠাকুদ্দার আমলের স্মৃতি । না থাকলেও চোখের দেখাটা তো হয়। বাদশা খান মুখিয়ে আছে ‘সিলভার সিটি’ নামের প্রোজেক্টে তাদের পৈতৃক বাড়িটাকে ঢুকিয়ে ফেলার। এপাড়ায় পরপর বাড়িগুলো সব কিনে নিয়েছে বাদশা। ডেভলপার না হাতি। আগ্রাসন। 

ধীমানকে দেখেই ছুটে এল নাড়ুর বউ মালতি । নাড়ুরা তিনপুরুষ ধরে তাদের ভাড়াটে । মেদিনিপুরের ডোমপাড়া ছিল ওদের আদি নিবাস। বাঁশের কাজের শিল্প ‘চালিশিল্প’ ওদের পারিবারিক পেশা । প্রথম যখন এপাড়ায় আসে মাথার উপর ছাত ছিল না। তার ঠাকুরদা এদের আশ্রয় দেন। সেই থেকে ওরা এখানে। চালিশিল্পের কাজ দেশ বিদেশে প্রচুর প্রশংসা পেলেও তেমন পয়সা জোটে নি ওদের । সবই সেই মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে ঢোকে । ধীমানের কোনও আফসোস নেই এদের বিনা ভাড়ায় রাখার জন্য। নাড়ু বাড়ীর আশেপাশের জঙ্গল আগাছা পরিষ্কার রাখে। ছাদ ঝাঁট দেয়।

জ্যেঠাবাবা চা খাবেন তো ? 

না রে আজ তিনবার হয়ে গেছে সকাল থেকে। তোরা কেমন আছিস ?

তাহলে বসেন । নারকেলের চিঁড়ে করেছি, খেয়ে দ্যাখেন 

সরু সরু করে কুচানো , জিরজিরে, পাতলা নারকেলের শুকনো শাঁস চিনির পাকে ভাজা। ধীমান আগেও খেয়েছেন এখানে। ভারি স্বাদু । 

প্রত্যেকবার একইরকম বানাস কি করে 

মালতি আঁচলচাপা দিয়ে হাসছে।

আমার বাপের বাড়ি বরিশাল । আমরা আপনেগো মতো কাঠঘটি নাকি ? বরিশালে নারকেল আর নারকেল । জলা দেশগাঁ । 

তা নাড়ুর সাথে তোর সম্বন্ধ হল কি করে

গঙ্গাসাগর মেলা। আমার শ্বশুর ওখানে গেসলেন বাঁশের ধামা কুলো এসব নিয়ে। আমরাও বিরাট দল গেছি । গেরামের প্রায় আদ্ধেক লোক । আমার হাতের কাজ দেখে শ্বশুরের খুব পছন্দ হল। 

কি বানিয়েছিলি ? 

নারকেলের দড়ি দিয়ে বড় বড় ঝোলা , চাটাই , ব্যাগ বানাতাম । উনি দেখেই বাঃ বাঃ করতে লাগলেন । তারপর বললেন যত মত তত পথ।

অ্যাঁ ? ধীমানের চোখ গোলগোল । এতো ঠাকুর রামকৃষ্ণর কথা রে। 

মালতি হাসছে। 

আমার শ্বশুর একদম মুখ্যু সুখ্যু ছিলেন সে তো আপনি জানেনই জ্যেঠাবাবা। কিন্তু হাতের কাজে দড় । রসিক মানুষ তো । বললেন যে আমাদের লাইনে যতো ভেন্ন ভেন্ন কারিগর আনতে পারবো ততোই মঙ্গল । আমার সাত বছরের মেয়ে টুসি তো চালিও বানায় আবার ছোবড়ার কাজও করে । 

মালতি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। জ্যেঠাবাবা, একটা কথা কদিন ধরেই আনাচেকানাচে শুনছি । টুসির বাবা ভাবছিল আপনাদের ফেলাটে গিয়ে বলে আসবে। 

ধীমান চোখ কুঁচকালেন। কি এমন কথা ?

আমাদের তুলতে পারছে না বলে খানসাহেবের লোকজন নাকি কুমতলব আঁটছে । 

ধীমানের হাত কাঁপছে । 

বুলডোজার না কি যেন বলে- তাই দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবে এবাড়ি । চুপ চুপ জ্যেঠাবাবা, বাইরের কাউকে যেন বলবেন না এখনি। আমার তো হাড়হিম হয়ে যাচ্ছে শুনে ইস্তক। 

ধীমানের হাত থেকে চিঁড়েভর্তি চামচটা পড়ে গেল । মনে হল তিনি নিস এর সাগরপারে বসে আছেন। তার সামনে বসা মালতি একজন হাসিখুশি ট্যুরিস্ট । 

এখুনি একটা হেস্তনেস্ত দরকার । ছেলেকে ফোন করবেন ? নাঃ থাক। বেচারা এমনিই ব্যস্ত থাকে। ছয় অঙ্কের ফিগারে মাইনে হলে কি হবে কর্পোরেট কোম্পানি গুলো চশমখোর । পুরো নিংড়ে নেয়। তার থেকে সোজাসুজি বাদশা খানের অফিসে যাওয়াই ভালো । কি আর হবে । তার মতো প্রবীণ মানুষকে কি গলাধাক্বা দিয়ে বের করে দেবে বাদশা ? ওকেও তো তিনি দেখে আসছেন সেই ন্যাংটোবেলা থেকে।

লা ওপালার সুদৃশ্য মগে এসপ্রেসো কফি এলো । ফেলতে পারলেন না ধীমান ।

ফ্ল্যাটবাড়ি মানেই জেরক্স কপি , একঘেয়ে -এসব ভাবছেন কেন আঙ্কল ? আজকাল তো লোকে এপার্টমেন্ট প্রেফার করে। গুগলে দেখবেন সারা পৃথিবীতে বেশির ভাগ সিটিজেন বাড়ির বদলে ফ্ল্যাট চাইছে । আরে বাবা, মেন্টেন্যান্স অনেক সুবিধা। বাড়ি হলে আপনাকে নিজেকে ছাত পরিষ্কার করাতে হবে। সিঁড়ি । আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাঙ্ক । ওভারহেড ট্যাঙ্ক । হ্যাঙ্গামা । কমন হলে স্টেয়ারস থেকে পোর্টিকো , গ্যারাজ সমস্ত ব্যাপারে আপনি জাস্ট টাকা দিয়েই খালাস। প্রপার ক্লিন । 

লি কুপারের ফেডেড জিনস , নাইক এর টিশার্ট । র‍্যাডোর সুদৃশ্য রিষ্টওয়াচ । উসকোখুসকো চুলগুলো হয়তো বাদশার স্টাইল স্টেটমেন্ট । ছেলেটা আমেরিকা থেকে এম বি এ করে এখানে প্রোমোটিং করছে কেন ? 

মোনোটোনাস বলছেন ? হ্যাঁ আঙ্কল , মানছি ফ্ল্যাটবাড়ি সব একরকম দেখতে হয়। তো ? 

কাঁধ উঁচু করল বাদশা। ধীমান নাতির কাছ থেকে সম্প্রতি জেনেছেন একে শ্রাগ করা বলে। 

তিনি চুপ।

আঙ্কল , এখন আর সেই জমানা নেই। ছোটবেলায় রচনা লিখতেন না? ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি? এখন যতো একরকম ততো পপুলার। শপিং মলে যান দেখবেন একই ডিজাইন একই ফ্যাব্রিকের শার্ট , ট্রাউজার । আপনাকে জাস্ট বেছে নিতে হবে তার থেকে। জামা জুতো পারফিউম ঘড়ি জুয়েলারি হেয়ার কাট মেক আপ সব কিছু ইউনিভার্সাল । ইউ হ্যাভ টু চুজ অ্যাকর্ডিং টু ইওর সাইজ। 

ধীমানের মনে পড়ল কোথায় যেন শুনেছিলেন কোন আলোচনাসভায় – মানবজাতি বৈচিত্র্য হারাচ্ছে কারণ দ্রুত চেষ্টা চলছে সারা পৃথিবীর সংস্কৃতিকে এক করে দেবার । তখন অবশ্য অতো তলিয়ে বোঝেননি । 

কিন্তু ধরো কেউ যদি আলাদাভাবে বাঁচতে চায়। আমি আমার পৈতৃক বাড়িটা রক্ষা করতে চাই। 

আপনি চাইলে থাকবে। বাট দ্যাট উইল বি আ মিউজিয়াম।

ঠোঁটের কোণায় অদ্ভুত একটা হাসি ঝুলে আছে ছেলেটার ।

যা ভাবছেন অতোটা খারাপ ছেলে নই আঙ্কল । সিলভার সিটি তে আপনার বাড়িটাকে হেরিটেজ প্লেস করে রেখে দেব । ভাবুন ভাবুন। সময় নিন। আপনিই বলেছেন কতো ইতিহাস জড়িয়ে আছে বাড়িটার সঙ্গে। 

এসি ঘরে বসেও ধীমান ঘামতে লাগলেন । বাইরের যেতে হবে একবার। প্রাণখোলা দুদ্দাড়ে হাওয়ায় । 

আঙ্কল ,কিছু লেখাপড়া তো আমিও করেছি। লুম্পেন লুচ্চা যাই ভাবুন মনে মনে

আহাহা কি বলছ – ধীমান অপ্রস্তুত মুখ নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন । এসব বোলো না বাবা।

দেখুন ফার্স্ট আর সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার এর পর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর হয় নি। হয়েছে ?

ধীমান ঘাড় নাড়বেন কিনা ভাবছেন। হয়েছে কি হয়নি কে জানে। তিনি ছিলেন জিওলজিক্যাল সার্ভের অফিসার। সারা জীবন চাকরির জন্য ফিল্ড আর ফিল্ড । ছোটাছুটি । শুভ্রাকে একটানা এক সপ্তাহ দিয়েছেন কি। ভাবারও অবসর ছিল না। 

এটাই থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার । নিঃশব্দে আপনার সব কিছু বদল হয়ে চলেছে। আপনার ধর্ম , আপনার কম্যুনিটি , আপনার প্রাইভেসি, আপনার স্পেশালিটি। সব একরকম হয়ে যাবে । এক। আর কটা বছর পর দেখবেন । 

তার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয় – ধীমান দরজার কাছে এগিয়ে গেছেন। 

না না এভাবে বলবেন না প্লিজ । দিস ইজ ট্রেন্ড। আচ্ছা , রনিদা এখনও সেই কোম্পানিতেই? 

ধীমান ঘাড় কাত করলেন। 

যাব একদিন রনিদার সঙ্গে দেখা করতে । ফাইনাল প্ল্যানের আগে আপনাদের পরামর্শ চাই। 

ধীমান দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। 

খুব শক্ত পাল্লায় পড়েছিস ধীমান । তোর আগ্নেয়াস্ত্র কই ? 

কুলকুল করে ঘামছেন ধীমান । হাওয়া চাই হাওয়া। আকাশটা মেঘলা । আষাঢ় মাস । স্যাঁতসেঁতে । দম মেরে আছে। গাছের একটাও পাতা নড়ছে না। 

ধর্মতলায় বাদশার ঝাঁ চকচকে অফিসের নীচেই কাবাবের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ । ধীমান ঢুকে পড়লেন আচমকা । ভাগ্যিস মোবাইলটা আনেননি সাথে। এতক্ষনে বউমা চার পাঁচটা কল করে ফেলতো। 

পরিপাটি করে গুছিয়ে খেলেন ধীমান । তন্দুরি নান, মাটন রেজালা , চিকেন রেশমি কাবাব। শেষপাতে ফিরনি। বাড়িতে দুপুরে করলাসেদ্ধ আর কাঁচকলা দিয়ে ছোট মাছের ঝোল খেতে খেতে মুখ পেঁদড়ে গেছে। তবে নতুন একটা আইটেম খেয়ে তিনি আজ সবথেকে বেশি তৃপ্ত । 

জিনিসটা হালিম । এখন পবিত্র রমজান মাস । বৈচিত্র্যের এ নগরে বহু রেস্তোরাঁয় হালিম পাওয়া যাচ্ছে । ধীমান ছাড়বেন কেন ? ডালের মধ্যে নরম গরম মাংসের টুকরো , কাঁচালঙ্কার কুচি। অপূর্ব । 

খেয়েদেয়ে একটা মিষ্টি পান মুখে ফেলে বাসে উঠে পড়লেন ধর্মতলা থেকে । কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে দিঘা, শঙ্করপুর , তাজপুর। 

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন ধীমান। কলেজ লাইফে পিকনিকে গেছিলেন শঙ্করপুর। সেখানে ভিন্ন ভাষাভাষী বন্ধুরা ছিল । কখনও তো অসুবিধা হয়নি । সাউথ ইন্ডিয়ান ছেলে বব মালয়ালি বলত। আমোদ বিহারিটা ভোজপুরী । মৃণাল মহুয়া নিয়ে এসেছিল সেবার। ওর থেকেই সাঁওতালি ভাষার প্রথম পাঠ । মফিজুর উর্দু কবিতা বলত। একবর্ণ না জেনেও চোখে জল এসে গেছিল। আর তার কথা ? সেই মেয়েটি ? জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া যার হাসি । আগুন রঙের একটা শাড়ি পরে সৈকতে নাচ করেছিল । নীল দিগন্তে ঐ ফুলের আগুন লাগলো । তার সঙ্গে কোনও কথাই হয় নি প্রথম দু’ বছর। কিন্তু নিজের বুকের সেই গোপন ভাষা পড়তে তার একটুকুও সমস্যা হয় নি। 

শেষ টারমিনাস। কন্ডাক্টর খৈনি দলতে দলতে নেমে গেল। 

একটা ফোন করা উচিত বাড়িতে ? বউমা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। 

কিন্তু, আজ শুধু নিজের সঙ্গে থাকা দরকার। ধীমান পায়ে পায়ে এগলেন । 

আঁশটে গন্ধটা আগেই টের পাচ্ছিলেন । এখন বাড়ছে । জেলেদের সারি সারি নৌকো । আকাশটা কালো করে এসেছে। হাওয়া ছেড়েছে । 

বিচে যাবার আগে পানের দোকান থেকে ফিল্টার উইলস নিলেন এক প্যাকেট। তারপর পানওয়ালার মোবাইল থেকে ছেলেকে মেসেজ করলেন। সেফ অ্যান্ড সিকিওরড। ডোন্ট থিংক মাচ । উইল রিচ টুমরো । ধীমান দত্ত। 

যাক , খবরটা অন্তত পৌঁছবে । ভাগ্যিস ছেলের মোবাইল নম্বরটা তার মুখস্থ । 

রাতটা কোনও হোটেলে কাটিয়ে আগামিকাল ভোরে কলকাতার বাস ধরবেন। আপাতত কিছুক্ষন একা। 

আহ। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিটার জোর বাড়ছে । ধীমান ছুটে গেলেন বিচ এর দিকে। 

আজ দাশুর চায়ের দোকানে ছেলেগুলো কি সব রগরগে আলোচনা করছিল । ওরা বুঝবে না কোনও কোনও দুঃখ আজীবন থেকে যায় মনের গভীরে । বন্দুকের গুলি বেঁধার থেকেও তীব্র যন্ত্রণার । স্মৃতি নিজেই সন্ত্রাস। পালিয়ে যেতে চাইলেও ছাড়ে না। 

শুভ্রা তখন তার জীবনে অলরেডি ইন। আলাপ হয়েছিল বর্ধমানে বেড়াতে গিয়ে। কলকাতায় দেখা করতে আসতো । ধীমান বুঝতেন বর্ধমানের মেয়ে শুভ্রা তার সঙ্গে পাকাপাকি সম্পর্ক গড়তে চাইছে।

সেদিনও ছিল এমন আষাঢ়ে সন্ধ্যা। তাদের কলেজের গ্রুপটা সারা দুপুর সমুদ্রে হুড়োহুড়ি করেছে। হোটেলে ফিরে ভাত খেতে খেতে বিকেল। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই। ঘুম আসেনি শুধু দুজনের চোখে । ধীমান আর সেই মেয়েটির । কৃষ্ণকলি। 

দক্ষিন ভারতীয় নাচে পটু ছিল সে। ভরতনাট্যম নাচে নাকি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত অডিটোরিয়াম । এমনটিই শুনেছিলেন কলেজে । ধীমান মাঝেসাঝে বাঁশি বাজাতেন । তাই কান পেতে শুনত হরিণী । 

সেদিনের সমুদ্রর কথা কোনোদিন ভুলবে না ধীমান । হাওয়ার জোর বাড়তে বাড়তে প্রায় ঝড় । ফনফনে হাওয়ার সাথে উত্তাল সমুদ্র। এমনিতে শঙ্করপুরের সৈকতে মহীসোপানের ভাগ বেশি । অনেক দূর গিয়ে তবেই সাগর গভীর । সেদিন কিন্তু সমুদ্র এসে লুটোপুটি খাচ্ছিল পায়ের কাছে। জেলেদের নৌকাগুলো ফিরে এলো । জোয়ার এসেছে । ধীমান দাঁড়িয়ে ছিলেন একা । সে এল। তারপর ধীমানকে হতচকিত করে তার হাত ধরে টেনে একছুট । কি দৌড় । ধীমান হাঁফিয়ে যাচ্ছিল । আকাশটা ছিল আজকের মতই কালো । কোথাও কোনও তারার মিটমিট ছিল না। 

হাঁটুর নিচ অবধি ঢেউ । ধীমানের বুকের মধ্যেও । দূরে ঝাউবন দুলছে হাওয়ায়। গোটা সৈকতে শুধু তারা দুজন। আর কেউ কোত্থাও নেই। 

ধীমানের মনে হল আদিম পৃথিবী । উথালপাথাল সমুদ্র । শুধু তারা দুজন । আর কোনও নরনারী নেই। ভালোবাসার ভাষা দেওয়া নেওয়া করছিল তারা। ধীমান চাইছিল আরও একটু গভীরে যেতে কিন্তু কৃষ্ণকলি আঁকড়ে রেখেছিল তাকে দুহাত দিয়ে। 

আর না, ডুবে যাবি । প্লিজ। 

দুজনেরই পা থেকে চটি কেড়ে নিয়েছিল সমুদ্র। সেই গাঢ় অন্ধকারেও ধীমান দেখেছিলেন কাজলকালো দুটো চোখ । 

সমুদ্রমন্থন করে অমৃতলাভের পর হুঁশ ফিরল দুজনের। 

এই রে চটি ছাড়া ফিরবেন কি করে ? ধীমান পাগলের মত চটি খুঁজতে লাগলেন । এই প্রথম মনে হল বিচে কেউ থাকলে ভালো হত। নিকষকালো অন্ধকারের মধ্যে আলো দিচ্ছে শুধু ঊর্মিমালা । ঢেউ এর ফসফরাস জ্বলছে। 

সমুদ্র যা নেয় ফিরিয়ে দেয় । সেদিন কিছুক্ষণের মধ্যেই চটিগুলো পাওয়া গেছিল। 

কিন্তু সে মুহূর্তটি আর ফেরেনি। বাকী জীবনে কৃষ্ণকলিকে বুকে ধরে রাখতে পারেননি ধীমান । সেই সেদিনের মতো। শুভ্রাকে কথা দিয়ে দিয়েছিলেন । কথার খেলাপ করতে পারেননি। 

পায়ে পায়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছেন ধীমান । আজও তেমনি দুরন্ত হাওয়া। বৃষ্টি । শুধু ফিরে আসবে না সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । বুকটা তোলপাড় করে উঠল ।

কতবার বুঝিয়েছেন কৃষ্ণকলিকে। ক্ষমা চেয়েছেন । তাও সে অভিমানী মেয়ে ক্ষমা করেনি। কথা বলার সম্পর্কটুকুও রাখে নি ধীমানের সাথে। হারিয়ে গেছে ধীমানের জীবন থেকে। 

শুভ্রাকে বলি বলি করেও বলতে পারেননি । এমনিতেই সে অনুযোগ করত ধীমানের সাথে তার বিস্তর দুরত্ব । হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন ধীমান । বুক মুচড়ে কান্না পায় আজকাল । 

আচ্ছা সব ফুরিয়ে যাবার আগে একবার তার খোঁজ নিলে হয় না ? ধীমান ভাবতে লাগলেন কলেজের পুরনো কোন কোন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা যায় ? চূড়ান্ত একটা চেষ্টা । 

এই সৈকতে দাঁড়িয়ে শেষবেলায় তাকে খুব অনুভব করছেন ধীমান । 

হঠাৎ একটা গাড়ির হর্নের শব্দ । তীব্র । কারা যেন টর্চ হাতে এদিকে আসছে। 

আপনি মিস্টার ধীমান দত্ত ? 

হ্যাঁ , কিন্তু

আপনার ছেলে লালবাজারে মিসিং ডায়েরি করেছেন। চলুন স্যার এক্ষুনি আমাদের সাথে। আই জি র অর্ডার আজই আপনাকে নিয়ে ফেরত যেতে হবে কলকাতায় । 

মনে পড়েছে বউমার বড়মামা বিশ্বনাথ সেন আই জি স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ।

আঃ ছাড়ুন তো । আমি কি নাবালক ? কাল সকালে যাবো । 

স্যার কাইন্ডলি কোঅপারেট। আমাদের কাছে অর্ডার আছে। 

ধীমানকে প্রায় জোর করেই জিপে তোলা হল।

কালচে বানভাসি সমুদ্র। ধীমান চোখ ফেরালেন । জিপের সবকটা পুলিশের মুখ একরকম । হোমোলগাস। মনোটোনাস। নিসের আততায়ীর ছবি দেখাচ্ছিল টিভিতে। সেই মুখ। তার মুখটাও ওরকম দেখতে হয়ে গেছে বোধহয়। নিজের অজান্তে ধীমানের হাত মুখে উঠে এল।

খাঁ খাঁ করছে সৈকত । প্রাণহীন । অবয়বহীন । ধূসর ।



লেখক পরিচিতি
দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

কোলকাতার অধিবাসী। পেশায় চিকিৎসক।
চিকিৎসা বিষয়ে নানা নিবন্ধ লিখে থাকেন পত্র-পত্রিকায়।
লেখালেখিও তাঁর অন্যতম কাজ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

30 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ!
    লেখিকাকে শুভেচ্ছা
    আবির

    উত্তরমুছুন
  2. ভীষণ ভালো লেখা, অসামান্য বুনন! মন ভরে গেল। পড়তে পড়তে আবিষ্ট হয়ে গেছিলাম। হ্যাটস অফফ!

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ লেখা। আবিষ্ট করে রেখেছিলো। অন্তর্নিহিত অর্থটি কিন্তু ভয়ঙ্কর

    উত্তরমুছুন
  4. সমান্তরাল ভাবে একটা বিষাদময় জীবনের চলন টুকরো টুকরো বাস্তব চিত্র ঘিরে। কোথাও কোথাও গতিময়তা একটু থমকেছে,সংলাপে আরেকটু স্বতঃস্ফূর্ততা প্রত্যাশা করেছিলাম, তবে সব মিলিয়ে বেশ ভাল লাগল। মূল্য বোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে এই কথাগুলো বলাটাও জরুরী ছিল। শুভেচ্ছা লেখিকাকে।

    উত্তরমুছুন
  5. সমান্তরাল ভাবে একটা বিষাদময় জীবনের চলন টুকরো টুকরো বাস্তব চিত্র ঘিরে। কোথাও কোথাও গতিময়তা একটু থমকেছে,সংলাপে আরেকটু স্বতঃস্ফূর্ততা প্রত্যাশা করেছিলাম, তবে সব মিলিয়ে বেশ ভাল লাগল। মূল্য বোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে এই কথাগুলো বলাটাও জরুরী ছিল। শুভেচ্ছা লেখিকাকে।

    উত্তরমুছুন
  6. গল্পের বুনন অসামান্য! পাঠান্তে কিন্তু একটা ভয় এসে গ্রাস করে ফেলল মনটাকে- হোমোলোগাস, মনোটোনাস হয়ে যাবার ভয়। আর এখানেই লেখিকার কুশলতা

    উত্তরমুছুন
  7. নিঃশব্দ পোস্টমর্টেম। সন্ত্রাসবাদ খুঁড়ে তুললো পচা সিস্টেমে গলতে থাকা বর্তমান প্রজন্ম। আমরা প্রত্যেকে নিজের মনে পুষছি ধ্বংসের বীজ।
    স্যালুট দোলনচাঁপা।

    উত্তরমুছুন
  8. আপনার লেখা আমাদের সেই নিভৃতিতে পৌঁছে দেয়, যেখানে শুধু পড়ে থাকে মাইল মাইল বিসতৃত একটা দেওয়াল আর বিরাট একটা আয়না। এভাবে নিজেকে খুঁড়ে পাওয়া বড় অপ্রতিম। সৈকত গল্পটি অসম্ভব তৃপ্তি দিলো।

    উত্তরমুছুন
  9. ভীষণ ভালো লাগল। স্বাভাবিক একাকীত্বের স্পষ্ট অভিব্যক্তি এবং মন্থনের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকার গল্প। খুব ভালো লাগল দোলনচাঁপা। অভিনন্দন,শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা দিলাম আমার তরফ থেকে বরাবরের মতই

    উত্তরমুছুন
  10. সন্ত্রাসবাদকে সামনে রেখে খুব সুন্দর তোমার গল্পের বাঁধুনী। পড়তে পড়তে ধীমান আমার সত্ত্বাকে গ্রাস করে ফেলছিল। আমি নিজেই ধীমান হয়ে উঠছিলাম। ধীমানের চিন্তা তার ফ্লাসব্যাক সব আমার। আমার আয়নায় তখন ধীমানের প্রতিচ্ছবি।
    আমার মনকে নাড়া দিয়ে গেল।

    উত্তরমুছুন
  11. খুব ধীরচলনে লেখা। সন্ত্রাসের পটভূমি ধরে এগিয়ে সৈকত - অন্তর্দ্বন্দ্ব। বিষয় ভাবনায় নতুনত্ব তেমন না থাকলেও স্বচ্ছন্দ গতি ও নিটোল ছবি নিবিষ্ট করে রাখল আদ্যোপান্ত।
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন
  12. পল্লব চট্টোপাধ্যায়২৮ জুলাই, ২০১৭ এ ১২:৪৫ PM

    কি সুন্দর! মুগ্ধ হয়ে পড়ে ফেললাম।

    উত্তরমুছুন
  13. ভয়ঙ্কর! দমবন্ধ হয়ে আসছিল!

    উত্তরমুছুন
  14. ভয়ঙ্কর! দমবন্ধ হয়ে আসছিল!

    উত্তরমুছুন
  15. অসাধারণ। ফেলে আসা সময়ের আয়নায় বহমান কালকে দেখা। কিছু হতাশা। কিছু দুঃস্বপ্ন। হয়ত একেই বলে প্রজন্মগত বিভেদ। অথবা বিকাশপর্যায়।

    উত্তরমুছুন
  16. চমৎকার। দোলন আজকাল প্রেসক্রিপশনেও গল্প লিখে দেয় বলে শোনা যাচ্ছে।
    বেলালদা।

    উত্তরমুছুন
  17. এমন অদ্ভুত মেলবন্ধন কখনও দেখিনি! এক দিকে বিশ্বজনীন বস্তুতান্ত্রিকতার গহন চিন্তা। আর এক দিকে রোম্যান্টিসিজম। এই দুটো কোন আঁশে? কীসের, বাঁশের বেতের, কী দিয়ে বাঁধলেন? সি আর এভিন্যুএর পৈতৃক বাড়ি আর বাদশা খান অর্থনীতির অনর্থ দিয়ে বাঁধা। মেদিনীপুরএর নাড়ুকে আর বরিশালের মালতীকে বাঁধল চালি শিল্প। বাদশাহ খানের ডোজার আর নিসের ঘাতক ট্রাক বাঁধা আধিপত্যবাদের নিষ্প্রেম সঙ্ঘাত দিয়ে। আমারও মনে হয় ধ্বংস; প্রলয়ই আনতে পারে গ্লোবাল কনভার্জেন্স। পুরো গল্পটা কোন বুনুনির কাঁটায় বাঁধা সেটাই ভাবতে বসেছি! আমি লেখক-টেখক হলে আপনাকে হিংসে করতাম। নই, তাই আপনার পাঠক হলাম। আরও পড়াবেন। শুভেচ্ছা সতত।

    উত্তরমুছুন
  18. আজকের পৃথিবীকে একেবারে ক্লোজ আপে ডেখটে পেলাম।ভয় পেলাম। তা তো রোজ ই পাই। নিজেকে দেখতে পেলাম অক্ষরের আয়নায়।

    উত্তরমুছুন
  19. যে ভয়ঙ্কর চালচিত্র দেখেও দেখতে চাইনে, 'সব ঠিকই আছে', আর 'সব ঠিক হয়ে যাবে'র বোকা আশ্বাস নিয়ে যারা এখনো ভাবছি দিন ফিরবে.. তারা এক অন্তর্লীন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি শেষে এসে । সব যে মধুরেন সমাপয়েৎ হয় না, এই সুকঠোর বাস্তবকে সামনে আনার জন্য ধন্যবাদ ।

    উত্তরমুছুন
  20. স্মৃতি নিজেই এক সন্ত্রাস! ..অনবদ্য ,হোমোলোগাস ,মোনোটোনাস হয়ে পড়ার প্রক্রিয়ায় আমাদের জাগতিক অবস্থান

    ভালো লাগল খুবই

    উত্তরমুছুন
  21. স্মৃতি নিজেই এক সন্ত্রাস! ..অনবদ্য ,হোমোলোগাস ,মোনোটোনাস হয়ে পড়ার প্রক্রিয়ায় আমাদের জাগতিক অবস্থান

    ভালো লাগল খুবই

    উত্তরমুছুন
  22. গল্পটা শেষ করে কিছু সময় বসে রইলাম। কি নেই এই গল্পে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ,নি:ষঙ্গতা,একাকিত্ব অভিব্যক্তিবাদ, ফেলে আসা সময়ের আয়নায় বহমান বর্তমান। কিছু হতাশা। কিছু দুঃস্বপ্ন। হয়ত একেই বলে জেনারেশন গ্যাপ। অথবা বিকাশপর্যায়। টোটাল প্যাকেজ। ঝরঝরে গদ্য।
    ডাক্তার ম্যাডামকে শুভেচ্ছা। প্রত্যাশা বেড়ে গেলো।

    উত্তর

    উত্তরমুছুন
  23. অসাধারণ লিখেছেন। আপনার শব্দচয়ন অনবদ্য। আরো লিখুন।

    উত্তরমুছুন
  24. খুব ভালো লাগলো। প্রসংসার ভাষা খুজে পেলাম না। শুধু মনটা উদাস হয়ে গেল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

    উত্তরমুছুন
  25. দক্ষ লেখক। কোথাও গিয়ে মনখারাপ হলো শেষটায়।

    উত্তরমুছুন