তামান্না সেতু 'র গল্প : সই

দুপুর থেকেই মেঘ ছিল সেদিন। মেঘের সাথে ছিল ঠাণ্ডা বাতাস। আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হয়েছিল নিশ্চয়ই। জ্যৈষ্ঠ মাসের ভ্যাপসা গরম, রোদের তাপ একটানা চলছিল দু-সপ্তাহ ধরে। তারমধ্যে এইটুকু ছায়া, এইটুকু জলজ বাতাসই বা কম কি? 

বুবুন বলেছিল একবার, ‘ছাতা নিয়ে নে দিদি, আজ ঠিক বৃষ্টি হবে দেখিস।’

বুবুন আমার ভাই। আমার থেকে তের বছরের ছোট। সেবার স্কুলে ভর্তি হল। মাথা ভর্তি কোকরা চুল, বড় বড় চোখ। আমি ননীগোপাল বলে ডাকি ওকে, লুকিয়ে। ডাকটা শুনলেই মা খুব বকা দেয়। চোখ মটকিয়ে বলে, ‘ননীগোপাল আবার
কী? মুসলমানের ছেলেকে ওসব হিন্দু নামে ডাকবি না।’

বুবুন আমার পায়ে পায়ে চলে। পোষা বিড়ালের মতো। ঘর থেকে বের হবার সময় বারান্দা পর্যন্ত দৌড়ে আসে ও। পিছন থেকে কম করে হলেও দু বার ডাকবে, ‘দিদি, মনে করে চকলেট আনিস’ বা ‘রোজ রোজ ফিরতে দেরি করিস কেন, আজ দৌড়ে চলে আসবি।’ এই পেছন থেকে ডাকা নিয়েও মা রেগে থাকে। এই ডাক নাকি অলক্ষ্মী। সেদিন বারান্দা থেকে সামনের রাস্তায় যাবার পরও বুবুন পিছে থেকে ডাকল, ‘তুই আজ বিকেলে ভিজে কাক হবি দেখিস।’ আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম মা বুবুনকে না বকে একবার আকাশের দিকে তাকাল।

বুবুন আর আমি এক মায়ের পেট থেকে জন্ম নেইনি। আমার জন্মের তিন মাসের মাথায় আমার মা মারা যায়। বছর গেলেই বাবা আবার বিয়ে করে। না করে উপায় ছিল না। সংসার সন্তান সামাল দেবার মতো মানুষ বাবা নয়। বেশ বড় হবার পর আমি জেনেছি, যাকে আমি মা বলে ডাকি সে আমার মা নয়। আমার হোক আর পরের হোক, মা আমার এতখানি জুড়ে ছিল যে আসল-নকলে আমার কিছু যায় আসে না। মা আমায় হাত দিয়ে ভাত খেতে দেয়নি কখনো। আমাদের অভাবের সংসারে মায়ের বিয়েতে পাওয়া দু-চারটে বাইরে পরে যাবার ভালো শাড়ি প্রতি বছর ঈদে বাক্স থেকে বের হত। সেলাই মেশিনের ঘটঘট আওয়াজ তুলে মা সেই শাড়ি কেটে আমার জামা বানাতেন।

বুবুনের জন্মের সময় বাবাও একটু ভেবেছিলেন মনে হয়, এবার বুঝি আমার প্রতি মায়ের ভালবাসা ফুরাল। বুবুনের জন্মের এক বছর ঘুরতেই সে সন্দেহ সবার ফুরিয়েছিল। মা আর আমি যেমন ‘সই’ ছিলাম তেমনই আছি। আজো আছি। বাবার মৃত্যুর পর মা কাঁদেনি। পাথরের মতো হয়ে গেল। সংসারটা এবার চলবে কী করে? তিনদিন পর হঠাৎ রাতের বেলায় ঘুম থেকে উঠে মা একেবারে কিশোরী মেয়েদের মত আমায় বলল, ‘রুনু, তুই তো আছিস আমাদের দেখার জন্য, তাই নারে? আমার, বুবুনের ভাবনার তো কিছু নাই?’ 

মার সে কথা শুনে প্রথম আমি জানলাম আমাকেও কারো কতখানি প্রয়োজন। সেদিন এক মুহূর্তে আমি যেন মায়েরও মা হয়ে উঠেছিলাম।

বললাম, ভাবনার কিচ্ছু নেই মা। আমি আছি তো। মা একটু হাসল, বলল, তোর বিয়ের বয়স হয়ে আসছে যে রুনু। তারপর? সৌম্য বুঝি তোকে রাখবে আমাদের জন্য? 

আমি ভীষণ রেগে বললাম, কী যে বল? আমি আর ওসব নিয়ে ভাবি না মা।

মা অনেকটা সময় চুপ থেকে বলল, ‘আমি আমায় নিয়ে ভাবি না রুনু। তুই বুবুনকে দেখে রাখিস।’

বাবা মারা গিয়েছেন চার বছর। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীগুলোতে মা আমার বয়স নিয়ে চিন্তিত হত; আমার বিয়ের বয়স! সেদিন বারান্দায় দাঁড়ানো বুবুন আর মাকে আমি আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিলাম, তখনও মা আমার দিকে তাকিয়ে। যতক্ষণ আমাকে দেখা যাবে ততক্ষণ মা আর বুবুন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। ছাতা নেইনি হাতে। তবুও ঐ ঠাণ্ডা বাতাস আর ছায়া করে আসা মেঘের জন্যই চোখে কাজল টেনে শাড়ি পরেছিলাম। চওড়া লাল পাড়ের ছাই মেঘ রঙা শাড়ি। লাল ব্লাউজ। লাল বড় টিপ।

বাবা মারা যাবার পর থেকে মা আমি আর বুবুন একসাথে খাই। আগে মা আমাদের পরে খেত। বাবার কথা বুবুন খুব বেশি বলে না। ওর সব চাওয়া ঘুরে ফিরে আমার কাছে। ঠাণ্ডা বাতাসটা কমে আসছিল। কোচিংয়ের দূরত্বটা হাঁটা পথ না হলেও রোজ ওইটুকু আমি হেঁটেই যেতাম। ফেরার সময় রাত হয়ে যায় বলে রিকশায় ফিরতে হত। গত পাঁচ বছরে বাইরের এলাকার অনেক নতুন মানুষ এই এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করে এসেছে। নতুন মানুষ দিয়ে পাড়া ভর্তি। মোড়ে মোড়ে তাদের ছেলেরা সিগারেট ফুঁকে আড্ডা দেয়, পেছন থেকে নানা কথা বলে। না হলে রাত হয়েছে বলে রিক্সায় চড়তে হবে এমন ভীতু আমি নই। ছাতাটা না নিয়ে সেদিন বড় ভুল করেছিলাম।

একটা গরম বাতাস ঢেউয়ের মতো তাড়িয়ে এসেই বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছিল। ঠিক তক্ষুনি একটা আশ্রয়ে না গেলে সত্যি সত্যি বুবুনের কথা ফলে গেয়ে ভিজে কাক হতাম। অসহায়ের মতো চারিদিকে একবার তাকিয়েছিলাম। সামনেই মোড়ের দোকানগুলো। নিজের ওপর এতো রাগ হচ্ছিল। ইস্ বুবুনটা কতবার ছাতার কথা বলল! সেদিন বৃষ্টিটা আর দশ মিনিট পর এলেই কোচিংয়ে পৌঁছে যেতাম।

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বড় হতেই, সকল জড়তা কাটিয়ে অনেকদিনের চেনা বাড়িটার গেট পার হয়ে ঢুকেছিলাম। ও বাড়ির উঠানের মাঝে বেশ বড় একটা পাকুড় গাছ। ঘরের সামনে বড় বারান্দায় বেতের মোড়া পাতা। দু বছরে একটু বদলেছে বাড়ির ভেতরটা। আগে বেশ পরিষ্কার গোছালো ছিল।

বারান্দার একপাশে রান্নাঘর, ধোঁয়া আসছিল সেখান থেকে। আমি জানি ওখানে কে। এ বাড়িতে দ্বিতীয় মানুষ থাকে না। মামা মামি চলে গেল অস্ট্রেলিয়া, সৌম্যদা গেল না। বলল, সব গুছিয়ে এক বছরের ভেতরেই যাবে। আমি জানতাম ওসব বুঝিয়ে ও শুধু মামা-মামিকে পাঠিয়ে দিল। তারপর দুবছর পার হয়েছে, সৌম্যদা যায়নি।

যতখানি সঙ্কোচ আমার হবে বলে ভেবেছিলাম বাড়িতে ঢোকার আগে, ততখানি কেন যেন হল না। এ বাড়ির সব আমার চেনা জানা। বারান্দার পাশের বাগান বিলাসী আমার লাগানো। বাবা মারা যাবার পর এ বাড়িতে এই প্রথম! অথচ তার আগে…!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে মাথা মুছতেই রান্নাঘর থেকে পরিচিত গলার স্বর ভেসে এলো, ‘তোর ডান পাশের চেয়ারের হাতলে গামছা আছে, মাথাটা ভালো করে মুছে নে।’

চেয়ারের হাতলে হলুদ একটা গামছা। মাথা মুছে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে দেখি, চারিদিকে এলোমেলো হাঁড়িপাতিলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চুলায় এক পাতিল নরম খিচুরি সজোরে নেড়ে যাচ্ছে সৌম্যদা।

আমায় দেখে হাসল। বলল, ‘বাড়িতে আমি একা। বাইরের বৃষ্টিকে বিশ্বাস করবি নাকি আমাকে, একবার ভেবে দেখ। কথা শেষ করেই আরেকবার হাসল।

রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে সৌম্যদা বলল, ‘তুই চাইলে আমি ছাতা দিতে পারি রুনু।’

কী জানি কী ভেবে বললাম, ‘তাড়িয়ে দিচ্ছ? এই বৃষ্টি ছাতায় মানবে?’

‘না মানলেও তুই মানিয়ে নিবি, রুনু। তুই তো পারিস সব কিছু মানিয়ে নিতে।’

এ বাড়িতে আমার আসার কথা ছিল বউ হয়ে। বাবা, মামা সবার ইচ্ছেতেই। সেই কোন ছোটবেলা থেকে আমি জানতাম সে কথা। অথচ বাবার মৃত্যুর পর আমি সব ভুলে যেতে চাইলাম। মাও সযত্নে দিল ভুলে যেতে। সৌম্যদার বাবাকে আমি মামা বলে ডাকতাম। 

পাশের মোড়াটা টেনে বসে চোখ মেলে সৌম্যদার দিকে তাকালাম। কত বছর পর ওর পাশে আমি! একটু শুকিয়েছে ও। চোখগুলো তাই আরও মায়াবী লাগছিল। এড়িয়ে চলা স্বভাবের সেই আমি সেদিন আমার মতো থাকার চেষ্টা একটুও করিনি। বাইরের বৃষ্টিটা হয়তো পরিচিত আমায় ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

কথা সৌম্যদাই শুরু করল, ‘এ মাসে তো দুদিন দেরি করেছিস কোচিং যেতে। আজও দেরি করছিস। তিন দিনের দেরিতে এক দিনের বেতন নাকি কেটে নেয়?’

আমার ভেতরে একটা আনন্দের বান যেন বলে গেল, রুনু, আজও এই মানুষটা তোর সবকিছুর খোঁজ রাখে। আমি চুপ করেই ছিলাম। সৌম্যদাই আবার সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ‘বুবুনের পড়ার দিকে খেয়াল না রেখে টিউশানি করে বেড়াচ্ছিস। ওর তো রেজাল্ট খারাপ হবে। সারাদিন হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াস রোদের ভেতর, জন্ডিস হলে বুঝবি। ছোটবেলায় তোর খুব অসুখ করত, মনে আছে রুনু?’

আমার সবকিছু মনে থাকার পরও বলেছিলাম, ‘না তো। খুব অসুখ হত বুঝি?’

সৌম্যদা এবার বেশ জোরে হেসে বলল, ‘খুউব। বৃষ্টির আঁচ গায়ে লাগলেই জ্বর, কাশি। বিচ্ছিরি অবস্থা! ভাল হয়েছে রুনু, না হলে আজ বৃষ্টির আঁচ বাঁচাতে তুই এ বাড়িতে দৌড়ে ঢুকতি না। বাড়ির পেছনে কদমগাছ লাগিয়েছি জানিস? তুই বলেছিলি লাগাতে। বিছানায় শীতল পাটি বিছিয়ে রাখি সব সময়। তুই বলেছিলি, সারা সংসারের কাজ শেষ করে রোজ দুপুরে তোর শীতল পাটিতে শুতে হবে। আমি আমার সবটা তোর জন্য সাজিয়ে রেখেছি, তুই বুবুন আর মামির ভাগটা আমায় দিলি না?’ 

সৌম্যদা কাঁদছিল কি না, আমি চোখ তুলে দেখিনি সেদিন। শুধু টের পাচ্ছিলাম আমার ভেতর থেকে একটা নারীকণ্ঠ তার সমস্ত আকুতি দিয়ে আমাকে বলছে, ‘রুনু, বুবুনকে তুই দেখিস।’

বৃষ্টিটা যেমন হুট করে এসেছিল তেমন হুট করেই কমে এলো। সেদিন আমি বৃষ্টির আঁচের মতোই আরও সকল আঁচ বাঁচিয়ে শান্তস্বরে সৌম্যদাকে বলেছিলাম, ‘ছাতাটা দাও না। আবার যদি হুট করে বৃষ্টি আসে। জ্বর হলে তো আমার চলবে না। পুরো বেতন না পেলে বিপদে পড়ে যাই।’

বাড়ি থেকে বের হবার পর আমার মনে হয়েছিল, কেমন আছে ও, সেটাও একবার জানতে চাওয়া হয়নি। সেদিনের ঠিক তের মাস পর সৌম্যদা মারা গেল আষাঢ়ের মাঝামাঝি। ও একাই মরে পড়ে ছিল ওর শোবার ঘরের শান্ত শীতল পাটির ওপর। দুদিন একটানা বৃষ্টি ছিল বলে কেউ ওর বাড়িতে গিয়ে খোঁজও নেয়নি। তাই ঠিক কয়টায় কীভাবে মারা গিয়েছিল কেউ বলতে পারল না। 

আমি কেমন ছিলাম তখন জানি না। সে সময়ের স্মৃতি চাইলেও মনে করতে পারি না খুব বেশি। বারবার নাকি জ্ঞান হারাতাম। তিন-চারটা মাস বিছানায় পড়ে থেকে কাটিয়েছি আবোল তাবোল বকে।

সে সময়ের একটা মাত্র স্মৃতি সব কিছু ছাপিয়ে এখনো আমার মনে পড়ে, সৌম্যদার মৃত্যুর কয়েকদিন পর একবার মা আমার সামনে এসে বসেছিল। ভাত মেখে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিল ভীষণ যত্নে। তারপর প্রশান্তির একটা শুভ্র হাসি হেসে মা বলেছিল, ‘রুনু, এতদিনে আমরা সই হলাম।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ