
লাঞ্চ টাইমে এককাপ কফি নিয়ে এসে খাবারের বাক্সটা খোলার জন্য ব্যাগের দিকে হাত বাড়াতেই গন্ধটা স্পষ্ট এসে নাকে লাগলো । অদ্ভুত ব্যাপার! এখানে এ গন্ধের কোন অর্থই হয় না । এ অফিসে কাজ শুরু করেছি দু’মাসও হয়নি । একমাত্র আমিই বাঙালি । অন্যরা কানাডিয়ান, চাইনিজ, ফিলিপিনো, ইউরোপীয় । উপমহাদেশের আর কেউ নেই । একজন অবাঙালি ভারতীয়ও না । দুপুরে খাবার জন্য যখন সবাই লাঞ্চ বক্স খোলে তখন অন্যান্য কক্ষ থেকে অদ্ভুত সব গন্ধ ভেসে আসে । কেউ কেউ মাইক্রোওভেনে খাবার গরম করে ।
তাদের খাবারের গন্ধ প্রকট হয়ে ওঠে । প্রথম প্রথম এই গন্ধে একটু অস্বস্তি বোধ হলেও এখন সয়ে গেছে । অথচ আজকের এই মুহূর্তে যে গন্ধটা নাকে এসে লাগছে তা অন্যদিনের সব গন্ধ থেকেই আলাদা । এবং এখানে এই মুহূর্তে একটু অপার্থিব, একটু অতিপ্রাকৃতই বলা যায় ।
মনের ভুল ভেবে কফির কাপটা নাকের কাছে এনে শ্বাস নেই । চনমনে ঘ্রাণটা বুকের অনেক ভেতর পর্যন্ত ঢুকে যায় । কফি খাওয়ার অভ্যেস ছিল না । প্রথম প্রথম হালকা মাথা ঘুরাতো । বেশি বেশি চিনি আর ক্রীম মেশাতে হতো । এখন বেশ লাগে । এই অফিসে কফি ফ্রি । যত খুশি নেয়া যায় । কিচেনে একটা বড় জারে কফি ফুটতে থাকে সারাদিন । সবাই যে যার মত করে নিয়ে নেয় । জার খালি হয়ে এলে কেউ একজন আবার নতুন করে তৈরি করে ।
গন্ধটা মনের ভুল মনে হয়েছিল । কিন্তু কফি শুঁকবার পরেও যায়নি । অথচ দেশ থেকে অনেক অনেক হাজার মাইল দূরের এই কানাডিয়ান অফিসে দুপুরের খাবার সময় টাটকা ইলিশ মাছের ঝোলের গন্ধ পাওয়াটা মনের ভুল না হবার কোন কারনই নেই । যেখানে আর একটাও বাঙালি কাজ করে না । অবশ্য ইলিশ মাছ যে এখানে পাওয়া যায় না তা নয় । এখানে প্রথম আসবার পর দু একটা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ইলিশ মাছ খাইয়েছে । কিন্তু তার সেই স্বাদ আর গন্ধ নেই । অথচ এই গন্ধটা বেশ তীব্র । নাকে ঢুকবার পরপরই মনে হলো যেন স্কুল থেকে ফিরে ক্ষিধে পেটে খেতে বসেছি । মা ভাত বেড়ে তার উপর ইলিশ মাছের ঝোল ঢেলে দিচ্ছেন। খেতে খেতে হাতের আঙুলগুলো তৈলাক্ত হয়ে উঠেছে। অনেকবার সাবান ঘসে তবে সে তেল যাবে । কিন্তু আমি কখনোই এই গন্ধটাকে মুছে ফেলতে চাইতাম না । ভালো লাগতো গন্ধটা । মা নেই অনেকদিন। তার মত করে ইলিশ কেউ রাঁধতে পারতো না । আলু বেগুনের ঝোল, সরিষা পাতুরী, মরিচ ভাজা, ভাপা ইলিশ । আহা। বাবাও প্রায়ই ইলিশ কিনে আনতেন । সেই সব দিন এখন অবাস্তব মনে হয় । যেন কোনদিন ঘটেনি এসব কিছুই ।
গন্ধটা আর নেই । খিদেটাও মরে গেছে । তাছাড়া বাক্স খুলে সেই প্রতিদিনকার পাস্তা (pasta) খেতে একটুও ইচ্ছে করছে না । কফি খেলে অবশ্য এমনিতেই খিদেটা একটু কমে । এখনো লাঞ্চটাইম শেষ হতে মিনিট বিশেক বাকি । তারপর আবার অফিসের নিত্যনৈমত্তিক কাজ । অনেকগুলো বিল পোস্টিং দিতে হবে । এরপর পেমেন্ট পোস্টিং । সব হয়ে গেলে আজকের একাউন্ট পেয়েবল এর আপডেটেড লিস্টিং টা ইমেল করে হেড অফিসে পাঠাতে হবে । তবে কাজের চাপ এমন নয় যে লাঞ্চ আওয়ারেও কাজ করতে হবে । আমি বরং এই সময়টা একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি । অফিস থেকে বেরিয়ে দুমিনিট হাঁটলেই একটা পার্কের মত জায়গা । গাছপালা ঝোপঝাড় । ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে । নিচে হাইওয়ে । ডিয়ারফুট ট্রেইল । প্রায় দিনই লাঞ্চ টাইমে এখানে এসে একটা বেঞ্চিতে বসে বসে ডিয়ারফুট ট্রেইলের দিকে তাকিয়ে প্রাইভেট কার, ট্রাক, নানারকমের ভ্যানের সাঁই সাঁই গতিতে ছুটে যাওয়া দেখি। গাড়িগুলো এতো জোত্রে ছুটতে থাকে যে একটা বিভ্রম তৈরি হয় । মনে হতে থাকে কোন একটা গাড়িতে চড়ে বসলে হয়তো গুলিস্তান চলে যাওয়া যাবে । এত এত গাড়ি, একটাও কি মিরপুর যাবে না? বাড্ডা? কাকরাইলের মোড়?
সাড়ে চারটায় অফিস শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্টপে এসে দাঁড়াই । সেই যে খিদেটা চলে গিয়েছিল, আর পায়নি । অবশ্য কয়েক কাপ কফি খাওয়া হয়েছে । আজকে মনটা একটু বেশি খারাপ লাগছে । দেশের কথা মনে পড়ছে । মাত্র তো মাস তিনেক হলো, অন্তত বছর না গেলে এই মন খারাপ বোধটা কমবে না – যারা এখানে অনেকদিন আছে তারা রোজই বলছে । সেই হিসেবে মন খারাপটা প্রতিদিনই একটু একটু কমার কথা । তা না হয়ে প্রতিদিনই একটু করে বাড়ছে বলে মনে হয় । অথচ স্বর্গের মত জায়গা ক্যালগারি । এখনকার আবহাওয়াটাওদারুন ভালো । তীব্র গরম নয়, ঠান্ডাও পড়তে শুরু করেনি । বাড়িতে সব সুবিধাই অফুরন্ত । গ্যাস যাবে না, জলের সাপ্লাই বন্ধ হবে না, লোডশেডিং হবেনা, বাড়ির বাইরে মাইকে কেউ চেঁচাবে না, গাড়ি বিকট হর্ণ দেবে না, উটকো ছেলেরা বাসার সামনে ভিড় করে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আড্ডা দেবে না । আর কত সুবিধা চাই । তবু লোডশেডিংয়ের দেশের জন্য মন খারাপটা বেড়েই চলেছে ।
বাসস্টপে বেশ ভিড় । এই সময়টাতে অনেক অফিস ছুটি হয় । মাঝে মাঝে এমন হয় ভিড়ের জন্য প্রথম বাসটাতে জায়গা মেলে না । পরেরটার জন্য অপেক্ষা করতে হয় । অবশ্য অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না । বাসস্টপের পাশেই একটা বিশাল মাঠ, তারপর একটা লেকের মত । এরপরে কী আছে দেখা যায় না বটে, কিন্তু আমি জানি ওটা বিমানবন্দর । ছোটবেলা থেকেই উড়োজাহাজের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ । মনে আছে উড়জাহাজ উড়ে যেতে দেখলেই আমি তাকিয়ে দেখতাম যতোক্ষণ না চোখের আড়াল হয় । আরো আশ্চর্য সেইসব উড়োজাহাজ থেকে কখনো কখনো সোনালী রঙের একরকম বর্গাকৃতির কাগজ নেমে আসতো । তার কয়েকটা পড়তো আমাদের বারান্দাতেও । সেগুলি কুড়িয়ে নিতাম । কিন্তু এসব ছোটবেলাতেই হতো । বড় হয়ে আর এমন কাগজ পড়তে দেখিনি । তাই মাঝে মাঝে ওই কাগজ পড়ার ব্যাপারটাকে কল্পনা মনে হয় । এখানে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যে বিমানগুলোকে বিমানবন্দরে নামতে দেখি, কিংবা বিমানবন্দর থেকে চলে যেতে সেগুলি ছোটবেলার মত অত উপর দিয়ে উড়ে যায় না, অত ছোটও দেখায় না । বেশ বড়, আর এত নিচ দিয়ে উড়ে যায় মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে । তাই বাসের জন্য অপেক্ষার সময়টা আর খারাপ লাগে না ।
বাসে উঠেই আমি চলে যাই একেবারে পিছন দিকে । পিছনে বসলেই পুরো বাসের মানুষগুলোকে একসাথে দেখা যায় । কত রকমের মানুষ! পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে তারা এই শহরে এসে মিলেছে । সাদা, তামাটে, কালো, শ্যামলা, লালচে মানুষ । তাদের কত রকম ভাষা। কত রকম পোষাক । এইসব দেখতে ভালো লাগে। তবে এই প্রায় দুই মাসে বাসের নিয়মিত যাত্রীদের চেহারা প্রায় মুখস্ত হয়ে এসেছে । এদের বাইরে এখন নতুন যাত্রীর দেখা পাওয়া যায় কমই । কেউ কেউ নজর কাড়ে । কারো চেহারা খুব পরিচিত মনে হয় । বিশেষ করে সেই লোকটা, অনেকটা প্রোঢ়ই বলা যায়, চমৎকার চাপ দাড়ি । দেখতে অনেকটা আসাদুজ্জামান নূর-এর মত দেখায় । চমৎকার হাসি । প্রৌঢ় হলেও একটা আকর্ষণ আছে চেহারায় । সেই লোকটাকে প্রথম দিন থেকেই দেখছি । একই রুট-এ কোথাও চাকরি করে সম্ভবত । ফেরবার পথে ভিড় বেশি থাকে, তাই অফিসে যাবার পথেই তাকে লক্ষ্য করি বেশি । প্রথম কয়েকদিন দেখেছি ভোরে বাসে উঠেই মাঝামাঝি কোন একটা সিটে জানালার পাশে বসে কোন একটা বই পড়তো । তারপর সেই মেয়েটার সাথে ভাব হয়ে গেল । একটা মেয়ে, প্রায় কিশোরী পর্ব শেষ করেছে, বেশ সুশ্রী। এই রুটের নিয়মিত যাত্রী সে-ও । কয়েকদিনেই লক্ষ্য করলাম তারা পাশাপাশি বসছে । গল্প করছে । প্রৌঢ় মানুষটি কী কী সব বলছে, আর মেয়েটি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে । মেয়েটিই আগে ওঠে বাসে, উঠে এমনভাবে দুই সিট মিলিয়ে বসে যে আর কেউ পাশে বসতে পারবে না । দুই স্টপেজ পরে লোকটা ওঠে, তখন মেয়েটা সরে জায়গা করে দেয় । লোকটা আর বাসে বই পড়ে না । বাড়িতে পড়ে বোধহয় কৌতুকের বই। নইলে তার কথায় মেয়েটা এত হাসে কেন?
বাসের ভেতরেই গল্পের শুরু, গল্পের শেষ হয় । মেয়েটা কি মানুষটির প্রেমে পড়ে গেছে? এমনটাই তো মনে হয়। একদিন তার স্টপেজ থেকে মানুষটি ওঠেনি । মেয়েটার সে কি অস্থিরতা ! জানালা দিয়ে বার বার উঁকি দেয় । এদিক ওদিক দেখে । তারপর সত্যি সত্যি যখন লোকটাকে ছাড়াই বাসটা ছেড়ে দিলে মন হয় যেন তার মোমের মত মুখে রাজ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে । সিটের এক কোনায় জড় বস্তুর মত পড়ে থাকে । পরেরদিন লোকটাকে ফিরে পেয়ে তার সে কী খুশি !
তারপর কোন একদিন থেকে লোকটা আর আসে না । প্রথম দুএকদিন মেয়েটা খুব অস্থির থাকে । জানালা দিয়ে তাকায় আর তাকায় । শেষে ক্রমশ নিথর হয়ে যায়। বুঝে ফেলে লোকটা আর আসবে না । মেয়েটাকে আর কিশোরী মনে হয় না । মনে হয় যেন তার বয়স বেড়ে গেছে অনেক । যেন মধ্যবয়সী রমণী । লোকটার উপর খুব রাগ হয় । আশ্চর্য্য মানুষ ! ফোন নম্বরটাও দেয়নি মেয়েটাকে? হয়তো চাকরি বদলেছে । আরেক রুটের বাসে বসে বই পড়ছে । কিংবা অন্য কোন তরুণীর সাথে ভাব জমিয়েছে । তাকে হাসির গল্প বলছে।
আজকেও বিষণ্ন মেয়েটাকে দেখি । প্রতিদিনকার মতোই নিস্তেজ । তবে জানালা দিয়ে আর তাকায় না । বুঝে ফেলেছে মানুষটি আর ফিরবে না । মেয়েটির জন্য মায়া হয় । হয়তো তাকে আর কেউ কোনদিন এমন করে হাসির গল্প শুনিয়ে হাসায়নি। হাসাতে গিয়ে বড় বেশি বিষাদ ঢেলে দিয়ে চলে গেল লোকটা । হায় কানাডিয়ান তরুণী । বাংলাদেশের শ্যামল গাঁয়ের কোন এক মেয়ের মত অবুঝ ভালোবাসা বুঝি তার হৃদয়ে । ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে ...
ভাবনার জাল ছিন্ন করে ফোনটা বেজে ওঠে, ওপাশে মিতালী । সে-ও কাজ থেকে ফিরেছে বোধহয় । ফোন ধরতেই জিজ্ঞেস করে,
দুপুরে খেয়েছো? কেমন হলো লাঞ্চ?
না, খাইনি । খিদেই পেল না আজকে ।
বল কি! আজকেই খিদে পেল না? ইলিশ মাছ পেয়েও খিদে পেল না?
ইলিশ মাছ? মানে?
কালকে কল্পনা বৌদি এসেছিলেন না? ইলিশ মাছের তরকারি দিয়ে গিয়েছিলেন । সেটাই তো আজকে তোমাকে লাঞ্চে দিলাম ।
গন্ধের রহস্য এবার পরিস্কার হলো । আমি মিতালিকে আশ্বস্ত করি, ঠিক আছে বাসায় এসেই খাবো ।
মেয়েটা ক্রোফুটে নেমে গেছে । আমার স্টপেজও প্রায় চলে এসেছে । স্টপেজে নামতেই দেখি রাস্তাটা নানা রঙ-এর পাতায় ছেয়ে গেছে । ফল (Fall) চলছে এখন। গাছগুলি রঙিন হয়ে উঠেছে । হলুদ, কমলা, লাল আর আজব আজব সব বাহারী রঙের খেলা । যেমন রঙিন হয়ে উঠেছে, তেমনি পাতা ঝরাচ্ছে । কয়েকদিনের মধ্যে সব পাতা ঝরে গিয়ে ন্যাড়া হয়ে যাবে গাছগুলো । তারপর স্নো পড়তে শুরু করবে । ক্যালগারিতে প্রথম শীত । সবাই বলে প্রথমটাই একটু কঠিন । এরপর টিকে যাবে ক্যালগারিতে ।
বাস থেকে নেমে বাসার দিকে হাঁটতে থাকি । একটা শীতল বাতাস বইছে টের পাই । ঠাণ্ডায় কাঁপবার মত নয়, কিন্তু শীতের আগমনী বার্তা । শব্দ শুনে উপরে তাকাতেই দেখি উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক । দক্ষিণে । ঊষ্ণ কোন এক দেশে ।
হাঁটা থামিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় । খুব করে বলতে ইচ্ছে হয়, ও পাখির দল, আমায় নিয়ে যাবে তোমাদের সঙ্গে? তোমাদের সঙ্গে উড়তে উড়তে উড়তে উড়তে আমিও গিয়ে পৌঁছুবো আমার সবুজ উষ্ণ দেশে । কপোতাক্ষের দেশে । ধানসিঁড়ির দেশে । জীবনানন্দের দেশে ।
জুলাই ১৯, ২০১৭
ক্যালগারি ।।
0 মন্তব্যসমূহ