দেবানন্দ সরকার'এর গল্প : মৃত চোখ

সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠতে উঠতে সুমনার মন অতীতে ভেসে বেড়াচ্ছিল। প্রায় কুড়ি বছর পর দেখা হবে আরেফিনের সাথে! এর মধ্যে আরেফিনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। ইমেল, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের যুগে প্রযুক্তির ইথারে আরেফিনের কোনো পদচিহ্ন নেই। পুরোনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখে না আরেফিন। বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান, মেডিকেল কলেজের পুনর্মিলনী, কারো বাড়িতে নিমন্ত্রণ কোথাও দেখা পাওয়া যায় না আরেফিনের। আরেফিনের কোনো ছবি গত কুড়ি বছরে ভেসে ওঠে নি কোথাও, কোনো বন্ধুর ফেসবুক পাতায়। আরেফিন কি আগের মতই আছে? লম্বা, ছিপছিপে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া ঘন কালো চুল। আরেফিন গলা খুলে হাসত না। ওর ঠোঁট কেঁপে উঠত মুচকি হাসিতে কিন্তু চোখ দু’টো চকচক করে উঠত। আরেফিনের চোখ কি এখনো জ্বলে আগের মত?


কুড়ি বছর পর দেশে এসেছে সুমনা। নাফিসের সাথে নিউজিল্যান্ড চলে যাবার পর সংসার আর চাকরি নিয়ে সংগ্রাম করতে করতে কোথাও যাবার সুযোগ হয়নি সুমনার। ছেলেমেয়ে দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার পর সুমনার এখন একটু দম ফেলার সুযোগ হয়েছে। তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে যাবার টিকেট কাটার পর সুমনা পরিকল্পনা করতে বসল কার সাথে দেখা করবে। মামাত বোন পারভীন ছাড়া নিকট আত্মীয় আর কেউ নেই সুমনার। বাবা-মা মারা গেছেন বেশ ক’ বছর হল। সে সময় সুমনা জীবনের স্রোতে ভেসে থাকার তাগিদে কোনোরকমে শ্বাস ধরে ছিল। তাঁদের মৃত্যুসংবাদ সুমনার বোধে অস্পষ্ট দাগ এঁকে মিলিয়ে গিয়েছিল দ্রুত। এখন নোটবুকের পাতায় কালির আঁচড় তুলতে গিয়ে মা-বাবার অনুপস্থিতি নতুন করে উপলব্ধি করল সুমনা। হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়ে অশ্রুর ধারা বইতে শুরু করল। ছোটবেলার স্মৃতি, অসংখ্য টুকরো টুকরো ঘটনা ভেসে বেড়াতে থাকল সুমনার চিন্তার চিত্রপটে। আর তার সূত্র ধরে কুড়ি বছর পর হঠাৎ করেই সুমনার মনে পড়ে গেল আরেফিনকে। আর কারো সাথে না হোক আরেফিনের সাথে নিশ্চয়ই দেখা করতে হবে। কিন্তু আরেফিনের সাথে যোগাযোগের উপায় কি? তিনজন বন্ধু আরেফিনের তিনটে ফোন নম্বর দিল যার কোনোটাই আরেফিন ধরল না। অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ফোন কি আরেফিন ধরে না? শেষ পর্যন্ত পারভীন আরেফিনের এক রোগীর ফোন থেকে আরেফিনের সাথে কথা বলে সুমনাকে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর একটার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন তলায় সুমনার জন্য সময় দিয়েছে আরেফিন।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে লম্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুমনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সার ধরে বেশ কয়েকটা ঘর। আরেফিন বলে নি কোন ঘরে যেতে হবে। একজন ডাক্তার সাদা এ্যাপ্রন পরে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে প্রায় দৌড়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর পিছু পিছু ফাইল হাতে ছুটছিল বেশ কয়েকজন। ছুটন্ত দলকে পথ করে দেবার জন্য সুমনা দেয়ালের সাথে সিঁটিয়ে গেল। ডাক্তার চোখের কোনা দিয়ে এক নজর সুমনাকে দেখলেন। তারপর কয়েক কদম পার হয়ে হঠাৎ ব্রেক কষে ঘুরে তাকালেন সুমনার দিকে, ‘আরে সুমনা না? তোমার তো দেখছি কোনো পরিবর্তন হয়নি।’

সুমনা চিনতে পারে না। বিশাল বপু চকচকে টাক আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা নিয়ে এই ডাক্তার কে?

‘বুঝতে পারছি চিনতে পার নি আমাকে। অবশ্য চিনতে পারবেই বা কিভাবে? আমি আরেফিন।’ 

সুমনার মুখ হা হয়ে যায়। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। সুমনার নিস্তব্ধতার সুযোগ নিয়ে আরেফিনের আশেপাশের লোকগুলো শোরগোল তোলে, ‘সার আমার রুগীটা দেখবেন না?’ ‘সার আমার কামটা হইব না?’ 

আরেফিন হাত তুলে শান্ত করে সবাইকে, ‘হবে হবে সব হবে। এ্যাই সালাম, এই আপাকে আমার রুমে নিয়ে বসা। সুমনা, তুমি সালামের সাথে যাও। আমি হাতের কাজটা শেষ করে আসছি। তারপর এক সাথে লাঞ্চ করব।’

সুমনা কিছু বলার আগেই আরেফিন চলে যায় সদলবলে। সালাম নামের এক তরুণ সুমনাকে সালাম দেয়, ‘আসেন আপা। আমি সারের পিওন।’ 

আরেফিনের ঘরে নরম সোফাতে এসে বসে সুমনা। বাইরের গনগনে রোদ থেকে এসে এসির ঠান্ডা বাতাসে শরীর সজীব হয়ে ওঠে। আরেফিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। পদোন্নতি হতে হতে অধ্যাপক হয়ে গেছে। আরেফিনের চেয়ারের পেছনের দেয়ালে বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রীর ছবি। তার নীচে রাখা লম্বা কাঠের টেবিলের ওপর ফাইল বই কাগজপত্রের এক পাশে আরেফিনের দুই কিশোরী মেয়ের ছবি। খুব মিষ্টি চেহারা মেয়ে দু’টির। সুমনা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক খুঁজল। আরেফিনের স্ত্রীর কোনো ছবি খুঁজে পেল না।

কি বিশাল পরিবর্তন আরেফিনের! এখনকার আরেফিনের মধ্যে কোনোভাবেই কুড়ি বছরের পুরোনো আরেফিন নেই। শুঁয়োপোকা রূপান্তরিত হয়ে বাহারী প্রজাপতি হয়। মানুষ আরেফিন বিপরীত রূপান্তরে কোলাব্যাং হয়ে গেছে। নাহার কি যত্ন নেয় না আরেফিনের? ভেতরে ভেতরে রাগ জমে সুমনার। সুমনা ছিল আরেফিন আর নাহারের প্রেমের সেতুবন্ধন। মেডিকেল কলেজে একই ব্যাচে ছিল সুমনা আর আরেফিন। প্রতি সপ্তাহে ফরহাদস্যারের সামনে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এক সাথে এ্যানাটমির আইটেম পরীক্ষা দিতে দিতে সুমনা আর আরেফিনের মধ্যে ভালোই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। সেই বন্ধুত্বের সুবাদে এক দিন আরেফিন সাহায্য চাইল সুমনার। পাড়ার মেয়ে নাহারের সাথে আরেফিনের প্রেম। কিন্তু নাহারের বাড়িতে কঠোর পাহারা। বাড়ি থেকে ইডেন কলেজ। এর বাইরে নাহারের আর কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই। আরেফিনের বারান্দা আর নাহারের জানালার চকিত চাহনীতে যে প্রেম কুঁড়ি মেলেছিল তা বিকশিত হবার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। সুমনা হয়ে গেল নাহারের সহপাঠী। ইডেন কলেজে ঢুকে নাহারকে পৌঁছে দিত আরেফিনের চিঠি। নাহার চিঠির জবাব পাঠাত সুমনার হাতে। কালেভদ্রে অল্পসময়ের জন্য সুমনার পাহারায় আরেফিন আর নাহারের দেখা হত কোনো বইয়ের দোকানে। আরেফিনের পাশে নাহারকে বড় বেমানান লাগত সুমনার। আরেফিন লম্বা সুদর্শন। সে তুলনায় নাহার ছিল বড়ই সাদামাটা। মুখের আদলে মন কেড়ে নেবার মত সৌন্দর্য ছিল না। কথা বলত খুব কম। আরেফিন যে কেন নাহারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তা সুমনা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে নি। অবশ্য এই যে হঠাৎ একটু দেখা, একটু হাত ছুঁয়ে যাওয়া এটাই হয়তো ওদের প্রেমকে সজীব করে রেখেছিল। এখনকার ছেলেমেয়ের মত অবাধ মিশ্রণের স্বাধীনতা পেলে হয়তো হারিয়ে যেত ওদের প্রেম। সুমনার কখনো পড়া হয়নি তবে আরেফিন বলত নাহার নাকি খুব সুন্দর চিঠি লেখে। তার অনুরণন বুকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনত আরেফিন। 

‘অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম তোমাকে?’ পর্দা সরিয়ে ঘরে এসে ঢোকে আরেফিন।

‘না ঠিক আছে। তুমি তো এখন অনেক বড় ডাক্তার। খুব ব্যস্ত মানুষ।’ সুমনা হেসে বলে।

আরেফিন হাসে না, ‘আমাকে দেখে খুব অবাক হয়েছ না?’

‘তাতো হয়েছি। রাস্তায় দেখা হলে তোমাকে চিনতে পারতাম না। এখন তোমার সাথে কথা বলে তোমাকে যেন একটু খুঁজে পাচ্ছি। তোমার গলার স্বরও যেন বদলে গেছে।’ সুমনা বলে।

‘এখনো আমার গলার স্বর তোমার মনে আছে?’ আরেফিন অবাক হয়।

সুমনা হাসে। কিন্তু ও কোনো জবাব দেবার আগেই একজন লোক এসে ঘরে ঢোকে। সাদা থ্রি পিস স্যুটের সাথে লাল টাই পরনে। এই গরমে পরে আছে কি করে? 

‘সার আমি লালবাগ থানা যুবলীগের সহ সভাপতি আযম। আমার আম্মার জন্য একটা কেবিন লাগব। আপনে যদি একটু কইয়া দেন।’ লোকটা বিনীত কন্ঠে বলে তবে বোঝা যায় কাজ না হলে সেই কন্ঠ যে কোনো সময় কর্কশ হয়ে যেতে পারে। আযম এসে বসে সুমনার পাশের চেয়ারে। দামী পারফিউমের গন্ধে বোঝা যায় আযমের পকেটে টাকার আনাগোনা খুব একটা কম নয়। আরেফিন দশ মিনিট ধরে দু’ তিনজনকে ফোন করে কথা বলে। তারপর আযমকে বলে, ‘আমি বলে দিয়েছি। আপনি অ্যাডমিশনে গিয়ে শরীফুলকে আমার কথা বলবেন। ও বেডের ব্যবস্থা করে দেবে।’

আযম লম্বা সালাম দিয়ে বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেয়। সুমনা বলে, ‘তোমার দেখি অনেক উটকো ঝামেলা!’

‘তা আছে। অনেকদিন হল তো এখানে। সবাই চেনে। কিছু ক্ষমতাও হয়েছে। লোকজন জানে আমাকে ধরলে কাজ হয়। তাই সচিব-মন্ত্রী-পিওন-মাস্তান সবাই আমার কাছে ধর্ণা দেয়। আমি না করি না। আমার ফোনে কারো যদি কোনো উপকার হয় তা হলে করে দেই।’

সালামের সাথে দু’টো ছেলে বড় বড় ট্রেতে করে প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে ঢোকে। ঢাকনা সরাতে সুমনার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এলাহী আয়োজন। খিচুড়ি, মুরগীর রেজালা, আস্ত ভাজা মাছ, চিংড়ির দোপেঁয়াজা।

‘এ দেখি কঠিন অবস্থা!’ সুমনার কন্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ে।

‘তোমার সাথে কতদিন পর দেখা। ঠিকমত আপ্যায়ন করতে হবে না?’ আরেফিন বলে।

সুমনা স্বল্পাহারী। ও সবকিছু একটু একটু তুলে নিয়ে খেল। আর আরেফিন খেল কব্জি ডুবিয়ে বেশ আয়েস করে। ওর খাওয়া দেখে বোঝা যায় এ বিশাল বপুর কারণ।

‘আমি খেতে একটু ভালোবাসি।’ আরেফিন বলে।

‘তাতো দেখতেই পাচ্ছি। নাহার কিছু বলে না?’ সুমনার গলায় হাল্কা উষ্মা জেগে ওঠে।

আরেফিন চোখ তুলে চায়। চশমা খুলে তাকায় সুমনার দিকে, ‘তুমি কিছু জানো না? অবশ্য জানবেই বা কিভাবে? তোমার সাথে তো কারো কোনো যোগাযোগ ছিল না। আচ্ছা তুমি দেশ ছাড়ার পর কারো সাথে কোনো যোগাযোগ রাখো নি কেন?’

আরেফিনের প্রশ্নের মধ্যে সুমনা বেসিন থেকে হাত ধুয়ে আসে। এই বিরতিটুকু কথা গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয় সুমনাকে, ‘আমার জীবনে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা গেছে আরেফিন। থার্ড ইয়ারে উঠতে না উঠতেই তো আব্বু আমাকে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিল নিউজিল্যান্ড। আমি কত বলেছি আমাকে পড়াটা শেষ করতে দিতে। কিছুই শুনল না। মেয়েদের পড়াশোনা করে কি হবে? নাফিস ইঞ্জিনিয়ার। ভালো চাকরি করে। পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হয়ে গেছে। এর চেয়ে ভালো পাত্র কি মিলবে নাকি? বিয়ের তিন বছরের মধ্যে দু’ ছেলেমেয়ের মা আমি। আর নাফিস একদম হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে চলে গেল। তারপর কিভাবে যে আমার দিন কেটেছে! কাগজে কলমে আমি হাই স্কুল পাশ। কে আমাকে কাজ দেবে? ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করে দু’ বাচ্চা বড় করতে করতে আবার পড়াশোনা করেছি। কি ভাবে যে দিনগুলো পার হয়েছে আমি জানি না। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম যেন। অতীত নেই ভবিষ্যত নেই। শুধুই বর্তমান। প্রতিটি মূহুর্ত বেঁচে থাকার সংগ্রাম। কারো সাথে যোগাযোগ করব কি? আব্বু-আম্মু মারা যাবার সময়ও আসতে পারি নি।’ সুমনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে।

‘কিসে পড়াশোনা করেছ তুমি? ছেলেমেয়েরা কি করে?’ আরেফিন কালো সিল্কের কাপড়ে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বলে।

‘আমি হাই স্কুলে ইংলিশ পড়াই। ছেলে পড়ছে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট। মেয়ে কম্পিউটার সায়েন্স। ওদের নিজের জগত তৈরী হয়ে গেছে। হাত পা ঝাড়া হয়ে গেছি আমি। এবার তোমার কথা বল। এরকম ফুটবল হয়ে গেলে কি ভাবে?’ সুমনা মুচকি হেসে বলে।

‘আমার কথা এখন থাক। হাতে সময় নেই। আমার এখন স্পেশাল আউটডোরে ছুটতে হবে। তুমি কি কোনো একদিন সকাল সাতটা নাগাদ আমার বাসায় আসতে পারবে? আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করবে। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব।’ আরেফিন উঠতে উঠতে বলে।

‘আমি পরশুদিন পারভীনের সাথে গ্রাম দেখতে বাগেরহাটে ওর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। ওখান থেকে ফিরে চলে যাবার আগে আর সময় পাব না। আমি কাল সকালে আসি?’ সুমনা আগ্রহ নিয়ে বলে।

‘আস। আমি বাড়িতে জানিয়ে রাখব।’ আরেফিন বলে। সুমনার সাথে সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত হেঁটে আসে আরেফিন। তারপর অন্য বারান্দা দিয়ে চলে যায় কাজের জগতে। সুমনা আরেফিন কি দেখাবে তা ভাবতে ভাবতে নেমে আসে নীচে।

পরদিন সকাল সাতটার একটু আগেই শুক্রাবাদে পারভীনের বাড়ি থেকে শ্যামলীতে আরেফিনের ডেরায় পৌঁছে যায় সুমনা। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বারো তলা বাড়ির তিন তলায় আরেফিনের অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট। বেল টিপতে আরেফিন নিজেই দরজা খুলে দিল। কাজে যাবার পোষাক পরে তৈরি আরেফিন। সুমনাকে একবারে ভেতরের ঘরে খাবার টেবিলে নিয়ে এল আরেফিন। টেবিলে স্কুলড্রেস পরে বসে আছে আরেফিনের দুই মেয়ে। আর টেবিলের পাশে ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ সুন্দরী এক রমণী।

‘আমার বউ নিলুফার। আর এরা হচ্ছে আইরিন আর কাশফিয়া।’ পরিচয় করিয়ে দেয় আরেফিন।

নাহারের বদলে নিলুফারকে দেখে একটু হতচকিত হয়ে যায় সুমনা। তারপর সাথে সাথে সামলে নিয়ে হেসে সালাম জানায় নিলুফারকে। সুমনার বিনম্র আচরণে নিলুফারও হাল্কা হাসে। আইরিন আর কাশফিয়া ক্লাস এইট-নাইনে পড়ে। ওদের সাথে এখনকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে সুমনা। স্কুলে যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ওরা তাড়াতাড়ি দুধের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিলুফারের সাথে। টেবিলে খাবারের পাহাড়ের দু’পাশে আরেফিন আর সুমনা চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। সুমনা অপেক্ষা করে থাকে কখন আরেফিন ওকে বলবে কি করে নাহারের স্থানে নিলুফার এসে বসল। সুমনার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। আরেফিন মগজের ভুনা দিয়ে আরো দু’টো পরোটা শেষ করে থামে। হাত ধুয়ে কফির মগটা নিয়ে আরেফিন সুমনাকে বলে, ‘এসো আমার সাথে।’ 

দুই মেয়ের ঘর পেরিয়ে ফ্ল্যাটের একদম শেষ মাথায় বেশ বড় একটা ঘর। তিনটে বিছানা ঘরে। একটা বিছানায় বসে আছে একটি মেয়ে। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে মনে হল। ‘ও হল সুফিয়া। সার্বক্ষণিক নার্স। আমাদের বাড়িতে থাকে।’ বলল আরেফিন। সুফিয়া হেসে বাথরুমে ঢুকে গেল। আরেফিন সুমনাকে নিয়ে এসে দাঁড়াল একটি বিছানার সামনে, ‘আমার মা। স্ট্রোক হয়ে ভেজিটেবল হয়ে গেছে আট বছর আগে। ডান দিক পুরো প্যারালিসিস। কথা বলতে পারে না। কিছু বললে বুঝতে পারে না। কিন্তু হার্ট চলছে এখনো নিজের গতিতে।’ আরেফিন হাত রাখে মায়ের কপালের ওপর। নরম স্বরে মাকে ডাকে। মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন, কোনো কথা বলেন না। আরেফিনদের বাড়িতে অন্য বন্ধুদের সাথে সুমনা এসেছে বার কয়েক। আরেফিনের জন্মদিনে, ঈদের পর দিন। আরেফিনের মা যত্ন করে অনেক রান্না করে খাইয়েছেন ওদের। গম্ভীর রাশভারী ভদ্রমহিলাকে অসহায় বোধহীন শুয়ে থাকতে দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল সুমনার।

আরেফিন এগিয়ে গেল অন্য বিছানার দিকে, ‘এই আরেক উদ্ভিদ। সতের বছর ধরে এভাবেই আছে। এই নাহার।’

আরেফিনের কথায় চমকে ওঠে সুমনা। সুমনার স্মৃতিতে আবছায়া নাহারের যে ছবিটা আছে তার সাথে মেলাতে পারে না। আরেফিন হাত ধরে নাহারের নাড়ির স্পন্দন মাপে। তারপর কিছু না বলে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।

বাইরের ঘরের সোফায় এসে বসে সুমনা। ওর উল্টো দিকে আরেফিন। হঠাৎ ধাক্কায় সুমনার মাথা দুলতে থাকে, ‘কি হয়েছিল নাহারের?’

আরেফিন ঘড়ির দিকে তাকায়, ‘পনের মিনিট সময় আছে। এর মধ্যে সংক্ষেপে বলছি। ইন্টার্নি করার সময় মাকে জানালাম নাহারের কথা। ও তখন ইডেন কলেজে মাস্টার্স করছে। পাড়ার মেয়ে। মা চেনে ওকে। শোনার সাথে সাথে না করে দিল। বাবা জোর সমর্থন জানাল মাকে। নাহার দেখতে ভালো নয়। ওর বাবা ছোট চাকরি করে। সবচেয়ে বড় কথা মা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছে নিলুফারকে বাড়ির বৌ করে নিয়ে আসবে। নিলুফার আমার দূর সম্পর্কের খালাত বোন। প্রতিদিন রাতে মার সাথে আমার এ নিয়ে কথা কাটাকাটি চলছিল। মা বেশিদিন সহ্য করতে পারল না। একদিন নাহারদের বাড়ি চড়াও হয়ে ধমকাধমকি করে আসল ওদের। শাসিয়ে আসল নাহার যদি আর আমার সাথে যোগাযোগ করে তবে পুলিশে খবর দেবে। নাহারের বাবামা ওকে কি বলেছিল জানি না। কিন্তু সেই রাতে নাহার ফ্যান থেকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ল। ওর গলা থেকে মনে হয় কোনো শব্দ বের হয়েছিল তা শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এসে ওকে নামিয়ে ফেলতে পেরেছিল। তবে ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। অক্সিজেনের অভাবে ওর ব্রেনের পার্মানেন্ট ড্যামেজ হয়ে গেছে। গত সতের বছর ধরে বোধহীন চেতনাহীন হয়ে ও পড়ে আছে।’

‘ও তোমার কাছে এল কি করে?’ সুমনা ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘কি জানো এ ঘটনায় আমার যতখানি ভেঙে পড়ার কথা তার চেয়ে মা ভেঙে পড়ল অনেক বেশি। সারাক্ষণ কাঁদে। বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে থাকে। মাকে দেখে নিজের দুঃখ ভুলে আমি শক্ত হলাম। মাকে বললাম মা আমরা দু’জনেই দোষী। চল প্রায়শ্চিত্ত করি। 

মা বলল কিভাবে? 

আমি বললাম নাহারকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসি। ওর দেখভাল করার দায়িত্ব নেই।

মা বলল কিন্তু ওরা কেন নাহারকে দেবে আমাদের কাছে?

কারণ আমি নাহারকে বিয়ে করব।

মা বিছানা থেকে উঠে বসল। কিন্তু আমি যে নিলুর মাকে কথা দিয়েছি।

আমি নিলুকেও বিয়ে করব। তুমি খালাকে, নিলুকে, নাহারের বাবামাকে বোঝাও।

আমার আর কথা বলতে হয়নি কারো সাথে। মা বাবা মিলে সব ব্যবস্থা করল। কাগজকলমে নাহারের সাথে বিয়ে হল আমার। তারপর বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে নিলু এল বাড়ির বৌ হয়ে। নিলুর দরকার একজন টাকাওয়ালা স্বামীর। ও আমার মধ্যে তার সন্ধান পেয়ে নাহারকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু তার বিনিময়ে ওর চাহিদা হয়ে গেছে আকাশছোঁয়া। বাড়িতে সুফিয়া থাকে সবসময়। আর তার সাথে পার্ট টাইম আরো চারজন আছে। দু’জন অথর্ব মানুষের ঠিকমত যত্ন নেওয়া তো চারটি খানি কথা নয়। মাঝে মাঝে নিউমোনিয়া হয়, ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন হয়। তখন ওদের ঘরটা পুরো হাসপাতাল হয়ে যায়। এই বিশাল খরচের সাথে নিলুর শাড়ি-গয়না-ভ্যাকেশনের চাপ। আমি এখন শুধু দু’টো কাজ করি। খাই আর টাকা কামাই। হাসপাতালের কাজের পর দু’টো চেম্বারে রাত সাড়ে বারটা পর্যন্ত রোগী দেখি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দেড়টা। আবার সকাল সাড়ে ছটায় ঘুম থেকে উঠে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। শুক্রবার ভোরের ফ্লাইট ধরে সিলেট চলে যাই। সারাদিন রুগী দেখে বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে সোজা চলে যাই চেম্বারে। এভাবে চলছে জীবন।’

‘তাই বলে তুমি নিজের দিকে একবার তাকাবে না? এভাবে কতদিন চলবে?’ সুমনা আর্তচিৎকার করে ওঠে।

‘যতদিন চলে। নাহার উদ্ভিদ হয়ে যাবার সাথে সাথে আমারও মৃত্যু হয়ে গেছে। খোদার কাছে শুধু চাই নাহার যেন আমার আগে চলে যায়। নাহারের বোঝাটা যেন নিলুর কাঁধে এসে না পড়ে।’

‘তোমার মেয়েরা? তাদের জন্য তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?’

‘ওরা তো আমাকে চেনেই না। সকালে স্কুলে যাবার আগে ব্রেকফাস্ট টেবিলে কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয় আমাদের। এরচেয়ে বেশি কিছু নয়। ওরা এখনো জানে নাহার ওদের ফুফু। আর একটু বড় হলে যখন সত্যি কথাটা জানবে তখন হয়তো আমাকে ঘৃণা করা শুরু করবে। চল উঠি। একটা ঝামেলার রোগির বোর্ড আছে। এখন না বের হলে দেরি হয়ে যাবে।’ আরেফিন তাড়া লাগায়। 

আরেফিনের সাথে গাড়িতে উঠে আসে সুমনা। ড্রাইভারের সামনে আর কোনো কথা হয় না ওদের মাঝে। শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ডে সুমনাকে নামিয়ে দিয়ে আরেফিন চলে যায়। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু হাঁটলেই গলির ভেতর পারভীনের ফ্ল্যাট। কিন্তু সুমনার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। পান্থপথের ফুটপাত দিয়ে আনমনে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ করেই একটা স্মৃতি মনে পড়ে যায় সুমনার। অনেক অনেক দিন আগে আরেফিনকে সুমনা জিজ্ঞেস করেছিল নাহারকে কেন ভালোবাসে ও। আরেফিন বলেছিল, ‘একদিন বিকেলে বারান্দায় বসে আইটেমের পড়া পড়ছি। কিছু ঢুকছে না মাথায়। মাথা দপদপ করছে। হঠাৎ চোখ তুলে দেখি উল্টোদিকের বাড়ির জানালায় বসে একটি মেয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। খুব বিমর্ষ চেহারা। জানালার শিক বসে গেছে মেয়েটির গালের ওপর। জেলখানায় বন্দী যেন। আমার তখুনি মনে হল এই মেয়েটিকে আমার বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে। আর সেই ইচ্ছেটা হবার সাথে সাথেই আমার মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল। কঠিন এ্যানাটমি সহজ হয়ে গেল দ্রুত। নাহার আমার মাঝে সাধারণ মানুষ থেকে অতিমানুষ হয়ে ওঠার প্রেরণা জাগিয়েছিল। ওকে ভালোবাসব না কেন?’ বলতে বলতে মুচকি হাসিতে আরেফিনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।


আজ অনেকবার কথা বলতে বলতে আরেফিন চশমা খুলেছিল। মরা মাছের মত ঝাপসা ঘোলাটে ওর চোখ। একবারও জ্বলে ওঠেনি॥

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ