ক’টা বাজে দাদা, একটু বলবেন?
চারটে পাঁচ।
এখান থেকে ভিক্টোরিয়া কতটা? বলতে পারেন?
হেঁটে গেলে তো মিনিট সাতেক লাগবে। এই তো সামনেই!
বাসে যাওয়া যাবে না, নাকি?
এখান থেকে তো ভিক্টোরিয়ার জন্য কোনও বাস যাবে না। তবে বাসের পাদানীতে দাঁড়িয়ে সামনের মোড়টায় নেমে যেতে পারেন।
ভাড়া কত হবে?
এক মিনিটেই নামিয়ে দেবে। তার জন্য আবার ভাড়া কী!
পিটিএসের সামনের রাস্তাটা দিয়ে বাসগুলো তখন বেঁকে চলে যাচ্ছে হুহু করে। ওখানকারই একটি ছাউনির তলায় বসে কথা হচ্ছিল দুটো মানুষের। একজনের পরনে গেঞ্জি আর জিনস। অপরজনের, ফতুয়া ও কালো রঙের টেরিকটের প্যান্ট। এই দ্বিতীয় লোকটিই প্রথম প্রশ্নটি করে। তার ঘন কালো চিমসে মুখে বেখাপ্পা সাইজের একটি সাদা গোঁফ। গালে সাদা সাদা গুঁড়ো চিনির দানা। মাথায় একটাও চুল নেই। লোকটা একবার নাকটা খুঁটে চট করে হাতটা টাকে মুছে নিল। হেস্টিংসের দিক থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ি ছুটতে ছুটতে আসছিল। সহিসটি বাচ্চা ছেলে। ঘোড়ার পিঠে কঞ্চির বাড়ি মারছে আর প্রায় পিত্তের মাঝখান থেকে টেনে আনছে চাপা শুকনো চিৎকার- হেই শালো! হেই শালো! রেন্ডির বাচ্চা! সিধা চল! সেদিকে মুখটা হাঁ-করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে টাকমাথা মানুষটি গেঞ্জি-জিনসকে বলল, আপনি কি ওদিকটায় যাবেন, দাদা?
কোথায়? পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে সেটাকে উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করতে করতে কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই আবার বলে বসল সে, ভিক্টোরিয়ার দিকে?
হ্যাঁ। আমি আসলে দাদা… উশখুশ করছে লোকটা…ঠিক সাহস করতে পারছি না রাস্তা পেরোতে। কেউ সঙ্গে থাকলে একটু বল পাই বুকে। বুঝলেন না! কথাটা বলে চট করে প্যান্টের বাঁ-পকেট থেকে একটা হলুদ রঙের ডিবে বার করে এক টিপ নস্যি নিয়ে ফেলল।
এখান থেকে এক্সাইডের দিকে যাচ্ছে এমন যে কোনও বাস ধরে চলে যান তাহলে। উঠতেও হবে না পুরোপুরি। পাদানীতে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই চলে আসবে। বললাম তো! ওই তো সামনের মোড়টায়। এখান থেকে মাথাটা একটু বাড়ালেই দেখা যাবে।
সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছি না ঠিক। এই জায়গায় আগে কখনও আসিনি তো। বুঝতে পারছি না।
নতুন নাকি?
কে? আমি? না! না! অনেক পুরনো। আপনাদের থেকে বছর চল্লিশের বেশি বয়স তো হবেই।
কলকাতায় নতুন? কথাটা বলতে বলতে দশ টাকার নোটটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে দিল ছেলেটি।
ও কি দাদা! টাকাটা এভাবে ছিঁড়ে ফেললেন! টাকা কেউ এভাবে ছিঁড়ে ফেলে?! সাক্ষাৎ লক্ষ্মী!
ও আর কাজে আসবে না কোনও!
তা কি হয়! টাকা যেখানেই রাখুন, যেভাবেই রাখুন, ঠিক কাজে আসে। ও জিনিস ফেলা যায় না কখনও।
আমি এর আগে আরও প্রায় হাজার দশেক টাকা এভাবে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। দু’হাজার, পাঁচশো, একশো- সব ছিঁড়ে দিয়েছি। ওগুলো দেখলে তাহলে কী বলতেন! এটা তো তাও মাত্র দশ টাকা। একটাই ছিল বোধহয় পকেটে। সেটাও ছিঁড়ে দিলাম। আমার কাছে আর কাজ চালানোর মতো নোট বোধহয় কিছুই রইল না। কিছু খুচরো আর একটা বাতিল পাঁচশোর নোট আছে। পাঁচশোর নোট তো আর চালানো যাবে না এখন। খুচরোগুলো ফেলে দিলেই তাই ল্যাঠা চুকোয়। আমি পুরো ফতুর।
জিনিসটা করছেন কেন ভাই? কিছু ঘটেছে আপনার সঙ্গে? লোকটা আবার আরেক টিপ নস্যি নিয়ে ফেলল।
আপনি বারবার এটা করছেন কেন?
আজ্ঞে?
এটা করছেন কেন?
কোনটা?
এই যে, এত ঘনঘন নস্যি নেওয়া?
ওহো! লোকটা পুরো মুখটা খুলেই হেসে ফেলল প্রায়। দাঁতগুলো দেখা গেল। কেউ যত্ন করে সেখানে ছাই মাখিয়ে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে। মাঝের দাঁতটি নেই। হাসিটা তার বীভৎস। এই ব্যাপারটা তো একটা শখ। নেশা।
আমারও এটা একটা শখ। লোকটি কথা বলতে বলতে কাছে চলে এসেছে একদম। গা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে মাটির গন্ধ। ছেলেটি একটু সরে দাঁড়াল।
টাকা জমানো একটা ভালো শখ। কিন্তু টাকা ছিঁড়ে ফেলাটা আবার কীরকম শখ! লোকটি অবাক হয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে গিয়ে একটা লম্বা হাঁচি দিয়ে ফেলল। নাক থেকে কিছুটা শিকনি ফত করে বেরিয়ে এসে পড়ল হাতের চেটোটায়। ঝাঁঝালো মুখমণ্ডল আর ক্ষুদ্র চোখ নিয়ে তারপর সে কী সেয়ানা হাসি! খুব ঠাণ্ডা লেগেছে, বুঝলেন! কথাটা বলে শিকনিটা আবার সে তার টাকে মুছে নিল। শিকনির রঙটা কিছু সবুজ। শহরের বায়ু এত শুষ্ক! দম বন্ধ হয়ে যায়।
নতুন নাকি?
একটা কথাই ক’বার করে জিগ্যেস করবেন? ওরা যে ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, তার ঠিক পিছন দিয়ে একটি বৃদ্ধ ছাতিম গাছ তার শিকরবাকড় নিয়ে মাথাটা তুলে আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে। তার পিছনে রেসকোর্সের রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে এক মনে ঘাস খেয়ে যাচ্ছিল একটি খচ্চর। ওদের কথা শুনে থমকে গিয়ে খাওয়া থামিয়ে একবার এদিকে মুখ তুলে তাকাল। ওখান থেকে একটু দূরের মোড় দিয়ে পিজির দিকে চলে যাচ্ছে অনেক হলুদ ট্যাক্সি। মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ট্র্যাফিক পুলিশকে দেখে খচ্চরের মনে পড়ল, লোকটা একবার তার পিঠে চড়তে গিয়ে উলটে পড়ে গিয়েছিল। খচ্চরটির তখন ময়দানে পোস্টিং। সে আর বেশি না ভেবে আবার খাওয়াতে মন দিল।
আপনি যতবার প্রশ্নটা না বুঝে অন্য উত্তর দিয়ে যাবেন।
এবারেও তো বুঝলুম না!
আপনি কি কলকাতায় নতুন? এর আগে কখনও আসেননি? গলায় জোর ছিল। আরও দুজন নতুন আনকোরা লোক ততক্ষণে ওই ছাউনির তলায় চলে এসেছে। নীল রঙের ছাউনি। তারা মন দিয়ে যে যার নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কাজ করছিল। একটা চেঁচামেচির আভাস পেয়ে ওদের দিকে তাকাল। ঘড়িতে তখন চারটে বেজে সতেরো। তারা আবার নিজেদের জগতে ফিরে গেল।
ওহ! তাই বলুন! কলকাতায় আসব না কেন?! খুব এসেছি! বারাসত কোর্টে হাজিরা দিতে একসময় ফি-হপ্তা আসতাম। জমি নিয়ে মামলা। ওখানে তখন কম থেকেছি!
বারাসতটা কলকাতায় এ কথা আপনাকে কে বলল? জিনসের পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে আরেকটা নোট পেয়ে গেল এবার ছেলেটি। পঞ্চাশ টাকার। মাঝখান দিয়ে আধাআধি চিড়ে ফেলল সে ওটাকে। গাড়িগুলো তখন সিগন্যালে থেমেছে।
এভাবে ছিঁড়ে ফেলছেন ভাই একটার পর একটা! এগুলা কি সব জাল নোট?
না। কখনওই না। একটাও নকল নোট নেই।
তাহলে এভাবে টুকরো টুকরো করে ধ্বংস না করে দিয়ে বরং এইগুলা ভিখারিকে দিয়ে দিন। তাতে পাপ কম হবে। কলকাতায় তো অনেক ভিখারি।
আপনি যাবেন তো? চলুন। রাস্তা ফাঁকা আছে এখন। ছেলেটি হাতে চারটে পাঁচ টাকার কয়েন নিয়ে বলল। হিপ পকেট থেকে বার করেছে।
হ্যাঁ। একটুখানি তো? আপনি কয়েনগুলা নিয়ে কী করবেন? ফেলে দেবেন?
কয়েন নিয়ে পরে ভাবা যাবে। ছেড়ে দিচ্ছি আপনাকে। চিন্তা নেই। চলুন। আপনার বাড়ি কোথায়?
আমি থাকি নিচু কমলাপুর গ্রামে।
সেটা আবার কোথায়?
খড়িকামাথানী চেনেন?
না। কোথায়? যাহ! গাড়িগুলো আবার ছেড়ে দিল! দাঁড়ান সিগন্যালে আরও পাঁচ মিনিট। না থামলে ও পাশে যাওয়া যাবে না এখন।
সে তো বুঝতেই পারছি।
ওরা ডিভাইডারের পাশে এসে দাঁড়াল। ওদের পাশে ট্র্যাফিক পুলিশ। খচ্চরের পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ বলুন এবার। কোথায় জায়গাটা?
পশ্চিম মিদনাপুর চেনেন?
হ্যাঁ। চিনব না! ঘুরতেও গেছি অনেকবার। শালবনি, জামবনি… মাওবাদী আছে তো!
এখন আর সে সব নেই। ওগুলা পুরনো ব্যাপার। ওখানকারই জায়গা। নয়াগ্রাম চেনেন?
না।
আরে যেখানে কয়েকদিন আগে দু’কিলোমিটার সেতু হল! সুবর্ণরেখার ওপর দিয়ে। চেনেন না!
না।
তাহলে তো কিছুই চেনেন না। আমাদের গ্রাম নয়াগ্রাম থানাতেই।
কী অদ্ভুত নাম! নিচু কমলাপুর!
ওখানে বর্ষা এলেই জল জমে যাবে প্রত্যেক বছর। তাই ওই নাম। আরেকটা আছে উঁচু কমলাপুর। ওখানে অত জল জমে না। বন্যার সময় নিচু কমলাপুরের লোকেরা উঁচু কমলাপুরের প্রাইমারি ইস্কুলে এসে থাকে।
এবারে বন্যা হয়নি?
বন্যা এবারে হয়নি। তবে জল জমে ছিল অনেকদিন। এখন নেমে যাচ্ছে।
আপনি কলকাতায় এলেন কেন ওখান থেকে? কিছু দরকার?
আমি একটা খোঁজাখুঁজি করতে এসেছি।
কী খুঁজবেন? গাড়িগুলো থেমে গিয়েছে সব আবার। পিজি থেকে একটি মড়া বেরিয়ে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের দিকে চলে যাচ্ছিল। সিগন্যাল পড়ে যাওয়ায় একদম ওদের ঘাড়ের ওপরেই ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। অল্পবয়সী মহিলা। মাথায় সিঁদুর।
এ হে! একদম ফুলের মতো মুখখানা! দেখুন একবার। দেখেন…
আপনি তাড়াতাড়ি চলুন আগে। নইলে আবার গাড়ি ছেড়ে দিলে রাস্তা পেরোনো যাবে না। আগে এটা করে নিয়ে তারপর নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। সামনের ওই গেটটা দিয়েই ভিক্টোরিয়ায় উকতে হবে।
এত বড়ো একটা নিমগাছ আছে এখানে? ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি এসেই লোকটার চিমসে মুখটা থুতনিসহ ঝুলে পড়ল। কতদিনের পুরানো হবে এটা?
জানি না। আমি গাছপালার খোঁজ রাখি না তত।
এ নিশ্চয়ই বহু বছরের পুরানো জিনিস। আমরা খাল-বিল, মাঠের দেশের লোক। আমাদের ওদিকে কোনও আড়াল-আবডাল নেই। দশ-বিশ বিঘে জমি সূর্য়ের আলোতে ফকফক করে পড়ে থাকে। আমরা গাছ চিনি। দারুণ গাছ। নালসের ডিম আছে ভর্তি। তবে, এখনও পিঁপড়ে হয়নি।
আপনি এইসব কথায় সময় নষ্ট না করে কাজের কথাটা বলুন, দাদা। কী খুঁজতে এসেছেন এখানে? সেটা বলুন। তাহলে আমি কিছু সাহায্য করতে পারি।
আমার নাতনীটা অনেকদিন হল হারিয়ে গেছে। সতেরো বছর বয়স। ক্লাস নাইনে পড়ে। ভালো নাম- বকুল জানা। আমাদের ওদিকে ভসরা বলে একটা জায়গা আছে। ওখানকার একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করত। ছেলেটা বয়সে অনেকটা বড়ো। সাইকেলের দোকানে কাজ করে। ভালো ছেলে না। কেশিয়াড়ি থানার পুলিশ একবার ধরেছিল ওকে কী একটা কেসে। একটাই নাতনি আমার। বারণ করতাম। শুনত না। খড়গপুর স্টেশন থেকে হারিয়ে গেছে আজ হয়ে গেল দু’মাস।
সে কী! পুলিশে খবর দিয়েছিলেন?
দিয়েছিলাম। বলল, দেখছি। তারপর আর কোনও খবরটা নেই। আচ্ছা, এখানেই কি ওনারা বসেন?
কারা?
যারা ভালোবাসাবাসি করতে আসেন?
হ্যাঁ। কিন্তু তা দিয়ে আপনার হবেটা কী?
আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোটো। একটা কথা বলি। মনে নেবেন না। আপনি বড়ো প্রশ্ন করেন। এক কথা বারবার বলেন। এটা একটা দোষ। আপনি যে তখন থেকে টাকাগুলো ছিঁড়ে ফালফাল করে দিচ্ছিলেন, আমি কি আপনাকে তা নিয়ে বেশি প্রশ্ন করে ত্যক্ত করেছি? বলুন? বলেন… কথাটা বলতে গিয়ে লোকটির গলার পেশি ফুলে গেল। ছেলেটি লক্ষ করল, গলার শুকনো কালো চামড়ায় এক ধরনের সাদা রঙের বিজগুড়ি বেরিয়েছে অনেকগুলো। পেশি ফুলে ওঠায় স্পষ্ট হয়েছে তা। আমরা মা সাঁতাইবুড়ির ভক্ত। তাঁর চরণে মানত রেখে এসেছি। নাতনী ফিরলে সোনার মুকুট গড়ে দেব জমি বেচে দিয়ে। তিনিই স্বপ্নে এসে দেখা দিয়ে গেছেন আমার।
মা সাঁতাইবুড়ি কি আপনাদের ওখানকার দেবতা?
তিনি তো সবখানেই আছেন। সুবর্ণরেখার পাড়েই তাঁর মন্দির। জঙ্গলের আগে আগে।
স্বপ্নে এসে কী বলেছেন তিনি আপনাকে?
আপনি আমায় যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখান থেকে কি ওনাদের মুখোমুখি দেখা যাবে?
ভালোবাসছে যারা, তাদের? হ্যাঁ।
আপনি এটা করবেন না আমার সঙ্গে। এতটা করলেন যখন, আরেকটু করুন। এমন জায়গায় নিয়ে যান, যেখান থেকে ওনাদের দেখা যাবে, কিন্তু মুখোমুখি হয়ে যাব না।
কেন? মুখোমুখি হলে কী হবে?
আমার সোনার মা’র ফিট আছে। ওর বিয়ের জন্য পাঁচ বিঘা আলাদা করে রাখা আছে। তাতে এখন হাঁটু অবধি বর্ষার জল। ও এলেই শুকিয়ে যাবে। তখন পুরো জমি চাষ করে দিয়ে বেচে দেব। ধান বেচার টাকা আর জমি বেচার টাকা দিয়ে ওই ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দেব ওর। কিন্তু আমাকে সামনসামনি দেখে অবাক হয়ে গিয়ে ফিট হয়ে গেলে এই বিদেশ-বিভুইয়ে আমি ওকে নিয়ে কী করব তখন তা বলতে পারেন?
সোনার মা… আচ্ছা… আপনার নাতনী।
হ্যাঁ। ওর ঠাকুমার দেওয়া নাম। সে তো আর নেই।
কথা বলতে বলতে তারা দুজন ফুটপাথ ধরে ভিক্টোরিয়ার পাঁচিলের কাছে এসে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল। সাড়ে চারটে বাজে। সূর্য কিছুটা আলো ছেঁকে নিয়ে নিচের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে বাকিটা পৃথিবী থেকে তুলে নিচ্ছে স্যাটস্যাট করে। ঘোড়ার গাড়ি, বাস, ট্যাক্সিবোঝাই করে বহু মানুষ ওই সময় জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছিল। তাদের কারও হাতে হরলিক্স-কমপ্ল্যান। বাড়ির লোকের জন্য পর্যাপ্ত ভিটামিন। কারও হাতে অন্যের বউয়ের হাত। ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউই ওদের খেয়াল করছিল না।
আপনি আসতে এত দেরি করলেন কেন? এই পার্ক তো আরেকটু বাদেই বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলেটি বলে।
আমি সকাল থেকে অন্য জায়গায় ঘুরছিলাম। বাবুঘাটের ওখানে। পিন্সেপ ঘাট আর মিলানিয়াম পার্ক আছে না? ওখানে। লোকটা একটু উবু হয়ে গেল পাঁচিলের কাছে। চোখটা তীক্ষ্ণ হল তার। দৃষ্টিটা ঝোপঝাড় ভেদ করে একদম বিষ মাখানো তীর হয়ে ভিক্টোরিয়ার বিভিন্ন বেদী, ঘাস, গাছের পিছনে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ওখানে তখন অজানা অচেনা শরীরগুলো একে অপরের মধ্যে মিশে যাচ্ছিল ক্রমে।
ওখানে কী করছিলেন? বলতে বলতে ছেলেটিও একটু উবু হল।
সেখানেও তো তেনারা বসে থাকেন। ওখানে গিয়েছিলাম তাই। আপনার মতো কেউ ছিল না ওখানে। তাই খুঁজতে বেগ পেতে হল। তবে দৃশ্যটি বড়ো বাজে। নির্লজ্জ। ওই অবস্থায় সোনার মা’র মুখোমুখি পড়লে আমি লজ্জায় মরে যেতাম একদম। নিজের হাতে খাইয়ে-দাইয়ে বড়ো করেছি। ও দৃশ্যের সামনে কি আমি সহজ হতে পারতাম? অথচ, মা বলেছিল, কলকাতায় যে সব ভালোবাসাবাসির স্থান আছে, সেখানে খোঁজ। নাতনীকে পেয়ে যাবি। লোকটির গলা ধরে আসে। কিছুই নেই এখানে। অন্যদিকটা যাবেন?
চলুন। দেখা যাক। পাঁচ টাকার কয়েনগুলো ছেলেটি আর ফেলে দেয়নি। এখনও হাতে রয়েছে। চারটে করে মোট কুড়ি টাকা।
ভিক্টোরিয়া বন্ধ হতে আর মিনিট দশেক দেরি। ওরা অন্য আরেকটা দিকে আসে। কোনও কারণ ছাড়াই দুজনেরই একটু শীত-শীত করে। ঝোপের আড়ালে বসে, চিৎ হয়ে, উবু হয়ে, দাঁড়িয়ে বিভিন্ন মূর্তি।
লোকটি এখানেও একইভাবে খুঁজছিল। ছেলেটি একবার পিছন ঘুরে তাকাল। দুটো লোক মারামারি করছে। কেন কে জানে! এ দৃশ্য দেখে তার চোখ অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে এখন। সে কালনার ছেলে। বাপের এক ছেলে। সম্পত্তির পুরোটাই পেয়েছিল। বাপ-ছেলের সংসার থেকে একটি সকালবেলা ছিটকে বেরিয়ে সেই বাবা আর ফিরে এলো না। শুনেছিল কলকাতায় চলে এসেছে। পাঁচমাথার মোড়ের দিকে দেখা গিয়েছিল হারিয়ে যাওয়ার আট দিন বাদে। গত এক বছর ধরে কলকাতার সব জায়গাতেই সে খুঁজে চলেছে তার বাবাকে। এই খুঁজতে খুঁজতেই সে দেখে ফেলেছে চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেনের মাঝখানে পা গলে গিয়ে মানুষের ছটফট করতে থাকা। রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের তলায় চাপা পড়ে যাওয়া। পথ চলতে চলতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ফুটপাথেই ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যু। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই খবরের কাগজ তাকে বর্ণনা করেছে ‘প্রত্যেক্ষদর্শী’ হিসাবে। নিজের বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে সে এখন এক নিস্পৃহ পেশাদার প্রত্যক্ষদর্শী। এছাড়া তার আর কোনও পরিচয় নেই। কেবল দেখে যাওয়া ছাড়া, দেখার ভিতর দিয়ে কিছু একটা খুঁজে নেওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। যা টাকাপয়সা আছে, তার সব কিছু ছিঁড়ে ফেলে দিয়েই সে কোনও মেট্রোর লাইনে মাথা দেওয়ার জন্য চলে যেতে চাইছিল। তখনই দেখা হল লোকটির সঙ্গে। সে জানে, নিজের নাতনীকে খুঁজতে খুঁজতে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই বুড়ো মানুষটিও এক সময় তার মতো প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে গিয়ে কোনওদিন হারিয়ে যাবে। যা হারায়, তাকে তো আর পাওয়া যায় না। সে চলে যায় চিরকালের মতো। তাকে খুঁজতে এসে আরেকটি নতুন মানুষই মুছে যায় কেবল। পুলিশের খাতায় তখন তার নামের পাশে শরীরের বিবরণে লেখা থাকে- মাঝারি গড়ন। গালে কাটা দাগ…
খিদে লেগেছে খুব। ডিম ভাজা খেতে ইচ্ছে করছে একটু। খাবেন? লোকটি মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করল। খুঁজতে খুঁজতে পাঁচিলের ফাঁকগুলোর মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়েছিল।
আচ্ছা। এক কাজ করুন। আমার কাছে এই যে কয়েনগুলো আছে, এগুলো দিয়ে কিনে আনুন। ওই সামনের মোড়ের মাথায় পাওয়া যাবে।
আপনার থেকে পয়সা নেব কেন? আপনি এত উপকার করলেন আমার! কয়েনগুলা বরং নিজের কাছে রাখুন।
নিন না আপনি। ওই সামনের মোড়ে গিয়ে কিনে আনুন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। কুড়ি টাকারই আনবেন।
আচ্ছা। আমি আনছি। আপনি একটু দেখবেন তো, খুঁজে পান কি না। ফরসা রং। অনেকটা চুল। খুব রোগা। গায়ে বেগুনি জামা।
লোকটি চলে যেতেই ছেলেটি একলাফে ওখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। দু’মিনিটের মধ্যে পিজির ক্রসিং। আরও পঁচিশ মিনিট বাদে এলগিন রোড। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে লোকে। আকাশভর্তি করে সন্ধে নেমে আসছে। এলগিন রোডের মোড়ে এসেই থমকে দাঁড়াল ছেলেটি। যাহ! একটা বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে! বারাসতটা যে কলকাতায় নয়, সেই কথাটাই তো লোকটাকে বলা হয়নি!
কথাটা বলার জন্য কালনার ছেলেটি আবার ভিক্টোরিয়ার দিকে হাঁটতে লাগল।
সে জানে, লোকটিকে এখনও ওখানেই পাওয়া যাবে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কোনও তাড়া থাকে না।
চারটে পাঁচ।
এখান থেকে ভিক্টোরিয়া কতটা? বলতে পারেন?
হেঁটে গেলে তো মিনিট সাতেক লাগবে। এই তো সামনেই!
বাসে যাওয়া যাবে না, নাকি?
এখান থেকে তো ভিক্টোরিয়ার জন্য কোনও বাস যাবে না। তবে বাসের পাদানীতে দাঁড়িয়ে সামনের মোড়টায় নেমে যেতে পারেন।
ভাড়া কত হবে?
এক মিনিটেই নামিয়ে দেবে। তার জন্য আবার ভাড়া কী!
পিটিএসের সামনের রাস্তাটা দিয়ে বাসগুলো তখন বেঁকে চলে যাচ্ছে হুহু করে। ওখানকারই একটি ছাউনির তলায় বসে কথা হচ্ছিল দুটো মানুষের। একজনের পরনে গেঞ্জি আর জিনস। অপরজনের, ফতুয়া ও কালো রঙের টেরিকটের প্যান্ট। এই দ্বিতীয় লোকটিই প্রথম প্রশ্নটি করে। তার ঘন কালো চিমসে মুখে বেখাপ্পা সাইজের একটি সাদা গোঁফ। গালে সাদা সাদা গুঁড়ো চিনির দানা। মাথায় একটাও চুল নেই। লোকটা একবার নাকটা খুঁটে চট করে হাতটা টাকে মুছে নিল। হেস্টিংসের দিক থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ি ছুটতে ছুটতে আসছিল। সহিসটি বাচ্চা ছেলে। ঘোড়ার পিঠে কঞ্চির বাড়ি মারছে আর প্রায় পিত্তের মাঝখান থেকে টেনে আনছে চাপা শুকনো চিৎকার- হেই শালো! হেই শালো! রেন্ডির বাচ্চা! সিধা চল! সেদিকে মুখটা হাঁ-করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে টাকমাথা মানুষটি গেঞ্জি-জিনসকে বলল, আপনি কি ওদিকটায় যাবেন, দাদা?
কোথায়? পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে সেটাকে উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করতে করতে কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই আবার বলে বসল সে, ভিক্টোরিয়ার দিকে?
হ্যাঁ। আমি আসলে দাদা… উশখুশ করছে লোকটা…ঠিক সাহস করতে পারছি না রাস্তা পেরোতে। কেউ সঙ্গে থাকলে একটু বল পাই বুকে। বুঝলেন না! কথাটা বলে চট করে প্যান্টের বাঁ-পকেট থেকে একটা হলুদ রঙের ডিবে বার করে এক টিপ নস্যি নিয়ে ফেলল।
এখান থেকে এক্সাইডের দিকে যাচ্ছে এমন যে কোনও বাস ধরে চলে যান তাহলে। উঠতেও হবে না পুরোপুরি। পাদানীতে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই চলে আসবে। বললাম তো! ওই তো সামনের মোড়টায়। এখান থেকে মাথাটা একটু বাড়ালেই দেখা যাবে।
সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছি না ঠিক। এই জায়গায় আগে কখনও আসিনি তো। বুঝতে পারছি না।
নতুন নাকি?
কে? আমি? না! না! অনেক পুরনো। আপনাদের থেকে বছর চল্লিশের বেশি বয়স তো হবেই।
কলকাতায় নতুন? কথাটা বলতে বলতে দশ টাকার নোটটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে দিল ছেলেটি।
ও কি দাদা! টাকাটা এভাবে ছিঁড়ে ফেললেন! টাকা কেউ এভাবে ছিঁড়ে ফেলে?! সাক্ষাৎ লক্ষ্মী!
ও আর কাজে আসবে না কোনও!
তা কি হয়! টাকা যেখানেই রাখুন, যেভাবেই রাখুন, ঠিক কাজে আসে। ও জিনিস ফেলা যায় না কখনও।
আমি এর আগে আরও প্রায় হাজার দশেক টাকা এভাবে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। দু’হাজার, পাঁচশো, একশো- সব ছিঁড়ে দিয়েছি। ওগুলো দেখলে তাহলে কী বলতেন! এটা তো তাও মাত্র দশ টাকা। একটাই ছিল বোধহয় পকেটে। সেটাও ছিঁড়ে দিলাম। আমার কাছে আর কাজ চালানোর মতো নোট বোধহয় কিছুই রইল না। কিছু খুচরো আর একটা বাতিল পাঁচশোর নোট আছে। পাঁচশোর নোট তো আর চালানো যাবে না এখন। খুচরোগুলো ফেলে দিলেই তাই ল্যাঠা চুকোয়। আমি পুরো ফতুর।
জিনিসটা করছেন কেন ভাই? কিছু ঘটেছে আপনার সঙ্গে? লোকটা আবার আরেক টিপ নস্যি নিয়ে ফেলল।
আপনি বারবার এটা করছেন কেন?
আজ্ঞে?
এটা করছেন কেন?
কোনটা?
এই যে, এত ঘনঘন নস্যি নেওয়া?
ওহো! লোকটা পুরো মুখটা খুলেই হেসে ফেলল প্রায়। দাঁতগুলো দেখা গেল। কেউ যত্ন করে সেখানে ছাই মাখিয়ে রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে। মাঝের দাঁতটি নেই। হাসিটা তার বীভৎস। এই ব্যাপারটা তো একটা শখ। নেশা।
আমারও এটা একটা শখ। লোকটি কথা বলতে বলতে কাছে চলে এসেছে একদম। গা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে মাটির গন্ধ। ছেলেটি একটু সরে দাঁড়াল।
টাকা জমানো একটা ভালো শখ। কিন্তু টাকা ছিঁড়ে ফেলাটা আবার কীরকম শখ! লোকটি অবাক হয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে গিয়ে একটা লম্বা হাঁচি দিয়ে ফেলল। নাক থেকে কিছুটা শিকনি ফত করে বেরিয়ে এসে পড়ল হাতের চেটোটায়। ঝাঁঝালো মুখমণ্ডল আর ক্ষুদ্র চোখ নিয়ে তারপর সে কী সেয়ানা হাসি! খুব ঠাণ্ডা লেগেছে, বুঝলেন! কথাটা বলে শিকনিটা আবার সে তার টাকে মুছে নিল। শিকনির রঙটা কিছু সবুজ। শহরের বায়ু এত শুষ্ক! দম বন্ধ হয়ে যায়।
নতুন নাকি?
একটা কথাই ক’বার করে জিগ্যেস করবেন? ওরা যে ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, তার ঠিক পিছন দিয়ে একটি বৃদ্ধ ছাতিম গাছ তার শিকরবাকড় নিয়ে মাথাটা তুলে আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে। তার পিছনে রেসকোর্সের রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে এক মনে ঘাস খেয়ে যাচ্ছিল একটি খচ্চর। ওদের কথা শুনে থমকে গিয়ে খাওয়া থামিয়ে একবার এদিকে মুখ তুলে তাকাল। ওখান থেকে একটু দূরের মোড় দিয়ে পিজির দিকে চলে যাচ্ছে অনেক হলুদ ট্যাক্সি। মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ট্র্যাফিক পুলিশকে দেখে খচ্চরের মনে পড়ল, লোকটা একবার তার পিঠে চড়তে গিয়ে উলটে পড়ে গিয়েছিল। খচ্চরটির তখন ময়দানে পোস্টিং। সে আর বেশি না ভেবে আবার খাওয়াতে মন দিল।
আপনি যতবার প্রশ্নটা না বুঝে অন্য উত্তর দিয়ে যাবেন।
এবারেও তো বুঝলুম না!
আপনি কি কলকাতায় নতুন? এর আগে কখনও আসেননি? গলায় জোর ছিল। আরও দুজন নতুন আনকোরা লোক ততক্ষণে ওই ছাউনির তলায় চলে এসেছে। নীল রঙের ছাউনি। তারা মন দিয়ে যে যার নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কাজ করছিল। একটা চেঁচামেচির আভাস পেয়ে ওদের দিকে তাকাল। ঘড়িতে তখন চারটে বেজে সতেরো। তারা আবার নিজেদের জগতে ফিরে গেল।
ওহ! তাই বলুন! কলকাতায় আসব না কেন?! খুব এসেছি! বারাসত কোর্টে হাজিরা দিতে একসময় ফি-হপ্তা আসতাম। জমি নিয়ে মামলা। ওখানে তখন কম থেকেছি!
বারাসতটা কলকাতায় এ কথা আপনাকে কে বলল? জিনসের পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে আরেকটা নোট পেয়ে গেল এবার ছেলেটি। পঞ্চাশ টাকার। মাঝখান দিয়ে আধাআধি চিড়ে ফেলল সে ওটাকে। গাড়িগুলো তখন সিগন্যালে থেমেছে।
এভাবে ছিঁড়ে ফেলছেন ভাই একটার পর একটা! এগুলা কি সব জাল নোট?
না। কখনওই না। একটাও নকল নোট নেই।
তাহলে এভাবে টুকরো টুকরো করে ধ্বংস না করে দিয়ে বরং এইগুলা ভিখারিকে দিয়ে দিন। তাতে পাপ কম হবে। কলকাতায় তো অনেক ভিখারি।
আপনি যাবেন তো? চলুন। রাস্তা ফাঁকা আছে এখন। ছেলেটি হাতে চারটে পাঁচ টাকার কয়েন নিয়ে বলল। হিপ পকেট থেকে বার করেছে।
হ্যাঁ। একটুখানি তো? আপনি কয়েনগুলা নিয়ে কী করবেন? ফেলে দেবেন?
কয়েন নিয়ে পরে ভাবা যাবে। ছেড়ে দিচ্ছি আপনাকে। চিন্তা নেই। চলুন। আপনার বাড়ি কোথায়?
আমি থাকি নিচু কমলাপুর গ্রামে।
সেটা আবার কোথায়?
খড়িকামাথানী চেনেন?
না। কোথায়? যাহ! গাড়িগুলো আবার ছেড়ে দিল! দাঁড়ান সিগন্যালে আরও পাঁচ মিনিট। না থামলে ও পাশে যাওয়া যাবে না এখন।
সে তো বুঝতেই পারছি।
ওরা ডিভাইডারের পাশে এসে দাঁড়াল। ওদের পাশে ট্র্যাফিক পুলিশ। খচ্চরের পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ বলুন এবার। কোথায় জায়গাটা?
পশ্চিম মিদনাপুর চেনেন?
হ্যাঁ। চিনব না! ঘুরতেও গেছি অনেকবার। শালবনি, জামবনি… মাওবাদী আছে তো!
এখন আর সে সব নেই। ওগুলা পুরনো ব্যাপার। ওখানকারই জায়গা। নয়াগ্রাম চেনেন?
না।
আরে যেখানে কয়েকদিন আগে দু’কিলোমিটার সেতু হল! সুবর্ণরেখার ওপর দিয়ে। চেনেন না!
না।
তাহলে তো কিছুই চেনেন না। আমাদের গ্রাম নয়াগ্রাম থানাতেই।
কী অদ্ভুত নাম! নিচু কমলাপুর!
ওখানে বর্ষা এলেই জল জমে যাবে প্রত্যেক বছর। তাই ওই নাম। আরেকটা আছে উঁচু কমলাপুর। ওখানে অত জল জমে না। বন্যার সময় নিচু কমলাপুরের লোকেরা উঁচু কমলাপুরের প্রাইমারি ইস্কুলে এসে থাকে।
এবারে বন্যা হয়নি?
বন্যা এবারে হয়নি। তবে জল জমে ছিল অনেকদিন। এখন নেমে যাচ্ছে।
আপনি কলকাতায় এলেন কেন ওখান থেকে? কিছু দরকার?
আমি একটা খোঁজাখুঁজি করতে এসেছি।
কী খুঁজবেন? গাড়িগুলো থেমে গিয়েছে সব আবার। পিজি থেকে একটি মড়া বেরিয়ে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের দিকে চলে যাচ্ছিল। সিগন্যাল পড়ে যাওয়ায় একদম ওদের ঘাড়ের ওপরেই ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। অল্পবয়সী মহিলা। মাথায় সিঁদুর।
এ হে! একদম ফুলের মতো মুখখানা! দেখুন একবার। দেখেন…
আপনি তাড়াতাড়ি চলুন আগে। নইলে আবার গাড়ি ছেড়ে দিলে রাস্তা পেরোনো যাবে না। আগে এটা করে নিয়ে তারপর নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। সামনের ওই গেটটা দিয়েই ভিক্টোরিয়ায় উকতে হবে।
এত বড়ো একটা নিমগাছ আছে এখানে? ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি এসেই লোকটার চিমসে মুখটা থুতনিসহ ঝুলে পড়ল। কতদিনের পুরানো হবে এটা?
জানি না। আমি গাছপালার খোঁজ রাখি না তত।
এ নিশ্চয়ই বহু বছরের পুরানো জিনিস। আমরা খাল-বিল, মাঠের দেশের লোক। আমাদের ওদিকে কোনও আড়াল-আবডাল নেই। দশ-বিশ বিঘে জমি সূর্য়ের আলোতে ফকফক করে পড়ে থাকে। আমরা গাছ চিনি। দারুণ গাছ। নালসের ডিম আছে ভর্তি। তবে, এখনও পিঁপড়ে হয়নি।
আপনি এইসব কথায় সময় নষ্ট না করে কাজের কথাটা বলুন, দাদা। কী খুঁজতে এসেছেন এখানে? সেটা বলুন। তাহলে আমি কিছু সাহায্য করতে পারি।
আমার নাতনীটা অনেকদিন হল হারিয়ে গেছে। সতেরো বছর বয়স। ক্লাস নাইনে পড়ে। ভালো নাম- বকুল জানা। আমাদের ওদিকে ভসরা বলে একটা জায়গা আছে। ওখানকার একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করত। ছেলেটা বয়সে অনেকটা বড়ো। সাইকেলের দোকানে কাজ করে। ভালো ছেলে না। কেশিয়াড়ি থানার পুলিশ একবার ধরেছিল ওকে কী একটা কেসে। একটাই নাতনি আমার। বারণ করতাম। শুনত না। খড়গপুর স্টেশন থেকে হারিয়ে গেছে আজ হয়ে গেল দু’মাস।
সে কী! পুলিশে খবর দিয়েছিলেন?
দিয়েছিলাম। বলল, দেখছি। তারপর আর কোনও খবরটা নেই। আচ্ছা, এখানেই কি ওনারা বসেন?
কারা?
যারা ভালোবাসাবাসি করতে আসেন?
হ্যাঁ। কিন্তু তা দিয়ে আপনার হবেটা কী?
আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোটো। একটা কথা বলি। মনে নেবেন না। আপনি বড়ো প্রশ্ন করেন। এক কথা বারবার বলেন। এটা একটা দোষ। আপনি যে তখন থেকে টাকাগুলো ছিঁড়ে ফালফাল করে দিচ্ছিলেন, আমি কি আপনাকে তা নিয়ে বেশি প্রশ্ন করে ত্যক্ত করেছি? বলুন? বলেন… কথাটা বলতে গিয়ে লোকটির গলার পেশি ফুলে গেল। ছেলেটি লক্ষ করল, গলার শুকনো কালো চামড়ায় এক ধরনের সাদা রঙের বিজগুড়ি বেরিয়েছে অনেকগুলো। পেশি ফুলে ওঠায় স্পষ্ট হয়েছে তা। আমরা মা সাঁতাইবুড়ির ভক্ত। তাঁর চরণে মানত রেখে এসেছি। নাতনী ফিরলে সোনার মুকুট গড়ে দেব জমি বেচে দিয়ে। তিনিই স্বপ্নে এসে দেখা দিয়ে গেছেন আমার।
মা সাঁতাইবুড়ি কি আপনাদের ওখানকার দেবতা?
তিনি তো সবখানেই আছেন। সুবর্ণরেখার পাড়েই তাঁর মন্দির। জঙ্গলের আগে আগে।
স্বপ্নে এসে কী বলেছেন তিনি আপনাকে?
আপনি আমায় যেখানে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখান থেকে কি ওনাদের মুখোমুখি দেখা যাবে?
ভালোবাসছে যারা, তাদের? হ্যাঁ।
আপনি এটা করবেন না আমার সঙ্গে। এতটা করলেন যখন, আরেকটু করুন। এমন জায়গায় নিয়ে যান, যেখান থেকে ওনাদের দেখা যাবে, কিন্তু মুখোমুখি হয়ে যাব না।
কেন? মুখোমুখি হলে কী হবে?
আমার সোনার মা’র ফিট আছে। ওর বিয়ের জন্য পাঁচ বিঘা আলাদা করে রাখা আছে। তাতে এখন হাঁটু অবধি বর্ষার জল। ও এলেই শুকিয়ে যাবে। তখন পুরো জমি চাষ করে দিয়ে বেচে দেব। ধান বেচার টাকা আর জমি বেচার টাকা দিয়ে ওই ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দেব ওর। কিন্তু আমাকে সামনসামনি দেখে অবাক হয়ে গিয়ে ফিট হয়ে গেলে এই বিদেশ-বিভুইয়ে আমি ওকে নিয়ে কী করব তখন তা বলতে পারেন?
সোনার মা… আচ্ছা… আপনার নাতনী।
হ্যাঁ। ওর ঠাকুমার দেওয়া নাম। সে তো আর নেই।
কথা বলতে বলতে তারা দুজন ফুটপাথ ধরে ভিক্টোরিয়ার পাঁচিলের কাছে এসে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল। সাড়ে চারটে বাজে। সূর্য কিছুটা আলো ছেঁকে নিয়ে নিচের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে বাকিটা পৃথিবী থেকে তুলে নিচ্ছে স্যাটস্যাট করে। ঘোড়ার গাড়ি, বাস, ট্যাক্সিবোঝাই করে বহু মানুষ ওই সময় জায়গাটা পেরিয়ে যাচ্ছিল। তাদের কারও হাতে হরলিক্স-কমপ্ল্যান। বাড়ির লোকের জন্য পর্যাপ্ত ভিটামিন। কারও হাতে অন্যের বউয়ের হাত। ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউই ওদের খেয়াল করছিল না।
আপনি আসতে এত দেরি করলেন কেন? এই পার্ক তো আরেকটু বাদেই বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলেটি বলে।
আমি সকাল থেকে অন্য জায়গায় ঘুরছিলাম। বাবুঘাটের ওখানে। পিন্সেপ ঘাট আর মিলানিয়াম পার্ক আছে না? ওখানে। লোকটা একটু উবু হয়ে গেল পাঁচিলের কাছে। চোখটা তীক্ষ্ণ হল তার। দৃষ্টিটা ঝোপঝাড় ভেদ করে একদম বিষ মাখানো তীর হয়ে ভিক্টোরিয়ার বিভিন্ন বেদী, ঘাস, গাছের পিছনে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ওখানে তখন অজানা অচেনা শরীরগুলো একে অপরের মধ্যে মিশে যাচ্ছিল ক্রমে।
ওখানে কী করছিলেন? বলতে বলতে ছেলেটিও একটু উবু হল।
সেখানেও তো তেনারা বসে থাকেন। ওখানে গিয়েছিলাম তাই। আপনার মতো কেউ ছিল না ওখানে। তাই খুঁজতে বেগ পেতে হল। তবে দৃশ্যটি বড়ো বাজে। নির্লজ্জ। ওই অবস্থায় সোনার মা’র মুখোমুখি পড়লে আমি লজ্জায় মরে যেতাম একদম। নিজের হাতে খাইয়ে-দাইয়ে বড়ো করেছি। ও দৃশ্যের সামনে কি আমি সহজ হতে পারতাম? অথচ, মা বলেছিল, কলকাতায় যে সব ভালোবাসাবাসির স্থান আছে, সেখানে খোঁজ। নাতনীকে পেয়ে যাবি। লোকটির গলা ধরে আসে। কিছুই নেই এখানে। অন্যদিকটা যাবেন?
চলুন। দেখা যাক। পাঁচ টাকার কয়েনগুলো ছেলেটি আর ফেলে দেয়নি। এখনও হাতে রয়েছে। চারটে করে মোট কুড়ি টাকা।
ভিক্টোরিয়া বন্ধ হতে আর মিনিট দশেক দেরি। ওরা অন্য আরেকটা দিকে আসে। কোনও কারণ ছাড়াই দুজনেরই একটু শীত-শীত করে। ঝোপের আড়ালে বসে, চিৎ হয়ে, উবু হয়ে, দাঁড়িয়ে বিভিন্ন মূর্তি।
লোকটি এখানেও একইভাবে খুঁজছিল। ছেলেটি একবার পিছন ঘুরে তাকাল। দুটো লোক মারামারি করছে। কেন কে জানে! এ দৃশ্য দেখে তার চোখ অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে এখন। সে কালনার ছেলে। বাপের এক ছেলে। সম্পত্তির পুরোটাই পেয়েছিল। বাপ-ছেলের সংসার থেকে একটি সকালবেলা ছিটকে বেরিয়ে সেই বাবা আর ফিরে এলো না। শুনেছিল কলকাতায় চলে এসেছে। পাঁচমাথার মোড়ের দিকে দেখা গিয়েছিল হারিয়ে যাওয়ার আট দিন বাদে। গত এক বছর ধরে কলকাতার সব জায়গাতেই সে খুঁজে চলেছে তার বাবাকে। এই খুঁজতে খুঁজতেই সে দেখে ফেলেছে চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেনের মাঝখানে পা গলে গিয়ে মানুষের ছটফট করতে থাকা। রাস্তা পেরোতে গিয়ে বাসের তলায় চাপা পড়ে যাওয়া। পথ চলতে চলতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ফুটপাথেই ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যু। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই খবরের কাগজ তাকে বর্ণনা করেছে ‘প্রত্যেক্ষদর্শী’ হিসাবে। নিজের বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে সে এখন এক নিস্পৃহ পেশাদার প্রত্যক্ষদর্শী। এছাড়া তার আর কোনও পরিচয় নেই। কেবল দেখে যাওয়া ছাড়া, দেখার ভিতর দিয়ে কিছু একটা খুঁজে নেওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। যা টাকাপয়সা আছে, তার সব কিছু ছিঁড়ে ফেলে দিয়েই সে কোনও মেট্রোর লাইনে মাথা দেওয়ার জন্য চলে যেতে চাইছিল। তখনই দেখা হল লোকটির সঙ্গে। সে জানে, নিজের নাতনীকে খুঁজতে খুঁজতে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই বুড়ো মানুষটিও এক সময় তার মতো প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে গিয়ে কোনওদিন হারিয়ে যাবে। যা হারায়, তাকে তো আর পাওয়া যায় না। সে চলে যায় চিরকালের মতো। তাকে খুঁজতে এসে আরেকটি নতুন মানুষই মুছে যায় কেবল। পুলিশের খাতায় তখন তার নামের পাশে শরীরের বিবরণে লেখা থাকে- মাঝারি গড়ন। গালে কাটা দাগ…
খিদে লেগেছে খুব। ডিম ভাজা খেতে ইচ্ছে করছে একটু। খাবেন? লোকটি মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করল। খুঁজতে খুঁজতে পাঁচিলের ফাঁকগুলোর মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়েছিল।
আচ্ছা। এক কাজ করুন। আমার কাছে এই যে কয়েনগুলো আছে, এগুলো দিয়ে কিনে আনুন। ওই সামনের মোড়ের মাথায় পাওয়া যাবে।
আপনার থেকে পয়সা নেব কেন? আপনি এত উপকার করলেন আমার! কয়েনগুলা বরং নিজের কাছে রাখুন।
নিন না আপনি। ওই সামনের মোড়ে গিয়ে কিনে আনুন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। কুড়ি টাকারই আনবেন।
আচ্ছা। আমি আনছি। আপনি একটু দেখবেন তো, খুঁজে পান কি না। ফরসা রং। অনেকটা চুল। খুব রোগা। গায়ে বেগুনি জামা।
লোকটি চলে যেতেই ছেলেটি একলাফে ওখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো। দু’মিনিটের মধ্যে পিজির ক্রসিং। আরও পঁচিশ মিনিট বাদে এলগিন রোড। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে লোকে। আকাশভর্তি করে সন্ধে নেমে আসছে। এলগিন রোডের মোড়ে এসেই থমকে দাঁড়াল ছেলেটি। যাহ! একটা বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে! বারাসতটা যে কলকাতায় নয়, সেই কথাটাই তো লোকটাকে বলা হয়নি!
কথাটা বলার জন্য কালনার ছেলেটি আবার ভিক্টোরিয়ার দিকে হাঁটতে লাগল।
সে জানে, লোকটিকে এখনও ওখানেই পাওয়া যাবে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কোনও তাড়া থাকে না।
0 মন্তব্যসমূহ