আনিফ রুবেদ
১
যখন তরিকুল মোয়াজ্জিন আজান দিচ্ছিল তখন ক্ষেত থেকে ফিরছিল ফানেস বিচ্ছু। সন্ধ্যা তখনও ঠিকমত লাগতে শুরু করেননি কারণ সূর্যটা ডুবেছিলেন ঠিকই কিন্তু লাল আভারা তখনও পশ্চিমদিক বেশ উজ্জ্বল করে ছিলেন। আলোর ঘন ফেনাদের গায়ে আজানের ফেনা মিশ্রিত হয়ে ধীরে ধীরে লাল আভারা অন্ধকারে রূপ নিচ্ছিলেন।
যেসব কাকেরা বাড়ি দূরে করেছিলেন তারা ফিরছিলেন বাড়ির দিকে। তাদের পাখারা তখন বলছিলেন--‘কাকগুলো যেহেতু কালো সেহেতু তারাও কালো।’ মাঠের এ মাথাতে যে গাছটি স্থির ছিলেন তাতে একটা পাখির বাসা অবস্থান করছিলেন। সেখানে এসে পৌঁছলে তরিকুল মোয়াজ্জিনের গাওয়া আজান শেষ হন এবং ফানেস বিচ্ছু পিছন ফিরে দেখে তার ক্ষেতের দিকে। সেখানে সে একটা কাকতাড়–য়া তৈরি করে রেখে এসেছে। তার হাতে এখনো হাঁড়ির কালি লেগে আছেন। ফানেস বিচ্ছু দু-তিন’টি পুরাতন শার্ট নিয়ে গিয়েছিল। সবকটি শার্টই পরিয়ে দেখেছে কাকতাড়–য়াটিকে এবং যেটিকে বেশি মানানসই মনে হয়েছে সেটি কাকতাড়–য়াটির গায়ে চড়িয়ে এসেছে। এখন পিছন ফিরে দূরে কাকতাড়–য়াটিকে দেখতে পেল সে। দারুণ! এটি শুধু কাক তাড়াবেন এমন নয়, এটি গরু ছাগল, অন্যান্য পাখি এমনকি রাতের বেলা মানুষকেও তাড়াতে সক্ষম বলে মনে হলো ফানেস বিচ্ছুর। কাকতাড়–য়াটির আদল এতটাই মানুষের মত যে, এ অ লে যদি বাঘ-সিংহের বাস থাকত তবে বাঘ-সিংহগুলো প্রায়ই ভুল করে কাকতাড়–য়াটির ওপর চড়াও হতেন মানুষের রক্ত পান করার বাসনায়। কাকতাড়–য়াটিকে দেখে নারীদের মধ্যে কামভাব জাগ্রত হওয়া সম্ভব বলেও তার মনে হলো। একটি সুন্দর কাকতাড়–য়া তৈরি করতে পেরে তার ভাল লাগছে। বড় রাস্তা পার হবার আগে ফানেস বিচ্ছু আবার ঘুরে দেখল তার ক্ষেতের দিকে এবং দেখল চমৎকার দায়িত্ব নিয়েই কাকতাড়–য়াটি দাঁড়িয়ে আছেন।
২
পঁচিশটি বছর যখন একে একে পার হয়ে গেছেন তখন তমিজ খন্দকার ভাবল--গ্রামে ক’টা দিন থেকে আসি। পঁচিশ বছর আগে ঢাকাতে আসার পর তেমনভাবে আর নিজ গ্রামে যাওয়া হয়নি। বড় জোর দিনে গেছে, কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে কাজ সেরে আবার ফিরে এসেছে। ঢাকা গিয়ে প্রায় ঢাকাতে বসে থেকেই নির্বাচন করেছে। একবার পাশ করেছে একবার ফেল করেছে। এমপি মন্ত্রি হয়েছে। দুপুরে খেতে খেতে তার মুখ দিয়ে বের হয়ে এলেন কথাটি--‘এবার কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে আসব।’ কথাটি যখন তার মুখ দিয়ে বের হয়ে এলেন তখন তার বউয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেলেন। সে মন খারাপ করে বসে থাকল। অপরপক্ষে তার মেয়ে ফরিদা খন্দকার খুশি হয়ে উঠল। তার বয়স তেইশ চব্বিশ। যেহেতু তমিজ খন্দকার একথা বলেছে সেহেতু মতটি স্থিরও হয়ে গেছেন। তমিজ খন্দকার গত সরকারের কৃষিমন্ত্রি ছিল। এবার সে আর কোনো মন্ত্রি নয় এমনকি এমপিও না।
৩
মন্ত্রির বাড়িটি ঠিক একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, যেমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন পঁচিশ বছর আগে। রিক্সা এসে থামলেন মূল বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। রিক্সা থেকে যখন মন্ত্রির ডান পা’টি নামলেন তখন বাম পা’টিও তার অর্ধ সেকেন্ডের মধ্যে নেমে আসলেন। বাম পা’টি নেমেই চড়ে বসলেন একটা ব্যাঙের বাচ্চার ওপর। ব্যাঙের বাচ্চাটি তখন নিমিষেই, নিশ্চুপেই একটি ক্ষুদ্র মাংস ¯তূপের মত হলেন। মন্ত্রি এসব খেয়াল করল না কিন্তু ফরিদা খন্দকার, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিজ্ঞানে সম্মান নিচ্ছে, সে ব্যাপারটি খেয়াল করল এবং তার মুখ দিয়ে অস্ফুট ‘আহ্’ শব্দ বের হলেন। তার গোমড়া মুখ করা মা’ও ব্যাপারটি খেয়াল করেছিল এবং ফরিদার এই অস্ফুট ধ্বনিটিকে অহেতুক মনে করল। ফরিদার জন্য তার মায়ের চোখ থেকে একটি বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টি বের হয়ে আসলেন। ফরিদা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা জাতীয় কিছু খেল। যে কয়েকটি ব্যাগেজ লাগেজ ছিলেন তা নিতে এসেছে এরফান আলি আর তার কিশোর বোবা ছেলে তারু। তারা ব্যাগগুলো নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগল। বোঝাবাহীদের পা’গুলো তাদেরকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছিলেন। অপরপক্ষে মন্ত্রিপরিবারের পা’গুলো দেখাচ্ছিলেন বেশ ধীর গতি। সন্ধ্যা যখন লেগে এলেন তখনই মন্ত্রি খেয়াল করল, গ্রামের পরিবর্তন খুব একটা হয়নি (ক্ষমতায় থাকার সময় ব্যাপারটি খেয়াল হয়নি তার, কারণ সেসময় নিজ জেলায় এসেছে, কাজ সেরে জেলা সদর থেকেই ফিরে গেছে। জন্মগ্রামে আসার সময় হয়নি)। কাঁচা রাস্তাটি কাঁচাই রয়েছেন, বিদ্যুৎ এখনো গ্রামে আসেননি। তারা বাড়িতে ঢুকল। এরফান আলি ঘরদোর আগে থেকে ঠিকঠাক করে রেখেছিল। তমিজ খন্দকার বলল--‘বুঝলে এরফান কয়েকদিন থাকব মনে করেই এসেছি।’ এরফানের মাথাটি সোজা থেকে ডান কাঁধের দিকে ঝুঁকে এলেন এবং মুখ দিয়ে উচ্চারণ করল--‘জ্বী স্যার, আপনার যদ্দিন ইচ্ছ্যা থাকেন অসুবিত্যা নাই।’
মন্ত্রি যতদিন থাকবে, এরফান আর তার বোবা ছেলে তারু তাদের দেখাশোনা করবে। রান্নাবান্নার কাজ করার জন্য আছে এরফানের বউ। বউটিকে নীল রংয়ের একটি শাড়ি জড়িয়ে রয়েছেন। বউ নিয়ে, বোবা ছেলে তারুকে নিয়ে এরফান বেশ ভালই থাকে মন্ত্রির এই বড় বাড়িতে। মন্ত্রির বাড়িঘরসহ জমিজমাও দেখাশোনা করে। একটিই সন্তান। আরো সন্তানের চেষ্টা করেও যখন হয়নি তখন লোকজন বলতে থাকে--‘এরফানের লাড়িতে প্যাঁচ পইড়্যা গেছে নাইহ্লে অর বহুর লাড়িতে।’ চিকিৎসা করে ব্যর্থ হবার পর কবিরাজও লোকজনের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল--‘এরফানের ছাইল্যা জর্মানোর ক্ষ্যামতা শ্যাষ হয়্যা গেছে। অর বউ এর কুনু সমস্যা নাই বলেই মনে হয়।’ লুকু কবিরাজ খুব ভাল কবিরাজ। তার কথা ঠিক বলেই মানুষে মানে।
৪
তিনদিন বলেও যখন আটটা দিন পার হয়ে গেলেন তখন ফরিদার মা খেয়াল করে দেখল, পিতা-কন্যা কেউই এখন পর্যন্ত ঢাকায় ফিরে যাবার কথা বলছে না। তখন নিজে থেকেই সে তাদেরকে ঢাকা ফিরে যাবার তাড়া দিল। এবং পরবর্তীতে আরো তিনদিন অব্যাহতভাবে তাড়া দেবার ফলে, মন্ত্রি ‘আগামীকাল ঢাকা ফিরে যাব’ বলে সিদ্ধান্ত জানায়। আগামীকালের আগের দিন সন্ধ্যাতে মন্ত্রি হাঁটতে হাঁটতে ফসলের মাঠ পার হয়ে একেবারে নদীর ধারে গিয়ে বসল কিছুক্ষণের জন্য। নদী বয়ে যাচ্ছেন বড়ই রুগ্ন হয়ে। মনটা খারাপ হলেন মন্ত্রির। বিশাল বিশাল চর বালুর বুক নিয়ে পড়ে আছেন। ওপারে একটা নৌকা বালিতে বসে আছেন আর বর্ষাকালের প্রতীক্ষা করছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলেন। ফিরতি পথ ধরল মন্ত্রি কিছুক্ষণ পর। জোছনার আলোয় ভাসছেন সবকিছু। ঘড়িটার দিকে তাকাল মন্ত্রি। রেডিয়ামগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছেন। আটটা মাত্র বাজছেন। এর মধ্যেই চারদিক নিস্তব্ধ। ফিরতি পথে হঠাৎ সে গান শুনতে পেল যেন। গানটি অস্পষ্ট, কণ্ঠটি অস্পষ্ট কিন্তু বোঝা গেল এটি রবীন্দ্রসংগীতের সুর। তার মনে হলো--‘এ গাঁয়ের মানুষের পক্ষে রবীন্দ্রসংগীত সম্ভব না, ভূতই একমাত্র পারে এটি করতে।’ সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল, কাউকে দেখা যায় কিনা। সে একটি ক্ষেতের ভেতর একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল এবং ততক্ষণে এটি নড়াচড়া করতে শুরু করেছেন। তার মনে পড়ল এটি তো সেই কাকতাড়–য়াটি। ‘গান কি তবে এই কাকতাড়–য়ার?’ ভাবল। কিছুক্ষণের মধ্যে কাকতাড়–য়াটি পা-হাতসহ পুরো শরীর নিয়ে নড়াচড়াও শুরু করলেন। বেশ উত্তেজিতভাবে নড়ছেন কাকতাড়ুয়া। এবার মন্ত্রি একটি শীৎহাসি শুনতে পেল আর গোঁ গোঁ শব্দ শুনতে পেল। মেয়েলি কণ্ঠের হাসি আর পুরুষালি কণ্ঠের গোঁ গোঁ শব্দ, ক্ষেত নড়ার খসখস শব্দ আর কাকতাড়–য়ার নাচন তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেন। সে ভয় পায়। ভয় জড়িত কণ্ঠে বলে-- ‘কেএএএএ?’ এই ‘কে’ শব্দটি লম্বা হয়ে বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি ব্যাপার একসাথে ঘটেন --
১. কাকতাড়–য়ার নড়াচড়া, হাসি, শব্দ সব বন্ধ হয়ে যান।
২. মন্ত্রি মূর্ছা যায়।
৩. মৃত্যু মন্ত্রিকে দখল করে নেন।
৪. মন্ত্রির মৃতদেহ পড়ে রইলেন।
৫
গ্রামেই কবর দিয়ে ফরিদা এবং তার মা ফিরে যায় ঢাকায়। ঢাকা থেকে কয়েকজন নেতা এসেছিল দাফনে অংশ নিতে। ঢাকায় ফিরে যাবার পর কয়েকটি মাস যখন চলে গেলেন তখন প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্রী ফরিদা একদিন বেশ কয়েকবার বমি করে। তার মা তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে সে তার গর্ভের কথা বলে। ফরিদার মা অবাক হয়ে যায় এই সরল স্বীকারে এবং অবাক হবার পর দ্বিতীয় প্রশ্নটি করে--‘সন্তানটি কার?’ ফরিদা হেসে বলে--‘কাকতাড়–য়ার।’ ফরিদার মা বিস্মিত হয়ে ফরিদার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে বিস্ময় কাটিয়ে আবার প্রশ্ন করে--‘ঠিক করে বল সন্তানটি কার?’ ফরিদা নিশ্চুপ থাকে। তার মুখ চোখ বেশ শান্ত। তার এই ভাব দেখে ফরিদার মা ভীষণ রেগে যায় এবং বলে--‘হেঁয়ালি রেখে ঠিক করে বল।’ ফরিদা বলে--‘ঐ বোবা ছেলেটির, তার নাম এখন ভুলে গেছি, যার মা আমাদের রান্না করে খাওয়াতো--গ্রামের বাড়িতে।’ ফরিদার মা অবাক হয়ে বলে--‘গ্রাম্যদিনগুলোতে তুই এই কাজই করেছিস বোবা ছেলেটির সাথে?’ ফরিদা বলল--‘না মা ঐ এক দিনই করেছি। যেদিন আসি তার আগের দিন সন্ধ্যার পর, বোবা ছেলেটা আর আমি মাঠের দিকে ঘুরতে যাই। কীভাবে যে কী হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমি বোবা কিশোরের সাথে ধর্ষকির মত আচরণ শুরু করি। সে প্রস্তুত ছিল না। সে রাজি ছিল না। আমি ধর্ষকির মত আচরণ করতে থাকলে সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে আমার দিকে তাকায়। তাকে আমি প্রস্তুত করে তুলি। তাকে আমি রাজি করে তুলি। আমি সঙ্গমসুখি হয়ে উঠি সে ক্ষেতে, যে ক্ষেতে একটি কাকতাড়–য়া আছে, একেবারে কাকতাড়–য়াটির পা ঘেঁষে। আমাদের উত্তেজনার প্রতিটি ঘাতের আঘাতে কাকতাড়–য়াটি নড়াচড়া করছিল। সম্ভবত, কাকতাড়–য়ার নড়াচড়া দেখেই বাবা ভয় পেয়ে হার্টফেল করেছিলেন। বাবাকে অন্যকোনো মানুষ ভেবে আমরা অন্যদিক দিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম।’
আরো কয়েক মাস পার হলে ফরিদা বুঝতে পারে সে সম্ভবত আজকে জন্ম দেবে। ঠিক ঠিক সেদিনই সন্ধ্যার সময়। স্ট্রিটলাইটগুলো যখন জ্বলে উঠলেন আর বাসার ভেতর লোডশেডিং এলেন তখন ফরিদা ব্যথায় কোঁকাতে লাগল। এ বাড়িতে একটি সন্তান আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। একজন প্রশিক্ষিত দাই ডাকা হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে ফরিদার স্বামী বিদেশে থাকে। ফরিদার মা মুখ গোমড়া করে বসে আছে কারণ এ সন্তানটি পৃথিবীতে আসুক তা চায়নি সে, প্রচুর বকাঝকা করে বা গা হাত নেড়ে বুঝিয়েও ফরিদাকে এবরেশনের জন্য রাজি করাতে পারেনি। প্রশিক্ষিত দাইয়ের হাতে শিশুটি কেঁদে উঠল কোঁহা... কোঁহা...
৬
এরফান বলল--‘কে হামাকে কহে হামার লাড়িতে প্যাঁচ প’ড়্যা গেছে, ছাইল্যা-পিল্যা হইবে না! যারা এসব কহ তারা আ’স্যা দেখ্যা যাও।’ তার বউয়ের জন্মানোর যন্ত্রণা উঠেছেন। দাই এসেছে। মন খারাপ করে আঙ্গিনায় বসে আছে তারু। কিছুক্ষণ পর দাই এরফানকে এসে বলল--‘তোমার ব্যাটা হয়্যাছে।’ তারুর মা মনে মনে মনে করল, যেদিন মন্ত্রি মারা গেছিল সেদিনের কথা, সেদিনের স্মৃতি। রান্নাঘরে সন্ধ্যার সময় রান্না করছিল আর মন্ত্রি রান্নাঘরে এসে কথাবার্তা বলতে বলতে একসময় জড়িয়ে ধরে আর তারুর মা চিৎকার করতে গিয়েও করে না ‘এত মানি মানুষ, মানহানি হবে’ এই ভেবে। এবং ‘যাই হোক সেই তো একরকম খাবার জোগাড় দেয় তাদের’ সুতরাং চিৎকারটি বা প্রতিরোধটি আর বের হয়ে আসতে পারেননি। সুখ নেওয়া শেষ হলে মন্ত্রি উঠে দাঁড়ায় আর আয়নার সামনে চুল আঁচড়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় মাঠের দিকে। ক্ষণেক আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে, বউটা এসব কথা মনে মনে নাড়াচাড়া করে। কিছুক্ষণ পর এরফান ঘরে ঢুকে ছেলেকে দেখতে। এরফানকে দেখে এরফানের বউ বলে--‘হামার ব্যাটা মুন্তিরি হইবে দেখ্যা লিও।’ শিশুটি কেঁদে উঠল--কোঁহা... কোঁহা...
৭
ফানেস বিচ্ছু নতুন একটা কাকতাড়ুয়া তৈরি করছে। সে এবার দু’টা শার্ট এনেছে কাকতাড়–য়ার জন্য। মন্ত্রি তার পুরাতন একটা শার্ট ফানেসকে দিয়েছিল গায়ে দেবার জন্য সেটি এবং যেদিন মন্ত্রি মারা যায় তার পরেরদিন সকাল বেলা কাকতাড়–য়াটির পায়ের কাছে একটি শার্ট পড়েছিলেন সেটি। কাকতাড়–য়ার পায়ের কাছে পড়ে থাকা শার্টটিকে কুড়িয়ে নিয়ে আসার সময় এরফানের সাথে দেখা হয়েছিল ফানেস বিচ্ছুর। এরফান বলেছিল--‘আরে, এট্যা যে হামার ব্যাটা তারুর শার্ট, দিয়্যা দ্যাও হামাকে।’ ফানেস বিচ্ছু একথা শোনার পর এরফানকে শুধু বলেছিল--‘এখন এট্যা কাকতাড়–য়ার শার্ট, তোমাকে দিব না।’
কাকতাড়ুয়া তৈরি হয়ে গেছেন। এখন শার্ট দুটি সামনে নিয়ে দেখছে আর ভাবছে ফানেস বিচ্ছু--কোন্ শার্টটিতে কাকতাড়–য়াটিকে বেশি মানাবে। এবার কাকতাড়–য়াটিকে খুবই ভাল হওয়া চায়। গতবারেরটি তেমন ভাল হননি। কারণ মন্ত্রিকে মাটি দিয়ে ফিরে আসার সময় সে তার ক্ষেতের দিকে তাকালে কাকতাড়–য়াটিকে দেখতে পেয়েছিল, যার ঘাড়ের ওপর একটি কাক বসেছিলেন। শেষে ফানেস বিচ্ছু সিদ্ধান্ত নেয় দুটি শার্টই সে ব্যবহার করবে একদিন একদিন করে। আজ মন্ত্রির শার্টটি তো কাল তারুরটি। কাল তারুর শার্টটি তো পরের কাল মন্ত্রির শার্টটি। সে একটি শার্ট পরিয়ে দিল কাকতাড়–য়াটিকে এবং ফিরে আসতে লাগল। ফিরে আসার সময় সে বড় রাস্তাটি পার হবার আগে ক্ষেতের দিকে তাকায় এবং কাকতাড়–য়াটিকে দেখতে পায়। চমৎকারভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কাকতাড়–য়া। বেশ বীরভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কাকতাড়ুয়া। ফানেস বিচ্ছু এই মুহূর্তে মনে করতে পারছে না, কাকতাড়–য়ার গায়ের শার্টটি মন্ত্রির না তারুর। তার হাতের শার্টটি মন্ত্রির না তারুর। সে বড় রাস্তা পার হয়। তরিকুল মোয়াজ্জিনের আজান শেষ হয়েছেন মাত্র। পিছনে--দূরে--ক্ষেতে--একটি কাকতাড়–য়া দাঁড়িয়ে আছেন। সে মনে করার চেষ্টা করতেই থাকল--কোন শার্টটা তারুর আর কোন শার্টটা মন্ত্রির...
2 মন্তব্যসমূহ
অদ্ভূত!!! ভয়ঙ্কর সুন্দর বুঝি একেই বলে!!! গল্পটি আজীবন লেখকের কথা মনে করিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
উত্তরমুছুনদারুণ গল্প, ঘোরলাগা গদ্য।
উত্তরমুছুন