সুমী সিকানদার'এর গল্প : অন্যদৃশ্য

বাড়িটা ঠিক কোন আমলে তৈরী তা জানা নেই । তবে বেশ পুরাতন সেটা কারুকার্য দেখেই বোঝা যায়। সারা বাড়ির সাদা রং করা সিলিং অনেক উঁচু উঁচু । ঘাড় কাৎ করে দেখা লাগে। আর তাতে নিখুঁত নকশা কাটা । কি যে সুন্দর যমজ নকশারা পরপর বসানো দেখলে জমিদার আমলের অন্দর বলে ঠাহর হয়।

সারা মেঝেতে লাল মার্বেলের উপুড় করা লাল রঙ ঢেলে দেয়া। । মুছলে পরে চকচক মেঝেতে চেহারা দেখা যায়। বসার ঘরটা আবার অন্যরকম। ছাদের দিকে পদ্মফুলের আধাফোঁটা মুখ পরপর বসে গেছে সমান ভাগ বাটোয়ারায়। চোখ গেলে কেমন ঘোর লাগে কথা থেমে যাবার পায়তারায়। মুহূর্তে হারিয়ে যেতে হয় জাগতিক থেকে অলৌকিকে। সুহা মুগ্ধ তাকিয়ে থাকে সুযোগ পেলেই । কি যেন ভাবন জোটে এলোমেলো। সাত বছরের কিশোরীর দু’কান জুড়ে নূপুরের ঝুমঝুম শব্দের মিশেল বাজতে থাকে, থেকে থেকে।

‘’রুমা ঝুমা রুমা ঝুম। কে এলো নূপুর পায়। ‘’

সে নাচতে জানে না ,অথচ নাচে না এমন কোন সময় অবশিষ্ট নেই । খেয়ালে বেখেয়ালে স্কুল থেকে ফিরে, আলসি দুপুরে কিম্বা অসময়ে ঘুম ভেঙ্গে আনমনে সে নেচে বেড়ায় নূপুর ছাড়াই। সব চেয়ে মজা লাগে গোল হয়ে ঘুরতে। অনরবত ঘুরতে থাকে ফ্রকের কুচির ওপর ভরসা করে।কুচি যত ফুলে থাকে তত গোল হয় বাতাস পেয়ে । এই কিশোরীর আনন্দ তখন বাড়তেই থাকে বাড়তেই থাকে। ঘুরে ঘুরে সমস্ত ঘরটাকে মঞ্চ করে নেচে নেচে কাজে লাগায় , যেন তাতে মালিকানা বাড়ে। যতক্ষণ যতোটা জুড়ে সে নাচতে পারব ততোটা অংশই তার নামে লেখা হয়ে যাবে।

এই বসার ঘরটিতে পাঁচ সিটের দুইটি সোফা রাখা । পাশে আলাদা দুটো সিঙ্গেল চেয়ার। অনেকগুলো কাঁসার তৈজস , আর মেঝেতে সাদা মার্বেলের পোশাক । ঠিক মাঝখানটায় লাল আর কালো বর্ডার দিয়ে বৃত্ত এবং আলপনা করা । নাচ এখান থেকেই শুরু হয় সুহার। এখানে আসলেই সে পড়া ভুলে নাচতে শুরু করে। ‘

সবচেয়ে অবাক লাগে দোতালার সিড়ির সামনের জায়গাটাতে এলে পরে। যত দুরন্তপনা যেন এক মুহূর্তে থেমে যায়। দোতালা ওঠার মুখেই এখানে একটা নামাজ ঘর আছে আলাদা। মিনারের নকশা করা । ছোট থাকতে খুব ভাল না বুঝলেও এই জায়গাটা যে বিশেষ আলাদা অনুভবের জায়গা সেটা বোঝে। আগরের পবিত্রতা শুঁকে নেয়ার বোঝাপড়া সুহাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে, শুদ্ধ করে। সুহামনি এই বাড়ির ছোট কন্যা । পুরো নাম সুহাসিনী সুলতানা।

মায়ের অবশ্য ঠিক নেই কখন কি নামে ডাকবেন। সুহি, সুহান, সুহামনি , সুহাই একশএকটা নাম যখন যেটা মনে আসে তিনি তার লেজ ধরে টান দিয়ে ডাকতে থাকেন।

‘’জ্বি জ্বি আসি মা ‘’ বলে কতক হেঁটে কতক লাফিয়ে বাকিটা দৌড়ে সে মায়ের কাছে চলে আসে। মা ঘিয়ে ভাজা সুজির হালুয়া আর গালফোলা লুচি নিয়ে বসে আছেন। সুহা খেলা ছেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসেছে । খেলতে গিয়ে তার হাঁটু ছেলা জামায় ময়লা, গালে কিসের যেন দাগ , মা রাগতে গিয়েও থেমে গেলেন ।
যাও আগে হাত মুখ ধুয়ে জামা বদলে এসো। কি অবস্থা করেছে চেহারার। সুহা সটকে পালায়।

ঘরে ঢুকে দেখে দিদি মন দিয়ে বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে কি যেন দেখায় ব্যস্ত। চেয়ার টেবিলে বসে কেউ বাইনোকুলার দেখে ? এখানে তো পড়শুনো করতে হয়। হুহ। দিদিটার বেলায় মায়ের কোনো বকাঝকা নেই কিচ্ছু নেই । সকল বকা এই সুহাকেই খেতে হয়। মনে মনে গজ গজ করতে করতে বাথ্রুমের দিকে ঢোকে সে।

মোট চারটি ঘরের একটি বন্ধ থাকে অতিথিদের জন্য।আর তিনটির একটি তার বাবা মায়ের , একটি ঘর ফুম্মার ,মানে বাবার ফুপু তাদের সাথে থাকেন। আর বাকিটা তার আর দিদির। কেন যে দিদিটা তার সাথে ঘুমায়। একটু যে রাত জেগে লুডু খেলবে তার উপায় নেই । রিরাট রাগি । গোল গোল কালো চশমা পরা এবং খুব কম কথা বলা দিদিকে ঐ পাড়ার বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয়ের অংকের মাস্টার লাগে তার। না পারতে কথা বলে না ।

অবশ্য মুড ভাল থাকলে দিদি কোলে বসিয়ে খাইইয়ে দেয়, গল্প করে ঘুম পাড়ায় ,ঘুমানোর সময় স্টোরি বুক্স থেকে ইংরেজী স্টরি পড়ে শোনায়। সোনাদিদিয়া। খালি একটু রাগ কম হলে ভাল হতো।

সেবার বাইরে থেকে আনা’ ‘লাওপালা’ সেটের কাপ ভেঙ্গে ফেলে সুহা তো ভয়ে পাথর । আর নড়তে পারে না। । মা বেলুন হাতে নিয়ে রান্না ঘর থেকে সুহার নাগাল পাবার জন্য দৌড়াচ্ছে , ধরার আগেই দিদি ছোঁ মেরে তাকে নিয়ে সোজা ছাদে চলে যায়। দুইহাতে দিদিকে জাপ্টে ধরে আছে সুহা। ছাদে গিয়ে দিদি তাকে কোল থেকে নামিয়ে ভয়ানক হাসতে থাকে।
‘আহা পাকা গিন্নি। ক্রোকারিজ ধরতে গেছিলি কেন ? ‘
‘’কত সুন্দর ডিজাইন তাই তো। সোনার মত চকচক কচ্ছিলো। চোখ গোল গোল করে ফিরিস্তি দিচ্ছে সুহা। একটু দেখতে নিতেই মা এমন জোরে নাম ধরে ডেকেছে যে আমার হাত থেকে পড়ে গেলো দিদি।
‘’থাক আর ভয় পেতে হবে না । মা কিছু বলবে না। কিন্তু বলতো মা’র কত শখের জিনিস পুরোনো আমলের । দিলি তো সেট ভেঙ্গে…।‘’

এতক্ষনে হুশ হয়েছে সুহার। তাই তো। মা’ যে মনে কষ্ট পেলো।

দিদি গালে করে ঘিয়ে ভাজা সুজি আর লুচি ছাদে আনিয়ে নিয়ে খাইয়ে দিলো পুরোটাই। আর খাবি ?

‘’উহু, ‘’ মুখ মুছে মাথা নাড়লো সে।
যা এবার মায়ের কাছে গিয়ে স্যরি বলে আয়। চল।‘
‘মা তো অনেক কষ্ট পেয়েছে তাই না দিদি।?’

সুহারা নিচে এসে দেখে মা, লোকজন দিয়ে জিনিস পত্র সরাসরি করছে। রান্নাখালা , সবুজের মা বুয়া। দারোয়ান মামারা মিলে বসার ঘরে একটা শোকেস এনে রাখলো, শোপিস আনলো আর একটা পেল্লায় বড় ছবি। মা এখানে রাখ, ওখানে রাখ বলে নির্দেশনা দিচ্ছেন। সুহা ভেবে পাচ্ছে না এখন কি মায়ের কাছে যাবে নাকি পরে? চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই মা ডেকেছে ‘’সুহানি এদিকে আয় মা।‘’
সুহা চুপচাপ গুটিগুটি মায়ের কাছে গেছে।
‘’তখন অনেক ভয় পেয়েছিলি সোনাবাচ্চা। এমন ভাবে ভয় পেতে নেই । একটা কাপ গেছে তো কিছুই হয়নি । এভাবে ভয় পেয়ে এলোমেলো দৌড়াবি না।‘’
এই বলে কোলে নিয়ে দুই গালে চুমো দিয়ে দিলো। মায়ের গায়ে সারাক্ষণ কি সুন্দর একটা ঘ্রাণ । মনে হয় খেয়ে ফেলে। ল্যাভেন্ডার সাবানের নাকি আতরের সে বুঝতে পারে না । শুধু মায়ের সাথে লেপ্টে থাকতে ইচ্ছে করে। মা তার সেরা মা।

মনোলিনা দেখছে বেশ কিছু কাঠের খোদাই করা শোপিস এবং শোকেস আনিয়েছেন মা। আর তিনটি বিশাল পেইন্টিং । কী সুন্দর ! কি যে সুন্দর। তাতে করে বসার ঘরে হলরুম ভাবটা কমে গেলেও বেশ ভাল লাগছে এখন। ময়মনসিংহের পুরাতন জমিদার বাড়ি থেকে নিলামে কাঠের খোদাই করা পাল্লা কিনেছেন দরজার । সেটাকে ভেতরের দিকের মূল দরজায় লাগানো হবে। যাতে করে বাইরে থেকে বৃষ্টির পানির ছাঁট এসে না লাগতে পারে। আরেক পাশে আছে জামদানি শাড়ির কাটা অংশের ফ্রেম । বনেদিয়ানার প্রায় বিলুপ্ত শৈখিনতা বেশ ধরে রেখেছেন সুহাসিনীর মা । তার বাবার বাড়ি অবস্থা সম্পন্ন ছিলো বোঝা যায় এখন। গহনা খুব সামান্যই আছে তবে যা আছে খুব নামকরা হাতের কাজ। এগুলো মেয়েদের জন্যই রাখতে চান। আর কোথাও এসব গহনার চিহ্ন থাকবে না ।
সুহার বাবা পেশায় উকিল, পসার তেমন নেই । তেমন রোজগার নেই তা সবাই বোঝে । তাই বড় সন্তান হিসেবে মনোলিনা দ্রুতই পড়া শেষ করে কাজে ঢুকে যেতে চায়। মা’কেও সেরকম ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু মা পাত্তা দিলেন না। যেন কিছু হয়নি।

কিন্তু সে শুনেছে গতমাসেই কিছু ধানি জমি বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। উত্তরাধিকারে পাওয়া অনেক কিছুই বিক্রি করে শেষ। বাকি আছে এই দশ কাঠা জায়গার উপর বাড়ি, ,দোকান হিসেবে ভাড়া দেয়া দুটি পজিশন। আর কয়েক বিঘার জমি তাও পানির তলায়।

আতাহার কাকা মওকা বুঝে বাগিয়ে নিয়েছেন অনেক কিছুই । তার অংশকে ভাড়া দিয়েছেন , কমিউনিটি সেন্টার করেছেন টাকা খাটাচ্ছেন পুরো দমে। কিন্তু বাবা বৈষয়িক নন। টাকা তিনিও সমান পেয়েছিলেন রাখতে পারেননি। জুয়া খেলায় প্রায়ই বড় অংকের হারা হারেন আর টাটকা জমির কোণা ধরে বিক্রি করেন। কেউ কেউ নিজের ক্রমাগত হারাকেই বিজয় বলে মেকি আনন্দ পেতে থাকেন। আর বিষাদে পূর্ণ করেন আয়ুর সবটুকু। বোতলে বোতলে অতলে অবচেতনে দিকভ্রান্ত হন তিনি।

সুহাসিনী শুনে ছিলো এই বাড়িটি নাকি এক কালে জমিদার বাড়ির অংশ ছিলো । সেখানে রোজ সন্ধ্যায় নাচগানের জলসা হতো। জরিদার ঘাগরা পরে শিল্পিরা গাইত নাচত। প্রতি সন্ধ্যায় আসর বসতো সূরাপানের। গানের সমঝদারেরা বাহবা দিতেন থেমে থেমে। সুহাসিনীর এক দূরের আত্মীয় নাচ করতেন সম্মানীর বিনিময়ে। পরম সৌন্দর্যের কারণে তাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছিলেন সুহার মামা। পরে পরিবারের সম্মান এবং আভিজাত্যের বিপক্ষে গিয়ে সেই কিন্নরীকে বিয়ে করে আনেন এক দিন। । এই বিয়ে মেনে নেবার তো প্রশ্নই ছিলো না । যার নাচ দেখে বাহবা দেয়া যায়, মন উচ্চাঙ্গে বাঁধা থাকে , প্রশংসার মুক্তো গিঁটখুলে ছুঁড়ে দেয়া যায় , তাকে আর যাই হোক ঘরে বউ করে তোলা যায় না। নানাজান কে রাজী করতে না পেরে মামা বের হয়ে যান নতুন মামি কে নিয়ে। কিছু দিন বাদে মামি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলে পরে নানাজান তার ভুল স্বীকার করেন।

লিনা খানিক অন্যমনষ্ক। বেশ কিছু দিন ধরে মনমালিন্য চলছে ঋষির সাথে। তাদের বাড়িতে ঋষির বাবা মায়ের প্রস্তাব পাঠানোর কথা কিন্তু কি যেন সমস্যা হয়েছে , ঋষি ঠিক মতো বলে না কিছুই। না বললেও লিনা বোঝে । তার বাবাকে নিয়েই সকল সমস্যার গোড়া। মদ্যপ জুয়ারী বাবার মেয়ের স্বাভাবিক বিয়ে হওয়া মুস্কিল। সবাই মেয়ে দেখার আগেই মদের গন্ধ পেয়ে ফিরে যায়।
সুহার কারণে লীনা সব খবরই পায়। বাসায় এত মালপত্র আনার কারণ সে আঁচ করে। মা তাকে দেখেশুনেই পাত্রস্থ করতে চায়, পাত্র অভিবাসী। মায়ের বান্ধবীর আত্মীয়র ছেলে। সামনের সামারে দেশে আসবে সপরিবারে। মা আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন না।

আজ কোন স্টোরি শোনাবে দিদিয়া? ঘুমাতে যাবার আগে সুহার বকবক। আজ ভালো লাগছে না রে। ঘুমা। আমি আছি তো ।

ঐ গল্পটা শোনাও। ঐ যে অনেক সুন্দর পরীর মত কন্যা। সন্ধ্যার পর শুধু ছাদে হাঁটতো আর নিচে পুকুরের পানিতে নিজের চেহারা দেখত।
তুই তো পাকা বুড়ি সব জানিস । নিজেই তো বলে দিলি । এখন ঘুমাও সুহানা ।

লিনা র মনে পড়েছে শোনা গল্পটা। লোকমুখে শোনা। তবে পুরোটা সুহা জানে না। । জমিদার কন্যা এরকম ঘুরতে ঘুরতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক রাতে। তার নকশা করা ঘাগরা ভেসে উঠেছিলো পদ্মপুকুরে । জরিচুমকির নকশাতে আলো পড়ে চিকচিক করছিলো ফুলেল ঘাগরা ।

লিনা মেসেজ লিখতে বসে ঋষিকে । সব গুছিয়ে লিখবে আজ। মা কি চাইছেন সব কিছু লিখতে শুরু করে সে খটখট করে । লিখতে লিখতে রাত গভীর । পা টিপে টিপে ছাদে যাবার জন্য সিড়ি ভাঙ্গে লিনা । রাতের ছাদ দেখতে কেমন দেখতে বড় ইচ্ছে তার । কিন্তু ভয়ে যাওয়া হয় না। আজ প্রায় পৌছে গেছে আস্তে করে দরজার ছিটকিনি তে টান দিতেই ‘’লিনুউউ’’ বলে ডাক । পেছন ফিরে দেখে মা। উফফফ এই মা’ টা সারারাত ঘুমায় না।

পানের বাটা নিয়ে সরু সরু করে সুপারি কুচি করছেন মা । এত ক্ষিপ্রতার সাথে কেউ সুপারি কুচি করতে পারে সেটা তাকে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এই সুপারির চিকন দানা মুখে ফেলে সে সারাক্ষণ চাবাতে থাকে। একবার এই সুপারি খাবার কারণে রক্তে বিষক্রিয়া হয়ে প্রায় মরতে বসেছিলেন । কিছুদিন বেশ বন্ধ তারপর আবার যেই কি সেই। মায়ের হাতে পানের বাটা আর সুপারি দেখে হাসে লিনা।
‘’আমার মা কে পান মুখে সুন্দর লাগে। সুখী মা।‘’
‘’ আরে আমি তো এখন সুখী হবোই । মেয়ে যে আমার বড় হয়েছে । মেয়ে বড় হলে মায়ের অনেক সুখ হয় , আর সেই মেয়ে যদি বুঝদার হয়। ‘’

মা কানের ঝুমকা নেড়ে নেড়ে হাসছেন। লিনার কেন যেন বুকটা ধক করে ওঠে। মা কি কিছু টের পাচ্ছেন?রাতের আকাশের লালাভ রঙ দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

ঋষি শেষ বারের মতো দেখে নিচ্ছে এপ্লিকেশন টা। সে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জায়গায় সিভি ড্রপ করেছে। দেশের বাইরে যাওয়াই আসল মোটো। তার এখানে ভাল লাগছে না। লিনাকে জানাবে জব হবার পর। কাজটা ঠিক হচ্ছে না জানে। কিন্তু উপায় নেই। লিনার কাছাকাছি যাওয়া সহজ ছিলো না । সে বুদ্ধিমতি এবং রিজার্ভ। এলোমেলো কথা বলা তার কাজ নয়। কিন্তু একজন মানুষ খুব নিবেদিত থাকলে অনেক সময় যতটা ভাবা যায় তার চেয়েও বেশি দ্রুত কাজ হয়। বন্ধুহীন লিনা এক ঋষিকেই বিশ্বাস করতো।

লিনার কাছাকাছি আসার পর যখন নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে তৃপ্ত ঠিক তখনই সব বদলে গেলো। ঋষি নিজের বাবা মা কে আর রাজি করাতে পারছে না। পদস্থ কর্মকর্তা বাবা তো এক কথায় নাকচ করে দিলেন। কবে কোন জমিদারি ছিলো তাই ধুয়ে কি পানি খাবো? মদ্যপ এবং জুয়ারী কোন ব্যক্তির সাথে নতুন করে আত্মীয়তার কোন কারণ নেই।
বাবার কথা অগ্রাহ্য করার কথা ঋষির। কিন্তু করলো না। লুকিয়ে দেশের বাইরে যাওয়াই সাব্যস্ত করলো। লিনা তো অপেক্ষা করতেও পারতো। বদলে যাওয়া নিজেকে চিনতে না পেরে নিজেই অবাক হচ্ছে ঋষি। অনেকক্ষণ মা ডাকছেন অনেক দিন পর কেউ তার পুরো নাম ধরে ডা্কলো। ঋষি কম্পিউটার বন্ধ করে উঠলো। লিনা কে ইমেইল সেন্ট করলো সে। সরাসরি যা হবার নয় , লিখে লিখে তা নিমেষেই হয়ে যায়।

সুহা বোনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। এইটা কি দিদি ? ওমা । এত্তো সুন্দর লাগছে? উঠে দাঁড়াও তো দেখি !! ‘’
‘’এখন তো মাথা বেঁধে দিচ্ছে রে। তুই যা, মা কি করছে দেখ গিয়ে। ‘ বসার ঘরে জনা বিশেক লোকজন। খাবারের সুঘ্রাণ, ব্যস্ততা সব মিলিয়ে আজ ভালো লাগছে সুহার। সে বড়দের মতো একলা এক সোফায় বসে আছে। ঐ যে লিনা। চট করে সিড়ির দিকে তাকালো সুহা। ঐ যে দোতালার সিড়ি বেয়ে তার প্রিয়তম বড় বোন এবং সাথে বন্ধুরা ধীরে ধীরে নেমে আসছে। আজ মনোলিনার আঙটি বদল।

লোকজন সব চলে যাবার পর বসার ঘরটা আচমকা শুন্য হয়ে যায়। যেন তাকে না বলে সবাই একযোগে অন্য কোথায় চলে গেছে । যেন কোন ষড়যন্ত্র ছিলো। ষড়যন্ত্র যে কেবল জীবিত দুজনের মধ্যে ঘটে থাকে তা তো নয়।

ঋষি কি করেছে , কিম্বা করবে তা নিয়ে আর ভাবছে না লিনা। তার এই মন নিজের কাছেই অচেনা লাগছে। সে শান্ত নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। সিদ্ধান্ত নেবার পর যে ফুরফুরে লাগে তা জানা ছিলো না ।

একের পর এক দৃশ্যেরা বায়োস্কোপের মত ঘুরে ঘুরে দেখা দিয়ে যাচ্ছে। কী যে প্রবল ভাবে চাইতো ঋষি তাকে। বহু কষ্টে ঋষি চুমু দেবার পারমিশন পেয়েছিলো। তাও গালে একটা । কিসের কি । চুমু দিতে শুরু করে সে কি আর থামে। বেপরোয়া সময় শান্ত থেকে অশান্ত হয়। কত কথা রাখার কথা ছিলো । কত কথা প্রতিজ্ঞা ছাড়াই রাখা হয়ে গেছিলো। কিন্তু কোনও কারণেই পৃথক হবার কথা ছিলো না। সারাজীবনের একত্রে থাকার শর্তগুলো কেমন খেই হারিয়ে বিষন্ন বাতাসের সাথে ঘুরে ঘুরে ঠিকানাহীন হা্রিয়ে যেতে থাকে।

এত বড় দরাজ বাড়িটার সাথে কিছু দিনের মধ্যেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। এখানে থাকবে মায়ের অপেক্ষার ঝুমকা , বাবার নির্লিপ্ত অনিয়মানুবর্তিতা , সুহার প্রাণ , আর নেপথ্য মহড়ারত নূপুরেরা। আর থেকে যাবে নিখুঁত সব নকশাকাটা। লিনা যত দূরেই যাক এই পুরানা নকশা বাড়িটা,, আশৈশব স্বপ্নের বাড়িটা বুকের ভেতর খোদাই হয়ে থাকবে। কোন পরম বিক্রমশালী নগরকর্তা একে ভেঙ্গে খান খান করতে পারবে না। মায়ের আমলেও না সুহার আমলেও না।
ঋষি ,এই সহজিয়া দালানের ততোধিক সহজ মানুষ কে বুঝে নেয়া তুচ্ছ তোমার কিম্বা, তোমার বাড়ির মানুষের আয়ত্তে থাকার কথাও না। লিনা একা একা বিড়বিড় করে। ঋষি পালিয়ে যাক তুরন্ত, লুকিয়ে যাক যতদূর সম্ভব।

কি রে ঘাগরা খুলতে ইচ্ছে করছে না? মা মুগ্ধ নয়নে লিনার দিকে তাকিয়ে থাকে । আজ মায়ের তুমুল খুশী। মেয়ে তার কথা রেখেছে।
‘’মা একটু পরে থাকি ? খুব সুন্দর তাই না মা? অনিন্দ্য কে বলো আমার খুব ভালো লেগেছে সব কিছুই।‘’

সারা ছাদটা চক্কর দিচ্ছে চাঁদ। নিচে তাকাতেই পুকুরের স্বচ্ছ টলটলে পানি দেখা যায়। তাতে আজকের সমস্ত সৌন্দর্য চুরি করে দাঁড়িয়ে থাকা মনোলিনার মুখ ভেসে ওঠে। লিনা জলের ওপর ভেসে ওঠা অবয়বের দিকে এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকলো। নিজেকে চেনা যায় না একেবারেই। জোৎস্নাটা ছায়া পেয়ে তাবৎ রহস্য কে ফিকে করে দিতে চাইছে। হালকা স্বরে ‘ রুমাঝুমা রুমাঝুম’ গানটার সুর শুনছে ঘুমন্ত পাতার দল। সুহা, ঘরে লিনা কে না পেয়ে দৌড় দিচ্ছে ছাদের দিকে। দিদি আজ ঐ কাজকরা সুন্দর ঘাগরাটা পরে ছাদে বসে আছে। আজ দুই বোন ঘুমাবে না। দিদি সেই পরীর মত কন্যাটার বাকি গল্পটা বলবে। সুহাসিনী সব গল্পের শেষটুকু জানে না। এখন ভোর চারটা সাড়ে চারটা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ