আমারে নিবা মাঝি লগে?

প্রশান্ত মৃধা

বাংলা উপন্যাসে সবচেয়ে মোক্ষম সংলাপের একটি : ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ ‘মোক্ষম’ শব্দটা হিসেব করে বসানো। যদিও, গদ্যকাহিনির সংলাপের ক্ষেত্রে মোক্ষম শব্দ হিসেবে খুব লাগসই নয়। কিন্তু মোক্ষম শব্দটিই এ ক্ষেত্রে সর্বক্ষমতাময় প্রয়োগগুণসম্পন্নœ একথা মাথায় রেখেই লেখা। এই মুহূর্তে, অন্তত এর চেয়ে কার্যকর শব্দ মনে আসছে না, সত্যি!


একটি সংলাপ কখনও কখনও একটি উপন্যাসের গন্তব্য আর গতিপথকে নির্ধারণ করতে পারে, পদ্মানদীর মাঝির এই একটি সংলাপ, সব দিক দিয়েই ওই অসাধারণ উপন্যাসটির সেই গন্তব্য আর গতিপথের দিশা নির্ধারক। একবারেই অমোঘভাবে, যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তূণে এই সংলাপটিই ছিল শেষ তির! প্রয়োজনমতো তিনি তা ব্যবহার করেছেন। অথচ, এই সংলাপটিই প্রথম যখন এই উপন্যাসের চতুর্থ পরিচ্ছেদে ব্যবহৃত হয়েছে, তখন এতটা অমোঘ আর কার্যকর লাগেনি, থাকেনি, হয়তো উপন্যাসের একদম শেষে ব্যবহার করার সময় রচয়িতা হিসেবে তাঁর খেয়ালও থাকেনি যে, সংলাপটি আগেও একবার ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু তাই-বা ভাবা যায় কী করে? পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দিককার রচনা। তখন প্রতিটি লেখা তিনি বারবার ঘষামাজা করতেন। খসড়ার পর খসড়া হত পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। সেই প্রায় আত্মঘাতী পরিশ্রমের কালে এই সংলাপটি যে ইতিপূর্বে ব্যবহার করেছেন, সেকথা তাঁর মনে না-থাকার কোনও কারণ নেই। বাংলা ভাষায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দর ও মাপের কথাসাহিত্যিক নন যে, প্রত্যেকটি বাক্যের প্রতিটি আলাদা আলাদা শব্দের ওপরে নিজের বিচরণের নিশ্চয়তার অংশভাগ নেন না। সেই একই সময়ে লিখেছেন তিনি পুতুল নাচের ইতিকথার (১৯৩৬) অমন প্রায় অসম্ভব অসাধারণ আরম্ভ : ‘খালের ধারে প্রকা- বটগাছটার গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।’ বাংলা উপন্যাসে মৃত্যুমুহূর্ত রচনা করে এমন কাহিনির অগ্রসরতা প্রায় বিরল!

পদ্মানদীর মাঝির একেবারে শেষ অংশটি একটু পড়া যাক। সেখানে হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপে কুবেরকে যেতেই হচ্ছে। কুবেরের ঘরে পাওয়া গেছে পীতম মাঝির সোনার ঘড়া। হয়তো রাসু রেখেছে অথবা রাখেনি। সে রহস্য কোনওভাবে উন্মোচিত হওয়ার নয়, সে সুযোগও রাখেননি ঔপন্যাসিক; ফলে, এখন জেলখাটা থেকে বাঁচার উপায় কুবেরের ময়না দ্বীপে চলে যাওয়া। এই সময় উপন্যাসের শেষ বারো-চোদ্দটি বাক্য :

কপিলা চুপিচুপি বলে, না গেলা মাঝি, জেল খাট।

কুবের বলে, হোসেন মিয়া দ্বীপি আমারে নিবই কপিলা। একবার জেল খাইটা পার পামু না। ফিরা আবার জেল খাটাইব।

কপিলা আর কথা বলে না।

ঘাটের খানিক তফাতে হোসেনের প্রকা- নৌকাটি নোঙর করা ছিল। একজন মাঝি ঘুমাইয়া ছিল নৌকায়। তাহাকে ডাকিয়া তুলিলে সে নৌকা তীরে ভিড়াইল। কুবের নীরবে নৌকায় উঠিয়া গেল। সঙ্গে গেল কপিলা।

ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, আমারে নিবা মাঝি লাগে?

হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা এতদূরে কুবের পাড়ি দিতে পারিবে না।

পদ্মানদীর মাঝি শেষ। পাঠক হিসেবে আমরা ধরে নিই, নিশ্চিত হই কপিলা গেছে কুবেরের সঙ্গে। হয়তো, বাংলা উপন্যাসের পাঠক হিসেবে স্বাভাবিক কল্পিত নায়ক-নায়িকার (?) গন্তব্য অনুযায়ী কুবের-কপিলাকে অনিশ্চিত যাত্রী হিসেবে চিহ্নিত করি। হয়তো, জেলে অথবা মাঝিদের নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে কপিলার মতন উচ্ছল শ্যালিকার কুবেরের মতন পৌরুষসম্পন্ন ভগ্নিপতির সঙ্গে ‘পালিয়ে যাওয়া’কে বেশ উপভোগও করি। কিন্তু মধ্যবিত্ত পাঠককুলের চিরকালীন (অন্তত দেড়শ’ বছর ব্যাপী) রুচির স্থিরীকৃত মানদ-ে যখন আঘাত লাগে, তাকে মাঝি-জেলেদের জীবনেই তা সম্ভব হিসেবে মনে মনে চালিয়েও দিই। তবে সে যাই হোক, পদ্মানদীর মাঝি পড়ার পরে, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ এক কাহিনিগদ্য পাঠের অভিজ্ঞতাও। সে অভিজ্ঞতার দোসরও খুব একটা নেই।

শেষের আগের পঙ্ক্তি : ‘ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, আমারে নিবা মাঝি লগে?’

যদি এখানে উপন্যাসের শেষ হত, তাহলে পাঠক হিসেবে এই উপন্যাস সম্পর্কে আমাদের ভাবনার গন্তব্য হত একÑ যদি এর পরের বাক্যে লেখকের স্বগত বয়ানটি না-থাকত, যদি কাহিনিকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজ দায়িত্বে বলে না-দিতেন কপিলা সঙ্গে না-গেলে কুবের এত দূর পথ, সেই সুদূর ময়না দ্বীপ পর্যন্ত যেতে পারবে না।

কিন্তু উলটো করে ভাবলে, যদি এই শেষ বাক্যের অনুমোদনটুকু না-থাকত? এ তো শুধু লেখকের অনুমোদন নয় যে তিনি চাইবেন এত দূর পথ কপিলা কুবেরের সঙ্গে যাক, এই অনুমোদন তো একই সঙ্গে কুবেরেরও। চরিত্র তো কত কাল ধরে বাংলা উপন্যাসে বাহাদুর হয়ে উঠেছে, কখনও লেখকের অনুমোদনক্রমে আবার কখনও যেন তাঁর প্রত্যক্ষ অনুমোদন ছাড়াই। এ যেন লেখকের হাতে লাটাই, কিন্তু ঘুড়ি নিয়ত খোঁজে নিজস্ব আকাশ। কুবেরের ক্ষেত্রেও তো তাই, কপিলার ক্ষেত্রে কখনও কখনও আরও বেশি। যদি সেই চতুর্থ পরিচ্ছেদের মতন এরপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কুবেরের মুখ দিয়ে বলাতেন কপিলাকে বাড়ি চলে যেতে, আর কপিলা, ‘হায়রে পুরুষ!’ বলে নৌকা থেকে ডাঙায় উঠে কুবেরের নৌকার চলে যাওয়া দেখত? তাহলে আজকের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাস হিসেবে যে নিশ্চিত আবার অনিশ্চিত গন্তব্যের দিশা নিয়ে উপস্থিত,Ñ সেখানে থাকত?

চতুর্থ পরিচ্ছেদে কুবের কপিলা সংলাপ একটু পড়ে নেয়া যাক :

কপিলা যে পিছু পিছু আসিয়াছে তা কি কুবের জানে?

তাহার আকস্মিক হাসির শব্দে কুবের ভয়ে আধমরা হইয়া যায়। ঠকঠক করিয়া সে কাঁপিতে থাকে। নির্জন নদীতীরে সন্ধ্যারাতে কে হাসিবে? মানুষ নয়, নিশ্চয় নয়!

কপিলা বলে, তামুক ফেইল্যা আইছ মাঝি?

কুবের নামিয়া আসিয়া তামাকের দলাটা গ্রহণ করে।

বলে, খাটাশের মতো হাসিস ক্যান কপিলা, আঁই?

কপিলা বলে, ডরাইছিলা, হ? আরে পুরুষ!

তারপর বলে, আমারে নিবা মাঝি লগে?

বলে আর কপিলা আব্দার করিয়া কুবেরের হাত ধরিয়া টানাটানি করে, চিরদিনের শান্ত কুবেরকে কোথায় যেন সে লইয়া যাইবে। মালার বোন না কপিলা? হ। কুবের তাহার দুই কাঁধ শক্ত করিয়া ধরিয়া অবাধ্য বাঁশের কি র মতো তাহাকে পিছনে হেলাইয়া দেয়, বলে, বজ্জাতি করস যদি, নদীতে চুবানি দিমু কপিলা!

এই যে কুবেরের কেতুপুরের বাড়িতে এসেছে কপিলা তার কারণ বন্যা। কুবেরের শ্বশুরবাড়ির গ্রাম আকস্মিক বন্যায় জলে তলিয়ে গেছে। কুবের তাদের দেখতে গিয়েছিল। সেখানে যেয়ে দেখে কপিলাও এসেছে, সম্প্রতি তার স্বামী আর-একটি বিয়ে করেছে। দরিদ্র জেলে কুবের কপিলা ও অন্য শালা-শালিসহ এতজন মানুষ নিয়া এসে প্রায় আতান্তরেই পড়ে। এত মানুষ খায়, রাতে তাদের খাওয়া দেখতে দেখতে কুবের ধারকর্যের হিসেবে করে। আর একসময় প্রতিটি রাতের মতো মাছ ধরতে আজও নদীর কূলে এসে বসে। গণেশ ও ধনঞ্জয় তখনও আসেনি। কুবের একলা নদীর কূলে বসে আছে। সেইখানে কপিলার আবির্ভাব তামাক নিয়ে।

পদ্মা নদীতে কোনওদিনই নারীরা মাছ ধরতে নামেনি। এই যে কপিলা কুবেরের হাত টানে, টেনে একান্ত আবদারে বলল তাকে সঙ্গে নেয়ার জন্যেÑ এই সঙ্গে নেওয়ার ছলটুকু এমন হঠাৎ, হয়তো আজই এই রাতে কপিলার কাছ থেকে আসবে কোনওভাবেই যেন ভেবে উঠতে পারেনি কুবের। কুবের কপিলার দিকে তাকায় অথবা কীভাবে তাকায় সেকথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেননি কিন্তু একটি ইঙ্গিতে তো তা ধরা আছে যে, কপিলা তাকে আবদার করে সঙ্গে নেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু এই কয়দিন, কপিলা এখানে আসার পরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কাহিনির কোথাও এই কথা লেখেননি যে, এমন ইঙ্গিতময় কোনও কথার আদানপ্রদান তাদের ভিতরে হয়েছে। হয়নি। হয়তো কপিলার দিক থেকে কুবেরের প্রতি এমন টান আগে থেকে ছিল কুবের তা বুঝতে পারেনি। হয়তো এই প্রথম এইখানে এই সংলাপগুলোর ভিতরে দিয়ে তার সূচনা হল।

তাহলে, এই সঙ্গে নেওয়ার আকুতির ভিতর দিয়ে চিরদিনের শান্ত কুবেরকে কপিলা যেখানে নিতে চায় সেই গন্তব্য না-জানা থাকলেও, তা ময়না দ্বীপ। সেখানে যাওয়ার কোনও ইঙ্গিত থাক বা না-ই থাক, সংলাপের এই মিলটুকু ছাড়া আর কিছুই তো নেইও। কোনও কিছুই নেই। তবে, এই কাহিনিতে কপিলার দিক থেকে কুবেরের প্রতি সরাসরি প্রেমের সূচনার ইঙ্গিতও এইসঙ্গে ঘটে গেল। একই সঙ্গে আর-একটি ব্যাপারও ঘটল, হয়তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজ্ঞাতেই, কিন্তু খুব সাহসের সঙ্গে জোর দিয়ে কোনওক্রমেই বলা যাচ্ছে না যে, ব্যাপারটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজ্ঞাতে ঘটেছে। একথা কোনওক্রমেই ভাবা সম্ভব নয় যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গল্প-উপন্যাসে কোনও পঙ্ক্তি-বাক্য নিজের কলমের বাহাদুরির ওপর ছেড়ে দিতেন। কাহিনিকে চাইলে ছেড়ে দেওয়া যায়, লেখককে তা দিতেও হয়, লেখক তা দিয়েও থাকেন, কিন্তু একটি সংলাপ! আর যে ব্যাপারটি ঘটল সেটিও যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজ্ঞাতে ঘটেছে তাও হয়তো নয়। হয়তো তিনি এই-ই চেয়েছেন তাঁর চব্বিশ-পঁচিশ বয়েসে লেখা এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে। হয়তো এই-ই এ উপন্যাসের প্রকৃত গন্তব্য।

এই চতুর্থ পরিচ্ছেদে, কপিলার ওই একটি সংলাপেই উপন্যাসটিও যেন নির্দিষ্ট করে নিল তার গতিপথ। এখানে উপন্যাসটি একটু টাল খেয়ে গেল যেন। হয়তো তাই স্বাভাবিক, ওই সংলাপটি, এখানে এই চতুর্থ পরিচ্ছেদে পদ্মানদীর মাঝির জন্যে। খুব সজ্ঞান পাঠক হওয়ার দরকার নেই, এমনিতেই এই উপন্যাসের নাম পদ্মানদীর মাঝি। সেই হিসেবে পদ্মা নদী হতে পারে আবার পদ্মানদীর মাঝিও উপন্যাসের মূল বিষয় হতে পারে। এখানে তাই হয়েছে। কিন্তু চতুর্থ পরিচ্ছেদ থেকে কপিলা যত কুবেরের দিকে এগোয়, গোটা উপন্যাস থেকে পদ্মা নদী ততটাই দূরে সরে যায়। যেন এরপর আর এই নদীকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের প্রয়োজনে সামনে আনার দরকারই বোধ করলেন না। তখন কেউ ময়না দ্বীপ থেকে ফেরে; অথবা, আসে যায়, হোসেন মিয়াও আসে। কুবেরও এই নদীর বুক ধরে ময়না দ্বীপে যায় আসে। কিন্তু উপন্যাসের শুরুতে, কি তারপরও যে নদীকে পাই, তা সত্যি যেন এই কাহিনিতে ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়। হয়তো তাই চেয়েছেন মানিক। তখন পদ্মা নদী কুবের ও কপিলার ময়না দ্বীপে যাওয়ার এক প্রয়োজনীয় মাধ্যমে বই অন্য কিছু নয়।

সেই দিক থেকে এই সংলাপ যে-কোনও বিচারেই খুব হিসেব করে বসানো, একেবারে মোক্ষম। এইখানে, চতুর্থ পরিচ্ছেদে নিজের কাছে যেমন, পাঠককেও সেই ইঙ্গিতের মুখোমুখি করতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ইঙ্গিতই রেখে গেছেন। যেন, এই সংলাপটা আবার বলা হবে, অথবা, সবশেষে এই সংলাপ ছাড়া কুবের-কপিলার অনিশ্চিত ময়না দ্বীপে যাওয়া কোনওভাবে সম্ভবপরও নয়।

কিন্তু সবশেষে, উপন্যাসের শেষ সংলাপ হিসেবে আবার যখন তা বলছে কপিলা, যদি না বলত, আবার যখন বলেছেও, তবু তার আগে যদি নৌকার ছইয়ের ভেতরে গিয়ে না বসত? আবার উলটো দিক দিয়ে ভাবা যাক, বসার পর যখন বলেছে তাকে সঙ্গে নেওয়ার কথা তখন যদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে অনুমোদন না দিতেন? তাও নয়, যদি কপিলার এই সংলাপটিরতেই শেষ হত এই উপন্যাস? তাহলে পাঠক হিসেবে আমাদের কল্পনার সব অংশকে এক জায়গা করে নিজের কল্পনাশক্তিকে জুড়ে দিয়ে পদ্মানদীর মাঝির কল্পিত কয়েকটি শেষ সত্যি ভেবে নেওয়া সম্ভব ছিল। চাইলেই ভেবে নিতে পারতাম আমরা। এখন তো সেই ভাবাভাবি, একটি ভাষার একখানি প্রধান উপন্যাস পাঠের পরে যা-যা ভাবা যায়, সেই উপন্যাস যে-যে রহস্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের, তার সম্ভব্যতা বিবেচনা মাথায় রেখে একটি দুটি হিসেব তো করে নেওয়া সম্ভব। তাহলে মালা আর কুবেরের সন্তানাদির কী হবে? পরে মালাও কী চলে যাবে ময়না দ্বীপে? সত্যি কপিলা শেষ পর্যন্ত গেছে তো কুবেরের সঙ্গে? সেইখানে তাদের আন্তঃপরিচয় কী হবে? এমনতর ভাবনায় কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সেই ভাবনা এখানে মুলতবি থাক। রচয়িতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেইসমস্ত ইঙ্গিতের কোনওমাত্র তোয়াক্কা করেননি। কোনও বড়ো লেখকই কখনই তা করেন না। আর মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে বিন্দুমাত্র মূল্য দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে তার শোভন জনগ্রাহ্য রূপ দেওয়া আরও অসম্ভব। তবে, যা সম্ভব করে রেখেছেন সেইটুকু বারবার পাঠ পুনঃপাঠে আমাদের সামনে এই ইঙ্গিত তো রেখেই গেছে যে, এই একটি সংলাপই আর সংলাপের পরে কুবেরের চিন্তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ লেখকের জবানিটিতে গোটা উপন্যাসের সমস্ত পাঠ-কে একটানে বদলে দিয়েছে। এতক্ষণ এই উপন্যাস যা-যা সম্ভাবনার রহস্য উন্মোচন করে আবার রহস্য আবৃত্ত করে এগিয়ে চলেছিল, তাকে সরিয়ে দিল।

পাঠক হিসেবে আমাদেরও জানা হল, প্রথমবার কপিলার সংলাপে সাড়া দেয়নি কুবের। লগে নেয়নি। উপায়ও নেই। কিন্তু কপিলাকে বাড়ি যেতে বলেছিল সে। সন্ধ্যার অন্ধকারে অবাধ্য কপিলা শান্ত কুবেরের সে কথা শুনতেও চায়নি। তাই কুবের তাকে নদীতে চুবাতে চেয়েছে। কপিলা যেন তাতেও রাজি। কিন্তু এইবার কুবেরের জেলখাটা অনিবার্য। কপিলা তাকে সে কথা মনেও করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কুবের তাও যাবে ময়না দ্বীপে। কিন্তু জানত না, কপিলা যাবে কি না। সে কপিলাকে তা জিজ্ঞাসাও করেনি। কিন্তু কুবের নৌকায় বসার একটু বাদেই কপিলাও গিয়ে বসে। আর এই কথা বলে, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ এখনও কুবের শান্ত। এই মুহূর্তে কপিলাও কোনওক্রমে দুরন্ত নয়। তাকে আর না করতে পারেনি কুবের। সামনের দূর পথ পাড়ি দিতে তার এখন সত্যি কপিলাকে চাই।

ফলে, সংলাপ হিসেবে এমন অনিবার্য ও লাগসই সংলাপ বাংলা উপন্যাসে সত্যি খুব কম আছে। প্রায় নেই-ই। থাকলেও সেই অনিবার্যতা ওই উপন্যাসের গন্তব্যের দিশা নয়। এখানে এতটাই মোক্ষম যে পদ্মানদীর মাঝিতে এই সংলাপ না-থাকার কথা কোনওক্রমে ভাবাই যায় না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চতুর্থ পরিচ্ছেদের সংলাপটি উপন্যাসের শেষে খুব হিসেব করে বসিয়েছেন। হয়তো চতুর্থ পরিচ্ছেদের সংলাপ থেকে এই শেষ সংলাপ পর্যন্ত পদ্মানদীর মাঝি সবমিলে জুড়ে আছে একটি বিন্দুতে।

এই অনিবার্যতা মোক্ষমের মতো কার্যকর শব্দ দিয়েও আসলে মিলানো যায় না।


২০১৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ