শামসুজ্জামান হীরা'র গল্প : জীবন

১.ক

অঘ্রান মাসের মাঝামাঝি, মোটে হেমন্ত; বসন্ত আসতে এখনও ঢের বাকি; কিন্তু এরই মধ্যে কোকিলদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। মাইকের আওয়াজে কান ঝালাপালা। প্রায় প্রতিসন্ধ্যাতেই এখানে-ওখানে বিরাট ইসলামি জলসা; কোকিলকণ্ঠী বক্তাদের দরাজ গলায় ওয়াজ-নসিহত!

হরিপুর আলহাজ্ব ইলিয়াচ লস্কর সিনিয়ার মাদ্রাসার ময়দানে বসেছে এমনই এক ইসলামি জলসা। এলাকার নামটি নিয়ে অনেক পরহেজগার বান্দার ঘোর আপত্তি। হরি বোল, বোল হরি! ইসলামি দেশ, অথচ দেখ, এখনও সেই মালাউনি নাম--হরিপুর! সবসময় লোকের মুখে হরি নাম! বাড়ি কোথায়? হরিপুর। যাচ্ছো কোথায়? হরিপুর হাটে। ঈদের নামাজ পড়লে কোথায়? হরিপুর ঈদগায়। শুনতে ভালো লাগে? হরিপুর নাম পরিবর্তন না করলে মুসলমানদের, বিশেষ করে কামলা-কিষান আতরাফ মুসলমানদের ইমান দুরস্ত হতে সময় লাগবে--আদৌ হবে কিনা সন্দেহ। আর সে-জন্যই জায়গাটির নাম আল্লাহবাদ রাখার জোর তদবির চালাচ্ছেন তাঁরা; কামিয়াব হবেনই ইনশাল্লাহ্। 

বিশাল মাঠে লোকে গিজগিজ; আরও আসছে এ-গ্রাম ও-গ্রাম থেকে। এত লোক আঁটলে হয়! এ-জলসাটি এলাকার সব থেকে বড় জলসা। না-হলেও লাখ খানেক লোকের সমাগম তো হয়ই নিদেনপক্ষে। মাদ্রাসার সব থেকে বড় ইনকামের পথ; মাওলানা মাশায়েখরাও ভালোই কামান ওয়াজ করে। সবার হাদিয়া আবার সমান নয়; ক্যাটাগরি অনুযায়ী একেক আলেমের একেক অংকের; কারও তিরিশ হাজার, কারও বা তিন। জলসার কিছু অংশে সামিয়ানা খাটানো। পশ্চিম প্রান্তে ঢাউস মঞ্চ --সারি সারি চেয়ার সাজানো। ওগুলোতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসীন হবেন সুদূর সোনাইমুড়ি থেকে আগত মাওলানা মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন, চাটগাঁর হাটহাজারি থেকে মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল কাহ্হার, চাঁপাইয়ের গোদাগারি থেকে মাওলানা মোহাম্মদ মতিউর রহমানসহ এলাকার অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি। এখন শুধু মঞ্চে একটি চেয়ার দখল করে বসে আছেন এলাকার একমাত্র ওয়াজকারী ও মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ হাশমতউল্লাহ্। মাটিতে খড় বিছিয়ে তার ওপর চটের আচ্ছাদন সাধারণ শ্রোতাদের বসার ব্যবস্থা। হাজেরানে মজলিস মৌজ করে বসেছে নরম চটের ওপর, বিখ্যাত আলেমদের ওয়াজ শুনতে। 

জলসার আশপাশে বসেছে পান-বিড়ি, চা, হরেক পদের মিঠাইমণ্ডার দোকান --ভালোই ব্যবসা হয় ওদের। কেষ্ট কুণ্ডুর মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। সকালে শ্রী শ্রী সিদ্ধিদাতা গণেশকে পূজা দিয়েছে ঘটা করে। বছরের প্রথম জলসায় ব্যবসা ভালো হলে সারা বছর ভালো কাটবে বলে ওর ধারণা। ভ্যানগাড়ির ওপর সাজানো ওর দোকান --কত পদের শুকনো মিঠাই, স্টোভে বসানো মাঝারি আকারের কড়াইয়ে ফুটন্ত তেল, কাপড়ের মধ্যে গোলানো বেসন নিয়ে অদ্ভুত দক্ষতায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বানায় জিলাপি। নীল রঙের গেঞ্জি গায়ে কেষ্টর গলায় ঝোলানো গাঢ় খয়েরি রঙের রুদ্রাক্ষের মালা। শুধু ওদের কেন, ইলেকশন ছাড়া মাইকের জমজমাট ব্যবসা এ-উপলক্ষ ছাড়া আর হয় কখনও? 

জলসা জমানোর জন্য মাদ্রাসার তালেবেলেমরা সুললিত গলায় হামদ্ ও না’ত এবং হিন্দি সিনেমার গানের সুরে ইসলামিসংগীত গেয়েই চলেছে একের পর এক। চোখ মুদে গান শুনছেন আর টেবিলে আঙ্গুলের টোকায় তাল ঠুকছেন হাশমতউল্লাহ্। আহা কী বেহ্তেরিন গলা। বিশেষকরে আবু সুফিয়ানের গলাটা কী মিঠা -- যেন পদ্মমধু! চেহারাও মাশাল্লাহ্। কেলাশ নাইনে পড়ে। কেরাতও করে জবর। মাদ্রাসার কেরাত প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট। ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন হাশমত। নিজের সুদূর অতীত স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে তিনিও দেখতে-শুনতে ছিলেন নজর কাড়ার মত সুপুরুষ; গলাও ছিল খাসা। সেই আমলে কেরাত প্রতিযোগিতায় তাঁর ধারে কাছেও কেউ ভিড়তে পারত না। 


১.খ

-লিল্লাহে তাকবির...। হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চিল্লিয়ে ওঠে এক তালেবেলেম।

-আল্লাহু আকবার...। কিছুটা হকচকিয়ে হাজেরানে মজলিশ সাড়া দেয়।

তালেবেলেমকে ধাক্কা দিয়ে পাশে ঠেলে দিয়ে হাশমতউল্লাহ দুহাত সম্মুখে প্রসারিত করে মুখ ভেংচে বলে ওঠেন, 

-আরে আল্লার বান্দাগের মুখে কী মইরচা ধইরা গেছে, নাকি ইন্দুর সান্দাইছে, জোর নাই কেন? তারপর বাজখাঁই গলায় নারা ধরেন,

-লিল্লাহে তাকবির...

-আল্লাহু আকবার...। এবার বেশ জোরেই আওয়াজ ওঠে।

হাশমতউল্লাহ্ বলে চলেন: আমি যাগর নাম বলব, আপনেরা বলবেন, খোশআমদেদ, জিন্দাবাদ

-হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল কাহ্হার...

-খোশআমদেদ...জিন্দাবাদ...

-হযরত মাওলানা মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন...

-খোশআমদেদ...জিন্দাবাদ...

-হযরত মাওলানা মোহাম্মদ মতিউর রহমান...

-খোশআমদেদ...জিন্দাবাদ...

-জালছা মোবারক...জালছা মোবারক...

-খোশআমদেদ...জিন্দাবাদ...

ধমকে ওঠেন হাশমত,

-আরে এইডাও শিখাইয়া দেওয়া লাগবি? বলেন, কামিয়াব হোউক... কামিয়াব হোউক...।

-জালছা মোবারক...জালছা মোবারক...

-কামিয়াব হোউক... কামিয়াব হোউক...

-আলহাজ্ব ইলিয়াচ লস্কর সিনিয়ার মাদ্রাসা...

-কামিয়াব হোউক... কামিয়াব হোউক...

আরে বহুত ল্যাঠায় পড়লাম দেখতাছি এই জাহেলগেরে নিয়া! এত নামিদামি মেহমানগের সামনে ইজ্জত আর থাকে না! কপালের ঘাম মুছে চেঁচিয়ে ওঠেন হাশমতউল্লাহ্, আরে বলেন জিন্দাবাদ...জিন্দাবাদ...। আগে কুনো সমায় জালছায় হাজির হন নাই নাকি আল্লার বান্দারা, অ্যাঁ...? নাটকের মত আগেভাগে রিহারস্যাল দেওয়া দরকার আছিল মনে হয়!

-আলহাজ্ব ইলিয়াচ লস্কর সিনিয়ার মাদ্রাসা...

-জিন্দাবাদ...জিন্দাবাদ...


ধীর পায়ে সার বেঁধে মঞ্চে এসে ওঠেন মেহমান মাওলানা মাশায়েখরা। একে একে আসন গ্রহণ করেন। হাজেরানে মজলিশ নড়ে চড়ে বসে, খস খস আওয়াজ ওঠে তাদের পাছার সঙ্গে খড়ের ঘষাঘষিতে। কেউ কেউ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মঞ্চে উপবিষ্ট বুজুর্গানদের পানে। কী নুরানি চেহারা, আহা! বিশেষ করে হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল কাহ্হারের। মনে হয় চেহারা থেকে যেন রহমতের নুর চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে! ডান গালে মস্ত এক মাশ, তবলার কালো গাবয়ের মত -- ভাবে মোহাম্মদ আনসার। নও-মুসলিম। আগে নাম ছিল আনন্দ কুমার দাস। তবলচি হিসেবে এলাকায় ভালোই নাম ছিল ওর। এক মুসলমান মেয়ের প্রেমে পড়ে ত্যাগ করে ধর্ম। পুরনো মুসলমানদের থেকে এখন ও বেশি পরহেজগার। বয়স চল্লিশ পার না-হতেই কপালে সালাত আদায়ের কালো চিহ্ন। নও-মুসলিম কল্যাণ সমিতি ওকে এক শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকে চাকরি জুটিয়ে দিয়েছে। দিব্যি আরামেই কাটছে ওর দিনকাল। হাশমতউল্লার বাড়ির কাছাকাছি একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে আনসার। 

ওয়াজকারীদের একেকজনের পরনে একেক লেবাস -- কারও সাদা ঢোলা পাঞ্জাবি, পায়ের গিঠ পর্যন্ত ঝোলানো, কারও সবুজ জরিদার আলখাল্লা, কারও মাথায় কিস্তি টুপি, কারও কারুকার্যখচিত গোল টুপি, কারও বা পাগড়ি। শীত এখনও তেমন জাঁকিয়ে না এলেও মৌলানা কাহ্হার গায়ে চাপিয়েছেন দামি কাশ্মিরি শাল -- ক’দিন আগে হিন্দুস্থান সফরের সময় বজরং পার্টির স্থানীয় এক নেতা কালাকৃষ্ণ চাঁদমানি উপহার দিয়েছিলেন। এ-পর্যন্ত একশ বায়াত্তর জন শালটিতে আঙ্গুল ছুঁইয়ে প্রশংসা করেছে, আহ্ কী জিনিস একখানা! এখানে আসার পরও জনা সাতেক অনুরাগী শালটা ছুঁয়ে তারিফ করেছে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলেছেন: কয়দিন যাবত জ্বর জ্বর লাগতেছে। এই সময়টা বহুত খারাপ; কখনও গরম, কখনও আবার ঠান্ডা --সহ্য হয় না। তকলিফ, বহুত তকলিফ! অন্যদের কাঁধে হাজি রুমাল। প্রত্যেকের শরীর থেকে ভুরভুরিয়ে বেরোচ্ছে আতরের কড়া বাসনা। কারও কারও হাতে হরেক পদের পাথর বসানো আংটি। মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বারবার অযথাই হাত নাড়ছিলেন এবং তাতে ইলেকটেরি বাত্তির আলোতে তার কব্জিতে ঝোলানো সদ্যকেনা দামি ঘড়ি আর আঙ্গুলে গলানো মদিনা মনোয়ারা থেকে আনা কিমতি জওহরের আংটি ঝকমক করছিল, যেমন রাত্তিরে জ্বলে শেয়ালের চোখ।


১.গ


ওয়াজ শুরু হয় এবং তা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। একেক ওয়াজকারী একেক বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন। তবে সবার আলোচনার মূল সুর, দেশে ইসলামি হুকুমত কায়েমের বিকল্প নেই। আর দেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করার মূল বাহিনী হল মাদ্রাসার তালেবেলেমরা। তবে উপস্থিত শ্রোতাদের আবেগকে নাড়া দিতে না পারলে আবার মাদ্রাসার তহবিল গঠন করা যাবে না। সেজন্য দরকার এমন প্রসঙ্গ যা ওই কাজটি ভালোমত করতে পারে। ভাগ্যই বলতে হয়, জলসার সময়টা পড়েছে মহরম মাসে। অথবা ইচ্ছা করেই হয়তো মহরম মাসে ফেলা হয়েছে।

শুরুতে দরাজ গলায় ওয়াজের সূত্রপাত করেন হাশমতউল্লাহ্। বয়সে সবার চেয়ে খুব ছোট না হলেও খ্যাতিতে অনেক পিছিয়ে, এ-ব্যাপারটা তিনি নিজেও বোঝেন। এলাকার বাইরে কোনও বড় জলসায় এখনও দাওয়াত পান না হাশমত। আর এটাই তো রেওয়াজ, যাঁরা গুরুত্বের বিচারে পেছনে ওয়াজ বা বক্তৃতার তালিকায় তাঁরা থাকেন সবার আগে। হাশমতের ওয়াজের সময় ঘাড় ফিরিয়ে বারবার তাকাচ্ছিলেন বাইরে থেকে আসা আলেমেরা। বাহ্, গলা বটে একখানা! ওয়াজের বিষয়বস্তুটাও চমৎকার বেছে নিয়েছেন। মেয়েলোকের চালচলন, পর্দাপুশিদা, কর্তব্যকর্ম। সুরা আন-নিসা থেকে অনর্গল উদ্ধৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। কোরআনে হাফেজ। মেয়েলোকের বাড়াবাড়ি নিয়ে দস্তুরমত পনের-বিশ মিনিট এমন সুন্দরভাবে গুছিয়ে ওয়াজ করলেন যে, ক্যাসেট করে ওই ওয়াজ দেশময় প্রচার করলে দেশে এই যে দিনকে দিন জেনা আর ধর্ষণ বেড়েই চলেছে, পত্রিকা খুললেই ধর্ষণের খবর, ইশকুলের কলেজের মাস্টাররা ছাত্রীদের করছে ধর্ষণ; শুধু কী ধর্ষণ, মোবাইল ফোনে সেই কুকামের ভিডিও না কী জানি কয়, করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। আল্লার এবাদত বাদ দিয়া মোবাইলে গানা-ভিডিও, হিন্দি ফিলিমে বাজার সয়লাব, নাউজুবিল্লাহ, হিন্দি সিনিমার কী উলঙ্গ নাচ! আরও কত কী শোনা যায়, বাজারে নাকি একেবারে আসল কামের ছবিঅলা সিডি পাওয়া যায়। তার এই নসিহতে এসব অনাচার একদম নির্মূল না হলেও কমে যাবে অনেকাংশে, ইনশাল্লাহ্।

তবে মওলানা মতিউর রহমান মহরম মাসের যে ফজিলত বর্ণনা করলেন তা সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করল। কিছুটা বিষাদ সিন্ধু কিছুটা অজানা ইতিহাস থেকে নেওয়া। ফেরেস্তাদের মধ্যে যেমন জিনের বাচ্চা ইবলিস লুকিয়ে ছিল তেমনি রাসুলুল্লাহ সাল্লালাইহি আলাইহিস সালামের সাহাবাদের মধ্যে ছিল মাবিয়া। কীভাবে মাবিয়া এজিদকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় বসায়, কীভাবে এজিদ রাসুলের পেয়ারা দুই নাতিকে সপরিবার হত্যা করে তার নিখুঁত বর্ণনা। একজনকে বিষ প্রয়োগে আর অন্যজনকে আহা, কারবালার মরুপ্রান্তরে, আহা! ইমাম হোসেনকে কী নির্মমভাবে কতল করা হয় সে বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি নিজেই বারবার কেঁদে ফেলছিলেন। শ্রোতারাও কেঁদে জারেজার। জলসা যেন বিশাল এক মরাকান্নার মচ্ছবে রূপ নিল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে কান্না থামার পর মওলানা মতিউর রহমান যখন রাসুলের ঘর অর্থাৎ মাদ্রাসার জন্য সাহায্য চাইলেন তখন চারদিক থেকে পাঁচশো, হাজার টাকার ঘোষণা আসতে থাকল। কেউ পাঁচ বস্তা সিমেন্ট, কেউ তিন মণ চাল, আবার কেউ বা দুই বান টিন সদকার নিয়ত করল। মঞ্চ থেকে মারহাবা, মাশাল্লাহ্, জিন্দাবাদ জাতীয় ধ্বনি আকাশ-বাতাস কাঁপাতে লাগল। শুধু দাতা নয়, তার মরহুম আত্মীয়-স্বজনদের নামও উচ্চারিত হল, আল্লাহ্ পাক পারওয়ারদেগারের কাছে দোআ চাওয়া হল তাদের রুহের মাগফেরাতের জন্য।

রাত একটা ত্রিশ মিনিট কিংবা একটু বেশিও হতে পারে, জলসা সাঙ্গ হল।



২.ক


গতরাতের জলসায় আশাতিরিক্ত সাফল্যে মনটা ফুরফুরে হাশমতউল্লার।

বাড়ির দাওয়ায় বসে সামনের আনাজ আর গাছগাছালির দিকে চোখ ফেলে নানা কথা ভাবছিলেন হাশমত। আগ-আগনের পাতলা কুয়াশায় ধানের জমি ঝাপসা দেখা যায়। নিচু জমি, বর্ষায় পানি জমে কোমর বরাবর, বছরে ফসল ওঠে তিনবার। দু’বার ধান, আমন বোরো, একবার কলাই। ধান কাটা শেষ বেশ কদিন আগেই --কাটা ধানের নাড়া আর জড়ো-করা শুকনো কচুরিপানায় আগুন জ্বালিয়ে ছাই করা হয় -- ভালো সারের কাজ করে এই ছাই।

জাংলায় ঝাপিয়ে এসেছে লাউ। আল্লার কী কুদরত দেখ, লাউগাছ যে লাউগাছ তারও ডগা কিনা হাতির শুঁড়ের মত কঞ্চি পেঁচিয়ে জাংলায় উঠে ওটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে দিব্যি নিশ্চিন্তে। কচি লাউয়ের মসৃণ গা যেন সদ্য জোয়ানকি-আসা মেয়েমানুষের গতর। জাংলা গলিয়ে নিচে ঝুলে আছে কত যে ছোট বড় লাউ।

হাশমতউল্লাহ্ উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকেন সম্মুখের জমিনের দিকে।

মনে হয় এই তো সেদিনকার কথা, জোয়ান হাশমতউল্লাহ্; সুদর্শন পুরুষ, লম্বা একহারা গড়ন, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, খাড়া নাক, চওড়া রোমশ বুক। গাল জুড়ে আরব দেশের ঘোড়ার কেশরের মত ঘন কালো চাপ-দাড়ি। ছোট করে ছাটা গোফের নিচে পাতলা ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ধবধবে দাঁতের সারি ঝিলিক দিত কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে। আল্লার নেক বান্দা হিসেবে সমাজের সবারই অগাধ শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য ছিল তাঁর ওপর।

আনসারের ঘটনাটাই ধরা যাক না কেন। আনসার, অর্থাৎ আনন্দ তবলচি যখন কুলসুমের প্রেমে পড়ে লুকিয়ে নিকা করল; সমাজে ঢিঢি তো কম পড়েনি। এক নিচু জাতের মালাউন কিনা খন্দকার বংশের অমন খুবসুরত মেয়েটাকে কব্জা করল! সালিশ বিচার বসেছিল বিষয়টি নিয়ে। ফয়সালার ভার গড়িয়েছিল শেষপর্যন্ত হাশমতের ওপর। একসময় কুলসুমের জন্য পাগল ছিলেন হাশমত। বয়সের তফাত অনেক, দোজবর, তদুপরি বংশমর্যাদায়ও অনেক নিচে; কোনওভাবেই রাজি করানো যায়নি কুলসুমের আব্বা খন্দকার মোক্তাদির সাহেবকে।

বিচারে কোনও পক্ষপাতিত্ব করেননি মোহাম্মদ হাশমতউল্লাহ্। বিচারের আগে তাঁর প্রস্তাবে অনেক ওজর-আপত্তি, গড়িমসি করেও বাধ্য হয়ে শেষ অব্দি রাজি হয়েছিল কুলসুম। বিচার হয়েছিল অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং ধর্মের অনুকূলে। একজন কাফেরকে দ্বিন ইসলামে নিয়ে এসে ভারি সওয়াবের কাজ করেছে কুলসুম।


আজ বয়সের ভারে কোথায় হারিয়ে গেছে চেহারার সে দ্যুতি -- ফরসা মুখের বালিয়াড়িতে সময়ের অমোঘ স্পর্শে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বাঁকাচোরা খাঁজ। পান খাওয়ার অভ্যাস করায় দাঁতের দেওয়ালে পড়েছে লালচে ছোপ। 




২.খ 


এক মাঝারি কৃষক পরিবারে জন্ম মোহাম্মদ হাশমতউল্লার। পিতা আফাজ আলী পরামানিকের বিঘা বিশেক নিজস্ব ভুঁই --বাদবাকি অন্যের জমিতে বর্গা চাষ। থাকার মধ্যে বউ, ছোট ভাই আর একমাত্র ছেলে হাশমত --বাপ আদর করে ডাকেন মতি, হাশমত থেকে মতি। প্রশ্ন উঠতে পারে হাশু না হয়ে মতি হল কেন। হাশু ছিল পরামানিকের জান্নাতবাসিনী বড় বোনের ডাকনাম; ও নামে ডাকা অতি বেয়াদবি। তাই মতি। আমরা এখন থেকে জনাব মোহাম্মদ হাশমতউল্লাহকে মতি বলে ডাকব, এবং এটাতে তেমন কোনও অন্যায় হবে বলে আমাদের মনে হয় না। 

মতিকে দ্বিনি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার নিয়ত ছিল পিতার। প্রত্যন্ত পাড়াগাঁ হাংড়াগাড়ির ফোরকানিয়া, যাকে বর্তমানে এবতেদায়ি বলা হয়, মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল তাকে। বাপের ইচ্ছা ব্যর্থ হয়নি। ভালো ছাত্র হিসাবে মতি ক্লাসে বরাবর এক নম্বর। তরতর করে উতরে যেতে থাকে সবগুলো ধাপ। আল্লার রহমতে গলাও পেয়েছে একখানা! অমন দরাজ গলা হাংড়াগাড়ি তো হাংড়াগাড়ি আশপাশের দশ গ্রামেও খুঁজে পাওয়া ভার। 

মাদ্রাসায় পড়লেও মতির কজন বন্ধু ছিল ইশকুল পড়ুয়া। আড্ডাটা জমত ওদের সঙ্গে। সুযোগ পেলেই বন্ধুদের নিয়ে চলে যেত পিপুলশীলা বিলপাড়ের যে বুড়ো বটগাছটা আছে তার নিচে জেলেদের ছোট্ট ছাপড়ায়। গান ধরত গলা ছেড়ে; সিনেমার আধুনিক গান। শ্যামল মিত্রের গান ছিল তার খুব প্রিয়। সাগরিকা সিনেমার সবগুলো গান ছিল ঠোঁটের ডগায় --আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে...। বন্ধুদের মধ্যে মকবুলের গলাটাও মন্দ ছিল না। ওর আবার প্রিয় গায়ক আহমদ রুশদি। প্রথম প্রথম মতিকে ঠেস দিয়ে বলত: তুই পড়স্ মাদ্রাসায়, গানা-বাজানা তো নাজায়েজ তোগোর জন্যি। কথাডা কি মিছা কইলাম? 

-মাদ্রাসায় তো পড়ি বা’জানের ইচ্ছায়। নাজায়েজ-ফাজায়েজ বুজি না। ভালো লাগে, গাই। আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, সাত সাগর আর তের নদীর পাড়ে...। 

-তো রাজকইন্যাডা কেডা? তোগোর বাড়ির কাছের পরিবানু নি কুনো? দেখতে তো হে পরির লাহানই...। 

-কী যে কস্। অ তো অহনও গেদি। অহনও বুকই জাগে নাই। তোর যা কথা! 

-টিপি দিলি দেখতি দেখতি সব জাগপি, বুজিছিস্? 

-তুই খুব অসভ্য! মতির ফরসা মুখ লাল হয়ে ওঠে। 

-ধুর, ভোদা...!

-আসলেই তুই খুব অসভ্য, খালি ভোদা ভোদা করিস, বালা কতা মুখে আসে না... 

-ক দেখি, ভোদা কোন ভাষা?

-কোন ভাষা আবার, মেয়ালোকের ওইডার গেরাইম্যা ভাষা...

-তোরে কইছে...। হেদিন দুই মাস্টর বলতিছিল, ভোদা অইল গিয়া আরবি ভাষা, বুদয়াহ্ --আমি শুইন্যা তো আরশয্য...। ধোনের আরবি কি হেইডা যদিল বলত...। 

-আরবি শব্দ হলিই কি সব বালা অয়...?

-বালা অইব না মানে! তুই চুনা দিয়া রাস্তার উপরে আরবিত্ বুদয়াহ্ লেইখ্যা রাখিছ, কেউ পাড়ায়নি দেখিছ! হক্কলে কী তমিজ কইরা ওইটা দেখপো আর যে লিখছে তার মা-বাপ তুইলা গাইল পারব। হ! আরবি অইল আল্লাহ্ পাকের ভাষা। আল্লায় জিব্রাইল আলাইহিস সালামরে দিয়া এই ভাষায় কালাম পাডায় নাই রাসুলুল্লার কাছে?

-অ, কতাডা হাচাই ...। ভুরু কুঁচকে বলে মতি। ভাবে, অথচ ভালো ভালো আরবি শব্দ, আল্লার কালাম, আহা, পায়খানার গুয়ের মধ্যে লুটোপুটি খেতে দেখেছে সে! মাদ্রাসার ফাজিল ম্যাট্রিক, বর্তমানে দাখিল, এমতেহানের সময় আরবিতে টোকা নকল পেশাব ফেরবার অছিলায় এসে কাঁচা পায়খানায় গড়গড়িয়ে ঢেলে দিতে দেখেছে কত তলেবেলেমকে! খারাপ লেগেছে; কিন্তু করার কী আছে! পরীক্ষায় পাশ না করলে ভবিষ্যৎ ঝরঝরা -- গরিব বাপ আশা করে বসে আছে, পোলা তার দ্বিনি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়া আখেরাতের জন্যি সোয়াব আর দুনিয়ায় উন্নতির জন্যি ভালোই পয়সা কামাবি! মিলাদ পড়ালিও তো কম আসে না, আর যদি দামি মৌলানা হবার পারে তা হলি তো কথাই নাই। আরবি জানলি সৌদিয়ায় যাওয়াও নাকি সহজ। 



২.গ


বয়স তো কম হল না মতির; বা’জান বলতেন, ওর যখন জন্ম --বাংলা ভাষা নিয়ে তখন খুব গণ্ডগোল চলছিল দেশে; ১৩৫৮ কি ৫৯ বাংলা। কিন্তু মনে হয়, এই তো সেদিনকার কথা, মাদ্রাসার ছাত্র সে। জীবনের ঘটনাগুলো কত দ্রুতই না ঘটে যায়। কত ক্ষুদ্রই না দুনিয়াবি এই জীবন, হায়! অনন্ত আখেরাতে আল্লাহ্পাক কী রেখেছে তার নসিবে কে জানে। আখেরাতটা কেমন? কোরআন মজিদে খুব ব্যাপক ব্যাখ্যা তো নেই। বেহেস্ত, যার পাদদেশে সুশীতল নদী প্রবাহিত -- জান্নাতিন তাজরি মিন তাহ্তিহাল আনহার; সুরা বাকারাসহ বেশ কটা সুরায় এ-বর্ণনা আছে।

মতিদের বাড়ির পাশ দিয়েও প্রবাহিত ক্ষীণস্রোতা নদী। বর্ষায় আবশ্য দু-কূল ফুলে-ফেঁপে উঠত সেই নদীর আর তার ঘুর্ণিস্রোত দেখে ভয় পেত বালক হাশমত। বাড়ির পেছনের বেতের ঝোপ থেকে রাতের বেলা ডাহুকের ডুব্ ডুব্ ডাক ভেসে আসত। কদমগাছ সেজে উঠত কদমফুলের ঝুমকো পড়ে।


সালেহা চাচির কানের ঝুমকোটাও ছিল কিছুটা কদমফুলের আদলে গড়া। সালেহা চাচির স্মৃতি মনে এলে এখনও --তা প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরও -- মনের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। পুলক আর কেমন যেন এক অনুভূতি মনের মধ্যে জড়াজড়ি করে আকুলি বিকুলি তোলে। দেখতে ভালোই ছিলেন সালেহা চাচি। গায়ের রং কিছুটা ময়লা; তাতে কী, মুখের গড়ন বল আর চোখের ধরন, তার ওপর আবার থুতনির বামদিকে সর্ষেদানা তিল -- সব মিলিয়ে চাচিকে ভালোই দেখাত। তাছাড়া পুরুষ মানুষের একটা বয়স থাকে যখন কোনও মেয়েমানুষকে বেশিদিন কাছ থেকে দেখলে চোখে ঘোর লাগে।

চাচি প্রসঙ্গ যখন এল তখন একজন চাচা থাকা জরুরি। মতির চাচা, বাপের ছোট ভাই কোব্বাদ আলী পরামানিক সৌদি আরবে চাকরি করেন -- ট্রাক-ড্রাইভার। দেশে যখন ছিলেন, থাকতেন আফাজ মিয়ার সঙ্গেই। বছর খানেক আগে দেশে এসে দেওভোগ গ্রামের মরহুম আজিমুদ্দিন সরকারের একমাত্র কন্যা মোসাম্মাৎ সালেহা পারভিনকে শাদি করেন কোব্বাদ। বিয়েটা ছিল বড় ভাইয়ের পছন্দ মাফিক। খানদানি ও পরহেজগার পরিবারের মেয়ে। মরহুম আজিমুদ্দিন অত্র এলাকার মধ্যে ছিলেন অত্যন্ত সম্মানীত এক ব্যক্তি। দেওভোগ জামে মসজিদের ইমাম। তদুপরি নক্সবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার কামেল পিরের বায়েতপ্রাপ্ত। মুরিদ তাঁরও কম ছিল না একেবারে। 

শাদির পর মাস খানেক দেশে কাটিয়ে কোব্বাদ আবার পাড়ি দিয়েছিলেন পবিত্র সৌদি আরবে। যেতে কী মন চায়। কিন্তু রুজি-রোজগার আসল জিনিস। ভালো রোজগার করতি না পারলি কি অমন ঘরের মেয়া জুটত ওর কপালে?

মতি তখন ফাজিল ম্যাট্রিক-এর ছাত্র। সবে মোচের রেখা গাঢ় হতে শুরু করেছে; রেশমের মত মিহিন দাড়ির অঙ্কুরোদ্গম নজর এড়ায় না।

বাড়ির বাইরে ল্যাংড়া আমের গাছ ঘেষে যে বৈঠকখানা ঘরটি, কিছুদিন হল ওটাতেই থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে মতির। কোব্বাদ চলে যাওয়ার পর থেকে এই ব্যবস্থা। নতুন বউকে তো আর বাইরবাড়ি থাকতে দেওয়া যায় না।

নতুন ঘরে অস্বস্তি লাগে। রাতে ঘুম আসতে চায় না। আসবে কী করে। নিঝুম বাড়িতে বিচ্ছিন্ন একটা ঘরে একাকী থাকা ওই বয়সে কি সহজ? ভয় ভয় করে। বাপকে জানিয়েছে সমস্যাটা, বলেছে: বা’জান আমার একা একা থাকতি ডর লাগে। 

আশ্বস্ত করেছেন বা’জান: ডর কি আব্বা, এই বাড়ি বান্ধা আছে আল্লার কালাম দিয়া। খারাপ কিছু সান্দাইতে পারব না।

মতি তবু তোতলায়: রাইতে নিম পাখি ডাকে --আমার খুব ডর করে বা’জান। আপনে নিম পাখি দূর করার একটা বেবস্থা করতে পারেন না -- আল্লার কালাম দিয়া? 

আফাজ তেতুলবিচি দাঁত বার করে হাসেন: পাগল আর কারে কয়, নিমপাখি তো পেঁচার আরেক নাম। ডাইকলে ডরানির কী আছে, হেহ্?

-আম্মায় যে কয়, নিমপাখি ডাইকলে নাকি অমঙ্গল হয়...।

-তোমার মায়ে জানে কী! জাহেল মেয়ামানুষ। নিমপাখি -- পেঁচা তো উপকারী পক্ষি, হিঁদুরা কয় লক্ষ্মীর বাহন -- হে হে হে...। তারপরও ডরাইলে আয়াতুল কুরসি পইড়া বুকে তিনবার ফুঁ দিলেই সব জ্বিন-ভূত লেজ তুইলা পলাইব।

তবু ভয় কাটে না মতির। নিম পাখির ডাকের মধ্যে কেমন যেন ভৌতিক ভাব। গা ছমছম করে। আরও তো অনেক পাখিই আছে, এমনভাবে ডাকে না তো কেউ!

বা’জানের বাতলে দেওয়া আয়াত পড়ে বুকে তিনবার ফুঁ দিয়ে আমকাঠের চৌকিটাতে শুয়ে পড়ে মতি।



২.ঘ


সালেহা চাচি খুবই পরহেজগার। নামাজ ক্বাজা করেন না কখনও। এমনকী বেতেরের তিন রাকাত ওয়াজিব আদায় না করে বিছানায় যান না। সালাত আদায়ের পর অনেকক্ষণ ধরে খুব অনুচ্চ স্বরে গুনগুনিয়ে কোরআন থেকে তেলওয়াত করেন। কখনও মিনমিনে সুরে, কখনও বা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেও শোনা যায়। কেন? খোদা মালুম! এ-বাড়িতে ওর তো কোনও কিছুর অভাব নেই। ভাসুর-ভাবি দুজনেরই খুব প্রিয়।

পর্দাপুশিদায়ও ষোল-আনা সালেহা। ভাস্তে হলে কী হবে, মতি এখন বালেগ, ওর সামনেও কোনও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘোমটা খোলেন না। কাজে-কম্মে এত পটু, ভাবতেও অবাক লাগে! সন্ধ্যাবেলায় বৈঠকখানায় হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে যান; মাঝমধ্যে গুছিয়েও দেন মতির বইপত্তর, এটা ওটা।

চাচি এ-সংসারে আসার পর মতির পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ আগের চেয়েও বেড়ে গেছে। সকাল সকাল বেরিয়ে যায় মাদ্রাসার উদ্দেশে। কেলাশ শেষ হলেই ফিরে আসে বাড়িতে। আড্ডা-টাড্ডা মারা যেন ভুলেই গেছে ইদানীং। হ্যাঁ, তবে এখনও কেরাতের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি। সামনেই মাদ্রাসার বার্ষিক কেরাত প্রতিযোগিতা। জেদ চেপেছে ওর, ফার্স্ট ওকে হতেই হবে। ওর মত গলা আর আছে কার, এখন যা দরকার তা হল আরবি উচ্চারণ আরও সহিভাবে রপ্ত করা। তাছাড়া কেরাত তো আর কোরআন খতমের মত দ্রুতপঠন -- যাকে বলে হদব নয়, সহিভাবে মাদে মুত্তাসিল আর মোতলাক দিয়ে তাজবিদসহ তারতিল, মানে সঠিক বিরতি দিয়ে টেনে টেনে পড়াকেই তো কেরাত বলে। হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্ --প্রতিযোগিতার আরও তো বেশ ক’মাস বাকি। 

মাদ্রাসা ছুটি হলে সরাসরি বাড়ি -- সাফসুতরো হয়ে মুখে চারটে গুঁজেই লেগে পড়ে কেরাত অনুশীলনে। আহা, কী সুললিত কণ্ঠ, লোকে যাকে বলে কোকিলকণ্ঠ।

-দেখছ, শুনছ ও মতির আম্মা, শুনছ গো বউমা, কী গলা বাচ্চাডার --মাশাল্লাহ্! ছেলের প্রশংসায় গদগদ গলায় বলেন আফাজ মিয়া।

মতির মা হেঁসেলের বারান্দায় বসে ধারালো বটিতে নওলা মাছ কোটেন। শাক বাছতে বাছতে বউমা চোখ পিটপিটিয়ে মুচকি হাসেন।


এখন প্রায় প্রতিদিন চিমনি ঘষেমেজে হারিকেন বাতিটা মতির পড়ার টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখেন সালেহা। সেদিনও বাতিটা রাখতে রাখতে বলেছিলেন তিনি: তোমার কেরাত খুব সুন্দর...কী গলা, আল্লাপাকের নেয়ামত!

মতি মুখ তুলে তাকায় ঘোমটা ফেলা চাচির দিকে। বলতে চায়: আপনের ভালো লাগে...? কিন্তু কথা বেরোয় না গলা চিরে। খুক্খুক্ শুকনো কাশির শব্দ বেরোয় কেবল। মনে মনে ভাবে, আল্লায় নিজ হাতে বানাইছে মনে হয় চাচিরে -- খুব যত্ন কইরা...।

সৌদি যাওয়ার পর প্রথমদিকে দশ পনেরো দিন পর পরই চিঠি আসত কোব্বাদ মিয়ার; সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চিঠি আসার বিরতিও বাড়তে থাকে। শেষ চিঠিতে লিখেছেন কোব্বাদ, দেশে ফিরতে আরও বছর খানেক লেগে যেতে পারে --এর আগে ছুটি মিলবে বলে মনে হয় না। শেষ চিঠিটা পড়ে সালেহার মুখ মলিন হয়ে ওঠে। এক বচ্ছর! আবার একটু খুশিও হন, যখন জানতে পারেন কোব্বাদ আলী মাঝে মাঝেই কাবা শরিফে গিয়ে তাঁর জন্য দোআ করেন আল্লাহ্পাকের দরবারে। আল্লার মহাপবিত্র ঘরে গিয়ে দোআ -- কজনের ভাগ্যে জোটে!



৩.ক


বোশেখ মাসের ঝাঁঝাঁ রোদ্দুরে মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফিরতে কাহিল কাহিল লাগে। সবুজ রঙের লম্বা ঝুল পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে সপসপে --শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। বড়াল নদীতে ছিলছিলে পানি। স্বচ্ছ পানির নিচে ঢেউ খেলানো বালির গতর দেখা যায়। স্থানে স্থানে জমে আছে কচুরি আর খুদে পানা। আশে পাশের গাঁয়ের লোকেরা দোয়ার পেতেছে সারি সারি -- যদি বাধে কিছু মাছ এই আশায়। যা-ই পায় তা-ই লাভ। নদীর পাশ ঘেঁষে সরু পথ ধরে হাঁটতে থাকে মতি। নারায়ণপুরের বাঁকটাতে নদীর ওপর ব্রিজ বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঠিকাদারের মাল-সামানা নদীর তীরে স্তূপ দিয়ে রাখা। অস্থায়ী ছাপরায় লেবার আর মিস্ত্রিদের ত্রস্ত ছোটাছুটি। বর্ষা আসার আগেই ব্রিজের পিলারগুলোর ঢালাই এমন পর্যায়ে নিতে হবে যাতে বর্ষায় কাজের কোনও অসুবিধা না হয়। পাইলিঙের কাজ চলছে জোরেসোরে। আরসিসি ঢালাই করা লম্বা লম্বা খাম্বাগুলো, যাকে বলা হয় প্রিকাস্ট পাইল, ধীরে ধীরে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্রিজের পিলার তৈরির জায়গাগুলোতে। মতি ঠায় দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে পাইলিঙের কাজ। আগে কখনও এরকম কাজ দেখেনি তো। আশ্চর্য হয়ে দেখে, অনেক উঁচু থেকে বেশ বড়সড় একখণ্ড লোহা এসে পড়ছে সিমেন্টের খুঁটির ওপর। শব্দ উঠছে ঢপস্, এ-জাতীয় কিছু। একটা মোটা রড ওই লোহার ফুটোর ভেতর দিয়ে উঠে গেছে অনেক দূর। লোহার মুগুরটাকে সোজা রেখে ঠিক জায়গায় আঘাত করবার কী অব্যর্থ কৌশল! পরে জিজ্ঞেস করে জেনেছিল, ওই মুগুরটাকে নাকি মাংকি বলে। মাংকি মানে তো বাঁদর। ওটা বাঁদর হল কী কারণে? বেশি লাফালাফি করে তাই বোধ হয় ওর কপালে জুটেছে অমন হাস্যকর প্রাণীর নাম!



৩.খ


ভাগ্য ভালোই বলতে হয়; বাড়ি ফিরতে না ফিরতে আকাশ ছাওয়া কালো মেঘ। কালবোশেখির ছোবল নয়তো! প্রায় দৌড়নোর গতিতে বাড়ি এসে পৌঁছে মতি। বৈঠকখানায় ঢুকে কাপড় পাল্টে বাইরে বেরোতে যাবে, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আর শোঁ শোঁ বাতাস। ঘরের চালের ওপর অবিরাম ঢিলের শব্দ। মতি টের পায় বোঁটা ছিঁড়ে পড়ছে ল্যাংড়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটে আসতে দেখা যায় চাচিকে, চটের বস্তা হাতে নিয়ে। ঝটপট কুড়াতে থাকেন আম --দেরি হলে আশপাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসবে এক দঙ্গল ছেলেপুলে, এমনকী বয়স্ক মেয়েলোকেরাও। ঝড়ে আম পড়লে বা বন্যায় পুকুর ভেসে গেলে আম কুড়াতে বা মাছ ধরে নিতে আইনে কোনও বাধা নেই। সামাজিক এই আইনটা এখানে চালু কোন কাল থেকে বলতে পারবে না কেউ। তারপরও ঠেকানোর চেষ্টা যে চলে না তা নয়; অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ হয়; কেউ পাত্তা দিলে তো!

মতি একবার ভাবে, যাবে নাকি আম কুড়ানোতে সাহায্য করতে, আবার পিছিয়ে যায় চাচির অবস্থা দেখে। বৃষ্টিতে ভিজে একশা -- পরনের ফিনফিনে কাপড় এমনভাবে লেপ্টে আছে যে, শরীরের সমস্ত ভাঁজ স্পষ্ট নজরে আসে। আহা, কী চমৎকার দেহ একখান --বৈঠকখানার জানালা ঈষৎ ফাঁক করে একমনে দেখতে থাকে মতি। হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পায় সে, ছিঃ, একি করছি আমি! কাজটা মোটেই ঠিক নয়, নাউজুবিল্লাহ্!

চাচি আম কুড়িয়ে চলে যাওয়ার পর মতি বাইরে বেরিয়ে আসে। প্রাণভরে গোসল করে বৃষ্টির পানিতে। বছরের প্রথম বারিশ, ঠান্ডা-টলটলে পানিতে অনেকক্ষণ ধরে ভিজে গা জুড়িয়ে নেয় মতি। পুকুরে গোসলে কি এ মজা আছে?



৩.গ


সেই যে দুদিন আগে জ্বর এসেছিল মতির এখনও যাওয়ার নাম নেই। গ্রাম-ডাক্তার জ্বর মেপেছেন, নাড়ি টিপেছেন, স্টেথো না কি জানি বলে যন্ত্রটা দিয়ে বুক পরীক্ষা করেছেন, জিহ্বা দেখেছেন তারপর ওসুধ দিয়ে আফাজ আলীকে বলেছেন: মনে হয় সাধারণ জ্বর; সাইরা যাইব এই দাওয়া খাইলেই। না সারলে দেখা কইরেন তিনদিন পরে।

ডাক্তার ঠিকই ধরেছিলেন, তিনদিনের দিন জ্বর কমতে থাকে। জ্বর সেরে গেলেও মুখ বিস্বাদ -- ভাত, ফল-ফলারি, দুধ কিছুই মুখে রোচে না। পানি খেতেও অভক্তি লাগে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে মতির।

অসুস্থতার এই দিন কটা সেবা-যত্নের ত্রুটি করেননি সালেহা; জ্বরের সময় মাথায় পানি ঢালা, কপালে জলপট্টি দেওয়া। মা-ও করেছেন দেখাশোনা, তবে তা কেবল রাতের বেলাটুকু; ঘুমিয়ে পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত।

বাইরে মেঘের গর্জন, বিজলির ক্ষণে ক্ষণে তীব্র ঝলকানি, টিনের চালে বৃষ্টির বড় বড় ফোটার আওয়াজ। চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে নিথর শুয়ে ছিল মতি। কোন ফাঁকে চাচি এসেছেন টেরই পায়নি। ওর মাথার পাশে মোড়া টেনে বসে মাথায় হাত বোলাতে থাকেন চাচি। সাঁঝ পেরিয়ে গেছে নাকি, বোঝা যায় না। আলো আঁধারির রহস্যময় খেলা ছোট্ট ঘর জুড়ে। চাচির কোমল হাতের পরশ আরাম দেয় মতিকে। কিন্তু একি! চাচির কোমল হাত ছাড়াও অন্য আর কিসের যেন স্পর্শ পায় মতি। এতটাই ঝুঁকেছেন যে, মতির কপালে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে সালেহার বুক। কেমন এক উষ্ণ অনুভূতির স্রোত বয়ে চলে মতির সারা গা বেয়ে। জ্বর কী আবার বাড়ল!

মতি অনুভব করে, আলগোছে ওর বুকের ওপর থেকে পাতলা কাপড়টা সরিয়ে ফেলেছেন চাচি। উদোম বুকে হাত বোলাচ্ছেন পরম সোহাগে। চাচির নিশ্বাসের হাওয়াতে কিসের গন্ধ! ক্রমেই তলিয়ে যেতে থাকে মতি অজানা এক জগতে। চাচির হাতের সচলতা ক্রমশ বেড়েই চলে। বুক পেরিয়ে, নাভি পেরিয়ে গিয়ে থামে এমন এক স্থানে যেখানে কোনও নারীহস্ত এতদিন প্রবেশাধিকার পায়নি। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা বা অস্বস্তিতে নড়ে ওঠে মতি। আপত্তি জানায়। ছোট্ট এক টুকরো শব্দ বেরোয় ঠোঁট ফুঁড়ে ওর: নাহ্ ...উহুঁ...। কিন্তু দুর্বল এই আপত্তিকে কে গ্রাহ্য করে!

চাচির হালকা দেহখানা ওর দেহের ওপর ওঠানামা করতে থাকে, যেমন করতে দেখেছিল পাইলিঙের মাংকিকে! তারপর একসময় এলিয়ে পড়ে ওর বুকের ওপরই। মুখ থেকে কাঁপা কাঁপা অস্ফুট আওয়াজ বেরোয় কেবল: আমার সোনা... কী সুখ গো...!

বাইরে তখনো চলছে বজ্রের তেমনই গর্জন, বৃষ্টির তোড় বেড়েছে আরও একটু বেশি।

সৌদি যাওয়ার আগে যতদিন বাড়িতে ছিলেন চাচি, প্রায় প্রতিদিনই বজ্রের গর্জন হত, সেই সঙ্গে তুমুল বর্ষণ হাংড়াগাড়ির নিভৃত পল্লীর বাড়িটাতে।





এখনও বর্ষণ হলে, আকাশ ফালা ফালা করে বিজলি চমকালে মোহাম্মদ হাশমতউল্লার মনে ভেসে ওঠে আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার সেই দিনগুলোর স্মৃতি।

মোসাম্মৎ সালেহা পারভিন এখন স্থায়ীভাবে বসবাস করেন রাজধানী ঢাকা শহরে। সৌদিতে চাকরি আরও কী না কী যেন কাজ করে ভালো টাকাই বানিয়ে এনেছিলেন কোব্বাদ চাচা। দক্ষিণখানে সাড়ে তিন কাঠা জায়গার ওপর বাড়ি বানিয়েছিলেন। চাচা ইন্তেকাল করেছেন বছর তিনেক হল। নিজ বাড়িতে সুখেই আছেন চাচি। বড় ছেলেটা ভালো চাকরি করে কোন এক কম্পানিতে যেন। চাচা মারা যাওয়ার পর চাচি একবার এসেছিলেন হাংড়াগাড়ি।

জীবনের ঘটনাগুলো কত দ্রুতই না ঘটে যায়। কত ক্ষুদ্রই না দুনিয়াবি এই জীবন, হায়! অনন্ত আখেরাতে আল্লাপাক কী রেখেছে তার নসিবে কে জানে। আখেরাতটা কেমন? কোরআন মজিদে খুব ব্যাপক ব্যাখ্যা তো নেই। বেহেস্ত, যার পাদদেশে সুশীতল নদী প্রবাহিত  জান্নাতিন তাজরি মিন তাহ্তিহাল আনহার...।

আশ্বস্ত হন হাশমতউল্লাহ্, আল্লাহ্পাক সুরা আন নিসায় এরশাদ করেছেন: নিশ্চয় জেনে রেখ, আল্লার সাথে শরিক বানানোর যে পাপ তা তিনি ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্য যেকোনও পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দিতে পারেন। ইন্নাল্লাহা লাইয়াগদাফিরু আইইউসরাকা বিহি ওয়া ইয়াগিফিরু মাদুনা জালিক ওয়ামাইইউশরিক বিল্লাহি ফাক্বাদিফতারা ইসমান আজিমা।

গভীর রাতে তাহাজ্জতের নামাজ আদায় করতে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়েন। আগামী ২১ শে মাঘ, বুধবার বিলবকরি মাদ্রাসার মাঠে বিরাট ইসলামি জলসায় দাওয়াত পেয়েছেন তিনি। ওদিকে মাইকিং হচ্ছে, নিজ কানে শুনে এসেছেন: বিরাট ইসলামি জালছা, ওয়াজ ফরমাইবেন এলাকার কৃতি সন্তান হযরত আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ হাশমতইল্লাহ্ ছাহেব...।

কথাটা এতক্ষণও না জানানো আমাদের অন্যায় হয়েছে, গত বছরের আগের বছর মোহাম্মদ হাশমতউল্লাহ্ আরেকটি ফরজ্ কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। যে-জন্য তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি টাইটেল।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ