বই-আলোচনা
কিন্তু এই স্বপ্নের জগত চিরদিন রয়
------------------------------------------------
সাগর রহমান
হারুকি মুরাকামি দৌড়াতে ভালোবাসেন। এ পর্যন্ত ২৬ বার ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছেন। নিজের মেমোয়ার্সের নাম রেখেছেন - হোয়াট আই টক এবাউট হোয়েন আই টক এবাউট রানিং। ঊনত্রিশ বছরে লিখেছেন প্রথম উপন্যাস, অনেকটা অকস্মাতই। দ্য নিউ ইয়র্কারে লেখা তার ‘দ্য রানিং নভেলিষ্ট’ থেকে, তার কথা মোতাবেক জানা যায়, সময়টা দুপুর দেড়টা। এপ্রিল ১, ১৯৭৮। বিয়ার খেতে খেতে, চুরুট টানতে টানতে, ঘাসের উপর শুয়ে খেলা দেখছিলেন। হঠাৎ করেই তার মনে হলো: “ইউ নো হোয়াট? আই কুড ট্রাই রাইটিং নভেল। ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে কিছু একটা যেন ভেসে ভেসে নেমে আসছিল । সেটা যাই হোক, আমি তা গ্রহণ করেছিলাম” ( সৃষ্টিশীল মানুষদের ক্ষেত্রে এমন কোন প্রণোদনার কথাই কি এলিজাবেথ গিলবার্ট তার ‘বিগ ম্যাজিক’ বইতে উল্লেখ করেছেন?)। ব্যস, সেই শুরু। উপন্যাসটি ছিলো ‘ হিয়ার দ্যা উইণ্ড সিং’। এটি সাহিত্য পত্রিকা ‘গানজো’র নতুন লেখক পুরস্কারে সিলেক্ট হয়, এবং সেই থেকেই শুরু হয় মুরাকামির সিরিয়াস লেখালেখির, দৌড়ের প্রতি আগ্রহও। দৌড়টা নিজেকে দীর্ঘদিন ফিট রেখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়ার নিমিত্তে। মুরাকামির সাহিত্যের কথা বলতে গিয়ে যে তার দৌড়ের কথা বলতে হলো, তার কারণ, লেখালেখির প্রতি তার অদম্য নিষ্ঠা। প্রতিটি উপন্যাসেই আছে ম্যারাথন দৌড়ের আমেজ, শুরু থেকে একটা অজানা জগতের রাস্তায় নিয়ে ফেলেন পাঠককে, তারপর তার হাত ধরে দীর্ঘ ভ্রমণ। অবশ্য, প্রায়শই সে ভ্রমণ বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় শেষ হয় না, চেনা আদলের আড়ালে যে অন্য ভুবনে নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি, তার আমেজ দীর্ঘ দীর্ঘ দিন বয়ে বেড়াতে হয পাঠককে। নিজের সাহিত্য জাত এবং কাজের ধরন চেনাতে গিয়ে মুরাকামি বলেছেন: “যেসব লেখকরা লেখার জন্মগত মেধা নিয়ে জন্মান, তারা গড়গড় করে লিখতে পারেন...। প্রাকৃতিক ঝরণা থেকে উৎসারিত পানির মতো তাদের বাক্য তৈরি হতে থাকে, খুব সামান্য চেষ্টা কিংবা প্রায় কোন চেষ্টা ছাড়াই এ ধরনের লেখকরা একেকটা লেখা শেষ করে উঠতে পারেন। দূর্ভাগ্যক্রমে, আমি এ দলে পড়ি না। চিজেল (নিড়ানি) দিয়ে পাথর সরিয়ে, গভীর গর্ত খুঁড়ে আমাকে আমার সৃষ্টিশীলতার সন্ধান পেতে হয়। প্রতিবার যখন আমি নতুন উপন্যাস শুরু করি, প্রতিবারই নতুন গর্ত খুঁড়তে হয় আমাকে। কিন্তু, যেহেতু দীর্ঘ দিন ধরে এ কাজটি আমি করে চলেছি, এখন আমি শারিরীক ও প্রায়োগিকভাবে এ ধরনের গর্ত খুঁড়ে নতুন পানির শিরা সন্ধানে দক্ষ হয়ে পড়েছি। যখনি আমি দেখি একটা উৎস শুকিয়ে এসেছি, আমি অন্য উৎস সন্ধান করি... ”। প্রকৃতই ম্যারাথন দৌড়ের সামর্থ্য না থাকলে হয়তো অমন উপন্যাস লেখাই যাবে না। এবং সে শুধু দৈর্ঘের জন্য নয়, তার অদ্ভুত বিষয় প্রকরনের বিস্তারের জন্যই বলা।
কথাসাহিত্যে গল্পবলার ভঙ্গিমার গুরুত্বটি বোঝাতে গিয়ে উপন্যাসিক জন আরভিং বলেছিলেন:... a good story is like a narcotic fix. It you can inject a good one into reader’s veins, they’ll get the habit and come back to you for the next one... হারুমি মুরাকামি সম্পর্কে এ কথাটা এত সত্য যে, তার বই ‘ কাফকা অন দ্যা সোর’ পড়ে পাঠকের মনে (পড়তে পারেন, শিরায়) যেসব কম্পন তৈরি হয়েছে, তার ঢেউ ছুঁয়েছে অসংখ্য প্রশ্নবানের জলোচ্ছ্বাসে। এসব প্রশ্নই লেখকের প্রতি তার পাঠকে উদগ্রীব জিজ্ঞাসার । একটি প্রশ্নের নমুনা:
প্রশ্ন: আমরা শুনেছি যে, আপনার (কাফকা অন দ্যা সোর বইয়ের) জাপানি প্রকাশক একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েব সাইট তৈরি করেছেন, যাতে পাঠক বইটির সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে পারে। আমরা যেহেতু সাইটি পড়তে পারছি না ( সাইটটি জাপানি ভাষায়, প্রশ্নকর্তা ইংরেজ), আপনার এই বইটি সম্পর্কে নিজের কিছু ‘সিক্রেট’ কি বলবেন আমাদের?
মুরাকামির উত্তর: ওয়েব সাইটটি তৈরির তিনমাসের মাথায় আমি প্রায় আট হাজারের মতো পাঠকের প্রশ্ন পেয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি উত্তর দিয়েছি প্রায় বারোশোর মতো। এটা সত্যিই পরিশ্রম সাধ্য কাজ, তবে আমি ব্যাপারটা উপভোগ করেছি। এর ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে আমি এসেছি যে, একটি উপন্যাসকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে আসলে একাধিকবার ( মাল্টিপল টাইমস) পড়া দরকার। এটা খানিকটা চালাকির মতো শোনাবে, তবে কথাটা সত্যি। আমি জানি, মানুষ অনেক ব্যস্ত, এবং তা নির্ভর করে জিনিসটা করতে সে পছন্দ করে কি-না, তার ওপরও। তবে আমি বলবো, সময় থাকলে, উপন্যাসটি একাধিকবার পড়ার জন্য। দ্বিতীয়বারে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি অবশ্যই রিরাইট করার সময় ডজন খানেকবার পড়েছি। প্রতিবারই খুব ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ ব্যাপারটা আরো কেন্দ্রিভূত/ পরিষ্কার হয়েছে। কাফকা অন দ্যা সোরে কয়েকটা ধাঁধাঁ আছে, কিন্তু কোনটারই কোন সমাধান দেয়া নেই। বরংচ, কয়েকটা ধাঁধাঁ একীভূত হয়ে একটা সমাধানের সম্ভাব্য আকারে রূপ নিয়েছে। এবং এ সমাধানের আকারটি বিভিন্ন পাঠকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে ধরা পড়েছে। অন্য ভাবে বলতে পারি, ধাঁধাঁগুলোর আসলে সমাধানের অংশ। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়, কিন্তু এ ধরনের উপন্যাসই আমি সাজিয়েছি ...
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মুরাকামির বেশির ভাগ বই সম্পর্কেই তার এ কথাটা খাটবে। সুররিয়ালিজম, ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম, ফিকশন, সায়েন্স ফিকশন - এ সবের সীমানা প্রাচীর গুঁড়িয়ে তিনি গল্প বলতে ভালবাসেন। বই পড়ে কাহিনীর কোন সুনির্দিষ্ট সমাধান না পেয়ে যে হতাশা, রাগ কিংবা অনুরাগ, কৌতূহল - যতো যাই জমুক না কেন, তার পাঠকরা যে পরবর্তী বইটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন, রাত বারোটায় বইয়ের দোকানে লাইন দেন গরম কপিটি হাতে নেবার জন্য ( তার ‘কালারলেস সুকুরু এণ্ড হিজ ইয়ার্স অব পিলগ্রিমেজ’ বিক্রি শুরু হয় লণ্ডনের বইয়ের দোকান ফয়েলসে, রাত বারোটায়, এবং তাতে সিনেমা দেখার লাইনের মতো দীর্ঘ লাইন ধরে বইটি কিনেন পাঠক), তার কারণ কি তবে আরভিংয়ের উদ্ধৃত কথাটার মধ্যে লুকায়িত - ‘পাঠকের শিরায় মাদকের মতো গল্পের ইনজেকশান’ই কী এর প্রধান নিয়ামক?
হারুকি মুরাকামি লিখেন জাপানি ভাষায়। কিন্তু তার বই বহুবছর ধরেই বিশ্ব জোড়া বইয়ের বাজারের বেস্ট সেলারের তালিকায়। ইতিমধ্যে অনূদিত হয়েছে পঞ্চাশেরও বেশি ভাষায়। তার নিজ দেশের বাইরের বই বিক্রির সংখ্যা কয়েক মিলিয়নেরও বেশি। ইতিমধ্যে ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি এওয়ার্ড, ফ্রান্ক ও’কনার ইন্টারন্যাশনাল শর্ট স্টোরি এওয়ার্ড, ফ্রান্জ কাফকা প্রাইজ, জেরুজালেম প্রাইজ - এমন বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জন্ম ১৯৪৯ এর ১২ জানুয়ারী। মুরাকামির অধিকাংশ উপন্যাসই প্রধান চরিত্রের নিজ বর্ণনায় ( ফার্ষ্ট পারসন নেরেটিভ)। ষ্টাইলটি জাপানে আই নভেল ( জাপানী সাহিত্যে আই নভেল হচ্ছে জাপানি সাহিত্যের এমন একটি শাখা, যা অনেকটা স্বীকারোক্তি মূলক সাহিত্য, যাতে ঘটা ঘটনা সমূহের সাথে লেখকের জীবনের কোন ঘটনার যোগ আছে - এ ধাঁচে বর্ণনা করা ) হিসেবে পরিচিত। হারুকী মুরাকামির জীবন ও তার লেখার উপর অতি সুখপাঠ্য বই লিখেছেন জে রুবিন ( ইনি মুরাকামির কয়েকটা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদকও)। তার লেখা ‘ হারুকি মুরাকামি এ- দ্য মিউজিক অব ওয়ার্ডস’ এ তিনি উল্লেখ করেছেন: মুরাকামির উপন্যাস বর্ণিত হয়েছে ফার্স্ট ফারসন ‘বুকো’র জবানিতে, যে অতি শান্ত, বিচ্ছিন্ন, বিমুখ হয়ে গ্রহণ করছে জীবনের অর্ন্তনিহিত উদভটত্বকে। তার উপন্যাসে পাঠক মুখোমুখি হন এমন সব বাস্তবতার, ঘটনার প্রবাহ এমন সব অনাকাংখিত মোড় নেয়, এক পৃষ্ঠা আগেও যে জানা যায় না পরের পৃষ্ঠায় কী ঘটতে চলেছে, তার কারণ হয়তো এই যে, তিনি নিজেই বলেছেন: “লেখা শুরুর আগে আমি কোন পূর্ব-পরিকল্পনা করি না। তবু আমি সফল হয়েছি। কারণ, আমি ‘পরবর্তী পৃষ্ঠায় কী ঘটতে চলেছে?’ - এ উত্তেজনা নিয়ে লেখাটাকে উপভোগ করি।” পুস্তক সমালোচক লরা মিলারের ভাষায়: “হারুকী মুরাকামির ফিকশন পড়ে মুগ্ধ হওয়া যতটাই সহজ, ততটাই কঠিন এটা বের করা যে, এ মনোমুগ্ধকর কুহক তিনি কিভাবে নির্মাণ করেন।” পাখি, হাতি, ভেড়া, বিড়াল - এসব চেনা জন্তুর উপস্থিতিকে অদ্ভুত মোচড়ে পাঠককে তিনি নিয়ে ফেলেন এমন এক চৌহদ্দীতে, যাতে স্মৃতি ও বিভ্রাটের বেড়া পাতলা হয়ে যায়, স্বপ্ন ও ইচ্ছেপূরণ এক টংকারে বেজে ওঠে। নিজের জন্য তিনি নির্মাণ করেছেন অন্য পরিম-ল, তার ভাষা ও ঘটনা বিন্যাসের সজ্জাও তারই তৈরি। মুরাকামির ভাষায়: At any rate, what I’d like to be is a unique writer who’s different from everybody else. I want to be a writer who tells stories unlike other writers.
‘কাফকা অন দ্যা সোর’ উপন্যাসটি এগুতে শুরু করে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক প্লটকে বেইজ করে। খুব পরে, প্রায় শেষে এ দুটো একটা জায়গায় মিলবে বটে, কিন্তু আমরা যখন পড়তে শুরু করবো, দেখবো জোড় এবং বেজোড় নাম্বার অধ্যায়ে প্লট দুটোকে বিন্যাস করে লেখক এগুচ্ছেন আমাদের নিয়ে। বেজোড় অধ্যায়ে বিন্যস্ত গল্পে দেখা যায়, পনের বছরের বালক, নাম কাফকা তামুরা (এটা তার আসল নাম নয়, উপন্যাসের কোথাও তার আসল নামটি জানা যায় না, এটা বলে সে সবার কাছে নিজেকে পরিচয় দেয়) একদিন বাড়ি ছেড়ে পালায়। কারণ? কাফকার বাবা ছেলের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যতবাণী করেছেন: কাফকা তাকে খুন করবে, এবং নিজের মা ও বোনের শয্যাসংগিনী হবে ( ওডিপাস কমপ্লেক্স), যারা কাফকার চার বছর বয়স থেকে নিরুদ্দিষ্ট। বাবার এ অভিশপ্ত ভবিষ্যতবাণীর নিয়তি থেকে পালিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া কাফকা একের পর নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ঠাঁই পায় নিজ এলাকা থেকে দূরে, তাকামাসু রাজ্যের এক ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে। মিসেস সেইকি ও ওসিমা - এ দুইজন ভিন্ন চরিত্রের মানুষের তত্ত্বাবধানে থাকা লাইব্রেরীতে পাঠ পিপাসু কাফকার চাকুরী আর পাঠ - দুই-ই চলতে থাকে। দেখতে পাই, কাফকা তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞানী, মিউজিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও তার সহজাত বিচরণ। দিন হয়তো এভাবেই যেতো, তবে তাতে ছেদ ঘটে একদিন তার খোঁজে পুলিশ আসায়। পুলিশের ধারণা একটা খুনের ঘটনার সাথে সে জড়িত। উপন্যাসের অন্য প্লটটি ( জোড় অধ্যায়গুলো) শুরু হয় অনেকটা থ্রিলার বইয়ের আদলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জাপানের শিকুকু বনে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে ও তাদের শিক্ষিকার বেড়াতে যায়। এবং কোন এক অজানা কারণে ( হয়তো ইউএফও) সবাই বেশ কয়েক ঘন্টার জন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। ঐ দলের সবাই অবশ্য পরবর্তীতে ভালো হয়ে যায়, কেবল নাকাটা নামক একটি ছেলে ছাড়া। জ্ঞান ফিরতে তার বেশ কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। এবং ধীরে ধীরে শরীর সেরে উঠলেও ছেলেটা শেষ পর্যন্ত বোকা হয়েই বেড়ে ওঠে, তবে তার মধ্যে দেখা দেয় এক অদ্ভুত ক্ষমতা, বিড়ালের ভাষা বুঝতে পারে সে। ( প্রসংগত, যুদ্ধকালীন এ ধরনের ঘটনার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি, নেই - সে কথাটার উত্তর দিতে মুরাকামি অস্বীকার করেছেন।) বর্তমানে তার পেশা হচেছ হারিয়ে যাওয়া বেড়াল খুঁজে বের করা। ঘটনার শুরু একটা বিশেষ বিড়াল খোঁজা শুরু করার পর থেকে। বিড়ালটিকে খোঁজার সূত্র ধরেই একসময় সে তার পরিচিত এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে বাইরে, নিয়তি তাকে নিয়ে চলে নানান জায়গায়, একসময় এক ট্রাক ড্রাইভার, হোসিনোর সাথে গাঁটছড়া বাঁধে তার। কাহিনীতে যোগ হতে থাকে নানান রকম টুইস্ট।
এ দুটো প্লট আপাত সম্পর্কহীন হয়েই এগুতে থাকে। দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন বয়স ও চরিত্রের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী যাত্রায় আমরা কখন যে জড়িয়ে পড়ি, তার কোন হুঁশ থাকে না। এখানে বলে রাখা দরকার, দুজনের গল্প সমান্তরালে বর্ণিত হলেও, তাদের ঘটনা কাল কিন্তু একসময়ের নয়। পড়তে পড়তেই মনে প্রশ্ন জমতে থাকে, কৌতূহল পরের প্যারায় টেনে নিয়ে যায় পাঠকে, এবং তার মীমাংসা না ছাড়াতে অন্য ঘটনা জমে ওঠে। নাকাটার সাথে চলতে চলতেই আমাদের দেখা হয় কাফকার বাবার সাথে, তার নাম জানতে পারি - জেক ডেনিয়েল, ইনি বিড়াল খুন করে তাদের আত্মা দিয়ে এক বিশেষ ধরনের বাঁশী তৈরি করেন। সে নাকাটার কাছে প্রার্থণা করে মৃত্যূ। অন্যদিকে যে ওডিপাস থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কাফকা, তার একটা ভিন্ন রূপের ট্র্যাজিডি তৈরি হয় ঘটনা পরিক্রমায়।
উপরের প্যারা দুটো পড়ে যারা আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন, ডিসক্লেমার না দিয়ে বইয়ের কাহিনী বর্ণনা করছি বলে, তাদেরকে বিনীত ভাবে জানাই, এগুলো বইয়ের গল্পটির খুব দূরতর আউটলাইন মাত্র, তাও শীষ ভাঙা পেন্সিলে আঁকা। মুরাকামির এই অর্ধ সহস্র পৃষ্টা ব্যাপী তিনকালে ব্যাপ্ত ( এবং সে ব্যাপ্তির সীমা এপার ওপার পৃথিবীও) উপন্যাসের এত সব সাব-প্লট আছে, এত সব ডেরা-উপত্যকা-গিরিখাদ আছে যে, পুরো ঘটনা যদি বলেও দিই, তবু মূল বইয়ের পাঠে সৌন্দর্য এতটুকু কমবে না। মুরাকামির ভাষা এবং গল্প বলার টেকনিক এতই অনন্য।
মুরাকামির পাঠকরা প্রতিবছরই নোবেল প্রাইজের সময় চোখ ও কান উৎকীর্ণ করে রাখেন, তাদের প্রিয় লেখককে এ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে কী না, এ সংবাদটি জানতে। তা হয়তো একসময় হবেও। ঘটনা বর্ণনাই যে ভালো ফিকশনের বৈশিষ্ট্য নয় - এ সর্বজন বোধ্য কথা সরিয়ে রেখে এ কথাটা মুরাকামির জন্য যোগ করার দরকার আছে যে, পাঠক প্রিয় গল্প বলার টেকনিক সব লেখকের জন্য খারাপ নয়। মূলতঃ মুরাকামির ফিকশনে গল্প বলার জাদুকরি টেকনিকই তাকে বিশ্বব্যাপী এত জনপ্রিয় করে তুলেছে, এবং এ প্রসংগে এ বোধটিও জানা যাক, জনপ্রিয়তা মানেই খারাপ জিনিস নয়, বেস্ট সেলার মানেই বাজারি লেখক নয়। কাফকা অন দ্যা সোরে মুরকামি প্রথম বারের মতো তার কমফোর্ট জোন থেকে সরিয়ে এসে গল্প বলেছেন। মানে বলতে চাইছি, তার অধিকাংশ উপন্যাসের প্রধান চরিত্ররা সাধারণত বিশ থেকে ত্রিশের বয়সী হন। এক্ষেত্রে কাফকা মাত্র বছর পনেরর বালক। তবে এতদসত্ত্বেও মুরাকামির চরিত্রগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য এ বালকের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। এই যেমন, জ্যাজ সহ পশ্চিমা ক্লাসিক্যাল সংগীতে তাদের বিপুল আগ্রহ এবং এ সম্পর্কিত জ্ঞান। মুরাকামি তারুণ্যের শুরুতে তার স্ত্রী সহ একটা ক্যাফে ও জ্যাজ ক্লাব চালাতেন জীবিকার জন্য। পশ্চিমা ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতে তার অগাধ আগ্রহ ও জ্ঞান রয়েছে, এ প্রসংগে বইও (এবসলিউটলি অন মিউজিক) আছে তার। মুরাকামির এই ভালোবাসা তার চরিত্রের মুখে প্রায়শঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে। তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপভোগ্য হলেও কাফকার ক্ষেত্রে খানিকটা আরোপিত মনে হতে পারে পাঠকের। এবং শুধু কাফকাই নয়, এ বইয়ে তার পাশাপাশি আরো অনেক চরিত্রকেই এসব ক্ষেত্রে গড়পড়তা সাধারণের চেয়ে অসাধারণ মনে হয় সময়ে সময়ে। এছাড়া বিড়াল প্রিয় এ লেখকের অনেক গল্পেই বিড়াল একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে, (The Wind-Up Bird Chronicle, 1Q84) যেমন আছে কাফকা অন দ্যা সোরেও। এমনকি যে হারিয়ে যাওয়া বিড়াল খোঁজার উছিলায় নাকাতার যাত্রা শুরু কাফকা অন সোরে, উই--আপ বার্ড ক্রনিকল উপন্যাসের গল্পও তেমনি এক হারিয়ে যাওয়া বিড়ালকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে যৌনতার অতি ব্যবহার করেছেন বলেই মনে হয়। যেমন: কাফকার সাথে সাকুরা ( যে হয়তো অন্য রিয়েলিটিতে তার বোন) তার রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা, যা মূলতঃ ঘটে তার স্বপ্নে; এবং সেইকি ( যে হয়তো অন্য বাস্তবতায় সম্পর্কে তার মা)’র সাথে তার শারিরিক সম্পর্ককে মনে হতে পারে যেন লেখক এমনটা ঘটাবেন বলেই, ঘটছে। না হলে শুরুর সেই ওডিপাস অভিশাপের অন্যরকম ফলন কাহিনী হতে বাদ পড়ে যায়। যেন তিনি ঠিক করেই রেখেছেন এমনটা ঘটাতে হবে, এবং চরিত্রগুলো তার তৈরি ফেইটের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কিছু ঘটনা ঘটিয়েছেন অতি দ্রুত, যেন প্লটের ইচ্ছেপূরণের জন্যই সেটা ঘটতে হয়েছে।
ঘটনা বর্ণনায় মুরাকামি আশ্রয় নিয়েছেন ফটোগ্রাফিক ডিটেইলসের। চরিত্রগুলোর পোশাক-আশাক, শারিরিক বৈশিষ্ট্য, তিনবেলা আহার, নিদ্রা, তাদের চারপাশের প্রকৃতি ও স্থানের সূক্ষ্ম ডিটেইলস দিয়েছেন প্রায় ক্ষেত্রেই। কোন কোন ক্ষেত্রে তা খানিকটা অদরকারী মনে হয়। সকাল থেকে রাত অব্দি একটি চরিত্র কোন সময়ে কী করছে, তার প্রতি মিনিটের হিসাব বর্ণনা করেছেন ক্লান্তিহীন। তা অবশ্য ঠিক একঘেঁয়ে হয়ে ওঠেনি তার বলার ধরনের কারণেই হয়তো। তবে লক্ষণীয় এই, এই যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বর্ণনা তিনি দিচ্ছেন, এর এমন ছবিসদৃশ্য উপস্থাপনই আসলে ফিকশনটিকে বাস্তবতার এত নিকটে নিয়ে এসেছে। যে জগত ছিলো তার মাথার ভেতরে, যে জীবন তিনি নির্মাণ করেছেন তার চরিত্রদের জন্য, সেখানটার পরিপূর্ণ চিত্র বাস্তব হয়ে আমাদের কাছে এসেছে সৎ বর্ণনার কারণেই। তাই হয়তো পড়তে পড়তে কাফকা কিংবা নাকাতাকে এত জীবন্ত লাগে।
কাফকা অন দ্যা সোরে মুরাকামি পপুলার কালচার, সাসপেন্স, হিউমার, বিজ্ঞান, মিউজিক, অন্য বাস্তবতা, পরা-বাস্তবতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ গড়ে তুলেছেন। অর্থাৎ, এ বোধ হয় যে, এর আগে এমন কিছু আর পড়িনি তো! আছে প্রচুর যৌন অনুসংগ, জাপানি ধর্মীয় ঐতিহ্যের ব্যবহার, বিশ্ব সাহিত্যের উল্লেখ। মুরাকামি ভাষা বর্ণনায় প্রচুর চিত্রকল্প ব্যবহার করেন। এবং এগুলো পড়ে উঠার অনুভূতি মনোমুগ্ধকর। কিছু কিছু উপমা কাব্য-ব্যঞ্জনায় ঝলমলিয়ে উঠে। এবং যথেষ্ট ইন্টারস্টেং তো বটেই। এই যেমন: sometimes fate is like a small sandstorm, that keeps changing direction, কিংবা, Memories warm you up from the inside. But they also tear you apart. কিংবা, Silence, I discover, is something you can actually hear. Not just beatiful, though – the stars are like the trees in the forest, alive and breathing. And they’re watching me.
এ লেখার শুরুতেই এই বইয়ের প্লট নিয়ে গড়ে ওঠা পাঠকদের প্রশ্নপাহাড়ের কথা বলেছিলাম। বই শেষ করে বেশ কিছু ধাঁধাঁ আসলেই মনকে আলোড়িত করে রাখে। কাফকার পিতার প্রকৃত খুনী কে? - এমন মোটা দাগের প্রশ্নের সমাধানও মুরাকামি উন্মুক্ত করে রেখেছেন পাঠকের জন্য। তারওপর কিছু অতিলৌকিক প্রাণী ও ঘটনা ঘটে নানান সময়ে, তাদের সম্পর্কেও মুরাকামি পাঠকের কৌতূহল জাগিয়ে, ঘটনা ঘটিয়ে পরবর্তী ঘটনায় নিয়ে যান। কাফকা অন দ্যা সোরের মূল গল্পের সাথে চোরাস্রোত হিসেবে চলতে থাকে আত্ম-প্রতিষ্ঠার গুণ, স্বপ্ন ও বাস্তবতার বিপরীতমুখী আর্ন্তসম্পর্ক, নিয়তির বহুমুখী তাড়না, মিথের দূরলক্ষ্য ভবিষ্যবচন, চেতন-অচেতনের সূক্ষ্ম সীমানার উভমুখী দোলন সহ আরো নানান উপাদান - যেগুলোকে মুরাকামি অত্যন্ত দক্ষহাতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, যারা ব্যবহৃত হয়েছে গল্পেরই প্রয়োজনে, এবং কে না জানে, খুব কুশলী না হলে গল্প হয়ে পড়তে পারে ওসব প্রকাশের হাতিয়ার মাত্র। মুরাকামির এই জটিল চোরাগুপ্তা পথে কাহিনী নির্মাণের মূল কথা আছে তার ভাষায়: ''The best way to think about reality'to get as far away from it as possible.'' অথচ এই কাজটি তিনি এমন সুস্বাদু উপায়ে করেন যেন, হ্যাঁ, এমন তো হতেই পারে। নাকাটার সাথে বিড়ালরা যে আবহাওয়ার খোঁজখবর দিয়ে কথা শুরু করে - এ আর এমন কী! আকছারই হচ্ছে। গল্পকার হিসেবে হারুক মুরাকামির এটাই অনন্য বৈশিষ্ট্য। এমন আপাত আজগুবি এবং স্বপ্নসম ঘটনাবলী তিনি ঘটান, তা সত্ত্বেও পাঠকের মনে হয় না এসব তিনি ঘটাচ্ছেন, প্রদর্শিত স্বপ্নটি তিনি দেখাচ্ছেনই না আদৌ, এটাই বাস্তব। আর যদি স্বপ্ন হয়েও থাকে, তার কারিগরও পাঠক নিজেই, এ তারই নিজ কল্পনা, মুরাকামির নয়।
কাফকা অন দ্যা সোরের ইংরেজি ভার্সন প্রকাশিত হয়েছে ভিনটেজ বুক, লণ্ডন থেকে। অনুবাদক: ফিলিপ গ্রেবরিয়েল। অনুবাদটি ২০০৬ সালের পেন/ বুক-অফ দ্যা-মান্থ ক্লাব ট্রানস্লেশান প্রাইজ পেয়েছে। পেপার ব্যাকে ৫০৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী এ দীর্ঘ উপন্যাস ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসী এওয়ার্ড পেয়েছে ২০০৬ সালে। ডেভিড মিসেলের কথায়: “আমি মনে করি, এটা বলা যায় যে, কাফকা অন দ্যা সোর মুরাকামি মাস্টারপিস হয়তো নয়, কিন্তু এটি একটি উদ্ভাবনী, মনোমুগ্ধকর, অতিযত্নের উপন্যাস...।” দীর্ঘ এ উপন্যাসটি পাঠ শেষে টের পাই, মুরাকামির জগতটি এই আশে পাশেই কোথাও আছে, ভিন্ন আলোয়, অন্য সংকেতে, পর্দার ভিন্ন ভাঁজের আড়ালে সে জগতে বারবার ডুব দেয়া চলে। মুরাকামিই বলেছেন: “একটি কাহিনী, একটি মনোগাটরি ( গল্প) - এমন কোন জিনিস না যা তুমি তৈরি করবে। এটা এমন জিনিস যা তুমি তোমার ভেতর থেকে টেনে বের করবে। গল্পটি ওখানেই ছিলো, তোমার ভেতরেই। বানানো নয়, বড় জোর ওটাকে তুমি বাহিরে তুলে আনতে পারো।” আমাদের নানামুখী অভিজ্ঞতা, দৃশ্য-শ্রাব্যতার আধুনিক ভজঘট প্রতিদিন কত কত অলীক সম্পর্ক গড়ে নানান স্নায়ু সংকেতে, কত যে গল্প-গাঁথা গেঁথে তোলে মননের কোন আড়ালে, মুরাকামি যেন সেই টুকরো-টাকরা দিয়ে জগত গড়েন, গড়ে আমাদের দেখান। মনে পড়ে জীবনানন্দের লাইন: ... আমাদের হৃদয়ের ব্যথা/ দূরের ধূলোর পথ ছেড়ে/ স্বপ্নেরে - ধ্যানেরে/ কাছে ডেকে লয়!/ উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়,/ মানুষেরো আয়ু শেষ হয়!/ পৃথিবীর পুরনো সে পথ/ মুছে ফেলে রেখা তার, -/ কিন্তু এই স্বপ্নের জগত, চিরদিন রয়... (কবিতা: স্বপ্নের হাতে)।
কিন্তু এই স্বপ্নের জগত চিরদিন রয়
------------------------------------------------
সাগর রহমান
হারুকি মুরাকামি দৌড়াতে ভালোবাসেন। এ পর্যন্ত ২৬ বার ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছেন। নিজের মেমোয়ার্সের নাম রেখেছেন - হোয়াট আই টক এবাউট হোয়েন আই টক এবাউট রানিং। ঊনত্রিশ বছরে লিখেছেন প্রথম উপন্যাস, অনেকটা অকস্মাতই। দ্য নিউ ইয়র্কারে লেখা তার ‘দ্য রানিং নভেলিষ্ট’ থেকে, তার কথা মোতাবেক জানা যায়, সময়টা দুপুর দেড়টা। এপ্রিল ১, ১৯৭৮। বিয়ার খেতে খেতে, চুরুট টানতে টানতে, ঘাসের উপর শুয়ে খেলা দেখছিলেন। হঠাৎ করেই তার মনে হলো: “ইউ নো হোয়াট? আই কুড ট্রাই রাইটিং নভেল। ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে কিছু একটা যেন ভেসে ভেসে নেমে আসছিল । সেটা যাই হোক, আমি তা গ্রহণ করেছিলাম” ( সৃষ্টিশীল মানুষদের ক্ষেত্রে এমন কোন প্রণোদনার কথাই কি এলিজাবেথ গিলবার্ট তার ‘বিগ ম্যাজিক’ বইতে উল্লেখ করেছেন?)। ব্যস, সেই শুরু। উপন্যাসটি ছিলো ‘ হিয়ার দ্যা উইণ্ড সিং’। এটি সাহিত্য পত্রিকা ‘গানজো’র নতুন লেখক পুরস্কারে সিলেক্ট হয়, এবং সেই থেকেই শুরু হয় মুরাকামির সিরিয়াস লেখালেখির, দৌড়ের প্রতি আগ্রহও। দৌড়টা নিজেকে দীর্ঘদিন ফিট রেখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাওয়ার নিমিত্তে। মুরাকামির সাহিত্যের কথা বলতে গিয়ে যে তার দৌড়ের কথা বলতে হলো, তার কারণ, লেখালেখির প্রতি তার অদম্য নিষ্ঠা। প্রতিটি উপন্যাসেই আছে ম্যারাথন দৌড়ের আমেজ, শুরু থেকে একটা অজানা জগতের রাস্তায় নিয়ে ফেলেন পাঠককে, তারপর তার হাত ধরে দীর্ঘ ভ্রমণ। অবশ্য, প্রায়শই সে ভ্রমণ বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় শেষ হয় না, চেনা আদলের আড়ালে যে অন্য ভুবনে নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি, তার আমেজ দীর্ঘ দীর্ঘ দিন বয়ে বেড়াতে হয পাঠককে। নিজের সাহিত্য জাত এবং কাজের ধরন চেনাতে গিয়ে মুরাকামি বলেছেন: “যেসব লেখকরা লেখার জন্মগত মেধা নিয়ে জন্মান, তারা গড়গড় করে লিখতে পারেন...। প্রাকৃতিক ঝরণা থেকে উৎসারিত পানির মতো তাদের বাক্য তৈরি হতে থাকে, খুব সামান্য চেষ্টা কিংবা প্রায় কোন চেষ্টা ছাড়াই এ ধরনের লেখকরা একেকটা লেখা শেষ করে উঠতে পারেন। দূর্ভাগ্যক্রমে, আমি এ দলে পড়ি না। চিজেল (নিড়ানি) দিয়ে পাথর সরিয়ে, গভীর গর্ত খুঁড়ে আমাকে আমার সৃষ্টিশীলতার সন্ধান পেতে হয়। প্রতিবার যখন আমি নতুন উপন্যাস শুরু করি, প্রতিবারই নতুন গর্ত খুঁড়তে হয় আমাকে। কিন্তু, যেহেতু দীর্ঘ দিন ধরে এ কাজটি আমি করে চলেছি, এখন আমি শারিরীক ও প্রায়োগিকভাবে এ ধরনের গর্ত খুঁড়ে নতুন পানির শিরা সন্ধানে দক্ষ হয়ে পড়েছি। যখনি আমি দেখি একটা উৎস শুকিয়ে এসেছি, আমি অন্য উৎস সন্ধান করি... ”। প্রকৃতই ম্যারাথন দৌড়ের সামর্থ্য না থাকলে হয়তো অমন উপন্যাস লেখাই যাবে না। এবং সে শুধু দৈর্ঘের জন্য নয়, তার অদ্ভুত বিষয় প্রকরনের বিস্তারের জন্যই বলা।
কথাসাহিত্যে গল্পবলার ভঙ্গিমার গুরুত্বটি বোঝাতে গিয়ে উপন্যাসিক জন আরভিং বলেছিলেন:... a good story is like a narcotic fix. It you can inject a good one into reader’s veins, they’ll get the habit and come back to you for the next one... হারুমি মুরাকামি সম্পর্কে এ কথাটা এত সত্য যে, তার বই ‘ কাফকা অন দ্যা সোর’ পড়ে পাঠকের মনে (পড়তে পারেন, শিরায়) যেসব কম্পন তৈরি হয়েছে, তার ঢেউ ছুঁয়েছে অসংখ্য প্রশ্নবানের জলোচ্ছ্বাসে। এসব প্রশ্নই লেখকের প্রতি তার পাঠকে উদগ্রীব জিজ্ঞাসার । একটি প্রশ্নের নমুনা:
প্রশ্ন: আমরা শুনেছি যে, আপনার (কাফকা অন দ্যা সোর বইয়ের) জাপানি প্রকাশক একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েব সাইট তৈরি করেছেন, যাতে পাঠক বইটির সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে পারে। আমরা যেহেতু সাইটি পড়তে পারছি না ( সাইটটি জাপানি ভাষায়, প্রশ্নকর্তা ইংরেজ), আপনার এই বইটি সম্পর্কে নিজের কিছু ‘সিক্রেট’ কি বলবেন আমাদের?
মুরাকামির উত্তর: ওয়েব সাইটটি তৈরির তিনমাসের মাথায় আমি প্রায় আট হাজারের মতো পাঠকের প্রশ্ন পেয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি উত্তর দিয়েছি প্রায় বারোশোর মতো। এটা সত্যিই পরিশ্রম সাধ্য কাজ, তবে আমি ব্যাপারটা উপভোগ করেছি। এর ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে আমি এসেছি যে, একটি উপন্যাসকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে আসলে একাধিকবার ( মাল্টিপল টাইমস) পড়া দরকার। এটা খানিকটা চালাকির মতো শোনাবে, তবে কথাটা সত্যি। আমি জানি, মানুষ অনেক ব্যস্ত, এবং তা নির্ভর করে জিনিসটা করতে সে পছন্দ করে কি-না, তার ওপরও। তবে আমি বলবো, সময় থাকলে, উপন্যাসটি একাধিকবার পড়ার জন্য। দ্বিতীয়বারে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি অবশ্যই রিরাইট করার সময় ডজন খানেকবার পড়েছি। প্রতিবারই খুব ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ ব্যাপারটা আরো কেন্দ্রিভূত/ পরিষ্কার হয়েছে। কাফকা অন দ্যা সোরে কয়েকটা ধাঁধাঁ আছে, কিন্তু কোনটারই কোন সমাধান দেয়া নেই। বরংচ, কয়েকটা ধাঁধাঁ একীভূত হয়ে একটা সমাধানের সম্ভাব্য আকারে রূপ নিয়েছে। এবং এ সমাধানের আকারটি বিভিন্ন পাঠকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে ধরা পড়েছে। অন্য ভাবে বলতে পারি, ধাঁধাঁগুলোর আসলে সমাধানের অংশ। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়, কিন্তু এ ধরনের উপন্যাসই আমি সাজিয়েছি ...
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মুরাকামির বেশির ভাগ বই সম্পর্কেই তার এ কথাটা খাটবে। সুররিয়ালিজম, ম্যাজিক্যাল রিয়েলিজম, ফিকশন, সায়েন্স ফিকশন - এ সবের সীমানা প্রাচীর গুঁড়িয়ে তিনি গল্প বলতে ভালবাসেন। বই পড়ে কাহিনীর কোন সুনির্দিষ্ট সমাধান না পেয়ে যে হতাশা, রাগ কিংবা অনুরাগ, কৌতূহল - যতো যাই জমুক না কেন, তার পাঠকরা যে পরবর্তী বইটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন, রাত বারোটায় বইয়ের দোকানে লাইন দেন গরম কপিটি হাতে নেবার জন্য ( তার ‘কালারলেস সুকুরু এণ্ড হিজ ইয়ার্স অব পিলগ্রিমেজ’ বিক্রি শুরু হয় লণ্ডনের বইয়ের দোকান ফয়েলসে, রাত বারোটায়, এবং তাতে সিনেমা দেখার লাইনের মতো দীর্ঘ লাইন ধরে বইটি কিনেন পাঠক), তার কারণ কি তবে আরভিংয়ের উদ্ধৃত কথাটার মধ্যে লুকায়িত - ‘পাঠকের শিরায় মাদকের মতো গল্পের ইনজেকশান’ই কী এর প্রধান নিয়ামক?
হারুকি মুরাকামি লিখেন জাপানি ভাষায়। কিন্তু তার বই বহুবছর ধরেই বিশ্ব জোড়া বইয়ের বাজারের বেস্ট সেলারের তালিকায়। ইতিমধ্যে অনূদিত হয়েছে পঞ্চাশেরও বেশি ভাষায়। তার নিজ দেশের বাইরের বই বিক্রির সংখ্যা কয়েক মিলিয়নেরও বেশি। ইতিমধ্যে ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি এওয়ার্ড, ফ্রান্ক ও’কনার ইন্টারন্যাশনাল শর্ট স্টোরি এওয়ার্ড, ফ্রান্জ কাফকা প্রাইজ, জেরুজালেম প্রাইজ - এমন বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জন্ম ১৯৪৯ এর ১২ জানুয়ারী। মুরাকামির অধিকাংশ উপন্যাসই প্রধান চরিত্রের নিজ বর্ণনায় ( ফার্ষ্ট পারসন নেরেটিভ)। ষ্টাইলটি জাপানে আই নভেল ( জাপানী সাহিত্যে আই নভেল হচ্ছে জাপানি সাহিত্যের এমন একটি শাখা, যা অনেকটা স্বীকারোক্তি মূলক সাহিত্য, যাতে ঘটা ঘটনা সমূহের সাথে লেখকের জীবনের কোন ঘটনার যোগ আছে - এ ধাঁচে বর্ণনা করা ) হিসেবে পরিচিত। হারুকী মুরাকামির জীবন ও তার লেখার উপর অতি সুখপাঠ্য বই লিখেছেন জে রুবিন ( ইনি মুরাকামির কয়েকটা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদকও)। তার লেখা ‘ হারুকি মুরাকামি এ- দ্য মিউজিক অব ওয়ার্ডস’ এ তিনি উল্লেখ করেছেন: মুরাকামির উপন্যাস বর্ণিত হয়েছে ফার্স্ট ফারসন ‘বুকো’র জবানিতে, যে অতি শান্ত, বিচ্ছিন্ন, বিমুখ হয়ে গ্রহণ করছে জীবনের অর্ন্তনিহিত উদভটত্বকে। তার উপন্যাসে পাঠক মুখোমুখি হন এমন সব বাস্তবতার, ঘটনার প্রবাহ এমন সব অনাকাংখিত মোড় নেয়, এক পৃষ্ঠা আগেও যে জানা যায় না পরের পৃষ্ঠায় কী ঘটতে চলেছে, তার কারণ হয়তো এই যে, তিনি নিজেই বলেছেন: “লেখা শুরুর আগে আমি কোন পূর্ব-পরিকল্পনা করি না। তবু আমি সফল হয়েছি। কারণ, আমি ‘পরবর্তী পৃষ্ঠায় কী ঘটতে চলেছে?’ - এ উত্তেজনা নিয়ে লেখাটাকে উপভোগ করি।” পুস্তক সমালোচক লরা মিলারের ভাষায়: “হারুকী মুরাকামির ফিকশন পড়ে মুগ্ধ হওয়া যতটাই সহজ, ততটাই কঠিন এটা বের করা যে, এ মনোমুগ্ধকর কুহক তিনি কিভাবে নির্মাণ করেন।” পাখি, হাতি, ভেড়া, বিড়াল - এসব চেনা জন্তুর উপস্থিতিকে অদ্ভুত মোচড়ে পাঠককে তিনি নিয়ে ফেলেন এমন এক চৌহদ্দীতে, যাতে স্মৃতি ও বিভ্রাটের বেড়া পাতলা হয়ে যায়, স্বপ্ন ও ইচ্ছেপূরণ এক টংকারে বেজে ওঠে। নিজের জন্য তিনি নির্মাণ করেছেন অন্য পরিম-ল, তার ভাষা ও ঘটনা বিন্যাসের সজ্জাও তারই তৈরি। মুরাকামির ভাষায়: At any rate, what I’d like to be is a unique writer who’s different from everybody else. I want to be a writer who tells stories unlike other writers.
‘কাফকা অন দ্যা সোর’ উপন্যাসটি এগুতে শুরু করে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক প্লটকে বেইজ করে। খুব পরে, প্রায় শেষে এ দুটো একটা জায়গায় মিলবে বটে, কিন্তু আমরা যখন পড়তে শুরু করবো, দেখবো জোড় এবং বেজোড় নাম্বার অধ্যায়ে প্লট দুটোকে বিন্যাস করে লেখক এগুচ্ছেন আমাদের নিয়ে। বেজোড় অধ্যায়ে বিন্যস্ত গল্পে দেখা যায়, পনের বছরের বালক, নাম কাফকা তামুরা (এটা তার আসল নাম নয়, উপন্যাসের কোথাও তার আসল নামটি জানা যায় না, এটা বলে সে সবার কাছে নিজেকে পরিচয় দেয়) একদিন বাড়ি ছেড়ে পালায়। কারণ? কাফকার বাবা ছেলের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যতবাণী করেছেন: কাফকা তাকে খুন করবে, এবং নিজের মা ও বোনের শয্যাসংগিনী হবে ( ওডিপাস কমপ্লেক্স), যারা কাফকার চার বছর বয়স থেকে নিরুদ্দিষ্ট। বাবার এ অভিশপ্ত ভবিষ্যতবাণীর নিয়তি থেকে পালিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া কাফকা একের পর নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ঠাঁই পায় নিজ এলাকা থেকে দূরে, তাকামাসু রাজ্যের এক ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে। মিসেস সেইকি ও ওসিমা - এ দুইজন ভিন্ন চরিত্রের মানুষের তত্ত্বাবধানে থাকা লাইব্রেরীতে পাঠ পিপাসু কাফকার চাকুরী আর পাঠ - দুই-ই চলতে থাকে। দেখতে পাই, কাফকা তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞানী, মিউজিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও তার সহজাত বিচরণ। দিন হয়তো এভাবেই যেতো, তবে তাতে ছেদ ঘটে একদিন তার খোঁজে পুলিশ আসায়। পুলিশের ধারণা একটা খুনের ঘটনার সাথে সে জড়িত। উপন্যাসের অন্য প্লটটি ( জোড় অধ্যায়গুলো) শুরু হয় অনেকটা থ্রিলার বইয়ের আদলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জাপানের শিকুকু বনে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে ও তাদের শিক্ষিকার বেড়াতে যায়। এবং কোন এক অজানা কারণে ( হয়তো ইউএফও) সবাই বেশ কয়েক ঘন্টার জন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। ঐ দলের সবাই অবশ্য পরবর্তীতে ভালো হয়ে যায়, কেবল নাকাটা নামক একটি ছেলে ছাড়া। জ্ঞান ফিরতে তার বেশ কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। এবং ধীরে ধীরে শরীর সেরে উঠলেও ছেলেটা শেষ পর্যন্ত বোকা হয়েই বেড়ে ওঠে, তবে তার মধ্যে দেখা দেয় এক অদ্ভুত ক্ষমতা, বিড়ালের ভাষা বুঝতে পারে সে। ( প্রসংগত, যুদ্ধকালীন এ ধরনের ঘটনার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি, নেই - সে কথাটার উত্তর দিতে মুরাকামি অস্বীকার করেছেন।) বর্তমানে তার পেশা হচেছ হারিয়ে যাওয়া বেড়াল খুঁজে বের করা। ঘটনার শুরু একটা বিশেষ বিড়াল খোঁজা শুরু করার পর থেকে। বিড়ালটিকে খোঁজার সূত্র ধরেই একসময় সে তার পরিচিত এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে বাইরে, নিয়তি তাকে নিয়ে চলে নানান জায়গায়, একসময় এক ট্রাক ড্রাইভার, হোসিনোর সাথে গাঁটছড়া বাঁধে তার। কাহিনীতে যোগ হতে থাকে নানান রকম টুইস্ট।
এ দুটো প্লট আপাত সম্পর্কহীন হয়েই এগুতে থাকে। দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন বয়স ও চরিত্রের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী যাত্রায় আমরা কখন যে জড়িয়ে পড়ি, তার কোন হুঁশ থাকে না। এখানে বলে রাখা দরকার, দুজনের গল্প সমান্তরালে বর্ণিত হলেও, তাদের ঘটনা কাল কিন্তু একসময়ের নয়। পড়তে পড়তেই মনে প্রশ্ন জমতে থাকে, কৌতূহল পরের প্যারায় টেনে নিয়ে যায় পাঠকে, এবং তার মীমাংসা না ছাড়াতে অন্য ঘটনা জমে ওঠে। নাকাটার সাথে চলতে চলতেই আমাদের দেখা হয় কাফকার বাবার সাথে, তার নাম জানতে পারি - জেক ডেনিয়েল, ইনি বিড়াল খুন করে তাদের আত্মা দিয়ে এক বিশেষ ধরনের বাঁশী তৈরি করেন। সে নাকাটার কাছে প্রার্থণা করে মৃত্যূ। অন্যদিকে যে ওডিপাস থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কাফকা, তার একটা ভিন্ন রূপের ট্র্যাজিডি তৈরি হয় ঘটনা পরিক্রমায়।
উপরের প্যারা দুটো পড়ে যারা আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন, ডিসক্লেমার না দিয়ে বইয়ের কাহিনী বর্ণনা করছি বলে, তাদেরকে বিনীত ভাবে জানাই, এগুলো বইয়ের গল্পটির খুব দূরতর আউটলাইন মাত্র, তাও শীষ ভাঙা পেন্সিলে আঁকা। মুরাকামির এই অর্ধ সহস্র পৃষ্টা ব্যাপী তিনকালে ব্যাপ্ত ( এবং সে ব্যাপ্তির সীমা এপার ওপার পৃথিবীও) উপন্যাসের এত সব সাব-প্লট আছে, এত সব ডেরা-উপত্যকা-গিরিখাদ আছে যে, পুরো ঘটনা যদি বলেও দিই, তবু মূল বইয়ের পাঠে সৌন্দর্য এতটুকু কমবে না। মুরাকামির ভাষা এবং গল্প বলার টেকনিক এতই অনন্য।
মুরাকামির পাঠকরা প্রতিবছরই নোবেল প্রাইজের সময় চোখ ও কান উৎকীর্ণ করে রাখেন, তাদের প্রিয় লেখককে এ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে কী না, এ সংবাদটি জানতে। তা হয়তো একসময় হবেও। ঘটনা বর্ণনাই যে ভালো ফিকশনের বৈশিষ্ট্য নয় - এ সর্বজন বোধ্য কথা সরিয়ে রেখে এ কথাটা মুরাকামির জন্য যোগ করার দরকার আছে যে, পাঠক প্রিয় গল্প বলার টেকনিক সব লেখকের জন্য খারাপ নয়। মূলতঃ মুরাকামির ফিকশনে গল্প বলার জাদুকরি টেকনিকই তাকে বিশ্বব্যাপী এত জনপ্রিয় করে তুলেছে, এবং এ প্রসংগে এ বোধটিও জানা যাক, জনপ্রিয়তা মানেই খারাপ জিনিস নয়, বেস্ট সেলার মানেই বাজারি লেখক নয়। কাফকা অন দ্যা সোরে মুরকামি প্রথম বারের মতো তার কমফোর্ট জোন থেকে সরিয়ে এসে গল্প বলেছেন। মানে বলতে চাইছি, তার অধিকাংশ উপন্যাসের প্রধান চরিত্ররা সাধারণত বিশ থেকে ত্রিশের বয়সী হন। এক্ষেত্রে কাফকা মাত্র বছর পনেরর বালক। তবে এতদসত্ত্বেও মুরাকামির চরিত্রগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য এ বালকের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। এই যেমন, জ্যাজ সহ পশ্চিমা ক্লাসিক্যাল সংগীতে তাদের বিপুল আগ্রহ এবং এ সম্পর্কিত জ্ঞান। মুরাকামি তারুণ্যের শুরুতে তার স্ত্রী সহ একটা ক্যাফে ও জ্যাজ ক্লাব চালাতেন জীবিকার জন্য। পশ্চিমা ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতে তার অগাধ আগ্রহ ও জ্ঞান রয়েছে, এ প্রসংগে বইও (এবসলিউটলি অন মিউজিক) আছে তার। মুরাকামির এই ভালোবাসা তার চরিত্রের মুখে প্রায়শঃই প্রকাশ হয়ে পড়ে। তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপভোগ্য হলেও কাফকার ক্ষেত্রে খানিকটা আরোপিত মনে হতে পারে পাঠকের। এবং শুধু কাফকাই নয়, এ বইয়ে তার পাশাপাশি আরো অনেক চরিত্রকেই এসব ক্ষেত্রে গড়পড়তা সাধারণের চেয়ে অসাধারণ মনে হয় সময়ে সময়ে। এছাড়া বিড়াল প্রিয় এ লেখকের অনেক গল্পেই বিড়াল একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে, (The Wind-Up Bird Chronicle, 1Q84) যেমন আছে কাফকা অন দ্যা সোরেও। এমনকি যে হারিয়ে যাওয়া বিড়াল খোঁজার উছিলায় নাকাতার যাত্রা শুরু কাফকা অন সোরে, উই--আপ বার্ড ক্রনিকল উপন্যাসের গল্পও তেমনি এক হারিয়ে যাওয়া বিড়ালকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।
কোন কোন ক্ষেত্রে যৌনতার অতি ব্যবহার করেছেন বলেই মনে হয়। যেমন: কাফকার সাথে সাকুরা ( যে হয়তো অন্য রিয়েলিটিতে তার বোন) তার রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা, যা মূলতঃ ঘটে তার স্বপ্নে; এবং সেইকি ( যে হয়তো অন্য বাস্তবতায় সম্পর্কে তার মা)’র সাথে তার শারিরিক সম্পর্ককে মনে হতে পারে যেন লেখক এমনটা ঘটাবেন বলেই, ঘটছে। না হলে শুরুর সেই ওডিপাস অভিশাপের অন্যরকম ফলন কাহিনী হতে বাদ পড়ে যায়। যেন তিনি ঠিক করেই রেখেছেন এমনটা ঘটাতে হবে, এবং চরিত্রগুলো তার তৈরি ফেইটের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কিছু ঘটনা ঘটিয়েছেন অতি দ্রুত, যেন প্লটের ইচ্ছেপূরণের জন্যই সেটা ঘটতে হয়েছে।
ঘটনা বর্ণনায় মুরাকামি আশ্রয় নিয়েছেন ফটোগ্রাফিক ডিটেইলসের। চরিত্রগুলোর পোশাক-আশাক, শারিরিক বৈশিষ্ট্য, তিনবেলা আহার, নিদ্রা, তাদের চারপাশের প্রকৃতি ও স্থানের সূক্ষ্ম ডিটেইলস দিয়েছেন প্রায় ক্ষেত্রেই। কোন কোন ক্ষেত্রে তা খানিকটা অদরকারী মনে হয়। সকাল থেকে রাত অব্দি একটি চরিত্র কোন সময়ে কী করছে, তার প্রতি মিনিটের হিসাব বর্ণনা করেছেন ক্লান্তিহীন। তা অবশ্য ঠিক একঘেঁয়ে হয়ে ওঠেনি তার বলার ধরনের কারণেই হয়তো। তবে লক্ষণীয় এই, এই যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বর্ণনা তিনি দিচ্ছেন, এর এমন ছবিসদৃশ্য উপস্থাপনই আসলে ফিকশনটিকে বাস্তবতার এত নিকটে নিয়ে এসেছে। যে জগত ছিলো তার মাথার ভেতরে, যে জীবন তিনি নির্মাণ করেছেন তার চরিত্রদের জন্য, সেখানটার পরিপূর্ণ চিত্র বাস্তব হয়ে আমাদের কাছে এসেছে সৎ বর্ণনার কারণেই। তাই হয়তো পড়তে পড়তে কাফকা কিংবা নাকাতাকে এত জীবন্ত লাগে।
কাফকা অন দ্যা সোরে মুরাকামি পপুলার কালচার, সাসপেন্স, হিউমার, বিজ্ঞান, মিউজিক, অন্য বাস্তবতা, পরা-বাস্তবতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ গড়ে তুলেছেন। অর্থাৎ, এ বোধ হয় যে, এর আগে এমন কিছু আর পড়িনি তো! আছে প্রচুর যৌন অনুসংগ, জাপানি ধর্মীয় ঐতিহ্যের ব্যবহার, বিশ্ব সাহিত্যের উল্লেখ। মুরাকামি ভাষা বর্ণনায় প্রচুর চিত্রকল্প ব্যবহার করেন। এবং এগুলো পড়ে উঠার অনুভূতি মনোমুগ্ধকর। কিছু কিছু উপমা কাব্য-ব্যঞ্জনায় ঝলমলিয়ে উঠে। এবং যথেষ্ট ইন্টারস্টেং তো বটেই। এই যেমন: sometimes fate is like a small sandstorm, that keeps changing direction, কিংবা, Memories warm you up from the inside. But they also tear you apart. কিংবা, Silence, I discover, is something you can actually hear. Not just beatiful, though – the stars are like the trees in the forest, alive and breathing. And they’re watching me.
এ লেখার শুরুতেই এই বইয়ের প্লট নিয়ে গড়ে ওঠা পাঠকদের প্রশ্নপাহাড়ের কথা বলেছিলাম। বই শেষ করে বেশ কিছু ধাঁধাঁ আসলেই মনকে আলোড়িত করে রাখে। কাফকার পিতার প্রকৃত খুনী কে? - এমন মোটা দাগের প্রশ্নের সমাধানও মুরাকামি উন্মুক্ত করে রেখেছেন পাঠকের জন্য। তারওপর কিছু অতিলৌকিক প্রাণী ও ঘটনা ঘটে নানান সময়ে, তাদের সম্পর্কেও মুরাকামি পাঠকের কৌতূহল জাগিয়ে, ঘটনা ঘটিয়ে পরবর্তী ঘটনায় নিয়ে যান। কাফকা অন দ্যা সোরের মূল গল্পের সাথে চোরাস্রোত হিসেবে চলতে থাকে আত্ম-প্রতিষ্ঠার গুণ, স্বপ্ন ও বাস্তবতার বিপরীতমুখী আর্ন্তসম্পর্ক, নিয়তির বহুমুখী তাড়না, মিথের দূরলক্ষ্য ভবিষ্যবচন, চেতন-অচেতনের সূক্ষ্ম সীমানার উভমুখী দোলন সহ আরো নানান উপাদান - যেগুলোকে মুরাকামি অত্যন্ত দক্ষহাতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, যারা ব্যবহৃত হয়েছে গল্পেরই প্রয়োজনে, এবং কে না জানে, খুব কুশলী না হলে গল্প হয়ে পড়তে পারে ওসব প্রকাশের হাতিয়ার মাত্র। মুরাকামির এই জটিল চোরাগুপ্তা পথে কাহিনী নির্মাণের মূল কথা আছে তার ভাষায়: ''The best way to think about reality'to get as far away from it as possible.'' অথচ এই কাজটি তিনি এমন সুস্বাদু উপায়ে করেন যেন, হ্যাঁ, এমন তো হতেই পারে। নাকাটার সাথে বিড়ালরা যে আবহাওয়ার খোঁজখবর দিয়ে কথা শুরু করে - এ আর এমন কী! আকছারই হচ্ছে। গল্পকার হিসেবে হারুক মুরাকামির এটাই অনন্য বৈশিষ্ট্য। এমন আপাত আজগুবি এবং স্বপ্নসম ঘটনাবলী তিনি ঘটান, তা সত্ত্বেও পাঠকের মনে হয় না এসব তিনি ঘটাচ্ছেন, প্রদর্শিত স্বপ্নটি তিনি দেখাচ্ছেনই না আদৌ, এটাই বাস্তব। আর যদি স্বপ্ন হয়েও থাকে, তার কারিগরও পাঠক নিজেই, এ তারই নিজ কল্পনা, মুরাকামির নয়।
কাফকা অন দ্যা সোরের ইংরেজি ভার্সন প্রকাশিত হয়েছে ভিনটেজ বুক, লণ্ডন থেকে। অনুবাদক: ফিলিপ গ্রেবরিয়েল। অনুবাদটি ২০০৬ সালের পেন/ বুক-অফ দ্যা-মান্থ ক্লাব ট্রানস্লেশান প্রাইজ পেয়েছে। পেপার ব্যাকে ৫০৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী এ দীর্ঘ উপন্যাস ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসী এওয়ার্ড পেয়েছে ২০০৬ সালে। ডেভিড মিসেলের কথায়: “আমি মনে করি, এটা বলা যায় যে, কাফকা অন দ্যা সোর মুরাকামি মাস্টারপিস হয়তো নয়, কিন্তু এটি একটি উদ্ভাবনী, মনোমুগ্ধকর, অতিযত্নের উপন্যাস...।” দীর্ঘ এ উপন্যাসটি পাঠ শেষে টের পাই, মুরাকামির জগতটি এই আশে পাশেই কোথাও আছে, ভিন্ন আলোয়, অন্য সংকেতে, পর্দার ভিন্ন ভাঁজের আড়ালে সে জগতে বারবার ডুব দেয়া চলে। মুরাকামিই বলেছেন: “একটি কাহিনী, একটি মনোগাটরি ( গল্প) - এমন কোন জিনিস না যা তুমি তৈরি করবে। এটা এমন জিনিস যা তুমি তোমার ভেতর থেকে টেনে বের করবে। গল্পটি ওখানেই ছিলো, তোমার ভেতরেই। বানানো নয়, বড় জোর ওটাকে তুমি বাহিরে তুলে আনতে পারো।” আমাদের নানামুখী অভিজ্ঞতা, দৃশ্য-শ্রাব্যতার আধুনিক ভজঘট প্রতিদিন কত কত অলীক সম্পর্ক গড়ে নানান স্নায়ু সংকেতে, কত যে গল্প-গাঁথা গেঁথে তোলে মননের কোন আড়ালে, মুরাকামি যেন সেই টুকরো-টাকরা দিয়ে জগত গড়েন, গড়ে আমাদের দেখান। মনে পড়ে জীবনানন্দের লাইন: ... আমাদের হৃদয়ের ব্যথা/ দূরের ধূলোর পথ ছেড়ে/ স্বপ্নেরে - ধ্যানেরে/ কাছে ডেকে লয়!/ উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়,/ মানুষেরো আয়ু শেষ হয়!/ পৃথিবীর পুরনো সে পথ/ মুছে ফেলে রেখা তার, -/ কিন্তু এই স্বপ্নের জগত, চিরদিন রয়... (কবিতা: স্বপ্নের হাতে)।
0 মন্তব্যসমূহ