বিষ্ণুরামের মন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে। এই জীবনের স্বপ্নই কি সে গড়েছিলো বিশ বছর আগে ! এ. এস. এম. মালবাবু, আর চেকার--বিষ্ণুরাম ব্যতীত এরাই স্টেশনের জনবল। বিষ্ণুরাম এদের প্রত্যেকের চেয়েই বয়সে বড়, তবু এরাই তার বন্ধু, উপদেশের জনো ছুটতে হয় এদেরই কাছে। পৃথিবীতে যে আরও মানুষ আছে তা মনে পড়িয়ে দেয় ‘আপ’ আর "ডাউন' ট্রেন দুখানা। অগণিত নরনারী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছোট্ট স্টেশন-ঘরটির দিকে--দু-একটি ছোকরা যাত্রী অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি ফেলে তার কোয়ার্টারের জানলায়। বিষ্ণুরামের জীবনে আছে শুধু অপেক্ষা-সূর্যোদয় মনে পড়িয়ে দেয় সন্ধ্যার কথা, আর সন্ধ্যা—রাত্রির।
না, এর একটা শেষ চাই।
একখানা মালগাড়ি হুইস্ল্ দিতে দিতে চলে যায়। বিষ্ণুরাম ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে, ঘুমের চোখে কুলঙ্গি থেকে পকেট-ঘড়িটা টেনে নিয়ে সময় দেখে। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে--এ. এস. এম. শিবু বেচারা সমস্ত রাত নাইট ডিউটি দিয়েছে,তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
--কই গো, তোমার চা হলো?
সাবিত্রী রান্নাঘর থেকেই উত্তর দেয় ; এই যে, জল ফুটে এসেছে।
বিষ্ণুরামের বিরক্তিভরা মন বিচলিত হয়ে ওঠে। বলে, আর হয়ে এসেছে! বলি, স্টেশনে যেতে হবে না ?
আঁচল দিয়ে কেটলিটা ধরে নিয়ে সাবিত্রী সেটা সশব্দে মেঝেতে নামিয়ে রাখে। ঢাকনিটা খুলে এক মুঠো চায়ের পাতা কোটলিতে ফেলে দিয়ে সাবিত্রী বেশ একটু গম্ভীর হয়েই বলে, কি হলো কি, সকাল থেকে খিঁচিয়ে রয়েছো যে? বিষ্ণুরামও বলে, সে জ্ঞান কি তোমার আছে! শিবুকে রিলিভ করতে হবে না ?
—ও, প্রাণ গলে গেল শিবুর দঃখে, আর আমি যে এদিকে রাতভোর ঘুমুতে পাই না, সেটা আর খেয়ালই হয় না, না ? আমার বেলায় ভোর চারটেয় চা চাই!
বিষ্ণুরাম আশ্চর্য হয়ে বলে, তুমি আবার রাত্তিরে ঘুমুতে পাও না ?
—তা আর জানবে কি করে, ষাঁড়ের মতো নাক ডাকিয়ে ঘুমোও, মনে করো সবাই তোমার মতো মনের সুখে ঘুমুতে পায়। বলি রাত্তিরে তিনবার করে কাঁথা বদলানো, গৌতম-গোরাকে নিয়ে কলঘরে দাঁড়ানো-- এসব তুমি করো ! কাচের গ্লাসে চা ঢেলে স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, নাও। অ্যাদ্দিন ধরে বলছি গার্ডকে সিলির হাট থেকে ছাঁকনি এনে দেবার জন্যে বলতে,তা আর পারলে না!
বিষ্ণুরামও বলে, হ্যাঁ, সাহেব গার্ড আজকাল, তা জানো? তাকে বলবো ছাঁকনি আনতে?
সাবিত্রী ফোঁস করে ওঠে, রেখে দাও তোমার সায়েব, আমার মতো গায়ের রঙ, সে আবার সাহেব ! বলেই দেখো না একদিন। পরক্ষণে সাবিত্রী নিজেই বলে, না-হয়, বরফআলাটাকে বলে দিও, সে তো যায় সিলি পর্যন্ত।
- -আইস-ভেন্ডারকে? বেশ বলেছো। তার চেয়ে বলো না একটা ছুরি কিনে দিয়ে তার সামনে গলাটা বাড়িয়ে দিই। ছুরি--ছুরি, জানো সাবু, একেবারে ছুরি বসিয়ে দেবে। ওসব লোককে বিশ্বাস নেই--ছোটলোক ক্লাস, পাঁচ আনায় কিনে বলবে, ছ আনা--আবার পূজোর সময় বকশিশ চাইবে।
কোনরকমে গরম চাটুকু ঢকচক করে গিলে নিয়ে একটা বিড়ি ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। সাবিত্রী চিমটে দিয়ে একটা জলন্ত কয়লা তুলে ধরে। বিষ্ণুরামও বিড়িটা ধরিয়ে নেয়।
সাবিত্রী বলে, কয়লা আবার শেষ হয়ে এলো, কয়লার গাড়ি কবে আসবে?
বিষ্ণুরাম বলে, কয়লার গাড়ি আর এখন যাবে না, মালগাড়ির ইঞ্জিন থেকে নাবিয়ে নিতে হবে। আজকাল মিলিটারির ঠেলায়--। বলে বিষ্ণুরাম পিড়িটা টেনে নিয়ে বসতে যাচ্ছিলো, সাবিত্রী বলে ওঠে, যাও, যাও, বসতে হবে না, তাড়াতাড়ি সেরে এসো, আবার ছেলেগুলো উঠলে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করবে। তোমার তো আবার দরজায় ধাক্কা দিলে--। বলেই সাবিত্রী হেসে ফেলে।
বিষ্ণুরাম চলে যায়, সাবিত্রী গিয়ে দাঁড়ায় খিড়কির দরজায়। গ্রাম্য অপরিষ্কার একটি বিলাসপুরী মেয়ে চলেছে মেঠো পথ ধরে--চেকারবাবুর বাড়িতে সে বাসন মাজে। লুধিয়া তার নাম, কিন্তু লোকে ডাকে--'রয়তাইন'।
সাবিত্রী ডাকে, এ রয়তাইন, দেখ্, রাস্তেমে রামদীনসে মিলনেসে জলদি ভেজ্ দেনা, হাঁ ?
—কাহে বাঈ ?
—সুরয কাঁহা দেখ্ তো? আভিতখ্ নাহি আয়া, ইসকা বাদ গাইয়া দুহনে হোগা, ঝারু-আরু লাগানে হোগা। যা, জলদি যাকে বোল দেনা।
বিষ্ণুরাম গাড়ুটা রেখে গামছায় পা মুছতে মুছতে এসে হাজির হয়, বলে, দেখ সাব, আমি এই পাঁচিশ বছর এখানে রয়েছি, তবু হিন্দী বলতে পারি না, আর তুমি এই সাত বছরের মধ্যে পাকা হিন্দুস্থানী হয়ে গেলে?
সাবিত্রী একমুখ হেসে বলে, শিবুকে রিলিফ দেবার কথা ভুলে গেলে?
একখানা হলদে মোটা পাবনার গেঞ্জি মাথায় গলিয়ে দিয়ে গলার বোতাম আঁটতে আঁটতে চিৎকার করে, ও সাবু, কোথায় গেলে গো, কোটটা দিয়ে যাও। সাবিত্রী রেলের কালো কোটাটা নিয়ে এসে হাজির হয়, বলে, কোট আনতেই গিয়েছিলাম। তুমি গেঞ্জি পরেই চলে যেতে পারো, কিন্তু আমার মনে থাকে, বুঝলে ?
বিষ্ণুরাম কোটটা গেঞ্জির উপরই পরে নেয়। তারপর চটিটা টানতে টানতে স্টেশনের দিকে যায়।
সাবিত্রী চিৎকার করে বলে দেয়, মাছ চালান-টালান থাকলে দু-একটা এনো।
রুটিন-বাঁধা জীবন। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ‘টরে টক্কা'--সংবাদ আদান-প্রদান, আর পয়েস্টটসম্যানকে দু-একটা অবাঙালী অশ্লীলতা-মাখানো আদেশ। এই তো তার জীবন।
--বাবুজী, বাফুরমে তো আভি তিন শো সাঁয়তিশ নম্বর কা চুনাকা গাড়ি হায়, খালি নাই হুয়া।
- -সে কি রে? এক হপ্তা হয়ে গেল, ডেমারেজ লাগবে যে! বলে দিস ব্রিজলালকে এবার আর ডেমারেজ বাঁচাতে পারবো না, এম্প্টি ফেরত পাঠাবার অর্ডার এসে গেছে।...খেলে যা, টু আপের ‘তার' আসেনি এখনও ? যা তো, শিবুর কাছে জিজ্ঞেস করে আয় 'ইনিংসে' পেয়েছে কি না, পেয়ে থাকলে কোথায় রেখেছে খোঁজ নিয়ে আসিস।--কেয়া মাংতা ? হাঁ, গাড়ি আভি আয়গা।...নেই, ডেহরা কামরেকা টিকিট নেই হয়, থার্ড ক্লাস হায়।...বাবুজী, মাল বুক করেগা, না ব্ল্যাঙ্ক টিকিট বানায়গা? ঠিক বাত্, টিকিটটা কুছ দরকার নাই হায়, হাম টি.সি.–কো বোল দেগা। হাঁ, পান খানেকা পয়সা তো মিলনাই চাহিয়ে।...আরে ও রামদীন, ফ্ল্যাগ দেখাবি যা, গাড়ি ইন করছে।
হুস হুস শব্দে আপ ট্রেনখানা এসে পৌঁছয়।--সোডা লেমনেড, সোডা লেমনেড। ওই একটি মাত্র শব্দ--ফেরিওয়ালার অনুপস্থিতি বিষ্ণুরামের অভ্যেস হয়ে গেছে।
---এই পানিপাঁড়ে, পানিপাঁড়ে !
মাস্টারমশায়কে দেখতে পেয়েই যাত্রীটি চিৎকার করে, মাস্টার সাব, পানিপাঁড়েকো জেরা-
--আভি দেতা বুলাকে। মাস্টার সাব হন হন করে গার্ডের গাড়ির দিকে ছোটে--খাতা মিলিয়ে মাল নামিয়ে নিতে হবে। মনে মনে বলে, শালা যেন হাওড়া স্টেশন পেয়েছে, পানিপাঁড়ে! সে ব্যাটা যদি তোকে জল দিতে আসবে তো আমার বাটনা বাটবে কে?
--হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। অল রাইট স্যার।
গাড়ি হুইস্ল্ দিয়ে চলে যায়--গার্ডের সবুজ পতাকাটা তখনও দেখা যায়। চিরন্তন ক্লান্তির ছাপটা স্টেশনের বুকে নেমে আসে। নিস্তব্ধ নিঃশব্দ প্রান্তর।
--মাস্টারবাবু, আমাদের মাছ এসেছে ?
--হ্যাঁ, এসেছে বইকি, পাঠালে আবার আসে না!
--ডেলিভারিটা দিয়ে দিন না একটু তাড়াতাড়ি।।
--তা দিচ্ছি, কিন্তু আমাকে কিছু মাছ আজ দিতেই হবে।
--আজ্ঞে, সে কি করে হয়, ওজন-করা মাল।
--না-হয় দাম দেবো রে বাপু।
--বারো আনা সের--বলুন কত চাই ?
--বেশ বাপু, তাই দে, এক সের আন্দাজ একটা ।
--খুচরো আছে ? এক টাকার নোট বের করলে হবে না।
চেকারবাবু এসে হাজির হয়।
—কি মাস্টারমশায়, গরিবের একটি মাছ মেরে দিলেন তো ?
বিষ্ণুরাম আশ্চর্য হয়ে বলে, মেরে দিলাম কি হে সত্যেন ? নগদ বারো আনা পয়সা দিচ্ছি, তাও খুচরো।
চেকারবাবু, কপট ক্রোধে বলে, আপনার কাছে পয়সা নিচ্ছে? সত্যিই তা’লে কাল ফুরিয়ে এসেছে, চেতাবনীর কথাই ফললো দেখছি।
বিষ্ণুরাম ক্যাশ থেকে খুচরা বারো আনা পয়সা বার করে দিতে যাচ্ছিলো, চেকারবাবু বলে ওঠে, পয়সা কি দিচ্ছেন, আগে ওজন দেখুন ?
মৎস্য-ব্যবসায়ীটি চেকারবাবুরে দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। ওজন দেখা হয়, এক মণ পঁয়ত্রিশ সের--ঠিক আছে। ভলিয়ুম মেপে দেখুন তো। দেখা যায় ভলিয়ুম অনেক বেশী।
চেকারবাবু বলে, হু’ হু’ হুইচেভার ইজ গ্রেটার। এবার বাছাধন ? হয় মাছটি দাও, না-হয় দু টাকা দশ আনা এক্সট্রা দাও।
--সে কি মাস্টারবাবু? সেখান থেকে ভাড়া দিয়ে পাঠিয়েছে, বেশী লাগলে তো সেখানেই চার্জ করতো।
বিষ্ণুরাম বিরক্ত হয়ে বলে, আইন শেখাতে হবে না, যা বললাম কর্, পরে রিপোর্ট করিস না-হয় ।
চেকারবাবুও এ কথায় সায় দেয়। সাবিত্রীর ভাগ্যে আমিষ জুটে যায়।
মিলিটারী স্পেশালটা আসতে কত দেরি, খেলারি থেকে তারে সে খবরটা নিয়ে বিষ্ণুরাম বাড়ি আসে। সাবিত্রী বিষ্ণুরামের কোটটা খুলে নিয়ে আলনায় টাঙিয়ে রাখে। বিষ্ণুরাম গেঞ্জিটা খুলে একটা টুল টেনে নিয়ে বসে, ঘর্মাক্ত লোমশ বুকটায় হাত বোলাতে থাকে। সাবিত্রী রান্নাঘরে পাখার সন্ধান করতে গিয়ে দেখে গোরা পাখাটার ডাঁটে করে একটা জলন্ত কয়লা তোলবার চেষ্টা করছে। সাবিত্রী রাগে ফেটে পড়ে।
হারমজাদা ছেলের কাণ্ড দেখো! পইপই করে তোকে বারণ করছি না, পাখা পোড়াতে নেই?
--পোড়ালাম আবার কই ? গৌরাঙ্গ মাখ কাচুমাচু করে উত্তর দেয়।
--পোড়ালাম আবার কই? আগুনে ঠেকালে পোড়ানো হলো না?
বিষ্ণুরাম শ্রান্ত বিরক্ত মুখে এসে হাজির হয়। স্টেশন-মাস্টারের একঘেয়ে জীবনের মাঝে যদি বাড়িতে এসেও একটু শান্তি না পাওয়া যায়, তবে আর মানুষের বেঁচে কি লাভ?
বলে, কি হলো কি, এত চিৎকার করছো যে?
সাবিত্রী ক্রোধান্বিত হয়েই উত্তর দেয়, হবে আবার কি? আমি একটু হাওয়া করবো বলে পাখা খুঁজে মরছি, আর ছেলে এদিকে সেটা আগনে পোড়াচ্ছে।
বিষ্ণুরাম বিনাবাক্যে গোরার হাত থেকে পাখাটা কেড়ে নিয়ে তার পিঠে ঘা কয়েক বসিয়ে দেয়।
বিষ্ণুরাম স্নান সেরে খেতে বসে, সাবিত্রী মাছি তাড়ায়। সাবিত্রী বলে, রামদীনকে বলে বলে তো পারলাম না। আজ এখনও কুয়ো থেকে জল তুলে দিয়ে যায়নি।
রামদীনের ডাক পড়ে। সে উঠনে এসে দাঁড়ায়।
বিষ্ণুরাম গম্ভীর গলায় বলে, এতক্ষণ কি করছিলি? জল তুলতে হবে না?
--জী, ভোজন করছিলাম। এখনি তুলে দিচ্ছি।
বিষ্ণুরাম রামদীনের কথায় হো-হো করে হেসে ফেলে।
—তুই ব্যাটা ভোজন করছিলি কি রে? ভোজন করবে বর্ধমানের মহারাজা, আমি করবো আহার, তুই ব্যাটা খাবি।
সাবিত্রীও হাসে। বিষ্ণুরাম এখনও শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে যায়নি!
আহারের পর আবার সেই স্টেশন। টরে টক্কা--টরে টক্কা--টরে টরে। মিলিটারী স্পেশালখানা চলে যায়। টি. এস.-এর মোটর-ট্রলিখানা বিদ্যুদ্বেগে চলে যায়। তারপর আসে ‘ডাউন’ ট্রেনখানা। মিনিট কয়েকের হইচই। পুনরায় সেই অসহ্য নীরবতা নেমে আসে সন্ধ্যার আবছায়া-অন্ধকারে। বিষ্ণুরাম তার কোটের পেতলের বোতামটা আঙুলে ঘষতে ঘষতে বাড়ি ফেরে।
--গৌতমটা গেল কোথায় ?
সাবিত্রী বলে, খেলতে গেছে, এখনি আসবে।
বিষ্ণুরাম ঈষৎ ক্রোধে বলে, সে ব্যাটার কিস্সু হবে না, বললাম টেলিগ্রাফিটা শিখে রাখতে, একটা এ. এস. এম-এর চাকরি হবে, তা না, কেবল টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো।
সাবিত্রী একটা থালায় করে দুখানা রুটি আর কিছ আলুভাজা নিয়ে এসে বিষ্ণুরামের সামনে নামিয়ে রেখে যায়। গোরা ওরফে গৌরাঙ্গ মায়ের পেছনে পেছনে এসে জলের গ্লাসটা বিষ্ণুরামের হাতে তুলে দিয়েই সরে পড়ে। ও-বেলার প্রহারটা তার এখনও মনে আছে।
জলযোগ সেরে বিষ্ণুরাম বের হয় শিবুর বাসার উদ্দেশে—তাসের আড্ডায়।
রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। গৌতম, গৌরাঙ্গ—এরা ঘুমিয়ে পড়েছে, সাবিত্রী ছোট মেয়েটাকে কোলে বসিয়ে বিষ্ণুরামের অপেক্ষা করে। বালতি বালতি তরল অন্ধকার যেন গড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীর বুকে--সাবিত্রীর মনে হয়, অন্যদিন তো এত দেরি হয় না ; জাফরির ফাঁকে চোখ রেখে লাইনের ও-পারে শিবুরে বাসার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সে দাঁড়িয়ে থাকে। বহুদূরে একটা কালো ছায়া দেখতে পেয়ে আশান্বিত হয়ে ওঠে, পরক্ষণেই বুঝতে পারে তার ভুল--বিষ্ণুরাম নয়, ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের পাহারাওয়ালা লাইন দেখে বেড়াচ্ছে। কোলের ঘুমন্ত মেয়েটা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সাবিত্রী তাকে নিয়ে সরে আসে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকে স্তন দেয়। কান উদ্গ্রীব থাকে একটা পরিচিত পদশব্দের আশায়।
শিকল নাড়ার শব্দে সাবিত্রী চমকে ওঠে। ঘুমের চোখেই ছুটে গিয়ে খিল খুলে দেয়। বিষ্ণুরাম ঘরে ঢুকেই বলে, তোমাকে আর বলে বলে পারলাম না। বলেছি না, আগে গলার সাড়া নিয়ে তবে দরজা খুলবে?
সাবিত্রী নিজের দোষ ঢাকা দেবার চেষ্টায় বলে, তোমার পায়ের শব্দ পেলেই আমি বুঝতে পারি, সাড়া নিয়ে দরকার?
বিষ্ণুরাম প্রগাঢ় আগ্রহে সাবিত্রীকে বুকের কাছে টেনে নেয়, সাবিত্রীর মুখটা ঘুরিয়ে ধরে তার নিজের মুখের দিকে। সাবিত্রীও মুহূর্তের জন্যে নিজেকে ছেড়ে দেয় স্বামীর হাতে ; পরক্ষণেই বিষ্ণুরামের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, লজ্জা করে না তোমার ! বুড়ো হতে চললে-এখনও ওইসব ? কপট ক্রোধে সে চলে যায় ভাত বাড়তে। বিষ্ণুরাম এখনও অভুক্ত।
বিষ্ণুরামের মুখে হাসি দেখা যায়--অতি দুঃখের হাসি। সমস্ত বুকটা তার মোচড় দিয়ে ওঠে। তার বয়স হয়েছে? হ্যাঁ, সত্যই তো সে এখন বৃদ্ধ। দোষ আর কারও নয়, দোষ তার বয়সের। আজ তাই ছেলেরা তাকে মানে না, তার প্রতি সাবিত্রীর আর-কোনো আকর্ষণ নেই।
বিষ্ণুরামের যৌবনের কথা মনে পড়ে। সাবিত্রীর একটা চিঠির উত্তর তার আজও মনে আছে। সাবিত্রী লিখেছিলো, ‘চিঠির শেষে তুমি যা চেয়েছো, তা কি চিঠিতে দেওয়া যায়, একদিন এখানে এসে নিয়ে যেয়ো।’ বিষ্ণুরাম ভাবে সেই জীবন আর এই জীবন--কত পার্থক্য।
কোলের খুকীটার কান্নায় তার তন্ময়তা ভেঙে যায়। একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ এসে নাকে ঠেকে। সাবিত্রী খুকীটার পিঠে ঘা কয়েক বসিয়ে দিয়ে কাঁথাটা টেনে নিয়ে চলে যায়।
বিষ্ণুরাম ভাবে, এ সংসারে থাকা অপেক্ষা তার স্টেশন-ঘর অনেক ভালো--টরে টক্কা—টরে টরে।
সেখানে আনন্দ না থাকতে পারে, অশান্তি তো নেই।
১৩৫০
না, এর একটা শেষ চাই।
একখানা মালগাড়ি হুইস্ল্ দিতে দিতে চলে যায়। বিষ্ণুরাম ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে, ঘুমের চোখে কুলঙ্গি থেকে পকেট-ঘড়িটা টেনে নিয়ে সময় দেখে। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে--এ. এস. এম. শিবু বেচারা সমস্ত রাত নাইট ডিউটি দিয়েছে,তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
--কই গো, তোমার চা হলো?
সাবিত্রী রান্নাঘর থেকেই উত্তর দেয় ; এই যে, জল ফুটে এসেছে।
বিষ্ণুরামের বিরক্তিভরা মন বিচলিত হয়ে ওঠে। বলে, আর হয়ে এসেছে! বলি, স্টেশনে যেতে হবে না ?
আঁচল দিয়ে কেটলিটা ধরে নিয়ে সাবিত্রী সেটা সশব্দে মেঝেতে নামিয়ে রাখে। ঢাকনিটা খুলে এক মুঠো চায়ের পাতা কোটলিতে ফেলে দিয়ে সাবিত্রী বেশ একটু গম্ভীর হয়েই বলে, কি হলো কি, সকাল থেকে খিঁচিয়ে রয়েছো যে? বিষ্ণুরামও বলে, সে জ্ঞান কি তোমার আছে! শিবুকে রিলিভ করতে হবে না ?
—ও, প্রাণ গলে গেল শিবুর দঃখে, আর আমি যে এদিকে রাতভোর ঘুমুতে পাই না, সেটা আর খেয়ালই হয় না, না ? আমার বেলায় ভোর চারটেয় চা চাই!
বিষ্ণুরাম আশ্চর্য হয়ে বলে, তুমি আবার রাত্তিরে ঘুমুতে পাও না ?
—তা আর জানবে কি করে, ষাঁড়ের মতো নাক ডাকিয়ে ঘুমোও, মনে করো সবাই তোমার মতো মনের সুখে ঘুমুতে পায়। বলি রাত্তিরে তিনবার করে কাঁথা বদলানো, গৌতম-গোরাকে নিয়ে কলঘরে দাঁড়ানো-- এসব তুমি করো ! কাচের গ্লাসে চা ঢেলে স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, নাও। অ্যাদ্দিন ধরে বলছি গার্ডকে সিলির হাট থেকে ছাঁকনি এনে দেবার জন্যে বলতে,তা আর পারলে না!
বিষ্ণুরামও বলে, হ্যাঁ, সাহেব গার্ড আজকাল, তা জানো? তাকে বলবো ছাঁকনি আনতে?
সাবিত্রী ফোঁস করে ওঠে, রেখে দাও তোমার সায়েব, আমার মতো গায়ের রঙ, সে আবার সাহেব ! বলেই দেখো না একদিন। পরক্ষণে সাবিত্রী নিজেই বলে, না-হয়, বরফআলাটাকে বলে দিও, সে তো যায় সিলি পর্যন্ত।
- -আইস-ভেন্ডারকে? বেশ বলেছো। তার চেয়ে বলো না একটা ছুরি কিনে দিয়ে তার সামনে গলাটা বাড়িয়ে দিই। ছুরি--ছুরি, জানো সাবু, একেবারে ছুরি বসিয়ে দেবে। ওসব লোককে বিশ্বাস নেই--ছোটলোক ক্লাস, পাঁচ আনায় কিনে বলবে, ছ আনা--আবার পূজোর সময় বকশিশ চাইবে।
কোনরকমে গরম চাটুকু ঢকচক করে গিলে নিয়ে একটা বিড়ি ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। সাবিত্রী চিমটে দিয়ে একটা জলন্ত কয়লা তুলে ধরে। বিষ্ণুরামও বিড়িটা ধরিয়ে নেয়।
সাবিত্রী বলে, কয়লা আবার শেষ হয়ে এলো, কয়লার গাড়ি কবে আসবে?
বিষ্ণুরাম বলে, কয়লার গাড়ি আর এখন যাবে না, মালগাড়ির ইঞ্জিন থেকে নাবিয়ে নিতে হবে। আজকাল মিলিটারির ঠেলায়--। বলে বিষ্ণুরাম পিড়িটা টেনে নিয়ে বসতে যাচ্ছিলো, সাবিত্রী বলে ওঠে, যাও, যাও, বসতে হবে না, তাড়াতাড়ি সেরে এসো, আবার ছেলেগুলো উঠলে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করবে। তোমার তো আবার দরজায় ধাক্কা দিলে--। বলেই সাবিত্রী হেসে ফেলে।
বিষ্ণুরাম চলে যায়, সাবিত্রী গিয়ে দাঁড়ায় খিড়কির দরজায়। গ্রাম্য অপরিষ্কার একটি বিলাসপুরী মেয়ে চলেছে মেঠো পথ ধরে--চেকারবাবুর বাড়িতে সে বাসন মাজে। লুধিয়া তার নাম, কিন্তু লোকে ডাকে--'রয়তাইন'।
সাবিত্রী ডাকে, এ রয়তাইন, দেখ্, রাস্তেমে রামদীনসে মিলনেসে জলদি ভেজ্ দেনা, হাঁ ?
—কাহে বাঈ ?
—সুরয কাঁহা দেখ্ তো? আভিতখ্ নাহি আয়া, ইসকা বাদ গাইয়া দুহনে হোগা, ঝারু-আরু লাগানে হোগা। যা, জলদি যাকে বোল দেনা।
বিষ্ণুরাম গাড়ুটা রেখে গামছায় পা মুছতে মুছতে এসে হাজির হয়, বলে, দেখ সাব, আমি এই পাঁচিশ বছর এখানে রয়েছি, তবু হিন্দী বলতে পারি না, আর তুমি এই সাত বছরের মধ্যে পাকা হিন্দুস্থানী হয়ে গেলে?
সাবিত্রী একমুখ হেসে বলে, শিবুকে রিলিফ দেবার কথা ভুলে গেলে?
একখানা হলদে মোটা পাবনার গেঞ্জি মাথায় গলিয়ে দিয়ে গলার বোতাম আঁটতে আঁটতে চিৎকার করে, ও সাবু, কোথায় গেলে গো, কোটটা দিয়ে যাও। সাবিত্রী রেলের কালো কোটাটা নিয়ে এসে হাজির হয়, বলে, কোট আনতেই গিয়েছিলাম। তুমি গেঞ্জি পরেই চলে যেতে পারো, কিন্তু আমার মনে থাকে, বুঝলে ?
বিষ্ণুরাম কোটটা গেঞ্জির উপরই পরে নেয়। তারপর চটিটা টানতে টানতে স্টেশনের দিকে যায়।
সাবিত্রী চিৎকার করে বলে দেয়, মাছ চালান-টালান থাকলে দু-একটা এনো।
রুটিন-বাঁধা জীবন। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ‘টরে টক্কা'--সংবাদ আদান-প্রদান, আর পয়েস্টটসম্যানকে দু-একটা অবাঙালী অশ্লীলতা-মাখানো আদেশ। এই তো তার জীবন।
--বাবুজী, বাফুরমে তো আভি তিন শো সাঁয়তিশ নম্বর কা চুনাকা গাড়ি হায়, খালি নাই হুয়া।
- -সে কি রে? এক হপ্তা হয়ে গেল, ডেমারেজ লাগবে যে! বলে দিস ব্রিজলালকে এবার আর ডেমারেজ বাঁচাতে পারবো না, এম্প্টি ফেরত পাঠাবার অর্ডার এসে গেছে।...খেলে যা, টু আপের ‘তার' আসেনি এখনও ? যা তো, শিবুর কাছে জিজ্ঞেস করে আয় 'ইনিংসে' পেয়েছে কি না, পেয়ে থাকলে কোথায় রেখেছে খোঁজ নিয়ে আসিস।--কেয়া মাংতা ? হাঁ, গাড়ি আভি আয়গা।...নেই, ডেহরা কামরেকা টিকিট নেই হয়, থার্ড ক্লাস হায়।...বাবুজী, মাল বুক করেগা, না ব্ল্যাঙ্ক টিকিট বানায়গা? ঠিক বাত্, টিকিটটা কুছ দরকার নাই হায়, হাম টি.সি.–কো বোল দেগা। হাঁ, পান খানেকা পয়সা তো মিলনাই চাহিয়ে।...আরে ও রামদীন, ফ্ল্যাগ দেখাবি যা, গাড়ি ইন করছে।
হুস হুস শব্দে আপ ট্রেনখানা এসে পৌঁছয়।--সোডা লেমনেড, সোডা লেমনেড। ওই একটি মাত্র শব্দ--ফেরিওয়ালার অনুপস্থিতি বিষ্ণুরামের অভ্যেস হয়ে গেছে।
---এই পানিপাঁড়ে, পানিপাঁড়ে !
মাস্টারমশায়কে দেখতে পেয়েই যাত্রীটি চিৎকার করে, মাস্টার সাব, পানিপাঁড়েকো জেরা-
--আভি দেতা বুলাকে। মাস্টার সাব হন হন করে গার্ডের গাড়ির দিকে ছোটে--খাতা মিলিয়ে মাল নামিয়ে নিতে হবে। মনে মনে বলে, শালা যেন হাওড়া স্টেশন পেয়েছে, পানিপাঁড়ে! সে ব্যাটা যদি তোকে জল দিতে আসবে তো আমার বাটনা বাটবে কে?
--হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। অল রাইট স্যার।
গাড়ি হুইস্ল্ দিয়ে চলে যায়--গার্ডের সবুজ পতাকাটা তখনও দেখা যায়। চিরন্তন ক্লান্তির ছাপটা স্টেশনের বুকে নেমে আসে। নিস্তব্ধ নিঃশব্দ প্রান্তর।
--মাস্টারবাবু, আমাদের মাছ এসেছে ?
--হ্যাঁ, এসেছে বইকি, পাঠালে আবার আসে না!
--ডেলিভারিটা দিয়ে দিন না একটু তাড়াতাড়ি।।
--তা দিচ্ছি, কিন্তু আমাকে কিছু মাছ আজ দিতেই হবে।
--আজ্ঞে, সে কি করে হয়, ওজন-করা মাল।
--না-হয় দাম দেবো রে বাপু।
--বারো আনা সের--বলুন কত চাই ?
--বেশ বাপু, তাই দে, এক সের আন্দাজ একটা ।
--খুচরো আছে ? এক টাকার নোট বের করলে হবে না।
চেকারবাবু এসে হাজির হয়।
—কি মাস্টারমশায়, গরিবের একটি মাছ মেরে দিলেন তো ?
বিষ্ণুরাম আশ্চর্য হয়ে বলে, মেরে দিলাম কি হে সত্যেন ? নগদ বারো আনা পয়সা দিচ্ছি, তাও খুচরো।
চেকারবাবু, কপট ক্রোধে বলে, আপনার কাছে পয়সা নিচ্ছে? সত্যিই তা’লে কাল ফুরিয়ে এসেছে, চেতাবনীর কথাই ফললো দেখছি।
বিষ্ণুরাম ক্যাশ থেকে খুচরা বারো আনা পয়সা বার করে দিতে যাচ্ছিলো, চেকারবাবু বলে ওঠে, পয়সা কি দিচ্ছেন, আগে ওজন দেখুন ?
মৎস্য-ব্যবসায়ীটি চেকারবাবুরে দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। ওজন দেখা হয়, এক মণ পঁয়ত্রিশ সের--ঠিক আছে। ভলিয়ুম মেপে দেখুন তো। দেখা যায় ভলিয়ুম অনেক বেশী।
চেকারবাবু বলে, হু’ হু’ হুইচেভার ইজ গ্রেটার। এবার বাছাধন ? হয় মাছটি দাও, না-হয় দু টাকা দশ আনা এক্সট্রা দাও।
--সে কি মাস্টারবাবু? সেখান থেকে ভাড়া দিয়ে পাঠিয়েছে, বেশী লাগলে তো সেখানেই চার্জ করতো।
বিষ্ণুরাম বিরক্ত হয়ে বলে, আইন শেখাতে হবে না, যা বললাম কর্, পরে রিপোর্ট করিস না-হয় ।
চেকারবাবুও এ কথায় সায় দেয়। সাবিত্রীর ভাগ্যে আমিষ জুটে যায়।
মিলিটারী স্পেশালটা আসতে কত দেরি, খেলারি থেকে তারে সে খবরটা নিয়ে বিষ্ণুরাম বাড়ি আসে। সাবিত্রী বিষ্ণুরামের কোটটা খুলে নিয়ে আলনায় টাঙিয়ে রাখে। বিষ্ণুরাম গেঞ্জিটা খুলে একটা টুল টেনে নিয়ে বসে, ঘর্মাক্ত লোমশ বুকটায় হাত বোলাতে থাকে। সাবিত্রী রান্নাঘরে পাখার সন্ধান করতে গিয়ে দেখে গোরা পাখাটার ডাঁটে করে একটা জলন্ত কয়লা তোলবার চেষ্টা করছে। সাবিত্রী রাগে ফেটে পড়ে।
হারমজাদা ছেলের কাণ্ড দেখো! পইপই করে তোকে বারণ করছি না, পাখা পোড়াতে নেই?
--পোড়ালাম আবার কই ? গৌরাঙ্গ মাখ কাচুমাচু করে উত্তর দেয়।
--পোড়ালাম আবার কই? আগুনে ঠেকালে পোড়ানো হলো না?
বিষ্ণুরাম শ্রান্ত বিরক্ত মুখে এসে হাজির হয়। স্টেশন-মাস্টারের একঘেয়ে জীবনের মাঝে যদি বাড়িতে এসেও একটু শান্তি না পাওয়া যায়, তবে আর মানুষের বেঁচে কি লাভ?
বলে, কি হলো কি, এত চিৎকার করছো যে?
সাবিত্রী ক্রোধান্বিত হয়েই উত্তর দেয়, হবে আবার কি? আমি একটু হাওয়া করবো বলে পাখা খুঁজে মরছি, আর ছেলে এদিকে সেটা আগনে পোড়াচ্ছে।
বিষ্ণুরাম বিনাবাক্যে গোরার হাত থেকে পাখাটা কেড়ে নিয়ে তার পিঠে ঘা কয়েক বসিয়ে দেয়।
বিষ্ণুরাম স্নান সেরে খেতে বসে, সাবিত্রী মাছি তাড়ায়। সাবিত্রী বলে, রামদীনকে বলে বলে তো পারলাম না। আজ এখনও কুয়ো থেকে জল তুলে দিয়ে যায়নি।
রামদীনের ডাক পড়ে। সে উঠনে এসে দাঁড়ায়।
বিষ্ণুরাম গম্ভীর গলায় বলে, এতক্ষণ কি করছিলি? জল তুলতে হবে না?
--জী, ভোজন করছিলাম। এখনি তুলে দিচ্ছি।
বিষ্ণুরাম রামদীনের কথায় হো-হো করে হেসে ফেলে।
—তুই ব্যাটা ভোজন করছিলি কি রে? ভোজন করবে বর্ধমানের মহারাজা, আমি করবো আহার, তুই ব্যাটা খাবি।
সাবিত্রীও হাসে। বিষ্ণুরাম এখনও শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে যায়নি!
আহারের পর আবার সেই স্টেশন। টরে টক্কা--টরে টক্কা--টরে টরে। মিলিটারী স্পেশালখানা চলে যায়। টি. এস.-এর মোটর-ট্রলিখানা বিদ্যুদ্বেগে চলে যায়। তারপর আসে ‘ডাউন’ ট্রেনখানা। মিনিট কয়েকের হইচই। পুনরায় সেই অসহ্য নীরবতা নেমে আসে সন্ধ্যার আবছায়া-অন্ধকারে। বিষ্ণুরাম তার কোটের পেতলের বোতামটা আঙুলে ঘষতে ঘষতে বাড়ি ফেরে।
--গৌতমটা গেল কোথায় ?
সাবিত্রী বলে, খেলতে গেছে, এখনি আসবে।
বিষ্ণুরাম ঈষৎ ক্রোধে বলে, সে ব্যাটার কিস্সু হবে না, বললাম টেলিগ্রাফিটা শিখে রাখতে, একটা এ. এস. এম-এর চাকরি হবে, তা না, কেবল টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো।
সাবিত্রী একটা থালায় করে দুখানা রুটি আর কিছ আলুভাজা নিয়ে এসে বিষ্ণুরামের সামনে নামিয়ে রেখে যায়। গোরা ওরফে গৌরাঙ্গ মায়ের পেছনে পেছনে এসে জলের গ্লাসটা বিষ্ণুরামের হাতে তুলে দিয়েই সরে পড়ে। ও-বেলার প্রহারটা তার এখনও মনে আছে।
জলযোগ সেরে বিষ্ণুরাম বের হয় শিবুর বাসার উদ্দেশে—তাসের আড্ডায়।
রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। গৌতম, গৌরাঙ্গ—এরা ঘুমিয়ে পড়েছে, সাবিত্রী ছোট মেয়েটাকে কোলে বসিয়ে বিষ্ণুরামের অপেক্ষা করে। বালতি বালতি তরল অন্ধকার যেন গড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীর বুকে--সাবিত্রীর মনে হয়, অন্যদিন তো এত দেরি হয় না ; জাফরির ফাঁকে চোখ রেখে লাইনের ও-পারে শিবুরে বাসার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে সে দাঁড়িয়ে থাকে। বহুদূরে একটা কালো ছায়া দেখতে পেয়ে আশান্বিত হয়ে ওঠে, পরক্ষণেই বুঝতে পারে তার ভুল--বিষ্ণুরাম নয়, ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের পাহারাওয়ালা লাইন দেখে বেড়াচ্ছে। কোলের ঘুমন্ত মেয়েটা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সাবিত্রী তাকে নিয়ে সরে আসে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাকে স্তন দেয়। কান উদ্গ্রীব থাকে একটা পরিচিত পদশব্দের আশায়।
শিকল নাড়ার শব্দে সাবিত্রী চমকে ওঠে। ঘুমের চোখেই ছুটে গিয়ে খিল খুলে দেয়। বিষ্ণুরাম ঘরে ঢুকেই বলে, তোমাকে আর বলে বলে পারলাম না। বলেছি না, আগে গলার সাড়া নিয়ে তবে দরজা খুলবে?
সাবিত্রী নিজের দোষ ঢাকা দেবার চেষ্টায় বলে, তোমার পায়ের শব্দ পেলেই আমি বুঝতে পারি, সাড়া নিয়ে দরকার?
বিষ্ণুরাম প্রগাঢ় আগ্রহে সাবিত্রীকে বুকের কাছে টেনে নেয়, সাবিত্রীর মুখটা ঘুরিয়ে ধরে তার নিজের মুখের দিকে। সাবিত্রীও মুহূর্তের জন্যে নিজেকে ছেড়ে দেয় স্বামীর হাতে ; পরক্ষণেই বিষ্ণুরামের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে, লজ্জা করে না তোমার ! বুড়ো হতে চললে-এখনও ওইসব ? কপট ক্রোধে সে চলে যায় ভাত বাড়তে। বিষ্ণুরাম এখনও অভুক্ত।
বিষ্ণুরামের মুখে হাসি দেখা যায়--অতি দুঃখের হাসি। সমস্ত বুকটা তার মোচড় দিয়ে ওঠে। তার বয়স হয়েছে? হ্যাঁ, সত্যই তো সে এখন বৃদ্ধ। দোষ আর কারও নয়, দোষ তার বয়সের। আজ তাই ছেলেরা তাকে মানে না, তার প্রতি সাবিত্রীর আর-কোনো আকর্ষণ নেই।
বিষ্ণুরামের যৌবনের কথা মনে পড়ে। সাবিত্রীর একটা চিঠির উত্তর তার আজও মনে আছে। সাবিত্রী লিখেছিলো, ‘চিঠির শেষে তুমি যা চেয়েছো, তা কি চিঠিতে দেওয়া যায়, একদিন এখানে এসে নিয়ে যেয়ো।’ বিষ্ণুরাম ভাবে সেই জীবন আর এই জীবন--কত পার্থক্য।
কোলের খুকীটার কান্নায় তার তন্ময়তা ভেঙে যায়। একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ এসে নাকে ঠেকে। সাবিত্রী খুকীটার পিঠে ঘা কয়েক বসিয়ে দিয়ে কাঁথাটা টেনে নিয়ে চলে যায়।
বিষ্ণুরাম ভাবে, এ সংসারে থাকা অপেক্ষা তার স্টেশন-ঘর অনেক ভালো--টরে টক্কা—টরে টরে।
সেখানে আনন্দ না থাকতে পারে, অশান্তি তো নেই।
১৩৫০
0 মন্তব্যসমূহ