উম্মে হাবিবা সুমি'র গল্প - দেশ ছাড়া মানুষের দেশ

বহুদিন বাদে লানুনি আবারও সাতক্ষীরা সীমান্তে দাড়িয়ে; পাসপোর্ট বিহীন দুহাজার এক সাল, বছরের শুরু, শীতকাল।  এই সীমান্ত এলাকা দিয়েই একদিন সে এসেছিল, চিরদিনের মতন, বসিরহাট দিয়ে সাতক্ষীরায়সেদিনও কোন পাসপোর্ট ছিল নাবছরটা ছিল সম্ভবত ১৯৬৩ সাল; তারিখ, মাস, আজ আর কিছু তার মনে পড়ছেনা।
মাঝেমধ্যে আনমনা হয়ে যাওয়া লানুনি বেগম এর চিরাচরিত রোগ স্বামী কাজী হাসান আলী পাশে দাড়িয়ে দুবার জোরে ডাকলেন, বেশ একটু জোরেই বললেন,শোন, চোখমুখ একটু বেশি করে করুণ করে রেখো। তুমি তো আবার বুদ্ধি করে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিছু বলতে পারো না। কেরামত কে সাথে দিচ্ছি, পারাপারে কোন অসুবিধে হলে কি ওপারে কোন বিপদে পড়লে ও হেল্প করতে পারবেখন স্বামীর কথা লানুনির কানে ঢুকছিলনা। তার মুখে রাজ্যের অন্ধকার মেঘ ঘন হয়ে বসে ছিল। লানুনি ভাবে, যার ছেলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, কষ্ট করে তার মুখ করুণ করার দরকার পড়েনা; এই সহজ সত্যটা তার জ্ঞানী স্বামী জানেন না
সাথে অসুস্থ্ ছেলে, এই কথা বলে আর চিকিৎসার কাগজপত্র দেখিয়ে বর্ডার পার হওয়া যায়, লানুনি তাও জানেবি, ডি, আর, এবং বি, এস, এফ এর জওয়ানদের ঘুষঘাস, মারধোরের অভ্যেস আছে বটে; তবে তারাও মানুষ, তাদেরও দয়া মায়া আছে। একটা অলিখিত নিয়মের মতন চলছে কয়েক বছর, অসুস্থ্ কেউ চিকিৎসার জন্য কোলকাতা যাচ্ছে দেখলে বর্ডারের দুপারের কর্তা ব্যাক্তিরাই নিয়ম কানুনে একটু শিথিলতা দেখায়। কিছু টাকা পয়সা দুদিকেই খসে, তবে সেটা ধর্তব্যর মধ্যে পড়ে না। তাছাড়া এর আগেও এই পথে বেশ কবার সাতক্ষীরা থেকে কোলকাতায় গিয়েছে লানুনি, স্বামীর সাথে, ছেলে রতনের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য। যেতে যেতে এ পথ তার চেনা, মুখস্থতাছাড়া সাতক্ষীরা থেকে ভোমরা বর্ডার পেরুলে, বসিরহাটের পর যতই কোলকাতার দিকে যাওয়া যায়, ততই তার আরও চেনা আর সহজ লাগে পথ টুকু। আগের রাতে এ কথাই সে বলছিল রতনের বাবাকেঅচেনা কেরামত কে কেন দিচ্ছে সাথে, এই নিয়ে লানুনি মৃদু তর্কও করেছে; কিন্তু হাসান সাহেবের সাথে তর্ক করা মানায় না স্বামীর এক হুঙ্কারেই লানুনিকে সব আদেশ মেনে নিতে হয়।
হাসান সাহেব ভাবেন, কেরামত তার নিজ এলাকার মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের এক নম্বর চ্যালা, কলেজ পাশ, চালাক চতুর মানুষ তার উপরে তার বর্ডার দিয়ে ভারতীয় জিনিসপত্রের আনা নেয়া থেকে শুরু করে মানুষ পারাপারের গোপন নানান ব্যবসাপাতি আছে তারবি, ডি, আর এবং বি, এস, এফ দুই দিকেই তার সখ্যতাবিপদে আপদে অসুখে বিশুখে পুজো আচ্চায় মুসলমান, হিন্দু দুধর্মের মানুষকেই বাংলাদেশ থেকে  ভারতে, আর ভারত থেকে বাংলাদেশে পাড় করিয়ে দেয় সেসুতরাং এপারে বা ওপারে, কোথাও কোন সমস্যা হলে সে  ম্যানেজ করতে পারবার কথা 

তার বউ যদি আরেকটু শিক্ষিত হত, আরেকটু বোধজ্ঞান থাকতো, তো তার এত ভাবনা হত না - হাসান সাহেব এর এটা বরাবরের ভাবনাউনি পানি উন্নয়ন বোর্ড এর দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তাসবসময় তার ছুটি মেলেনা। গত দুদিন ধরে তার মাথা কাজ করছে না বলে মনে হচ্ছে এর আগে প্রত্যেকবার উনি  বহু কষ্টে ছুটি জোগাড় করেছিলেন সরকারী চাকুরেদের নানান নিয়ম কানুন, চিকিৎসার কথা বলে বিদেশ যাবার ছুটি পান না তারা তাই তীর্থে যাবার মিথ্যে অজুহাত লাগে ঢাকায় গিয়ে মন্ত্রণালয়ে  ধরনা দিয়ে ভারতে আজমীর শরীফে তীর্থের নাম করে বিদেশ যাবার অনুমতি নিয়েছিলেন আগে এইভাবে  কয়েকবার গিয়ে শেষ পর্যন্ত রতন এর ভাল চিকিৎসাও হয়েছিল। এখন এমন এক দুঃসময় এসে হাজির হল, যে নিজের ছুটির জন্য, কি বউ আর ছেলের পাসপোর্ট রিনিউ করবার জন্য, কোন কিছুর জন্যই যে তিনি ঢাকা যাবেন সেই সময় তার হাতে নেই এদিকে ছেলের যায় যায় অবস্থা। একমাত্র ছেলে কোন বাবার মাথার ঠিক থাকে? তার মধ্যে লানুনির এই ঘেনঘেনানি যে  সে একলাই যেতে পারবে।  কাজী সাহেব ভাবেন, বিনা পাসপোর্টে বর্ডার পার হয়ে কোলকাতায় যাওয়া, আবার চিকিৎসা করিয়ে ফিরে আসা কি চাট্টি খানি কথা!  
লানুনির পর পর দুই মেয়ে, তারপর বেশ কয়েক বছর বাদে জন্মানো মেলা আদরের এই ছেলেটা। নাম রতন একুশ বছরের তরতাজা ছেলেতার এই কঠিন অসুখটা শুরুতে ধরা পড়েনি। খালি মাথা আর কান ব্যাথা ছিল, কোন চিকিৎসায় ব্যাথা কমেনা। প্রথমে সাতক্ষীরায়, পরে পাশের বড় শহর খুলনায়, তারপর রাজধানী ঢাকায় গিয়েছিল তারা। সেখানে গিয়ে মাথায় অপটিক নার্ভে টিউমার ধরা পড়েছিল।  ডাক্তার, হাসপাতাল, ক্লিনিক, কবিরাজী, পীর ফকিরেও  কোন উন্নতি হচ্ছিল না। ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসা করানোও খুব সহজ ছিল না তাদের জন্য। কাছের কেউ নেই সেখানে লানুনির স্বামীর দূর সম্পর্কের এক চাচার বাসায় গিয়ে বারবার থাকা যায় না। পরে হাসান সাহেব তার সহকর্মীদের পরামর্শে কোলকাতা যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ কেউ মাদ্রাজের ভেলোরে যাবার কথাও বলছিলেন। অত সামর্থ্য তাদের নেই। হাসান সাহেব এরই মধ্যে ছেলের জন্য প্রভিডেনড ফান্ডের টাকা তুলেছেন, পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া গ্রামের জমি বেঁচেছেন। কত কষ্ট করে সরকারী গৃহ নির্মাণ ঋণ নিয়ে শহরের এক চিলতে জমিতে বাড়ির কাজে হাত দিয়েছিলেন, সব অমনি থেমে গেল।

সাতক্ষীরা থেকে কোলকাতা যাওয়া সহজ, আবার কঠিন ও। কিলোমিটার হিসেবে কোলকাতা সাতক্ষীরার মেলা কাছেসাতক্ষীরা থেকে ঢাকা যাবার পথের অর্ধেকেরও অনেক কম পথ। প্রথমে সাতক্ষীরা শহর থেকে ভোমরা বন্দর, তারপর বসিরহাট, তারপর কোলকাতা। এপথে গেলে খরচ বাঁচে, সময় ও। ঢাকা হয়ে প্লেনে চড়ে বারবার যাবার মেলা ঝক্কি, খরচ ও অনেকতাই তারা বাড়ির কাছের পথ দিয়ে কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে রতন এর চিকিৎসা করাবার ব্যবস্থা নিয়েছিল ছেলের অবস্থা প্রথমে ভাল হলেও, পরে আবার খারাপের পথে যেতে যেতে বড্ড বেশীই দূর্বল হয়ে পড়ল। একদিকে লানুনি আর রতন, দুজনের ই পাসপোর্ট এর মেয়াদ শেষ, আর অন্যদিকে হাসান সাহেবের ছুটির তদবির করার মতন সময় হাতে নেই। লানুনি তাই একলাই রওনা দিতে প্রস্তুত ছিল, যেমন করেই হোক। লালুনির জন্য এ যেন ছিল এক অগ্যস্ত যাত্রা।
ভোমরা স্থল বন্দর। লানুনি দাড়িয়ে আছে। ছোট একটা বাদামী রঙের ভ্যানিটি ব্যাগ আর ছেলের চিকিৎসার কাগজপত্র সহ মোটা ফাইলটা তার এক হাতে;  আর আরেক হাতে শক্ত করে ছেলেকে জাপটে ধরে আছে সেহাসপাতালে দিন থাকার কাপড়চোপড়ের বড় ব্যাগটা কেরামত এর কাছে। স্বামী হাসান সাহেব পই পই করে সব বুঝিয়ে দিয়ে তারপর সীমান্তের দেড়শ গজের ওপাশ থেকে ফিরে গেছেন।

বর্ডার পার হবার জন্য অপেক্ষমান মানুষের বড্ড ভিড় আজ, লম্বা লাইনে দাড়িয়ে আছেন লানুনি সকাল সকালই তারা বেড়িয়েছিল। কিন্তু এত মানুষ এত আগে থেকে এসে লাইন ধরে আছে দেখে লানুনি হতাশ হয়ে পড়ে। রোদ চড়চড় করে বাড়ছে। শাড়ির আঁচলের এক কোণাদিয়ে ছেলের মাথা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে সে দু এক জন কে অনুনয় করে সিরিয়াল ভেঙ্গে একটু আগাতে পেরেছে; কিন্তু তারপরও লম্বা লাইন, সবাই আগে যেতে দিতে রাজিও না। সামনে ঈদ, অনেকেই সম্ভবত শপিং এ যাচ্ছে, কেউ যাচ্ছে ব্যবসার কাজে, কেউ কেউ তারই মতন চিকিৎসার কাজে। সবারই মেলা দরকার। কেরামত ও খুব সুবিধা করতে পারল নাসে বরং ব্যাস্ত তার পিছনের আরেকজনের সাথে সীমান্তের বিষয়ে কি সব আলাপে, লানুনি বুঝতে পারছিলনা যে তাদের আলাপের বিষয়বস্তু ঠিক কিআশে পাশে টং ঘরের মতন মেলা ছোট ছোট দোকান পাট বসেছে পানি, বিস্কুট, চা, পান সবই পাওয়া যাচ্ছে। গতবার এত দোকান ছিল না।  একটু দূরে বিশাল এলাকা জুড়ে টিনের শেড, তার আশে পাশে রঙ বেরঙের চ্যাপটা মাথাওয়ালা কয়েকশ ভারতীয় ট্রাক, রাতের চালানে এসেছে; মালামাল খালাস করছে। লানুনি দেখে, কি নেই সেখানে? পিয়াজের বস্তা, পাথরের চ্যাঁই, কয়লা আরও কত কি! সব সে চেনেও না। রোদে চোখ জলছে তার। সীমান্ত পারাপারের অপেক্ষায় থাকা এই লম্বা মানুষের সারির সামনে এগুতে আর কতটুকু বাকি, দেখতে গিয়ে সোজা তাকায় লানুনি,এই প্রথম তার চোখে পড়ে  বি, ডি, আর, এর সাইনবোর্ড সে স্পষ্ট পড়তে পারছে, কাল রঙের টিনের পাতে মোটা
মোটা সাদা অক্ষরে বড় করে লেখা -সীমান্তর অতন্দ্র প্রহরী। আপনার পরিচয় দিন।
বি, ডি, আর, চেকপোস্ট, ভোমরা স্থল বন্দর, সাতক্ষীরা, বাংলাদেশ
লানুনির মাথায় কয়েকটা শব্দ একসাথে ঝা ঝা করতে থাকে, আপনার পরিচয় দিন, আপনার পরিচয় দিন, আপনার পরিচয় দিন ......।
রানু ও রানু, তোর নাম লানুনি হয়ে গেল কেন রে, কেউ যেন ডাকছে। লানুনি স্পষ্ট শুনছে। এটা মায়ের গলা, সে স্বর এখনও মনে আছে। মা কি জানে না যে, ছোট বেলায় সে অমন হঠাৎ মরে না গেলে তার আজ এ দশা হত না। সৎ মায়ের বছর বছর বিয়োন বাচ্চা কোলে কাঁখে মানুষ করতে হয়েছে; তাদের বড়জন উচ্চারণ করতে পারত না, তাই সে একসময় রানু থেকে লানু, তারপর লানুনি হয়ে গেল! ভাগ্যিস বড়বোন মনিবু কষ্ট করে তাকে উদ্ধার করেছিল। বুবুর সাথে বয়সে তার মেলা তফাৎ আরও ভাইবোনেরা আছে, কেউ লানুনির কথা ভাবেনি, বা তাদের সাধ্যে কুলোয় নি মনি বুবুই বাপ- চাচা কে চিঠির পর চিঠি লিখে লানুনিকে বর্ডার ক্রস করিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তার কাছে পূর্ব পাকিস্তানে, যশোরে

মনিবুর স্বামী আগে থেকে বড় সরকারী চাকরী করত ব্রিটিশ সরকারেরদেশভাগের সময়ে তাকে অপশন দেয়া হয়েছিল, যে সে হিন্দুর দেশ ভারতে যাবে, নাকি মুসলমানের দেশ পাকিস্তানে রয়ে যাবেমাত্র ১৪ বছর বয়সে বুবুর বিয়ে হয়েছিল, সেটা ছেচল্লিশের দাঙ্গার আগের বছর, তখনো লানুনির জন্ম হয়নি। দাঙ্গার ভয়াবহ সব গল্প চারিদিকে। মনিবুর বর তাই পাকিস্তানেই থেকে যায়, সাথে বুবু ও।
সৎ মায়ের সংসার ছেড়ে মনিবুর কাছে যেতে পেরে কিশোরী বয়সে লানুনির মনে হয়েছিল, বড় বাঁচা বেঁচে গেল। কিন্তু বর্ধমানের সেই মাটির দোতলা বাড়ি, পিছনের তাল পুকুর, সেই পুকুরের কালচে সবুজ জল, তার পিছনের তাল সুপারীর সারি, রাতের জোনাকি আর ঝি ঝি পোকাদের কোলাহল, যেখানে রাত বিরেতে তেনারা (ভূত পেত্নীরা) ঘুরাঘুরি করে, - সেই সব দৃশ্য গুলো, গল্প গুলো লানুনি কে আঁকড়ে ধরে থাকে। ভুতের মতন ঘাড়ে চেপে বসা দৃশ্য গুলো প্রায়ই স্বপ্নে হানা দেয়; লানুনির মনে হয় সে এক বন্দী মানুষ।
হঠাৎ হায় হায়, এই যা, পড়ে গেল, এই সব শব্দে  লানুনির স্বপ্নঘোর কেটে যায়; জাপটে ধরে ছেলেকে। রতন মাথা ঘুরে পড়ে গেলে লাইন ভেঙ্গে বেশ কয়েকজন দৌড়ে আসে।  কেরামত এই একবার কাজের কাজ করে, প্রথমে পানির ছিটে দেয় রতনের চোখে মুখে। তারপর সোজা বি, ডি, আরকে কি কি সব বলে। আহা, বলে সামনের লাইনে থাকা মানুষেরা লাইন ভেঙ্গে লানুনি কে এগিয়ে যেতে দেয়। চেকপোস্ট পেরুবার বাকি কাজ টাকা পয়সা দিয়ে কেরামতই ম্যানেজ করে। কাস্টমস, ইমিগ্রেশন পুলিশ কেউ কোথাও বেশিক্ষণ তাদের  আর আটকালো না।  
কোলকাতার সেই পুরনো চেনা হাসপাতালে পৌঁছাতে লানুনির প্রায় দুপুর গড়াল।  হাসপাতালে পৌছার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ডাক্তার বাবুরা জানিয়ে দিলেন, কোন চিকিৎসা নেই আর, সময়ও বেশী নেই, আমরা রাখতে পারছি না, আপনি তাড়াতাড়ি আপনার দেশে ফিরে যান নার্স আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, ভারতে মারা গেলে ছেলের ডেড বডি নিয়ে বাংলাদেশে ফিরতে অনেক হ্যাপা আছে। দমবন্ধ করা একটা সময়।

দীর্ঘশ্বাসগুলো বুকে নিয়ে ফিরতে শুরু করে লালুনি। একা।  ঠিক একা না, সাথে ছেলে প্রায় অচেতন, বমি ও গোঙ্গানি ক্রমশঃ কমে এসেছিল, থেকে থেকে ঘড় ঘড় টাইপের বড় শ্বাস এর শব্দ শোনা যাচ্ছিলকেরামত কে এদিকে ওদিকে খুঁজেও পাওয়া গেল না। হাসপাতাল থেকে একজন নার্স সাহায্য করল, কোন মতে লানুনি একটা ফোন করতে পারল, সাতক্ষীরায় স্বামীর  অফিসের নাম্বারে। হাসপাতালের এক দালাল দয়া করে শিয়ালদা স্টেশনে যাবার ট্যাক্সি ডেকে দিল
স্টেশনে পৌঁছে লানুনির মধ্যে বিভ্রম দেখা দিতে শুরু করে; ছেলেকে তখনও বুকে আঁকড়ে ধরে ছিল সে।  টেনে টেনে টিকেট কাটার বুথেও গিয়েছিল ঠিক ঠিক। তখনই তাঁর মনে সন্দেহ দেখা দেয়, মনে হতে থাকে সে জানেনা,  ঠিক কোন দিকে তার যাবার কথাস্টেশন মাস্টার কে লানুনি বলতে থাকে, আমার বর্ধমানের টিকেট দরকার। আচ্ছা, কাটোয়ায় কি ট্রেন এখন সরাসরি যায়! লানুনির মনে তখন হলদিয়া, জয়কৃষ্ণপুর, কৈথন, কাটোয়া, শব্দ গুলো ঘুরছিল ফ্যানের বাতাসের মতন ফর ফর শব্দ করে করে । মনে হচ্ছিল, একবার কাটোয়ায় গিয়ে পৌঁছালে আর কেরামত এর দরকার হত না। ছোটবেলার সেই মাটির দোতলা বাড়িতে শান্তিতে এক বেলা ঘুমাতে পারত সে। টিকেট কাউন্টারের ক্যাশিয়ার এর কথা বলার বা শোনার সময় নেই, সে বলে, আজ্ঞে, আপনি পরে আসুনলানুনি কাউন্টারের এক পাশে ছেলেকে ধরে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,  আহা মিহিদানা আহা সীতাভোগ ...প্রায় অচেতন ছেলেকে ডেকে ডেকে জাগাবার চেষ্টা করছিল সে, বলছিল, যেন সে একটু হাটে আরেকটু কষ্ট করে দাঁড়াতে চেষ্টা করে একটু ক্ষণ পর, বর্ধমানে পৌঁছলে আর চিন্তে নেই, ছোটবেলার গল্পে শোনা সীতাভোগ খেতে পাবে রতন রতন কে সোজা করে রাখার জন্য ছড়া শোনাতে থাকে লানুনিঃ
শাকের সেরা পুঁই,
 মাছের সেরা রুই,
 কলার সেরা মর্তমান,
 জেলার সেরা বর্ধমান
লানুনির সম্বিত ফেরে যখন পাশের কেউ একজন তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনেরে চেনা চেনা লাগতিসে, আপনের বাড়ি কনে? আপনে কি সাতক্ষীরের মামুদপুরের কাজী বাড়ির কেউ হন?।  তখনি লানুনির মনে পড়ে, তার আসলে বাংলাদেশে ফেরার কথা। বর্ধমান না, উলটো দিকে বসিরহাটের টিকেট দরকার তার। পাশ ফিরে দেখে, কাপড়চোপড়ের ব্যাগ আর প্রেসক্রিপশন, টেস্টের কাগজপত্রের ফাইল নেই উধাও মানে কেউ নিয়ে সটকে পড়েছে। কেরামত তো আগে থেকেই নেই। উদ্ভ্রান্ত বোধ নিয়ে লানুনি চারিদিকে তাকাচ্ছিল। হাতে তখন শুধু পুরনো ক্ষয়ে আসা বাদামী রঙের চামড়ার ভ্যানিটি ব্যাগ হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ-ফাইল এদিক ওদিক  খোঁজার বৃথাই চেষ্টা করল সে কিছুক্ষণ। শেষে একসময় আপন মনেই বলল, ওগুলো হারিয়ে ভাল হয়েছে ছেলে আর ব্যাগ দুহাতে দুদিকে করে একলা সে আর টানতে পারছিল না।
সম্বিত ফিরিয়ে দেয়া লোকটা বলতে থাকে, যে সে সাতক্ষীরার সুলতানপুরের কুমোরপাড়ার ছেলে, নাম অজয় পাল। দুবছর আগের পূজোয় পালপাড়ায় হামলা হলে বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিল। এখনও নাকি তাঁর মনে আছে ছোটবেলায় মামুদপুরের কাজী বাড়িতে কি এক কাজে তার বাবার সাথে গিয়েছিল সে, লানুনিই নাকি তাকে অনেক বাতাসা আর জিলিপি খেতে দিয়েছিল সেদিন। লানুনির কিছু মনে পড়ে না। অজয় বলে, কাকীমা চলেন, আপনেরে বসিরহাট এর হাস্নাবাদ ট্রেনে তুলে দিই লানুনি চেষ্টা করল বুঝতে, অজয় নামের এই ছেলের মতলব কি! ছেলেটা রতনের বয়সীই হবে, দু এক বছরের বড়ও হতে পারে। ছেলেটা আবার বলে, কাকীমা, ভয় পায়েন না, দরকার হলি আমি যাবানে সাথেলানুনির মনে ভয়-ভাব কমে আসে, সে পথ হারাবার ভয় থেকেও যেন বেঁচে যায়।  

ট্রেনে বসিরহাট এর হাস্নাবাদ পৌঁছুতে তাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। লানুনি বার বার অজয় কে জিজ্ঞেস করছিল, সময় কত। তার আর সময়ের তর সইছিল না। রতনের অবস্থা ভাল না, সে গোঙাচ্ছিল থেমে থেমে।
ট্রেন থেকে বসিরহাটে নেমে ভ্যানে করে তাঁরা পৌঁছাল ইছামতির পাড়ে বোটঘাট। এখান থেকে নৌকায় পাড় হতে হবে। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল তখনবৃষ্টি আসে বাতাসের সাথে, হিম হয়ে নামে। সময়টা মাঘ মাস। এমন এক হিমের সন্ধ্যায় শীত যখন গ্রামে গঞ্জে কেবল জাকিয়ে বসতে শুরু করেছে,তখন লানুনি ইছামতি পেরুচ্ছিল। সাথে অসুস্থ ছেলে। ছেলেকে নিয়ে দেশে পৌঁছাতে হবে, ততক্ষন যেন বেঁচে থাকে নাড়ি ছেঁড়া বাপধন। নইলে বিনা পাসপোর্টে রোগী দেখাতে কোলকাতা আসার দাম হবে চড়া।
ও সোনা ও বাছা, আরেকটুঁ  হাট বলে লানুনি যখন প্রায় অচেতন ছেলে কে নিয়ে টেনে টেনে নৌকায় উঠল, তখন প্রায় মাঝ রাত, শেষ নৌকা। বিশাল নৌকায় লানুনিরা ছাড়া আর দু তিন জন মানুষ, একজন সাইকেল সহ। শীতের রাত। সবাই চাদর জড়িয়ে জুবুথুবু। তার মধ্যেও তারা লানুনি আর তাঁর ছেলেকে চোখ বড় বড় করে দেখছে লানুনি মাঝে মাঝে রতন এর বুকে হাত দিয়ে দেখে, শ্বাস আছে তো? ক্ষীন শ্বাস, তাঁর ভয় বাড়তে থাকেছেলেকে নিয়ে দেশে ফেরা যাবে তো? লানুনির দেশে না, ছেলের দেশে। ও বাপ, মরিস নে সোনা বলে একবার ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল লানুনি ইছামতি পেরুতে আধা ঘণ্টার একটু বেশী লেগে গেলইছামতীর আরেক পাড়, ইটেনডা ঘাটে পৌঁছুল তারাএখান থেকে থ্রী হুইলার, বেবি ট্যাক্সি পাওয়া যায় সব সময়। কিন্তু মধ্য রাতে সেদিন কোন থ্রী হুইলার মিলল না। চড়া দামের ভাড়া হাঁকানো একমাত্র ভ্যানেই উঠে বসতে হল।   
আর কোন মতে কয়েক মাইল এগুতে পারলেই পানিতর, তারপর ঘোঁজাডাঙা সীমান্ত। ওপারে ভোমরা বন্দর,আলীপুর,  সাতক্ষীরালানুনি ছেলের বুকে হাত দেয়,বিড় বিড় করেন আপন মনে, "হা খোদা, ছেলেরে কেন তুমি এ মরণ অসুখ দিলে; দিলে যদি তারে মাটি দেও খোদা, দেশে তার মরণ দেও হে খোদা...!  অন্ধকার চিরে ভ্যান চলছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, এগুচ্ছে না মনে হচ্ছিল, অন্ধকার ঘিরে আসছে আরও ঘন হয়ে। জন-মনিশ্য'র দেখা নেই কোন ধারে; যত দূর চোখ যায় খালি কুয়াশা জাপটায়ে থাকা অন্ধকার, কোন ঘর দুয়ার ও চোখে পড়েনা। ভ্যান যে চালাচ্ছিল, সে মানুষ তো! নইলে সময় এমন থেমে আছে কেন, ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিল না লানুনি।
কুলকুল করে ঘামছিল সে, ছোটবেলায় বর্ধমানে থাকতে মনি বুবু নাইওর গেলে গল্প বলত। সেই গল্প মনে পড়ে তারগল্পে শাশুড়ির অত্যাচারে অল্পবয়সী বউটা পালাচ্ছে, ছুটছে - বাপের গ্রামদেশে যাবে সে, বাঁচবে। শীতের রাত; একটু ওম যদি মিলত গায়ের পাতলা হয়ে আসা শাড়ীতে শীত মানে না, হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে ছুটছে মেয়েটা, পা আর চলেনা। তখন মেয়েটা দেখে একটা আগুন এর গোলাও ছুটছে তার পাশে পাশে, আর ছড়া কেটে বলছে, হাতের নোয়া (লোহা) খুলে ও বউ পোঁয়া আগুন পোঁয়া শীতের রাতে তেনারা ঘুরে বেড়ায়, নানারূপ ধরে কাছে এসে ঘাড়ে বসবে, শুধু লোহাতে তাদের ভয়। মানুষ চেহারা হলে, পায়ের দিকে দেখতে হবে, পা উলটো কিনা; উলটো হলে সেও ভেক ধারী কোন ভূত-পেত্নী। তখন সাবধান; হাতের লোহার বালা খুলিস নে যেন, - এইভাবে বুবু সাবধান করে দিয়েছিলো, সেও কতকাল আগের কথা। ভ্যান চালক বাবুল আর সাথে পথে এসে জোটা অজয় পালের পায়ের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায় লানুনি  হাতের অষ্ট ধাতুর বালাটা আরও শক্ত করে ছেলের বুকের সাথে ধরে রাখে সে।  
ভোর এর অস্পষ্ট আলো দেখা যেতে শুরু করে এক সময়। সেই ভ্যানে করে ঘোঁজাডাঙা স্থল বন্দর পৌঁছুল ওরা। অপর প্রান্তে  ভোমরা বন্দর ছাড়িয়ে বাংলাদেশের গাছ দেখা যেতে থাকে একসময়। 
বর্ডার পার করে দিয়ে অজয়ের চলে যাবার কথা ছিল; কিন্তু কি মনে করে সেও লানুনির সাথে এসেছিল। বর্ডারে বি, এস, এফ এবং বি, ডি, আর, খুব করে জেরা করছিল। প্রথমে পাসপোর্ট দেখতে চাইল। লানুনি বুঝাতে চেষ্টা করল, সে গতকাল সকালেই এই পথে গিয়েছিলগতকালের জওয়ানদের শিফট বদলে গিয়েছে, সুতরাং নতুন আরেক দলকে আগের দিনের সকাল বেলার কথা বলে কিছু মনে করানো সম্ভব না। দু দিকেই অজয় আর লানুনির সাথে থাকা টাকা, রূপী যা ছিল, প্রায় সব দিতে হল।   কাস্টমস দেখল, লানুনির সাথের ছেলেটা বেঁচে আছে না মরে গেছে, বুঝা গেল না। ওরা ভয়ে কোন রিস্ক নিল না, যান, যান, তাড়াতাড়ি যান, বলে ঝামেলা এড়াতে চাইল। ফ্যাকড়া বাধাল ভোমরার এপারের ইমিগ্রেশন পুলিশ। হাক ছেড়ে জিজ্ঞেস করে, সাথে ডেড বডি হলে, আমাদের কাগজপত্র দেখতে হবে...লানুনি ভয়ে জমে যেতে যায় যেন; ছেলেকে বুকে আঁকড়ে টেনে হিঁচড়ে আগাতে থাকেছেলের বুকে হাত দিয়ে দেখে লানুনি, হাল্কা ধুকপুক এখনও আছেঅজয় জোর গলায় বলে উঠে, না না উনার ছাওয়াল একনো বাঁচি আছে..., বলতে বলতে তার সাথে থাকা আর অল্প কিছু রুপি পুলিশ এর হাতেও ধরিয়ে দেয় সে পুলিশ এর এখানে  রেট করা আছে পঞ্চাশ টাকা; কিন্তু অজয়ের দেয়া বিশ রূপীতেও খুশি ওরা, টাকায় কনভার্ট করলে খারাপ নাএকদম কিছু না পাওয়া থেকে, কিছু না কিছু তো পাওয়া গেল। আর তাছাড়া যদি সত্যিই ডেডবডি হয়ে যায়, আর সঙ্গের মানুষদের টাকা পয়সা না থাকে, তো পুলিশেরও ঝক্কি কম না।  
বর্ডার পেরিয়ে ভোমরা পেরিয়ে সাতক্ষীরা সীমান্তে এসে লানুনি তার স্বামীর দেখা পেল। ফোন পেয়ে আগে থেকে হাসান সাহেব এসে হাজির ছিলেন। একটা টেম্পো ও ঠিক করে রেখেছিলেন সেই ঠিক করে রাখা টেম্পোতে উঠে বসল সবাই। রতন কেমন অচেতন, ভারী হয়ে এসেছে। সবাই মিলে ধরাধরি করে তাকে টেম্পোতে তুলে।  
ভারী ভারী মালবাহী পাঁচটনি ট্রাক যায় এই পথে সারা বাংলাদেশে। রাস্তার পীচ, ইট, সুরকি তাই বেশি দিন টেকে নারাস্তা খানা খন্দে ভরা। টেম্পোটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে থাকে। আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার। অন্তত ঘরে নিয়ে ছেলের শেষ শুশ্রূষা টুকু করতে পারলেও মায়ের মনে শান্তি হবে। লানুনি ধরে থাকে ছেলেকে, রতন অচেতন পুরো কোন গোঙানির শব্দও আর শোনা যায়না, ঠোঁটের কোণায় বিজ বিজ করে কিছু থুতু বেরিয়ে আসছিল শুধু, শাড়ীর আচলে নরম করে মুছে দেয় লানুনিহাসান সাহেব ডাকতে থাকেন, ও রতন, ও বাপ, দেখ আমি আছি সাথে রতন শোনে না। দুপাশে সবুজ ঘন হয়ে আসা গাছপালার দিকে অজয় তাকিয়ে থেকে চোখের জল আড়াল করতে চেষ্টা করতে থাকে। ঠিক এই সময় একটা বড় খন্দে পড়ে টেম্পোর চাকা।
এরপর, এই ঝাকুনিতেই সব শেষ; শেষ দীর্ঘশ্বাস শুনেছিল সবাই
সাতক্ষীরা শহরের লানুনিদের সেই অর্ধ সমাপ্ত বাড়িতে যখন টেম্পো পৌছাল, তখন সেখানে রাজ্যের মানুষ। বাতাসের আগে শোকের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। হাসান সাহেব, তার বড় দুই মেয়ে সহ আরও অনেকে ডাক ছেড়ে কাঁদছিল। অজয় কিছুক্ষণ বারন্দায় এক কিনারায় বসেছিল; তারপর কখন যে সে চলে গেল, কেউ খেয়াল করল না। অজয় হাঁটতে হাঁটতে ভাবে সে একবার তাদের কুমোরপাড়াটা দেখে যায়; পরে ভাবে, নাহ, তাকেও সীমান্ত পেরুতে হবে বিনা পাসপোর্টে, তার মা ও বসে থাকবে তার চিন্তায়

লানুনি কাঁদেনি সেদিন। চোখ থেকে পানি গড়ালেও তার কান্নার শব্দ শোনেনি কেউ লানুনি বেঁচে ছিল আরও দুবছর মারা যাবার আগে সে কোন একদিন তার মনিবু কে বলেছিল, বুবু, তোমার আগে যদি মরে যাই, তো আমার কবর বর্ধমানে আমার দেশের মাটিত দিও 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. হৃদয় ও চোখ ভিজে যাওয়া লেখা..

    উত্তরমুছুন
  2. জীবনের মাটিছোঁয়া গল্প, যেন বিপণ্ণ মানুষদের রোজনামচা! গল্পকার সেই গল্পের মধ্যে নিজেকে গভীরভাবে গেঁথে রেখেছিলেন সারাক্ষণ, তাঁর আরো গল্প পড়বো সময় করে, শিখবো লিখা!

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. খুবই সুন্দর হয়েছে লেখাটা।

    উত্তরমুছুন