রুমা মোদক-এর গল্প : নয়নতারা ও জৈবিকতার গল্প


(১)

ফকফকির সাথে আমার গল্পগুলোর কোন ভাষা নেই। কিন্তু ভাব আছে। আমি কিংবা ফকফকি দুজনেই দুজনের মনের ভাব দিব্যি বুঝে নেই। কোন অসুবিধে হয় না। মুখের ভাষায় নয়,হৃদয়ের ভাবে। এই ভাব বিনিময়ে আমার যতোটা তাড়া, তার সিকি-আর্ধেকও ফকফকির নেই।
কারণ ফকফকি এখানে আমার গায়ে গা লাগিয়ে না বসলে আমি এখানে বড় বেমানান নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। বোধকরি তাই আমি তার মায়ায় পড়ি।

আর চামড়ার সাথে লেগে থাকা চামড়ার ঘঁষায় আমার ভিতরে জেগে থাকা মায়ায় ফকফকির সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলি। ফকফকির দিকে সবসময় তীক্ষ্ণ নজর রাখি। কেনো রাখি এর কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। যেমন এই অজপাড়াগাঁয়ে একলা দাঁড়িয়ে থাকা স্টেশনটায় যখন কোন অপরিচিত মানুষ দেখা যায়, ফকফকি আমার কাছে জিজ্ঞেস করে,কওতো এ কত টেহা দিব? আমি মানুষটিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করি, চেহারা- সুরত,কাপড়-চোপড়, ভাব-ভংগি। তারপর সিদ্ধান্ত দেই, দেখিস পাঁছ টেহা দিব। কখনো বা বলি, দেহিস টেহা দিব না। যখনই যা বলি,নির্ভুল তাই ঘটে। আমি জ্যোতিষী নই, দীর্ঘদিন এই স্টেশনটিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখতে দেখতে মানুষ দেখেই ঠিক ঠিক চিনতে ভুল হয় না আমার। ফকফকি দাঁত কেলিয়ে হাসে। ও পাঁচ টাকার মর্যাদাও বুঝে না,দশ টাকার মর্যাদাও বুঝে না। তবে পাঁচ/দশ টাকা নোটের বেশি উপার্জনে তার মায়ের খুশি বুঝে। আমি ওর খুশি বুঝি।ডানদিকে হেলে থাকা মাথাটা আরো বেশি নিচের দিকে ঝুলতে থাকে,বাড়তে থাকে ঠোঁট গলে ঝরতে থাকা লালার ঝুল। এর বেশি ব্যক্ত করার ক্ষমতা ফকফকির নেই। আমার তো এটুকু প্রকাশেরও ক্ষমতা নেই,তারপরও যে ফকফকি আমাকে বুঝে নেয় এই আনন্দেই আমি মহানন্দে এই স্টেশনে একলা নিসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকি,মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।রোদে-বৃষ্টিতে, ঝড়-ঝণঝায়।

আমাদের সাথে অবশ্য আরেকজন জুটেছে মাস কয়। ব্যাংড়া। পা দুটো পোলিওক্রান্ত বাঁকা দু পা টেনে হিঁচড়ে ল্যাঙরাতে ল্যাঙরাতে রেলগাড়ির জানালায় হাত বাড়াতে পারে ব্যাংড়া, আমাদের নিশ্চল অবস্থার সাথে তার এই সামান্য তফাৎটুকু ছাড়া সেও আমাদের মতোই ভাষায় ভাব বিনিময়ে অক্ষম। কয় মাসে সে দিব্যি আমাদের সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সঙ্গী হয়ে উঠে।

(২)

দুই টাকার ময়লা নোটটি থালায় ছুঁড়ে দিয়ে যাত্রীটি স্টেশন ছেড়ে গেলে ধপ করে থাম্বায় ঝুলে থাকা গুটিকয় বাতি নিভে যায়। রাত এসে সন্ধ্যার সবটুকু আলো গিলে খাওয়ার আগেই আজ লোডশেডিং নামে। যদিও প্রতিদিন এই অন্ধকার নামার ব্যত্যয় হয় না,তবু আজ তা দ্রুত নামে অন্যদিনের চেয়ে।

সমান্তরাল লাইন বেয়ে চলে যাওয়া সবরকম রেলগাড়ি থামার মতো আভিজাত্য নেই স্টেশনটির।সারাদিনে তাও অনভিজাত গোটা পাঁচেক রেলগাড়ির বিরতি মেলে।

স্টেশনটির মাইল পাঁচেক দূরত্বে অগুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি গ্রাম। এসব গ্রামে কোন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনেই মানুষের আসা-যাওয়ার খুব প্রয়োজন পড়েনা কালে ভদ্রেও। মূলত এই স্টেশনে নেমে অটোরিকশা ধরে দেশে নতুন আবিষ্কৃত হামহাম জলপ্রপাত মাত্র আধঘণ্টার রাস্তা। বন-বাঁদাড় ভেঙ্গে ঝোঁপ-জঙ্গল পেরিয়ে প্রাকৃতিক এই জলপ্রপাত দেখতে বেশির ভাগ আসে শহুরে ছাত্র-ছাত্রীর দল। আর আসে মাইলখানেক দূরত্বে 'মতিহার টেক্সটাইল মিলসের' চাকরিজীবীরা। তাদের সংখ্যাও খুব কম নয়। হাজারখানেকের প্রায়। তবে ঈদ পার্বণের মতো রেলস্টেশনে সবসময় এদের এতো ভীড় হয় না। দু- চারজন আসে যায়, তাদের আত্মীয়- পরিজনেরাও আসে। 

দিনের শেষ রেলগাড়িটি দূরে মাঠ পেরিয়ে কুপি বাতির আগুন জ্বলে উঠার আগেই নামী স্টেশনে নোঙর ফেলার উদ্দ্যেশ্যে ছুটে গেলে, আমার একটু দুশ্চিন্তা হতে থাকে। সাধারণত ফকফকির মা এই রেলগাড়িটির অপেক্ষাতেই থাকে। এটি চলে যাবার সাথে সাথেই ফকফকিকে নিতে চলে আসে। আজ আসছে না দেখে আমার দুশ্চিন্তা কূয়ার অতলে পানির উপরিতল খোঁজার মতো থৈ খুঁজতে থাকে দূরে,আরো দূরে.......। যতোদূরে দৃষ্টি যায়, ততোদূরে দেখতে থাকি।

স্টেশনের একমাত্র খাবারের ঝাঁপটি শেষ হয়ে যাওয়া সিঙারার ডালা বাইরে উল্টে দিলে আশেপাশে অপেক্ষারত কুকুর কয়টা জমে যায় মূহুর্তে। পাভলভের সাপেক্ষ প্রতিবর্তবাদ অনুসারে সময়মতো আশেপাশে ঘুরাফেরা করে। এইসময় কাকপক্ষিহীন নিরালা স্টেশনটিতে কুকুরেরা খাবারের কণা নিয়ে হল্লা করে। জমে থাকা ধুলো ময়লার গন্ধ শুঁকে নির্ভুল খাবার কণার সন্ধানে। রাত ঘনিয়ে গিলে খেতে থাকে সন্ধ্যার গায়ে লেপ্টে থাকা দিনের সামান্য চিহ্নটুকুও।আমার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে।

(৩)

হরিচরণ হাইস্কুলে আজ বিকালেও পরীক্ষা ছিলো। দুপুর দুইটায় শুরু হওয়া পরীক্ষা বিকাল পাঁচটায় শেষ হলে স্কুলঘরের কক্ষগুলো ঝাঁট দিয়ে পরদিনের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে, তালা লাগাতে লাগাতে স্কুলের প্রধান ফটকের বাইরে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে যায়। উততুরে বাতাস ঠিকমতো বয় কী বয় না সন্ধ্যা নামতে দিরং হয় না। জরিনা বিবির জানে আর দেয় না, একটানা তিনঘণ্টা দৌড়াতে হয়েছে স্কুলের এমাথা-ওমাথা। এখন আবার মাইলখানেক হেঁটে যেতে হবে মেয়েরে আনতে। পরীক্ষার টাইম ধরতে গিয়ে দুপুরে খাওয়াও হয় নি। খিদার চোটে মাথা ঘুরছে। যদিও স্কুলে সিঙারা টিফিন ছিলো। কিন্তু সে খায়নি, কিংবা বলা যায় খেতে পারে নি। নিজেরখানা ছাড়াও অন্য শিক্ষকদের প্লেটে ফেলে যাওয়া আধখাওয়া-না খাওয়া মিলিয়ে চার-পাঁচখানা মিলিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাগুলো এসব হাধালোভা খেতে খুব পছন্দ করে। বাচ্চাদের এতো পছন্দের খাবার একা নিজের পেটে তাই ঢুকে না। 

স্কুলে যাবার সময় কোনরকমে ভাতটা নামিয়ে, মরিচ পুড়ে পেঁয়াজ- লবণ দিয়ে মাখিয়ে রেখে এসেছে। ঘরে রেখে আসা চারজন নাবালক সন্তান নিজে নিজে খেয়ে নিতে জানে। তাদের জন্য নয়,আজ নিজের জন্যই ঘরে ফিরতে হবে। পেট যেমন খিদেয় চোঁ চোঁ করছে, তেমনই মিরধার মাঠ পেরিয়ে মাইলখানেক রাস্তা পাড়ি দেয়ার চিন্তাটাও তো আছে। আগামাথা হীন যতোদূর চোখ যায়, সব মৃধার জমি। লোকে এরে বলে মিরধার মাঠ। এই মৃধার মাঠটা পাড় হতে গেলে কোথা থেকে যে উত্তুরে বাতাস হুড়মুড় করে শরীরের চামড়া মাংস ভেদ করে হাড্ডির ভেতরে ঢুকে যায়। ঘরে ফিরে অনেক সময় জুড়ে আগুন তাপালেও সে শীত আর বের হয় না হাড্ডি থেকে। ছাপড়া থেকে শীতের কাপড়খানাও নেয়া দরকার।

ভাতের হাড়িতে ভাতের পরিমাণ দেখে মেজাজ চড়ে যায় জরিনা বিবির- হাভাইত্যাগুলারে যত্ত খাওয়াও পেড ভরে না। কত্তডি ভাত রাইন্ধা রাইখ্যা গেছি, আমার জন্য দুইমুডা রাইখ্যা খাইলো না। বাপডাও আছিলো যেমন হাভাইত্যা, পেডের শত্রুগুলাও তেমনি হইছে হাভাইত্যার ঘর অ হাভাইত্যা। বিড়বিড় করতে করতে হাড়ি চেঁছে কয়েকমুঠো ভাত লবণ-মরিচের ভর্তা দিয়ে পেটে চালান করে দেয় দ্রুত। প্লাস্টিকের জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে ভেতরটা একটু শান্ত হয়। মাথার ভনভনানি কমে। 

বাচ্চাগুলার একটাও ঘরে নাই। সন্ধ্যা নামলেই সবগুলো হেডমাস্টারের বাড়ি টিভি দেখতে চলে যায়। হেডমাস্টার আর হেডমাস্টারের বউ একটারে দিয়ে বাসন মাজায়, আরেকটারে দিয়ে দোকান দিয়ে কয়েল আনায়, একটারে দিয়ে ঘর উঠান ঝাঁট দেয়ায় আর বিনিময়ে ঘন্টাদুয়েক টিভি দেখতে দেয়। তালা-চাবির বালাই নেই, ঘরে আছেই বা কী নেবেই বা কী? ছাপড়ার দরজাখানা টান দিয়ে বন্ধ করে মেয়েরে আনতে হাঁটা শুরু করে জরিনা বিবি।

(৪)

পুরোনো লুঙ্গি আর শার্টে লেগে থাকা ময়লা, সর্দি, পাইলসের রক্তের শুকনো দাগ, শুকনো গোবরের দাগ সব ঢাকা পড়ে গেছে অন্ধকারে। চেহারায় হাজারটা অনাচার অত্যাচারের ভাঁজ নিয়ে লোকটি ফকফকির সামনে দাঁড়ালে আমার দুশ্চিন্তা ভয়ে রূপ নেয়। ভয় গ্রাস করে বিষাদ, বিষাদ গ্রাস করে উৎকণ্ঠা। হালকা শীতে লোকটির নাক-চোখ-মুখ মাফলারে ঢাকা হলেও তাকে চিনতে মোটেই অসুবিধা হয় না আমার।মাঝে মাঝেই তাকে ফকফকির আশেপাশে ঘুরতে দেখি। ফকফকির মা আর তার পারস্পরিক বাদানুবাদে তার পরিচয়টাও অজানা নয় আমার। যদিও তার ফকফকির কাছে আসার উদ্দ্যেশ্য কিছুটা স্পষ্ট কিছুটা অস্পষ্ট আমার কাছে, তবু ফকফকির মায়ের আদিম নির্লজ্জ ইংগিত আসন্ন বিপদের সম্ভবনায় আমাকে নানাবিধ উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় তীব্রভাবে তাড়িত করতে থাকে। লোকটি উবু হয়ে বসে স্টেশনের ডানপাশ ঘেঁষা পরিত্যক্ত লাল দালানের ভাঙ্গা দরজায় বিছানো চাটাইয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটির পাশে।

থালায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আধময়লা-ময়লা-ছিন্ন-কড়কড়ে নোটগুলো একসাথে করে হাতে নিয়ে গুনতে থাকে লোকটি। ডানদিকে কাত হয়ে ঝুলতে থাকা মেয়েটির মাথা ঝুলার পরিমাণ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ওর মুখ থেকে লালা ঝরার পরিমাণও। চোখগুলো স্ফীত হয়ে বের হয়ে আসতে চায়। আমি তার ভাষা বুঝে নেই। ভয় পাচ্ছে সে, খাদকের কাছে খাদ্য হবার ভয়। প্রকৃতি অবোধ প্রাণীকেও ভিতর থেকে নিজেকে রক্ষার তাগিদ দেয়।

হঠাৎ পিছন দিক থেকে ফকফকির মা লোকটির হাত থেকে ছোঁ মেরে টাকাগুলো নিয়ে নেয় নিজ হাতে,লোকটির অপ্রস্তুত অসচেতনতাকে জিম্মি করে।

আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। ফকফকির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে রাখতে টেরই পাই নি কোনদিক দিয়ে ওর মা স্টেশনে ঢুকেছে। টাকাগুলো করায়ত্ত করে শান্ত হয় না সে। তার তারস্বরে স্টেশনের নিশ্চুপ নিস্তব্ধতা খান খান ভাঙতে থাকে- ফিরা যদি দেহি মাইয়ার ধার অ ঘুরঘুর করছস, তরে জেলের ভাত খাওয়াইয়া ছাড়মু। ফকফকির মায়ের সে ক্ষমতা আছে কী নেই সেই ভাবনার অতলে যায় না লোকটি, মিনমিন করে- কী কছ, মাইয়া কী আমার না? তর একলা? ফকফকির মা দ্বিগুন তেজে চেঁচিয়ে উঠে- অ অহন মাইয়া তর? ক্যান জন্মের পর কস নাই গায়ের রং অত দলা ক্যান? হাঙ্গা আরেকটা কইরা খোঁজ নিছস এই কয় বছর? 

মুষলধারে বৃষ্টির ফোঁটার মতো তেড়ে আসা কথার তোড়ে পেরে উঠবেনা জেনে,মাফলারে নাক-কান-মুখ ঢেকে চোরের মতো উলটা হাঁটা দেয় লোকটি।তখনই দূরে হুইসেল বাজে পরবর্তী রেলগাড়ির। হুইসেলের শব্দে নিজের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যাচ্ছে লক্ষ্য করে ফকফকির মা নিজেই কথায় ক্ষান্ত দেয়। এনামেলের থালাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে, টাকাগুলো কোমরে গুঁজে ফকফকিরে কান্ধে নিয়ে বাড়িমুখো হাঁটা দেয় সে।

রেলগাড়িটি মিনিট দুই বিরতি দিলে ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামে উচ্ছ্বল যুবকদল।নিরালা খাবারের ঝাঁপটিতে খাবার খুঁজে ব্যর্থ হয়ে আমার দিকে উদাস দৃষ্টি রাখে তারা। সমস্বরে গেয়ে উঠে- এখান তুকে মানাইছে না গ, এক্কেবারে মানাইছে না গ।

(৫)

গেলো সপ্তাহে রেলগাড়ির চাকার নিচে পড়ে কয়েক টুকরা হয়ে গেছে ব্যাংড়া। ল্যাংড়া পা টেনে হিঁচড়ে রোজ এই স্টেশনে থামা রেলগাড়িগুলোর জানালায় হাত বাড়াতো ব্যাংড়া এলমুনিয়ামের বাটি নিয়ে।কোমরে ঝুলত দড়ি দিয়ে বাঁধা হাফপ্যান্ট।পরনে নাইলনের শার্টে অনেকদিনের জমে থাকা ঘামের গন্ধ এই শীতেও যাত্রীদের নাকে ধাক্কা দিতো।

বেশ কয়েকমাসে আমার আর ফকফকির সাথে বেশ খাতির হয়ে গিয়েছিলো তার। সমান্তরাল লাইন ধরে কুউউ ঝিকঝিক শব্দ করে রেলগাড়ি স্টেশন ছেড়ে গেলে আমার গায়ে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে উপার্জিত টাকাগুলো গুনত। বাঁ হাতে টাকাগুলো আর ডান হাতে শূন্য থালাটা ধরে জুলজুল তাকিয়ে থাকতো সিঙারার ঝাঁকার দিকে। জমানো সিঙারার ময়দার আস্তরণ ভেদ করে আলু আর পেঁয়াজের গন্ধ স্টেশনের ডাল পাতা থাম্বায় লেগে থাকতো। কখনো বা রেলগাড়ির জানালা গলে ভিতরে ঢুকে অধরা হয়ে যেতো। অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ ছাড়া আর কোন ধ্বনি প্রকাশে অক্ষম ছেলেটির খিদে সেই গন্ধের সাথে পাল্লা দিয়ে বেশিদূর যেতে পারতো না। হাতের গুণা টাকা থেকে পাঁচ টাকা খরচ করে সিঙারা খাবার ইচ্ছে আর প্রয়োজনটাকে গলাটিপে ধরে সে পুণরায় গায়ের পুরো শক্তিতে পা দুটো টেনে নিয়ে মেয়েটার পাশ ঘেঁষে গা এলিয়ে দিতো পরবর্তী রেলগাড়ির অপেক্ষায়।

দিনশেষে ব্যাংড়ার বাপ নিতে এসে সবার আগে উপার্জিত টাকাগুলো গুনতো। উপার্জনের টাকা তার প্রত্যাশার সীমা স্পর্শ না করলে অভুক্ত ছেলেটাকে প্ল্যাটফর্ম থেকেই পেটাতে পেটাতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতো। কোনদিন খাবারের ঝাঁপিতে জমায়েত হওয়া দু চারজন লোক বাঁচাতে এগিয়ে আসতো।কোনদিন কেউ থাকতো না। আমারও ক্ষমতা নেই তাকে বাঁচানোর। অসহায় তাকিয়ে দেখা ছাড়া।

সেই ব্যাংড়া দুচারটাকা বেশি উপার্জনের জন্য রেললাইন পাড়ি দিয়ে অন্য প্ল্যাটফর্মে যেতে চেয়েছিলো। হঠাৎ অভিজাত স্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে ছুটে আসা একটি রেলগাড়ি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে যায় তাকে। মূহুর্তে নিশ্চুপ নিস্তব্ধ স্টেশনটা তিনগাঁয়ের মানুষে ভরে উঠেছিলো। পুলিশ এসে নীল পলিথিনে মুড়ে মাংসপিণ্ডগুলো তুলে নিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত তারা ভীড় করে দেখছিলো ভনভন মাছি উড়া ব্যাংড়ার জমে থাকা মাথার খুলি, ছিন্ন আঙ্গুল, বিচ্ছিন্ন গোড়ালি আর প্ল্যাটফর্মের ধুলো বালিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাহাজারি করা ব্যাংড়ার মা আর বাবাকে। শুধু তাই নয়, বেঁচে থাকা ব্যাংড়াকে কেউ একটা পাঁচ টাকার সিঙারা কিনে না দিলেও ব্যাংড়ার শোকগ্রস্ত বাপ মাকে তারা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে অর্থ সাহায্য করছিলো। এবং কারো সাহায্যের পরিমাণ বিশ টাকার বেশি বৈ কম ছিলো না। সেদিন তাদের উপার্জিত টাকার পরিমাণ দেখে চোখ টাটিয়েছিলো ফকফকির মায়েরও। 

তারপর এই অপমৃত্যু ঘিরে সব কোলাহল থেমে গেলে ব্যাংড়ার মা নিঃসাড় ধুলোবালি মেখে শুয়ে থাকলেও ব্যাংড়ার বাপ টাকাগুলো একত্রিত করে ঠাণ্ডা মাথায় গুনতে বসে। আর তারপর সারাদিন হাহাকার করা নিঃসাড় ব্যাংড়ার মাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো, কান্দিছ না, যত্তো টাকা হইছে একমাস বইয়া খাইতে পারুম। তারপর ব্যাংড়ার মায়ের দুর্বল শরীরটি কোনরকমে ছাপড়া পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই নিজে বের হয়ে গিয়েছিলো হরিণছড়া চা বাগানের মদের পাট্টার উদ্দ্যেশ্যে। কত্তোদিন পর হাতে কিছু উদ্বৃত্ত টাকা!

(৬)

এশার আযান শেষ হলেই আশেপাশে গভীর রাত নেমে যায়। স্কুল ঘরের পাশে ছাপড়া বানিয়ে থাকে জরিনা বিবি। কয়েক গজের ভিতরে আর কারো ঘরবাড়ি নেই। হেডমাস্টার দয়া দেখিয়ে থাকবার এ জায়গাটুকু করে দিয়েছে। স্কুল চলাকালীন সময়ে বাচ্চাগুলোর সামান্য শব্দও সহ্য করে না হেডমাস্টার। সাতসকালে বাসি ভাত খাইয়ে তাই গরু ছাগলের মতো ঘর থেকে এগুলোরে বের করে দিয়ে,শুধু মেয়েটাকে নিয়ে বের হয়ে আসে সে। তারপর বিকালে স্কুল ছুটি হওয়ার আগে পর্যন্ত আর খবরও রাখে না। রাখার উপায়ও নাই। 

স্কুলের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযানের পর এশার আযান কানে আসার আগেই সারাদিনের ধকলে বাচ্চাগুলো সব ঘুমে ঢুলতে থাকে। জরিনা বিবি নিজেও দুচার গ্রাস গিলে বাতি নিভিয়ে রাতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু কদিন ধরেই এ সময়টাতে জব্বার আলী এসে হানা দেয়।

জরিনা বিবি তার ঘুমের বিঘ্নের কারণে যতো না খ্যাঁকখ্যাঁক করে, তার চেয়ে বেশি খ্যাঁকখ্যাঁক করে তার আসার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে। মেয়েটার আশেপাশে ঘুরঘুর করে লোকটা। কয়মাস ধরে খেয়াল করছে সে। আজ বেড়ার ছাপড়ায় টোকা দিলে সে ক্ষেপে উঠে- ক্যান আহছ? ক্যান আহছ?? দলা চামড়ার লোভ সামলাইতে পারছ না? জব্বর আলী ঘরে ঢুকে মুখ চেপে ধরে জরিনা বিবির, কছ কী জী হুনবো।

হ, কত্তোই না হুননের কান জীয়ের! তাই হুনলেই কী আর না হুনলেই কী! মেয়েটার দুধ-সাদা রং আর পঙ্গু-ভাষাহীন অবস্থার দিকে সন্দেহের আঙুল তুলে দ্বিতীয় বিয়ে করে কয়বছর জরিনা বিবির ত্রিসীমানা মাড়ায় নি জব্বর আলি। 

এখন সেই মেয়ের গায়ে-গতরে যখন নারী হয়ে উঠবার লক্ষণ সুস্পষ্ট, তখন জব্বর আলীর রোপণ করে যাওয়া সন্দেহের বীজ জরিনা বিবিকেও ছাড়ে না। শক্ত শিকড়ে দাঁড়িয়ে ডালপালা মেলে, জব্বর আলী তো বিশ্বাস করে না এই ধলা ফকফকা মেয়েটা তার ঔরসের। তাই এখন ঘন ঘন তার ছাপড়ায় আসার পিছনে কেবল কিছু টাকা হাতড়ানো এটা নিজেকেও বিশ্বাস করাতে পারে না জরিনা বিবি। 

আজ কোনমতেই জরিনা বিবিকে থামাতে পারে না জব্বর আলী, বাইর হন, বাইর হন ঘর থিক্কা। মন অ কইরছইন, আমি কিছুই বুঝিনা না? জরিনার চিৎকার উন্মাদের মতো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেলে জব্বর আলী টের পায় আর দুচার মিনিট এমন চেঁচামেচি অব্যাহত থাকলে হেডমাস্টারের কান পর্যন্ত পৌছে যাবে। হেনস্থার অন্ত থাকবে না। নাক-মুখ-কান লুকিয়ে নীরবে বের হয়ে যায় সে।

জব্বর আলী যায় বটে, জরিনা বিবির ভাবনা থামে না। মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে তার মহাবিপদ। যতোই দিন যাচ্ছে,নির্দিষ্ট অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জানান দিচ্ছে সে নারী। তারউপর এরকম দুধে-আলতায় চোখ আটকে যাওয়ার মতো গায়ের রং। দিনে দিনে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। জব্বার আলী যেখানে ঘুরঘুর শুরু করে দিয়েছে, সেখানে অন্য পুরুষ তো কোন ছাড়! কী করে সে মেয়েটাকে নিয়ে। সে রাতে দুশ্চিন্তায় তার ক্লান্ত ঘুম বারকয়েক ছুটে ছুটে যায়।

(৭)

সপ্তাহ না ঘুরতেই দুঃসংবাদটির জন্য প্রস্তুতি তো দূরের কথা, কল্পনাও ছিলো না আমার। দীর্ঘদিন আমার গায়ে গা লাগিয়ে শুয়ে থাকতো ফকফকি। এমন সাদা গায়ের রঙ, স্টেশনে আসা প্রতিটি যাত্রীর চোখ টাটাতো। অপরিচ্ছন্ন দিন যাপন আর স্টেশনে উড়তে থাকা বেওয়ারিশ ধুলোর পরতের পর পরত তার গায়ে আশ্রয় নেয়াতেও যে রং একটুও মলিন হয় না। পুড়ে যায় না প্রখর রোদে কিংবা তুফানে। গায়ের রঙটার কারণেই যার নামটাও হয়ে গেছে ফকফকি। ইচ্ছে করতো জিজ্ঞেস করে ফকফকির মাকে,মাইয়া এইডা কুড়াইয়া পাইছস নি? কিন্তু আমার তো প্রশ্ন করার ভাষা নেই।

সেই ফকফকি আজ সকালে ব্যাংড়ার মতো রেলগাড়ির নিচে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি নানা হিসাব করি, কোনটাই মেলাতে পারি না।

ব্যাংড়ার জন্য ভিতরে ভিতরে পুড়তো ফকফকি। নিস্তব্ধ দুপুরে যখন অনামী স্টেশনটাতে কোন রেলগাড়ি থামে না, ফকফকি ব্যাংড়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতো। ব্যাংড়ার অতিমানবিক গোঁ গোঁ এর কারণে উঠতি যৌবনের ফকফকির ধার ঘেঁষার সাহস পেতো না শিকারী শুকুন দৃষ্টি। আমিও নিশ্চিন্ত থাকতাম। ব্যাংড়ার জলজ্ব্যান্ত শরীরটা নিষ্প্রাণ মাংসপিণ্ডে পরিণত হলে ফকফকির জন্য আবার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে আমার। বিশেষ করে সেই লোকটা যখন ফাঁকফোকর পেলেই মেয়েটার কাছে ঘুরঘুর করতো আমি কী করবো ভেবে পেতাম না।

সপ্তাহ না ঘুরতেই আমার সকল দুশ্চিন্তার অকল্পনীয় অবসান ঘটিয়ে ফকফকিও পরিণত হলো মাংসপিণ্ডে, একই ভাবে রেলগাড়ির চাকার নিচে? আমি হিসাব মেলাতে পারি না, ব্যাংড়া না হয় পা টেনে হিঁচড়ে দুটো টাকা বেশি ভিক্ষা পাওয়ার লোভে মাঝে মাঝেই সমান্তরাল রেললাইন পাড় হয়ে ওপারে যেতো। কিন্তু ফকফকি তো হাঁটতে পারে না। সে কী করে রেলগাড়ির চাকার নিচে গেলো?

ফকফকির মৃত্যুতে আমি স্টেশনটিতে একেবারেই বেমানান একলা হয়ে যাই। কানে বাজতে থাকে উচ্ছ্বল ছেলেদের গলার স্বর- এখান তুকে মানাইছে না গ.......। আমি দেখি সপ্তাহ না ঘুরতেই ঘটনা সমূহের পুনরাবৃত্তি। তিন গায়ের মানুষের ভীড়, ঘিলু- মগজ ঘিরে মাছির ভনভন, প্ল্যাটফর্ম জুড়ে ফকফকির মায়ের আহাজারি, বেদনার্ত মানুষের ছুঁড়ে মারা টাকা। ছিন্ন-ময়লা- অর্ধময়লা-নোংরা- কড়কড়ে টাকা। কোনটির পরিমাণ বিশ টাকার নিচে নয়। পুলিশ....নীল পলিথিন.....

সব কিছুর নীরব সাক্ষী হতে থাকি আমি।

সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে, আবার নিস্তব্ধতা নামার প্রস্তুতি শুরু হলে জরিনা বিবি টাকাগুলো সব কুড়িয়ে আমার গা ঘেঁষে ফকফকির ফেলে যাওয়া চাটাইয়ে বসে গুনতে। আমি সাক্ষী, নির্বাক-অচল ফকফকির এই কয়মাসের রোজগারের চেয়ে আজ ফকফকির মৃত্যুর পর তার মা জরিনার রোজগার কয়েকগুন বেশি। জরিনা বিবির মুখে স্বস্তি নাকি বিষাদের ছায়া, বাড়তে থাকা অন্ধকারে ঠিকঠাক পড়তে পারি না আমি।

কোথা থেকে এসে জব্বর আলী তখন জুটে হঠাৎ। তাকে দেখেই টাকাগুলো দ্রুত কোমরে গুঁজে চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায় জরিনা বিবি।

জব্বর আলী হাত টেনে ধরে জরিনা বিবির, কয়টা বেশি টাকার লোভে মাইয়াডারে রেলের চাক্কার নিচে দিলি? জরিনা বিবিও তৎক্ষণাৎ ক্ষেপে উঠে। কী কন না কন ঠিক-ঠিকানা নাই! জব্বর আলীও পাল্টা উত্তর দেয়,ভাবছস আমি কিচ্ছু বুঝি না? তাদের অপ্রিয় বাক-বিতণ্ডা বাড়তে থাকার পারদ একসময় সীমা ছাড়িয়ে যায়,জরিনা বিবি বাকরুদ্ধ বলে উঠে- ফালাইলে ফালাইছি, টেহার লাইগ্যা না, তর ডরে......।

তখন হঠাৎ অনতিদূরে গাছ-গাছালিতে নীড়ে ফেরা পাখ-পাখালিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ পাওয়া যায়। কাছেই কয়েকটা কুকুরছানা মা-কুকুরের স্তনবৃন্তের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে,জরিনা বিবি দ্রুত পায়ে স্টেশন ছাড়ে। 

আর আমার কানে বাজতে থাকে উচ্ছ্বল ছেলেদের সম্মিলিত সুর- এখান তুকে মানাইছে না গ........। প্রথমে ব্যাংড়া তারপর ফকফকির চলে যাওয়াতে বড় একা নিঃসঙ্গ বেমানান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমি অভিজাতহীন এই স্টেশনটাতে। কে কবে কখন এখানে খুব অযত্নে কিংবা মায়ায় লাগিয়েছে আমাকে কিংবা ঝড়ো বাতাসে মাটিতে আশ্রয় গেড়ে ডালপালা মেলেছি আমি আমার মনে পড়ে না।কিন্তু এই এত্তোগুলো বছর ধরে এখানে এই পরিত্যক্ত দালানের পাশে, ইট-পাথর, কুউউ ঝিকঝিক রেলগাড়ি, ছোট্ট স্টেশনঘর, অপরিসর খাবারের ঝাঁপি, উদোম আদিমতা আর উলঙ্গ জৈবিকতায় প্রকৃতির নিয়মে বছর ধরে ফুটানো নয়নতারা ফুল নিয়ে বড় বেমানান হয়ে পড়ি আমি।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ