ভাগ্যিস বাসাটার লাগোয়া পার্কটা ছিল। সকাল-সন্ধ্যে অন্তত দুবার গিয়ে একটু বসা নাহয় বার তিরিশেক চক্কর। ছেলে সেই সকাল নটায় ক্লাসে বেরোয়, চারটায় ফিরে আহ্লাদ করে মায়ের হাতে খাওয়া, ঘন্টাখানেক ফেসবুক তারপর লাইব্রেরি। ফিরতে ফিরতে রাত বারো। ওর বাবার দেশ থেকে স্কাইপে সেই একই বুলি-
‘দেখো, ডায়বেটিস বাড়িও না। বরফ পড়লে হাঁটাহাঁটির দরকার নেই। দুশ্চিন্তা করবে না। আমেরিকার বিশুদ্ধ বাতাসে শরীর এমনিতেই ভালো থাকবে দেখো। ছেলেকে আর কতকাল নুলো বানিয়ে রাখবে? ওকে নিজে হাতে খেতে বলো। ঘরের কাজে তোমাকে একটু হেল্প করে তো? মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে কেন? এখন কত ডিগ্রি? ও বাবা! মাইনাস নাইন?’
‘হ্যাঁরে অরূপ, নিতীশের মতো ছেলের সাথে কে মেয়ে বিয়ে দেবে? দুটো পা-ই পোলিওতে অচল। হুইল চেয়ারে চলাফেরা’
‘দেবে না কেন মা, ও তো স্কলার’
‘না মানে ওর তো পছন্দের কেউ নেই জানি। শুধু স্কলার হলেই হবে?’
‘না হলে খালি হাতে ফিরবে। এতো শিঘ্রিই বিয়ে করার কী আছে’
‘বয়স তোমারও তিরিশ হতে চললো বাছা। এবার একটা ঘরে তোলো। না হয় বলো দেশে গিয়ে মেয়ে দেখি’
‘উহ মা, ম্যালা বকো না তো। তাড়াতাড়ি খাবার দাও। আজও ফিরতে রাত হবে। তুমি আমার জন্যে রাত জাগবে না’
‘রাতদিন আর জাগছি না, সামনে মাসেই কেটে পড়বো দেখিস। আমার সংসার নেই?’
‘সংসার মানে তো তোমার হাবি। তুমি না থাকলেই মনে হয় ভদ্রলোক ভালো থাকে। ইউ আর ইম্পসিবল মা’
‘তবে রে!’
কদিন খুব বরফ পড়লো। হাঁটাহাঁটি বন্ধ। জানালায় বসে তুষারপাত দেখি। গুনগুন করি -
‘স্নো ফ্লেক্স স্নো ফ্লেক্স উই নো স্নো ফ্লেক্স
ফলিং ফলিং ফলিং ফলিং ফলিং অন মাই নোজ’
আগে ভাবতাম বুঝি ইলশেগুড়ির মতো দানা দানা বরফ পড়ে। ওমা! কর্নফ্লেক্সের চেয়েও বড় বড়। সেইজন্যই স্নো ফ্লেক্স। রান্নাঘর থেকে একটু ঘুরে এসে আবার বাইরে তাকালেই চরাচর অমল-ধবল। ছোট গাছগুলোর মাথায় বরফ জমে বিশাল বিশাল সাদা বল হয়ে আছে। মনে হয় কে যেন পেল্লাই স্কুপে আইসক্রিম ভরে আস্তে করে রেখে চলে গেছে। পার্কের স্লিপার, দোলনা, সিঁড়ি বরফের স্থাপত্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় গাছেরা রাস্তার আশ্রয়হীন বৃদ্ধের মত নিরবে সহ্য করছে শীতল কশাঘাত। যন্ত্রের সাহায্যে ঘুরে ঘুরে রাস্তা থেকে বরফ সরাচ্ছে ইউনিভার্সিটির পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। ফিনিক্স পাখির মত আবার বরফের পাটি বিছিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতি। পিএইচডি করা পণ্ডিত ছেলেরা হাতে বেলচা নিয়ে পুরু বরফে ডেকে যাওয়া গাড়ির কোনটা তাদের তার নম্বরপ্লেট খুঁচিয়ে বের করতে হদ্য হচ্ছে।
কবে বরফ সরবে কবে আবার হাঁটতে পারবো ভাবতে না ভাবতেই উজ্জ্বল রোদ উঠে গেল কদিন পরেই। খোলা জায়গাগুলোয় বরফ জড়ো করে করে টিলা বানিয়ে রাখা হয়েছে। পার্ক বাচ্চাদের খেলার উপোযোগী হতে আরও দু’একদিন লাগতে পারে। পরপর কদিন না হাঁটলে অপরাধবোধে ভুগি। পায়ে একটু কাদা লাগলেও পার্কের কংক্রিট গোলচত্বরের উপর চরকির মত কয়েক পাক ঘুরলাম। ইতস্তত স্থাপিত লোহার সংলগ্ন চেয়ার টেবিলের যেটার ওপর তখনও একখানা ধুসর রোদের টেবিলম্যাট বিছানো ছিল সেখানে এগুতে গিয়েই থমকে গেলাম। টেবিলের ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে এক আলোময় কিশোরী। ঘন কালো সান্দ্রমেঘের চুল সারা পিঠ ছড়িয়ে আছে। মাঝখানে থিরবিজুরি মুখমণ্ডল। পরনে লম্বা স্কার্ট আর গেঞ্জি। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই উঠে পড়লো। আমার ইংরেজি হিন্দি দুটোর অবস্থা-ই করুণ। যখন দেখি কেউ ভালো ইংরেজি বলতে পারছে না তখন তাদের সামনে আমার ইংরেজির বহর দেখে কে? কিন্তু প্রকৃত ইংরেজি জানাদের সামনে আমি তোতলাতে থাকি। মেয়েটিকে সরলসোজা দেখে বেশ কায়দা করে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলাম-
‘বোসো। হোয়াটস ইয়োর নেম?’
মেয়েটি বোবার মত তাকিয়ে থাকলো। ভারতীয় মুখ। শ্রাবস্তির কারুকার্য। কপালে সিঁদুর।
‘তুমহারা নাম কেয়া হায়?’
বুঝলো। বললো – ‘মিনাকশি’।
‘এখানে কোন বাসায় থাক? হু ইজ ইয়োর হাজবেন্ড?’
আবার বোবা চাহনি। হাত নেড়ে জানালো সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
বললাম - ‘মানে তুমহারা পতি আরকি’
‘ও! নিতীশ’।
নিতীশের বউ? এইটুকুন বাচ্চা মেয়ে? পনের বছরের বেশি হতেই পারে না। মোমের পুতুলের মত এমন একটা মেয়েকে কোন প্রাণে বত্রিশ-তেত্রিশ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী পাত্রের হাতে তুলে দিল ওর মা-বাবা? কীভাবে পারলো? নিতীশ অরূপের চেয়ে বয়সে তিন-চার বছরের বড়ই হবে। পাঁচ বছরের পিএইচডি কোর্সে নিতীশের তিন বছর প্রায় হয়েই গেল। আমার অরূপের দু’বছর যাচ্ছে। মেয়েটিকে নিতীশের পাশে কল্পনা করে আমি শিউরে উঠি।
আমার সাথে মিনাকশির খোশগল্প করার খুব ইচ্ছে ছিল বলে মনে হলো না। হয় সে আমার ভাষা বুঝছিল না বা নিজেকে মেলে ধরার যথেষ্ট ভাষা তার ছিল না। আবার টেবিলে মাথা দিয়ে সে দূরে কোথাও তাকিয়েছিল। আমি ওদিকে কৌতুহলি বাঙালি। আমার ছেলে বলে মা, এদেশে কেউ নিজে থেকে কিছু না বললে অকারণ কৌতুহল দেখাবে না। আর কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করা তো রীতিমত অসভ্যতা। কিন্তু মিনাক্ষী তো আমাদের বাড়ির কাছের মেয়ে। ও কি আর এদেশের ভব্যতা দুদিনেই রপ্ত করেছে? যা মনে করে করুক জিজ্ঞাসা করলাম-
‘মিনাক্ষী, ইন্ডিয়ামে তুমহারা ঘর কাঁহা?’
‘ইন্ডিয়া’। আমার মুখের দিকে না তাকিয়েই সে বললো।
‘না মানে ইন্ডিয়া তো জরুর। কিন্তু হুইচ পার্ট অব ইন্ডিয়া? প্রভিন্স কা নাম কেয়া?’
সে ঠোঁট উল্টিয়ে মাথা ঝাঁকালো। বোঝেনি। মিনমিন করে কী জানি একটা বললো যা কোনো রাজ্যের নাম নয়। মনে হয় ওর গ্রামের নাম।
আমিও ছাড়ার বাঙালি না। আমার নিজস্ব হিন্দিতে আবার বললাম-
‘নিতীশকা ঘর আর তুমহারা ঘর কি এক জাগামে?’
‘হা’
‘তাহলে কাঁহা?’ নিতীশ কোন রাজ্যের ছেলে তা আমার জানা ছিল না।
মিনাক্ষী অবহেলায় ছড়িয়ে থাকা একঢাল চুল দুহাতে তুলে নিয়ে ক্লান্তহাতে খোঁপা করতে করতে আবার দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল। সে দৃষ্টি বরফের কঠিন থাবা থেকে কেবল মুক্ত হওয়া শ্রীহীন গাছের মাথা ছাড়িয়ে যেন পৌঁছে গেল গাছপালা ঘেরা একটি সবুজ গ্রামে, দোচালা বাড়ির খোলা উঠোনে, ধীরে বয়ে যাওয়া কালোজলের প্রিয় নদীটার পাড়ে। যেন আপন মনেই বললো-
‘উউউই নালন্দা কি পাস’।
অ। বিহার।
আহারে বাচ্চা! নিজের রাজ্যের নামটাও যে জানে না তাকে কিনা সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারে এই আমেরিকায় এনে ফেলা? ওর চুল আবার আপনিই খুলে পড়লো। আমি আদরের সাথে শক্ত করে এবার বেঁধে দিলাম। ওর চোখে কৃতজ্ঞতা এবং অশ্রু। সে অশ্রু কিসের যা সামান্যতম আদরে গলে পড়ে – তা আমার না বোঝার কথা না।
কোন কোনদিন ক্লাস থেকে ফিরে হুইল চেয়ারে বসে নিতীশ নিজেই পার্কে এসে হাজির হয়। নির্লিপ্ত মিনাক্ষী একটু এগিয়ে গিয়ে চেয়ার ঠেলে সামনে নিয়ে আসে। নিতীশের চোখেমুখে যেন ভালোবাসার ফল্গুধারা। বউয়ের হাত মুঠোর মধ্যে ধরে ঘাড় উঁচু করে নিতিশ দ্রুত ওদের আঞ্চলিক হিন্দিতে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করে। যেটুকু বোঝা যায় তাতে মনে হয় - খেয়েছ তো? স্নান করেছ? একটু ঘুমিয়েছ? মন খারাপ করোনি তো? মিনাক্ষী কেবল হ্যাঁ না করে জবাব দেয়। আমি প্রায়ই পার্কে বসে মিনাক্ষীর সাথে গল্প করি দেখে নিতীশ খুবই কৃতজ্ঞ। মিনাক্ষী বোঝে না বলে ইংরেজিতে বলে-
‘আন্টি, ও তো রোজ কান্নাকাটি করে। আমি বলেছি ছয় মাস পর আমি ওকে দেশে রেখে আসবো। তারপর একবছর পর আমার কোর্স শেষ হলে আমি দেশে ফিরে যাব। কিন্তু জানেনই তো বারবার যাতায়াতের খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। এটুকু মিথ্যে বলতেই হচ্ছে। যদি জানে আরও দেড়বছর থাকতে হবে তাহলে ও ঠিক পালিয়ে যাবে।’
মিনাক্ষী অবলা পশুর মত ফ্যালফ্যাল করে চোখে চেয়ে থাকে। ওর চোখে সন্দেহ খেলা করে। আমি ওকে বুকে টেনে নিই।
মাসখানেক পর মিনাক্ষী আমার সাথে বেশ সহজ হয়। ও ওদের আঞ্চলিক ভাষায় অনেক কথা বলে যায়। হয়তো বা তা হিন্দি। কিন্তু আমরা কুষ্টিয়ার মানুষরা যেমন সিলেটি ভাষা বুঝিনা তেমনি ওর সিলেটির মত ভাষার মধ্যে যেটুকু হিন্দি সেটুকু আর অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝার চেষ্টা করি। ওরা চার বোন। ও তিন নম্বর। বাবা কৃষক। ও ঙ্কুলে যেত। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিতে উঠার পর বিবাহিত মেজ বোনকে দুটো মেয়েবাচ্চাসহ ওর শ্বশুরবাড়ির লোক বের করে দিলে মিনাক্ষীর লেখাপড়ার ইতি ঘটে। বোন-বাচ্চাদের ভরণপোষণের জন্য ওর বাবা আর পড়াতে পারেনি। ছোট বোনটা পড়ছে। এবার গিয়ে হয়তো দেখবে ওরও বিয়ে হয়ে গেছে। ওর দিদি-জামাইবাবু আমেরিকায় থাকে। ভালো সম্মন্ধ আসবে।
‘তোমার নিতীশকে পছন্দ হয়েছিল?’
‘এ বাত মাত পুছো আন্টি। গরীবদের পছন্দ থাকতে নেই। কোন উপায় ছিল না। অনেক লেখাপড়া জানা ছেলে, আমেরিকায় পড়াশুনা করে, একটু খুঁত আছে তাতে কী? আমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাবে – এতেই সবাই রাজি’।
‘নিতীশ তো আসলে খুব ভালো ছেলে, তোমাকেও তো খুব ভালোবাসে’
‘আমি তো ওর লেখাপড়ার কিছুই বুঝিনা। আমি নিজেও লেখাপড়া না জানার মত। এ দেশ আমার ভালো লাগে না। এই বরফ আমার বিচ্ছিরি লাগে। এখানকার খাওয়ায় আমার বমি আসে, মন খুলে কারো সাথে কথা বলতে পারি না’।
আমি ওকে কাছে টেনে নিই। ওর কাতর মুখটা বুকে চেপে রাখি। ওকে যে আরও কিছু গোপন ব্যথা চেপে রাখতে হয় তা বুঝেই জড়িয়ে ধরে রাখি।বলি-
‘এই যে শীত চলে যাচ্ছে। এবার বসন্ত আসবে। দেখবে ফুলে ফুলে চারদিক কেমন ভরে ওঠে। তখন তোমার ভালো লাগবে দেখো’।
মিনাক্ষীর চারু চিবুক থিরথির করে কাঁপে। জানি এবার চোখে পানি জমবে। ওর পানপাতা মুখ বৃষ্টিধোয়া কচিপাতার মত সজীব হবে। ও বলবে-
‘এ পৃথিবীর কোন দেশই আমার গ্রামের মত সুন্দর না গো মাসি। এখানে কোথায় জল সরে গেলে পলি জমে? বাবার সাথে সেই পলিতে ধান বুনেছি। কচি ধানের পেট টিপে দুধ খেয়েছি আমরা বোনেরা। রাধাচূড়া ফুলের সাথে কৃষ্ণচূড়া ফুলের বিয়ে দিয়েছি। সারা দুপুর নদীর জলে স্নান করে কোঁচড় ভরে ঝিনুক তুলেছি ঘরে। যেবার খুব বর্ষা হলো সেবার মা প্রতি বেলায় শালুক রাঁধতো। কী স্বাদ মাসি! হবে না? একেবারে আমাদের বাড়ির উঠোনে পুকুর হয়ে গেল যে! জল নেমে গেলে আমরা দোপাটির চারা পুঁতেছিলাম। লক্ষী আর সরস্বতী মানে আমার মেজদির মেয়ে দুটো আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। আসার দিন এমন কাঁদছিল!’
আমিও নিতীশের মত মিথ্যে না বলে পারলাম না। বললাম আর ছ’টা মাস পরেই তো নিতীশ তাকে রেখে আসবে। এ ক’টা দিন দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। তিন-চার মাস তো কেটেই গেল। হায় কিশোরী! যে মেয়ে এক নালন্দা ছাড়া নিজের জেলার নামও জানেনা তার কি সাদা মানুষে ভরা এই সাদা বরফের দেশ ভাল লাগতে পারে?
মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে আর একদিনও মন টিকছিল না। ছেলে মায়ের মর্ম বোঝে বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্লেনে তুলে দিল। রান্না করে খাওয়ার ছেলে সে না। জানি খালি ম্যাকডোনালস আর কফি খেয়ে কাটাবে। ওর বাবা বলে একটু রেঁধেবেড়ে খেতে শিখতে দাও ছেলেটাকে। বিদেশ গিয়েও মায়ের হাতে খেলে কেবল পন্ডিতই হবে, মানুষ হবে না। মায়ের ব্যথা কি বাবারা বোঝে? যতদিন না বাবারা গর্ভধারণ করবে ততদিন এভাবেই বলতে থাকবে। মাছ তো ছুঁয়েও দেখে না। পনেরদিনের মত মাংস রান্না করে প্যাকেটে ভরে ফ্রিজে রেখে এলাম। জানি ছ’মাস একবছর পর এসে আমাকেই সেসব গারবেজ করতে হবে। মিনাক্ষীর সাথে দেখা করে আসতে পারলাম না। মেয়েটার জন্য বুকের মধ্যে খামচাচ্ছিল।
দুই
মা ভালো হয়ে উঠতে না উঠতেই ছেলের জন্য মন কেমন করছিল। কী খাচ্ছে না খাচ্ছে বাচ্চাটা আমার। নারীর জ্বালার শেষ নেই। বন্ধুরা বলে এখন ছেলের জন্য কষ্ট পাচ্ছ, যখন নাতিপুতি হবে তখন দেখো তাদের ছেড়ে থাকা কী যন্ত্রণার। মরণের আগে যন্ত্রণার শেষ নেই। অরূপ ফোনে বললো-
‘মা, এ মাসেই চলে আস। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে’।
‘হ্যাঁরে, মিস আমেরিকাকে বিয়ে করেছিস নাকি?’
‘এসেই দেখ। না এলে বলবো না’
‘করে ফেললে সহজে যাচ্ছি না। তোকে নিয়ে তাহলে দুঃশ্চিন্তা শেষ হয়’
‘মা, আমি এ ছ’সাত মাস বার্গার, ফ্রেন্স ফ্রাই আর কফি খেয়ে আছি। তোমার প্রাণে সয়?’
জায়গা মতো হাত দিয়েছে ছেলে।
‘আচ্ছা দেখি। নিতিশ-মিনাক্ষীরা কেমন আছেরে?’
‘সবাই ভাল। তুমি না এলে এ বছরের ফাইনালে ফেল করবো বলে রাখলাম’
‘আরে বাবা তিষ্ট ক্ষণজাল’।
তিন
‘কই তোর সারপ্রাইজ? গুল মেরেছিস?’ আসলেই ভেবেছিলাম সেই সুন্দরী আমেরিকানকে সাথে নিয়ে ছেলে আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে এসেছে। না, একা। শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে। আনন্দে দূর থেকেই লাফাতে লাফাতে এসে আমাকে উঁচু করে তুলে ঘুরপাক খায়। গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল ঘুরানো হাত দুটো দেখে প্রাণ কেঁদে ওঠে। যেন দু’টো কাঠি। সারা রাস্তা বকর বকর করলো। খুশীতে আত্মহারা পাগল ছেলে আমার।
রাত করে বাসায় ফিরে ভালো ঘুম হলো না। কখন সকাল হবে, কখন মিনাক্ষীর সাথে দেখা হবে ভাবতে ভাবতে সকালের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অরূপ ডাকলো-
‘মা, আজ আমার আড়াইটায় ক্লাস। চলো দুজনে একটু পার্কে ঘুরে আসি, ছাতা নিও। বৃষ্টি আসতে পারে’।
পার্কের পেছনদিকটায় বেশ খানিকটা জায়গা ঘেরা। শীতকালে ওরকমটা ছিল না। ভেতরে ভাগ ভাগ করা জমির সারি। অরূপ ওদিকটায় এগোচ্ছে। সবুজে সবুজে চারপাশ ভরে উঠেছে। শীতকালের খোলা আকাশ নেই। গাছের পাতার ফাঁকে আকাশ যে চেয়ে থাকে। ভেজা ঘাস। পুরু মখমলের মত এত ঘন ঘাস আমাদের দেশে দেখা যায় না। চোখ তুলতেই চোখে পড়লো জমিটার মধ্যে নিতীশের হুইল চেয়ার। পাশেই হুড নামানো একটা প্যারাম্বুলেটার। নিড়ানি দিয়ে মাটি খুঁড়ে বীজ পুঁতছে মিনাক্ষী। নিতীশ নিচু হয়ে আগাছা তুলছে।
‘মা দেখো, এই তোমার সারপ্রাইজ’ – বলে অরূপ প্যরাম্বুলেটারের হুড ফেলে দিল। ফুটফুটে সপ্তাখানাকের একটা শিশু ঘুমাচ্ছে। মিনাক্ষী ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
‘হাউ আর ইউ আন্টি? দেখো ইয়ে হামারা বেবি’- বলে মিনাক্ষী হাত ধরে আমাকে বাচ্চার কাছে নিয়ে গেল। নিতীশ হাত বাড়িয়ে আমার দু’হাত চেপে ধরলো। ওর মুখে স্বর্গীয় দীপ্তি।
অরূপের ওপর ভারি রাগ হলো। আগে জানালে খালি হাতে নবজাতকের মুখ দেখতে হতো না। মিনাক্ষীর দু’হাত কাদায় মাখামাখি। গালে লজ্জা আর আনন্দের লাল আভা। এমনভাবে বীজ পুঁতছিল দেখে মনে হচ্ছিল যেন সাতরাজার ধন লুকাচ্ছে। বললো বাকি বীজগুলো লাগিয়েই সে আমার সাথে অনেক গল্প করতে বসবে। নিতীশ বাচ্চার মুখের দিকে চেয়ে থেকে আমাকে ইংরেজিতে যা বললো তার মানে হলো-
‘মিনাকশী জানেই না যে আর মাত্র পাঁচ মাস আমরা এ দেশে থাকতে পারবো। ওর ধারণা আমেরিকায় বাচ্চা হলে সে বাচ্চা নিয়ে আর দেশে ফেরা লাগে না’।
0 মন্তব্যসমূহ