শওকত আলী'র গল্প : কপিলদাস মুর্মুর শেষ কাজ


বাতাস উঠলে এখন টাঙনের পানিতে কাঁপন লাগে না। পানি এখন অনেক নিচে। বালি কেটে কেটে ভারি ধীরে স্রোতে এখন শীতের টাঙন বয়ে যায়। পানির তলায় বালি চিকমিক করে, কোথাও কোথাও সবুজ গুল্ম স্রোতের ভেতরে ভাটির দিকে মাথা রেখে এপাশ ওপাশ ফেরে। চতুর দু-একটা মাছ তিরতির করে উজানে ছুটে গেলেও আবার ভাটিতে ফিরে আসে।
কিন্তু কাঁপে না পানির স্রোত। এমনকি সাঁকোর ওপর দিয়ে চিনিকলের ভারী আখ-বওয়া ট্রাকগুলো যাবার সময়ও না। সাঁকোর থামগুলো গুমগুম শব্দ করে ওঠে, কিন্তু পানির স্রোত তেমনি ধীরে, তেমনি শান্ত। আসমান কান্দর আর দিগন্তজুড়ে যে শীতের একটা শান্তভাব থাকবার কথা, সেই ভাবটা টাঙনের স্রোতে আজকাল সব সময় ধরা থাকে।


আজ ঐ শান্ত নদীর ধারে বসে থাকবার জন্যেই কিনা কে জানে। কপিলদাস ভারি আরামে রোদের দিকে পিঠ মেলে দিয়ে ঝিমোতে পারে। তার চারদিকে নানা শব্দ কিন্তু সেসব তার কানে ঢোকে কি না বোঝা মুশকিল। ধরো, কী রকম গাঁ গাঁ চিৎকার করতে করতে চিনিকলের ট্রাকগুলো ছুটছে, ফার্মের ভেতরে বিনোদ মিস্তিরি খান-দুই ট্রাক্টর ট্রায়ালের জন্য চালু করে রেখেছে—তার ধক ধক ধক ধক শব্দ একটানা সকাল দুপুর রাত ধরে ক্রমাগত হয়ে চলেছে, নদীর ওপারে আবার কোথায় এক রাখাল সারা দিন ধরে একটানা বুনো সুর বাঁশিতে বাজিয়ে যাচ্ছে—এসবই তার কানে ঢুকবার কথা। কিন্তু কপিলদাস চুপচাপ। মাথাটা ডাইনে-বাঁয়ে অল্পস্বল্প দুলছে, আর সে বসে রয়েছে তো বসেই রয়েছে।

ওদিকে ছাগল ঢুকে যদি সবজিক্ষেত তছনছ করে, কি বিন্দা মাঝির বউ সোনামুখী নগেন হোরোর বোন সিলভীর সঙ্গে ঝগড়া বাধায় কিম্বা নদীর ওপারে খোলা কান্দরে খরগোশ তাড়িয়ে নিয়ে আসে কোনো ভিন গাঁয়ের কুকুর এবং সে জন্যে যদি এপারের বাচ্চারা লে লে হৈ হৈ করেও ওঠে—কপিলদাস নড়বে না, হেলবে না, কান পাতবে না—কাউকে একটা কথা জিজ্ঞেসও করবে না।

আসলে কপিলদাস বুড়োর কাছে সবই একটার সঙ্গে আরেকটা মেলানো বলে মনে হয়, এ রকমই হয়ে আসছে দুনিয়ায়। ঝগড়া বলো, ঝাঁটি বলো, জন্ম বলো, মরণ বলো—সবই একটার সঙ্গে আরেকটা মেলানো। কত দেখল সে জীবনে। সব কিছুই শেষ পর্যন্ত একটা জায়গায় গিয়ে মিলে যায়। রাগ বলো, ক্ষোভ বলো, আবার হাসিখুশি মনের ভাব বলো, কিম্বা সামনে প্রকাণ্ড কান্দর, কি কান্দরের ওপরকার আসমান আবার তার নিচে টাঙনের স্রোত—সব কিছু, যা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা শোনা যাচ্ছে—সবই একটার সঙ্গে আরেকটা শেষ পর্যন্ত মেলানো। আসলে, তার মনে হয়, সংসারের অনেক ভেতরে শান্ত ধীর এবং নিরবচ্ছিন্ন একটা স্রোত আছে। সব কিছুর ওপর দিয়ে ঐ স্রোত বয়ে যায়। সেখানে কাঁপন নেই, উত্তেজনা নেই, চিৎকার নেই। সব কিছু সেখানে ক্রমাগত একটার সঙ্গে আরেকটা মেলানো।

ঠিক এ ধরনের একটা গা-ছাড়া পরিতৃপ্ত ভাব আজকাল তাকে প্রায়ই পেয়ে বসে। আর সে জন্যেই শীতের রোদে পিঠ দিয়ে ভারি আরামে সে ঝিমোতে পারে। বয়স বেড়ে গেলে সম্ভবত মানুষের এ রকম একটা অবস্থা এসে যায়।

তবে সব সময় ঐ ভাবটা থাকে না।

মাঝে মাঝে ঐ রকম ঝিমোতে ঝিমোতে সে হঠাৎ আবার জেগেও ওঠে। তখন নগেন হোরোর বোন সিলভীর চিৎকার, মহিন্দরের ছেলের খরগোশ শিকার, কি ম্যানেজার মহাজনের দুর্ব্যবহার—এইসব ঘটনা তার চোখে পড়ে যায় এবং একটু একটু উত্তেজনাও বোধ করে। আর আশ্চর্য লাগে তার। চারদিকে এত কাণ্ড ঘটছে অথচ সে কোনো জায়গাতেই নেই—কোনো কিছুতেই সে জড়াচ্ছে না। ভাবো তো কী কাণ্ড! কপিলদাস কি এই রকম ছিল? নিজেকেই জিজ্ঞেস করে : কপিলদাস, এই রকম ছিলি তুই?

আর তখনই পুরনো ঘটনা ছবির পর ছবি সাজিয়ে নিয়ে আসে চোখের সামনে। পুশনা পরবে কী, তুমুল নাচ জুড়েছে দেখো কপিলদাস। তার গলায় বাঁধা মান্দল কী রকম শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, মেয়েদের গলায় কেমন শানানো স্বর। কপিলদাস দেখতে দেখতে নিজের যৌবনকালে চলে যায়। একের পর এক ঘটনা মনে পড়তে থাকে তার। আর ঐ রকমভাবে স্মৃতি তার সামনে পুরনো পসরা খুলে বসলে সে ভারি সুখে ঐসব পুরনো ঘটনার মধ্যে বিচরণ করে ফেরে।

একবার সেই যে কী হলো, মহাজনের ধান খামারবাড়ি থেকেই কিষানদের হাতে বিলিয়ে দিলি—মনে আছে সে কথা?

আর মানুষের পাদ্রিকে টাঙনের পানিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলি? মনে নাই?

চকিতে সে দেখতে পায় বর্ষায় ভরা টাঙনের পানিতে পাদ্রি তলিয়ে গেল। ঘোলাটে পানির মধ্যে কালো জুতোসুদ্ধ তার পা দুখানি ওপরে উৎক্ষিপ্ত হতে দেখা গেল স্পষ্ট করে। একটু পরই মানুয়েল পাদ্রি আবার ভেসে উঠেছিল। আর সে কী গাল! সাঁতরাতে সাঁতরাতে শাসাচ্ছিল : দেখিস তোর বাপকে বলব, দেখব বিচার হয় কি না।

সেই ছেলেবেলার কথা। হাপন ছিল যখন সে। তোর তীর কী রকম নিখুঁত নিশানায় গিয়ে বিঁধত, কপিলদাস, মনে নাই সে কথা?

হ্যাঁ, মনে আছে। কপিলদাস মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নিজেকে শোনায়—সব মনে আছে।

কেন মনে থাকবে না। সান্তালের বাচ্চা না সে? দেখো তো খরগোশের পেছনে কে ছুটছে অমন? শুকদেবের ব্যাটা চতুর মাঝি, নাকি দিবোদাসের ব্যাটা কপিলদাস? আর ঐ দেখো, কপিলদাসের শিকারি কুকুর কী রকম ছুটে যাচ্ছে তীর-খাওয়া শিকারের পেছনে। কপিলদাস মনের ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পায় তার কালো রঙের কুকুরটাকে—যেটা তার কিশোরকালের সঙ্গী ছিল সর্বক্ষণ। কুকুরটাকে শেষ পর্যন্ত বাঘে খেল।

কপিলদাসের মনে কুকুরের শোক উথলে ওঠে। টুঁটিছেঁড়া রক্তাক্ত কুকুরটাকে সে মনের ভেতরে দেখে আর কাঁদে।

একেক সময় আবার হাসেও কপিলদাস। ভারি প্রসন্ন হাসিতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে একেবারে। কেউ দেখে না, কিন্তু তবু বুড়ো হাসে। আহা কী দিন সেসব! সিনথিয়ার সঙ্গে দেখা হয় না, কপিলদাসের সদ্য যৌবনের রক্তে তখন ধিমি ধিমি তাত। বড় কষ্ট তখন মনের ভেতরে—কিছুই ভালো লাগে না। ঐ সময় নসীপুরের হাটে দেখা হল। কামারহাটির পেছনে, ধাঁই ধাঁই শব্দে লাল লোহার ওপরে হাতুড়ি পড়ছে আর পাশে ভাঁটের ঝাড়—সেখানে ভাঁটফুলের বুনো গন্ধ, সন্ধ্যারাতের চাঁদ পূর্ব-আকাশে। সাঁওতাল মেয়ের দুবাহু ময়াল সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরল গলা। কালো চোখের পানিতে জোছনার আলো চিকচিক করে উঠেছিল। তবু হাসছিল সিনথিয়া। তার হাসি দেখে মন ভরে যাচ্ছিল কপিলদাসের। সেই মন-ভরানো সুখের হাসিও বুকের ভেতর থেকে একেক সময় উঠে আসে।

কপিলদাস একেক দিন আবার নিজের কাছে গল্প ফাঁদে। দূর থেকে দেখা যায় বুড়ো থেকে থেকে মাথা নাড়াচ্ছে আর ঝুঁকে ঝুঁকে দুলছে। কোন্ গল্পটা আরম্ভ করবে সে? বাহ্! গল্পের কি আর শেষ আছে—নিজেকেই শোনায় বুড়ো। ধরো, মেলার সেই ঘটনাটা—

মেলার গল্পটাই হঠাৎ মাঝখান থেকে শুরু হয়ে যায়। কেন যে বেছে বেছে মেলার গল্পটাই শুরু হয়—সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। গল্প আরম্ভ করলেই সে মেলার ঘটনায় চলে আসে।

ছাড়, ছেড়ে দে! বাহুর ভাঁজে চেপে ধরা গলার ভেতর থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছে। লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঘামের গন্ধ এবং ঐ রকম দমবন্ধ হয়ে আসা আওয়াজ—ভারি কৌতুকের বিষয় হয়ে ওঠে। কপিলদাস ঐ অবস্থাতেই মজা পেয়ে হেসে ওঠে এবং গলা চেপে ধরা বাম বাহুর হাতের মুঠো ডান হাতে ধরে একটু জোরে চাপ দেয়। আর ঐ রকম চাপ দিতেই লোকটা আ-হ্ শব্দ করে আর্তনাদ করে ওঠে। তার দু চোখে ভয়ানক বিভ্রান্ত ঘোলাটে দৃষ্টি। ঐ আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় লোকটার গলাটা বোধ হয় মটাৎ করে ভেঙে গেল। অত বড় শরীর, কিন্তু পা দুখানা কেমন শ্লথ হয়ে মাটি থেকে আলগা হয়ে যায়। আর তাতে উল্টো বিপদ হয়। ঐ রকম বিশাল শরীরের পুরো ভারটা এসে পড়ে নিজের ওপর। কী মুশকিল, কপিলদাস কী করবে তখন বুঝতে পারে না। লোকটার জোরে জোরে নিশ্বাস নেবার শব্দে ভারি খারাপ লাগতে আরম্ভ করে একসময়। ওদিকে একটা নাগরদোলা লোকসুদ্ধ ভয়ানক বনবন করে ঘুরছে দেখতে পায়। শুনতে পায় কলের গান বাজছে—ফান্দেহ্ পড়িয়া বগা কান্দেহ্ রে-এ-এ-এ—নিজেকে তখন অনেক দূরের মানুষ বলে মনে হয়। মনে হয় সে বোধ হয় মেলার মাঝখানে নেই। ঐ রকম অবস্থায় চারিদিকের লোকজন তাকে ছাড়িয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। কপিলদাস দূর থেকে পেছনে তাকালে দেখতে পায়, লোকটা মাথা নিচু করে দু হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে।

কেন যে ঐ রকম মারামারি কাণ্ডটা ঘটেছিল, ঠিক মনে করতে পারে না। শুধু লোকটার মুখ মনের ভেতরে দেখতে পায়। লোকটার নাম কী, বাড়ি কোথায়, কোন প্রসঙ্গে ঐ রকম ঘটনা ঘটে গিয়েছিল, কিছু মনে আসে না।

কিম্বা ঐ ধানকাটার ব্যাপারটাই ধরো না কেন। আধিয়ার জোতদারের মাঝখানে পড়ে গেল সাঁওতাল বস্তিটা। গুপীনাথ হুঁ হুঁ করে না, ডাইনে-বাঁয়ে তাকায় না। ওদিকে কে একজন আগুনের কুণ্ডলীর ওপরে আরেক বোঝা নাড়া চাপিয়ে দিয়ে গেল। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আর ঐ আগুনের আলোয় গুপীনাথের কপাল চকচক করতে লাগল। কিন্তু সে শাদা চুলভর্তি মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে আছে তো বসেই আছে।

কপিলদাসের ঘাড়ের কাছে শীতের বাতাস শিরশির করে এসে লাগছিল। আগুন দেখতে পেলে শীতের কামড়টা বোধ হয় বেশি লাগে। নইলে হঠাৎ ঐ সময়ই বা কেন কানের কাছে দিয়ে, ঘাড়ের কাছ দিয়ে, শিরশির শিরশির করে শীত তার শরীরে ঢুকে ক্রমাগত ছড়িয়ে যেতে থাকবে। কিন্তু বুড়োর কাণ্ডখানা দেখো, হুঁ হুঁ করে না। বলে দেয় না, ডাইনে যেতে হবে, না বাঁয়ে। একদিকে জোতদার মহাজন আর অন্যদিকে আধিয়ার কিষান। ওদিকে আবার কুয়াশার নিচে পাকা ধান শুয়ে আছে যুবতী মেয়ের মতো। কুন দিক যাবে মানুষ—হাঁ মড়ল, কহে দে, কুন দিক যাবে।

কিন্তু গুপীনাথ সাড়া দেয় না—যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্বাস নিচ্ছে কি না বোঝা দায়।

সাঁওতালদের তখন কী মুশকিল ভাবো দেখি। মহাজন বসত করবার জায়গা দেয়, আবাদের জমি দেয়, গিরস্তির কাজ দেয়—সেই মহাজনের বিপক্ষে কেমন করে যায়। মহাজন যে সব দেয়। হাঁ, সব দেয়—কিন্তুক পেটের ভাতটা কি সারা বছর দেয়, আঁ? কহ মড়ল, কহে দে, দেয় পেটের ভাতটা? এই রকমের সব বাদানুবাদ। কিন্তুক যদি ভিটেমাটি থেকে তুলে দেয় তাহলে? এই রকমের সব তর্কাতর্কি। ওদিকে গুপীনাথ কিছুই বলে না। মড়ল হলে বোধ হয় ঐ অবস্থায় কিছু বলা যায় না।

কিন্তুক তখন ভারি জাড় হে মহড়। দেহ দলদল করে কাঁপছে। দূরে দূরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের মধ্যে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল—হামরা মহাজনের সঙ্গে নাই, আধিয়ার কিষানের সঙ্গে হামরা।

কে বলেছিল কথাটা? মনে নেই এখন। সে নিজে হতে পারে, মোহন কিন্তু হতে পারে—কিম্বা চতুর মাঝিও হতে পারে। লোকটা যে কে, ঠিক মনে নেই। কিন্তু কথাটা ঠিক মনে আছে।

তারপর?

কপিলদাস আর খেই ধরতে পারে না। বিচারসভার শেষদৃশটা স্মরণে আসে না। বরং হঠাৎ ধানকাটার দৃশ্যটা মনের ভেতর দেখতে পায় সে। কপিলদাস মাঠে নেমেছে, পাশের ক্ষেতে মোহন কিস্কুর বউ টুরি—সারা কান্দরে আর একটা মানুষ দেখা যায় না। ধান গাছের নোয়ানো পাতায়, শিষের গায়ে, তখনো রাতের হিম ফোঁটায় ফোঁটায় জমে আছে। রোদের তাপ গায়ে লাগে কি লাগে না, এমনি কুয়াশা।

হঠাৎ পাশে অস্ফুট আর্তনাদ শুনে ফিরে তাকাল সে। দেখল, টুরি মাঝি হাতের কাঁচিয়া ফেলে তার বিশাল পেট দু’হাতে চেপে ধরে বসে পড়েছে। কপিলদাস চিৎকার করে লোকজন ডাকাডাকি করল। কাছাকাছি একটি মানুষ নাই হে তখন—ভালো তো, কী বিপদ! সে নিজে এগিয়ে গেলে সে কি গালাগাল টুরির। ঐ গালাগাল শুনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। আর ঐ রকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল টুরি একটু পরই উঠে দাঁড়াচ্ছে। মেয়েটা তারপর টলমল পায়ে হেঁটে হেঁটে একটা ঝোপের আড়ালে চলে গেল।

পুরুষ মানুষ আসলে নিষ্কর্মা। কপিলদাস মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নিজেকেই শুধোয়, বল নিষ্কর্মা নয়? জন্মের সময়টাতে তার কিছু নেই। সে শুধু বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকতে পারে।

ঐ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সে টুরির কাতরানি শুনেছিল। মেয়ে মানুষের ঐ চাপা অথচ মর্মভেদী আর্তনাদের সঙ্গে বোধ হয় আর কিছুর তুলনা হয় না। ওহ্ সে কী কষ্টকর ঐ রকম আর্তনাদ শোনা। তার একটু পরই সদ্যোজাত বাচ্চার কান্না শুনতে পেয়ে তার সমস্ত শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে খুশি জেগে উঠেছিল। ছুটে গিয়েছিল তখন ঝোপটার দিকে। হ্যাঁ, ঝোপটাকে সে মনের ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পায়। বাঁশঝাড় ছিল, একটা নাটার গাছ ছিল। আবার কয়েকটা আঁশশ্যাওড়ার গাছও দেখা যাচ্ছিল। সেখানে আবার একটা সাপের খোলসও ছিল। আঁশশ্যাওড়ার ডাল থেকে নাটাগাছের কাঁটাভর্তি ডাল পর্যন্ত লম্বা করে টানানো। সেই খোলসটার ওপর আবার রোদ এসে পড়েছিল তখন। আর ঐসব দেখতে দেখতে, হ্যাঁ ভারি মনোযোগের সঙ্গে দেখতে দেখতে, মাথা উঁচু করে সে তাকিয়েছিল।

ভারি আশ্চর্য সেই দৃশ্য। সদ্যোজাত শিশুর নাড়ি দাঁত দিয়ে কাটছে মা। বাচ্চাটা থেকে থেকেই চিৎকার করে উঠছিল। সদ্যোজাত বাচ্চার কান্না কিন্তু অদ্ভুত। অদ্ভুত নয়? কেমন আঁ আঁ করে শরীরের সমস্ত নিশ্বাস বার করে দেয় গলা দিয়ে, তারপর নিশ্বাস নিয়ে হিক্কা তোলার মতো দেহ কাঁপিয়ে দমকে দমকে কাঁদতে থাকে। ঐ রকম কান্না শুনেও মা কিন্তু কিছু বলছিল না। কে জানে ঐ রকম সময়ে মায়েরা বাচ্চার কান্না শুনতে পায় কি পায় না। হ্যাঁ, মা কিছুই বলছিল না। কোনো সোহাগের কথা মায়ের মুখে ফুটছিল না। তাই দেখে সে মনে মনে কিছুটা উত্তেজনা বোধ করছিল। কিন্তু তখন মা ভয়ানক ব্যস্ত না? তার তখন বাচ্চার কান্না শোনার মতো সময় কোথায়? বলো, অতদিকে তখন নজর দিতে পারে?

হ্যাঁ, দেখছিল সে, মায়ের নিজের শরীর একদিকে, আরেক দিকে সন্তান। নিজের ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড় সন্তানের গায়ে জড়িয়ে দিচ্ছিল তখন। আহা, হাত দুখানি কী শান্ত, কী কোমল—কবজির ভাঁজটুকু কিম্বা আঙুলের নড়াচড়াটুকু টাঙনের মোলায়েম ঢেউয়ের মতো মনে হচ্ছিল। নিজের অনাবৃত বক্ষদেশ নিয়ে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কপিলদাস এখনো স্পষ্ট দেখতে পায়, দুধে স্ফীত সাঁওতাল মায়ের বুক কি রকম নিঃসঙ্কোচ হতে পারে। বোঁটা দুটি, বোঁটা দুটির চারপাশে কালো ঘেরটুকু পর্যন্ত ভারি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। শুধু মায়ের বক্ষদেশ নয়—নিম্নাঙ্গের কাপড়ও কি রকম রক্তাপ্লুত, তাও সে দেখতে পাচ্ছিল। কালো শরীরে সাদা কাপড় এবং সাদা কাপড়ের ওপর আবার ঐ রকম ডগডগে লাল রক্ত—সেও সবুজ ঘাসের মাঝখানে। সকালবেলার রোদে গোটা দৃশ্য ভয়ানক জ্বলজ্বল করছিল তার চোখের সামনে। তারপর যখন সে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল—আহা—সে যে কি রকম একটা ভাব, সে বলে বোঝাতে পারবে না। বাতাসে পাকা ধানের গন্ধ, তার নিচে ভেজা মাটির গন্ধ এবং তারো নিচ থেকে যেন নবজাত শিশুর গন্ধ উঠে আসছিল। আর ওই সময় তার দু’হাতের মধ্যে ধরা ঐ রকম রক্তাক্ত কোমল একটি লাল ফুল।

বাচ্চাটা লাল মুখ মেলে চিৎকার করে উঠছিল। তার মাড়ি, জিভ, কুঁচকানো নাক, পিটপিটে চোখ দুটি এখনো সে মনের ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পায়। আর হ্যাঁ, হাঁটতে হাঁটতে ঐ সময় সে দুহাতে বাচ্চাটাকে দোলাচ্ছিল।

কপিলদাস বুড়ো বসে বসেই হাত দুখানা তুলে শূন্যে দোলাতে আরম্ভ করে।

ঐ রকম গল্প বলতে বলতে বেলা ফুরিয়ে যায় একসময়। রোদের তাপ কমে আসে। ঝাপসা চোখ দুটি মেলে সে তখন আসমানের ধূসর রঙ দেখে। এবার নদীর ভাটি থেকে উঠে আসা শঙ্খচিলের ডাকটাও শুনতে পায়। বাতাসে তখন শীতের কামড়। তার দু’হাতের আঙুল ছেঁড়া কোটের বোতাম দুটি খুঁজতে থাকে।

আর ঐ সময়ই তার চোখে পড়ে যায়। দেখে কজন লোক টাঙনের উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে বস্তির দিকে হাত তুলে কী যেন দেখাচ্ছে। লোকগুলোকে সে চিনতে চেষ্টা করে। ওখানে এই সময়ে কারা? অমন পরিষ্কার জামা-কাপড় পরা—কে লোকটা? অনেক ক্ষণ ধরে লোকটার নড়াচড়ার ভঙ্গি লক্ষ করে। লক্ষ করতে করতেই মনে পড়ে—কদিন আগেও বোধ হয় ওদের এইভাবেই দেখেছে সে। ঠিক এইভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বস্তির দিকে হাত তুলে কী যেন বলাবলি করছিল। সে একসময় চিনতে পারে। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরা লোকটা ম্যানেজার মহাজন ছাড়া আর অন্য কেউ হতে পারে না। কিন্তু এমন সময় ওখানে দাঁড়িয়ে ওদের কী কাজ? একবার মনে হয়, জরিপ হচ্ছে বোধ হয়। একেক সময় ঐ রকম জমিজমার মাপামাপি চলে। ওরা কি জমিজমা মাপতে এসেছে? কই এ রকম কোনো খবর তো তার কানে আসেনি।

একটু পর আর দেখা যায় না কাউকে। দেখতে না পাওয়ায় কৌতূহলটা আর থাকে না। কপিলদাস তখন গরুর পালের ঘরে ফেরা ঘুণ্টির আওয়াজ কান পেতে শোনে। ফার্মের গরুগুলোর গলায় নতুন ঘুণ্টি বাঁধা হয়েছে নিশ্চয়ই। আজকাল বোধ হয় জয়হরির ছোট ছেলেটা ফার্মের গরু চরায়। জয়হরির কী যেন হয়েছিল? জয়হরির কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করে সে। আর ঠিক ঐ সময়ে কাছে এসে দাঁড়ায় সলিমউদ্দিন। এসেই ডাকে : বুঢ়া দাদা, বাড়িত যাবো নাই?

হ্যাঁ যামু, সে জয়হরির কথা স্মরণ করতে না পেরে সলিমউদ্দিনের দিকে মনোযোগ দেয়। ছোঁড়া কোত্থেকে আসছে, সেই কথা জিজ্ঞেস করতে করতে উঠে দাঁড়ায়।

সলিমউদ্দিন তখন কুশিয়ার ক্ষেতে আজ কী কাণ্ডটা ঘটেছে, সেই ঘটনার বর্ণনা আরম্ভ করে। এবং ঐ আরম্ভের মুখেই সে জানিয়ে দেয়—বুঢ়া দাদা, তুমার বস্তিটা আর এইঠে থাকবে নাই, ইবছর এইঠে ধানের আবাদ হবে। কথাটা কেন যে বলে ছোঁড়া, বুড়ো ঠিক ধরতে পারে না। কিম্বা এমনও হতে পারে যে তার বর্ণনাতেই বোধ হয় প্রসঙ্গটা থাকে না। সিলভী আজ বিন্দা মাঝির বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে। কিভাবে, সেই ব্যাপারটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে বর্ণনা করে। তারপর হঠাৎ বিন্দা মাঝি এসে গেলে কী হলো সেই পরিস্থিতিটাও সে ব্যাখ্যা করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। কপিলদাস হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়ায় আরেকবার। সিলভীর বাপের কথা স্মরণ করে ফিরেও এসেছিল, শেষে কী যে হয়ে গেল লোকটার? কবিরাজের হাট থেকে ফিরছিল সেবার—হ্যাঁ, এই রকম জায়গাতেই বোধ হয় ঘটেছিল ব্যাপারটা। সে মাটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খোঁজে। বর্ষাকালের ব্যাপার, মাটিতে ফাটল ধরেছিল—ওদিকে টাঙন তখন পাগল। মাটি ধসে পড়েছিল হঠাৎ। তখন সন্ধ্যা, শিবনাথ বোষ্টম পুলের ওপর দাঁড়িয়ে গান গাইছিল। ঠিক ঐ সময়ে ঘটনাটা ঘটে। কপিলদাস পুরনো কালের এইসব খুঁটিনাটি ঘটনার কথা ভাবতে শুরু করে দেয়।

ওদিকে কিন্তু কানের কাছে গুনগুন করে সলিমউদ্দিন বলেই চলেছে—সিলভী তারপর কী কহিল জানিস বুঢ়া দাদা? বিন্দা মাঝিক কহিল, তুই ম্যানেজার মাহাজনের কুকুর। কুকুর কহা কি ঠিক—তুই কহ বুঢ়া দাদা?

কুকুর বলেছে? কলিদাস আবার দাঁড়িয়ে যায়। হরগোবিনের মেয়ে, নগেন হোরোর বোন, সিলভী, কুকুর বলেছে। অ, সলিমউদ্দিনের দিকে তার চিন্তা ফিরে আসে, কুকুর কহে দিলে, ক্যানে?

আহ্ হা। সলিমউদ্দিনকে আবার পুরনো কথার খেই ধরতে হয়। বলে, আরে ঐ যে কহিনু বিন্দা মাঝি ম্যানেজার মাহাজনের ঘরের ভিতর থে বাহার হয়ে আসিল আর আসে ধমকালে, মারিবা চাহিল।

ম্যানেজার মহাজনের সঙ্গে কি তখন বিন্দা ছিল? একটু আগে অস্পষ্ট দেখা লোকজনের মধ্যে বিন্দা মাঝি ছিল কি না, সেই কথাটা স্মরণ করতে চাইল বুড়ো।

সলিমউদ্দিনের বর্ণনা তখনো ফুরোয়নি। বলল, সিলভীর কী তেজ, বাপ, মায়ামানুষ না ডাইন—এক্কেবারে দাও উঠালে মারবার তানে!

কপিলদাসকে এবার মনোযোগী হতে হয়—কী কহিল? দাও উঠালে মারবার তানে—কা’ক মারবার তানে?

বিন্দা মাঝিক বাহে, বিন্দা মাঝিক।

অ, কপিলদাস মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। হরগোবিনের মেয়ে সিলভীকে মনের ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পায়। খুঁটি উপড়ে গিয়ে ও মেয়ে ছাগলের পালটাকে যখন আলোর উপর দিয়ে হৈ হৈ হুস হুস করে তাড়াতে থাকে আর ছুটতে থাকে তখন তার শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখো। যদি পুরুষমানুষ হও তো নজর ফেরাতে পারবে না। সিনথিয়া ছিল ঐ রকম। কপিলদাস মুর্মু নজর ফেরাতে পারত না। দেখো, ঐ রকম মেয়ে সিলভী, সে-ই কিনা দা তুলে তেড়ে গিয়েছে বিন্দা মাঝির দিকে। কী হইল, তারপর কী হইল?

প্রশ্নটা মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো, কিন্তু কৌতূহলটা আর থাকে না। দূরে দেখতে পায় ম্যানেজার মহাজন সম্ভবত আবার এসে দাঁড়িয়েছে উঁচু পাড়ের ওপর। বস্তির দিকে হাত তুলে তুলে কী যেন দেখাচ্ছে। আর ঠিক ঐ সময় দেখো বাচ্চারা আবার শিকার করে ফিরছে—ঐ সামনেরটি বোধ হয় তার নাতি। তার কুকুরটাকে স্পষ্ট চেনা যায়।

সলিমউদ্দিন তখনো সিলভীর প্রসঙ্গ পাল্টায় না। কী কী সব বলতেই থাকে। সিলভীর ভাই নগেন হোরোর নাম করে। কেন যে—খেই ধরা মুশকিল। নাকি সলিমউদ্দিন সিলভীর সঙ্গে ইদিক-সেদিক কিছু একটা করছে? কপিলদাসের হঠাৎ সন্দেহ হয়। তবে সলিমউদ্দিনের খিটখিটে হাড়সর্বস্ব শুকনো চেহারাটা দেখে আবার মায়াও হয়। কিন্তু সান্তাল মেয়ের তো শুধু পুরুষমানুষ হলে চলে না। তার মরদ পুরুষ দরকার। সে ফস করে জিজ্ঞেস করে, হাঁ বাহে, পচই খাইছি কুনোদিন?

সলিমউদ্দিন বুড়োর কথায় হকচকিয়ে যায়। ঐ কী রকম বিদঘুটে প্রশ্ন। জবাব দেয়, না বুঢ়া দাদা, নিশা মোর সহ্য হয় না।

কপিলদাসের হঠাৎ খেয়াল হলো লোকগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না। এখুনি না দেখল! মুহূর্তের মধ্যে কোথায় উবে গেল অতগুলো মানুষ।

নাকি সে দেখেনি! তার কেবলি মতিভ্রম হতে থাকে। এদিকে সলিমউদ্দিনের সেই খামারবাড়ির ঘটনাটার বর্ণনা তখনো ফুরোয়নি। এখন অবশ্যি সিলভীর কথা বলছে না। কিন্তু ম্যানেজার মহাজনের কথাটা বলেই চলেছে। ম্যানেজার মহাজন, বিন্দা মাঝি, বিন্দা মাঝির বউও আবার ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে তার বর্ণনায়।

বিন্দা মাঝির মাউগটা বুঢ়া দাদা—হাঁ, বুঝল নি, এক্কেবারে বেহায়া বাহে। হাসে কেমন, দেখলে তোর শরীল জ্বলে যাবে।

নাও বোঝো! এবার কপিলদাসের হাসি পায়। কোন্ কথা থেকে কোন্ কথায় এসে পড়ল। এরও তাহলে মাথায় দোষ আছে।

কিন্তু ম্যানেজার মাহাজন কী কহিল্ শুনবো? কহিল্, আর নহে, তুমার বস্তিটা ইবার উঠায় দিবে, দু-চার দিনের ভিতর এইঠে টাকটর চলিবে।

কপিলদাস দাঁড়িয়ে পড়ে কথাটা কানে ঢুকতেই। দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, আ, কী কহিল?

সলিমউদ্দিন কথাটা আবার বলে। বিন্দা মাঝির বউ সোনামুখী ম্যানেজার মহাজনের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর ঝগড়া হলো আর তার পরই ম্যানেজার মহাজন কথাটা জানিয়ে দিয়েছে। কথাটা কিভাবে বলেছিল সেইটাই সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে।

সলিমউদ্দিনের কথা শুনতে শুনতে সে চারদিকের অন্ধকারের দিকে নজর ফেরায়। শীতকালের অন্ধকার ভারি দ্রুত নামছে। নদীর ওপারে কান্দরের দিকে রাখালের ডাকাডাকি শব্দ মিইয়ে এসেছে অনেক ক্ষণ। ধোঁয়া ধোঁয়া মলিন কুয়াশা কালো হয়ে ক্রমে ক্রমে নিচের দিকে নেমে এসে একেবারে ঢেকে দিয়েছে ক্ষেত, গোহাল, মানুষ এবং বস্তিতে। চারদিকের ছড়ানো মানুষ এখন কাছাকাছি হচ্ছে, ঘরে ফিরছে সবাই। মানুষের যত কথা সব এখন একে একে উঠোনে উঠোনে গিয়ে জড়ো হচ্ছে! এখন কিছুক্ষণ আগুনের কুণ্ডলীর চারপাশে কথাগুলো বিনবিন স্বরে ঘোরাঘুরি করবে। তারপর সেটাও যাবে চুপ হয়ে। মানুষজন তখন যার যার ঘরে গিয়ে ঢুকবে। অন্ধকার আর শীত কী রকম অদ্ভুত জিনিস দেখো, মানুষকে তাড়িয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। অন্ধকার দেখে মন ভয় পায় আর শীত দেখে শরীর! কাণ্ডটা দেখো!

অন্ধকারের দৃশ্য দেখতে দেখতে একটুখানি দার্শনিক ভাবনা এসে যায় বুড়োর মনে। সলিমউদ্দিনের কথা প্রায় ভুলে যায় ঐ সময়। অত যে খুঁটিনাটি বর্ণনা তার কিছুই কানে ঢোকে না। বিন্দা মাঝির বউ ম্যানেজারের ঘরে ঢুকেছিল সেই দুপুরবেলা, সবাই যখন কুশিয়ার ক্ষেতে। তারপর কুশিয়ার ওজনের সময় বিকেলবেলা সবাই যখন খামারবাড়ি এলো, তখন দুজনকে একসঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে দেখা গেল। ঐ সময় হেসে হেসে মশকরা করে কী যেন বলছিল বিন্দা মাঝির বউ, ম্যানেজারও তখন খুশি ছিল, সিলভীর দিকে তাকিয়ে সেও সম্ভবত কিছু বলছিল। ওদের ঐ রকম কাণ্ড দেখেই কিনা কে জানে, তীব্র চিৎকার করে গালাগাল দিয়ে উঠেছিল সিলভী। ম্যানেজার মহাজন ঐ গালাগাল শুনে বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে এসেছিল। উঠোনের মাঝখানে ওজনের কাঁটা পোঁতা ছিল। নবীন বর্মণ আর আকালু পরামাণিক কুশিয়ার মাপতে শুরু করে দিয়েছে তখন। বিন্দা মাঝিও কেন যে কথাটা বলতে গেল ঐ সময়। তার নেশা ছিল তখনো। সে সিলভীকে ছিনাল বলে গাল দিয়ে উঠল। আর ঐতে বিপদ হয়ে গেল। সিলভী কুশিয়ার কাটা দা নিয়ে সাঁ করে ছুটে গেল বিন্দা মাঝির দিকে। সিলভী অবশ্যি কিছু করতে পারেনি। তাই নাকি পারে। অত লোকজন চারদিকে। ঐ কাণ্ডটা ঘটে যাবার পরে ম্যানেজার মহাজনের কী রাগ—এই মারে তো এই মারে! শেষে, মানে রাগটাগ যা দেখাবার দেখানো হয়ে গেলে, তার আসল কথাটা জানিয়ে দিল সবাইকে।

সলিমউদ্দিন সম্ভবত যথেষ্ট আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে না। কপিলদাস কিছুক্ষণ শুনেও ঠিক ধরতে পারে না কথাটা। তার কেবলি তখন মনে হচ্ছে ম্যানেজার মহাজন এই সন্ধেবেলা নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালেই বা কেন, আর কেনই বা ঐভাবে হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। বিন্দা মাঝির বউ ম্যানেজারের সঙ্গে মশকরা করে কথা বলছিল—এইটুকু শুধু তার মনের মধ্যে ধরা পড়ছিল। দৃশ্যটা সে মনের মধ্যে দেখতেও পাচ্ছিল। ঐ সঙ্গে থেকে থেকে আবার সিলভিয়ার সঙ্গে সলিমউদ্দিনের ফষ্টিনষ্টির কথা, অন্ধকারের কথা, ঠাণ্ডার কথা সব একসঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিল। এমনকি টুরির সদ্যোজাত বাচ্চাটাকে দু’হাতে দোলাচ্ছিল পর্যন্ত সে মনে মনে। হ্যাঁ, তারপর কী যেন? সে হঠাৎ শুধোল : হাঁ, কী কহছিল ম্যানেজার মাহাজনের কথা, টাকটর কুনঠে চলিবে?

এত কথার পর এই প্রশ্ন। সলিমউদ্দিন রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়। বলে, না বুঢ়া দাদা, তোরঠে কুনো কথা কহা যায় না, কুনো কথা তোর ফম থাকে না।

সলিমউদ্দিনকে ক্ষুব্ধ হতে দেখে কপিলদাস বুড়ো ছোঁড়ার ঘাড়ে হাত রাখে। কী কপাল ছেলেটার দেখো, এই বয়সে মা-বাপ-ভাই-বোন চৌদ্দগুষ্টি খেয়ে বসে আছে। একটা চাকরি ছিল ফার্মে, ম্যানেজারের বউয়ের হুকুমে সেটিও গেছে। ছেলেটার রোগা দুর্বল শরীরে হাত রাখলে তার একেক সময় মায়া হয়। এখনো তাই হলো, বেচারা! সেই কখন থেকে ঘটনাটা বলে যাচ্ছে। কপিলদাস এবারে আন্তরিক আর মনোযোগী হয়। প্রায় মিনতি করে বলে, হাঁ বাপু, তারপর কী হইল কহ তো? ম্যানেজার শালা কী কহিল?

আবার কথাটা নতুন করে বলতে হলো সলিমউদ্দিনকে। বলল, তুমার বসতটা ইবার উঠায় দিবে, এইঠে ইবছর টাকটর চলিবে।

কপিলদাস এবারও বুঝতে পারে না। তার নিজের হিসাব মেলে না। ট্রাকটর জমিতে চলবে, তাই চলে এসেছে এতকাল। মানুষের বসতের উপর দিয়ে ট্রাকটর চলতে যাবে কেন? ই কেমন কথা? সে অন্ধকারেই ডাইনে-বাঁয়ে তাকায়। বলে, ঠিক শুনিছিস তুই, কহ ঠিক শুনিছিস?

সলিমউদ্দিন এবার সত্যিই বিরক্ত হয়। বলে, মোর কথা বিশ্বাস না হয় আর কাহাকো পুছে দেখ। মুই ইবার যাঁউ, তুই বুঢ়া মানুষ, তোর কিছু ফম থাকে না।

কথাটা বলেই হঠাৎ ছোঁড়া চলে গেল।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপিলদাস বুড়োর ঠাণ্ডা লাগছিল। কিন্তু সচল হবার কথা তার মনে আসছিল না। কথাটা কি ঠিক? কী কাণ্ড বলো দেখি, কথা নেই বার্তা নেই, বসতের ওপর দিয়ে ট্রাকটর চলবে। কপিলদাস চিৎকার করে ডাকে তখন; সলিমউদ্দিন, এ সলিমউদ্দিন।

তার ডাক সলিমউদ্দিনের কানে পৌঁছোয় কি না, বোঝা যায় না। অন্ধকারের ভেতর থেকে কোনো সাড়া আসে না। চারদিকে তার মেলানো সংসার। টাঙনের স্রোত, দক্ষিণের কান্দর, মানুষজন, আসমান, ধানক্ষেত, এমনকি নিজের সুখ-দুঃখ কি সাফল্য-ব্যর্থতা পর্যন্ত সে আজকাল একটার সঙ্গে আরেকটাকে মেলানো দেখতে পায়। আর সে জন্য নিজের ছোট্ট দুনিয়ায় সে ভারি নিশ্চিন্ত ছিল। কেমন ধারণা হয়েছিল, জীবন এ রকমই বয়ে যায়। একটুখানি ঝগড়া বিবাদ, হৈচৈ, কিছু দুঃখ, খানিক সুখ, জনম-মরণ সব মিলিয়েই জীবন। সে ভেবে নিয়েছিল এইভাবেই দুনিয়া তার নিয়ম পালন করে। কিন্তু সলিমউদ্দিন এ কোন কথা বলল? কথাটা তার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল।

তবে হলে কী হবে, আসলেই সে বুড়ো মানুষ তো। মন একদিক থেকে আরেকদিকে চলে যায়। কয়েক পা এগোতে না এগোতে ওপরের দিকে নজর তুললে আসমানের তারা দেখতে পায় সে, আর তাই দেখতে পেয়ে সে আসমানের শোভা দেখে কিছুক্ষণ। চোখ ঝাপসা, কিন্তু দেখতে পায় ঠিকই—শীতের আসমানে ঝকঝক করছে নীল নীল তারা। তারা কি আসলেই নীল? নাকি তার অমনি হঠাৎ মনে হলো। সে ঠিক ধরতে পারে না। একটা তারা তার খুব চেনা মনে হলো। ঐ তারাটাই না?

ঐ রকম দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সে পুরনো কথার মধ্যে চলে যায়। নরম কোলের ওপর ছিল কথাটা। মুখের ওপর সিনথিয়ার স্তনভার। সিনথিয়া সোজা হয়ে বসায় বুকের আড়াল সরে যায় আর তখন তারাটা চোখে পড়েছিল। একটা ঘোরের মধ্যে থেকে জেগে উঠেছিল সে। সিনথিয়া কানের কাছে ফিসফিস করছিল, চলো পালাই।

পালাব, সিনথিয়া মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, না। পষ্ট করে জোরের সঙ্গে বলেছিল, না।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপিলদাস মাথা নাড়ায়। আর নিজেকে শোনায়—না, ক্যানে পালাব। তার পা আপনা থেকে বাড়ির পথ ধরে। কোথায় পালাবে সে। একসময় আবার হাসি পায় বুড়োর, পালাবার কথাটা এলো কোত্থেকে? তুই বুঢ়া মানুষ হে মড়ল—নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে তখন সে বলে, তোর কিছু ফম থাকে না। আর ঐ সময় ট্রাকটরের আওয়াজটা তার কানে এসে ধাক্কা মারে। কী কারণে যে হঠাৎ ধকধক শব্দ করে জেগে উঠল ঘুমন্ত ট্রাকটরটা, আন্দাজ করা মুশকিল। বিনোদ মিস্ত্রি একেক দিন এই রকম হঠাৎ ট্রাকটরের এঞ্জিন চালিয়ে দেয়। ট্রাকটরটা সে চোখের সামনে দেখতে পায় যেন। বিশাল বিশাল দুই চাকা ঘুরতে ঘুরতে মাঠের বুকের ওপর দিয়ে চলেছে। পেছনের ধারালো চাকতিগুলো মাটি ফালা ফালা করে দিচ্ছে, গন্ধ বেরুচ্ছে কাটা মাটির ভেতর থেকে। ঐভাবে ট্রাকটরটা চলে আসে একেবারে দীনেশ কিস্কুর বাড়ির সীমানা পর্যন্ত। তার পরই বেশ দিব্যি ঘুরে যায়। বসতই হলো ট্রাকটর চলাফেরা করার শেষ সীমানা। হ্যাঁ, কলের জিনিস ঐ পর্যন্ত আসে। সংসারের সীমানা পর্যন্তই তার আসবার ক্ষমতা, তারপর আর পারে না, এতকাল অন্তত পারেনি। আর এখন সেই কলের জিনিস হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে দীনেশ কিস্কুর উঠোনে। ঘরের দেয়ালে ভোঁতা নাক ঢুকিয়ে উল্টোদিকের দেয়াল ফুঁড়ে বেরুবে। দৃশ্যটাকে সে মনের ভেতর দেখতে পায়। আর তাই দেখে সে ভয়ানক অস্থিরতা বোধ করে। ই কী কথা আঁ? ট্রাকটর চলে আসবে সংসারের বুকের ওপর? সংসারে কাচ্চাবাচ্চা, গাইগরু, সবজিক্ষেত, সুখ আহ্লাদ—সব কিছুর ওপর দিয়ে গড়গড় করে চলে বেড়াবে—ই কেমন কথা, ম্যানেজার মহাজন ও রকম হুকুম কেমন করে দেয়?

সলিমউদ্দিনের কথাগুলো এবার একের পর এক মনের ভেতর স্পষ্ট হতে থাকে। সিলভীর দা নিয়ে বিন্দা মাঝির দিকে তেড়ে যাবার ঘটনা, সোনামুখী আর মহাজনের ঢলাঢলি—ওদিকে নগেন দাস কী একটা চিঠি লিখেছিল না কোথায়? ব্যাপারটা নিয়ে না কিছুদিন ধরেই টানাহেঁচড়া চলে আসছে?

কপিলদাস বুড়োর এখন মনে পড়তে থাকে। এই বস্তি উঠে যাবার ব্যাপারটা আকস্মিক নয় একেবারে—তাহলেও, এই কি শেষ পর্যন্ত পরিণতি? বস্তিটস্তি উঠে যাবে আর ট্রাকটর চলতে থাকবে ঘরবাড়ি-ভিটেমাটির ওপর দিয়ে। কোথায় একটা মেয়েমানুষের মাথা গরম করে মাতালের দিকে দা উঁচিয়ে তেড়ে যাবার ঘটনা আর কোথায় বাড়িঘর সংসারসুদ্ধ লোপাট করে দেওয়া! কিসের সঙ্গে কিসের জড়ানো। কিন্তু ভাবো তো, বসতটা কত পুরনো? মনে আছে তোর? হাঁ বাহে, মড়লের ব্যাটা, তোর কি ফম আছে?

হাঁ হাঁ, ফম আছে। বিচার বসেছিল ফার্মের অফিসঘরে। কে একজন সাহেব মানুষ শুধোচ্ছিল। আর সে উত্তর দিচ্ছিল। কবে কোন প্রাচীনকালে এসেছিল একদল মানুষ। সেই দলের মড়ল ছিল শিবোনাথ। শিবোনাথ আবার গুণিন ছিল। কিন্তুক গুণিন হলেই কি সব হয়, আ? হয় কখনো? হয় না।

ঐ পর্যন্ত বলার পর আর বলতে পারেনি সে—মহিন্দর ধমকে উঠেছিল। পরে জানিয়েছিল, তুই আর হামার সঙ্গে আসিস না বাপ—তোর কথার কুনো ঠিক নাই। কুন কথাত তুই কুন কথা কহিস বুঝিস না।

হাঁ মড়ল, তুই বুঢ়া মানুষ—তুই কিছু করিবা ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ