ঠিক
আগের শনিবার সকাল সাড়ে আটটার সময় মহুলকে অফিসের গাড়ি এসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন
এসময়ই মহুলের অফিসের গাড়ি আসে। তখন অনেকেই ওকে দেখে, বা দেখতে পায়। তখন ওর মাথার ওপর
সানগ্লাস। চোখের পাতায় ড্রেসের সঙ্গে ম্যাচ করা রঙের আভা, ঠোঁটে চড়া রং, একদম টাইট
বুক আর সোজা সোজা ফিনফিনে সিল্কি চুল।
এ
সময় কানে মোবাইল নিয়ে মহুল ঘোরে গণপতি এনক্লেভের সামনে। একটু কান পাতলে হাই হিল জুতোর
টক টক শব্দ শোনা যায়। ওর দিকে কেউই কান রাখে না, সবাই চোখ রাখে। চোখে চাটে!
একবার
দেখেই গণেশ বিড়বিড় করে, পশ!
গণপতি
এনক্লেভের ঠিক উলটো দিকে গণেশের চায়ের দোকান। তরুলতা অ্যাপার্টমেন্টের নীচে। এত বড়
অ্যাপার্টমেন্টে নীচে চায়ের দোকান কেউ রাখতে চায়নি। প্রমোটার ও ফ্ল্যাট ওনাররা ঝামেলা
পাকিয়েছিল। অথচ গণেশের বাপেরও ওখানে চায়ের দোকান ছিল। গণেশ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে।
সুযোগ
বুঝে প্রোমোটার হাবলে সাহা ওকে ফুটিয়ে দেওয়ার তাল করেছিল। পারেনি। কেন না ফাইনাল ডে-তে
গণেশ সাতসকালে হাবলে সাহার বাড়ি গিয়েছিল। তার আগের দিন সারারাত সে ঘুমায়নি। চোখ দুটো
জবা ফুলের মতো লাল। সে গিয়ে সটান হাবলে সাহার বসার ঘরে বসে। হাবলে তখন বউ নিয়ে বসে
চা খাচ্ছে। বউয়ের পাশে সেঁটে বছর সাতেকের মেয়ে। এ সময় গৃহস্থ, হাফ গেরস্তবাড়িতে এরকমই
একটা চিত্র থাকে। চারদিকে শান্ত শান্ত ভাব।
গণেশ
শান্ত গলায় বলেছিল, ‘এই খানকির ছেলে শোন, দোকানটা চলে গেলে
আমার বউকে ঝিগিরি করতে হবে, আমার ছেলে মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম ছাড়িয়ে করপোরেশনের খোঁয়াড়ে
পাঠাতে হবে। আর সেসব আমি সহ্য করতে পারব না। আমাকে মেট্রো রেলে গিয়ে ঝাঁপ দিতে হবে।
আজ ফাইনাল ডে। আমার দোকান যদি চলে যায়, এই
আমি তোর মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে কিরা কেটে যাচ্ছি, এই ঘরে এমনই একদিন সকালে এসে তোর মেয়ে
আর বউকে আমি মেরে রেখে যাব। এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন। আমি তোকে চমকাচ্ছি না। সেরেফ
আমার ডিসিশনটা বলে গেলাম। তোরা ডিসিশন জানতে চেয়েছিলি, আমি জানিয়ে গেলাম।’ কথাটা বলে হাবলে সাহার মেয়ের মাথায় হাত
দিয়েছিল গণেশ। একদম ছুঁয়ে দিব্যি।
ওর
কথা শুনে হাবলে সাহা চিৎকার করেছিল, ‘আমার
বাল ছিঁড়বি। জানিস তোকে পুলিশ দিয়ে তুলে দিতে পারি।’
‘জানি।’ কথাটা বলে পকেটে থেকে গণেশ মোবাইল ফোনটা বের করেছিল।
হাবলে সাহার পেটোয়া পুলিশ অফিসার তিমিরবাবু। কদিন আগে ওকে নম্বর দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল,
ফাইনাল ডিসিশনটা জানিয়ে দিবি। গণেশ তাকে ফোন করল, বলল, ‘স্যার আমি গণেশ বলছি, চাওয়ালা গণেশ। আমি ফাইনাল ডিসিশনটা
বলে গেলাম, হাবলে সাহার কাছ থেকে শুনে নেবেন।’
ফোন
কেটে গণেশ একবার ঝটকা মেরে হাবলে সাত বছরের মেয়ে আর বউয়ের দিকে তাকিয়েছিল।
হাবলের
বউ আঁতকে উঠেছিল আগেই এখন তার চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে।
হাবলে
ভ্যাবলা হয়ে গিয়েছিল।
বিকেলের
মিটিংয়ে এসে হাবলে সাহা বলেছিল, ‘গণেশের দোকান এখানে থাকবে। এখানে ওর বাপ
ঠাকুর্দা করে খেয়েছে। আমি ওকে উৎখাত করতে পারি না। অত পাপ আমার ধম্মে সইবে না। যার
ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছে কিনুন, নইলে ফোটলাস হয়ে যান। টাকা সময়মতো ফেরত দিয়ে দেব।’
প্রমোটারের
পালটিতে খাওয়াতে ফ্ল্যাট হোল্ডারা অবাক হয়ে চুপ করে গিয়েছিল। বড় কষ্টে গণেশ তার দোকান
বাঁচিয়েছিল। তারপর থেকে গণেশ অনেক পালটে গেছে।একটা সোজা আর একরোখাভাব সে বুকের মধ্যে
পুষে রাখে সবসময়। সে সোজাকে সোজা আর উলটোকে স্পষ্ট ভাষায় উলটো বলা শিখেছে।কাউকে না
চমকে, চায়ের কোয়ালিটি আর আলুরদম, ঘুগনির স্বাদে মন দিয়েছে গণেশ।
গণেশ
প্রতিদিন সকাল সাতটার সময় মহুলকে দেখে, ছেলের ইস্কুল বাসের জন্য দাঁড়িয়ে। ভিজে চুল।
চুলগুলো লতপত করছে। আগে এই চুলগুলো কোঁকড়ানো ছিল। এখন সোজা হয়ে গেছে। সকালে মহুলকে
যারা দেখে তারা দু’বার দেখে। না দেখে উপায় থাকে না। তাদের
চোখে মুগ্ধতা। যেন সাক্ষাৎ দেবী মূর্তি!
গণেশ
বিড়বিড় করে, সতীলক্ষ্মী!
এরপর
মহুলকে গণেশ দেখতে পায় অনেক রাতে। তবে সেটা সব দিন নয়। গাড়ি এসে মহুলকে গেটের সামনে
ছেড়ে দেয়। গাড়ি থেকে নেমে মহুল তিরিশ সেকেন্ড সময় নেয়। নিজেকে ধাতস্ত করতে। বেশিরভাগ
দিনই নেশায় টলমল করে।
গণেশ
রুটি তড়কার প্যাকেট করতে করতে বিড়বিড় করে, খানকি!
গণেশের
তড়কারও খুব নামডাক। এখন চিকেন কষা, এগ কারি করছে। ফ্ল্যাটের বউদিদের খুব সুবিধে।
সেই
মহুল সাতদিন হল নেই।
নেই
মানে নেই। গণেশ শুনেছে বউদি ভ্যানিস হয়ে গেছে। প্রথম খবরটা দিয়েছে অঞ্জলী।
অঞ্জলী
ওদের যশদের বাড়ির সর্বক্ষণের মেয়ে। ওর সঙ্গে গণেশের একটা আলাদা ভাব আছে। এই রুটি তড়কা,
মাঝে সাঝে গণেশ দেয়। অঞ্জলীও মাঝে সাঝে গণেশের ছেলেমেয়ের জন্য দামি চকোলেট দেয়। গণেশ
পরিষ্কার বলে নিয়েছে— ‘যা দিচ্ছিস তা জিনিস চুরির মাল নয় তো?’ অঞ্জলী দিব্যি কেটে বলেছে, ‘আমাকে খেতে দিয়েছে, আমি না খেয়ে বাবুর
জন্য এনেছি।’
সেই
অঞ্জলী এসে রোববার সকালে খবর দিয়ে গেছে, বউদি আর এ বাড়িতে আসবে না। গুরুদেব ফিল্মসের
গুরুবাবুর ফ্ল্যাটে থাকবে।
গণেশ
আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘আরে গুরুপ্রসাদ তো সাদিসুদা! দুটো হারামিমার্কা
ছেলে আছে।’
‘তাতে কি, বউদিও কি আনম্যারেড! তারও তো
একটা ছেলে আছে। ও বিষে বিষে বিষক্ষয় হবে।’
গুরুদেব
ফিল্মস-এ মহুল চাকরি করত। যশের জন্যই চাকরিটা পাওয়া।
অঞ্জলী
বলল, ‘বড়বাবু কাকে বলছিল— বউদি কেপট হয়েছে। কেপট বোঝো, রক্ষিতা।
বউ থাকতে আর একটা পোষা মেয়েমানুষ!’
গণেশ
মাথা নাড়ল। তারপর সারাদিনে এর চায়ে চিনি মিস করে গেল। ডায়াবিটিক কাস্টমারের চায়ে ডবল
সুগার ঝেড়ে দিল। রোববার বিকেলে সেন পরিবারের কারও টিকি দেখতে পেল না। সোমবার ভোরবেলা
বুঝল— খবর পাক্কা!
পরেরদিন
গণপতি এনক্লেভের সামনে সকাল সাড়ে সাতটায় যশকে দেখা গেল। হাফ প্যান্ট, লাল স্যান্ডো
গেঞ্জি পরে ছেলের পুলকারের অপেক্ষায়। গণেশের মনে হল যশ সারারাত ঘুমায়নি। চোখের কোণে
কালি, লাল চোখ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভরতি গাল। সারারাত নির্ঘাত খুব মাল গিলেছে।
সাতসকালেই
আজ অনেকেই যশকে দেখল। আহা সক্কালবেলা যেন দেবতা দর্শন! নির্ঘাত ঘরে গিয়ে বউকে বলবে,
যশকে দেখলাম। কী ফ্যানটাসটিক লাগছে! টিভির থেকেও ভালো।
গণেশও
চায়ে চিনি গুলতে গুলতে যশকে দেখল। ওর চোখে মুখে দুশ্চিন্তা। যা অন্য কারো চোখে পড়ল
না। তা গণেশের চোখে পড়ল। আসলে গণেশ চায়ের গ্লাসে চামচ ঠুকতে ঠুকতে অনায়াসে বলতে
পারত, আজ যশের সতীলক্ষ্মী বউ লাল রঙের ব্রা পরেছে। আজ কালো। মহুলের ব্রায়ের রং
যদি গণেশ বলতে পারে, যশের চোখের কোণে কালি দেখতে পাবে না কেন?
কাজের
ছেলেটাকে দিয়ে গণেশ একটা লিকার পাঠাল যশের জন্য। ইশারা করল, খা!
যশ
চা হাতে নিয়ে শুকনো হাসল। এখন ও চা খাচ্ছে আর ছেলের পুলকারের জন্য অপেক্ষা করছে।
গণেশ
খুব ভালোবাসে যশকে। এই তো ওর চোখের সামনে দিয়ে যশ হিরো হল। কে বলবে, ওর দোকানের ঘুগনি,
আলুরদম এখনও ওদের বাড়ি যায় টিফিন কৌট ভরে। যশের ঘুগনিতে একটু লংকা পড়লে লাল হয়ে যেত।
ভালো ছেলে। নরমসরম। সেই ছেলে কদিন আগে ‘আয়না
গয়না’ সিরিয়ালে কী মারপিটটাই না করল ছিনতাইবাজদের
সঙ্গে। যশের এখন তিনটে মেগা চলে। সবই গুরুদেব ফিল্মসের। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়, ফেরে
মধ্যরাত! সেই গুরুপ্রসাদের ফ্ল্যাটে এখন গিয়ে উঠেছে মহুল। গুরুপ্রসাদের কেপট হয়েছে।
যশের
জন্য মহুলের চাকরি গুরুদাস ফিল্মসে। যশের জন্য সবাই চেনে মহুলকে। যশ না থাকলে ওকে কে
চিনত? অমন সুন্দরী অনেক আছে, তারা সব বাড়িতে হয় ছেলে ছোঁচাচ্ছে, নইলে বসে বসে সিরিয়াল
দেখছে। যশের উচিত হয়নি স্টেজ শো করতে গেলি, গিয়েই একবার দেখা তারপরই বিয়ে! এটা ঠিক
হল? সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে! তোর মতো ভালো ছেলের সঙ্গে একটা ভালো মেয়েরই বিয়ে হত। নাহলে
রাধিকাকে বিয়ে করতে পারতিস। সবাই তো বলত, ‘উজান গঙ্গা’র রাধিকার সঙ্গেই ওর বিয়ে হবে। কাগজে ম্যাগাজিনেও
লিখত যশ আর রাধিকার প্রেম চলছে। সেই তুই মেয়েটাকে কষ্ট দিলি, তাকে বিয়ে করলি না। ‘উজান গঙ্গা’য় সিরিয়ালে বিয়ে করে রাধিকাকে বউয়ের মর্যাদা দিলি
না, বাস্তবেও বিয়েই করলি না। কেন?
যশের
কাছ থেকে যেদিন বিয়ের খবর পেল সেদিনই গণেশ বলেছিল— কী রে রাধিকাকে বিয়ে করবি?
যশ
হাসছে—ধুসস, তুমিও খবরের কাগজের ঢপ খাচ্ছো গণেশদা!
কেন
রে—সবাই বলত?
সবাই
কারা বলত বলো—আমি তোমাকে কোনওদিন বলেছি? না, রাধিকা
তোমাকে এসে বলে গেছে? ওটা খাওয়ানো খবর। সিরিয়াল শেষ তো খবর শেষ!
গণেশ
হাঁ করে যশের মুখের দিকে তাকিয়ে। বলল, ‘তাই?’
‘হ্যাঁ তাই!’
‘তোদের কিন্তু খুব মানাত?’
‘সিরিয়ালে—! আমি ওকে বিয়ে করলে ওই মেয়ে সারাদিন তোমার কাছে
এসে বসে থাকত। তোমার সব বিড়ি ধ্বংস করে দিত!’
গণেশ
বলল, ‘ওই মেয়ে বিড়ি খায়? শালা অ্যাকটিং করছিস
আমার সঙ্গে। মনে রাখিস, আমিও কিন্তু অ্যাকটিং জানি। আমার গুরু এসে আমাকে প্রণাম করেছে—তোর মনে আছে?’
যশ
দু হাত তুলে নমস্কার করে।
বিয়ের
কার্ড দেওয়ার সময় গণেশের বউ মঞ্জরী বলেছিল—আমি ভেবেছিলাম রাধিকার সঙ্গে যশের বিয়ে হবে।
যশের
বাবা হরিশদা আঁতকে উঠেছিল, ‘সিরিয়ালের মেয়েকে কেউ ঘরে ঢোকায়? সব পাপ!
পাপ!’
গণেশ
দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ‘সিরিয়ালের ছেলেকে কেউ ঘরে ঢোকায়? সব পাপ!
পাপ!’
গণেশ
এখন মহুলকে দেখে আর হাসে, নে দেখ, পাপ বলে রাধিকাকে ফুটিয়ে কেমন বাঁশ ঢুকিয়েছিস বাগানে!’
যশকে
দেখতে দেখতে পাউরুটিটা পুড়িয়ে ফেলল গণেশ। দুধ উথলে গেল।
দুই
এখন
প্রতিদিন সকালে যশকে দেখা যাচ্ছে ছেলেকে স্কুলের পুলকার ধরানোর জন্য অপেক্ষা করতে।
গণেশ রোজ দেখছে। দেখছে যশের চোখের তলায় আরও যেন কালি জমে যাচ্ছে। যশ এসে দাঁড়ালেই গণেশ
লিকার পাঠিয়ে দেয়। মাঝে একদিন অঞ্জলীও বাচ্চাটাকে পুলকারে তুলে দিয়ে গেল।
একদিন
অঞ্জলীকে গণেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘খবর কী?’ সাধারণত গণেশ এটা করে না। কিন্তু করে ফেলল। অঞ্জলী
বিষণ্ণ মুখে বলল, ‘ভালো না।’
‘কেন?’
‘বড়বাবু সারাদিন মায়ের ঘরে। ছোটবাবু তার
ঘরে। বাচ্চাটার সবকিছু আমাকে করতে হচ্ছে। আর মায়ের ঘরে নার্স যতই করুক, আমাকেও সেখানে
হাতে হাতে কাজ করতে হয়। আর পারি না। তারপর ফোনের জ্বালাতন। ওদের সব মোবাইল অফ। বাড়ির
ফোন সারাক্ষণ বাজছে, সেটা আমাকেই ধরতে হচ্ছে, বলতে হচ্ছে, কেউ বাড়ি নেই। এত মিথ্যে
কথা বলা যায়!’
গণেশ
চুপ করে থাকে। বলে, ‘যা ঘুগনি নিয়ে যা, যশ খাবে।’
অঞ্জলী
বলে, ‘বাচ্চাটার জন্য কষ্ট হয়। তবে কী জানো,
বড়বাড়ির বাচ্চারাও বড় হয়েই জন্মায়। আমাদের বাড়ির বাচ্চা হলে মা মা করে কেঁদে ভাসিয়ে
দিত। আর রুকু রোজ রাতে একবার জেনে নেয় মা ফিরবে কি না, ব্যস, হয়ে গেল। আসলে এসবের মাঝে
বাচ্চাটা একটু একা হয়ে পড়েছে, এটুকুই যা সমস্যার। নইলে আর কিছু না।’
গণেশ
বলে, ‘আরে ও কি বুঝবে, ও দুধের শিশু!’
অঞ্জলী
ফিসফিস করে, ‘আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজনও সব জেনে গেছে।
কাল আমাকে দুজন জিগ্যেস করছিল বউদি কোথায়?’
‘তুই কী বললি?’
‘কেন শ্যুটিঙে। বাইরে লোকেশন পড়লে তো অনেক
জায়গায় বউদি যেত। আমি সেটাই বলছি। আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি কী বলতে হবে। ওদের ওইসব
শ্যুটিংই গো দাদা, ওদের প্রেম ভালোবাসা বলে কিছু নেই, সব অ্যাক্টিং!’
গণেশ
হিসেব করে খবরটা এখনও গণপতি এনক্লেভ ছেড়ে বাইরে আসেনি। এলে এই দোকানে আগে আলোচনা হত।
তরুলতা
অ্যাপার্টমেন্টের লোকজনরা গণেশকে পছন্দ করে না। ওরা সর্বসম্মতভাবে গণেশ এবং গণেশের
দোকানকে বয়কট করে চলে। ওদের কেউ যদি কখন বাইরে চা খেতে চায়, তারা দূরের দোকানে যায়।
আর ঘুগনি, আলুরদম, তড়কা, চিকেনকারিতে কাজের লোকদের পাঠায় গোপনে। গণেশ তরুলতার লোকজনকে
একটু বেশি বেশিই দেয়। গণেশ বোঝে তার চায়ের দোকান তরুলতার গ্ল্যামার কমিয়ে দিয়েছে। এ
বাড়ির লোকজন যখন কাউকে সহজে অ্যাড্রেস দেয়। মানে, মেট্রো থেকে নেমে রিকশয় উঠে কী বলতে
হবে। সেটা ওরা বলে—‘রিকশায় উঠে বলবে যশের ফ্ল্যাটের সামনে
নিয়ে চলো। যশের ফ্ল্যাটের ঠিক উলটো দিকে আমাদের ফ্ল্যাট।’ তরুলতা ফ্ল্যাটটা পাবলিক চেনে না। রিকশওয়ালারাও
না। গণেশের চায়ের দোকানের আড়ালে তরুলতা হারিয়ে
গেছে। অথচ একবারেই বললে হয়—‘গণেশের চায়ের দোকান, ওই বাড়িতেই আমরা
থাকি। তাহলে একটা বাচ্চা ছেলেও দেখিয়ে দেবে।’ গণেশ জানে চায়ের দোকানে ফ্ল্যাটবাড়ির লোকদের গ্ল্যামার
নষ্ট হবে।
অথচ
গণেশের কিন্তু আলাদা একটা গ্ল্যামার আছে। যেমন, টিভি বা সিনেমার আচ্ছা আচ্ছা হিরো হিরোইন
যশের বাড়ি এলে তারা এই দোকানের ঘুগনি, আলুরদম খায়। কখনও কখনও রাতের পার্টি থাকলে রুটি
তড়কা চিকেন গণেশের দোকান থেকে যায়। কিন্তু গণেশ এসব নিয়ে ফাটায় না। যারা জানে তারা
জানে, সে কখনও এসব নিয়ে হম্বিতম্বি করে না।
আসলে
যশকে সে ছোট থেকে দেখেছে। তার সামনেই বলতে গেলে যশ বড় হল। এ পাড়ারই তো ছেলে। শম্ভু
ব্যানার্জির বাড়ির নীচে ভাড়া থাকত। পরে গণপতিতে ফ্ল্যাট কিনে এল।
কদিন
আগে ‘আয়না গয়না’ সিরিয়ালে যশ যখন অতগুলো ছেলের সঙ্গে একা মারপিট
করল। পরের দিন যশের সঙ্গে গণেশের দেখা। গণেশ বলল, ‘হ্যাঁ রে মারপিটের সিনগুলো সাবধানে করিস—সিনটা হেভি হয়েছে। অরিজিনাল ঝাড়। খুব
কেলিয়েছিস!’
যশ
হাসে বলে, ‘অরিজিনাল হল সেই সিনটা— যেদিন তুমি আমার কানের গোড়ায় দিয়েছিলে,
মনে আছে?’
গণেশের
খুব মনে আছে, যশের ফুটবলের শটে গণেশের বাপের উনুন উড়ে গিয়েছিল। রাগের মাথায় গণেশ টেনে
একটা ঝাপড়া মেরেছিল যশকে।
সেদিনের
কথায় যশ হাসছে। গণেশ মুখ লুকিয়ে বাঁচে না।
কিন্তু
এখন যশ মুখ লুকিয়ে বাড়ির ভেতর বসে আছে। অঞ্জলী বাজার করছে, ফোন ধরছে, ছেলে সামলাচ্ছে।
ওদিকে
‘জামাইবাবু’ সিরিয়ালে কাউকে কিছু না বলে যশ বিদেশ চলে গেল।
‘আয়না গয়না’ সিরিয়ালে ওকে এক দল কিডন্যাপ করছে। কদিন আগে যশ
এত মারপিট করল, আর এবার ওকে ধাক্কা মেরে ক’জন অ্যাম্বাসাডারের মধ্যে তুলে নিয়ে ভোঁ! আশ্চর্য!
মারপিট তো দূরের কথা ও আজ একটু হাত পা পর্যন্ত ছুঁড়ল না!
‘তোমার আমার জীবন’এ যশ মারাই গেল।
তোমার
আমার জীবনে ও মারা যেতেই অনেকের টনক নড়ল। বুঝল কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। মঞ্জরী বলল,
যশকে সবাই বাদ দিচ্ছে—নইলে এমন হয়?
যশ
কী দোষ করল, ওকে বাদ দেবে কেন? দোষ যদি কেউ করে থাকে সেটা ওর বউ মহুল করেছে, গুরুদেব
ফিল্মসের গুরুপ্রসাদ করেছে।
সেদিন
অঞ্জলী এসে ফিসফিস করল, কাল রাতে বাড়িতে অনেকে এসেছিল। হ্যাঁ গো গণেশদা ছোটদাবাবুকে
নাকি সব সিরিয়াল থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছে! বাড়িতে তো টিভি চলে না। তাই কিছু জানতে পারি
না। আজ চারতলার বউদি বলল।
গণেশ
ঘাড় নাড়ল, বাদই দিচ্ছে, নইলে সব সিরিয়াল থেকে হাওয়া হয়ে যায়।
পরের
দিন কাগজে দেখা গেল খবরটা, কাগজওয়ালারাও বলছে গুরুপ্রসাদের সঙ্গে গোলমালে যশ বাদ পড়েছে
গুরুদেব ফিল্মস থেকে। ছোট খবর। খবরটা পড়ে গণেশ বলল, শালা রিপোর্টারগুলো গান্ডু, ও বাদ
পড়ল কোথায়, যশই তো যাচ্ছে না। আমার কাছে পাক্কা খবর আছে।
এভাবে
চলল আরও সপ্তাহখানেক। মঞ্জরী বলল, কোন একটা সিনেমার ম্যাগাজিনে লিখেছে, গুরুপ্রসাদের
সঙ্গে যশের ফাটাফাটি গোলমাল। গোলমালের কারণ ‘এক ফুল দো মালি’ বলে রিপোর্টার ইঙ্গিত দিয়েছে! শেষে নাকি লিখেছে
যশের কেরিয়ার প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। মাঝে দেখছিল, টিভি সিরিয়ালের লোকজন ঘনঘন যশের বাড়িতে
আসছে যাচ্ছে।
অঞ্জলী
বলল, ‘ভেতর ভেতর খুব মিটিং হচ্ছে।’
আরও
বেশ কিছুদিন কাটল।
একদিন
গণেশ বলল, ‘এই অঞ্জলী তোর ছোটবাবু কখন ফাঁকা থাকে
বলিস তো?’
‘সব সময়ই তো ফ্রী আছে।’
‘ঠিক আছে বলে দিস—আমি দোকান বন্ধের পর দুপুরে যাব, একটা
দরকার আছে।’
‘ঠিক আছে বলে দেব।’
দোকান
বন্ধ করে দেড়টা নাগাত গণেশ ঢুকল গণপতি এনক্লেভে।
অঞ্জলী
বলল, ‘দাদাকে বলে রেখেছি—ওই ঘরে চলে যাও।’
ঘরে
ঢুকে গণেশ দেখল যশের বিছানা জুড়ে নানান কাগজ ছড়ানো। কিছু লিখছিল।
যশ
বলল, ‘এসো বস!’
‘কী রে তোর ব্যাপার কী রে?’
‘কী ব্যাপার? এই কাগজপত্র—সিনেমার একটা স্ক্রিপ্ট লিখছি।’
‘তুই শুনলাম ওই গান্ডু গুরুপ্রসাদের সঙ্গে
ক্যাচাল করে সব ছেড়ে ছুড়ে বসে আছিস।’
গণেশের
কথায় হো হো করে হেসে উঠল যশ।
গণেশ
বলল, ‘হাসছিস, শালা আমার সঙ্গে অ্যাকটিঙ মারিও
না।’
‘পাগল আমি অ্যাকটিং করব, তারপর তুমি আমার
কানের গোড়ায় দাও আর কি?’
গণেশ
একটু লজ্জা পেল। বলল, ‘এমন করিস না ভাইটি। গোলমাল হলে পালিয়ে
যেতে নেই। বুক ঠুকে সামনে দাঁড়াতে হয়। যা গিয়ে শালাকে ফ্লোরের মধ্যে ঢুকে তেড়ে খিস্তি
দে। মা মাসি এক করে দে। দিয়ে অন্য চ্যানেলে ভিড়ে যা। পাবলিক সেটাই দেখবে। তুই যশ!’
যশ
বলল, ‘বাইরে খুব হচ্ছে না! তোমার চায়ের দোকানের
পার্লামেন্ট কী বলছে বলো?’
‘ধুস শালা! আমি আমার কথা বলতে এসেছি। হেসে
ওড়াস না।’ গণেশ থামে। বলে, ‘একদিন তুই আমাকে বলেছিলি, আমি গিয়েছিলাম
হাবলে সাহার বাড়ি, তুই বলেছিলি— আবেগ দিয়ে অ্যাকটিং করবে গণেশদা। হাবলে
সাহার ঘরে ঢুকে ওকে ওর মেয়ে বউয়ের সামনে খানকির ছেলে দিয়ে শুরু করে, ওর মেয়ে বউকে খুন
করার হুমকি দেবে। তুমি ঠিক মতো বললে ও ভয় পাবেই। তোমার হারানোর কিছু নেই। যদি থানা
পুলিশ হয়, আমরা পাড়ার ছেলেরা আছি, বলব, তোমার মাথার ঠিক নেই। কী বলতে কী বলেছ। তুমি
ঠিক মতো বললে—ভয় ও পাবেই। তোমার দোকান গেলেও ওরও সারা
জীবনের শান্তি যাবে?’
গণেশ
থামে, বিছানার ওপর পড়ে থাকা জলের বোতল তুলে দু ঢোঁক জল খায়, বলে, ‘বিশ্বাস কর, তুই বলেছিলি অ্যাকটিং করতে—আমি কিন্তু সেদিন অ্যাকটিং করিনি, যা
করেছিলাম তা সত্যি, যা বলেছিলাম তা সত্যি সত্যি। আমি ভেতর থেকে বলেছিলাম, আমি আমার
বিশ্বাস থেকে বলেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আমার পরিবার ভেসে গেলে, আমি ওকেও শান্তিতে
থাকতে দেব না। আমি খুন করতে পারি।’
‘আঃ গণেশদা!’ যশ ওকে থামায়।
গণেশ
বলল, ‘সেদিন আমার পুলিশকে ফোন করা, সেদিন আমার
হাবলে মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করা—সব
তোর কাছে ওভারঅ্যাকটিং ছিল। আমি জানি, তুই আমাকে বলেছিলি, এটা ওভার হয়েছে। কিন্তু ভাইটি
বিশ্বাস কর, আমি সেদিন অ্যাকটিংই করিনি, ওভার অ্যাকটিং করব কীভাবে?’
যশ
মাথা নিচু করে।
গণেশ
বলে, ‘এবার তুই যা, তোকে আমি বলব, তুই গিয়ে
অ্যাকটিং করিস না। হয় তুই গিয়ে একবার গিয়ে মহুলের কাছে দাঁড়া—গিয়ে স্পষ্ট করে তোর কথা, তোর ছেলের কথা
বল, মন থেকে বল, বিশ্বাস থেকে বল। যা বলতে ইচ্ছে করে, তাই বল। ভালোবাসার কথা বল, বলে
ওকে বাড়ি নিয়ে এসে, অন্য চ্যানেলে যা। আর যদি খিস্তি দিতে ইচ্ছে করে তাই দিয়ে আয়। তুই
ওদের বলে আয়—যশকে কারও ইচ্ছেয় বিদেশ পাঠানো যায় না,
কেউ ইচ্ছে করলে যশকে মেরে ফেলতে বা কিডন্যাপ করাতেও পারবে না। এই দেখো আমি যশ। আমি
উঠে দাঁড়াচ্ছি! আমি তোমার চ্যানেলে নেই, অন্য চ্যানেলে ফাটাচ্ছি—।’
তিন
গণপতি
এনক্লেভে চত্বরে মহুল কানে ফোন, হাই হিলে টক টক করে হাঁটছে। হাঁটছে না উড়ছে। সকালে
অনেকে দেবী দর্শন করে। রাতে মাতাল হয়ে গুরুপ্রসাদের গাড়ি থেকে নামে। গণেশ খানকি দর্শন
করে। আর পাবলিক ওদের জোড়ায় হাসি মুখ দেখে গুরুদের ফিল্মসের রিয়েলিটি শোয়ে। বেস্ট জোড়ি! জোড়ি হ্যায় তো অ্যায়সা!
‘আয়না গয়না’ সিরিয়ালে যশ কিডন্যাপারদের সঙ্গে তুমুল মারামারি
করে ফিরে এসেছে।
‘জামাইবাবু’ সিরিয়ালে বিদেশ থেকে মেম গার্লফ্রেন্ড নিয়ে যশ ফিরেছে।
‘তোমার আমার জীবন’ সিরিয়ালে মরে গিয়েছে, কিন্তু যশের চেহারা
নিয়ে কে এল? কে এল?
অঞ্জলী
এসে ঠোঁট ফুলিয়ে খবর দিয়ে গেছে।
গুরুপ্রসাদ
আর যশের কম্প্রোমাইজ হয়ে গেছে। কম্প্রোমাইজ মানে জানো তো মিটমাট। ওদের মিটমাট হয়ে গেছে।
মহুল
এখন দুজনের। যশের বউ। গুরুপ্রসাদের কেপট। কেপট মানে জানো তো রক্ষিতা। বউ ছাড়া পোষা
বাইরের মেয়েছেলে।
সেদিন
বড়বাবু মাকে বলছিল, দুদিন ওয়েট করো, গুরুপ্রসাদ কোনও মেয়েছেলেকেই পারমানেন্ট করে না।
শখ ফুরালেই ওর পাছায় লাথি মারবে। তখন ওই মাগি আবার তোমার ছেলের পায়ের কাছেই পড়ে থাকবে।
ওয়েট করো।
গণেশ
চায়ে নিষ্ঠার সঙ্গে চিনি দেয়। সতীলক্ষ্মী দেখে। আর বিড়বিড় করে। রাতের গুরুপ্রসাদের
গাড়ি গণপতি এনক্লেভের সামনে থামলে, তড়কায় সামান্য মাংসের ঝোল মেরে বিড়বিড় করে, পাপ!
পাপ!
0 মন্তব্যসমূহ