‘প্রত্যেকের জীবনে টার্নিং পয়েন্ট বলে একটা ব্যাপার
আছে। সেই জায়গাটা থেকে ভাগ্যরেখার ঊর্ধ্ব বা অধোগতি হয়’, বুদ্ধু মামা বলতেন। বুদ্ধু মামা আমার
মায়ের পিসতুতো ভাই। মামার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল কোন এক কোরবানির ঈদে বন্ধুর বাড়িতে চাটাইয়ের ওপর
কাটা মাংস ভাগ করার মুহূর্ত।রক্তমাখা চাটাই দেখে মামার মাথায় অভিনব এক ব্যবসার বুদ্ধি
ঝিলিক দিয়েছিল; বাঁশের ঝুড়ির ব্যবসা।
যেনতেন ঝুড়ি নয়, উপহার সামগ্রী প্যাকিং এর ঝুড়ি।
কাঁথা ফোঁড়, বেনারসি পাড় বা জামদানি পাড় দিয়ে হাতল এবং চারধার মোড়া। মামার সেই সব ঝুড়ির
ইউরোপ আমেরিকায় এখন দারুণ কদর। এম,এ, পাশ করে তিন বছর প্রায় বেকার ছিলেন মামা। ট্যুইশনির টাকায় নুন
আনতে পান্তা ফুরোতো। আর এখন গুলশান বনানীতে ফ্ল্যাট,দামি গাড়ি!
আমার জীবনের সেই টার্নিং পয়েন্ট এল গতকাল হঠাৎ শুকনো
মেঘ ঘষে বাজ পড়ার মত। দুপুর বেলা চৌদ্দ
বছরের মেঘলাকে ল্যাপটপে আমেরিকার ছবি দেখাচ্ছিলাম। যে
গোলকধাঁধায় গত চার বছর আমি হাবুডুবু খাচ্ছি ওইটুকুন মেয়ে মাত্র
চার মিনিট একুশ সেকেন্ডের ভিডিওটা দেখেই ফট করে বলে বসল, ‘হি ইজ গে অর মে বি বাইসেক্স্যুয়েল।’ প্রশ্ন নয়, সিদ্ধান্ত।
মেঘলার সঙ্গে মাত্র দশ বারো দিন আগে আমার পরিচয়।
ছাদে। অরিন্দম তখনো আসেনি আমেরিকা থেকে। মেঘলা দোতলার ভাড়াটে মীরা’পুর চাচাতো বোন। নিউইয়র্ক থাকে।
বাবা মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছে। অরিন্দমও নিউইয়র্কে থাকে। বাড়িতে সবাই ভাত
ঘুমে। আমার দুপুরে
ঘুমানোর অভ্যেস নেই। কাকিমা ছাদে আমসত্ত্ব শুকোতে দিয়েছিল, ভাবলাম
নেড়ে দিয়ে আসি। তিনতলা থেকে ছাদ মাত্র চৌদ্দটা সিঁড়ি। আগে কী লাফিয়ে মিনিটে উঠে যেতাম। আর সেদিন এ ক’টা সিঁড়ি ভাঙতেই
আমার বুক পেট বেয়ে সরসর ঘাম নামছিল সাপের মত। হাঁপাচ্ছিলাম। শরীর অনেক ভারী হয়ে
গেছে।
ছাদের এককোণে বুড়ো নিম গাছটা। ওর চিরল পাতা ভরতি
ডালপালা রেলিং ছাড়িয়ে ছাতার মত রোদ আগলে রাখে। সেই ছায়ায় ছোট একটা চায়ের টেবিল আর ক’খানা চেয়ার পাতা।
বাবা কাকুরা ছুটির দিনে তাস পেটায়। একসময় এই জায়গাটা আমার বড়ই প্রিয় ছিল।
ভুলভাল বানানে ভরা প্রথম প্রেমপত্র মাকে লুকিয়ে এখানেই পড়েছিলাম। আমার বই পড়া, স্বপ্ন
দেখা, ঠাকুরমার কোলে মাথা রেখে ভরা জোছনায় রামায়ণের ‘কিষ্কিন্ধ্যা কান্ড’ শোনা;
সব এইখানে। এখন এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত টানা তারে ছাদ জুড়ে দোল
খাচ্ছে আধ শুকনো শাড়ি কাপড়। কাপড়ের ফাঁক গলে প্রিয় জায়গাটায়
এসে দেখি বুঁদ হয়ে বই পড়ছে শ্যামলা কিশোরী। পুরু চশমা পরা। আমাকে দেখতে পায়নি। আমিই এগিয়ে গিয়ে
চমকে দিলাম। মিশুকে মেয়েনিমেষেই আলাপ জমে গেল আমাদের। আমার পেটে কান পেতে
বাচ্চাদের নড়াচড়ার শব্দ শোনার চেষ্টাও করে ফেলল।
‘ওরা দুপুরে ঘুমাবে। লক্ষ্মী বাচ্চা’। ওর বলার ধরণে হাসতে
হাসতে আমার চোখে জল চলে এল। হাতে ধরা বইটা বন্ধ করে চেয়ার টেনে আমার পা জোড়া তুলে
দিল পাকা বুড়ির মত। কী বই জানতে চাইলে বলল, ‘এটা একটা ডার্ক বই। তোমাকে আমি এটার গল্প বলব না।
তোমার এখন সব খুশি খুশি গল্প শোনাই ভাল।’
‘ওরে আমার শাশুড়ি মা!’ আমি
আদর করে গাল টিপে দি। কাকিমা’র আমসত্ত্বের ওপরে
ঢাকা দেয়া ফিনফিনে কাপড় তুলে দু’জন মিলে বেশ
খানিকটা সাঁটিয়ে দি। কী সুন্দর বাংলা বলে! আমি খেপাই, ‘মেঘলা তোমার নাম তো রোদেলা হওয়ার কথা।’ ও জানায় ওর জন্ম
শ্রাবণ মাসে, নিউইয়র্ক সিটিতে। মায়ের ইচ্ছে ছিল ‘শ্রাবণী’ রাখবে
কিন্তু উচ্চারণের জটিলতা এড়াতে ‘মেঘলা’ রাখল। একসময় মীরা’পু উঠে আসে ওকে ডাকতে। মীরা’পুকে বললাম, ‘কোথায় লুকিয়ে
রেখেছিলে এই মেয়েকে?’ একথা সেকথার পর ‘অরিন্দম আসছে’, জানাই মীরা’পুকে’।‘চলে এস নিউইয়র্ক ভার্সেস নিউইয়র্ক জমবে এবার।’
মীরা’পুরা এই বাড়িতে এসেছে বেশিদিন হয়নি। আগে ছোটকাকু থাকত
ওই ফ্ল্যাটে। অফিসের বাংলোয় চলে গেছে কাকুরা। মিরা’পুর বাবা কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক। মীরা’পু একটা এন,জি,ও, তে নির্বাহী প্রধান হিসেবে কাজ করছে ঢাকায় । বিয়ে করেনি এখনও।
প্রায়ই বিদেশে যায়। যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের নিয়ে ওর কাজ।ওদের বাড়ির সবাই
ভীষণ ভাল। খালাম্মা আমার জন্যে আমের আচার বানিয়ে পাঠিয়েছেন। আমার শরীরের অবস্থা শুনে একটা বিশেষ দোয়া
পড়ে ফু দিয়ে গেলেন এই সেদিন।
গত বুধবার অরিন্দম এল। বাড়ি ঢুকেই কোন রকমে ঠাকুরমা’র পা ছুঁয়েই
বেডরুমে চলে এল। আমাকে ভালকরে দেখলোও না। অথচ অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর এই প্রথম
দেখা আমাদের । মা, বাবা,
কাকু গিয়েছিল আনতে ঢাকা এয়ারপোর্টে, তারপর গাড়িতে কুমিল্লা। মাঝরাত পার হয়ে গিয়েছিল পৌঁছুতে। ঘরে ঢুকেই টি- শার্টটা মাথা গলিয়ে ছুঁড়ে দিল মেঝেতে। আমি বেশ ঘাবড়ে
গিয়েছিলাম। ‘পিঠে একটু পাউডার ছিটিয়ে দাও তো’, বলেই ঝপ করে কাছিমের মত উবু হয়ে শুয়ে
পড়েছিল। আমি ড্রেসিং টেবিল থেকে জনসন বেবি পাউডারটা হাত বাড়িয়ে নিতেই ওর ফর্সা পিঠে চোখ আটকে
গিয়েছিল। ঘাড়ের ঠিক নিচেই তিনটে আঁচড়। বেশ গভীর। নখ গেঁথে গেছে যেন। রক্ত মরে
বেগুনি হয়ে ছিল। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চেপে গেলাম।পাউডার ছড়ানোর ফাঁকে আলতো আঙুল
চালিয়েছিলাম। কেঁপে উঠেছিল যেমন মিনি পুষিটার পিঠে উলটো দিকে হাত বোলালে তিরতির কাঁপে! নিজেই হয়তো পিঠ
চুলকোতে গিয়ে জোরে টেনেছে। তাতে উল্লম্ব হওয়াই স্বাভাবিক, অনুভূমিক নয়। এটা ঠিক,দেশের ঘ্যামা গরম ওর সহ্য হয় না। কিন্তু গাড়িতে তো এসি চালু ছিল। একটু পরেই ও মৃদু নাক ডাকতে শুরু করে
দিয়েছিল। রাতে আর খেতে ওঠেনি। আমিও খাইনি। সেই তিনটে আঁচড় কেন জানি রাতের গায়ে আঁচড় কেটে জাগিয়ে
রেখেছিল আমাকে।
অরিন্দম বছরে একবার আসে নিয়ম করে শীতে; এবারের
আসাটা অন্য রকম। আমার পেটের ভেতর যমজ বাচ্চাদের একজন উল্টে আছে। জটিল অবস্থা। সাতমাস চলছে।
বেশ ভালই চলছিল সব, হঠাৎ বিপত্তি। আমি শ্বশুর বাড়িতেই ছিলাম। ফরিদপুরে। এখানেই থাকতে
চেয়েছিলাম। কিন্তু আল্ট্রাসোনোর রিপোর্ট জানার পর মা-বাবা, পিসি,
কাকু, কাকিমা সব সদলবলে এক ভর দুপুরে হাজির। মা যথারীতি
ফ্যাঁচফ্যাঁচ শুরু করে দিল, ‘এতদিন পর ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন কোন অঘটন যেন না হয়।’ কুমিল্লায় আমার পিসি পিসেমশাই দুজনই ডাক্তার। অতএব নাটক জমবার আগেই আমাকে
বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে গাড়িতে উঠতে হ’ল; ঠিক চার বছর আগের সেই দিনটার মত।
চার বছর আগে অবশ্য সব পুরুষেরা এসেছিল। আমার এখনও
কানে বাজে, ‘৩২ নম্বর আপনার গেস্ট।’ সেই বিকেলটার প্রত্যেকটা মুহূর্ত
আমার কাছে এতটাই সতেজ যে আমি ইচ্ছে হলেই নিমেষে অবিকল সচল করতে পারি। দিনটা ছিল রোববার। কোরবানি ঈদের ছুটি শেষ করে হোস্টেলে ফিরেছি দু’দিন আগে, শুক্রবারে। ব্যাগ খুলে সব বেরও করিনি। বিকেল সাড়ে
চারটা বা চারটা পঁয়ত্রিশের মত হবে। ক্লাস শেষে সবে ফিরেছি হোস্টেলে। ওড়নাটা চেয়ারের হাতলে রেখে জামা
পাল্টাতে যাচ্ছি এমন সময়ে ডাক। ৩২ নম্বরের গেস্ট। আমার গেস্ট? আমি অবাক! প্রেম করিনা। হুটহাট ছেলে
সহপাঠীরাও আসে না বিকেলে। হুড়মুড় করে ওড়না ছাড়াই নেমে আসি নিচে। বুক কাঁপছিল অজানা
আশঙ্কায়। দেখি বাবা আর দুই কাকু বসে আছে গেস্টরুমে। কী বৃত্তান্ত ? ‘একঘণ্টার মধ্যে
তৈরি হও।’ ব্যাগ মোটামুটি গোছানোই। ওপরে উঠে মোবাইলে লাগাই মা’কে ‘আয় না আগে তারপর সব শুনবি।’ আমি গলার আওয়াজের ওঠানামায় ঘটনার গুরুত্ব মাপার চেষ্টা করি। কিছুই বুঝিনা। বাড়ি পৌঁছে দেখি সবাই ঠিকঠাক।
তবে? আস্তে
আস্তে জট খোলে। মস্ত মানী পরিবার। একমাত্র ছেলে। বুয়েট থেকে পাশ করা
ইঞ্জিনিয়ার। নিউইয়র্কে এক নামকরা আইটি কোম্পানিতে কাজ করে। এমন পাত্র লাখে এক। পরদিন বিকেলে দেখতে আসবে
সুদূর ফরিদপুর থেকে। আমার থার্ড ইয়ার। ‘আর এক বছর পরেই আমার অনার্স ফাইনাল, তারপর
হোক এসব’, আমি কাঁদতে থাকি। ‘দেখতে এলেই কি বিয়ে হয়ে যায়?’ ছোট কাকু বলে। পরদিন বিকেলে শাড়ি পরে,
টিপ পরে সঙ সেজে বসি। ঝাঁক বেঁধে সব আসে। পাত্র কিছুই বলে না অবিরাম সেল ফোনের
বোতাম টেপে। ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর নিজের আঙুল থেকে খুলে আঙটি পরিয়ে দেন পাত্রের মা, ‘মেয়ে ভারি মিষ্টি!’
পাত্রের তাড়া আছে। ছুটি শেষ। হিন্দু বিয়ের ঝক্কি
অনেক। সব মাথা একসাথে পঞ্জিকার ওপর হুমড়ি খায়। আর ঠাকুরমা হামামদিস্তায় আমার বুকের ধুকপুকির সাথে
মিলিয়ে সমান তালে পান ছেঁচে যায়। পনের দিনের মাথায় বিয়ে; এক মাস পরে পাত্র ফিরে যায়
কাজের জায়গায়। কিন্তু আমার ফেরা হয় না কোথাও; না ইউনিভার্সিটি না নিউইয়র্ক; আমার ননদ, শাশুড়ি-শ্বশুর
সবাই বলে, ‘ডিগ্রীটা করে ফেল । ফরিদপুরে কি কলেজের অভাব? ভর্তি হয়ে যাও একটাতে।’ আমার থার্ড ইয়ার ইংলিশ অনার্স, আমার শেক্সপিয়ার,
আমার আন্টন চেকভ চোখের জলে সাঁতরায় আর রাতের বালিশ শুষে
নেয় সব চুপকথা।
নিউইয়র্ক থেকে ফোন আসে ওর। কখনও সপ্তাহ শেষে কখনও দশ
বার দিন পরপর। শুনি ট্যাকনিকেল কারণে আমার কাগজ পাঠাতে দেরি হচ্ছে; নিউইয়র্কে
সব কিছুতে কড়াকড়ি। তবে প্রতি মাসে আমার একাউন্টে নির্দিষ্ট তারিখেই মোটা টাকা জমা হয়।
বিয়ের চার বছর পার তাও আমার কোল বিরান। প্রতি বছর
বড়দিনের ছুটির সাথে ছুটি মিলিয়ে তিন সপ্তাহ্র জন্যে আসে অরিন্দম।। বন্ধুদের নিয়েই
থাকে। আমি দেখতে ভাল তাও কেন যেন ও আমার মোহে পড়ে না। আমার শাশুড়ি তখন পুরুষ মানুষের পা পিছলানোর গাঁজন
শোনান। এক নাগাড়ে সেই প্যাঁচাল শুনতে শুনতে আমার হাই ওঠে । দুনিয়ার নিকৃষ্ট গালি
গুলো মগজে বাজে। গতকাল আমার মুখ দিয়ে যে সমস্ত গাল বেরুলো এগুলো হঠাৎ একদিনের হুজুগ নয়, চার
বছর ধরে জমানো এবং চর্চিত। অরিন্দম তো বটেই, আমার মা বাবাও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল
আমার খিস্তি শুনে। আর বুড়ি ঠাকুরমা হাতে করে তেলেজলে গুলে আমার তালুতে থপ থপ লাগাচ্ছিল।
ওরা আমাকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে চালিয়েছে। আমার এতগুলো
বছর কেবল সমাজের চোখে ধোঁকা দিতে নষ্ট করেছে। যাওয়ার আগে ও বলছিল ভেবে দেখতে। আমি আমার
জায়গায় ‘জন’ জনের
জায়গায়। আমাকে টাকা পয়সা যেমন দিচ্ছে তেমনই দেবে বাচ্চাদের একটু বড়
হলেই ও নিয়ে যাবে আমেরিকায়। জন ওদের ভালবেসেই বড় করবে। রাগে অপমানে আমার শরীর দিয়ে আগুন
ঠিকরে বেরুচ্ছিল; আমি সেই জনসন এন্ড জনসন বেবি পাউডারের কন্টেনারটা ছুড়ে মারি সব শক্তি
দিয়ে। টিপ ফসকে যায়, ওর গায়ে লাগে না।
ওরা দু’জন দুজনকে ভালবাসে, জন আর অরিন্দম। সেই বুয়েটের দিনগুলি
থেকে। জন আমেরিকান এম্বেসিতে কাজ করতো । ওর আমেরিকা যাওয়া জন এর সুবাদেই । ওদের সম্পর্কটা
বাড়ির সবাই বুঝে গিয়েছিল কিন্তু বাইরে জানাজানি হলে নিজের একমাত্র বোনের বিয়ে
ভেস্তে যাবে তাই জন আর ও আমেরিকা পাড়ি দেয়। এর মধ্যেই আমার শাশুড়ি গোল বাঁধান।হার্ট এ্যাটাক।
অরিন্দম ওঁদের একমাত্র ছেলে। বংশের প্রদীপ দেয়ার জন্য তো চাই কাউকে। কাজেই মাকে
স্তোক দিতে বিয়ে একটা করতেই হয়।
আমি অরিন্দম কে দেখি, ভাবলেশহীন কী সহজে বলে যাচ্ছে
ও! বলতে বলতে জামা কাপড়ও গোছায় সমান তালে। পাসপোর্ট নেয়। ল্যাপটপ গোছায়। ভাগ্যিস
ল্যাপটপ থেকে সব ছবি, ভিডিও পেনড্রাইভে নামিয়ে দিয়েছে মেঘলা! আইনি লড়াইয়ে লাগতে পারে।
গতকাল মেঘলা আর মীরা’পু এসেছিল
অরিন্দমের সাথে দেখা করতে। ও বাইরে গিয়েছিল। মীরা’পু কাকিমা’র সাথে গল্পে মজে
গেল। আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম মেঘলাকে ছবি দেখাতে। ছবির বেশির ভাগই অরিন্দম
আর জনের লং-আইল্যান্ডের বাড়ির। ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ ছিল
অনেক; তুষার পড়ছে জোর অথবা সাবওয়েতে টুপি মেলে রেখে কালো
মানুষটা অদ্ভুত মায়াবী গলায় হারানো প্রেমিকার জন্যে গাইছে,
‘পৃথিবী বড় ক্রূর
ফিরে এসো,
ভুলচুক শুধরে নেব,
আমি তোমাকেই ভালবাসি’ --কী
সুন্দর গান!
সবচেয়ে লম্বা ক্লিপটা ছিল চারমিনিট একুশ সেকেন্ডের।ওর
জন্মদিনে সহকর্মীরা হেঁড়ে গলায় গাইছে ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’! ‘জন’ উপচে
পড়া ফেনাময় বিয়ারের মগ উঁচিয়ে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলছে
‘চিয়ার্স’। মনে হচ্ছে যেন আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে। আমি মেঘলাকে পরিচয়
করিয়ে দি, ‘এ হল জন, অরিন্দমের বন্ধু। ওরা এক বাড়িতে থাকে’। মেঘলা চোখ সরু করে
দেখে আলো আঁধারীতে ওদের নাচ। অরিন্দম আর জনও নাচছে। আমি তখনও বলে যাই, ‘আমার বাচ্চা হওয়ার
খবরে জন বড়ই খুশি। কী সুন্দর কার্ড পাঠিয়েছে। টুইন বেবি, পেটে
চাপ দিলে হাসে আবার কাঁদে। দাঁড়াও তোমাকে দেখাই!’ আমি পা বাড়াতে যাই; ড্রেসারের ড্রয়ারেই কার্ডটা।
মেঘলা হাত ধরে আমাকে টেনে বসায়। অবাক হয়ে দেখে আমায়, ‘তুমি বোঝনি?’ আমি
কী বুঝব’? ‘হি ইজ গে অর মে বি বাইসেক্স্যুয়েল।’ ভিডিও ক্লিপটা
রিওইয়াইন্ড করে। পজ দিয়ে স্ক্রিন শট নেয়। জুম করে। আমি দেখি আলো আঁধারিতে ওদের
ঠোঁটে ঠোঁট।
চোখের সামনে সব খান খান ভেঙে পড়ছিল কাচের মত। মেঘলা
আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল শক্ত করে। আমি মনে মনে একটার পর একটা সেই ভাঙা কাচের টুকরো
প্রাণপণে জুড়ছিলাম।আর সেই তিনটা আঁচড় বেগুনি নয় ফলসা রঙে ভাসছিল আমার চোখের জল ছাপিয়ে।
2 মন্তব্যসমূহ
Ranjana Banerjee is a profound story teller like Banaphool - she is the raconteur of our time. On a sliver of a fleeting idea, she would weave a story just as majestic and/or heart wrenching as this one revisiting our emotion over and again on a cascading wave of surprises.
উত্তরমুছুনHumbled.
উত্তরমুছুন