হাইওয়ের দিকে : জয়ন্ত দে



সন্ধে থেকেই কারেন্ট নেই। প্রিয়াঙ্কা যখন স্টেশনে এল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। মফসসল শহরে সাড়ে সাতটা মানে বেশ রাত। কিন্তু কিছু করার নেই। আজ ট্রেনের গোলমাল ছিল সকাল থেকেই। সকালের দিকে অবরোধ হয়েছিল। বেলায় অবশ্য উঠে যায়। কিন্তু তাতেই যা গোলমাল, জট পাকানোর তা পাকিয়েই গেছে। তবু সে বেরিয়েছিল, তার না বেরিয়ে কোনও উপায় ছিল না। যদি এমন হত দুপুর পর্যন্ত অবরোধ চলত, তাহলে বলার মতো একটা কথা থাকত। সে বলতেই পারত-কী করে আসব ?

অনির্বাণ বলেছিল, যেও না। এই ট্রেনের গোলমাল, কোথায় আটকে বসে থাকবে। তখন এক কেলোর কীর্তি হবে।
কিন্তু প্রিয়াঙ্কা না গিয়ে পারল না। অনেকগুলো টাকা। সে সকালে ট্রেন অবরোধ শুনেই ইউনিয়নের দেবজ্যোতিবাবুকে ফোন করেছিল। উনি শুনে বললেন, ম্যাডাম আজ যেভাবেই হোক আসুন। নইলে আপনার এ টাকা উদ্ধার হওয়া খুব মুশকিল।
প্রিয়াঙ্কা হাঁফাতে হাঁফাতে বলেছিল, আমি কী করে যাব? ট্রেন অবরোধ।
আপনি বাসে চলে আসুন। দেখুন গরজ আপনার, ম্যানেজমেন্ট বলেছে আজই  টাকাটা দেবে। মিস করবেন না, আপনি আসুন। ইউনিয়ন আর কতদিকে সামলাবে?
কিন্তু ট্রেন যদি না চলে-ৃবাসে ওঠা অসম্ভব হয়ে যায়, আমি একা মেয়েমানুষ!
দেবজ্যোতিবাবু ফোনের ওপারে চুপ করে থাকল। বলল, দেখুন। অনেক কষ্ট করে এটা আদায় করেছি। আপনি বিনা নোটিশে চাকরি ছেড়ে দিয়ে লা-পাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন। কোম্পানি টাকা আপনাকে দিত না। চার বছর পরে এসে টাকার ডিমান্ড করছেন। আপনি সাত মাস ধরে ঘুরছেন। আপনি আজ না এলে আপনার টাকা মায়ের ভোগে। আমি আপনার জন্যে বলছি, এতে অনেকে আঁশটে গন্ধ পাচ্ছে। ভাবছে আপনার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক আছে। আমি আজই কাজটা মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনি যদি না আসেন, প্লিজ এ ব্যাপারে আর কোনওদিন আমার কাছে অন্তত আসবেন না। আপনি বাসে আসুন। ঘুরপথে আসুন। প্রয়োজনে আজ রাতে কোনও আত্মীয়ের বাড়ি থেকে যাবেন।
প্রিয়াঙ্কা বিড়বিড় করল, ঠিক আছে, আমি এখনই বেরুচ্ছি।
অনির্বাণ আবারও বলল, আমি জানি না কীভাবে যাবে? এই টিভিতে দেখাচ্ছে স্টেশন চত্বর রণক্ষেত্র। কাজকের দিনে আর যেও না।
আজকের দিন শুনে প্রিয়াঙ্কা একটু চমকে গেল। ভাবল, অনির্বাণের কি মনে আছে? বলল, তাই তো, আমার কেমন ভয় লাগছে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে? চলো না, টাকাটা নিয়ে নয় আজ একটু ঘুরে বেড়িয়ে আসব।
আমি! না, না। অনির্বাণ আরও ভয়ার্ত গলায় বলল। তুমি বরং ওনাকে বলো না, টাকাটা উনি রেখে দিক, কাল তুমি নেবে।
দিশাহারা প্রিয়াঙ্কা বলল, বলব?
হ্যাঁ বলো। বলেই দেখো না। যাও, বারান্দায় গিয়ে ধীরে সুস্থে ওনাকে বলো। ক্যাশ তো দেবে না, দেবে চেক। চেকটাই রেখে দেবে।
প্রিয়াঙ্কা এবার বারান্দায় গিয়ে ফোন করল। যদি না যায়, আর চেকটা যদি দেবজ্যোতিবাবু রাখেনবলল।
ফোনের ওপার থেকে দেবজ্যোতিবাবু হাসলেন, বললেন, ম্যাডাম, একটু আগেই আপনাকে আমি বললাম, অনেকেই আপনার সঙ্গে আমার একটা আঁশটে গন্ধ পাচ্ছে। অনেকেই ভাবছে, একটা সুন্দরী মহিলাকে এই উপকারের পিছনে নিশ্চয়ই আমার কোনও উদ্দেশ্য আছে। এখন যদি আপনার টাকা আমি হাতে করে রাখি, তাহলে পুরো বিষয়টা কামিনী কাঞ্চন যোগ হয়ে যাবে। তাই আমি বলি কি, আপনি আসুন, একটু কষ্ট করেই আসুন। নইলে আপনাকে পস্তাতে হবে।
প্রিয়াঙ্কা বিড়বিড় করে বলল, ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। তার মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে অফিসের লোকজন সত্যিই তেমন কিছু ভাবে নাকি, ছিঃ ছিঃ! নিজের পাওনা টাকার জন্য তাকে কত কথা শুনতে হচ্ছে!
সে ঘরে আসতেই ব্যাজার মুখে অনির্বাণ বলল, না, তোমার দ্বারা হবে না। তুমি তো ধারাভাষ্যের মতো মালটাকে টাকা রাখার কথা বললে। আরে ন্যাকামি করেএকটু খেলিয়ে বলতে হয়। দেখতে ঠিক রাখত। তুমি বোঝো না ও তোমার জন্যে কেন এত করছে? এরা অনেক শেয়ানা, তোমার উপকার করে, তোমাকে কৃতজ্ঞতার ডোবায় ডুবিয়ে এরা মাছ ধরবে। ও ফিদা হয়ে রয়েছে। শালা সব করবে, তুমি ঠিক করে বলো। বলো, কাল আপনি যেখানে বলবেন, আমি টাকাটা নিতে সেখানে যাব। দেখবে, ঠিক রাজি হয়ে গেছে।
প্রিয়াঙ্কা নিজেকে খুব শান্ত করল, বলল, না, আমি যাব।
কীভাবে যাবে, উড়ে উড়ে?
দেখি কী করে যাই।
তাহলে এক কাজ করো, বুদ্ধিটা তোমার খারাপ লাগবে, তাহলেও আজকের দিনটার জন্য তোমাকে মেনে নিতেই হবে।
আজকের দিনটা বলতে প্রিয়াঙ্কার আবার বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল, ওর কি মনে আছে তাহলে? সে বলল, বলো কীতুমি তো বলবে, টাকাটা যাক, না পেলে না পাবে, আজ  আর যেতে হবে না, তাই তো?
না, না, অতগুলো টাকা, যাক বললে হবে। আমি বলছিলাম, তুমি বলরামকে একবার বলো, ও তোমাকে বাইকে করে দমদম ছেড়ে দিয়ে আসুক। তুমি তারপর মেট্রো ধরে চলে যাও। তবে আমার মন বলছে, তুমি যদি বাইকে ওকে ঠিকভাবে জাপটে ধরো, ও তোমাকে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা দুটোই করবে, এমন সুযোগ ও ছাড়বে না। বেচারা হাঁ করে আছে।
অনির্বাণের কথাটা শুনে প্রিয়াঙ্কার গা চিড়বিড় করে উঠল। বলরামের বাইকে উঠে আমি যাব, তুমি আমায় ভেবেছ কী!
খারাপ কিছু ভাবিনি। সিচ্যুয়েশন ডিমান্ড করছে, তাই একটু হেল্প নিলে। মনে করো না, ফেরার সময় এটা হয়েছে, ট্রেন অবরোধ, সেখানে বলরাম আছে, তার বাইক আছে, তোমাকে বললতুমি আসবে কি না?
প্রিয়াঙ্কা দাঁত কিড়মিড় করল, ওর সঙ্গে আসার আগে আমি ট্রেনের তলায় মাথা দেব।
অনির্বাণ হাসল, আরে ট্রেন তো চলছে না, বন্ধ। গল্পটা যে ওখানেই, তোমার মাথা অ্যাকসেপ্ট করবে কে?
পশু! প্রিয়াঙ্কা ছিটকে পাশের ঘরে চলে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ছোটলোক!
অনির্বাণ আয়েশ করে সিগারেট ধরাল। কবে বলরাম একলা পেয়ে একটু চক্কর চালিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, তাতে একদম মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে। ও না থাকলে এই বাড়িটায় থাকতে পারতাম। দু বছর পর তো হাটিয়ে দিত, বলরাম হুমকি দিয়ে সেই পুরনো ভাড়ায় আবার এগ্রিমেন্ট করিয়ে দিল। সেদিন তো এত ফোঁস করলে না। উলটে সবাইকে চা খাওয়ালে। বললে বলবে ভদ্রতা। ভদ্রতা না ছাই সুবিধেবাদী!

দুই
স্টেশনের ভেতরে আলো, বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কী মানুষ, দেখছে লোডসেডিং, তবু বাড়িতে বসে আছে, একটু তো এগিয়ে আসতে পারে। টাকাটা পেয়ে প্রিয়াঙ্কাই একবার ফোন করেছিল। ফোনের ওপারে অনির্বাণের উচ্ছ্বাস শুনেছিল, ব্যাস ওই পর্যন্ত, আর একটাও ফোন নেই। সে কীভাবে আসবে, সে কী ভাবে আসছে, এত নিষ্পৃহ অনির্বাণ!
প্রিয়াঙ্কা স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াল। চারদিকে টিমটিমে মোমবাতির আলো। রিকশা কি আছে? প্রিয়াঙ্কার কিছুই চোখে পড়ছে না। ট্রেনের গোলমালের জন্য এদিককার লোকজনরা সব কাজে বের হয়নি। ফলে টোটো, অটো সব বন্ধ। রিকশাঅলাদেরও ফিরতি প্যাসেঞ্জার নেই। তাই সন্ধের পর সব গাড়ি তুলে দিয়েছে নির্ঘাত। আজ তার সঙ্গে শাড়ির বড় ব্যাগটা নেই, এটাই বাঁচোয়া। নইলে ওই ব্যাগ নিয়ে সে কী করত? তবে একদম খালি হাতেও সে বের হয়নি। কাঁধের ব্যাগে খান চারেক বাছাই শাড়ি ছিল। এর মধ্যেও তার আজ দুটো শাড়ি বিক্রি হয়েছে। ভ্যাগিস নিয়ে গিয়েছিল।
কী করবে ভাবছিল প্রিয়াঙ্কা, ফোন করবে একটা অনির্বাণকে। রিকশা নেই হাঁটতে হবে বলে নয়, এই অন্ধকার রাস্তা, ওর বুকের ভেতরটা কাঁপল। না, ফোন করে লাভ কি? এর আগে একবার এমন হয়েছিল, ফিরে এসে দেখল কিছু নেই, তারওপর টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন ফোন করেছিল সে। অনির্বাণ অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছিল, তুমি তো একবার হেঁটে আসবে, আমাকে যেতে হবে আবার আসতে হবে, মানে দুবার। তারচেয়ে একটু অপেক্ষা করো। দেখো একটা না একটা কিছু পেয়ে যাবে। সেদিন অন্যকিছু পায়নি প্রিয়াঙ্কা, পেয়েছিল বলরামকে
সেদিন বলরাম পরের ট্রেনে কাজ থেকে ফিরছিল, ওকে দেখে বলল, বউদি আমার সঙ্গে যেতে পারেন, নইলে এই ব্যাগ নিয়ে কী করবেন?
এই ব্যাগ নিয়ে তোমার বাইকে, তুমি পারবে?
উঠে একবার দেখুন না।
অনেক দ্বিধায় ভুগে সেদিন সে বলরামের বাইকে বসেছিল। তবে সে খুব সাবধানী। বলরামের পরেই তার শাড়ির ব্যাগটা রেখেছিল। তারপরে নিজে বসে শাড়িটা ঘোমটার মতো করে মাথা ঢেকে নিয়েছিল, যাতে কেউ দেখলে সহজে না চিনতে পারে।
প্রিয়াঙ্কাকে এ তল্লাটের এত মেয়ে বউ চেনে, তাদের স্বামীরাও চেনে যে সে নড়লে চড়লে খবর হয়। অনেকে বলে, শুধু প্রিয়াঙ্কা সুন্দরী নয়, ওর পছন্দও খুব সুন্দর। অনেকে এর সঙ্গে যোগ দেয় একটা মোক্ষম কথাশুধু বরটা পছন্দ করতে ভুল করেছিল।
ভুল প্রিয়াঙ্কা করেনি, করেছিল ওর বাবা মা। ভালো চাকরি দেখেছিল। হতে পারে প্রাইভেট ফার্ম, কিন্তু চাকরিটা বেশ বড়ই করত অনির্বাণ। কিন্তু বিয়ের পরে পরেই প্রিয়াঙ্কা বুঝেছিল, তার স্বামীর রোজগার আটআনা কিন্তু খরচ বারোআনা। বাবুগিরি! শুধু বাবুগিরি। এই যে সংসার, ফ্ল্যাট, গাড়িসব স্বাস্থ্য ফোলানো ফাঁপানো।
প্রিয়াঙ্কার এক জামাইবাবু বিয়ের পর পর যখন এটা সেটা থেকে অনেক কিছু জানতে পারে তখন মজা করে বলেছিল, হ্যাঁ রে প্রিয়া তোর বরের সব কিছুতেই কি স্টেরয়েড মারা!
প্রিয়াঙ্কা লজ্জায় মরে যেত।
কিন্তু মাঝে মাঝে ওর অবাক লাগত ওর শ্বশুর শাশুড়ি কী শিক্ষা দিয়েছে ছেলেকে।  ছোটবেলা থেকেই কী এরকম?  সব সময় নিজেরটা? জামা প্যান্টের যত্ন করছে,  জুতো পালিশ করছে,  নখে ফাইল করছে, মাথার চুলে ক্রিম ঘষছে, কিছু খেলেই দশ মিনিট লাগছে মুখ দাঁত পরিষ্কার করতে। ঠিক আছে করুক এটা তার একদমই ব্যক্তিগত। কিন্তু পকেটে পঁচিশটা ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড। হেন কোনও ব্যাংক নেই যাতে ওর স্বামীর অ্যাকাউন্ট নেই। গাড়ি করে অফিস যেত, গাড়ি করে ফিরত। পার্ক স্ট্রিটের নামী রেঁস্তরা ছাড়া খেত না। প্রিয়াঙ্কার খুব খারাপ লাগত না। কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারল ফুটুনি দেখাতে গিয়ে ওর গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে দেনায়। তবু থামল না অনির্বাণ। একসময় সে দেনা মাথার ওপর দিয়ে বইছে। দিন রাত বাড়িতে পাওনাদার আসছে। তারা অনির্বাণকে না পেয়ে প্রিয়াঙ্কাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে। অনির্বাণ যে চেক দিচ্ছে, তা বাউন্স করল, পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল, তিনদিন পর জামিন পেল। তখন বাড়ির সামনে আরও একদল দাঁড়িয়ে। কোমরে দড়ি দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে। অফিস থেকেও অনেক টাকা সরিয়েছিল। একদিন অফিস ওকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়াল।
প্রিয়াঙ্কা চাকরি করত । একদিন পাওনাদরের ভয়ে রাতারাতি কলকাতা শহর ত্যাগ করল অনির্বাণ। প্রিয়াঙ্কাও চাকরি ছেড়ে চলে এল এখানে। না-এসে উপায় ছিল না। ব্যক্তিগত ধারও অনেক। তারা বাড়ি বয়ে এসে দু একবার হামলা করে গেল। ভয় দেখাল তুলে নিয়ে গিয়ে কেটে বাইপাসে ফেলে দেবে।
ভয় পেয়েছিল অনির্বাণ পালাতে চাইল। রাতারাতি এখানে। ব্যবস্থা করে দিয়েছিল অনির্বাণের চেনাশোনা এক ড্রাইভার। তার পর থেকে ও ঘরবন্দি। প্রায় চার বছর। প্রিয়াঙ্কার মনে হয় কলকাতা শহরের লোকজন, পাওনাদারেররা অনির্বাণকে সবাই ভুলে গেছে। এখন ও কিছু কাজকর্মের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু অনির্বাণ এই জীবনে বেশ মজা পেয়ে গেছে।
ভোরবেলা লাল নীল ট্র্যাকসুট পরে মর্নিংওয়াক, সেখানেই চা সিগারেট খেয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মেরে ফেরা। বেলা দশটা বাজলেই দাড়ি কেটে, চান সেরে, হালকা একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ক্লাবে। সেখানে ক্যারাম পেটানো। ঠিক দেড়টা বাজলে ফিরে এসে ভাত খেয়ে টিভি, ঘুম। বিকেল-সন্ধের মুখে বেরিয়ে পরে, আবার ক্লাব। ফেরা রাত দশটায়। শনি রবিবার রাত এগারোটা হয়ে যায়, কেননা ওইদিন ওর মদ্যপানের আসর থাকে। তবে পারতপক্ষে এলাকার বাইরে যায় না অনির্বাণ। মাঝে দু বার কলকাতা গিয়েছিল। শেষবারে দেখা হয়ে গিয়েছিল একজনের সঙ্গে। তার সঙ্গে কী হয়েছিল প্রিয়াঙ্কা জানে না, কিন্তু বুঝেছিল অনির্বাণ বেশ ভয় পেয়ে গেছে। আর কোনওদিন কলকাতামুখো হয়নি।
প্রিয়াঙ্কা সকালে উঠে বাজারে যায়। দুজনের রান্না খাওয়া, তাই বাজার খুব সামান্য। একদিন বাজার গেলে তিনদিন যেতে হয় না। অনির্বাণ একদম মাছ খায় না। ও মাছ বলতে বোঝে, ফ্রিশফ্রাই, বড়জোর চিংড়ি। ডিম খায় খুব। সকালে ওর চাই ব্রেড বাটার অমলেট, টি। প্রিয়াঙ্কা আগের দিনের রাতের রুটি খায়। দুপুর যা হোক কিছু রান্না করে প্রিয়াঙ্কা বেরিয়ে যায়। ও সপ্তাহে পাঁচদিন কলকাতায় যায়। পনেরো কুড়িটা অফিস, স্কুল ধরা আছে। সেখানে শাড়ি নিয়ে যাওয়া, ইনস্টলমেন্টের টাকা তোলা। এরমধ্যে বড়বাজারে মহাজনের কাছেও যেতে হয়। ওর তিনটে মহাজনের ঘর ধরা আছে। ওরা নিদ্বির্ধায় ওকে শাড়ি দেয়। চারবছর ধরে তিল তিল করে প্রিয়াঙ্কা ওদের বিশ্বাস অর্জন করেছে।
অনির্বাণ কিন্তু অন্য কথা বলে। বলে, সুন্দর মুখ দেখে সবাই ভুলে যায়।
ওর কথা প্রিয়াঙ্কা গায়ে মাখে না। ওর এক দিদি একবার বলেছিল, কেন ওকে খাওয়ে দাইয়ে পুষছিস? একটা লাথি মেরে চলে আয়। তুই যা বিজনেস করিস তোর একটা পেট রাজার হালে চলে যাবে। শান্তিতে থাকতে পারবি।
প্রিয়াঙ্কা শান্তির মানে জানে না। ও জানে অভ্যেস! ওর মনে হয়, ও নিজের জন্যেই এখানে আছে। কারও জন্যে না। মাসের ঠিক এক তারিখে ও বাড়িভাড়া দেয়। আজ পর্যন্ত কোনওদিন দু তারিখ হয়নি। ঝকঝকে তকতকে ওর ঘরদোর, বাড়িঅলা উঁকি মেরে কোনওদিন ওর খুঁত দেখতে পায়নি। তবু একদিন বাড়িঅলা রেগে গেল প্রচণ্ড। যেদিন শুনল, রিকশঅলারা তার বাড়ির নাম দিয়েছেশাড়িবউদির বাড়ি! শুনেমাত্র বাড়িঅলা ওদের নোটিশ দিল। উঠে যেতে হবে। অকুলপাথারে পড়েছিল প্রিয়াঙ্কা। এখানে তার এত চেনাজানা, এত কাস্টমার। আবার তাদের নতুন করে বাড়ি চেনানো। কাছাকাছি কোথায় বাড়ি পাবে? স্বামী বসে খায়, বউ শাড়ি বিক্রি করে, এই পরিচয়ে কে ওদের বাড়িভাড়া দেবে?
সমস্যা সমাধান করল বলরাম। ছেলেটা বিডিও অফিসে চাকরি করে। কিন্তু গুণ্ডা প্রকৃতির। পার্টি থেকে ক্লাবসবেতেই বলরাম আছে।
বাড়িঅলাকে হুমকি দিয়ে নতুন এগ্রিমেন্ট করিয়ে দিল। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল প্রিয়াঙ্কা। বলরাম বলেছিল, বউদি এবার একটা ছোটখাটো দুকাটা আড়াইকাটা জায়গা কিনে নিজের কিছু করুন। আপনার যা গুডউইল আছে আপনি ধারে মাল পেয়ে যাবেন।
প্রিয়াঙ্কার মনে হয় তাই করলেই ভালো হয়। ওর যা গয়না আছে তাতে দু কাটা জমি হয়ে, হয়তো বাড়িরও অনেকটা হবে। তবে প্রিয়াঙ্কা ধার করবে না। বিজনেস থেকে টাকা বের করবে না। যেটুকু করবে ক্যাশ।
প্রিয়াঙ্কাও এমন কিছু ভাবছে দেখে, প্রচণ্ড রেগে গেল অনির্বাণ। দুদিন কথা বলল না। তারপর বলল, ধার বলো, ক্যাশ বলো সব ওই বলরামই দেবে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না, তলে তলে কী হচ্ছে?
প্রিয়াঙ্কা বুঝেছিল, অনির্বাণ মুখে যা বলছে আসলে তা নয়, ওর ভয় পাওনাদারের যদি আসে। এই বাড়িঘর নিয়ে টানাটানি করে। একটা ব্যাংক, একজন পাওনাদার ওর হদিশ পেলে সবাই এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সবাই ওকে খুঁজছে। যে কোনও দিন ওদের এখান থেকে পাততাড়ি গুটাতে হবে।
প্রিয়াঙ্কা মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, সে আর পালাবে না। তেমন মনে হলে অনির্বাণ চলে যাক। সে এখানেই থাকবে। চারবছর ধরে তিল তিল করে, কী সম্মানের সঙ্গে সে এটুকু জায়গা করেছে। অনির্বাণ শুনে ভ্রূ কোঁচকায়, এখানকার কটা পাবলিক তোমার থেকে শাড়ি নেয়।  এখান থেকে চলে গেলে তো কলকাতার অফিস, স্কুলগুলো চলে যাচ্ছে না।
প্রিয়াঙ্কা ঠিক করেছে জমি সে কিনবে, আজ না হোক কাল কিনবে। তার আরও কত লোকজন আছে। প্রিয়াঙ্কা বোঝে অনির্বাণ মুখে বলরামকে নিয়ে এত বাজে কথা বলে, কিন্তু প্রিয়াঙ্কাকে টোপ দিয়েই ও বলরামের মতো একটা ছেলেকে হাতে রেখেছে। আর বলরাম, অফিসের সময়টুকু বাদ দিকে সারাদিন অনির্বাণের সঙ্গে পড়ে আছে। কেন পড়ে আছে প্রিয়াঙ্কা বোঝে। দরকারে অদরকারে তাদের বাড়ি আসছে। তাদের সংসারে অনির্বাণের মারফত হুটহাট ঢুকে পড়ছে। প্রিয়াঙ্কা বোঝে, সব বোঝে, বলরামের চোখে মুখে সব কথা লেখা আছে। কী আছে প্রিয়াঙ্কার মধ্যে যে ও এমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে থাকে।

তিন
এখন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে প্রিয়াঙ্কা ভাবল কী করে সে যাবে, এতটা রাস্তা। এমন সময় দেখল বলরাম তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, বউদি, সন্ধে থেকে পাওয়ার কাট হয়েছে। আপনি কীভাবে যাবেন। টোটো বন্ধ, অটোও চলছে না।
প্রিয়াঙ্কা গম্ভীর হল, বলল, খুব মুশকিল, রিকশাও তো নেই দেখছি।
হ্যাঁ, রিকশাও নেই।
বলরাম খুব সংকোচে বলল, আমার সঙ্গে বাইক আছেআপনি কি যাবেন বউদি? আমি কিন্তু আপনার জন্যেই দাঁড়িয়েছিলাম।
প্রিয়াঙ্কা তাকিয়ে থাকল বলরামের দিকে। বলল, তুমি বরং দেখো যদি কোনও রিকশা পাওয়া যায়।
রিকশা পাবেন না, পেলে আমি তাকে আপনার জন্যে দাঁড় করিয়ে রাখতাম।
হঠাৎ ওর মনে হল অনির্বাণই বলরামকে পাঠিয়েছে। দেখেছে লোডসেডিং, নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল টোটো বা অটো চলছে না। প্রিয়াঙ্কা বলল, তোমায় কি দাদা পাঠালো?
না, না, অনির্বাণদা জানে না, সকালেই শুনেছিলাম আপনি কলকাতায় গেছেন। তারপর শুনলাম, সব বন্ধ, আমি তাই এসে দাঁড়িয়ে আছি। ভেবেছিলাম, আগেভাগে একটা রিকশা ঠিক করে রাখব। কিন্তু কিচ্ছু নেই।
প্রিয়াঙ্কা বলল, আমি হেঁটে চলে যাব বলরাম, তুমি এসো।
বলরাম বলল, ঠিক আছে চলুন বাইকটা তাহলে আমি গ্যারেজ করে রাখছি, আমিও আপনার সঙ্গে হেঁটে যাব। রাস্তাটা খুব অন্ধকার, এতটা পথ।
আমি তোমার সঙ্গে হাঁটব না। তোমার বাইক আছে, তুমি চলে যাও। কারেন্ট এসে যাবে আমি যেতে যেতে। এমন কিছু রাতও হয়নি।
বলরাম বলল, ঠিক আছে আমি আপনার সঙ্গে যাব না, আপনি আগে হাঁটুন, আমি পিছনে আছি।
ওর কথা শুনে প্রিয়াঙ্কা কিছু বলল না। সে স্টেশনের সিঁড়ি দু ধাপ নেমে এল। হাঁটতেই যখন হবে, দেরি করে লাভ নেই। সে তো বিশ্বাস করে একবার উঠেছিল বলরামের বাইকে। কী করেছিল বলরাম? সুযোগ পেয়ে তাকে নিয়ে উড়ে গিয়েছিল চেনা অচেনা কত রাস্তায়, কী তার বাইকের স্পিড, কোথায় পাড়ার রাস্তা, কোথায় হাইওয়ে! সাত রাজ্য ঘুরে উড়েছিল ওর বাইক। একসময়, প্রিয়াঙ্কা কাকুতি মিনতি করেছিল, প্লিজ বলরাম, এ কোথায় চলেছি, বাড়ির দিকে চলো। বলরাম বাড়ির দিকে চলেনি। একসময়, প্রিয়াঙ্কা বলেছিল, তুমি না পাড়ার রাস্তা ধরলে আমি বাইক থেকে ঝাঁপ দেব।
প্রিয়াঙ্কা ঝাঁপ দেবে শুনে বলরাম বাড়িমুখো হয়েছিল। তারপর অনির্বাণের কাছে এসে সে গল্প হা হা করে কী হাসি! তাল মিলিয়ে অনির্বাণও হাসছিল। ছোটলোক!
বলরাম বলল, বউদি আজ  আপনার জন্মদিন!
জন্মদিন কথাটা শুনে প্রিয়াঙ্কা হেসে ফেলল। কে বলল তোমায়, তোমার দাদা!
না, না, সেই রেশন কার্ড করার সময় আমি দেখেছিলাম।
ও! প্রিয়াঙ্কা ঢোঁক গিলল। ওর মনে আছে। বলল, হতে পারে।
বউদি একটা জিনিস চাইব দেবেন? ওর গলার স্বর বেশ নীচু। এমন নীচু গলায় কথা বলার ছেলে ও নয়। স্থির হয়ে দাঁড়াল প্রিয়াঙ্কা বলল, কী?
সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করে দেবেন? আজ আপনার জন্মদিন, আশা করি আপনি ফেরাবেন না। সেদিন আমি অন্যায় করেছি।
প্রিয়াঙ্কা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। বলল, তোমাকে ক্ষমা করলে তো তোমার বাইকে চড়তে হয়।
না, না, আমরা হেঁটেই যাব, চলুন আমার অসুবিধে হবে না। আমি শুধু সামনের মোড়ে যতনের দোকানে গাড়িটা দিয়ে যাব।
গম্ভীর মুখে প্রিয়াঙ্কা বলল, বাইকটা স্টার্ট দাও, আমি উঠছি।
আপনি বাইকে যাবেন! বলরাম যেন ওর কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। বলল, চলুন তাহলে।
বলরাম বাইকে স্টার্ট দিল। একটু এগতে প্রিয়াঙ্কা বলল, আজ কী বললে, আমার জন্মদিন! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তা আমার জন্মদিনের গিফট কই?
রাস্তার একধারে বাইক থামাল বলরাম, আমি তো কিছু আনিনি। দোকানপাটও যে বন্ধ এদিকে। তারপর আপনার যা রাগ। কিছু দিলে যদি রাগ করেন? কী নেবেন বলুন, আমি কাল দেব।
প্রিয়াঙ্কা বলল, না, আজ চাই।
আজ, আজ  কী দেব?
তুমি বাইক থামালে কেনচালাও।
বলরাম বাইক নিয়ে এগিয়ে গেল কিছুটা। প্রিয়াঙ্কা বলল, এদিকে নয়, ওদিকে চলো
হাইওয়ের দিকে? বিস্মিত বলরাম প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, আমার গিফট। প্রিয়াঙ্কা এগিয়ে এসে বলরামের গা ঘেঁষে বসল, ওর কাঁধে নখ সুদ্ধ আঙুল চেপে ধরল। বলল, স্পিড তোলো। পড়ে যাব না, আমি তোমাকে ধরে আছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. সব্বাই বলরামদের দোষ দেয় কিন্তু অনির্বাণ তো বলরামের চেয়েও খচ্চর !

    উত্তরমুছুন
  2. ভাল লাগল। শ্বাসরোধী একটা সম্পর্কের বাইরে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ের সহজভাবে শ্বাস নেওয়ার গল্প।

    উত্তরমুছুন