লরি ভর্তি আম যায় না বাইরে। মাঝে মাঝে লাঠি হাতে তারা তেড়ে আসে ঠিকই। কিন্তু সারা মরশুমে একবার কী দু’বার। ভগীরথপুরের জমিদারদের বাগান। জমিদারি নেই। তবুও ‘জমিদার বাড়ি’ নাম থেকে গেছে। অজস্র শুকনো এবং হলুদ পাতা। হলুদ পাতাগুলো সদ্য ঝরে মাটিতে রঙ ছড়িয়েছে। বিশাল আম বাগানের এখানে ওখানে ছাগল ও গরু চরছে। ঘাস খাচ্ছে। হলুদ পাতাও। দূরে দূরে খেলছে রাখালরা। হাতে পাচন। গরু খেদানোর। বয়স্ক মহিলা ও বাচ্চা মেয়েরাও শুকনো পাতা কুড়োচ্ছে। যেখানে ঘাস নেই সেখানে ঝাঁটার স্পর্শে উড়ছে ধুলো। এখানে সেখানে পড়ে আছে শুকনো, আধা শুকনো গু। সেগুলো বাঁচিয়ে পাতা জড় করা চলছে। গ্রামে কয়েকটা বাড়িতে মাত্র পায়খানা ঘর। মাটির উনুনে জ্বাল দেওয়ার জন্য জমিয়ে রাখা হবে পাতা। গাছের শুকনো ডাল, ধানের তুঁষ, পাটকাঠি ইত্যাদির সঙ্গে এগুলোও রান্নার কাজে লাগবে। গাছ কেটে, কাঠ করে, শুকিয়ে রান্না করার চল নেই। পরিণত গাছ কাটা পাপ। বিশ্বাস, নরকে যেতে হয়। তাই সহজে গাছ কাটে না কেউ। এখন পাতা ঝরার সময়। আম বাগান জুড়ে কেবলই পাতা ঝরে চলেছে। হা করে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দেখি আমারই মতো এক বালিকা হেঁটে আসছে। আমার মতো হলেও ঠিক আমার মতো নয়। ফর্সা। খালি গা। দড়ির ফিতে বাঁধা রঙচটা সুতির ইজের পরে। খালি পা। লম্বা চুল ঘাড় থেকে নেমে এলোমেলো। বাম দিকে সিঁথি। সে আমাকে অতিক্রম করে গেল। আমার দৃষ্টি ওর দিকেই। ডাকলাম,
: এই ছুঁড়ি, নাম কি রে তোর?
ঘুরে তাকায় সে।
: ফুলকুমারী।
: কুথায় থাকিস? ফুলের দ্যাশে? আমার দাদিমা ফুলকুমারীর কাহানি বলে। তুই কী সেই?
: না! আমি তো...
: কুথা যাস?
: রাস্তা চিনতে পারি না। কদমতলা কুনদিকে?
: একটুকুন দাঁড়া। নিয়ে যাবো। পাতাগুলা বস্তায় ভরে নি।
সে দাঁড়ায়। আমের পাতাগুলো তাড়াতাড়ি ভরে নিই চটের বস্তায়। বস্তার কোণ ডানহাতে। পাতা ভর্তি বস্তা পিঠ থেকে গোঁড়ালি পর্যন্ত ঝুলে। বা হাতে ঝাঁটা। হাঁটছি।
: চ।
বস্তাটা পায়ের গোড়ালিতে ক্রমাগত ধাক্কা খায়। শব্দ ওঠে। শুকনো পাতার ওপর পা ফেলার শব্দও। সেও হাঁটে। পাশাপাশি। ওকে খুব ভালো লাগছে। বড় টানা চোখে যদিও রাস্তা হারানোর আতঙ্ক। বড় বড় আমগাছ। মোটা গুঁড়ি। কতকাল এভাবে মাথা তুলে কে জানে! গুঁড়ির ওপরের দিকে লম্বা পাতার সবুজ পরগাছা। বেগুনি-সাদাটে ফুল। বলি,
: সই পাতবি?
সে মাথা হেলায় সম্মতিতে।
: কিছু যে নাই আমার। কী দিয়ে সই পাতবো?
: এট্টু দাঁড়া।
আমি বস্তা ও ঝাঁটা ঘাসের ওপর শুইয়ে রাখি। একটা গাছের গুঁড়ি ধরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করি। পারি না। ডালগুলো এত ওপরে। ফুলকুমারী আমাকে নিবৃত্ত করে। আমার ইচ্ছা সেও যেন বুঝে গেছে। তরতর করে সে গাছে ওঠে। ঠিক কাঠবেড়ালীর মতো। একটা কাঠবেড়ালী তাকে দেখে লেজ তুলে ছুটে পালায় গাছের ওপর। সে কাঠবেড়ালীকে দেখে নিয়ে হাত দিয়ে গুঁড়ি আঁকড়ে ধরে, গুঁড়ির ফেটে যাওয়া ত্বকের ফাটলের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট পায়ের আঙুল স্থাপন করে করে সে পৌঁছে যায় পরগাছাগুলোর কাছে। আমি ভয়ে ভয়ে ওর দিক থেকে একবারের জন্যও চোখ সরাই না। যদি পড়ে যায় তো মা শুনতে পেলে রক্ষা থাকবে না। দোষ দেবে আমাকেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে শুকনো পাতার বস্তাটা নীচে রাখি। যদি সে পড়েই তো বস্তার ওপরেই যেন পড়ে। মনে মনে প্রার্থনা করি। পরগাছাগুলো থেকে বেগুনি-সাদাটে ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচে ফেলতে থাকে ফুলকুমারী। আমি কুড়িয়ে এক জায়গায় রাখি। ফুল তোলা শেষ হলে সে সন্তর্পণে নেমে আসে। ওর গাছে ওঠার দক্ষতা দেখে অবাক হই। বলি,
: তোর মা বকবে না?
: না।
: কী ভালো! আমার মা গাছে উঠতে দ্যায় না। বলে ঠাং ভেঙে যাবে।
ফুলকুমারী হাসে। ফুলগুলো ভাগ করে দুজনে নিই। দুজন দুজনকে ফুল দিই। সুর করে দুজনে বলি,
: সই রি সই, দুধের কড়ি কই?
ফুলকুমারী: আজ দিব না, কাল দিব না। দিব দু’দিন বৈ।
এবারে ও প্রথম লাইন। আমি দ্বিতীয় লাইন। বলি আর পরস্পরকে একটা করে ফুলের ডাটি দিই। যতক্ষণ ওর সব ফুল আমার কাছে আর আমার সব ফুল ওর কাছে চলে না যায় ছড়া কাটি দুজনে।
: এবার চ। না হলে আমার পিঠে পড়বে। তোর বাপের নাম কী রে?
ফুলকুমারী: আইনুদ্দি। আমার দাদোর মিস্টির দুকান আছে।
: ও! কদমতলার কাছে তোদের বাড়ি। লায়?
ফুলকুমারী: হ্যাঁ।
আ: তালে বেশি দূর না। তোখে থুয়ে আসবো।
ফুলকুমারী আস্বস্ত হয়। ওর এক হাতে ফুলের গুচ্ছ, অন্য হাতে আমার ঝাঁটা। আমাদের বাড়ি চিনিয়ে দিই ওকে। মা, দাদি, ফুপুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ছোট বোনদের সঙ্গেও। উত্তেজনায় সবাইকে বলি ওর সঙ্গে আমার সই পাতানোর গল্প। গাছে ওঠার ব্যাপারটা চেপে যাই। ফুল প্রাপ্তির একটা বানানো গল্প বলি। ওর দাদোকে সবাই চিনতে পারে। ফুপু আমার পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে। এর তার নানান উপকার ক’রে চাল, গম, আরো কত কী নিয়ে আসে। গ্রামের সবাইকে চেনে। মায়ের সম্মতি নিয়ে ওকে রেখে আসি।
সেদিন থেকে দাদি, ফুপু আর মায়ের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করি।
: দুধের কড়ি কী দিব বল না? বুলছনা ক্যানে?
দাদি আর ফুপু ক্ষীর বানিয়ে সইকে ডেকে খাওয়াতে বলে। মা ‘দেখছি’ বলে নিজের কাজ করতে থাকে। বাড়িতে ক্ষীর হওয়ার উত্তেজনায় আমি অস্থির। কিন্তু স্পষ্ট দেখলাম ক্ষীর রান্নার কথা হতেই সবার মুখেই কেমন কেমন একটা ভাব। দুধ, গন্ধ চাল নেই। খেজুর গুড় হবে যদিও। একটা খেজুর গাছ বাড়িতে আছে। কিন্তু গাছি চাচা এখনো আসেনি। চাচা এসে গাছ চেঁছে হাঁড়ি ঝোলাবে তবে রস হবে। জ্বাল দিয়ে গুড়। অনেক দেরি। সেসব তোয়াক্কা না করে সই পাতানোর আনন্দে সারাদিন কাটে। মাটির পুতুলের সংসার বের করে তাদের জামাকাপড় পরাতে পরাতে সইয়ের পুতুলের সঙ্গে আমার পুতুলের বিয়ে দেব ঠিক করি। বিকেলে দেখি সই আর ওর দাদি এসে হাজির। সঙ্গে ছোট মাটির হাড়িতে রসগোল্লা। আমি আর সই লাফাতে লাফাতে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি। কদিন পর মা দুটো হাত খানেক লম্বা কাঠের পুতুল বানাতে শুরু করে। একটা আমার, একটা সইয়ের। রোজ মায়ের কাছে বসে বসে তাদের গড়ে ওঠা দেখি। মা ধারালো ছুরি ও হেসে দিয়ে কাঠ কুঁরে কুঁরে কাঠের গায়ে পুতুলের আকার দিতে থাকে। দুটোই মেয়ে পুতুল। কদিন পরে বানানো শেষ হতেই মায়ের ছেঁড়া শাড়ির টুকরো দিয়ে শাড়ি পরিয়ে একটা পুতুল সইকে দিয়ে আসি। সে দারুণ খুশি। কিন্তু মেজ বোন মেনে নিতে পারে না। আমার পুতুলটা বোনকে দিই।
সই ভিন পাড়ার। ওর সঙ্গে খেলা হয় না। নিজের পাড়ায় আমার খেলার সাথী আছে। সইয়েরও তাই। কদিন পর সই আমাদের প্রাইমারি ইশকুলে পড়তে এল। আমার ক্লাসে। অনেকটা সময় একসঙ্গে। প্রতি বছর নতুন ক্লাস। ইশকুলটা পাশের গ্রাম ভগীরথপুরের বাবু পাড়ার প্রান্তে। আমাদের গ্রাম থেকে অনেকটা হেঁটে, রাস্তার দুদিকে দুটো বড় আমবাগান পেরিয়ে, কয়েকটা বাড়ির পর বাম দিকে হাই ইশকুল পার হয়ে আরো কিছুটা গিয়ে ইশকুল। ইশকুলের সামনেও আমবাগান। ইশকুলে সব ক্লাসের আলাদা ঘর না থাকায় মাঝে মাঝে আমবাগানে ক্লাস হয়। সহজ পাঠের ছবি আর কবিতাগুলো আমাকে আঁকড়ে ধরে। সইও পড়ে। ছড়াগুলো মুখস্থ। দুষ্টুমিও করে। ছেলেগুলোকেও পেটায় সে। আর মাস্টারের কঞ্চি খায়। কিন্তু মাস্টারের মুখের ওপর কথা বলার সাহস কারো নেই।
হাই ইশকুলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মেয়েদের দেখি স্কুলে ঢুকতে আর অধৈর্য হয়ে ভাবি কবে ওদের মতো বড় হয়ে হাই ইশকুলে পড়বো। ইশকুলে যাওয়ার সময় পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে দঙ্গল বেঁধে গেলেও ফেরার সময় সইও থাকতো। কোনো বাড়ির ভেতর পেয়ারা বা ডালিম ধরলে রক্ষা নেই। স্কুলের ছেলেগুলোর সঙ্গে চুপি চুপি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গাছে উঠে ঠিক চুরি করবে সই। তার ভাগ পাবো আমিও। কোনোদিন গাছের মালিকরা টের পেয়ে গেল তো হয়েছে। সবাই মিলে দঙ্গল বেঁধে দৌড়তে থাকি। রাস্তায় নয়। এঁকেবেঁকে এর বাড়ির পিছন দিয়ে, ধান খেতের ভেতর দিয়ে, গাছের আড়ালে আড়ালে। চিনে ফেললে মজা নেই। সেজন্যই দৌড়ানো। নাহলে চাইলেই দিত। তখনো পর্যন্ত কারো গাছে ফল ধরা মানে ভাগ সবার। কাঁচা রাস্তায় মাঝে মাঝে মোটর বাইক যায়, সরকারি গাড়ি যায়। আর সবসময় গরুর গাড়ি। ধুলো হয় খুব। কোনোদিন মূল রাস্তার ধারের ধুলো মাখা বৈচির জঙ্গলে ঢুকে ফল খাওয়া। কোনোদিন মূল রাস্তা ত্যাগ করে ইশকুলের সামনের আমবাগান ধরে হাসপাতাল চত্বর পার হয়ে কৃষি খেতের আলের মধ্যে ঝোপ কুলের জঙ্গলে পাকা শেয়ালি-কুল ফ্রকের কোছা ভর্তি করে, গায়ে কাঁটার আঁচড় খেয়ে গ্রামের আমবাগানের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যে যার বাড়ি ফেরা। কোনোদিন ধুলোর মধ্যে কিতকিত, নুনদাড়ি এবং আরো আমাদের গ্রাম্য খেলা শেষ করে ধুলো মেখে বাড়িতে বকুনি খাওয়া। কোনোদিন বৃক্ষে জড়িয়ে থাকা দারুণ রঙওয়ালা একগাদা মাকাল ফল তুলে রাস্তায় ছুঁড়ে ভাঙতে ভাঙতে, ছড়া বলতে বলতে বাড়ির দিকে রওনা, ‘মাকাল ফল দেখতে ভালো/ উপর ভালো ভিতর কালো’। কোনোদিন ছাগল গুঁটির ফল তুলে চুলের মধ্যে ক্লিপের মতো আঁটকে প্রসাধন করা। কোনোদিন বকুল ফুল কুড়িয়ে এনে গেঁথে গেঁথে মাস্টার মশায়ের চেয়ার সাজানো আর একটা মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়া। বর্ষায় বৃষ্টি ভেজা এড়াতে কচু পাতা মাথায় ইশকুল যাওয়া। পাকা আঁশ শ্যাওড়ার ফল খাওয়া তো আছেই। এভাবে সহপাঠী ও সইয়ের সঙ্গে সময় কেটে যেতে যেতে ক্লাস ফোর। সই এর বিষয়ে আপ্লুত হয়ে থাকাও অনেকটা কমে এসেছে। পরস্পরের বাড়ি যাওয়াও। হঠাৎ করেই কদিন ধরে সই ইশকুলে আসছে না। ভাবছি এতদিন তো কামাই করে না। মনে হল অসুখ করেছে। পরের দিন খোঁজ নিতে যাই। ওদের বাড়িতে ঢুকে সইকে দেখি না কোথাও। ওর ভাইবোনগুলোও নেই। বাইরে কোথাও খেলছে হয়তো। সইয়ের দাদিকে দেখি। খেজুর পাতার পাটি বুনছে।
: দাদি, সই কুথায়?
: তোর সইয়ের বিহে। দাদো আর বাপ গেলছে বিহে দিতে।
: কুন গাঁয়ে?
: আমি চিন্হি? বাংলাদ্যাশের কুন গায়ে।
: ও!
মন খারাপ করে ফিরে আসি। এত দূর! এই গ্রামের ছেলেমেয়েদের আশেপাশের গ্রামেই বিয়ে হয়। কেন যে এত দূরে সইয়ের বিয়ে দিতে গেল কে জানে। বাড়িতে এসে বললাম। সবাই বললো আমার বিয়ে হলে আমিও দূরে কোথাও চলে যাবো। বোনেরা হাসে। আমার মন খারাপ হয় আরো।
শীত পড়েছে। নরম রোদ। ইশকুলে যাই। ছুটি। এক সপ্তাহ বন্ধ। আমরা খুশি। ‘মাস্টার মশাই ছুটি/ গরম গরম রুটি’ সুর করে বলতে বলতে বাড়ি ফেরার রাস্তায়। কাল রাতে নাকি বাবু পাড়ার জমিদার বাড়ির টিভির খবরে বলেছে ইন্দিরা গাঁধি গুলি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। এদিক ওদিক খানিকক্ষণ খেলাধুলা করে বাড়ি ফিরি। গ্রামের কদমতলায় জটলা। রেডিও বাজছে। খুব জোরে। সবাই চুপ। সাইকেলে বা হেঁটে যেতে যেতে অনেকেই থমকে দাঁড়িয়েছে। আমরাও। ইন্দিরা গাঁধি নাকি মরেই গেছে। দুজন বডি গার্ড নাকি গুলি করেছে। দেশের অবস্থা ভালো না। সবাই বলছে দাঙ্গা লাগবে। কেউ গ্রাম ছেড়ে বের হতে চাইছে না। ইশকুল, অফিস, কাজকর্ম সব বন্ধ। দাঙ্গা আবার কী? বুঝতে পারছি না। কিন্তু লোকের শুকনো মুখ আর কথাবার্তা শুনে বুঝি একটা ভয়ঙ্কর কিছু হবে। পরশু নাকি দাহ। দিল্লিতে। ভগীরথপুরের জমিদার বাড়ির টিভিতে দেখা যাবে। খবর রটে যায়। টিভি কেমন করে দেখে? কেউ বলতে পারে না। নিজে নিজেই ভেবে নিই লাইন দিয়ে একজন একজন করে কোনো যন্ত্রে চোখ রাখলে একেবারে সবকিছু সত্যি সত্যি দেখা যাবে, যেরকম চোখের সামনে দেখি। নির্দিষ্ট দিনে দাদি ছাড়া বাড়ির সবাই জমিদার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। রাস্তায় লোক গিজগিজ করছে। ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, বুড়ি, বাচ্চা। সবাই জমিদার বাড়ির দিকে হাঁটছে। আব্বার পরিচিত একটা বাড়ির ছাদে উঠি আমরা। দেখি জমিদার বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। সকাল থেকেই লোকে নাওয়া খাওয়া কাজ ভুলে ভীড় জমিয়েছে। নীচে জায়গা না পেয়ে দেয়ালে, ছাদে, গাছে, জানলায় যে যেখানে সুবিধা পেয়েছে ঝুলে পড়েছে। চৌকো মতো বাক্স। লোকজনের নাগালের বাইরে অনেক উঁচুতে রাখা। মাঝখানের অংশটা সাদা। চারপাশে কাঠের মতো রঙ। দুটো গোল মোটা কালো নব। লম্বা তার টেনে ওটার সঙ্গে জোড়া হচ্ছে। সবার চোখ বাক্সটার দিকে। নীচে হইচই ধাক্কাধাক্কি চলছে সমানে। অনেক চেষ্টার পর বাক্সটার সাদা অংশটায় ঝিকিমিকি সাদাকালো জলের ওপর আলো পড়লে যেরকম হয় খানিকটা সেরকম দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। আরো কিছুক্ষণ পর প্রথমে ঝিরিঝিরি শুধু। ঢেউ এর মতো। পরে সাদা কালো ছবি ভেসে উঠলো। স্টুডিয়োতে ছবি তুললে যেরকম হয়। কিন্তু লোকজন হেঁটে বেড়াচ্ছে। কথা বলছে। কত লোক এতটুকু বাক্সটায়! উপস্থিত জনতা হঠাৎ নিঃশব্দ। পিন পড়লেও যেন শোনা যাবে। ইন্দিরা গাঁধির শব। ফুলে ঢাকা। আব্বা চিনিয়ে দেয় রাজীব গাঁধিকে। হাতে জ্বলন্ত একটা লম্বা কাঠ। লোকজন আবার হইচই করে উঠলো। ওপর দিয়ে তার টানলেও ধাক্কাধাক্কিতে কখন খুলে গেছে। কেউ তার ধরেই ঝুলে পড়েছে বোধ হয়। বাক্সতে আর ছবি নেই। লোকজন দৌড়ল ঠিকঠাক করতে। অনেকক্ষণ পর ছবি চালু হল যখন চিতায় আগুন জ্বলে গেছে। এখানে নীচে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মাথায় ঘোমটা বয়স্ক মহিলা কাঁদছে। সন্ধ্যের মুখে মুখে মিছিলের মতো করে হাঁটতে হাঁটতে লোকজন যে যার গ্রামে ফেরে। কত কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বেশ কিছুদিন। কাটাকাটি মারামারি চলছে নাকি সারা দেশে। এখানেও নাকি শুরু হবে। শেষ পর্যন্ত তেমন কিছুই হয় না। সইয়ের দাদো আর আব্বা গ্রামে ফেরে। সই ফেরে না।
আমি হাই ইশকুলে। আগের মতো খেলার সময় নেই। বোনদের দেখভাল, পড়াশোনা, ইশকুল, মাকে ঘরের কাজে সাহায্য এইসব করতে করতে সারাদিন কেটে যায়। যেদিন ইশকুল বন্ধ থাকে সেদিন পাড়ার সাথীরা দঙ্গল বেঁধে নদীতে স্নান করতে গিয়ে অনেকটা সময় খেলাধুলা করি। নদীর জলে আমাদের কত খেলা। সাঁতার তো আছেই। গরম কালে নদীর প্রস্থ ছোট হয়ে এলে সাঁতরে এপার ওপার করা আছে। কত খেলার কত ছড়াও আছে। ‘পানকৌড়ি পানকৌড়ি ডাঙায় উঠো সা। তুমার শাউড়ি ডাক পাড়েছে বেগুন কুট সা। উ বেগুনডা লিও না লিও না পুক্কা ল্যাগেছে। উ ঘরে যাইও না যাইও না ভাসুর আসেছে। ভাসুরের হাতের পান খ্যায়ে ধ্বক্ লাগেছে। ধ্বক্ ধ্বক্ ধ্বক্ কদমের ফুল ফুট্টে উঠেছে।’ এইসব সুর করে বলি। খেলতে খেলতে বাড়ির কথা ভুলে যাই। শীতকালে জলের নীচে যে সুন্দর উত্তাপ থাকে তা শরীরে নিতে নিতে জল ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না। উঠলেই তো শীতের কাঁপুনি। মা কতদিন দেরি দেখে হাতে পাটকাঠি নিয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি অপরাধ বোধে ভেজা গায়ে মায়ের নাগালের বাইরে দিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়েছি। মাটিতে দ্রুততম ভেজা পায়ের ছাপ। চুল থেকে টপটপ জলকণা। ফসলের খেতের মাঝখানের আল ধরে দৌড়। বাড়ি ঢুকে দাদির কাছে লুকোনো। জানি, দাদি রক্ষাকর্ত্রী। নদী থেকে বাড়ি অব্দি পৌঁছতে পৌঁছতে মার রাগ জল। সেদিন ভয়ে ভয়ে বেশি বেশি বাড়ির কাজ করা। ছোট বোনদের হাতমুখ ধুয়ে ধুলো পরিষ্কার করে চুল আঁচড়ে ঘরে দাদির কাছে বসিয়ে দেওয়া। ছোটটা দাদির কোলে। সারাদিন ধুলো ঘেঁটে হাত পা নোংরা করেছে। সন্ধ্যার আগে হ্যারিকেনের কালিমাখা কাচ মুছে, কেরোসিন ঢেলে সলতের পোড়া আগা ভেঙে অন্ধকারের প্রস্তুতি। নারকেল তেলের ডিব্বা দিয়ে বানানো লম্ফগুলোতেও কেরোসিন ঢেলে সলতে ভাঙা। অন্ধকার নামলেই জ্বালিয়ে যথাস্থানে। বইয়ে বেশি বেশি মনোযোগ। আব্বা ও চাচা তখন পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে বা অন্য কোথাও ছেলেদের সান্ধ্য আড্ডায়। ফুফু হয়তো বটতলা পাড়ায় চিঁড়ে কূটতে গিয়ে তখনো ফেরেনি। কারো বাড়িতে হয়তো কাঁথা সেলাইয়ের বায়না নিতে গেছে। প্রতিদিনের এইসব নানান টুকিটাকিতে সইয়ের কথা সেভাবে আর মনেই থাকে না। একদিন সইয়ের দাদির সঙ্গে দেখা।
: কী গো দাদি, সই কবে আসবে?
: অত দূর দ্যাশ থেকে সইকে লিয়ে আসা সুজা ব্যাপার লয় গো লাতনি। আমরাও যে যাতে পারি ন্যা। ভিছা না কি বুলে ওই কাগজ লাগে। টাকা লাগে।
আমি আর কথা বলি না। সইয়ের অদর্শণ সেভাবে আর পীড়িতও করে না। ওর মুখ ধীরে ধীরে যেন আবছা হতে থাকে। আমাদের গ্রামের পুরুষরা অনেকেই রাজমিস্ত্রি আর জোগাড়ের কাজ করে। দক্ষিণ খাটতে যায়। দক্ষিণ খাটা মানে যে কল্যানী বা কলকাতায় কাজ করতে যাওয়া বড় হয়ে বুঝেছি। ওদের কাছে শহরের গল্প শুনেছি। গ্রামে কাজ না থাকায় একবার আমার আব্বাও গেল দক্ষিণ খাটতে। আব্বার কাছেও শুনলাম কলকাতার কথা। ওখানে নাকি অনেক ইশকুল আর কলেজ। মেয়েদের আলাদা ইশকুল আর কলেজও নাকি আছে। আব্বার কাছে বায়না ধরলাম কলকাতায় পড়তে যাবো। আব্বা ভালো করে পড়াশোনা করে আগে ইশকুল শেষ করতে বললো। ভালো নম্বর না পেলে নাকি কলকাতায় ভর্তি হওয়া যায় না। আমরা চার বোন। আমি জানি, আবার যে কোনো সময় মায়ের পেট ফুলে উঠবে। ভাই চায়। আমাকে সবসময় ফ্রক পরতে হয় এখন। স্তন ফুলে উঠছে। মাঝে মাঝেই স্তনে কী অসহ্য যন্ত্রণা। যন্ত্রণা হয় আর একটু করে বড় হয়। ফ্রকের ওপর দিয়ে এখন বোঝা যাচ্ছে। বিব্রত হই। বই দিয়ে বুক আড়াল করে ইশকুলে যাওয়া আসা করি। হঠাৎ একদিন হিসু করার জায়গা দিয়ে রক্ত। সাঙ্ঘাতিক ভয়। কী হল? পড়ে গিয়ে লাগলো কী? কিন্তু আমি তো এর মধ্যে পড়ে যাইনি। কিছুতে খোঁচা লেগে রক্ত বেরোচ্ছে? মাকে বললেই মারবে। ঠিক আমার দোষ খুঁজে বের করবে। তারপরেও আমার কেমন মনে হয় বিষয়টা গোপনীয়। হিসুর জায়গা গোপন করে রাখতেই তো শিখিয়েছে মা, দাদি, ফুপু। ফুপু বাড়িতে নেই। দাদিকে বলি। চুপিচুপি। দাদি হাসে। দাদির ওপর রেগে উঠি। আমার রক্ত পড়ছে আর দাদি হাসছে। দাদি হাসতে হাসতে মার কাছে যায়। মা রান্নাঘরে। খড়ে ছাওয়া মাটির রান্নাঘর। তারই পিছনে দাদিকে টেনে নিয়ে এসে কথা বলছিলাম। ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। ভয়। মা নির্ঘাত মারবে। কান খাড়া করে শুনি দাদি মাকে বলছে,
: বো, তুমার মেয়ে বড় হয়ে গেল। ন্যাকড়া লিয়ে আসো।
আশ্চর্য! মা কিছু বলে না। উল্টে তাড়াতাড়ি দু টুকরো ন্যাকড়া আর এক বালতি জল নিয়ে আমার কাছে আসে। কদিন আগে এই ন্যাকড়াগুলো গরম জলে সেদ্ধ করছিল মা। মার চোখের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাই। রাগ নেই। তিরস্কার নেই। অবাক কাণ্ড! পেট ব্যাথা করছে। পেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সোজা হতে পারছি না। দড়ি বাঁধা সস্তার ইজের রক্তে ভিজে যাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি। পাটকাঠির বেড়া দিয়ে ঘেরা স্নান করার জায়গায় আমাকে নিয়ে যায় মা। ন্যাকড়াগুলোর সঙ্গে দেখি একটা সাদা ডোর। মা কিছু না বলে ডোরটা আমার কোমরে বেঁধে দেয়। একটা ন্যাকড়া ভাঁজ ক’রে ক’রে চওড়ায় হাতের তালুর সমান ক’রে ফেলে। ভয় কেটে গেছে। মার কাণ্ডকারখানা কেমন রহস্যময় ঠেকছে। বাথরুমের দড়িতে ন্যাকড়াগুলো রেখে আমার আর একটা ইজের নিয়ে আসে। তখন বৈঠকখানায় আব্বা আর তার এক বন্ধু চা মুড়ি খাচ্ছে, গল্প করছে। ফিসফিস করে কথা বলে মা।
: ন্যাকড়ার মাঝখান মুতের স্থানে দিয়ে দুদিক ডোরে আঁটকে দিবি। পড়ে যেন না যায়। কাউকে বুলবি না। সাথীদেরও না। ন্যাকড়াগুলা ভিজে গেলে ধুয়ে ওদিকে মেলে দিবি।
মা আঙুল দিয়ে পায়খানা ঘরের পিছন দিকে ইঙ্গিত করে চলে যায়। মনে পড়ে মাকে দেখেছি লালচে হয়ে যাওয়া ন্যাকড়া ধুয়ে মেলে দিচ্ছে পাটকাঠি পালার আড়ালে বা পায়খানা ঘরের পিছনে জঙ্গলের মধ্যে। ‘মা, কি করছো?’ দেখে ফেলে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা ধমকে বিদায় করেছিল আমাকে। উল্টে এই জঙ্গলে আমি কী করতে এসেছি তাই নিয়ে বকেছিল। প্রশ্নটা আমারও। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। ন্যাকড়াটা পরে নিয়ে রক্তে ভেজা ইজের ধুয়ে দিতে দিতে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকি। এরকম কি সব মেয়েদের হয়? কই, কেউ কোনোদিন বলেনি তো? আমার খেলার সাথীদের হয়েছে? সইয়ের? অনেকদিন পর সইয়ের কথা মনে পড়ে। এক সপ্তাহ ইশকুলে যেতে পারি না। বাড়ির কাজ করতে পারি না। শুয়ে থাকতেও ভয় করে। যদি বিছানা ভিজে যায়। মা চ্যাপ্টা কাচের বোতলে গরম জল ভরে দেয়। তলপেটে চেপে ধরে থাকি। যন্ত্রণা খানিক কমে। মা কেমন সতর্কতার গলায় একদিন বলে, যেখানেই থাকি দিনের আলো থাকতে থাকতে যেন বাড়ি ফিরি। আর যেখানে সেখানে যার তার সঙ্গে যেন বেড়াতে না যাই, খেলতে না যাই। এই নিষেধাজ্ঞা আর রক্তপাতের মর্মোদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে উঠি। দাদি আমাকে বুঝিয়ে দেয় সব, বাড়িতে যখন ছেলেরা থাকে না তখন। সন্ধ্যেবেলা। লম্ফর শিখাটা কেঁপে ওঠে। প্রত্যেক মাসে? ভয়ে গলা শুকায়। এক সপ্তাহ পর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরি। পড়াশোনা করি। বাড়ির কাজও। নদীতে স্নান করতে যাই। আমবাগানে যখন তখন যেতে পারি না। খেলাধুলা বন্ধ। খেলতে যাওয়ার জেদ ধরলে মা ধমকায়। অগত্যা পুতুল খেলি। রান্নাবাড়ি খেলি। পুতুলের বিয়ে দিই। বিয়ের ভোজ হিসেবে দশ পয়সার দশটা লজেন্স নিমন্ত্রিতদের খাওয়াই। ইশকুলে যাই। নতুন ক্লাসে উঠি। মা আর আমাকে মারে না। বকাবকি করতে ছাড়ে না অবশ্য। আমার বোনেরাও বড় হতে থাকে। এই বছরেই ভাই জন্মায়। সবার মুখে হাসি। ভায়ের দারুণ যত্ন ও আদর। আমরা বোনেরাও তাকে কোলছাড়া করি না। ধুলো ঘাঁটতে দিই না। নোংরার মধ্যে হামাগুড়ি দিতে দিই না। দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে ভাইবোনগুলো। আমবাগানে আম ধরে। সবাই আম কুড়োতে যায়। আমি যাই না। ঝড় বৃষ্টি হলে গাছের নীচে আম পড়ে জমে থাকে। লোকেরা ভিজে একসা হয়ে বস্তা বস্তা আম বাড়ি নিয়ে যায়। ওদের কাছে চাইলে অনেক দেয়। ঝড়ের মধ্যে আমাদের কাউকে বাগানে যেতে দেয় না মা। আঁখের গুঁড় দিয়ে আমের চাটনি বানায় মা। নুন দিয়ে বানায় খাট্টা। নুন চিনি দিয়ে আমসেদ্ধ মাখা। ফুপুর সঙ্গে বসে আচারও বানায়। কাঁচের বয়ামে রোদ মাখে মিস্টি আচার, তেল আচার। চটের বস্তার ওপর শুকায় আমচুর। সাদা কাপড়ে রোদ খায় আমসত্ব। বোনেরাও বড় হয়। ভাইও। বাড়িতে রোজ রোজ ভালো খাবার হয় না। হলে গোটা ডিম ভায়ের। আমরা বোনেরা ভেঙে ভাগ করে খাই। সবাইকে খাইয়ে মা খেতে বসে। পাতে শুধু ঝোল আর দু’টুকরো আলু। একসঙ্গে খেলে মাকে আমি বা মেজ বোন নিজের ভাগের ডিমের টুকরো দিই। নিতে চায় না, জোর করে মুখে ঢুকিয়ে দিই।
আমি এখন ক্লাস নাইন। মেজ বোনটিও হাই ইশকুলে। আমার জন্য গঞ্জের দোকান থেকে আব্বা কিনে এনেছে নীল ব্লাউজ, নীল পাড় শাড়ি, সাদা পেটিকোট। প্রবল উত্তেজনা। প্রথম শাড়ি পরবো। আব্বার অনেক টাকা খরচ হয়েছে বলে মন খারাপকেও পাত্তা দিচ্ছি না। শাড়ি দেখতে গিয়ে দেখি ব্রা নেই। আব্বা ব্রা এর কথা ভাবেইনি। মাকে বলি। মা বলে আব্বাকে। আমার প্রথম ব্রা আসে। গেঞ্জি ব্রা। টেপ ফ্রকের মতোই। কিন্তু ছোট। ইলাস্টিক আছে বলে গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকবে। দিদিগুলোকে দেখেছি। এরকমই পরে। শাড়িতে স্বচ্ছন্দ হই ক্রমশ। আর ছেলেদের বিষয়ে রহস্যময় শিহরণে অস্থির। মাধ্যমিক পরীক্ষা এগিয়ে আসে। শাড়ির উত্তেজনা কমে। পড়া আর পড়া। মাধ্যমিক টপকাই। টেনেটুনে প্রথম বিভাগ। বিয়ের জন্য ঘটক আসতে শুরু করে। আব্বা বলে,
: ছেলে ভালো।
মা বলে,
: না।
দাদি বলে,
: সোমত্ত মেয়ে ঘরে রাখতে নাই।
তালাক প্রাপ্ত ফুপু বলে,
: যদি আমার মুতন হয়ে যায়?
ছেলেগুলোর দাবী পূরণ করার অর্থ নেই আব্বার ব’লে শেষমেশ মা জিতে যায়। আমি উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিই। কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়ার জেদ ধরি। আগে থেকেই আব্বাকে শুনিয়ে রাখি। আব্বা চুপ। মা বেঁকে বসে,
: এতদূরে চলে যাবি!
: এখানে যে ভালো কলেজ নাই মা।
দেখতে দেখতে আবার হেমন্তের দিন। পাতা ঝরা শুরু। কৃষি খেত হলুদ হয়ে উঠবে শীতকালে। খেতজুড়ে তারই প্রস্তুতি। সর্ষে চারা বেরোচ্ছে মাঠে মাঠে। বাগানের ভেতর দিয়ে ইশকুলে যেতে ইচ্ছে হয় আমার। কতদিন আম বাগানে যাই না। শুকনো পাতা কুড়োতে আসি না। এখন আমার ছোট বোনেরা আসে। আমি শাড়ি পরে, সাইড ব্যাগে বইপত্র নিয়ে বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটি। সারা বাগান জুড়ে হলুদ পাতা ধীর লয়ে ঝরে পড়ছে। ঘাসগুলো গজিয়েছে আবার। দূরে দূরে রাখালরা গরু ছেড়ে দিয়ে গাছের নীচে খেলছে। মহিলা ও বাচ্চা মেয়েরা নারকেল কাঠির ঝাঁটা দিয়ে শুকনো পাতা কুড়োচ্ছে। ধুলোয় ভরে গেছে রাস্তা। পরগাছাগুলোতে ফুল। বাগানের এক কোণ দিয়ে যেখানে রাস্তাটা চলে গেছে সেখানে কয়েকটি অবয়ব। অস্পষ্ট। বিরামহীন পাতা ঝরছে। মাটিতে পড়ে অদ্ভুত মৃদু শব্দ। অবয়বগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। ধুলোর ভেতর দিয়ে পেটফোলা মহিলা। কোলে বাচ্চা। বাঁ হাতে আরেকটি বাচ্চার হাত ধরা। ডানদিকে হাঁটছে অপেক্ষাকৃত বড় বাচ্চাটা। তার মাথায় ছোট পোঁটলা। বাচ্চা তিনজন ছেঁড়া নয় কিন্তু পুরোনো ফ্রক পরে। পিছনে গোঁফওয়ালা লোক। কানের দুপাশের চুল পাকা। মাথায় রঙিন নকশা করা টিনের ছোট বাক্স। বাক্সর ওপর একটা পোঁটলা লুঙির কাপড় দিয়ে বাঁধা। ডান হাত দিয়ে বাক্সটা ব্যালান্স করেছে। বাঁ হাতে একটা কাপড়ের থলে। পাতা ঝরছে। পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ঠিক চিনেছি। ফুলকুমারী। আমার সই। কালচে, রোগা। গালের হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। ওকে তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতে চাই।
: শুনছো? কদমতলা কুনদিক দিয়ে যাব?
রাস্তা বলে দিই। আমাকে চিনতে পারেনি। রাস্তাও ভুলেছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। সেই ছোটবেলায় শেষ দেখা। আমিও পাল্টে গেছি বুঝতে পারি।
অজস্র আম পাতা গায়ে এসে পড়ে। হাঁটতে গিয়েও পা চলে না। কী এক বেদনা জড়িয়ে ধরে। পায়ের নীচে হলুদ আম পাতার স্তূপে তলিয়ে যেতে থাকি।
লেখক পরিচিতি
কবি, গল্পকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক
জন্ম: ৭ আগস্ট, ১৯৭৭, মুর্শিদাবাদে
জন্ম: ৭ আগস্ট, ১৯৭৭, মুর্শিদাবাদে
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইন্দো-ইতালীয় ফিল্ম স্কুল রূপকলা কেন্দ্র থেকে পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন চলচ্চিত্র পরিচালনা বিষয়ে।
প্রকাশিতব্য বই: একাকী কয়েকটি জীবন ও অন্যান্য (গল্পগ্রন্থ, ২০১৭), এবং আমার চুলগুলি ফণা তুলছে (কবিতা, ২০১৭)
পরিচালিত চলচ্চিত্র: কবি (তথ্যচিত্র, ২০০৪), সবুজের অভিযান (তথ্যচিত্র, ২০০৫), শবনম (ফিকশন, ২০০৪), মহারাণী কাশেশ্বরী কলেজ (তথ্যচিত্র, ২০০৫), আবাদ (ডকু-ফিকশন, ২০০৭), আইনী পরিষেবা (ডকু-ফিকশন, ২০১১), অসংগঠিত শ্রমিক (সমাজসচেতনামূলক বিজ্ঞাপনচিত্র, ২০১১) ইত্যাদি।
সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ সহ অনেক প্রোথিতযশা পরিচালকের সঙ্গে। চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে লেখেন কলকাতার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনে।
0 মন্তব্যসমূহ