সুমী সিকানদার'এর গল্প : চৌকি

এক সময় মনে হতো যিনি চৌকিতে বসে আরাম আয়েশ করেন তিনিই চৌকিদার ।চৌকির সাথে পাহারার কি সম্পর্ক তা অনুধাবন করা বাড়ির শিশুদের কাজ ছিলো না। আমারও না। 

তো চৈকিখানা উঠোনের মাঝখানে পেয়ারা গাছেরতলায় আরামসে গেঁড়ে বসে থাকতো। মাঝে মাঝে তাকে রোদে আনা হতো। বাড়ির কিশোরী কন্যাটি গোসল সেরে ভেজা চুল রোদের দিকে মেলে দিয়ে বসতো চৌকিতে। শুয়ে বসে চলতো গল্পের বই পড়া। রাশান অনুবাদের বই, রুশ দেশের উপকথা। ছবিতে ছবিতে সেই সব বই সয়লাব। অঙ্ক করতে হলে অবশ্য ভেতরবাড়ি থেকে বেতের চেয়ার টেবিল চলে আসতো। বেতের টেবিল চেয়ারে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে অংক পারুক আর না পারুক পা দুলাতে অসীম আনন্দ। 

পেয়ারাগাছটা পেল্লায় দেখতে, প্রায় অর্ধেক উঠান জুড়ে সে থাকতো। স্বভাবে আরাম কেদারা টাইপ । এ ডালে ও ডালে হেলে অনেকটা মাটিকে ছুঁয়ে বড় হয়েছে, ফলে বাড়ি বাচ্চারা তো বটেই পাড়ার ছেলে মেয়েরা খেলতে এলেও পেয়ারা গাছে এক বেলা হেসে খেলে পেয়ারা পেড়ে ঝাললবন সমেত খেয়ে তবে বাড়ি ফিরতো। খুবমন খারাপ হলেও প্রকান্ড গাছটা কিশোরীর প্রিয় বন্ধু। কোথায় যে পাতার আড়ালে তাকে লুকিয়ে রাখতো বড়রা ডাকতে এলে কোনমতেই খুঁজে পেত না।দড়ির দোলনা টাঙ্গানো ছিলো শক্ত ডালে। দুলে দুলে চলে যাওয়া সময়কে ভাবলেও মনে দলা জেগে ওঠে। 

উঠোনের চার ধারে বাস্তভিটা অনুযায়ী চারটা নারকেল গাছ । সেই নারকেলগুলো সবুজ থেকে মরচে রঙ হতে না হতেই দক্ষ লোক গাছে তুলে দিয়ে নারকেল পাড়ানো হতো। কিভবে তারা লুঙ্গিটাকে কোমরকাছা করে নারকেল গাছে উঠত এবং এতটুকু কাপড় আলগা না করেই ফের গাছের গা বেয়ে বেয়ে নেমে আসতো সেটাও ছিলো এক দেখার বিষয়। 

সকালের রোদ তেতে যাবার আগেই বড়ির শিশু কন্যাটিকে রোদে তেল মেখে ফেলে রাখা হত। রোদ খাওয়ানো হলে গায়ের রঙ আচ্ছা রকম পুড়ে তামা হয়ে গেলে পরে তাকে স্নান করিয়ে ফের চৌকিতে বসানো হতো। তখন এই শিশুর চতূর্দিকে তিনচার খানা পেলব নরম বালিশ দেয়া হতো যতে সে পড়ে না যায়। 

কিশোরীর কন্যাকে পুঁচকেটার গুরুদায়িত্ব দিয়ে মা মাসিরা রান্নার যোগাড়ে চলে যেতেন ।দায়িত্ব পালনে শিশুরা বড়দের চাইতে যে কোন অংশেই কম নয় তা সময়মত ঠিক বোঝা যায়। 

কিশোরীটি ঘাড় শক্ত করে অপলক চোখে কয়েকমাস বয়েসি চাচাতো বোনের রক্ষনাবেক্ষনে তাকিয়ে থাকতো। বোন যেন কোনভাবেই পড়ে ব্যাথা না পায়। 

বিকেলের দিকে নানাজানের বন্ধু বান্ধব এসে চৌকির ইজ্জত বাড়ালেন। সন্ধ্যা অব্দি রাজনৈতিক আলাপ এবং তাস চলতো। চৌকির কারণে তাদেরকে আর বেতের চেয়ারে বসতে হতো না। তাস ছাড়াও জুয়া চলতো দানে দানে। টাকার জুয়া। নানীজানের ভালো না লাগলেও তিনি মুখ বুজে রান্না করতেন দফায় দফায়। 


নানীজান বৃষ্টি আসার আগে কাপড় তুলতে যত না তাড়া দিতেন চৌকি তুলতে আর বেশি। চৌকি ভিজে গেলে নরম হয়ে ভেঙ্গে যাবে। কেউ না কেউ ধরাধরি করে বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ার আগেই চৌকিটাকে বারান্দায় নিয়ে আসতো। 

তাতে আমাদের গুড়াগারা গুলোর মজা খানিক বাড়তো। বারাব্দায় চৌকি ফেলে রেখেছে । এখন লাফানো যাচ্ছে। আম্মা কেন যেন ‘ এই কেউ এখানে খবরদার লাফালাফি করবেনা’ বলে হাঁক দিয়েই ফের কাজে ডুবে যাচ্ছেন। যতবার তিনি লাফাতে দেখছেন ততো বার একই কন্ঠে এই নিষেধ চলছে। কেউ শুনছে কি শুনছে না আম্মা খেয়াল করছেন না। 

নানীজানের শরীর ভালো না তার ওপরে মাথায় এক চিন্তা। কি ,আজ নাকি চৌকিটা কে উঠোনেই ফেলে রাখা হয়েছে।কেউ তাকে মনে করে তোলেনি? নানীজানের পা ভাঙ্গা উনি নিজে পারছেন না, ক্রমাগত বক বক করতে থাকলেন। বাড়ির বউ-ঝিরা তার কথায় পাত্তাই দিলো না। বাড়ির বড়ছেলে সকালে অফিস এই কৈফিয়তে ঘুমাতে গেলো। কিশোরী মেয়েটা ঘুমাতে গেল, ঢক ঢক পানি খেয়ে নিলো ঘুমানোর আগে। ছোট বাচ্চাটা পেট ব্যাথায় কি না জানি না প্রচুর কাঁদছে। এত কিছু নানীজান কে আজ স্পর্শ করছে না। অন্য সময় হলে তিনি নিজেই পেটে তেল মেখে মেখে বাচ্চার কান্না থামিয়ে দিতেন। 

নানীজানের প্রেসার বাড়ছে । রাত বাড়ছে তর তর। রাতের মেঘ কেমন রহস্যময়। কোথায় উড়ে যেতে চায় কাউকে বলতে চায় না। নানীজানের মনে দুশ্চিন্তা বাড়ছেই । কেন এখনও চৌকিটা কে ঘরে নেয়া হচ্ছে না। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গাছের পাতাদের চুপচাপ বৃষ্টিতে ভেজাই নিয়ম । তারা অনেক বাতাসের সাথী হয়ে পাতা নেড়ে নেড়ে খেলে কিন্তু নড়াচড়া করতে পারে না। 

বেচারা চৌকি সারারাত উঠোনে পড়ে রইল। কেউ তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এলো না। 

একা দাঁড়িয়ে থাকা চৌকির দিকে ভোর বেলা নানীজান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন। ওজু করে তসবীহ নিয়ে চৌকিতে বসেন । নিবিষ্ট তসবীহ তার চারপাশকে একান্তে অনুগত করে রাখে। মৃদু স্বরে তিনি পাঠ করছেন নিয়মিত পারা। 

আকাশ ফর্সা হবার সাথে সাথে তসবীহ তার রঙ বদলে ফেলেছে । ধুপ ছায়া রঙ একা এক রঙ ধারণ করতে জানে না। তাতে কয়েক প্রকার রঙ কথা বলে।

নানীর রঙ ছিলো ডালিমবরণ । বেলা বাড়তেই সে রঙ মলিন হয়ে আসে। নানীজান চৌকির মাঝ বরাবর এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন। সবাই ঘুম ভেঙ্গে এই প্রবীণাকে চৌকিতে একা শুয়ে থাকতে দেখে হাঁক ডাক শুরু করেন। কেউ দুধ বানিয়ে আনেন , কেউ চোখে মুখে পানি ছিটাতে থাকেন। আম্মা ... আম্মা... 

মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিবাহ জনিত কারণে এক মিশমিশে কালো সাংবাদিকের বাহুলগ্না হয়ে এই বাড়িতে আসা অব্দি সত্তরটা শীতবসন্ত কাটানো প্রাণবন্ত ডালিমকন্যার আজ সাড়া নেই । 

অল্প সময়ের মধ্যেই নানীজানকে নিয়ে অনেক লোকজনের কতাবার্তা চললো। তিনি কোথায় শেষবারের মত শয্যা গ্রহন করবেন তা নিয়েই তর্ক। মাটিতেই যখন আস্থা তখন যেকোন মাটিকেই আপন দেহ রাখা যায়। সবমাটির গায়েই মাটি গন্ধ । মুঠো ভর্তি করে মাটি স্পর্শ করে নানীজানের জন্য হঠাৎ আকুল কান্না আসে । ছোটবোন কে কোলে নিয়ে কিশোরী ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। নানী তার মাথায় বিলি কেটে কেটে তেল দিয়ে দিতেন। গোল গোল লোকমার বউ বানিয়ে ভাত খাইয়ে দিতেন। আম্মা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসলে দৌড়ে নানীজানের আঁচলের নাগাল পেলেই আর কোন বিপদ আসতে পারতো না। নানীজান কেন আজ এত ভোরে চৌকিতে শুতে আসলেন। এখন কে তাকে নারকেলের পাতা কেটে চশমা আর ঘড়ি বানিয়ে দেবে। কান্নায় বুক কাঁপছে তার। 

বাড়ীর মহিলারা চাপা স্বরে কাঁদছে আর কোরানের পাতায় পাতায় চোখের জলের অক্ষয় দাগ ফেলে যাচ্ছে। আজ যিনি বিদায় নিলেন তার জন্য তাদের আজ সমবেত পাঠ।

বরই পাতা জলে স্নান করানোর পর নানীজান কে প্রথমবারের মত মাথায় নিয়ে পায়ে চলা স্বজনের কাঁধে অন্য এক চৌকি চললো। । সাধের কাঠের ক্ষয়ে আসা চৌকি বয়স্ক উঠোনের ছায়ায় চার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। এই বাড়িতে এই চৌকিটাকে নানীজানই কিনে এনেছিলেন , কবে যেন মনে নেই।, নানীজানকে জিজ্ঞেস করে আসি।। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা, পাঠককে মূর্হুতেই ঘটনার সাথে জাঁকড়ে ফেলে। সুমী সিকান্দারের অন্যান্য লেখার মতই হৃদয় ছোঁয়া।

    উত্তরমুছুন
  2. ছবির মত সুন্দর। খুব ভালো লাগল

    উত্তরমুছুন